এক মুঠো বুনোপ্রেম পর্ব-২৫

0
7

#এক_মুঠো_বুনোপ্রেম

পর্ব ২৫

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

(পূর্নমনস্কদের জন্য)

লিও কে বিদায় জানিয়ে এষ, অগ্র, আরাধ্যা আর পূর্ণ বসেছে ড্রয়িং রুমে। না! গল্পের আসর নয়, আবার গল্প যে নেই তাও না।

এষ আর অগ্র সোফায় বসা, আর আরাধ্যা ও পূর্ণ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। পূর্ব বাড্ডার পেছন দিয়ে যাওয়া রামপুরা লেকের লেজের অংশ (যেটুকুতে সংস্কার কার্য চলে নি) সেটুকু এ বিশাল জানালা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। লেকের এ অংশটার প্রস্থ বেশ চওড়া। লেক জলে টুইটম্বুর। লেকের এক পার্শে বিশাল বিস্তৃত কাশবন আর অন্যপাশে আফতাব নগর। আর্শিদের এপার্টমেন্ট এই আফতাব নগরের আধুনিক এলাকাটিতেই। আভিজাত্য পূর্ণ আবাসিক এ এলাকায় দেখার মতো আভিজাত্য শুধু এ লেকের বিশাল জলরাশির সাথে লেকের স্রোতের ফলে সৃষ্ট নির্মল ও মনোমুগ্ধকর সমীরন! সাথে পাখিদের কলতান তো আছেই! পূর্ণ আর আরাধ্যা দুজনেই বিশাল সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে গল্পে মত্ত। দুজনে দুজনায় যে মজে আছে দারুনভাবে। নতুন নতুন প্রেম বলে কথা!

এষ তার দু হাতের করতল দিয়ে নিজের সমগ্র মুখমন্ডল আলতো চেপে ধরে রেখেছে। চোখ দুটি তার প্রচন্ড জ্বলছে। কনুই দুটো দু পায়ের উপর ভর করানো। এমন শরীরে কি জানি গভীর ভাবনায় সে ডুবে আছে।
অগ্র এষকে তার হাতে একটা আঙ্গুলের খোঁচা দিয়ে মেয়েদের মতো ন্যাকা স্বরে বললো,

” দেখো না এষ ভাইয়া! নব প্রেমিক দম্পতি!”

এষের চোখ গুলো লাল হয়ে আছে। ফর্সা মুখমন্ডল মলিন হয়ে আছে একজোড়া শুষ্ক উষ্ঠের উপস্থিতিতে। সে ঠোঁট দুটো যেনো নড়তেই চাইছে না। তার পরো সে কষ্ট করে নাড়িয়েই কথা বলে উঠলো অগ্রের সাথে,

” ব্রো, নব প্রেমিক দম্পতি, বাক্যটা মানায় না! এটা হবে নব প্রেমিক যুগল!”

এষের খুব অসহ্য লাগছে এখানে বসে থাকায়। শরীর মোটেও টানছে না, কিন্তু একমাত্র মেহমানদারির খাতিরে সে ওদের সাথে বসে আছে!
কিন্তু অগ্রের সেদিকে খেয়াল নেই।
আর্শির বন্ধুরা সবাই আজ এ বাড়িতেই থাকবে সারাদিন এমন প্ল্যান ই করা হয়েছে। ওদিকে আর্শিকে মেডিসিন গুলো নিয়ে রেস্ট নিতে বলেছে ডক্টর লিও, তাই সে নিজ কক্ষেই শুয়ে আছে। আর্শির বেশি কথা বলা বা শোনাও মানা করে দিয়েছে ডক্টর লিও। আগের ঘুমের ঔষধ সব বাদ দেওয়া হয়েছে। লিও এষকে বলে গেছে যেনো আর্শি এক সেকেন্ডের জন্যও চোখের আড়াল না হয়! না ঘুমাতে পারলে প্রয়োজনে হাত, পা ও মাথা ম্যাসাজ করে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে।

