এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-১৯+২০

0
180

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৯.

[ সতর্কতা : এই পর্বের দু একবার কিছু স্ল্যাং ওয়ার্ডস ইউজ করা হয়েছে। কারো তাতে সমস্যা থাকলে সেই শব্দগুলো এড়িয়ে যাবেন। ]

বন্দুকের নলটা ঠিক কণ্ঠনালির কাছে ঠেকেছে। তর্জনী আঙুল দ্বারা কেবল ট্রিগার চাপার দেরি। সামান্য চাপ পড়লেই বুলেটটা রুহীর কণ্ঠনালি চিড়ে বের হবে। এরকম পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের কি রূপ প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত? ভয়, আতংক, উৎকণ্ঠা? কিন্তু রুহীর মধ্যে সেসব কিছুই কাজ করছে না। এই বুলেট এখন আর কি-ই বা করতে পারবে? তার বিশ্বাস তো ভেঙে গুড়িয়েই দিয়েছে এই পরিচিত মুখোশধারী ভিন্ন পুরুষটা। প্রতারণার খঞ্জরে রক্তাক্ত করে দিয়েছে তার ভেতরটা।

অশ্রু জর্জরিত নয়ন যুগলের পানে চেয়ে আব্রাহাম মৃদু হেসে বলে,

“ থ্যাঙ্কিউ জান। তোমার সাহায্য ছাড়া এই মহান প্ল্যান ম্যাপ রেডি করা সম্ভব হতো না কখনো। “

আব্রাহামের মুখে উচ্চারিত কথাটা অডিটোরিয়ামে উপস্থিত সকলের কর্ণগোচর হয়। রুহীর সহপাঠীরা অবিশ্বাস্য সুরে চেচিয়ে উঠে,

“ রুহী, তুই এদের হেল্প করেছিস? “

শিক্ষিকা রুনা ফারহানাও ঘৃণা মিশ্রিত স্বরে প্রশ্ন করে,

“ অসভ্য মেয়ে, তুমিও এদের সাথে মিলিত? “

রুহী জবাব দিতে পারে না। সে নীরব ও নিরুত্তর রয়। শিক্ষার্থীদের শোরগোল আরেকটু বেড়ে যায়। সকলেই রুহীকে নানারকমের প্রশ্ন করে যাচ্ছে। আব্রাহাম চটে যায় উচ্চস্বরে। সে চট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। পিস্তলটা সকলের দিকে তাক করে বাজখাঁই গলায় বলে উঠে,

“ যার মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হবে তাকে গুলি করে চিরতরে তার মুখ বন্ধ করে দিবো। “

মুহুর্তেই সবগুলো গলার স্বর হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। গান পয়েন্টে সকলেই ভীত হয়ে পড়ে। আব্রাহাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে সকলকে দেখে নিয়ে অডিটোরিয়াম হতে বেরিয়ে যায়। পিছনে রয়ে যায় এক ঝাঁক প্রাণ হারানোর ভয়ে উৎকণ্ঠিত মানুষ।

__________

নাস্তা সেড়ে প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ খেয়ে বসে আছে বাণী। একা ঘরটা এ পর্যন্ত বেশ কয়েক বার ঘুরে দেখেছে সে। ছিমছাম সৌখিন মানুষের হাতে যে বাড়িটা সাজানো তা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু বাণীর পা জোড়া বারবার গিয়ে থামে সেই রুদ্ধ দুয়ারে। মনে জাগে মৃদু চাপা কৌতূহল। রুমটা বন্ধ কেন সেই উত্তর খুঁজে পায় না সে। হয়তো সেই রুমটা এই বাড়ির মালিকের খুবই ব্যক্তিগত জায়গা। বাণী আর সেদিকে পা মাড়ায় না। অন্যের বাড়িতে তার অনুপস্থিতিতে তারই ব্যক্তিগত ব্যাপারে এতো উঁকিঝুকি মারাটা যথেষ্ট কুরুচিপূর্ণ কাজ।

বাণী খাবার টেবিলে মাথা এলিয়ে বসে। চোখের সামনে ভেসে উঠে বহ্নির চেহারাটা। সেই মায়া চোখের বাচ্চাটাই তার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ। নাহয় এই জীবনের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই বাণীর। মাথা এলিয়ে দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাণীর ক্লান্ত চোখ জোড়া বুজে আসে। ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতেই তার চোখের পাতায় ভেসে উঠে অতীত।

__________

সময়টা ২০১৩ সাল। ১৪২০ বঙ্গাব্দ। সময়টা বর্ষাকাল। বাণীদের ব্যাচের ও লেভেল এক্সাম শুরু হতে বাকি কেবল দেড় মাস। গত দেড় বছরের অধিক সময়ে বেকবেঞ্চার বাণী তালুকদার মই বেয়ে একটু একটু করে নিজের রোলটা টেনে শাহরিয়ার দূর্জয় নামক ছেলেটার পিছনে এনে স্থির হয়েছে। সবসময় নিজের দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ানো মেয়েটা রাতারাতি নিজের জীবন নির্দিষ্ট রুটিনের আয়ত্ত্বে এনেছে। সন্ধ্যা ছয়টা হতে রাত নয়টা পর্যন্ত সময়টা ফিজিক্স, ম্যাথ, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি বিষয়ক টিউটরদের পিছনে ব্যয় করেছে। দশটার পর থেকে রাত একটা পর্যন্ত সময়টা পাড় করেছে নিজের মতো করে পড়ে। কোনো দিক দিয়ে কোনো খামতি রাখে নি সে। তার এই আমূল পরিবর্তন দেখে তার পরিবার বিষম খেলেও মনে মনে খুশি হয়। ভেবে নেয় হয়তো বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাণীর মধ্যে সিরিয়াসনেস কাজ করছে।

