এক মুঠো অনুভূতি পর্ব-২৭+২৮ এবং শেষ পর্ব

0
665

#এক_মুঠো_অনুভূতি💖
লেখিকা- তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২৭+২৮(শেষ)

–এই শুক্রবার আফরাকে ছেলে পক্ষ আংটি পড়াতে আসছে। কথাটা জানার পরেও তোমার মাঝে কোন রিয়েকশন নেই, ফাইজা?
আশ্বিন কিছুটা অবাক হয়েই ওহির দিকে তাকিয়ে আছে। ওহি আশ্বিনের পাশে বসে আপনমনে ফোন দেখছে যেন আশ্বিনের কোন কথাই তার কানে যাচ্ছে না। সে ফোন দেখতে দেখতে হঠাত মুখ তুলে আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে,
–দেখুন তো, এই জামাটা আমি আফরা আপুর আংটি বদলের দিন পড়লে আমাকে কেমন লাগবে?

ওহির কথায় আশ্বিন ভ্রু কুঁচকে তার দিকে ফিরে তাকায়। কোথায় এখন তার নিজের আফরার জন্য টেনশন করার কথা। ওহি তো বলেছিলো ওসমানের মনে আফরার জন্য সুপ্ত অনুভূতিকে প্রকাশ করাতে সাহায্য করবে। তাহলে এখন এমন আচরণ করছে কেনো?
–ফাইজা, কি হয়েছে তোমার? তুমি কোন কিছু সিরিয়াস ভাবে নিচ্ছো না কেনো?
–কি করলাম আমি?
–কি করলে তুমি? আফরার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ফাইজা। কাল ছেলে পক্ষ আংটি পড়িয়ে দিলে এই বিয়ে আর ভাঙা যাবে না। কারণ এখানে আফরার পাশাপাশি আঙ্কেলের সম্মানও জড়িয়ে আছে।
–আমি জানি তো আশ্বিন। আর আমরা এই বিয়ে ভাঙবো না। কারণ, আফরা আপুর সাথে আমার ওসমান ভাইয়ারই বিয়ে হচ্ছে।

আশ্বিন ওহির কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে,
–কি বললে তুমি?
–হুম। এইসব ভাইয়ার প্ল্যান ছিলো। ভাইয়া সেদিন বাবাকে বলেছিলো সে একজন মেয়েকে পছন্দ করে। কিন্তু মেয়েটার ফ্যামিলি এখন তার বিয়ের চিন্তাভাবনা করছে। ব্যাস, বাবা ভাইয়ার কাছে ঠিকানা নিয়েই চলে যায় আফরা আপুর বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। বাকিটা তাদের মাঝে কথাবার্তা দিয়ে সব ঠিকঠাক হয়েছে।
–এতকিছু হয়ে গেলো অথচ আমি এখন এসব জানতে পারছি?
ওহি আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দেয়। আশ্বিন রেগে তার দিকে তাকিয়ে,
–অথচ আফরা এই কদিন কি পরিমান মন খারাপ করে ছিলো তুমি জানো? দাঁড়াও আফরাকে এখনই আমার বলতে হবে।
–আরে না না। ভাইয়া বলেছে এটা সারপ্রাইজ রাখার জন্য। আর দুদিন পর তো জানতেই পারবে। তাই না? আমরা বরং ডেকুরেশন প্ল্যান করি।
ওহি কথাটা বলে আশ্বিনের হাত ধরে ভার্সিটির ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আসে।
———————-

