#এক_মুঠো_অনুভূতি💖
লেখিকা- তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২৪
ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে পার্কের একটি বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে ওহি আর আশ্বিন। ওহির হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুপচাপ বসে আছে আশ্বিন। ওহি দু এক বার তাকিয়ে আশ্বিনের এই নিস্তব্ধতার কারণ খুঁজে যাচ্ছে।
–কি হয়েছে আপনার? হঠাত এতো চুপচাপ।
–কিছু না এমনি। তোমার বাবা আজ অনেক খুশি হয়েছে ফাইজা। আঙ্কেলের চোখ মুখে এক অন্যরকম খুশির ছাপ ছিল। হয়তো কাল সারাদিন ধরে তিনি যে ভয়টা নিয়ে ছিলেন, আজ সম্পূর্ণ ভাবে বিষয়টা পাল্টে যাওয়ায় তিনি নিশ্চিন্ত আর অবশ্যই খুশি।
আশ্বিনের কথায় ওহি কিছু না বলে চুপচাপ বসে থাকে। হয়তো আশ্বিন ঠিক বলছে। কিন্তু ওহির কাছে বাবার মনের অবস্থা বোঝা এতো সহজ কাজ না। ওহি কিছু না বলে আশ্বিনের কাধে মাথা রাখে। আশ্বিন একবার ওহির দিকে তাকিয়ে তার হাত শক্ত করে ধরে।
——————
আশ্বিন ওহিকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছে। ওহি আশ্বিনকে বিদায় দিয়ে উপরে তার ঘরের বারান্দার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে উপরে চলে আসে।
বাবার কাছে হয়তো এতক্ষণে মা আর ওসমান ওহির রেজাল্টের কথা জেনে গিয়েছে। হয়তো তারা দুজন এখন অনেক খুশি হয়ে ওহির ফিরে আসারই অপেক্ষা করছে। ওসমান আর মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে ওহি বাসার ভেতর প্রবেশ করে অবাক হয়ে যায়।
পুরো বাড়ি জুড়ে এক নীরবতা গ্রাস করছে আর রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে ওহির পছন্দের খাবারের সুঘ্রাণ। ওহি সোফার উপর কাধের ব্যাগটা রেখে মা আর ওসমানকে কয়েকবার ডাক দেয় কিন্তু কারো কোন সারা নেই।
–কি আশ্চর্য! কোথায় গিয়েছে সবাই?
ওহি ফোন নিয়ে ওসমানের নম্বরে কল দিতে যাবে তখনই ওসমান আর বাবা একসাথে ছাদ থেকে নিচে নেমে বাসায় প্রবেশ করে। ওহি ওসমানকে আসতে দেখে কিছু বলতে চাইলেও বাবার দিকে ফিরে চুপ হয়ে যায়। ওসমান ততক্ষণে ওহির কাছে এসে ওহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
–অনেক অনেক অভিনন্দন ছোট। আমি জানতাম আমার বোন অনেক ভালো রেজাল্ট করবে। আমি অনেক অনেক অনেককক খুশি হয়েছি।
ওহি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই ওহির মা বাসায় প্রবেশ করে ওহির বাবাকে,
–সব ঠিকঠাক করা শেষ। এখন বাকি রান্নাগুলো তাহলে করে ফেলবো নাকি?
