এক ফালি প্রণয় পর্ব-২৮+২৯

0
3

#এক_ফালি_প্রণয়|২৮|
শার্লিন_হাসান

আলতাফ পারভেজ চৌধুরী সিঁড়ি বেয়ে উঠতে যাবে তখন ফারিহা চিৎকার করে বলে, “শুনেছো? আদ্রিশের বিয়ে এই সপ্তাহে।”

“আলহামদুলিল্লাহ! পাত্রীটা কে?”

“আগে যাকে ফিক্সড করা ছিলো সেই।”

“তাহসিনা?”

“হ্যাঁ! তুমি বলো বিয়েটা হলে ভালো হয়না?”

“হলে ভালো হয় তবে না হলে আরো বেশী ভালো হয়।”

দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলে আলতাফ পারভেজ চৌধুরী। আদ্রিশ সেসব আমলে নেয়নি। আগামী কালকে শিকদার বাড়ীতে বিয়ের প্রস্তাব যাবে।

মা ছেলে মিলে বিয়ের যত পরিকল্পনা আছে সব করছে।৷

পরের দিন সকালে আদ্রিশ একটু খান বাড়ীর দিকে যায়। শিকদার বাড়ীতে বলে রেখেছে রাতে তারা যাবে। খান বাড়ীতে আসতে, রাত্রি আদ্রিশকে দেখে বেশ অবাক হয়। পাঁচটা বছর পর আদ্রিশের দেখা। ব্রু জোড়া প্রসারিত করে তাকায় রাত্রি। রাত্রিকে উপেক্ষা করে আদ্রিশ ভেতরে গিয়ে চিৎকার করে রাফিকে ডাকে। ততক্ষণে রাফি নিচের দিকে আসে। আদ্রিশ রাফির সোজাসুজি দাঁড়িয়ে তার বাহুতে হাত রেখে বলে, “আরে শালা বাবু! আজকাল দেখি মানুষ মারার পেছনে বেশ দৌড়াচ্ছো।”

“মান নে?”

“মানেটা ইজি! সময় হলে বুঝবে।”

তখন আবার রুশা আসে নিচে। আদ্রিশকে দেখে রুশা হেঁসে বলে, ” আরে জিজু কেমন আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি?”

হেঁসে জবাব দেয় আদ্রিশ। রাত্রি, আদ্রিশ আর রুশার ভাব দেখে জ্বলছে। তার মেয়েটা ও কীভাবে জেনো আদ্রিশ কে সহ্য করছে। তখন রাত্রি বলে, ” তা নতুন কোন খবর নিয়ে এসেছো?”

“কেন এই বাড়ীতে আসাটা কী নিষিদ্ধ নাকী?”

“তাহাফ খান এসব পছন্দ করে না।”

“বাড়ীটা বুঝি তাহাফ চৌধুরীর?”

“সে যারই হোক!”

“সে যারই হোক! পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ সে যার লজ্জা নেই।”

“আদ্রিশ চৌধুরী ডোন্ট ক্রস ইওর লিমিট।”

“আমার শ্বশুরের বাড়ীতে থাকেন আবার তার মেয়ের হবু বরের সাথে উঁচু গলায় কথা বলছেন।”

“তাহসিনাকে আমি দেখে নেবো।”

“চুপ থাকবে তুমিি?”

মাঝাখানে রুশা কথাটা বলে। রাত্রি তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায়। জেনো মেয়েকে চোখের রাগের আগুনে বর্ষ করে দিবে। রুশা সেসব আমলে নেয়নি। রাফি সোফায় বসে কপাল স্লাইড করছে। আদ্রিশ তখন বলে, “আমার বউ যদি চায় তো আপনারা এই বাড়ীতে থাকবেন। আর না চায় তাহলে সোজা ব্যাগ গুটিয়ে নিবেন।”

তখন রাত্রি জবাব দেয়,
“তুমি এসব বলার কে?”

“বাড়ীটা আমার বউয়ের তো আমি আমার দায়িত্ব পালন করবো না?”

“বিয়ে করেছো?”

“হ্যাঁ!”

“কবে?”

