এক মুঠো বুনোপ্রেম পর্ব-২১+২২

0
12

#এক_মুঠো_বুনোপ্রেম

পর্ব ২১

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

ইনভেস্টিগেশন টিম অপরাজিতার ফ্ল্যাট থেকে চলে গিয়েছে ঘন্টা খানেক হলো। আর কয়েকটা ফোর্স চলে গিয়েছে ঢাকা শহরের প্রতিটি প্রবেশ পথে, উদ্দ্যশ্য আর্শি যেনো কোনোক্রমেই ঢাকার বাইরে যেতে না পারে। আর্শি হারানোর পাঁচ ঘন্টা হতে চললো, আর অপরাজিতা যেনো ক্ষণে ক্ষণে আরো বেশি করে ঢলে পড়ছে। কলিগরা তাকে যথাসাধ্য শান্ত করার চেষ্ঠা করছে।

এই অসুস্থ্যতার জন্যই ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা এয়ারলাইন্স হতে তাকে জরুরি ফ্লাইটে দেশে পাঠানো সমীচীন নয় বলে মনে করছে চিকিৎসক গণ।

অপরাজিতার মাথায় হাজার চিন্তার উদ্রেক।
.
.

আর এষ মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে বিছানায়। সে আর্শিকে নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবেছে। হাজারটা প্রশ্ন এসে মাথায় ভীড় করছে। ডায়রিটা আর পড়ারও সাহস হচ্ছে না। এতকাল যা কিছু এষ পাগলের প্রলাপ ভেবেছে বা শুধুই আর্শির স্বপ্ন ভেবেছে, তা শুধু স্বপ্ন নয়, তা বাস্তব। মাথার রগটা দপদপ করছে এষের। যেনো প্রবল রক্তচাপে সেটা এখনই ছিঁড়ে যাবে। প্রহ নামের অস্তিস্ত সত্যিই আছে কিনা এটা নিয়ে কোনোদিন গভীর করে ভাবেনি এষ। সত্যিই প্রহকে এক কাল্পনিক চরিত্র ভাবা এষ আজ আর্শির লেখনীতে প্রহের খোঁজ পেলো। আর্শি ডায়রিতে প্রহের প্রতি নিজের অনুরাগের কথা লিখেছে। ডায়রিটা আরো বেশি পড়তে গেলে হয়তো আর্শির প্রেম, পরিণয় এসব বিষয়ও পাওয়া যাবে। আর সেসব পড়ে সহ্য করতে পারবে না এষ।

এষের নিজের হাতের ধমনী কেটে ফেলতে কেমন জানি প্রবল ইচ্ছে জাগছে। তবে কেনো? কেনো সে নিজেকে কষ্ট দেবে? আর্শির প্রতি যে সে এত এগিয়েছে, তার পেছনে বাঞ্চা জুগিয়েছে তো অপরাজিতা!
অপরাজিতার প্রতি চরম ঘৃণা লাগলো এষের। কারন অপরাজিতা তাকে এত কিছু লুকিয়েছে আর্শির ব্যাপারে? অপরাজিতা ইচ্ছে করলেই এষকে আর্শির ছোটোবেলার প্রেম সম্পর্কে বলতে পারতো। কিন্তু সুকৌশলে অপরাজিতা সব লুকিয়েছে এষের কাছে। তার নিজের ফুপি যে এভাবে বিয়ে করেছে তাও তার জানা ছিলো না। কারন চাকরী পাওয়ার পর থেকে তার ফুপি অপরাজিতার খোঁজ কেউ রাখেনি, আর অপরাজিতাও নিজের জেদ বহাল রেখে অগোচরে ছিলো বহু বছর। আর প্রেম, বিয়ে এসব তো আরো পরের বিষয়! তবে একদিন হুট করে একটা মেয়ে(আর্শিকে) নিয়ে হাজির হলো অপরাজিতা নিজের বাবাবাড়িতে। সেদিনের কথা এষের মনে পড়ে। অহমিকার কারনে বাড়ি ত্যাগ করা অপরাজিতা ছোট্ট শিশুর ন্যায় কেঁদে কেটে আবার নিজের মেয়েকে নিয়ে পৈতৃক ভিটায় স্থায়ী হয়। অপরাজিতা আর্শিকে নিজের মেয়ে বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। কিন্তু অপরাজিতার সাথে আর্শির চেহারার নূন্যতম মিল না থাকায় কেউ তার কথা বিশ্বাস করতে পারে না। তারপরো তারা আর্শিকে সাদরে গ্রহণ করে একমাত্র অপরাজিতার কথা বিবেচনা করে। অপরাজিতার স্বামি যে একজন ভীনদেশী মানুষ তা ও কেউ জানতো না। বিবাহোত্তর জীবন সম্পর্কে কেউ কিছু জানতে চাইলে অপরাজিতা আর আবেগ দেখিয়ে অশ্রু বিসর্জন করে নির্বিকার থাকতো। তাই কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে তাকে আর বিব্রত করতো না। আর আর্শিকেউ কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে সদুত্তর পেতো না। আর্শি ছিলো চুপচাপ, কারো সাথে মেশতো না, কথাও বলতো না। আর ছোটো ছোটো জিনিস আর্শি ভুলে যেতো বলে সারা বছরই মেয়েটা অসুধের উপর চলতো। অপরাজিতা চাকরিতে চলে গেলেও অপরাজিতার মা ও ন্যানী রুকাইয়া সবসময় চোখেচোখে রাখতো আর্শিকে।
এষ আত্মভোলা হয়ে কখন একটা ছুড়ি হাতে নিয়েছিলো সে নিজেই জানে না।