–হ্যা অবশ্যই। এখনই না করলে তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। একটু পর তো মেহমান সবাই চলে আসবে।
ওহির বাবার কথা শুনে ওহির মা মাথা নেড়ে রান্নাঘরে চলে যায়। ওহি সবার এমন অদ্ভুত কথার অর্থ কিছুই বুঝতে পারছে না। সে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে ওসমানের দিকে তাকাতেই ওসমান ওহির গাল টেনে,
–বাবা তোর এই ভালো রেজাল্ট সেলিব্রেট করতে চাইছেন। তাই আজ তোর সব পছন্দের খাবার রান্না হয়েছে। আমরা সবাই মিলে ছাদে পার্টি করবো। আর মেহমান হিসেবে আসবে জাইমা আফরা আশ্বিন আর রোদ্দুর। বাবা নিজে তাদের ইনভাইট করেছে।
ওসমানের কথায় ওহি অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকায়। ওহির বাবা ততক্ষণে উনার রুম থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে ওহির কাছে এসে,
–ওহি, এই জামাটা তোমার জন্য নিয়ে এসেছি। দেখো তো পছন্দ হয় কিনা। আমি তো জানি না তোমার কেমন ড্রেস পছন্দ, কোন রঙ পছন্দ। তাই নিজের পছন্দ মতোই এটা নিয়ে এসেছি। নাও দেখো।
বাবার কথা শুনে ওহি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বাবার হাত থেকে প্যাকেট নিয়ে নেয়।
বাবা যে তার রেজাল্টে খুশি হয়ে উপহার নিয়ে এসেছে, কথাটা মনে হতেই অজান্তেই ওহির চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। ওসমান বোনের দিকে তাকিয়ে তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে।
–দেখ পছন্দ হয়েছে কিনা।
ওহি একনজর ওসমানের দিকে তাকিয়ে প্যাকেট খুলে একটা জামা বের করে অবাক হয়ে যায়। গাঢ় আকাশী রঙের অসম্ভব সুন্দর একটি গাউন! ঠিক যেমনটা ওহি ছোটবেলায় তার বাবার কাছে চাইতো। ওসমান আর ওহি দুজনকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওহির বাবা ভ্রু কুঁচকে,
–কি? পছন্দ হয়নি?
ওহি বাবার কথায় উনার দিকে তাকিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। ওহির বাবা হয়তো বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন তাই কিছু না বলে ওহিকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
দূর থেকে ওসমান সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে রান্নাঘর থেকে লুকিয়ে সবকিছু দেখতে থাকা মায়ের দিকে তাকায়।
এই দিনটা হয়তো তাদের পরিবারে স্মৃতির পাতায় রাখার মতো একটি দিন হয়ে থাকবে।
বিকেলে,
আফরা আর জাইমা আগে আগেই ওহির বাসায় চলে এসেছে। ফ্যামিলি পার্টি হলেও তারা আজ দুজন খুব সুন্দর দুটি গাউন পড়ে এসেছে।
তাদের স্বাগতম জানাতে এসে ওসমান আফরার দিকে তাকিয়ে হা হয়ে যায়। মেয়েটা এমনিতেই সুন্দরী, তার উপর এই পোষাক আর হালকা সাজে তাকে কোন হুরপরী থেকে কম লাগছে না। ওসমান তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে অজান্তেই বলে ফেলে,
–মাশাআল্লাহ!
আফরা তার কথায় কিছুটা লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে নেয়। জাইমা একবার আফরার দিকে তাকিয়ে আবার ওসমানের দিকে ফিরে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আফরার হাত ধরে ওসমানের পাশ কাটিয়ে ওহির রুমে চলে আসে।
ওহি বাবার দেওয়া গাউন পড়ে হালকা সাজগোজ করে রুমে বসে আছে। আফরা আর জাইমা রুমে প্রবেশ করেই ওহির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে একসাথে বলে উঠে,
–ওহিইই! এটা তুই? তোকে পুরোই পুতুলের মতো লাগছে।
ওহি তাদের কথায় খুশি হয়ে,
–বাবা কিনে দিয়েছে। কেমন হয়েছে?