“আমি ফ্রিতে কাউকে কিছু বলিনা।”

কথাটা বলো আদ্রিশ রাফির দিকে তাকায়। স্মাইল দিয়ে বলে, “নকল হাশরের ময়দানে যাওয়ার জন্য রেডি হও শালাবাবু।”

রাফি রেগে বলে, “আদ্রিশ চৌধুরী আমাদের এভাবে না শাসিয়ে নিজের বাবাকে শাসাও কাজে দিবে। তোমার বাবাই তো আসল খু’নি আমার চাচ্চু আর চাচ্চির।”

মূহুর্তে মাথায় আগুন ধরে যায় আদ্রিশের। সে তার বাবার প্রতি রেগে আছে ঠিক তবে উল্টাপাল্টা কিছু সহ্য করতে পারবে না। রাফির দিকে তাকিয়ে তেজী স্বরে বলে, “আমার বাবার নামে আর একটা বা’জে কথা বললে এখনি তোর খুলিটা উড়িয়ে দেব।”

“মানো আর না মানো এটাই সত্যি।”

আদ্রিয় জবাব দেয়না। রুশার থেকে বিদায় নিয়ে সে একটা লেকের কাছে যায়। তার বাবা এটা করতে পারেনা। তীর্থ খানের সাথে কত সুন্দর বন্ডিং ছিলো। সম্পর্ক এতো সুন্দর ছিলো বলার বাহিরে। তার বাবা খোলস পালটাতে পারে না। আদ্রিশ এটা কিছুতেই মানতে পারছে না। সত্যি হলেও মানতে পারবে না। এটা সত্যি হলে তাহসিনার কাছে সে বড়মুখ করে কথা বলবে কীভাবে? বাবা মায়ের খু’নির ছেলেকে আদৌ বিয়ে করবে তো? ভালোবাসা হারানোর সুর চিত্তে বাজছে কঠোর ভাবে। আদ্রিশ নিজেকে ধাতস্থ করে।

“এসব ফেইক! সব ফেইক। তাহসিনা এসব কিছুই হয়নি আংকেল আন্টি রেড এক্সিডেন্টে মা-রা গিয়েছে।”

★★★

শারমিন আঞ্জুম এবং সাইখা ইসলাম,সিনথি রান্না সামলাচ্ছেন। সন্ধ্যায় ফারিহা চৌধুরী এবং আদ্রিশ চৌধুরী আসবেন। তিশা, শিশা রোদের সাথে গল্প করছে।
শিকদার বাড়ীতে ব্যস্ততা। নতুন মেহমানের আগমন হবে। তূর্ণ অফিস থেকে এসে শুনেছে আদ্রিশের সাথে রোদের বিয়েটা হবে হয়ত। তূর্ণ কিছু বলেনা। মানতে না পারলেও একটু আধটু খুশি সে। অন্তত রোদের চোখের আড়াল হতে পারবে। পূর্ণর সাথে রোদের বিয়ে হলে তূর্ণ কখনো সুখে সংসার করতে পারতো না। ভালোবাসা না পাওয়ার আক্ষেপ এবং আফসোস তাকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হতো। এখনো আফসোস হয়! তবে রোদ আড়াল হলে হয়ত একটু কম হবে।

“ভালোবাসা না পাওয়ার তীব্র যন্ত্রণায় ভীষণ রকমের মন পোড়ে। ভাগ্যিস! এই মন পোড়া গন্ধ কেউ পায়না।”

তূর্ণ কে দেখে রোদ ঠান্ডা পানির বোতল এনে দেয় ফ্রিজ থেকে। আগে এই দায়িত্ব টা সে পালন করতো। সিনথও আসার পর সিনথি এটা করে। তবে কাজে থাকলে রোদই পানির বোতল এগিয়ে দেয়।

তূর্ণ কী মনে করে রোদের রুমে প্রবেশ করে। খাটের পাশের টেবিলের উপর ছোট্টো ভাজে শুকনো ফুলগুচ্ছ পড়ে আছে। তূর্ণ সেগুলো হাতে নেয়। ফুলগুলো তো তারই দেওয়া। রোদ রুমে আসে তূর্ণ ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রোদকে বলে, “ফুলগুলো যত্নে রেখো রোদ।”

“আচ্ছা রাখবো।”

“শোনলাম আজকে তোমায় দেখতে আসবে।”

“হ্যাঁ! ঠিকই শুনেছো।”

“আমার দেওয়া শাড়ীটা পড়ো।”

“তোমার দেওয়া কোন শাড়ীটা? তুমি তো কখনো আমায় শাড়ী দাওনি ভাইয়া।”