ও লেভেল এক্সাম শুরু হওয়ার দেড় মাস পূর্বে স্কুল জীবনের সমাপ্তি উদযাপন করতে শিক্ষার্থীরা মিলে তথাকথিত র‍্যাগ ডে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে স্কুল প্রাঙ্গণে। স্যার, ম্যাডামদের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করে বাণী আরমিনকে নিয়ে ছুটে যায় গ্রাউন্ড ফ্লোরের ওয়াশরুমে। আয়নায় নিজেকে ভালো করে পরখ করে ইউনিফর্মের উপর র‍্যাগ ডে এর সাদা টি শার্টটা গায়ে জড়িয়ে নেয় সে। আরমিন বান্ধবীর স্পেশাল ডে তে তাকে সুন্দর করে তৈরী করতে ব্যস্ত। উঁচু করে বাধা পোনিটেলটা খুলে উন্মুক্ত চুলগুলো চিরুনীর সাহায্যে আঁচড়ে দেয় সে। নিজের ব্যাগ হতে লিপটিন্ট বের করে বাণীর ঠোঁটে তা মেখে দিতে দিতে বিজ্ঞের ন্যায় প্রশ্ন করে,

“ আমি তোকে যেই সিনেমার লিস্ট দিয়েছিলাম সেগুলো দেখেছিস? ভালো করে প্র্যাক্টিস করেছিস তো? “

বাণী মুখ লটকে জবাব দেয়,

“ ঘন্টা শিখেছি। ধ্যাৎ! সিনেমার ডায়লগ মুখস্থ করে গেলে ও ভাববে আমি মেমোরাইজ করা পড়া টিচারের সামনে উগড়ে দিতে এসেছি। “

আরমিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিরিয়াস মুখ করে বলে,

“ আচ্ছা, সিনেমার ডায়লগ বাদ। শোন, তুই জাস্ট যাবি আর বলবি আই লাভ ইউ৷ শেষ। সিম্পল। “

বাণী নীরবে শুনলো আরমিনের কথা। শুনতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে বলতে ঠিক ততটাই কঠিন।

বাণী প্রশ্ন করে,

“ তোর কি মনে হয়? ও আজকে আসবে? “

“ আসবে না কেন? গত দুই সপ্তাহ ধরে ক্লাস অফ। হয়তো শুধু র‍্যাগ ডে থাকলে আসতো না। কিন্তু স্কুলে বেসিক ফর্ম ফিল আপের ডেটও আজকে। অবশ্যই আসবে। “

দুই বান্ধবী রেডি হয়ে বের হয় দূর্জয়কে খুঁজতে। স্কুলের মাঠে সব স্টুডেন্টরা আনন্দে মেতে রয়েছে। শেষ স্মৃতি হিসেবে একে অপরের টি শার্টে লিখে দিচ্ছে কিছু সংখ্যক শব্দ। সব ভীড়ে খুঁজেও যখন দূর্জয়ের কোনো হদিস মিলে না তখন বাণীর খেয়াল হয় দূর্জয় কোথায় থাকতে পারে। বাণী যাওয়ার আগে আরমিন তাকে জড়িয়ে ধরে বেস্ট অফ লাক জানায়।

স্কুলের পিছনে শুনসান বাস্কেটবল কোর্টে পা রাখতেই বাণী দেখে কাঠের একটা বেঞ্চিতে মাথা নত করে বসে আছে কাঙ্ক্ষিত মানুষ। বাণীর মুখে হাসি ফুটে উঠে। সে এগিয়ে গিয়ে নিঃশব্দে বেঞ্চির একপাশে বসে। প্রফুল্ল গলায় বলে উঠে,

“ ইয়ো টপার! তোমার সাদা টি শার্টে কেউ মার্কারের দাগ বসিয়ে দিবে সেই ভয়ে এখানে এসে লুকিয়ে আছো? অবশ্য আমার টি শার্টেও আমি এখনো কাউকে দাগ বসাতে দেই নি। ভাবলাম রোল ওয়ানকেই নাহয় সবার আগে সেই সুযোগ দিবো। “

বলে বাণী নিজের হাতের মার্কারটা দূর্জয়ের সামনে ধরে। দূর্জয় মাথা তুলে তাকায় না। না কোনো প্রতুত্তর করে। দূর্জয়ের কোনো মতিভ্রম না দেখে বাণীও নীরব হয়ে যায়। মনে মনে কথাগুলোকে সাজিয়ে নেয়। মিনিট এক পরে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বলে,

“ আই হ্যাভ টু সে সামথিং। “

বাণীর আর বাকিটা মুখে বলার সাহস হয় না। সে নীরবে উঠে গিয়ে দূর্জয়ের পিছনে দাঁড়ায়। হাতে থাকা লাল রঙের মার্কারটা দিয়ে সফেদ টি-শার্টে ইংরেজিতে লেখে,

