#এক_মুঠো_বুনোপ্রেম
পর্ব ২
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
রাজধানীতে এক খ্যাতনামা প্রাইভেট ভার্সিটির ক্লাশরুমে গোল হয়ে বসেছে ভার্সিটির কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিরিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট এর কিছু স্টুডেন্ট। আর্শি, আরাধ্যা, অগ্র, নিহু ও পূর্ণ। এরা পাঁচজন মিলে এক সার্কেল। সবাই প্রাণের বন্ধু। এরা সবাই কলেজ জীবন থেকেই একসাথে পড়ে আসছে। শুধু পূর্ণ বাদে। পূর্ণর সাথে এদের পরিচয় ভার্সিটিতে এসে। আর্শির মতোই এরা সবাই ধন্যাঢ্য পরিবারের সন্তান, শুধু পূর্ণ বাদে। গ্রাম থেকে আসা পূর্ণ বাবার রিটায়ারমেন্টের টাকায় ভর্তি হয়েছে এই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। পাশে নিজে টিউশন করে টিউশন ফি মিটিয়ে এই প্রাইভেট ভার্সিটি তে পড়াশুনা করে। ভীষন ই মেধাবী পূর্ণ ভার্সিটির বন্ধুদের এসাইনমেন্ট করেও টাকা কামাই করে।
বন্ধুরা যারা এসাইনমেন্ট করতে পারে না, তাদের নির্ভরযোগ্য ভরসা হলো পূর্ণ। সাথে রাতের বেলা একটা পার্ট টাইম জব ও করে পূর্ণ। আর্শি বাদে সবার এসাইনমেন্ট করে দিচ্ছে পূর্ণ । সবার দৃষ্টি পূর্ণের দিকে আর পূর্ণের দৃষ্টি তার ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে নিবদ্ধ। সবাই তাদের চোখের দৃষ্টি লাগিয়ে পূর্ণকে জোর দিচ্ছে তাড়াতাড়ি তার কাজ শেষ করার জন্য। এজন্য পূর্ণ স্বাবভাবিক ভাবেই বেশ চাপ বোধ করছে, আর দ্রুত হাত চালাচ্ছে। আর আর্শি মাঝে মাঝেই তার হাতে থাকা এসাইনমেন্টের হার্ডকপিটা উল্টে পালটে দেখছে, যেটা তাকে এষ করে দিয়েছে। ঘড়িতে সময় সকাল নয়টা ছুঁইছুঁই। দশটায় ই এসাইনমেন্ট সাবমিট করতে হবে। তাই পূর্ণ দ্রুত তার কিবোর্ড চালাচ্ছে, যেনো সময়ের আগেই সব শেষ করতে পারে।
ওদিকে পূর্ণ বাদে বাকি চারজন গল্প শুরু করলো।
“এই পৃথিবীটা বড়ই আজব! তার থেকে আজব পৃথিবীর এই মানুষগুলো, কেউ যাকে চায়, তাকে পায়না! আবার কেউ যাকে পায় তাকে সে চায়ই না। কেনো এমন হয়রে? কেনো এমন হয়? হোয়াই?”
উদাস বদনে কোনো অনির্দিষ্ট দিকে তাকিয়েই আরাধ্যা একথা বলে উঠলো আনমনে।
” তুই কি আমাকে মিন করে এসব ফিলোসফার টাইপের কোটেশন বলছিস স্যানোরিটা?”
আর্শি চশমার ফাঁক দিয়েই জ্বলে উঠলো ওর সবচাইতে প্রিয় বান্ধবী আরাধ্যার দিকে।
আরাধ্যা কে সে স্যানোরিটা নামেই ডাকে, আদর করে।
আরাধ্যা বরবরই খুব কুল মাইন্ডের।
আর্শির জ্বলে উঠা চোখকে অগ্রাহ্য করে আরাধ্যা মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললো,
” না, তোকে না, আমি তোর ফেলে দেওয়া রেড রোজ গুলোকে কে উদ্দ্যেশ্য করে বলছি! রেড রোজগুলো কি দোষ করেছিলো যে, ওদেরকে একবার এক্সেপ্ট করা হলো, তারপর আবার অযত্নে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলা হলো?”