“ওই যে মাইশার মেহেদী নাইটে একটা পার্সেল শূন্য এনে দিয়েছিলো। তোমার নামে এসেছিলো! ওই শাড়ীটা আমি গিফ্ট করেছিলাম।”

রোদ থমকে যায়। ওইটায় একটা চিরকুট ছিলো! সে তো ভেবেছিলো কে না কে দিয়েছে। তূর্ণ তার প্রতি দুর্বল জানে কিন্তু এসব! সিনথি জানলে? না! রোদের সাথে সিনথির ভালো বন্ডিং তৈরী হয়েছে। রোদ জবাব দেয়না। তূর্ণ পুনরায় বলে, “প্লিজ রিকুয়েষ্ট আমার দেওয়া শাড়ীটা পড়বা।”

“হু!”

ফুলগুলো যত্নে রেখো প্লিজ! এগুলো আমার ভালোবাসার প্রতীক।”

“ভালোবাসো আমায়?”

তূর্ণ তখন মুচকি হেঁসে বলে, ” আমার বউ আছে রোদ। এজ এ্যা ব্রাদার হিসাবে বলেছি।”

তখন দরজার দিকে চোখ যায় রোদের। মাত্র সিনথি প্রস্থান করেছে। পূর্ণ তখন এদিকটায় আসে। সিনথির যাওয়াটা সে দেখেছে। তূর্ণ, রোদকে দেখে পূর্ণ কিছু বলেনা। রোদের সামনে আসতেও তার লজ্জা লাগে আজকাল। তূর্ণ শুকনো গোলাপগুচ্ছ রোদের হাতে দিয়ে বলে, ” রিকুয়েষ্ট!”

তড়িঘড়ি প্রস্থান করে তূর্ণ। রোদ সেভাবে দাঁড়িয়ে রয়। পূর্ণ লিভিং রুমে আসতে শরীফ শিকদার তাকে ডেকে নেয়। পূর্ণর কথার বলার মতো কোন ইচ্ছে নেই তবুও বলতে হচ্ছে। শরীফ শিকদার পূর্ণকে বলে, ” রোদের অন্য কেথাও বিয়ে দিতে হবে না। বিয়েটা তুমি করো পূর্ণ।”

“দুঃখিত! অন্য কথা থাকলে বলুন?”

“এটাই আমার কথা। এটাই তোমাকে শুনতে হবে।”

“আমি বাধ্য নই!”

“বাধ্য তুমি। নাহলে কোনদিক দিয়ে কাকে টান দেই আমি টের ও পাবা না।”

“তোর খবর আছে টাকলা শরীফ।”

“মুখ সামলে কথা বলো পূর্ণ। আমি তোমার চাচ্চু! মানছি মাথায় একটা টাক আছে তাই বলে এভাবে বলাটা ঠিক নয়।”

“ভাগ্য ভালো টাক ফাটানোর কথা বলিনি। নিজের লিমিটে থাক নাহলে বুলেট কপাল বরাবর গেঁথে দেবো। আমি পূর্ণ কাউকে পরোয়া করিনা।”

“তাহলে নিজের কোন প্রিয়জনকে হারানোর জন্য রেডি হও।”

পূর্ণ চুপসে যায়। নিজেকে ধাতস্থ করে বলে, ” বল কী করতে হবে?”

“ভদ্র ভাবে কথা বলো।”

“বলুন কী করতে হবে?”

“আদ্রিশ যখন আসবে দেখার পালা, ডেট ফিক্সড, ডিনার শেষে যাওয়ার আগ মূহুর্তে তুমি বলবা, তুমি রোদকে বিয়ে করতে চাও। তুমি বেঁচে থাকতে রোদকে অন্য কোথাও বিয়ে হতে দিবে না।”

“আই’ভ গার্লফ্রেন্ড চাচ্চু।”

“ওই অরিনকে প্রয়োজনে আমি বুঝ দিয়ে দিবো।”

“ঠিক আছে। তোমার জন্য বিরাট সারপ্রাইজ আছে চাচ্চু।”

“এই না হলে আমার ভাতিজা। চাচ্চুর মতো হবা।”

পূর্ণ জবাব দেয়না। আদ্রিশ, ফারিহা আসতে তাঁদেরকে সাদরে গ্রহণ করে পূর্ণ, তূর্ণ, শরীফ শিকদার। তিশা,শিশা মিলে রোদকে রেডি করায়। সিনথি আসেনি! ব্যপারটা সবারই খটকা লাগে। তূর্ণ রুমে যাওয়ার মতো সাহস পায়নি।