“ I Love U “

বাণী যতটা না জলদি লেখাটা লিখে দূর্জয় তার চেয়েও দ্রুত মাথা সোজা করে বাণীর দিকে ফিরে দাঁড়ায়। বিস্ফোরিত চোখে এক পলক বাণীকে দেখে নিয়ে নিজের শার্টের উপর পরিহিত টি শার্টটা খুলে হাতে নিয়ে তাতে লেখা তিনটি শব্দ পড়ে। অত:পর রক্তিম দৃষ্টি মেলে বাণীর দিকে তাকিয়ে চেচিয়ে উঠে,

“ এই বেশরম মেয়ে! ন্যূনতম লজ্জা নেই তোমার মাঝে? বহুদিন ধরে তোমার এই নাটক সহ্য করছি আমি। অল্প বয়সে যে এতো পেঁকে গিয়েছো তোমার বাসায় জানে? কি মনে করেছো তুমি? ফার্স্ট বেঞ্চে বসা, পড়াশোনার প্রতি হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে যাওয়া, এই মুখে রঙচঙ মাখা এসবের কারণ আমি বুঝি না? আমাকে ইম্প্রেস করার জন্য এতো পরিশ্রম? অথচ আমি শুরু থেকেই তোমার প্রতি বিরক্ত এটা বোঝার মতো সামান্য কমনসেন্স তোমার মধ্যে কাজ করে না? তুমি রিলেটেড প্রতিটা বিষয়ই আমার কাছে খুব বিরক্তিকর লাগে। তোমার গান, তোমার গিটারের টুংটুং শব্দ, তোমার উচ্চশব্দের হাসি, তোমার এই অতিরিক্ত এক্সট্রোভার্ট আচরণ, আমার দিকে তাকিয়ে তোমার বেহায়ার মতো ফ্লায়িং কিস ছোড়া। ইচ এন্ড এভ্রিথিং এবাউট ইউ ইজ ইরিটেটিং। আর তোমার সাহস কিভাবে হয় আমার পারমিশন ছাড়া আমার গায়ে হাত দেওয়ার? তার উপর আবার বেহায়ার মতো এসব লিখে বেড়াও। হোয়াট ডু ইউ থিংক? তুমি এভাবে আমার টি শার্টে আই লাভ ইউ লিখে দিলেই আমি হাসতে হাসতে তোমার প্রপোজাল এক্সেপ্ট করবো? আই জাস্ট হেট দিজ ব্লাডি থিং। “

কথাটুকু শেষ করতে না করতেই দূর্জয় নিজের হাতের টি শার্টটা দু হাতে টেনে হিচড়ে ছিড়ে ফেলে। তার দু চোখ ঠিকরে যেনো আগুন বের হচ্ছে। নিঃশ্বাসের গতি এলোমেলো। হয়তো সর্বদা ঠান্ডা থাকা মানুষ গুলো রেগে গেলে এরকমই তান্ডব লীলা চালায়। বাণী নীরবে দেখে দূর্জয়ের ধ্বংসলীলা। অপমানে থমথমে মুখশ্রী কালো হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। চোখে জমে থাকা অশ্রু গড়িয়ে পড়ার সুযোগ খুঁজছে কেবল। কিন্তু বাণী সেই সুযোগ দেয় না। আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না সে। দৌড়ে কাউকে কিছু না বলে সেখান থেকে প্রস্থান করে। সাইকেলের গতি বাড়িয়ে পৌঁছে যায় বাসায়। সবার অগোচরে বাসায় প্রবেশ করতে চাইলেও হঠাৎ একজন যুবক এসে তাকে টেনে বসার ঘরে নিয়ে যায়। প্রফুল্ল গলায় জানায়,

“ আই হ্যাভ এ গুড নিউজ। “

বাণীকে নিরুত্তর তাকিয়ে থাকতে দেখে যুবক হেসে জানায়,

“ আমি কানাডায় যেই ইউনিভার্সিটির জন্য এপ্লাই করেছিলাম সেখান থেকে মেইল এসেছে। আ’ম গোয়িং টু কানাডা নাও। “

যুবকের কথা যেনো বাণীর বুকের দাউদাউ করা আগুনে কিছুটা ঘি ঢালে। তার কাছে অসহ্যকর ঠেকে সবকিছু। দূর্জয় নামক সেই ছেলে, সায়াহ্ন নামক নিজের এই বড় ভাই। সবার কথাগুলো যেনো কেবল তাকে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্যেই। বাণী মা, বাবা, ভাইয়ের আনন্দের মজলিশ ছেড়ে নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। বিছানার দিকে এগোতে নিলেই তার চোখে পড়ে বিছানার এককোণে রাখা তার কালো রঙা গিটারটা। সাথে সাথেই তার মনে পড়ে যায় দূর্জয়ের বলা সেই কথাটা,

“ তোমার গিটারের টুংটুং শব্দ, তোমার গান এভ্রিথিং এবাউট ইউ ইজ ইরিটেটিং। “

বাণীর দুঃখগুলো ক্রোধে রূপ নেয়। রাখবে না সে এই গিটার। ছুড়ে ফেলে দিবে। গাইবে না আর কোনো গান। ছেড়ে দিবে চির জীবনের জন্য। আজকের এই দিনটা সে নিজের জীবনের স্মৃতি পাতা হতে ছিড়ে ফেলে দিবে।

আচমকা কলিংবেলের শব্দে বাণীর তন্দ্রা কেটে যায়। বেরিয়ে আসে অতীতের পাতা থেকে। পুরনো স্মৃতিচারণে তার বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। কিছু পাতা কখনো জীবন থেকে মুছে ফেলা যায় না। শাহরিয়ার দূর্জয়ও বাণীর জীবনের সেরকমই এক অধ্যায়।

__________

রুহীদের শিক্ষিকা রুনা ফারহানা বত্রিশ বছর বয়সী এক নারী। এক সন্তানের জননী এই নারী দ্বিতীয় বারের মতো অন্তসত্তা। একমাস হয়েছে তিনি জানতে পেরেছেন এই ব্যাপারটা। সবেমাত্র চারমাস। সামনের মাস থেকেই উনি চাকরিটা ছেড়ে দিতেন। কিন্তু এসবের মাঝে এরকম একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে কে জানতো? বিপদ কি আর বলে কয়ে আসে?