আফরা ভার্সিটি থেকে বাসায় আসার পথে ওসমানকে দেখতে পেয়ে থমকে যায়। এই কদিন তাকে ভুলে যাওয়ার হাজারো চেষ্টার করেও কোন লাভ হয়নি তার। সে ওসমানের থেকে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিতেই ওসমান তাকে ডেকে উঠে তার কাছে এসে,
–কেমন আছেন আফরা? ওহি বললো আপনার নাকি বিয়ে?
–হুম। এই শুক্রবার আংটি বদল।
–বাহ! তো আমাকে ইনভাইট করবেন না? নাকি আমার কথা ভুলেই গিয়েছেন?
ওসমানের কথায় আফরা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে,
–ভুলিনি। আপনাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব না। যাই হোক, ওহির কাছে কাল আপনাদের সবার জন্য ইনভাইট কার্ড দিয়েছি আমি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সব ঠিকঠাক হয়েছে তাই কোনকিছু খেয়াল নেই আমার।
–হুম। এতো তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করছেন শুনে অবাক হয়েছিলাম। ভালোই হলো, আপনার বিয়েতে সবাই অনেক আনন্দ করতে পারবে।
আফরা মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। বিয়েটা তার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে। সব যেন অবাস্তব, ঘুম ভেঙে গেলেই যার কোন অস্তিত্ব থাকবে না।
ওসমান আফরার অবস্থা দেখে মনে মনে হেসে যাচ্ছে। যদিও সে ভালো করেই জানে, আফরা সত্যিটা জানার পর তার উপর ভয়ংকর রেগে থাকবে। কিন্ত সেই রাগ ভাঙানোর পদ্ধতি জানা আছে তার।
–ঠিক আছে তাহলে, শুক্রবার দেখা হচ্ছে। আফরা, আপনার জন্য এমন কিছু উপহার নিয়ে আসবো যা আপনাকে চমকে দিবে।
–মানে?
–মানে শুক্রবার দেখতে পারবেন। একটু অপেক্ষা করুন। অপেক্ষার ফল কিন্ত মিষ্টি হয়।
ওসমান কথাটা বলে আফরাকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। আফরা অবাক হয়ে ওসমানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।

এদিকে,

আশ্বিন ওহির হাত ধরে শপিং মল ঘুরে যাচ্ছে। আফরার আংটি বদল উপলক্ষে দুজন মিলে সেইম কালারের ড্রেস কিনেছে। আশ্বিনের জন্য ওহি খুব সুন্দর একটি পাঞ্জাবী পছন্দ করে দিয়েছে।
মেয়েটা খুব যত্ন করে আশ্বিনের জন্য কেনাকাটা করছে দেখে আশ্বিন মনে মনে অনেক খুশি। সে নিজেও ওহির জন্য শাড়ি চুড়ি মালা সিলেক্ট করে দিচ্ছে।

ওহি একের পর এক চুড়ি হাতে পড়ে আশ্বিনকে দেখাচ্ছে আর আশ্বিন সবগুলোই সুন্দর বলে যাচ্ছে।
–আশ্বিন আপনি তো সবগুলো চুড়িই সুন্দর বলছেন। তাহলে আমি কোনটা কিনবো?
–তোমার হাতে সবগুলো চুড়ি সুন্দর লাগলে আমি আর কি বলবো ফাইজা? এক কাজ করো সবগুলোই নিয়ে নাও।
ওহি কোমরে হাত রেখে ভ্রু কুঁচকে আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে,
–আপনার মাথা ঠিক আছে তো আশ্বিন? বেশি কথা না বলে আপনার কাছে কোনটা বেশি ভালো লেগেছে সেটা বলুন।
ওহির কথায় আশ্বিন হেসে উঠে চুড়িগুলোর মাঝে একটা মেরুন রঙের সুন্দর চুড়ি সিলেক্ট করে দেয়। ওহি চুড়িগুলো হাতে নিয়ে,
–আমারও এই চুড়িগুলোই পছন্দ হয়েছিল। আপনার আর আমার পছন্দ এক রকম আশ্বিন।
ওহি আর কথা না বাড়িয়ে চুড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে আর আশ্বিন মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে ওহির দিকে। খুব সাবধানের মাঝেও ওহিকে মায়াবতী লাগে আশ্বিনের।
এসব ভাবতে ভাবতেই ওহিকে নিয়ে অন্য দোকানে চলে আসে আশ্বিন।

ওহি খুব মনোযোগ দিয়ে আশেপাশের সবকিছু দেখছিলো তখন আশ্বিনের ফোনে কল আসায় সে ওহির সামনে থেকে কিছুটা সরে গিয়ে কল রিসিভ করে।
–আশ্বিন ওই জামাটা কেমন?
ওহি কথাটা বলে পিছনে ফিরে আশ্বিনকে দেখতে না পেয়ে তাকে খোঁজার জন্য দোকান থেকে বেরিয়ে পড়ে। আশেপাশে কোথাও আশ্বিন নেই। ওহি এদিক সেদিক ভালোভাবে খেয়াল করে, আশ্বিনের খোঁজে অস্থির হয়ে পড়ে। এই অল্প সময়ের মধ্যেই কোথায় চলে গিয়েছে সে? টেনশনে ওহির মাথা বন্ধ হয়ে আসছে, এখন কি করবে সে? আশ্বিন তো তাকে না বলেই চলে যাওয়ার কথা না!
তখনই কানে ভেসে আসে পরিচিত এক কন্ঠস্বর,

–এই চশমা!