–খুব সুন্দর। মানতে হবে, আঙ্কেলের চয়েজ আছে।
আফরার কথায় ওহি কিছু না বলে মুচকি হাসি দেয়।
এদিকে,
রোদ্দুর আর আশ্বিন একসাথে ওহির বাসায় চলে এসেছে। প্রায় দুইঘন্টা ধরে ডাকা-ডাকির পর রোদ্দুরের ঘুম ভাঙায় তাদের আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।
আশ্বিন আর রোদ্দুর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে,
–আরো ঘুমিয়ে থাক তুই। ফাইজা’র বাবা এই প্রথম নিজ থেকে আমাদের দাওয়াত দিয়েছেন, আর তোর জন্য আমাদের দেরি হয়ে গেলো। এখন আঙ্কেল জিজ্ঞেস করলে কি বলবো? রোদ দুপুর থেকে ম/রা/র মতো পড়ে ঘুমাচ্ছিলো, তাই আমাদের আসতে দেরি হয়েছে।
–বেশি কথা বলিস না আশ্বিন। এইসব তোর জন্যই হয়েছে। কাল ওহির কথা শুনেই, আমার বাসায় চলে এসে সারারাত ধরে ওহির জন্য টেনশন করেছিস। আমি বলি কি, টেনশন করার জন্য কি তোর নিজের বাসা ছিলো না? না থাকলে পার্কে গিয়ে বসে থাকতি। সারারাত নিজে তো ঘুমাসনি, আমাকেও ঘুমাতে দেয়নি।
আশ্বিন রোদ্দুরের কথায় তার দিকে একবার রাগি ভাবে তাকিয়ে কিছু না বলে ছাদে চলে আসে। ওসমান তাদের স্বাগতম জানিয়ে ওহির বাবার কাছে পরিচিত হওয়ার জন্য নিয়ে যায়।
——————-
আশ্বিন রোদ্দুর আর ওসমান মিলে ওহির বাবার সাথে কথা বলছে। তখনই নিচ থেকে জাইমা আফরা আর ওহি ছাদে আসে। আশ্বিন কথা বলার মাঝে একবার দরজার কাছে ওহির দিকে তাকিয়ে থমকে যায়। কোন কথাই আর তার কান পর্যন্ত আসছে না, শুরু কানের কাছে বেজে চলেছে ঝিরঝির এক শব্দ। সে মন্ত্র-মুগ্ধের মতোই তাকিয়ে আছে ওহির দিকে।
ওহি আশ্বিনের দিকে এগিয়ে আসতেই ওহির বাবা মা তাদের সবাইকে গল্প করতে বলে খাবারের আয়োজন করতে চলে যায়।
–কেমন লাগছে আমাকে?
ওহির কথায় আশ্বিনের হুশ ফিরে। সে কিছুটা ঝেড়ে কেশে ওহির দিকে তাকিয়ে,
–পরির চেয়েও বেশি সুন্দর। আশ্বিনের পরি ফাইজা।
আশ্বিনের কথায় ওহি কিছুটা লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। গাল দুটোয় মুহূর্তেই লাল আভার কিরণ দিচ্ছে তার।
ছাদের সাউন্ড বক্সে খুব সুন্দর একটি গান বেজে যাচ্ছে। সবাই মিলে একে অপরের সাথে টুকটাক গল্প করছে। এর মাঝেই ওসমান নিচ থেকে একটা ছোট্ট বালিশ নিয়ে এসে,
–পার্টির আনন্দ তখনই জমে উঠে যখন সেখানে ছোটখাট গেইম রাখা হয়। তাই এখন আমরা সবাই মিলে কিছু গেইম খেলবো। খেলার মুল উপকার হলো এই বালিশ। যা এই মিউজিকের সাথে গোল হয়ে বসে থাকা আমাদের এক জনের হাত থেকে অন্যজনের মাঝে ঘুরবে। মিউজিক শেষ হওয়ার পর যার হাতে বালিশ থাকবে, তাকে নাচ, গান, কবিতা বা অভিনয় যে কোন একটা করে দেখাতে হবে।
ওসমানের কথায় সবাই রাজি হয়ে গোল হয়ে বসে পড়ে। সবাই ঠিকঠাক ভাবে বসায় ওসমান মিউজিক প্লে করে আর সাথে সাথেই শুরু হয় খেলা।
মিউজিকের তালে তালে এক জন অপর জনের কাছে বালিশ ছুঁড়ে দিচ্ছে। সবাই যেন খেলার মাঝেই হারিয়ে গিয়েছে ঠিক তখনই মিউজিক অফ হয়ে যায় আর বালিশ থেকে যায় জাইমার হাতে।
–না না, আমি মানি না। রোদ আমাকে মিউজিক শেষ করার পর বালিশ দিয়েছে।
জাইমার কথায় রোদ্দুর অবাক হয়ে,
–কি বললে? এখন এসে সব দোষ আমার?