উত্তাপ বিহীন দুপুরটা আজ অন্য দিনের মতো স্বাভাবিক নয়। চারিদিকের পরিবেশটা কেমন গুমোট এবং থমথমে। আব্রাহাম আর অডিটোরিয়াম রুমের দিকে পা মাড়ায় নি। তবে দূর হতেই বিভিন্ন আদেশ দিয়ে চলেছে সে। যেই আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে অন্য আতঙ্কবাদীরা। যার মধ্যে অন্যতম হলো প্রতিটা কাঁচের জানালাই ঢেকে দেওয়া হয়েছে মোটা কাপড়ের পর্দা দ্বারা। যেনো বাহির হতে কেউ তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম না হয়।

পুরো অডিটোরিয়ামে সবাই যখন একসঙ্গে জোড়ো হয়ে বসে একে অপরকে সাহস ও ভরসা জুগিয়ে যাচ্ছে ঠিক সেই মুহুর্তে অডিটোরিয়ামের এককোণে মাথা নত করে অন্যদিকে ফিরে বসে আছে এক রমণী। সবার থেকে বিচ্ছিন্ন। দূর হতেই সে আঁচ করতে পারছে সবার ঘৃণ্য দৃষ্টি। চোখদুটো তার ফ্লোরের দিকে নিবদ্ধ। দৃষ্টি তুলে তাকানোর অবস্থায় নেই সে। এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতেও তার মধ্যে মৃত্যুভয় কাজ করছে। আজ এই আতঙ্কবাদীদের হাতে প্রাণ গেলেও বুঝি তার কিছু যায় আসে না।

অতিরিক্ত টেনশন এবং দীর্ঘক্ষণ নিচে বসে থাকার ফলেই বোধহয় রুনা ফারহানা তলপেটে তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করছে। ব্যথাটা ক্রমশ কেবল বাড়ছে বৈ কমছে না। প্রেগন্যান্সির সময়টাতে প্রায়ই মহিলাদের একটু পর পর প্রসাবের চাপ অনুভব করে। মিসেস রুনাও তার ব্যতিক্রম নয়। মধ্যে দু একবার তিনি নিজের সমস্যার কথা জানিয়ে আতঙ্কবাদীদের নিকট আবেদন করেছে যেনো তাকে দুই মিনিটের জন্য ওয়াশরুমে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু হৃদয়হীন পশু গুলো উনার আবেদন অগ্রাহ্য করে। রুনা ফারহানারো আর পিস্তলের বিরুদ্ধে গলা উঁচু করে কিছু বলার আর সাহস হয় না। কিন্তু এই পর্যায়ে তলপেটের ব্যথাটা অসহনীয় ঠেকছে তার কাছে। সইতে না পেরে আচমকা তিনি পেট চেপে ধরে তীব্র স্বরে আর্তনাদ করে উঠে।

অডিটোরিয়ামে উপস্থিত সকলের দৃষ্টিই নিবদ্ধ হয় তার দিকে। একজন আতঙ্কবাদী এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে,

“ এই মাগী। চিল্লাস কেন? এক্কেবারে পেট বরাবর গুলি কইরা বিষ ব্যথা ছুটামু। “

মিসেস রুনা কোনো প্রতুত্তর করতে পারে না। বরং চিৎকার করতে করতে একপাশে হেলে পড়লে একজন শিক্ষার্থী নিজের কোলে উনার মাথাকে আশ্রয় দিয়ে ব্যকুল স্বরে বলে উঠে,

“ ম্যাম অসুস্থ। প্লিজ উনাকে অন্তত যেতে দিন। একজন কমে গেলে নিশ্চয়ই আপনাদের বড় কোনো ক্ষতি হবে না? “

শিক্ষার্থীর কথা শুনে একজন আতঙ্কবাদী ক্ষিপ্র পায়ে এগিয়ে এসে রাইফেলের অপরপাশের মাথা দিয়ে তার পিঠে আঘাত করে বলে,

“ এই খা*কি মাগী। খুব জবান চালাইতেসোস? দিমু কাইট্টা? “

আতঙ্কবাদীর উগ্র আচরণে ভীত হয় সকলে। মুহুর্তেই এক বিশৃঙ্খল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। রুহী নীরব দর্শকের ন্যায় দেখে সেই দৃশ্য। সে অনেকটা দরজার কাছেই বসে ছিলো। সব আতঙ্কবাদীরা যখন শিক্ষার্থীদের শাসাতে ব্যস্ত সেই সুযোগে সবার দৃষ্টির অগোচরে রুহী অডিটোরিয়াম হতে বেরিয়ে আসে সামান্য মুক্ত অক্সিজেনের আশায়। নিঃশ্বাসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে হঠাৎ করে।