মুহূর্তেই থমকে যায় ওহি। ধীরে ধীরে পিছনে ফিরে আশ্বিনকে দেখতে পায়। ওহি আর আশেপাশে খেয়াল না করেই দৌঁড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। আশ্বিনও আর কথা না বাড়িয়ে তাকে আগলে ধরে। ওহি এখন ভয়ে কান্না শুরু করেছে।
–আশ্বিন, আপনি কোথায় চলে গিয়েছিলেন? আমি তো ভেবেছিলাম আপনি আমাকে রেখেই চলে গিয়েছেন।
আশ্বিন শক্ত করে ওহিকে ধরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে,
–শান্ত হও ফাইজা। আমি আছি তো এখানে, দেখো কোথাও যাইনি।
এই হাত তো আমি ছেড়ে যাওয়ার জন্য ধরিনি, চশমা। ভয় নেই, তোমায় ছেড়ে যাচ্ছি না আমি।
ওহি কিছুটা শান্ত হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে,
–আপনি কোথায় চলে গিয়েছিলেন? আমি আপনাকে কতক্ষণ ধরে খুঁজে যাচ্ছি।
–মা ফোন দিয়েছিলো তাই কথা বলতে গিয়েছিলাম। এর মাঝেই দেখি তুমি নেই, আমিও তো তোমায় আশেপাশে খুঁজে যাচ্ছি।
আশ্বিনের কথায় ওহি এতোক্ষণে তার দিকে খেয়াল করে। আশ্বিন যে তাকে দেখতে না পেয়ে আশেপাশে পাগলের মতো খুঁজে বেরিয়েছে সেটা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ওহি আর কথা না বারিয়ে তার ওরনা দিয়ে আশ্বিনের কপাল মুছে দেয়। আশ্বিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
–চলো বাসায় যাবো। ভয় পাইয়ে দিয়েছো আমায়। আমাকে চিন্তার মাঝে রাখা তোমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে ফাইজা। তোমার একটা ব্যবস্থা আমি করছি, দাঁড়াও।
ওহি আশ্বিনের কথায় মুচকি হেসে তার হাত ধরে শপিং মল থেকে বেরিয়ে আসে।
সে ভালোভাবেই জানে, আশ্বিন তার কষ্ট পাওয়ার মতো কোন কাজই করবে না।

পরন্ত বিকেল, ভালোবাসার মানুষের হাতের উপর হাত রেখে হেটে যাচ্ছে আশ্বিন আর ওহি। এগিয়ে যাচ্ছে নতুন এক পথ চলায়, যেখানে অনুভূতি দখল করে আছে দুজনের।
——————

বাড়ি ভর্তি মেহমান। আফরার বাবা মেহমানদের দেখাশোনার কাজে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পর হয়তো চলে আসবে ছেলেপক্ষ।
আফরার ঘরে বসে আছে আশ্বিন আর রোদ্দুর। দুজনেই এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে আফরার দিকে। লাল রঙের একটি শাড়ি পড়ে খুব সুন্দর করে সাজগোজ করে বসে আছে আফরা। সকাল থেকেই সে চুপচাপ। আশ্বিন আর রোদ্দুর হাজার চেষ্টা করেও মন ভাল করতে পারছে না তার।
–এখন তো একটু স্বাভাবিক ভাবে থাক। বিয়ে তো হয়ে যাচ্ছে না, শুধু আংটি পড়াবে আজ। এমন ভাবে শোক পালন করছিস যেন এটা কোন ম/রা বাড়ি।
রোদ্দুরের কথায় আফরা মুখ তুলে তাকায় তার দিকে। কিছুতেই কোনকিছুই ভালো লাগছে না আফরার। সে হাজার বার চেষ্টা করেছে স্বাভাবিক ভাবে থাকার জন্য কিন্ত সম্ভব হচ্ছে না। আশ্বিন তার অবস্থা বুঝতে পেরে আফরার সামনে এসে একটা চেয়ারে বসে,