জাইমা রোদ্দুরের দিকে রেগে তাকাতেই রোদ্দুর চুপ হয়ে যায়। তাদের দেখে সবাই একসাথে হেসে উঠে।
ওসমান একটা কাচের বাটিতে কয়েকটা ছোট চিরকুট লিখে নিয়ে জাইমার সামনে ধরে। জাইমা একটা কাগজ নিয়ে দেখে সেখানে লেখা আছে গান।
সবার জোরেই শেষে জাইমা খুব সুন্দর একটা গান গায়। তারপর আবারও শুরু হয় খেলা।
খেলার সাথে সাথে, ওসমান একবার গান গেয়েছে, আফরাকে একটা কবিতা বলতে হয়েছে আর রোদ্দুরকে একটা অভিনয় দেখাতে হয়েছে। সবাই মিলে খেলার মাঝেই হারিয়ে গিয়েছে তখনই আশ্বিনের জন্য আসে নাচ। আশ্বিন নাচের পরিবর্তে গান নিতে চাইলেও কেউ রাজি হয়না।
–আশ্বিন যা আছে তাই করতে হবে তোকে। তুই আর ওহি একসাথে একটা কিউট ডান্স করবি। কথা ফাইনাল।
আফরার কথায় সবাই একসাথে সম্মতি দিলেও আশ্বিন আর ওহি একে অপরের দিকে অবাক হয়েই তাকিয়ে আছে। ওহি অবশ্য এই নিয়ে রাজি না থাকলেও শেষে সবার কথায় রাজি হয়।
আশ্বিন এসে ওহির সামনে হাত বাড়িয়ে দিতেই ওহি সাত পাঁচ ভেবে আশ্বিনের হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়। ওসমান গিয়ে গান প্লে করলেই আশ্বিন আর ওহি একসাথে নাচতে শুরু করে।
চাঁদের আলোর মাঝে ভালোবাসার মানুষকে এতটা কাছ থেকে দেখতে পেয়ে আশ্বিন এক মনে ওহির দিকেই তাকিয়ে আছে। যেন সে আশপাশের সব খবর ভুলে গিয়েছে। ওহি কিছুক্ষণ আশ্বিনের এই দৃষ্টিতে চোখ রেখে পর মুহূর্তেই চোখ নামিয়ে নেয়। কিছুটা লাজুকতা আর কিছুটা অস্বস্তি এসে ভর করেছে ওহির মনে। তাই আশ্বিনের দিকে ফিরে তাকানোর সাহস হচ্ছে না তার। নাচ শেষ হতেই সবাই হাত তালি দিয়ে তাদের দুজনের খুব প্রশংসা করতে থাকে।
এর মাঝেই ওহির বাবা মা ছাদে চলে আসায় খেলার এখানেই সমাপ্তি ঘটে।
–চলবে।
#এক_মুঠো_অনুভূতি💖
লেখিকা- তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২৫
আজকের এই দিন আর এই মুহূর্তগুলো হয়তো কখনোই ভুলবে না ওহি। বাবা মায়ের মুখের এই হাসি আর আশ্বিন সহ সকল বন্ধুদের সাথে কাটানো সময়গুলো বেশ উপভোগ করেছে সে। সবার মাঝে ওহি এতটাই হারিয়ে গিয়েছিল যে এখন তার রাতের ঘুম হারাম করে আজ সারাদিনের কথাই ভেবে চলেছে। রাত দুইটা বিশ, অথচ ওহি খাটে হেলান দিয়ে বসে আজকের তোলা ছবিগুলো দেখে যাচ্ছে।
আশ্বিনকে আজ অনেক সুন্দর লাগছিলো ওহির কাছে। খুব আহামরি সুদর্শন না হলেও, প্রতিবার ওহি তাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছে। আশ্বিনের কথা ভাবতে ভাবতেই ওহি কল দিয়ে বসে আশ্বিনকে। যদিও এত রাতে ফোন দেওয়া বেমানান কাজ, তবুও মনের কোথাও এই সুপ্ত ইচ্ছেই তাকে ফোন করতে বাধ্য করেছে।
এদিকে,
আশ্বিন হয়তো তারই ফোনের অপেক্ষায় ছিলো তাই ফোন দেওয়ার সাথে সাথেই রিসিভ করে নেয়। ওহিও এতে খানিকটা অবাক হয়।
–এখনো জেগে আছো ফাইজা?
–ঘুম আসছিলো না। আপনি ঘুমাননি কেনো?