তবে এবার সে ছুঁড়িটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে অপরাজিতাকে কল দিলো। আজ অপরাজিতাকে এষের মুখোমুখি হওয়া থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। কোন অধিকারে সে এষের জীবন নিয়ে এমন ছিঁনিমিনি খেললো? কেনো সে এতদিন প্রহর বিষয়টা গোপন করেছিলো? আর কেনই বা আর্শির সকল বিষয়?

এখন আর্শি যদি সত্যিই প্রহ র কাছে চলে যায় তবে তো এষের বেঁচে থাকার আর কোনো মানেই হয় না!

অপরাজিতার ফোনে রিং হতে লাগলো।

ওপাশে রিসিভ হলো, তবে অপরাজিতা নয়! অন্য কাউকে দ্বারা।

সে জানালো, অপরাজিতা হসপিটালে এডমিট। আর্শি হারিয়ে যাওয়ার খবরে তার প্রাণ ওষ্ঠাগত। সে আর কারো সাথে কথা বলতে স্বক্ষম নয়।

এষ নিজের মুষ্ঠি টেবিলে সজোরে আঘাত করলো।

অপরাজিতাকে সে পেলে এখন কিছু একটা করেই ফেলতো, ফুপি বলে আর গণ্য হচ্ছে না তার।

এষের ফোনে কল এলো পুলিশের ওসি আরমানের।

এষ স্ত্রস্ত হয়ে ফোন রিসিভ করলো। আর ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” হ্যালো ইন্সপেক্টর? এনি আপডেট?”

ওসি আরমান বলা শুরু করলো,

” স্যার আমরা আর্শির ফোন ট্রাক করেছি, তার নতুন নাম্বার বের করতে আমাদের অনেক বেগ পোহাতে হয়েছে। সে এখন বিমানবন্দরের ধারেকাছে কোথাও। অতি দ্রত তাকে বের করে ফেলা হবে। আর্শি ঘন্টাখানেক আগেই একজনের সাথে ফোনে কথা বলেছে। ডিউরেশন চার মিনিট বত্রিশ সেকেন্ড। নাম্বারটা কানাডার। ডোন্ট ওরি প্লিজ, ইউ উইল ট্রাই আওয়াফ বেস্ট”

এটুকু বলেই ওসি আরমান ফোন কেটে দিলো।

আবারো শত প্রশ্নের জাল বুনলো এষের মাথায়।

আর্শি এয়ারপোর্টে কি করে? সে কি বিদেশ চলে যাবে? আর সে কানাডার কার সাথে কথা বলেছে?
কি সে রহস্য? এষের মাথা ধরে আসলো। ঘাড়ের অসহ্য যন্ত্রণায় সে মুষড়ে পড়লে লাগলো।