আর্শি নিজের হয়ে আত্মপক্ষ স্বমর্থন করতে লেগে গেলো,
” ফুলগুলো না নিলে এষ তখন হয়তো কেঁদেই দিতো, তাই নিয়েছিলাম, পরে ডিপার্টমেন্ট এ এসে যখন চিন্তা করলাম, আফটার অল আমি বিবাহিতা, আর এক পুরুষের স্ত্রী হওয়া স্বত্ত্বেও আমি যদি আরেক পুরুষের কাছ থেকে ফুল নেই, তাও রেড রোজ, তাহলে সেটা কি কোনো ভালো মানুষের বৈশিষ্ট্য হবে?”
আর্শির একথা শুনে না চাইতেও পূর্ণ হো হো করে হেসে বলে উঠলো, আবার থেমে গিয়ে এসাইনমেন্ট করায় লেগে গেলো। আর অগ্র বলে উঠলো,
” কেউ কেউ নিজের জামাই না থাকা স্বত্ত্বেও নিজেকে বিবাহিতা ভাবে আর কেউ কেউ জামাই থাকতেও নিজেকে অবিবাহিতা ভাবে! তুই ঠিকই বলেছিস রে আরাধ্যা দুনিয়ার মানুষজনের রুপ এতো অদ্ভূত কেন রে?
অগ্রের একথা শুনে নিহু বলে উঠলো,
” অগ্র, তুই কি আমাকে মিন করে এটা বললি?”
অগ্র বলে উঠলো,
” না মানে?…”
নিহু রাগান্বিত স্বরে বললো
” না মানে কি রে? না মানে কি? তোদেরকে কে বলেছে যে আমি বিবাহিতা? ও আই আন্ডারস্টুড.., নেহাল তোদেরকে বলেছে যে, আমরা বিয়ে করেছি? নেহালই তো! আর কে বলবে? ঐ ডিসগাস্টিং টার সাথে কেন যে রিলেশন করেছিলাম, যারে পায় তারেই বলে বেড়ায় যে আমাকে সে বিয়ে করেছে! আমি রিয়েলি বিয়ে করি নিরে বন্ধুসকল, অই নেহাল এত বেশি পযেসিভ যে, ধ্যাৎ ভাল্লাগেনা! ”
অগ্র ওকে থামালো,
” আচ্ছা, মেনে নিলাম যে তোরা বিয়ে করিস নি, নেহাল তোকে হারানোর ভয়ে সবাইকে বলে বেড়ায় যে, তোরা বিবাহিত, বাস্তবে তোরা যাস্ট লাভার কাপল। তোর কথার পেছনে লজিক আছে, কিন্তু আমি না আর্শির কথার পেছনে কোনো লজিক ই খুঁজে পাই না, ও মনে হয় আগের জন্মে বিয়ে করেছিলো, আই মিন যাদেরকে বলে জন্মেশ্বর! আর এই জন্মে ও আগের জন্মের সেগুলো স্বপ্ন দেখে আর স্বপ্ন দেখে এই বর্তমান জন্মটাকে ও বরবাদ করে দিচ্ছে। আর এষের মতো একটা ব্রিলিয়ান্টকে ও চরকির মতো ঘুরাচ্ছে ওর ড্রামা দিয়ে। চোখে পড়ে একটা মোটা চশমা, তার উপর মনে থাকে না একটা কিচ্ছু, মাথার মধ্যে শুধু গোবর আর গোবর, আএ এই মেয়েকে যে এষ নামের সেই জেন্টেলম্যান লাইক করেছে, এটা ওর ভাগ্য! ”
আর্শি অগ্রের এতগুলা লেকচারের বিপরীতে বেশ ক্ষেপে গিয়েই বলে উঠলো,
” অবজেকশন! আমি রিয়েলি ই বিবাহিত! লেকচার ভালোই দেওয়া শিখেছিস। যেদিন সত্যি সত্যি আমার প্রহ এসে পড়বে, সেদিন দেখবি, হি লাভস মি মোর দ্যান এনিওয়ান, এলস! এষ এর দিন তখন হবে শেষ! যখন দেখবে আমি বিবাহিতা তখন আমার পেছনে ঘুরাঘুরি ঠিকই বন্ধ করে দেবে! ”
সবাই ওর দিকে একযোগে বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে আছে দেখে আর্শি চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
” ওভাবে সবাই আমার দিকে কি দেখছিস? আই এম রিয়েলি ম্যারিড… ”
ওর কথার প্রত্তুত্তরে ওর চারজন বন্ধুই নিজেদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়ে একযোগে বলে উঠলো,
” ও স্যরি স্যরি, তুই রিয়েলিই ম্যারিড!”