–এমনি, আমারও চোখে ঘুম নেই। আজকের কথা ভাবছি, দিনটা স্বপ্নের মতো ছিলো। তাই না ফাইজা? ভার্সিটি থেকে ফিরে আসার পথে তোমার বাবা যখন নিজ থেকে আমাকে ফোন করে তোমাদের বাসায় বিকেলে আসতে বললেন, আমি ভেবেছিলাম আমাকে নিয়ে বাসায় হয়তো কোন ঝামেলা হয়েছে। কিন্ত তারপর যখন আঙ্কেল বললেন তোমার রেজাল্ট সেলিব্রেট করবে, তখন আরো বেশি অবাক হয়েছি।
–আমিও অবাক হয়েছি। বাবা কখনোই আমাদের বন্ধু বান্ধব থাকা পছন্দ করতেন না। বাবার মতে বন্ধু থাকলে আমরা তাদের সাথে আড্ডা আর ঘুরঘুর করে সময় নষ্ট করবো, পড়ালেখার প্রতি মনোযোগ হারিয়ে ফেলবো। আজ বাবাই চাইছেন আমরা যেন বন্ধু বান্ধব নিয়ে ভালো ভাবে থাকি।
–সময়ের ব্যবধানে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়। বাই দ্য ওয়ে, তোমাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছিলো। এমনিতেই তুমি অনেক সুন্দর কিন্তু আজকের ব্যাপারটা আরো আলাদা ছিলো।
আশ্বিনের কথায় ওহি কিছুটা লজ্জা পায়। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আশ্বিন ওহির চোখ মুখের এই লাজুকতার রেশ হয়তো দেখতে পারছে না, তবে অনুভব করতে পারছে ঠিকই। বাকিটা রাত কেটে যায় দুজনের মাঝে টুকটাক গল্পের মেলায়।
—————–
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে নাস্তার পর ছাদে হাটতে এসেছে ওহি। সেদিন পার্টির পর আজ দুদিন ধরে কারো সাথে দেখা হয়নি তার। এই দুদিন বাবা বাসায় থাকায়, সে যথাসম্ভব বাবার সাথে সময় কাটানোর চেষ্টা করেছে। কাল রাতে বাবা ফিরে যাওয়ায় কিছুটা মন খারাপ হয় ওহির।
একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে দোলনায় বসে ফোন বের আশ্বিনের নম্বর বের করে কল দিতে গিয়েও থেমে যায় সে। দুদিন ধরে আশ্বিনের সাথে খুব রাত পর্যন্ত গল্প করা হয়। কাল রাতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি তাই, হয়তো এখনও ঘুমিয়ে আছে সে। আশ্বিনকে এই মুহূর্তে বিরক্ত করতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। তাই আফরার নম্বরে কল দেয়।
–হ্যালো আফরা আপু!
–ওহি? কি খবর তোমার? দুদিন ধরে তো দেখাই করছো না। আশ্বিন বললো তুমি নাকি ইদানীং খুব ব্যস্ত?
–তেমন কিছু না। বাবার সাথে দুদিন গল্প গুজব করেই ছিলাম। আজ কি তুমি ব্যাস্ত?
–এখন কোন ব্যাস্ততা নেই। কদিন পর মাস্টার্সে ভর্তি হবো, তারপর আবারও শুরু হবে ব্যাস্ততা। ওহি এক কাজ করো, তুমি আর জাইমা মিলে আমার বাসায় চলে আসো। আজ মেয়েরা মিলে আড্ডা দেই!
–খুব ভাল বুদ্ধি। কিন্তু জাইমা তো তার ফুপির বাসায় গিয়েছে। আমি একাই আসছি।
–ঠিক আছে।
ওহি আর দেরি না করে রেডি হয়ে আফরার বাসায় চলে আসে। যদিও আফরার বাসায় তার যাওয়ার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন।
দুদিন ধরে আফরা ওসমানকে ইগনোর করে চলছে। ওসমান বিষয়টা জানার চেষ্টা করলেও তার প্র্যাকটিকেল নিয়ে হঠাত ব্যস্ততার জন্য আফরার সাথে কোন যোগাযোগ হচ্ছে না। ওহি দুদিন ধরেই বিষয়টা লক্ষ করেছে। আফরা কিসের জন্য এমন করছে তা বোন হিসেবে জানতে হবে ওহির।
————
রান্নাঘরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রান্নার সাথে টুকটাক গল্প করছে ওহি আর আফরা। বাবা ব্যাবসার কাজে বাহিরে গেলে পুরো বাসা জুরে একাই থাকতে হয় আফরাকে। ওহির কাছে বিষয়টা খুব খারাপ লাগে। কেননা, তার বাসায় বাবার অনুপস্থিত থাকলেও সে মা আর ভাইয়ার সাথে গল্প করে কাটিয়ে দিয় কিন্তু আফরার বাসায় কথা বলার মতোও কেউ নেই।
–ওহি আজকের আবহাওয়া কিন্ত খুব সুন্দর। শাড়ি পড়ে ঘুরতে যাবে নাকি?