মনে হলো যেনো সে মরেই যাবে।

এমন অবস্থায় সে নিজেই উপরালার কাছে একটা দোয়া করে বসলো,

” হে খোদা, আর্শিকে না পেলে আমি আত্মহ’ত্যা করতে চাই না, তবে আমি যেনো এমনিতেই মরে যাই, তুমি আমাকে এমনিতেই উঠিয়ে নিও প্লিজ”

এমন সময় কল এলো এষের ফোনে। এক অচেনা নাম্বার!
চিকন স্বরের একজন বলা শুরু করলো,

” এষ! আমি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি, আয়, আমাকে এসে নিয়ে যা জলদি, এখানে লেখা আছে, এয়ারপোর্ট রোড, উত্তরা”

এষ চেঁচিয়ে উঠলো, ” আর্শি?”

কলটা কেটে গেলো!

আর্শির কন্ঠস্বর শুনে এতক্ষণ এষের বুকের মধ্যে যে হৃদপাখি ছটফট করছিলো বের হওয়ার জন্য এখন তা থিতু হলো।

সে পালটা কল করলো আর্শিকে,

” তুই যেখানে আছিস, ঠিক সেখানেই থাক, এক পা ও নড়িস না আর্শি, আমি এক্ষুণি আসছি”

বলেই ছুটলো আর্শির দেওয়া ঠিকানার উদ্দ্যেশ্যে। তার আগে ওসি আরমানকে জানালো গোটা ঘটনা।
.
.

আর্শিকে পাওয়া গেছে সে খবরে অপরাজিতাও যেনো প্রাণ খুঁজে পেলো।

সে নিজেই এষকে কল করলো এবার।

এষ নিজেকে বহু কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করলো। আগে আর্শিকে হাতে পাওয়া যাক, তারপর সে অপরাজিতাকে প্রশ্নবানে বিদ্ধ করবেই করবে। ছাড় নেই তার!
.
.

রাত দশটা। চারপাশে সোডিয়াম লাইটের আলোর সাথে পূর্ণিমার চাঁদের আলো যোগ হয়েছে। এয়ারপোর্টের আউটডোর লাউঞ্জের ওয়েটিং সিটে বসে আসে আর্শি। পরনে ওয়েস্টার্ন গাউন, চোখে চশমার পরিবর্তে নীল লেন্স, মুখে সুনিপুন সাজসজ্জা! এষের ভীষণ ঈর্ষা হলো, এ কার জন্য সেজেছে আর্শি? এষের জন্যতো কখনো এভাবে সাজেনি? এষ স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো বিষাদকে সঙ্গী করে।
তবে এষকে দেখেই আর্শি ছুটে এসে সজোরে জাপটে ধরলো তাকে। এষের বুকে মুখ লুকিয়ে তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলে উঠলো,

” বিলিভ মি এষ , আমি এখানে কিভাবে এলাম তার কিছুই আমার মনে নেই, ইভেন আমি যে সকালে ঘুম থেকে উঠেছি, সেটুকুও আমার মনে নেই!”

এষ আর্শির লুকিয়ে রাখা মুখ বের করে, নিজের দুহাতের তালু দিয়ে সজোরে আর্শির গাল দুটো চেপে ধরে বললো,

” তুই আমাকে ভালোবাসিস আর্শি, বল তো, আমার চোখের পানে একদৃষ্টে চেয়ে বলতে হবে?”

এষের এমন প্রশ্নে ভড়কে গেলো আর্শি। সে নিজের চোখ ফিরিয়ে নিলো এষের দিক হতে। তারপর বলে উঠলো,

” ভালোবাসিই…”

এষ আর্শিকে দু হাতে থামিয়ে হা হা করে হাসা শুরু করলো।

” থাক! থাক! আর্শি আমি তোকে বিব্রত করতে চাই না, তুই যে এক বিরল মানসিক রোগে আক্রান্ত তা তুই জানিস? আমি জানি তুই জানিস না! তোর সবকিছু ভুলে যাওয়ার বাতিক আছে, জানিস? ”