আর্শি ওদের একযোগে একথা বলায় বেশ মনোক্ষূন্ন হয়ে সামান্য দূরে গিয়ে অপর দিকে মুখ মলিন করে বসে গেলো।
সেখানে বসে সে নিজের এসাইনমেন্ট টা দেখতে লাগলো! এসাইনমেন্টের দিকে তাকাতেই ও ক্ষণিক আগে ঘটে যাওয়া সবই ভুলে গেলো।
আর মনে মনে বলে উঠলো,
” কি আশ্চর্য! ছেলেটা কি দারুন করে আমার এসাইনমেন্ট টা করে দিয়েছে! আবার হার্ড কপিও করে দিয়ে গিয়েছে। ”
আর্শি দূরে চলে যাওয়ার পর আরাধ্যা, অগ্র, নিহু বসে আবার গল্প জুড়ে দিলো।
নিহু ফিসফিস করে বলে উঠলো অগ্রকে,
” এষ! আহারে! বেচারা এষ! আমেরিকা থেকে কম্পিউটার সফটওয়্যার এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে এসেছে, নিজের প্রাণের প্রিয়তমাকে এসাইনমেন্ট করে দেওয়ার জন্য! বেচারা ইচ্ছে করলেই কত বড় বড় কোম্পানির জব করতে পারে, আর সে কিনা আর্শির এসাইনমেন্ট করার জন্য দেশে পড়ে আছে! আর দেশে এসে নিজের ফুপির বাসায় এক রাতো সে থাকতে পারেনি আর্শির জন্য। কারন আর্শি ওকে থাকতে মানা করে দিয়েছে, ওদের বাড়িতে! ”
অগ্র বলে উঠলো,
” ওর জন্য তোর এত পুড়ে কেন রে সিস?”
উত্তরে নিহু বলে উঠলো,
” ওর জন্য আমার পুড়বে কেন? এখন তো আমার পুড়ছে ঐ রেড রোজগুলার জন্য, ঐ সময় তুই লালগোলাপ গুলো ঠিকই এক্সেপ্ট করলি আর ক্লাশরুমে এসেই তুই সেগুলো ডাস্টবিনে থ্রো মারলি কেন?”
ফিসফিস করা স্বত্ত্বেও দূরে বসে থাকা আর্শি আবার তা শুনে ফেললো, সে আবার আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলে উঠলো,
” আমি তখন সামান্য আলাভোলা হয়ে গিয়েছিলাম, তাই ফ্লাউয়ার গুলো নিয়ে নিয়েছিলাম, তাই বলে সেটা আমি মন থেকে নিইনি, আফটার অল আমি একজনের স্ত্রী, একজনের স্ত্রী হয়ে থাকার পর আরেকজনের কাছ থেকে রেড ফ্লাওয়ার নেওয়া আমার উচিত হয়নি, সে যতই আমার কাজিন হোক না কেনো? তাই ফেলে দিয়েছি। আই সুড স্টে লয়াল টু ওয়ার্ড মাই হাবি প্রহ!”
আরাধ্যা বলে উঠলো,
” তো, দোস্ত, কোনোদিন দেখালি না আমাদেরকে মিস্টার প্রহকে, কই সে? একদিনও তো দেখালি না! ”
এই প্রশ্ন শুনে আর্শির মাথাটা ধরে এলো। ভারি লেন্সের চশমা থাকা স্বত্তেও চোখের সামনের সব কিছু ঘোলাটে হয়ে এলো। শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। হাত পা থরথর করে কেঁপে সে ঠাস করে পড়ে গেলো ফ্লোরে!
.
.