রুহী নিজের ইউনিফর্মের গলার কাছটা সামান্য টেনে ধরে এলোমেলো পা ফেলে লম্বা করিডোর পেরিয়ে অন্যদিকে মোড় ঘুরতে নিলেই একজোড়া হাত তাকে টেনে একপাশে নিয়ে যায়। রুহী ঝাপসা চোখে সেই হাতের মালিককে দেখতেই তার অস্থিরতার মাত্রা আরো বেড়ে যায়। আব্রাহাম চোখ কুচকে বলে,

“ বেরিয়ে এসেছো কিভাবে? খুব সাহস বেড়েছে? প্রতি পদে এখানে বোম সেট করা। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই তোমার শরীর টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। “

রুহী আব্রাহামের কথায় গুরুত্ব দেয় না। সে বুক টেনে নিঃশ্বাস নিতে নিতে আবার পা বাড়াতে নিলেই আব্রাহাম ফের তার হাত টেনে ধরে। ধমকের সুরে বলে,

“ সমস্যা কি তোমার? কি করতে চাইছো? “

রুহী অস্পষ্ট গলায় বলে,

“ ওয়াশরুম যাবো। “

আব্রাহাম মিনিট এক রুহীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তার হাত ধরে বলে,

“ ছুটে পালানোর চেষ্টা করবে না। আমি যেখানে যেখানে পা রাখবো সেই পথ অনুসরণ করে আসো। “

__________

মুখে পানির ঝাপটা মারতেই সামান্য ধাতস্থ হয় রুহী। সিংকের পানি ছিটে এসে তার ইউনিফর্মের অনেকটাই প্রায় ভিজে গিয়েছে। তবুও সেদিকে মাথা ব্যথা নেই তার। এতক্ষণের দলা পাকিয়ে গলায় আটকে থাকা কান্না এবার বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে। বেসিনের দুই পাশে হাতে ভর দিয়ে মাথা নত করে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে সে। কত রাত! কত রাত সেই মানুষটার সাথে নিজের কলেজের প্রতিটা কোণা নিয়ে গল্প করে বেরিয়েছে সে। মনখোলা রুহী যদি ঘূনাক্ষরেও টের পেতো প্রতারকটার উদ্দেশ্য তাহলে হয়তো নিজের মুখে ও মনে তালা মেরে রাখতো। এতোগুলো প্রাণ আজ যেই বিপদে পড়েছে সেই বিপদের একাংশের জন্য হলেও রুহী নিজেকে দায়ী অনুভব করছে। এতোগুলা মানুষের প্রাণের দায় বয়ে তো সে পরপারেও শান্তি পাবে না। এপারে লোকে তাকে লানত দিবে। সেই ভাবনা মাথায় উঁকি দিতেই রুহী এবার কাঁদতে কাঁদতে কপাল চাপড়ে উঠে। সব তার দোষ। একজন আতঙ্কবাদীকে হৃদয়ে জায়গা দেওয়ার কি কোনো শাস্তি আছে আইনে? যদি থেকে থাকে তবে সেই শাস্তি ঠিক কতটা ভয়ংকর?

বাথরুমের খোলা দ্বারের সামনে পাথরের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছে আব্রাহাম। না এগিয়ে যাচ্ছে মিছে প্রেয়সীর কান্না মুছতে, আর না তাকে কোনোধরনের তাড়া দেখাচ্ছে। মিনিট খানেক পর রুহী নিজেই নিজেকে সামলে নেয়। রক্তিম চোখের অশ্রু মুছে পানির কলটা বন্ধ করে সে। শান্ত পায়ে এগিয়ে যায় আব্রাহামের দিকে। আব্রাহাম যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে নিলেই রুহী তার হাত ধরে বাঁধা দেয়। আব্রাহাম ভ্রু কুচকে তাকাতেই রুহী অর্ধ ভেজা দেহটা আরেক পা এগিয়ে নিয়ে ধীর গতিতে আব্রাহামের বুকের ঠিক বা পাশটায় মাথা গুজলো।

সারাজীবন বহু পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে আব্রাহাম। কিন্তু এরকম বিস্ময়কর পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়ে নি সে। নিজের সকল কীর্তিকলাপের পর রুহীর এমন কান্ডের কোনো অর্থবহ মানে খুঁজে পায় না সে। আব্রাহামের এসব ভাবনার মাঝেই তার বুকের বা পাশ হতে থমথমে নারী স্বর বলে উঠে,

“ শেষবারের মতো তোমার হৃৎস্পন্দন শোনার লোভ সামলাতে পারলাম না। কিন্তু আফসোস! আজকে এই বুকের মাঝে শুধু একজন প্রতারকের হৃৎস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি আমি। “

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২০.

তন্দ্রাভাবটা কেটে যেতেই বাণীর কানে ভেসে আসে আরও দু একবার কলিংবেলের শব্দ। বাণী দরজার পীপহোল দিয়ে তাকাতেই দেখে সকালের সেই মুখটা। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ইলিয়াস কাঞ্চন। এবার আর বাণী তেমন একটা ভয় পায় না। বরং স্বাভাবিক ভাবেই দরজা খুলে। ইলিয়াস কাঞ্চন কোনো ভনিতা না করে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে উঠে,

“ ম্যাডাম আপনার জন্য লাঞ্চ। “

বাণী নীরবে প্যাকেটটা নিয়ে বাহিরের দিকে উঁকি মারে। দূর হতে সে দেখতে পায় উঠোনের ওদিকটায় আরো দু’জন কাটকাট চেহারার যুবককে দেখা যাচ্ছে। সেই পানে তাকিয়ে থেকে বাণী ইলিয়াসকে প্রশ্ন করে,