–আফরা তোর মনে আছে? কিন্ডারগার্ডেনে যখন আমাদের প্রথম পরিচয় হয়, আমরা তখন দুজন দুজনের শ/ত্রু ছিলাম। এমন কোনদিন বাদ ছিলো না যখন ক্লাসে তোর আর আমার ঝগড়া হয়নি। ছোট থেকে ছোট বিষয়ে আমরা গিয়ে একে অপরের নামে মিসকে বিচার দিয়েছি। স্কুলের সবাই জানতো আমাদের শ/ত্রু/তার গল্প। কিন্ত তারপর কি হলো?
দুই সপ্তাহ তুই স্কুলে আসিসনি, তখন আমি তোকে মিস করতে শুরু করেছিলাম। তারপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারি তোর মা মা/রা যাওয়ায়…।
দু’সপ্তাহ পর তুই স্কুলে আসলেও আর আগের মত ছিলি না, দুষ্ট প্রকৃতির মেয়েটা হঠাত করেই শান্ত হয়ে গিয়েছিল। তোর এই শান্ত ভাব আমি মেনে নিতে পারিনি। তাই তোর কাছে গিয়েছিলাম কারণ জানতে। তখন তুই আমার কাছে কি বলেছিলি মনে আছে তোর?

–হুম। বলেছিলাম আমার মা অনেক দূরে চলে গিয়েছে আশ্বিন। আমার মাকে এনে দাও, আমি আর কখনো দুষ্টুমি করবো না।

আফরার কথায় রোদ্দুর আর আশ্বিন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। আফরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুচকি হেসে,

–তার পর তুই আমাকে তোর বাসায় নিয়ে গিয়েছিলি আশ্বিন। তোর মায়ের কাছে নিয়ে বলেছিলি, আফরা এটা আমার মা। আজ থেকে আমার মা তোমারও মা। যতদিন পর্যন্ত তোমার মা ফিরে না আসবে, আমার মাকে তুমি মা ডাকবে। আমাদের বন্ধুত্ব সেদিন থেকেই শুরু হয়, তাই না আশ্বিন? আমি সেদিন নতুন এক পরিবার পেয়েছি, ভাই পেয়েছি, বন্ধু পেয়েছি। যে সারাজীবন আমার কষ্টগুলো ভাগ করে নিয়েছে, সারাজীবন আমার পাশে থেকেছে।

আফরা কথাগুলো বলে আশ্বিনকে জড়িয়ে ধরে। আশ্বিন তার মাথায় হাত রেখে,
–তাহলে আজও বিশ্বাস রাখ আমার উপর। তোর জীবনের এতো বড় সিদ্ধান্তে, খোঁজখবর নিতে আমি কোন গাফিলতি করবো না। আমার উপর বিশ্বাস রেখে এখন হাসিখুশি থাক। এই বিয়ে তোর ভালোর জন্যই হচ্ছে, কারণ তোর খুশিই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আফরা।
আফরা আর কথা না বাড়িয়ে মাথা নেড়ে হ্যা বোঝায়। রোদ্দুর এসে আফরাকে ধরে শান্তনা জানায়।

আশ্বিন আর রোদ্দুর দুজন মিলে আফরাকে ছেলে পক্ষের সামনে নিয়ে আসে। আফরা মাথা নিচু করে থাকায় সামনে কাউকে দেখতে পারছে না। ওহি ততক্ষণে দৌঁড়ে এসে আফরার হাত ধরে,
–আফরা আপু তোমায় খুব সুন্দর লাগছে। ভাইয়া তো আজ দেখেই জ্ঞান হারাবে।
ওহির কথায় আফরা কিছুটা অবাক হয়েই ওহির দিকে ফিরে তাকায় তারপর সামনে তাকিয়ে বাবার পাশে ওসমানকে দেখে চমকে উঠে। কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে কি হচ্ছে এসব বুঝতে পেরে আশ্বিনের দিকে ফিরে তাকায় আফরা। আশ্বিন আর রোদ্দুরের মুখের হাসিই বলে দিচ্ছে যে তারা দুজন আগে থেকেই সব জানতো।
–তোরা আগে থেকেই সব জানতি?