–হুম,যাওয়া যায়। বিকেলে তাহলে একসাথে ঘুরতে যাবো।
ওহির কথায় মাথা নেড়ে চুপ হয়ে যায় আফরা। ওহি একনজর আফরার দিকে তাকিয়ে রান্নায় মনোযোগ দেয়। অন্যদিন নিজ থেকে গল্পের আসর জমিয়ে নেওয়া মেয়েটা আজ এমন চুপচাপ! বিষয়টা ভাবতে হচ্ছে তার।
হঠাত বাসার কলিং বেল বেজে উঠায় আফরা ওহিকে রান্না দেখতে বলে এসে গেইট খুলে দেখে আশ্বিন।
–তুই এখানে?
–এতো অবাক হচ্ছিস কেনো? আমি আসতে পারি না? রোদের বাসায় গিয়েছিলাম, বাসায় নেই। আঙ্কেলের সাথে নাকি কোথায় গিয়েছে, তাই তোর বাসায় এসেছি।
আশ্বিন কথাটা বলেই গেইট দিয়ে ঢুকে ড্রইং রুমের সোফায় এসে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। আফরা আশ্বিনের পিছু পিছু এসে,
–কিন্তু আমরা আজ ব্যাস্ত আছি। তুই বাসায় চলে যা। নয়তো পরে আসবি।
আফরার কথায় আশ্বিন কিছুটা অবাক হয়,
–আমরা মানে? আর কে আছে এখানে?
“আমি আছি”
ওহি রান্নাঘর থেকে কথাটা বলে আফরার পাশে এসে দাঁড়ায়। আশ্বিন একবার ওহির দিকে তাকিয়ে একবার আফরার দিকে ফিরে,
–ফাইজা! তুমি এখানে আছো এটা আমাকে আগে বললে তো আমি আরো আগেই চলে আসতাম। আর, তোমরা হঠাত কি করছিলে দুজন মিলে?
আশ্বিনের কথায় আফরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে হেসে উঠে,
–আমরা কি করছি সেটা বড় বিষয় না। বাট এখন তোর অনেক কাজ আছে।
–কি?
আশ্বিন দুজনের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলতেই আফরা আশ্বিনের গাল টেনে হেসে উঠে।
————————-
সোফায় বসে বারবার রান্নাঘরের দিকে উকি দিচ্ছে ওহি। আফরা পাশে বসেই আপন মনে মুভি দেখছে। ওহির অবশ্য মুভির দিকে কোন মনোযোগ দেই, সে বারবার রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে আশ্বিনের অবস্থা বুঝতে চাইছে।
–আপু, উনাকে রান্না করতে দেওয়া কি আমাদের ঠিক হলো? উনি যদি রান্না করতে না পারে তাহলে তো সমস্যা হবে। আবার কোন অঘটন না হয়ে যায়।
আশ্বিনকে নিয়ে ওহির কপালে এই চিন্তার ছাপ দেখে হেসে উঠে আফরা। দুজনের মাঝে মনের এমন মিল দেখে ভালো লাগছে তার।
–চিন্তা করো না ওহি। আশ্বিন ভালোই রান্না করতে পারে। অবশ্য এখন যদি রাগের বশে ঝাল মরিচ বেশি দিয়ে দেয় তবে অন্য হিসাব। আহারে আশ্বিন, বেচারা ভেবেছিলো তোমার সাথে টাইম স্পেন্ড করতে। কিন্তু এখন তাকে রান্নার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছি। তুমি রাগ করো না আবার।
আফরার কথায় ওহি কিছু না বলে আবার রান্নাঘরের দিকে তাকায়। আশ্বিন খুব সুন্দর করে রান্না করছে দৃশ্যটা দেখে খুশি হয় সে।
–ওসমান ভাইয়াও ভালো রান্না করতে পারে।
ওহি আফরার উদ্দেশ্যে কথাটা বলতেই আফরার মুখের হাসি উঠে যায়। সে ওহির থেকে মুখ সরিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে শুধু বলে,
–ওহ!