“ আপনারা খেয়েছেন? “

ইলিয়াস কাঞ্চন ইঞ্জিন দ্বারা চালিত রোবটের ন্যায় জবাব দেয়,

“ না ম্যাডাম। “

বাণীর অদ্ভুত মায়া লাগে। ছেলেগুলো সকাল থেকে বাহিরে দাঁড়িয়ে তাকে পাহারা দিচ্ছে। ওদের উঠোনে চেয়ার পেতে বসতে দিলে কেমন হয়? কিন্তু মনের ভাবনাটা আর প্রকাশ করার সাহস পায় না বাণী। এটা তার নিজের বাড়ি নয়। অন্যের বাড়ি। বাড়ির মালিকের অনুমতি ব্যতীত তার ঘরের আসবাবপত্রে হাত দিতেও বাণীর মনে সায় দেয় না। তাই সে কেবল বলে,

“ আপনারাও খেয়ে নিয়েন। “

“ ওকে ম্যাডাম। “

বাণী দরজা ভিড়িয়ে দিতে নিলেই ইলিয়াস কাঞ্চন ফের বলে উঠে,

“ ম্যাডাম। “

বাণী প্রশ্নবোধক দৃষ্টি মেলে তাকাতেই ইলিয়াস একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ আপনার জন্য। “

বাণী উৎসুক দৃষ্টি মেলে খামটা হাতে নেয়। দরজাটা লক করে সেই খাম হাতে বসার ঘরে গিয়ে একটা সোফায় বসে। খামটার উপরে কিছু লেখা নেই। নাম পরিচয়হীন সম্পূর্ণ। খামটা খুলতেই ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা ভাজ করা সফেদ কাগজ। বাণী ধীর হাতে কাগজের ভাজ খুলে। সঙ্গে সঙ্গে সে দেখতে পায় সম্পূর্ণ কাগজ জুড়ে বহু পরিচিত একজন হাতের লেখা। বাণী নীরবে পড়তে শুরু করে,

বাণী তালুকদার,

এই মুহুর্তে হেডকোয়ার্টারে একটা নীরব রুমে এই কাগজ এবং কলম হাতে বসে আছি আমি। যুদ্ধের ঘন্টা বেজেছে। সেই যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে আমার মনে পড়লো তোমার সঙ্গে একটা জরুরী হিসেব মেটাতে হবে আমায়। সেজন্য ঘড়ি ধরে ঠিক পাঁচ মিনিট সময় চেয়ে নিয়ে এই নীরব রুমে ছুটে এসেছি। কাগজ কলম হাতে নিয়ে লিখতে বসেছি।

এগারো বছর আগে, স্কুলের ব্যাক ফিল্ডের বাস্কেটবল কোর্টে দাঁড়িয়ে আমি তোমাকে অনেকগুলো কথা বলেছিলাম। যথেষ্ট দুর্ব্যবহার করেছি সেদিন তোমার সাথে। এই উপলব্ধিটা আমি সেদিনই করতে পেরেছিলাম। কিন্তু তোমার সাথে আর কখনোই আমার দেখা হয় নি। না পেয়েছি ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ। তাই আজ বলছি, আমার সেদিনের ব্যবহারের জন্য আ’ম সরি।

বাণী এই এগারো বছরে বহু কিছু বদলেছে। দুটো আলাদা পথের পথিক আমরা। কিন্তু দেয়ার ইজ সামথিং লাইক কলড ডেস্টিনি। আলাদা পথের দুই পথিক হওয়া সত্ত্বেও মহান আল্লাহ বারবার আমাদের এক মোড়ে এনে সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দিচ্ছে। বিষয়টা নেহাৎই কাকতালীয় নাকি উনার মর্জি তা আমার জানা নেই। যেখানে যাচ্ছি সেখান থেকে ফেরার সম্ভাবনা কতদূর তা-ও আমার জানা নেই। কিন্তু যদি আল্লাহ হায়াত রাখেন এবং আমি ফিরে আসি তবে আমি নিজের প্রশ্নের উত্তর আদায় না করে তোমাকে যেতে দিবো না।

আর… থাক। আমার পাঁচ মিনিট প্রায় ফুরিয়ে এলো। তাই এখানেই এই চিঠির সমাপ্তি টানছি।

ইতি,
মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়।

টানা হাতের লেখার ছোট ছোট শব্দগুলোয় আরেকবার চোখ বুলায় বাণী। তার যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে খুব। দূর্জয় ক্ষমা চেয়েছে? আত্মগরিমায় ভরপুর মানুষটা ক্ষমা চাইতেও জানে? অবশ্য এই সরিটা কি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো? বাণীর তো মনে হয় না। তার মনে হয় দূর্জয়ের এগারো বছর আগে বলা প্রতিটা কথা যথার্থ ছিলো। আপন ভাবনা গুলো একপাশে রেখে বাণীর মস্তিষ্কে হঠাৎ বেজে উঠে দূর্জয়ের লেখা চিঠির তিনটি শব্দ। ‘যুদ্ধের ঘন্টা বেজেছ’। কিসের যুদ্ধ?