আফরার প্রশ্নে আশ্বিন আর রোদ্দুর কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওহি সামলে নিয়ে,
–আহা আপু, এসব কথা পরে নাহয় জানা যাবে। আগে চলো তো সবাই অপেক্ষা করছে।
ওহি আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আফরার হাত ধরে সামনে যেতে যেতে পেছনে ফিরে একবার আশ্বিনের দিকে তাকায়। তার দেওয়া পাঞ্জাবীতে খুব সুন্দর লাগছে আশ্বিনকে।
অপরদিকে, আশ্বিন ইশারায় ওহিকে বোঝায় তাকে খুব সুন্দর লাগছে। ওহির ইশারা বুঝতে পেয়ে একটা লাজুক হাসি দিয়ে চলে যায়।

আংটি বদলের পর খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই যে যার মত গল্পে ব্যাস্ত। আফরা আর ওসমানকে আশ্বিন ছাদে রেখে এসেছে। এই মূহুর্তে দুজনের কথা বলে সব মিটমাট করে ফেলাই ভালো হবে। তবে, ওহির এই অনুরোধের জন্য কম কথা শুনতে হয়নি আশ্বিনকে। এর হিসাব ওহির কাছে সে ঠিকই আদায় করবে।

-মনে মনে আমাকে বকে আর লাভ নেই আশ্বিন। আমার জন্য নাহয় একটু বকা খেয়েছেন। তো কি হয়েছে? আমরা আমরাই তো নাকি?
–হ্যা।
আশ্বিন রেগে কথাটা বলে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। ওহি আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে,
–আশ্বিন আজকের চাঁদটা খুব সুন্দর তাই না?
ওহির কথায় আশ্বিন কিছু না বলে চাঁদের দিকে ফিরে তাকায়। ওহি সেই সুযোগে আশ্বিনের কাধে মাথা রাখে। ওহির এরূপ কাজে আশ্বিনের রাগ ভেঙে মুহূর্তেই হেসে উঠে ওহির মাথার উপর আলতো করে তার মাথা রাখে।

সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ওসমান আর আফরার বিয়ের তারিখ খুব শীঘ্রই দেওয়া হয়। সবাই যখন তাদের বিয়ের কথায় খুশি তখনই ওহির বাবা সবার উদ্দেশ্যে একটি ঘোষণা দেয়,
–আমার ছেলে ওসমানের সাথে আফরার বিয়ের খবরে সবাই অনেক খুশি। আর এই খুশির মুহূর্তে আমি আর একটি খুশির সংবাদ দিতে চাই।

ওহির বাবার কথায় ওহি সহ সবাই কিছুটা অবাক হয়। ওহি একবার ওসমান আর একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে কিসের সংবাদ সেটা বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু বুঝতে না পেরে আবার বাবার দিকে ফিরে তাকায়।
–ওসমানের বিয়ে ঠিক করতে আসার পর আমার মিস্টার আকাশ চৌধুরীর সাথে পরিচয় হয়। তাদের সাথে কথায় কথায় আমাদের মাঝে একটি ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব তৈরি হয় যার ফল স্বরূপ আমরা তা আত্মীয়তার মাধ্যমে গড়তে চাইছি। মানে, সহজ কথায় যাকে বলে আমি আশ্বিনের সাথে আমার মেয়ে ওহির বিয়ের প্রস্তাবে আমি সম্মতি জানিয়েছি। ওহির পড়ালেখা শেষ হওয়ার পর একটি ভালো দিন তারিখ দেখে তাদের দুজনের বিয়ের কাজ সম্পন্ন হবে।

ওহির বাবার কথা শুনে ওহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোন কিছুই তার কান পর্যন্ত যাচ্ছে না, শুধু কানের কাছে বেজে যাচ্ছে তার আর আশ্বিনের বিয়ে!
ওহি ধীরে ধীরে আশ্বিনের দিকে তাকিয়েই দেখে আশ্বিন স্বাভাবিক ভাবেই তার দিকে তাকিয়ে আছে। ওহি অবাক হয়ে,
–আশ্বিন এসব কিভাবে? কখন হলো?
আশ্বিন মুচকি হেসে ওহির কাছে এসে,
–বলেছিলাম না, আমার রেজাল্টের রেকর্ড ভাঙার জন্য খুব শীঘ্রই সারপ্রাইজ পাবে। এই নাও তোমার সারপ্রাইজ!
অনেক অভিনন্দন মিসেস আশ্বিন চৌধুরী। খুব শীঘ্রই আমাদের হাত এক হতে যাচ্ছে, তুমি আমার পারমানেন্ট হতে যাচ্ছো।