নেহালের মৃত্যু আর নিহুর গা ঢাকা দেওয়ার ব্যাপারে তারা প্রথমে আলোচনা করছিলো। নিহুর অনেক খোঁজ করা হয়েছে, কিন্তু তাকে কোথাও পাওয়া যায় নি। তবে ইনস্ট্রাগ্রামে সে নতুন নতুন ফটো আর ভিডিও আপলোড করছে নতুন প্রেমিককে সাথে নিয়ে দেশ দেশান্তরে ঘুরাঘুরি সম্বলিত। আর্শিকে নেহালের মৃত্যুর খবর নতুন করে আর জানানো হয়নি, কারন এতে সে আবার কি না কি রি এক্ট করে! ডক্টর লিও তাকে কোনো নেগেটিভ নিউজ দিতে মানা করেছে।

পূর্ণ আর আরাধ্যা জানালার ধারে গিয়ে একে অপরের আঙ্গুল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে।

এতে অগ্রের মুখশ্রীতে এক ধরণের ঈর্ষা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। এর একমাত্র কারন সবাই এখন জোড়া কপোত কপোতি জুটিয়ে ফেলেছে এক অগ্র ছাড়া। এতে ওর মনটা শুধু আঁকুপাকু আঁকুপাকু করছে।

পূর্নের চাকরি হওয়ার পর তার মন যেনো একশ আশি ডিগ্রী ঘুরে গেছে আরাধ্যার প্রতি। পূর্নের মুখে এখন ক্ষণে ক্ষনে পূর্ণতা পায় আরাধ্যার গুণকীর্তনে। আরাধ্যা এই, আরাধ্যা ইজ দ্যা বেস্ট হিউম্যান বিইং! আরাধ্যা ইজ দ্যা বেস্ট ফ্রেন্ড ম্যাটার! বেস্ট লাভার ম্যাটার…ইত্যাদি লেগেই আছে পূর্নের মুখে। আর অগ্র এসবের একমাত্র অগ্রজ শ্রোতা। সে এসব শুনে আর জ্বলে, জ্বলে আর শুনে। নিজের একটাও প্রেমিকা এযাবত জুটলো না বলেই তো এত জ্বলন তার!

অগ্র একটা ম্যাগাজিন নিয়ে কয়েক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে আবার রেখে দিলো। ম্যাগাজিনে তার মনোযোগ নাই। তারপর কি জানি ভেবে এষকে উদ্দ্যেশ্য করে অগ্র বলে উঠে,

“শীট! এষ ভাই, আমি ভেবেছিলাম তুমি একটা স্মার্ট! বাট! ইউ আর এ কমপ্লিট ফুলিস গাই!

হুট করে অগ্রের বলে উঠা এসব কথা শুনে এষ হতবুদ্ধি হয়ে গেলো।

শুধু বলে উঠলো, ” হ্ হ্ হোয়াট!”

এষ এবার ঝটিকা এষের একদম কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,

” এষ ব্রো, লিসেন কেয়ারফুলি! তুমি এসব কি করছো বলো তো? তুমি আর্শিকে আজই বিয়ে করে নাও তো, প্রহ টহ নামে কেউ নাই আই থিংক, আর থাকলেই কি? ওরা তো আর বিয়ে করে নাই, তার আগে তুমিই বিয়ে করে নাও আর্শিকে..”

কথাটা চুপিচুপি ফিসফিস করে তাগাদা দিয়ে বলে উঠলো অগ্র।

এষের আবার গা কাঁপছে। এবার তার জ্বরটা ঠিক এসে গেছে। অগ্রের কথা শুনে এর মধ্যেও সে হেসে দিলো। এষ কিছু বলতে যাবে এর মধ্যে অগ্র আবার বলে উঠলো, তবে এবার সে জোরে জোরেই বললো,

” এষ ভাইয়া কি আমাকে টিটকারির হাসি দিলা? দিলে দাও, নো প্রবলেম! শোনো ব্রো, কাঙ্গালের বুদ্ধি কিন্তু বাসি হইলেও ফলে৷ আমি যা বলছি, তা না করলেই বরং ফিউচারে পস্তাইবা, বুইঝো! দরকার পড়লে আমরা সবাই বিয়ের স্বাক্ষী হবো, আর কোনো হেল্প? আর যদি চাও আজই হানিমুনে পাঠানোর ব্যবস্থাও করতে পারবো বুঝলা? আমার মামা চাচা আছে এয়ার ফোর্সে ইভেন বিমানের পাইলট! ”