বাণী দ্রুত বসার ঘরে একবার চোখ বুলায়। একটা ছোট বেতের গোল টেবিলের উপর হতে রিমোটটা হাতে নিয়ে টিভি অন করে। কিন্তু বেচারি নিরাশ হয়। টিভিতে ডিশের লাইনের সংযোগ নেই। বাণী রিমোট ছেড়ে দ্রুত উঠে দরজার কাছে এগিয়ে যায়। দরজা খুলে বাহিরে উঁকি দিয়ে মৃদু কম্পিত গলায় ডাকে,

“ ইলিয়াস কাঞ্চন। “

ডাকতে দেরি কিন্তু বান্দার হাজির হতে দেরি হয় না। রোবটের ন্যায় জবাব দেয়,

“ জি ম্যাডাম। বলুন। “

“ এই বাসায় টিভিতে ক্যাবল কানেকশন নেই। তাই নিউজ দেখতে পারছি না। বাহিরে কিসের যুদ্ধ চলছে? কি হয়েছে? আমাকে বলবেন? “

ইলিয়াস কাঞ্চনকে ভাবুক দেখায়। চট্টগ্রাম শহরের বুকের কালো অধ্যায়ের কথা ম্যাডামকে জানানোর আগে কি একবার স্যারের অনুমতি নেওয়া উচিত? কিন্তু সেই অনুমতি চাওয়ার সুযোগ তো আপাতত নেই। ভাবুক কাঞ্চন ফের তাকায় উদগ্রীব বাণীর মুখপানে।

__________

নীরব অডিটোরিয়ামে হুটহাট শোনা যাচ্ছে ক্ষীণ ফুপিয়ে কান্না করার শব্দ। কিন্তু তা বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না। তার পূর্বেই অস্ত্রধারী আতঙ্কবাদীরা অস্ত্রের বলে সেই স্বরে মাটি চাপা দিয়ে দিচ্ছে। ভয়ে আতংকিত মুখগুলো যখন প্রাণ শঙ্কায় ভীত তখন সেই অডিটোরিয়ামের এককোণে নির্জীব এক নারী দেহ অসাড় হয়ে ফ্লোরে পড়ে রয়। চেতনাহীন সেই রমণীকে দূর হতে সবার অগোচরে অতি সাবধানে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে এক জোড়া তীক্ষ্ণ ঈগল চোখ। এই মেয়েটাও ভীতু। অন্য সবার মতো দূর্বল। নাহয় সামান্য এক কুপানোর দৃশ্য দেখে কেউ জ্ঞান হারায় নাকি?

আব্রাহাম নিজের দৃষ্টি রুহীর উপর থেকে সরিয়ে তাকায় অডিটোরিয়ামের ডানপাশে। যেখানে একটা নিথর লাশ পড়ে রয়েছে। লাশটা আর কারো নয় বরং শিক্ষিকা রুনা ফারহানার। ভদ্রমহিলা পেট ব্যথায় তীব্র চেঁচামেচি করছিলো। আব্রাহামের দলের এক রাগচটা সদস্য যার নাম মুবিন, সে মহিলার সেই চেঁচামেচি সহ্য করতে পারে নি। সোজা ধারালো এক অস্ত্র হাতে নিয়ে এসে মহিলার পিঠে ও বুকে দুটো কোপ বসায়। আব্রাহাম তখন কেবল রুহীকে নিয়ে অডিটোরিয়ামের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো। এরকম এক দৃশ্য দেখে দু’জনেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। আব্রাহাম দৌড়ে এগিয়ে যায় মুবিনের দিকে এবং রুহীর মস্তিষ্ক এই ধাক্কা সামলাতে না পারে নিশ্চল হয়ে যায়। দরজার সামনেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় সে। রুমে উপস্থিত সকল শিক্ষার্থী নিজেদের শিক্ষিকার প্রতি সেই নৃশংসতার সাক্ষী হয়। দু একজন গা গুলিয়ে উক্ত জায়গায়ই বমি করে দেয়। সকল হোস্টেজের মনেই তখন প্রতিধ্বনি হচ্ছে একটাই কথা,

“ এরকম ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হওয়ার থেকে মৃত্যু বরণ করা ঢের সহজ। “

আব্রাহাম মুবিনকে থামাতে গেলে তাদের হাতাহাতির মাঝেই মুবিন আরেকটা কোপ বসায় রুনা ফারহানার দেহে। তবে এবারের কোপটা রুনা ফারহানার গলার কাছটায় লাগে। মুহুর্তেই দেহটা ঝাকি তুলতে তুলতে সকলের সামনে নিশ্চুপ হয়ে যায়। সেই থেকে যে রুহী জ্ঞান হারিয়েছে এখনো তার জ্ঞান ফিরে নি। অবশ্য আব্রাহাম কাউকে তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করার আদেশ দেয়ও নি। হৃদয়বান দূর্বল মেয়েটার প্রতি এটা আব্রাহাম যেনো কোনো দয়া করলো। আব্রাহাম মনে মনে শুধায়,

“ তুমি ঘুমাও রুহী। এই তান্ডবলীলা স্ব চোক্ষে সহ্য করতে পারবে না তুমি। তোমার ঘুমে কেউ ব্যাঘাত ঘটাবে না আজ। “