–ওসমান ভাইয়ার উপর তুমি রাগ করেছো আপু?
–না, রাগ করবো কেনো?
–আমাকে বলো আপু, এভাবে কথাগুলো লুকিয়ে রেখে আরো কষ্ট পাবে। বলো, কি হয়েছে?
ওহির কথায় আফরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে,
–ওহি, প্রিয় মানুষকে অন্য কারো সাথে দেখা খুব কষ্টের জানো? অন্য কারো কাছে বিষয়টা কেমন আমি জানি না, তবে আমার কাছে তার পাশে অন্য কাউকে মেনে নেওয়া খুব কঠিন।
আফরার কথায় কিছুটা অবাক হয় ওহি। ওসমানের পাশে কাউকে সহ্য করা মানে?
–কি দেখেছো তুমি?
–দুদিন ধরেই ওসমানকে একটি মেয়ের সাথে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। সেদিন, তাদের একসাথে কফি শপে আড্ডা দেওয়া থেকে কাল দেখেছি তাদের পাশাপাশি রিকশায়। দুজন খুব হাসিখুশি ছিলো তখন। অথচ এই দুদিন আমার কোন ম্যাসেজ, ফোন এর উত্তর দেওয়ার সময় নেই তার। হয়তো তার প্রতি শুধু আমার মনেই অনুভূতি ছিলো। তার মনের খবর না জেনেই, আমি তাকে নিয়ে অনুভূতির বাসা বেঁধে ফেলেছিলাম। এর ফল আমি এখন পাচ্ছি।
আফরা কথাটা বলে ওহির আড়ালে চোখ মুছে নেয়। ওহি কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তার জানা মতে ওসমান এমন করার কথা না। তবে? প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তার। এখনই বাসায় গিয়ে ওসমানকে কথাগুলো বলতে পারলে ভালো হতো।
–এই নে! যা যা বলেছিস সব রান্না হয়েছে। শুধু তোর এই রান্নার জন্য ফাইজার সাথে আমার রোমান্টিক মোমেন্ট নষ্ট হয়েছে। কোথায় ভেবেছিলাম আমি আর সে একসাথে মুভি দেখবো।
–বিয়ের পর দেখিস। এখন চল খেতে যাই।
আফরা হেসে উঠে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে। ওহি আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াতেই আশ্বিন তার সামনে এসে দুহাত ওহির গালে রেখে,
–তোমার জন্য স্পেশাল ভাবে পায়েস রান্না করেছি। খেয়ে দেখো তো হবু বরের রান্না পছন্দ হয় কিনা। চলো আজকে তোমাকে আমি নিজে হাতে খাইয়ে দিবো।
আশ্বিন কথাগুলো বলে ওহিকে নিয়ে টেবিলে এসে বসে। নিজেই প্লেটে খাবার নিয়ে ওহির মুখের কাছে খাবার ধরে। আফরার সামনে আশ্বিনের এই কান্ড ওহি কিছুটা লজ্জা পায়। আশ্বিনের অবশ্য তা নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। আফরা খেতে খেতে তাদের দিকে তাকিয়ে,
–আমি যে এখানে বসে আছি এই খেয়াল কি তোর আছে আশ্বিন? বেচারী আমার জন্য লজ্জা পেয়ে খেতে পারছে না।
আফরার কথায় আশ্বিন তার দিকে তাকিয়ে,
–এতোই যখন বুঝিস তাহলে এখনও কাবাবে হাড্ডি হয়ে বসে আছিস কেনো? যা টিভি দেখতে দেখতে খাবার খেতে থাক।
আফরা আশ্বিনকে একটা ভেংচি কেটে চলে আসে। এদিকে ওহি তাদের কথায় মাথা নিচু করে আছে। কি লজ্জার বিষয়। আশ্বিন না আসলেই! তবে আশ্বিনের এই নিজ হাতে খাইয়ে দেওয়া বেশ ভালো লাগল তার।
–চলবে(ইনশাআল্লাহ)