এষ একদৃষ্টে অগ্রের কথা শুনছে।

এষের এসব কথা কিছুই ভালো লাগছে না। কারন সে ভালো করেই জানে আর্শি কোনোভাবেই এখন বিয়ে করতে রাজী হবেনা এষকে। তাছাড়া আর্শিকে সুস্থ্য করার আগ পর্যন্ত এষের আর কোনো লক্ষ্য, উদ্দ্যেশ্যই যেনো নেই। সুস্থ্য হয়ে সে যাকে গ্রহণ করতে চায়, তাকেই গ্রহণ করছে। সব উপরওয়ালার আর আর্শির হাতে ছেড়ে দিয়েছে সে।

তবে এষ ভাবছে অন্য কথা। আর্শিকে কিভাবে কিছুদিন অপরাজিতা হতে দূরে রাখা যায়, সে ভাবনা ভাবছে এষ। কারন লিওয়ের দেওয়া মেডিসিন গুলো একটানা না সেবন করাতে পারলে আর্শির ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনা যে আছে!

এসব ভাবনার মধ্যেই অগ্র একথা বলে নিলো, প্রথমে বিরক্ত হলেও পরক্ষণেই এষের ভাবনান্তর হলো। অগ্র তো ঠিকই বলেছে। আর্শিকে আজই বিয়ের প্রপোজাল দিলে কেমন হয়? তাহলেই আর্শিকে অপরাজিতার বেড়াজাল হতে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া যেতো। কিন্তু এটা কি ঠিক হতো? কয়দিন বাদে আর্শি সুস্থ্য হয়ে যদি বলে প্রহকে চাই, তখন সে তো আবার প্রহের কাছেই চলে যাবে?

এতসব ভাবতে ভাবতেই অগ্র আবার বলে উঠলো,

” এষ ভাইয়া, এতকিছু ভেবো না তো, একটা কথা আছে না? এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার?( প্রেম এবং যুদ্ধের বেলায় সব কিছুই বৈধ) তাহলে আজই আর্শিকে বিয়ে করে প্রেমের পরিনতি দেওয়াটাও বৈধ! এতে কোনো দোষের কিছু নেই”

এষ চিন্তায় তার নিচের ঠোঁট উপরের ঠোঁটে চেপে পা নাড়াতে লাগলো।
কি করবে আর কি বলবে ভাবতে লাগলো।

ওদিকে পূর্ণ আর আরাধ্যা ড্রয়িং রুমের বিশাল জায়ান্ট গ্লাস উইন্ডোর সামনে দাঁডিয়ে আকাশ দেখছিলো আর নিজেদের কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করছিলো। পূর্ণের জব হওয়ার পর থেকে আরাধ্যার সাথে তার মনের আদান প্রদান ঘটে গেছে। দুজনে এখন দুজনার মনোসঙ্গী। তাদের প্রণয় এখন পিকে(চূড়ায়) উঠে গেছে। এষ এক দুবার ওদিকে তাকিয়ে দেখলো, আর সঙ্গে সঙ্গে অগ্র ওদের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ঈঙ্গিত করে দেখিয়ে এষকে বললো,

” তুমি ভাই বিয়েই করতে চাও না, আর এই দুইজন তো বিয়ে না করেই একশ বার ইয়ে করে ফেললো!”

বলেই চোখ টিপে হেসে দিলো অগ্র।

এষ মৌন রইলো, অগ্র আবার বলে উঠলো,

” ব্রো, আমি তো ভাবছিলাম, আমিও তোমার বোনের জামাই হবো! ”

” হোয়াট?” এষ আচমকা চমকে উঠলো একথা শুনে।

অগ্র হেসে সুধালো,

” আই মিন ব্রো, আমি না, আমার কোনো দোষ নাই, আর্শিই আমাকে বলেছিলো যে, তোমার বোন কায়া নাকি ভীষণ সুন্দরী, ওর সাথে আমাকে সেট আপ করিয়ে দিতে চেয়েছিলো আর্শি নিজেই!”