তূর্ণর দেওয়া শাড়ীটা পড়েই রোদ আসে। আদ্রিশ রোদকে দেখে মনে,মনে মাশাআল্লাহ বলে। সবার সামনেই একগুচ্ছ শুভ্র গোলাপ দেয় রোদকে। তাদের টুকটাক কথাবার্তা, দেখাদেখির পালা শেষে ডিনার করে নেয়। ফারিহা চৌধুরী রোদকে রিং পড়ান। শরীফ শিকদার বেশ আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন পূর্ণ কিছু বলবে। আদ্রিশদের ও যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে।

#চলবে

#এক_ফালি_প্রণয়|২৯|
#শার্লিন_হাসান

তূর্ণর দেওয়া শাড়ীটা পড়েই রোদ আসে। আদ্রিশ রোদকে দেখে মনে,মনে মাশাআল্লাহ বলে। সবার সামনেই একগুচ্ছ শুভ্র গোলাপ দেয় রোদকে। তাদের টুকটাক কথাবার্তা, দেখাদেখির পালা শেষে ডিনার করে নেয়। ফারিহা চৌধুরী রোদকে রিং পড়ান। শরীফ শিকদার বেশ আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন পূর্ণ কিছু বলবে। আদ্রিশদের ও যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে।
সবার থেকে বিদায় নিয়ে আদ্রিশ এবং ফারিহা বেড়িয়ে পড়ে। পূর্ণ তাঁদেরকে হাসি মুখে বিদায় দেয়। শরীফ শিকদার পূর্ণর কাজে হাত মুষ্টি বদ্ধ করে নেয়। পূর্ণ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে শরীফ শিকদারের সোজাসুজি সামনের সোফায় বসে।

“বেশী বাড় বেড়ো না রেকর্ডিং ফাঁস করে গলায় ফাঁস ঝুলিয়ে দেবো কিন্তু।”

পূর্ণর কথায় তিশা ব্রু জোড়া প্রসারিত করে তাকায়। প্রতিত্তোরে বলে, “কার রেকর্ডিং ফাঁস করবে ভাইয়া?”

“আছে একজন।”

“ওহ্!”

পূর্ণ বাঁকা হেসে শরীফ শিকদারের দিকে তাকায়। তিনি মুখটা গম্ভীর করে উঠে চলে যান। তূর্ণ কিছুক্ষণ বসে ছিলো লিভিং রুমে। ক্লান্ত লাগছে তাই রুমের দিকে অগ্রসর হয়। সিনথি খাবার খায়নি! শারমিন আঞ্জুম এবং সাইখা ইসলাম অনেকবার ডেকেছে। মাথা ব্যথার কথা বলে বিষয়টা এড়িয়ে গেছে সিনথি। তাই কেউ আর তেমন ডাকাডাকি করে ডিস্টার্ব করেনি। তূর্ণ সিনথির কথা স্মরণ হতে কিচেনে যায়। সাইখা ইসলামকে বলে, “সিনথির খাবার টা দাও!”

সাইখা ইসলাম কথা না বাড়িয়ে খাবার বেড়ে তূর্ণর হাতে দেয়। তূর্ণ খাবার নিয়ে রুমের দিকে যায়। পূর্ণর চোখে পড়ে ব্যপারটা। মূহুর্তে খারাপ লাগা কাজ করে। আজকে তার জন্যই এমন দূরত্ব তার ভাই আর ভাবীর মাঝে।

রুমে এসে দরজা লক করে লাইট অন করে তূর্ণ। রুমে সিনথির অস্তিত্ব নেই। খাবারের প্লেট সোফার সামনের ট্রি টেবিলে রেখে বেলকনিতে যায় তূর্ণ। সিনথি দোলনায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্ণ কন্ঠে গম্ভীরতা টেনে বলে, “রুমে আসো সিনথি।”

সিনথি জবাব দেয়না। তূর্ণ পুনরায় একই বাক্য উচ্চারণ করে। তাতে ও সিনথি সায় দেয়না। বার কয়েক একই বাক্য উচ্চারণ করলেও কোন রেসপন্স পায়না তূর্ণ। বাধ্য হয়ে সিনথির সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি টায়ার্ড সিনথি। রুমে আসো!”

“আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ুন।”

“ডিনার করোনি তুমি।”

“খিদে নেই আমার।”

“সেটা আমি জানতে চাইনি।”

কথাটা বলে সিনথির হাত ধরে তূর্ণ। সিনথিকে টেনে রুমে এনে বেলকনির দরজা লাগিয়ে দেয় সে। মেয়েটার চোখমুখ ফোলে লাল হয়ে আছে। তূর্ণ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে, “সবার অতীত থাকে সিনথি। আমি তাকে পাইনি! তুমি এখন আমার বর্তমান এবং ভবিষ্যত।”

“আমাদের মাঝে কিছুই নেই তূর্ণ।”

তূর্ণ কিছু বলেনা। খাবারের প্লেট এনে সিনথির সামনে রেখে বলে, “আমার সময় লাগবে।”

সিনথি জবাব দেয়না। তূর্ণ হাত ধুয়ে এসে সিনথিকে খাইয়ে দেয়। এঁটো প্লেট নিয়ে লিভিং রুমে যায় তূর্ণ। তখন আবার রোদ আসে লিভিং রুমে তার হাতে জগ। হয়ত পানি নিতে এসেছে। দু’জন, দু’জনকে দেখে কিছুই বলেনা। যে যার মতো রুমে চলে যায়। সিনথি খাটের একপাশে আধশোয়া হয়ে, মুখে হাত দিয়ে দৃষ্টি সামনের দেওয়ালে স্থির করেছে। তূর্ণ লাইট ওফ করে শুয়ে পড়ে। সে ভীষণ টায়ার্ড! ঘড়ির কাটা তখন প্রায় বারোটার ঘরে।

সিনথির ঘুম আসেনা। ঘন্টাখানেক পর সিনথি খেয়াল করে তূর্ণ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। উঠে বেলকনিতে যায় সিনথি। সে তো চেয়েছে তার বরের জীবনে প্রথম এবং শেষ ভালোবাসাটা সে হোক! একবারে হালাল সম্পর্ক স্থাপন করে ভালোবাসবে তাই তো এই পাপের দুনিয়ায় নিজেকে পবিত্র রেখেছে। হালাল যে সবসময় সুন্দর! কিন্তু মানুষ তো ভালোবাসে! ভালোবাসতে বারণ নেই। ভালোবাসা একটা পবিত্র শব্দ। শত ক্রোশ দূর থেকেও ভালোবাসা যায়। আবার হাতে হাত রেখেও বিশ্বাস ভাঙা যায়। আসলেই মানব জাতি বড্ড অদ্ভুত।

সিনথির রাতটা বেলকনিতে অম্বরের চাঁদ এবং গুটি কয়েক তারা’র সাথে কেটে যায়। তিনটার দিকে রুমে এসে শুয়ে পড়ে সে।

পরের দিন সকালে শিকদার বাড়ীতে ব্যস্ততা বেড়ে যায়। রোদের বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়েছে আর তিন দিন পর-ই তার বিয়েটা। তূর্ণ, শরীফ শিকদার তারা অফিসে। পূর্ণ, শূন্য বাকীটা দেখছে। চৌধুরী পরিবারের সাথে তীর্থ খানের ভালো সম্পর্ক ছিলো একসময় সেটা সবারই জানা। এছাড়া আদ্রিশ যেহেতু রোদকে চেয়েছে সেখানে না করার সাধ্য কারোর নেই।

ফারিহা চৌধুরীর সাথে রোদের কথা হয়। শুধু আদ্রিশের সাথে কলে কথা বলেনা সে। মাঝেমধ্যে আদ্রিশ নিজে নক দেয়। রোদ সীন করে রিপ্লাই করেনা। এই নিয়ে আদ্রিশের কপাট রাগ জমেছে।

আফিয়া ইসলাম চৌধুরী বাড়ীতে এসেছেন। আদ্রিশ বলেছে সিনথিকেও যাতে নিয়ে আসে। একমাত্র কাজিন বলে কথা। সিনথি ও চেয়েছে চলে যেতে শিকদার বাড়ীতে থাকার ইচ্ছে তার নেই। কিন্তু তূর্ণ দিবে কীনা সেটাও সে জানে না।