ওহি যেন অবাকের শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছে। কি বললো আশ্বিন এসব? মানে সে নিজে থেকে ওহির বাবাকে তাদের বিয়ের কথা বলেছে? বাবা রাজি হবে কিনা যে ভয় এতদিন ধরে ওহির মাঝে বাস করছিলো, সেই ভয় মুহূর্তেই হারিয়ে যাওয়ায় ওহি স্তব্ধ হয়ে আছে।
আফরা আর জাইমা এসে তাদের দুজনকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। ওহি আর আশ্বিন শুধু চেয়ে আছে একে অপরের দিকে।
——————–

কয়েক বছর পর,

ওহির অনার্স কমপ্লিট করার পর আজ তার আর আশ্বিনের বিয়ে। বিয়েটা হবে ওহির বাসায় তাই সকাল থেকেই বাসার সবাই এই সেই কাজ নিয়ে ব্যস্ত।
ওহি সুন্দর করে সেজে তার রুমেই বসে আছে। এই দিনটা স্বপ্নের মতো লাগছে তার কাছে। এক মুঠো অনুভূতি নিয়ে দুজনের মাঝে যে বন্ধন তৈরি হয়েছিল তা আজ পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। জাইমা এসে ওহির পাশে বসে,
–আঙ্কেল এই সাতদিন ধরে আমাদের যেভাবে কাজের মাঝে লাগিয়ে রেখেছে ওহি। আমার মনে হচ্ছে দশ কেজি ওজন কমে গিয়েছে এই সাত দিনেই।
–তো কি হয়েছে? তোর আর রোদ ভাইয়ার বিয়ের সময় কি আমি কম কিছু করেছিলাম? তখন তো খুব আনন্দে ছিলি তুই।
জাইমা ওহির কথায় একটা ভেংচি কাটে। তখনই আফরা একটা পিচ্চি কোলে নিয়ে ওহির রুমে এসে,
–ওহি তুমি একটু ওয়াসিফ’কে তোমার কাছে রাখবে? আমার কতো কাজ আছে, কিছুই করতে পারছি না।
–হুম অবশ্যই। বাবাই এসো ফুপির কাছে।
ওয়াসিফ আর কথা না বলে ওহির কোলে এসে বসে। সবাই বলে, ওসমানের পিচ্চি ঠিক ওসমানের মতোই হয়েছে। সবার আদরের ওয়াসিফ।

কিছুক্ষণ পরেই বাহির থেকে শব্দ আসতে থাকে বরপক্ষ চলে এসেছে। ওহি কথাটা শুনতেই বুকে ধক করে উঠে। সত্যিই কি আজ তাদের বিয়ে? কথাটা মনে হতেই এক রাশ মিশ্র অনুভূতি কাজ করেছে তার।

স্টেজে রোদ্দুর আর রাফিনের পাশে বসে আছে আশ্বিন। রাফিন ওহির বিয়ে উপলক্ষে তার স্ত্রী জুঁইকে নিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। সবাই যখন আশ্বিনের সাথে কথায় ব্যস্ত তখনই জুঁই আফরা আর জাইমা মিলে ওহির মাথার উপর একটা ওরনা ধরে তাকে নিয়ে আসে স্টেজের কাছে।
আশ্বিন মুগ্ধ নয়নেই চেয়ে আছে তার ফাইজার দিকে। ওহি আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে একটা লাজুক হাসি দিয়ে মাথা নামিয়ে নেয়। আশ্বিন স্টেজ থেকে নেমে ওহির হাত ধরে হাতে একটা চুমু খেয়ে তাকে স্টেজে নিয়ে যায়। সবাই একসাথে হেসে উঠে হাত তালি দিতে থাকে। ওহি লাজুক হেসে সবার থেকে মুখ ফিরিয়ে আশ্বিনের দিকে ফিরে দেখে আশ্বিন তাকিয়ে আছে তার দিকে।

এই বছরগুলো আশ্বিন ছায়ার মতো পাশে থেকেছে ওহির। তার ছোট খাটো সকল প্রয়োজনে সব সময় আশ্বিন পাশে ছিলো। সেই প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত আশ্বিনের প্রতি ওহির নেই তার কোন অভিযোগ। শুধু আছে এক মুঠো অনুভূতি থেকে পূর্ণতার অনুভূতি।
দুজন তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে আর স্টেজে বেজে চলেছে একটি গান,
“তুমি আমার অনেক শখের
খুঁজে পাওয়া এক প্রজাপতি নীল,
আমি রংধনু রঙে সাজিয়েছি
দেখ এক আকাশ স্বপ্নীল।”

@@@সমাপ্ত@@@