আর্শি হতবুদ্ধের ন্যায় মাথা চুলকালো।

(চলবে)

#এক_মুঠো_বুনোপ্রেম

পর্ব ২২

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

” থাক! থাক! আর্শি আমি তোকে বিব্রত করতে চাই না, তুই যে এক বিরল মানসিক রোগে আক্রান্ত তা তুই জানিস? আমি জানি তুই জানিস না! তোর সবকিছু ভুলে যাওয়ার বাতিক আছে, জানিস? ”

এক নি:স্বাসে এষের এতগুলা কথা শুনে আর্শি হতবুদ্ধের মতো মাথা চুলকালো। এষের কন্ঠ বেশ ঝাঁঝালো ছিলো কথাগুলো বলার সময়। এষ নিজেকে গুটালো। আর্শির চোখ দুটিতে বিষাদ। সে কেনো সবকিছু এভাবে ভুলে যায়? নিজের প্রতি নিজের যেনো এক পাহাড় বিতৃষ্ণা, এক সমুদ্র বিরাগ! এক মহাকাশ অভিযোগ।

আর্শি নিজেকে হেয় দৃষ্টি করে মাটির দিকে তাকালো।

এষ বুঝতে পারলো সে আর্শিকে হারিয়ে যাওয়ার কষ্টে আর্শিকেই বেফাঁশ প্রশ্ন করে ফেলেছে সে। আর্শি, যে কিনা তার জানপ্রাণ, তার জীবনের একমাত্র মূল্যবান ভালোবাসা! তাকে সে এভাবে নিজের কথা দ্বারা আঘাত করতে পারে না! নিজের প্রতি নিজেই ধিক্কার জানালো এষ। সকালে উঠেই সে আর্শিকে মেডিসিন গুলোও খাওয়ায়নি, সেজন্যও হয়তো আর্শির এমন হয়েছে। আর্শির ভুলে যাওয়ার বাতিক থাকলেই, এর জন্য তো আর আর্শি দায়ি নয়। বরং এর জন্য মেইন কালপ্রিট হলো অপরাজিতা। অপরাজিতা কেনো এতকিছু তাদের পরিবারের কাছে লুকালো? আর্শি ও আর্শির পরিবার সম্পর্কে প্রতিটি বিষয় অপরাজিতা লুকিয়েছে। শাস্তি যদি পেতেই হয়, তবে অপরাজিতা কেই পেতে হবে।

এষ আর্শিকে স্বাভাবিক করার জন্য নিজেই তার কাছে এসে, দু হাতের নরম তালু দিয়ে আর্শির দু গাল স্পর্শ করে বললো,

” আমার লক্ষীটার কোনো দোষ নেই। আ’ম স্যরি। আমার সব দোষ। সকালে আমি তোকে তোর মেডিসিন গুলোও খাওয়াই নি। সেজন্যই তুই সব ভুলে গিয়েছিলি। তুই হারিয়ে যাওয়ার পর আমার যেনো দম আটকে যেতে ধরেছিলো। পৃথিবীতে তোকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়, এভাবে আর হারিয়ে যাবি তো আমাকে মে’রে তারপর যাবি।”

একথা বলতেই আর্শি এষের মুখ চেপে ধরলো।

” স্টপ প্লিজ৷ ম’রার কথা আর কোনোদিন ভুলেও মুখে আনবি না, আর কোনোদিন হারাবো না আমি, প্রমিস!”

এষ সুযোগ টা লুফে নিলো এষ। নিমেষেই বলে দিলো,

” শুধু প্রমিস করলেই হবে না, ডক্টর লিওয়ের কাছে তোকে যেতে হবে এবার, কোনো ছাড় নেই!”

“ডক্টর লিও!”