এষ এবার হাসলো। ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বললো,

” আমার বোন কায়ার তো আবার হাবাগোবা ছেলে পছন্দ নয়, লাইক ইউ! সে একটা ওভার স্মার্ট মেয়ে। ওকে নিয়ে তুমি ভেবো না! ওর কাছে তুমি পাত্তা পাবে না, আর ওর সাথে পাল্লা দিয়েও এগুতে পারবে না! তুমি ওর ধারে কাছেও না! ”

একথা শুনে অগ্র বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়ে, কাঁদোকাঁদো স্বরে বললো,

” আমি কি তাহলে ব্রো আজীবন সিঙ্গেল ই থেকে যাবো? আমার কি কোনো গতি হবে না? পূর্ণ চিরকুমার সংঘের সদ্যস্য হয়েও বিয়ের আগেই ভার্জিনিটি হারাইছে, আর আমি কি আজীবন ভার্জিনই থাকবো?”

অগ্রের কথা শুনে এষ এতসব দুশ্চিন্তার মধ্যেও হেসে দিলো।

অগ্রের এসব প্রশ্নের উত্তর তার দিতে ইচ্ছে করছে না। তাই অগ্রকে পাশ কাটিয়ে একবার আর্শিকে দেখতে আর্শির রুমে গেলো। আর্শি বিছানায় আধাশোয়া হয়ে নিজের ল্যাপটপে টম এন্ড জেরি দেখছিলো আর মিটিমিটি হাসছিলো।

এষ আসা মাত্রই এষকে নিজের পাশে বসার জন্য ঈশারা করলো।

এষ বিছানায় বসতেই আর্শি নিজের গা ঢলে দিলো এষের উপর। তারপর নিজের কাঁধ এষের কাঁধে শুইয়ে দিলো। আর্শির শরীরের ভারও এষের উপর এসে পড়ছে। এষ আশ্চর্যান্বিত হলো। আর্শির স্পর্শে যেনো নিমেষেই তার জ্বর জ্বর ভাব, চোখ জ্বালাপোড়া, মাথাব্যথা সব রোগ নিমেষেই সেরে গেলো। শরীরটা চনমমে হয়ে গেলো।

আর্শি টমের একটা হাস্যকর সিন দেখে এবার খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। আর্শির হাসি হতে যেনো মুক্তা ঝড়ছে। এ দৃশ্য দেখে এষের নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে বিপত্তি বাঁধলো। দু হাতের শক্ত বাঁধনে আর্শিকে জড়িয়ে নিলো নিজের বক্ষপৃষ্টে। ল্যাপটপ গড়িয়ে পাশেই পড়ে গেলো।

” আরে! আরে! কি করছিস এষ?”

আর্শি একথা বলেও রেহাই পেলো না।

আর্শির কোমড় জড়িয়ে এষ নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে আর্শিকে জড়িয়ে যেনো নিজের শ্বাস খুঁজে পেলো।

হাঁপাতে হাঁপাতে বুক ভরে শ্বাস নিতে নিতে সে আর্শির কানের খুব কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,

” প্লিজ আমাকে থামাস না! আমি অক্সিজেন নিচ্ছি, তুই আমার অক্সিজেন! প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো তোর স্পর্শ ছাড়া। আমাকে নিজের করে নে আর্শি। আমি যে তোকে ছাড়া বাঁচি না! তোকে ছাড়া মুমুর্ষু আমি। তুই যে আমার লাইফ সাপোর্ট! ”

আর্শি আর বাঁধা দিলো না। সে নিজেও এষকে নিজের বাহুডোরে বাঁধলো। এষ নিজের ঠোঁট ডুবালো আর্শির ঘাড়ে।

শিরশিরে অনুভীতিতে আর্শি চোখ বুজলো।

এষ তার ঠোঁট উঠিয়ে ফিসফিসিয়ে আবার বললো,

” চল আর্শি আজই আমরা বিয়ে করে ফেলি। আই কান্ট স্টে আ সিঙ্গেল মোমেন্ট ইউদাউট ইউ”

(চলবে)