সন্ধ্যায় আফিয়া ইসলাম কল দিয়েছে সিনথিকে। তূর্ণ সোফায় বসে অফিসের কাজ করছিলো। সিনথি খাটের উপর বসা। টুকটাক কথা বলে সিনথি ফোন তূর্ণর কাছে দেয়। তূর্ণ সালাম দিয়ে টুকটাক কথা শেষ করতে আফিয়া ইসলাম বলেন, “সিনথিকে চাচ্ছিলাম চৌধুরী বাড়ীতে নিয়ে আসতে। জানোই তো আমরা দুই বোন দু’জনের দু’টো সন্তান।”

“সিনথি বর্তমানে আমার স্ত্রী আর আমার পরিবারে ও অনুষ্ঠান আছে। আমার স্ত্রী আমার পরিবারের সদস্য আর পরিবারের অনুষ্ঠানে পরিবারের কোন সদস্যের অনুপস্থিতি আমার পছন্দ না।”

“ঠিক আছে তোমার যা ভালো মনে হয়।”

কল কেটে দিতে তূর্ণ কঠোর গলায় বলে, ” তুমি এখনো রাগ করে আছো?”

“আমি কারোর উপর রাগ করিনা।”

“তাহলে অভিমান?”

“জানি না।”

“আচ্ছা শোনো!”

কথাটা বলে তূর্ণ সিনথির কাছে যায়। হাতে হাত রেখে বলে, ” রোদ আমার অতীত! আমরা প্রেম ও করিনি কিন্তু। শুধু এক তরফা ভালোবেসেছিলাম রোদকে ব্যাস এটুকু।”

“আমি এসবের কিছুই জানতে চায়নি।”

“হ্যাঁ জানি জানতে চাওনি। আমি বললাম আরকী।”

“বলতেও বলিনি।”

“স্যরি!”

সিনথি জবাব দেয়না। তূর্ণ পুনরায় বলে, “তুমি তো এই জেনারেশনের মেয়ে তাই না সিনথি? রোদ আমার অতীত আমার ভালেবাসা ছিলো। আমরা প্রেম করিনি! এখন তুমি আমার বর্তমান!”

“প্লিজ আর বলবেন না রোদ আপনার ভালোবাসা ছিলো। আমি হার্ট হই!”

তূর্ণ জবাব দেয়না। ভালোবাসা ছিলো, ভালোবেসেছিলাম আমি অস্বীকার করতে পারবো না সিনথি। তবে আর কখনো হয়ত বলা হবে না, মানুষটাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। আমি বাস্তবতার বেড়া জালে আবদ্ধ, দায়িত্বে সীমাবদ্ধ। তবুও হয়ত মনের কোণে এক জনমের না পাওয়া ভালোবাসা এবং ভালোবাসার মানুষটা থেকেই যাবে।

শরীফ শিকদার পূর্ণকে একের পর এক থ্রেট দিচ্ছে বিয়েটা যাতে ভে’ঙে দেয়। পূর্ণ সেসব আমলে নেয়নি। বিয়েটা হচ্ছে তো হোক! অরিনকে সে কখনো ঠকাতে পারবে না। দুনিয়া উল্টে গেলেও না। কারোর মন ভাঙতে গিয়েও ভাঙেনি সে এটা ভেবেও শুকরিয়া তবে মন ভাঙা ব্যথা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে সে। কী জানি শেষ অব্দি না কী তার মনটাই কেউ ভে’ঙে দিয়ে চলে যায়।

দেখতে,দেখতে রোদের বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসে। আজকে দুপুরে হলুদ এবং সন্ধ্যায় মেহেদীর অনুষ্ঠান।
চৌধুরী বাড়ী বেশ সুন্দর ভাবে সজ্জিত করা হয়েছে। একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা। আলতাফ পারভেজ চৌধুরী না পেরে নিজের কিছু ক্লায়েন্ট, পার্টনারদের ইনভাইট দিয়েছে। একপ্রকার নাকে দড়ি দিয়েই বিয়েতে নাচাচ্ছে আদ্রিশ। কথা বলেনা তবে দায়িত্ব সবটাই পালন করতে হচ্ছে। রেগে মেজাজ হারান আলতাফ পারভেজ চৌধুরী। তবুও কিছু বলতে পারেন না। তাহসিনা তার বাড়ীর পূত্র বঁধু হবে এটা সহ্য হচ্ছেনা আলতাফ পারভেজ চৌধুরীর। নিজের খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসতেই হবে। আসল মুখোশটা তো ফাঁস হয়ে যাবে। যে ঘনিষ্ঠ বন্ধু তীর্থ খান এবং তার অর্ধাঙ্গিনীর খু’নি এমনকি বন্ধুর মেয়েকেও মারতে চেয়েছিলো। শিকদার পরিবারের কেউ হয়ত তাকে ছেড়ে কথা বলবে না।