আর্শি হসপিটালাইজড! বিছানায় লম্বালম্বি ভাবে শুইয়ে রাখা হয়েছে ওকে। ওর মাথার পাশে একটা চেয়ারে এষ বসে বসে শুধু ঘড়ি দেখছে। রাত নয়টা বাজে। এখনো আর্শি একটা কথাও বলেনি, খায়ও নি কিছু। আর্শির নিরব মুখপানে সে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। কি মায়া এ মেয়েটার মুখে কে জানে? এর মায়ায় পড়ে সে সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে এদেশে এসে রয়েছে। বাবা মা, ভাই বোন সবাই আমেরিকায় স্যাটেল হয়ে রয়েছে। প্রতিদিনই ওদের সাথে ঝগড়া করতে হয় তার, এ মেয়েটার জন্যই। বন্ধু বান্ধব সবাই বলে শেষ পর্যন্ত এক চশমাওয়ালীর প্রেমে পড়লি। তাও মাথায় গোবর। সব ভুলে যায় শুধু।
এষ মনে মনে আর্শিকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে উঠলো,
” ও মনোহারীনি, কি যাদু করেছো তুমি আমাকে? যেজন্য তোমার ঐ বোঁচা নাক আর ছোটো ছোটো চোখের মায়ায় আমি পড়েছি। তোমার অনাদর, অবহেলা আজ আমার পানাহার। তোমার দেওয়া অপমান আমার গলার মালা। আর এই মায়া এখন পাগলামীতে রুপ নিয়েছে। তোমাকে না দেখলে আমার একটা মুহূর্ত ও অসহ্য লাগে! আমি সারাদিন তোমার বাসার নিচে বা ভার্সিটির পাশেই ঘোরাঘুরি করি। এ কোন ধরনের বুনোপ্রেম? কে জানে? ”
এষ এসব মনে মনে বলছিলো আর নিজের অজান্তেই সে আর্শিকে বলে উঠলো,
” তুমি যেমনই হও না কেনো, লাভ ইউ মোর দ্যান মাই লাইফ আমার বনের রানী”
আর এতক্ষণ কেবিনের বাইরে রাখা একটা সোফায় ওর চার বন্ধু। সবার চোখে মুখে আতঙ্ক!
ওদের জন্যই ওদের প্রিয় বান্ধবীর এ দশা! মেয়েটার এত বড় অসুখ, তাও সে কোনোদিন তার বন্ধুদের একথা বলেনি। সবটাই লুকিয়ে রেখেছিলো।
চারজনের মনেই মনস্তাপের বিশাল পাহাড়।
ডাক্তার এসে বসে থাকা আর্শির বন্ধুমহলকে বললো,
“আপনারা হয়তো জানেন না পেইসেন্ট আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত? এটি একটি নিউরো ডিজেনারেটিভ রোগ যা সাধারণত ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে থাকে, এবং এটির কারনে ডিমেনশিয়া বা স্মৃতি শক্তির বিলোপ হয়ে থাকে । সাধারণ প্রাথমিক লক্ষণ হল সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি মনে রাখতে অসুবিধা ৷ রোগের অগ্রগতির সাথে সাথে, উপসর্গগুলির মধ্যে ভাষার সমস্যা, বিভ্রান্তি, সহজে হারিয়ে যাওয়া, মেজাজের পরিবর্তন , অনুপ্রেরণা হ্রাস , আত্ম-অবহেলা এবং আচরণগত সমস্যা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে । ধীরে ধীরে, শারীরিক ক্রিয়াকলাপ নষ্ট হয়ে যায়, শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। হঠাৎ ই অতিরিক্ত উদ্বেগ ওকে পুশ করার জন্য সে জ্ঞান হারিয়েছিলো। আমরা ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি। তো মিসেস অপরাজিতার সাথে আমার কথা হয়েছে উনি আসছেন। ”
বন্ধুদের সবার চোখই ভিজে উঠলো কথাগুলো শুনে। অনুশোচনায় বিদগ্ধ হলো সবাই।
কেনো তারা বান্ধবীকে উত্তেজিত করেছিলো? সে না হয় থাকলোই তার মিথ্যে জগত নিয়ে। সে নাহয় থাকলোই তার মিথ্যে জগতের মিথ্যে স্বামি প্রহ কে নিয়ে। কেনই বা ওরা খোঁচাতে গেলো? আর মেয়েটা ফল করলো?
এমন সময় মিসেস অপরাজিতা সেখানে প্রবেশ করলো। আর্শির এ অবস্থা দেখে অপরাজিতা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। আর্শি যেনো তার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। অপরাজিতার কাঁধে হাত রেখে এষ তাকে স্বান্তনা দিলো।
আর্শির বন্ধুরা সবাই এগিয়ে এলো।
” আন্টি স্যরি, আমরা না বুঝেই ওকে..”
” না, তোমাদের কোনো দোষ নেই। দোষ আমারই, আমি ওর এ রোগটাকে তেমন গুরুত্ব দেইনি, আম সো স্যরি আর্শি !”
(চলবে)