আর্শি ভয়ে ঢোক গিললো। ডক্টর ফোবিয়া আর্শির ছোটোকাল থেকেই৷ তার পরো বহু বার হসপিটালাইজড হতে হয়েছে তাকে। কিন্তু ডক্টর লিওয়ের চেম্বারের সাজসজ্জা তার মনে আরো ভীতির সৃষ্টি করে, তাই সেদিন ওরকম এবনরমাল হয়ে গিয়েছিলো।

এষ আর্শির হাত ঝাঁকুনি দিয়ে বললো,

” হুম, ডক্টর লিও! এবার তার কাছেই তোর ট্রিটমেন্ট হবে৷ তবে তার চেম্বারে নয় বরং আজ তোদের বাসাতেই সে আসবে, তার সাথে আমার কথা হয়েছে! আর তবে ভুলেও ডক্টর লিওয়ের ব্যাপারটা ফুপির কাছে জানাবি না। কারন সে চায় না ডক্টর লিও তোর চিকিৎসা করুক! ”

আর্শি আর কোনো কথা বললো না।

এষ আর্শির হাত ধরে টেনে বললো,

” চল গাড়িতে উঠে বসি, সারাদিন কিছু খাইনি, তুই খেয়েছিস? সামনেই রেস্টুরেন্ট, দুজনে পেট পুরে খাবো আগে, তারপর বাসায় যাবো !”

আর্শি ‘হা’ বোধক মাথা নাড়লো।

গাড়িতে উঠেই এষের মনে পড়লো, আর্শির কাছে না ফোন ছিলো, ঐটা কোথায়?

আর্শির কাছে এষ ফোনটা চেয়ে নিলো।

” তোর ফোনটা দে তো? গান শুনবো!”

আর্শি নিজের ফোন এষের হাতে তুলে দিলো।

এষ একটা ইংরেজী রিলাক্সিং মিউজিক বিশিষ্ট গান ছেড়ে দিলো।

গাড়ি ড্রাইভিং করা শুরু করলো সে। আর্শি চোখ বুজে মাথা সিটে হেলান দিয়ে আধাশোয়া হয়ে বসলো। সেই সুযোগে এষ আর্শির কললিস্ট চেইক করতে লাগলো। প্রথম নাম্বারটা দেখেই এষের হাত কেঁপে উঠলো। আর বুকের মধ্যে একটা মোচড় দিয়ে উঠলো। কে এ ব্যক্তি? যার সাথে আর্শি বেশ কয়েকবার কথা বলেছে?

নাম্বারটা অন্যদেশীয়। তাতে বেশ কয়েকবার কথা বলেছে আর্শি।

এষ নাম্বারটা টুকে নিলো।

এষ ওসি আরমান কে একটা ধন্যবাদ জানালো আর্শি সম্পর্কে সকল সঠিক তথ্য সংগ্রহের জন্য।

এত রাতে রাস্তা প্রায় জ্যামমুক্ত থাকায় দ্রুতই তারা বাড়ি পৌঁছে গেলো।
.
.

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আর্শি নিজেকে দেখে নিজেই হতভম্ব। চিৎকার করে এষকে ডাকতে লাগলো সে।

এষ আর্শির রুমে দৌড়ে এলো।

আর্শির ক্ষীপ্র প্রশ্ন এষকে,

” এসব কি এষ? আমার চোখে চশমার পরিবর্তে নীল লেন্স! আর এটা কি ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়েছি! মুখে মেকাপ! এসব কি আমি কখন এসব করলাম?”

এষ আর্শিকে বুকে টেনে নিয়ে শান্ত করলো,

” কুল ডাউন বেইব, কিচ্ছু হয়নি, তুই তখন হুঁশে ছিলি না, তাই তোর কিচ্ছু মনে নেই, আমি বললাম ই তো আগামীকাল সকালে ডক্টর লিও এ বাসায় আসবে, যাস্ট তাকে তোর ট্রিটমেন্টের দায়িত্ব টা দে, দেখবি যে তোর সব, সব মনে পড়ে যাবে”

আর্শি থামলো, তবুও তার অস্থির মন তাকে বারবার প্রশ্ন বানে জর্জরিত করতে থাকলো।

এতক্ষণ সে নিজেকে কেনো খেয়াল করেনি? কখন সে এসব করেছে? সে নিজেই জানে না! আর না জানি কত কি করেছে সে এই হারিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘন্টা কে জানে? অজানা শঙ্কায় সে ভেতরে ভেতরে মুষড়ে গেলো। কোনো খারাপ কিছু তো সে আবার করে নি?