দুপুরের দিকে ছাঁদে ছোটোখাটো হলি,হলুদ রাখে সবাই। রোদ হলুদ শাড়ী পরিধান করে। বাকীরাও শাড়ী পড়েছে। দুগালে অল্পস্বল্প লাল রঙের আবির মাখিয়েছে সে। কিছু পিকচার তুলে রাখে। দুই মামী মিলে হাতের পিঠে আলতো হলুদ ছোঁয়ায়।

আজকের হলুদে অরিন ও এসেছে। পূর্ণ বলেছে আসতে! শরীফ শিকদার সবাইকে দেখেই যাচ্ছে। একে তো রোদের বিয়েটা আদ্রিশের সাথে হচ্ছে। পূর্ণ কিছুই করছে না তারউপর গাড়ের কাছে অরিনকে এনে রেখেছে। চেয়েছিলো অরিনের পরিবারে গিয়ে থ্রেট দিয়ে কিছু টাকা ধরিয়ে দিবেন। মধ্যবিত্ত পরিবার নিশ্চয়ই রাজী হয়ে যেতো। কিন্তু এই পূর্ণ এক কাঠি উপরে।

শরীফ শিকদার বুঝে গেছেন তার এই প্লানিং কাজ হবে না। নতুন কিছু ভাবতে হবে। অরিন পূর্ণকে আবির মাখায়। তারা হাসছে,দৌড়াদৌড়ি করছে। আজকে পূর্ণ জেনো অরিনের সাথেই বাচ্চা হয়ে গেছে। কী জানি! এই কয়েকদিনে পূর্ণ জেনো ভীষণ তীব্র ভাবে অরিনকে ভালোবেসে ফেলেছে। মেয়েটার সব বাচ্চামি আজকাল ভালো লাগে। আগে তো ইগনোর করে যেতো। এতো ভালোবাসছে সে আদৌ অরিনকে হারিয়ে ফেলবে না তো? নাকী সে হারিয়ে যাবে? বুকের ভেতর দুমড়েমুচড়ে উঠে পূর্ণর। ভালোবাসা হারানোর ভয় নাকী নিজেকে হারানোর ভয় কিছুই বুঝতে পারছে না সে।

রোদ ও সবার সাথে মিলে হাসিখুশি ভাবে আবির মাখছে। সিনথিও এসবে যোগদান করেছে। সবাই সাদা পান্জাবি, মেয়েরা লাল শাড়ী পড়েছে। তূর্ণ এসবে নেই। সিনথি দুমুঠো ভর্তি আবির নিয়ে তূর্ণর দুই গালে লাগায়। সবার আড়ালে কপালে চুমু খেয়ে বলে, “এই আবিরের রঙের সাথেই ধুয়েমুছে যাক অতীত। আমি আপনায় ভালোবাসি! আপনি একান্ত আমার! আমার অর্ধাঙ্গ।”

তূর্ণ হেঁসে সিনথির কোমড়ে হাত রেখে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ” তুমি সব ভুলে আমার হতে চাইলে আমিও আগলে নেবো। ভালোবাসারা ভালো থাকুক আমাদের কল্পনায় কিংবা আমাদের ছোঁয়ায়।”

সিনথি হাসে। তবে সে বাক্যটায় রোদকেও যে মিন করেছে বুঝেছে। ভালোবাসারা ভালো থাকুক কল্পনায়! হাহ্! সিনথি কিছু বলেনা। তবে বুঝেছে তূর্ণর ভালোবাসার গভীরতা। রোদের দিকে তাকিয়ে সিনথি শুধায়, “নিশ্চয়ই তুমি ভাগ্যবতী কন্যা! আমার ভালোবাসা একসময় তোমায় ভালোবেসেছিলো। পাগলের মতো ভালোবেসেছিলো। এক তরফা ভালোবাসা, প্রকাশিত ভালোবাসার তুলনায় ভীষণ ভয়ংকর হয়। প্রকাশ না করেও গভীরভাবে ভালোবাসা যায়।”

#চলবে