.
.

অপরাজিতার সাথে আর্শিকে কথা বলিয়ে, মেডিসিন খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এষ আবার বসলো আর্শির ডায়রিটা হাতে নিয়ে।

এষ পড়তে লাগলো।

আজ সকাল থেকেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। আমার স্টেপ মম অপরাজিতা আমাদের বাড়িতে এসেছে। ওদিকে আমি চলে এসেছি ঢাকায়। আমার নিজের মা কে দেখতে । সে এক মানসিক হাসপাতালে গত ছয় মাস যাবত এডমিট। ডক্টররা বলেছে সে এখন বাড়ি চলে যেতে পারবে। তবে সে আমাদের বাড়ি নয় বরং আমার নানার বাড়ি যাবে। আমার নানারা নারায়নগঞ্জের অনেক স্বনামধন্য পরিবারের সন্তান। নারায়নগঞ্জের নাম তখন ছিলো সূবর্ণ গ্রাম, আবার সোনারগাঁও ও বলা হতো। তখন বাংলার রাজধানী ছিলো সোনারগাঁও। সূবর্ণ গ্রামের নবাবদের বংশধর নাকি আমার নানা। আর প্রহ ও সেই পরিবারেরই সন্তান। আমার মাম্মীর আপন চাচাতো ভাইয়ের ছেলে হলো প্রহ। আমার তো ভীষণই খুশি লাগছে আমি এখন থেকে প্রহদের সাথেই থাকতে পারবো। তবে একটা ঝামেলা আছে। সেটা হলো, আমার বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। কারন তারা দুজনেই ভীষণ স্বাধীনচেতা। দুজনেই দুই বিপরীতধর্মী মানুষ। তাদের আচার আচরন, জীবন প্রণালী, ধ্যান ধারণা, পছন্দ অপছন্দ সবই সম্পূর্ণ ভিন্ন। দাদা দাদী, ও আমাদের দু পক্ষের আত্মীয় স্বজন তাদের বহু বুঝিয়েও কোনো সুফল পায়নি। তাদের কোনোক্রমেই এক করা সম্ভব নয়। তারা নিজেদের জেদে অটূট। তাই তারা দুজনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পৃথক হয়ে যাবে। তবে আমাকে নিয়ে তাদের যত দ্বন্দ। আমাকে মাম্মি ও নিতে চায় আবার পাপা ও নিতে চায়। আমিও দুজনকে নিয়েই থাকতে চাই। তবে ডক্টর বলেছে আমার মাম্মীর যে অবস্থা তাতে তাকে দেখতেই চারজন লোক লাগবে। সে আবার আমাকে রাখে কিভাবে? যেকোনো সময় সে সবকিছু ভুলে যায়! একবার আমাকে রুমের মধ্যে রেখে তালা দিয়ে চাবি নিয়ে বাইরে চলে যায়। তখন আমার বয়স মাত্র ছয় বছর, তারপর আশেপাশের লোকজন ও কাজের লোক মিলে দরজা ভেঙ্গে আমাকে উদ্ধার করে! দাদীর মুখে শুনেছিলাম, এর আগেও আমার মা আমার সাথে এমনটি করেছিলো। আমার মায়েরই বা দোষ কি? আসলে আমার মা একজন মানসিক রোগী, সোজা কথায় পাগল! নিজের মায়ের সম্পর্কে এসব লিখতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, তবে অনেক সময়ই সত্য ভীষণ কষ্টকর হয়। মাম্মী শত চাইলেও আমাকে তার কাছে রাখতে পারে না, আর আমি ইচ্ছে করলেও তার কাছে যেতে পারি না। তাই আমার দেখাশোনার দায়িত্ব দাদা দাদী নিয়েছেন। এবার কিছুদিনের জন্য মাম্মীর কাছে যাচ্ছি।দেখি এবার কতদিন আমি তার কাছে থাকতে পারি! তবে আমার মাম্মী এবার বলেছে আমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে, তাই আমি ভীষণই আনন্দিত! গিয়ে দেখি, কি সারপ্রাইজ আমার জন্য অপেক্ষা করছে!”

( চলবে)