__________

কলেজ এরিয়ার চারিদিকটা সম্পূর্ণভাবে সামরিক বাহিনী নিজেদের অধীনে নিয়ে এসেছে। এই এরিয়ার ধারে কাছেও কোনো সাধারণ মানুষ কিংবা সাংবাদিকদের আনাগোনার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। যদিও হোস্টেজদের পরিবারের সদস্যরা ইতিমধ্যে সেখানে ভীড় জমিয়ে কান্নার রোল জুড়ে বসেছে, তবে তাদের সামলানোর দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছে পুলিশের কাধে। কিছু সংখ্যক পুলিশ যেখানে শান্তনা মূলক কথা দ্বারা তাদের শান্ত রেখে সাহস জোগানোর চেষ্টা করছে, সেখানে অন্য প্রান্তে কিছু সংখ্যক পুলিশ চামারের ন্যায় আচরণ করছে তাদের সঙ্গে। এরই মাঝে রয়েছে সাংবাদিকদের ভীড়। যারা সন্তানের প্রাণ আশংকায় ভীত বাবা মা’র দিকে ক্যামেরা তাক ছুড়ে যাচ্ছে অদ্ভুৎ সব প্রশ্ন।

“ আপনার কি মনে হয় ভেতরে আপনার সন্তান কি অবস্থায় আছে? আপনার কি নিজের সন্তানের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ হয়েছে? “

টিভির নিউজ চ্যানেলের দিকে স্থির এক জোড়া দৃষ্টির মালিক তীব্র ঘৃণা মিশ্রিত স্বরে বলে উঠে,

“ কি অদ্ভুৎ কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রশ্ন! “

চৌধুরী নিবাসের প্রায় সকল সদস্যরাই আজ বাসায় উপস্থিত। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে এরকম একটা নিউজ দেখার পরে তরী রশীদ বাদে আর কেউই বাসা থেকে বের হয় নি। টিভির সামনে বসে থাকা সকলে পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর বলা কথাটার গভীরতা উপলব্ধি করে। এইতো বেশিদিন না। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে কেবল ছয় মাস পিছিয়ে গেলেই এরকম একটা দিনের সাক্ষী হয়েছিলো তারা। যখন তাদের ঘরের ছেলে এবং ছেলে সমতুল্য মেয়ে জামাই আতঙ্কবাদীদের কব্জায় বন্দী ছিলো। সেদিন চৌধুরী এবং রশীদ পরিবারের সকলেও এদের মতো নিজেদের সন্তানকে অক্ষুণ্ণ অবস্থায় ফিরে পাওয়ার প্রার্থনায় মশগুল ছিলো। আফজাল চৌধুরী মনে মনে মানত করেছিলেন যে ছেলে দুটোর জন্য সদকা হিসেবে মসজিদে এতিম শিশুদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করবে। তূর্য ও শোভন যেদিন সুস্থ হয়ে নিজ নিজ বাড়ি ফিরে সেদিন আফজাল সাহেব নিজের মনের সুপ্ত মানত পূরণ করেছিলেন।

লিভিং রুমের একপাশে একটা সোফায় বসে থাকা শোভন সবার অগোচরে নীরবে সেখান থেকে প্রস্থান করে। নিজের রুমে ফিরে এসে দরজাটা ভেতর থেকে লক করে অতি গোপন এক স্থান হতে বের করে উচ্চপদস্থ একজন সম্মানিত ব্যক্তি হতে পাওয়া একটা চিঠি। যেখানে লেখা রয়েছে,

শোভন মুহতাশিম চৌধুরী,

আমি যখন এই চিঠি লিখছি তখন আপনি হাসপাতালে জীবন মরণের পাঞ্জা লড়ছেন। অফিসার শোভন বিশ্বাস করুন যখন আমাকে এই মিশনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় এবং আমি হোস্টেজ লিস্টে আপনার নামটা দেখি তখন আমি বাকহারা হয়ে পড়ি। এইতো কিছুদিন পূর্বেই তো আমাদের দেখা হলো। তরতাজা এক প্রাণকে আমি এমন এক কেস নিয়ে তদন্ত করতে দেখি যেই কেসকে উপরমহল হতে অপ্রয়োজনীয় বলে বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু আপনি সেদিন সেই আদেশের তোয়াক্কা করেন নি। দুর্দম্য সাহস নিয়ে একাই কেসটার ছক কষতে শুরু করেন। সকল অর্ডারের বিরুদ্ধে গিয়ে। আমার বিশ্বাস আপনি খুব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবেন। নিজের পরিবারের জন্য আপনি সুস্থ হবেন। এই দেশের বুকে একজন শোভন মুহতাশিমের প্রয়োজন বলেই আপনি সুস্থ হবেন। এই চিঠিটা পড়ার জন্য হলেও আপনাকে সুস্থ হতে হবে।

আপনি চিন্তা করবেন না। এই কেসটা আমি এখানেই ছেড়ে দিবো না। এই কেসের সাথে জড়িত প্রতিটা কেঁচোকে তাড়া করবো। তারা যেই গর্তেই গিয়ে লুকিয়ে থাকুক না কেনো আমি সেই গর্ত খুড়বো প্রয়োজনে। ইনশাআল্লাহ গর্ত হতে কেঁচো ও সাপ দুটোকেই বের করতে সক্ষম হবো। হতেই হবে। কারণ যেখান থেকে শোভনদের দায়িত্বের ইতি ঘটে সেখান থেকেই দূর্জয়দের সেই দায়িত্বের ভার বইতে হয়।

May our country live long.

ইতি,
মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়।

সম্পূর্ণ চিঠিটায় একবার চোখ বুলিয়ে শোভন জানালা দিয়ে একবার বাহিরে তাকায়। বিড়বিড়িয়ে বলে,

“ আল্লাহ আপনার সহায় হোক মেজর দূর্জয়। “

__________

সামরিক বাহিনীর জিপে করে ‘Do not cross the line’ এর সীমানা অতিক্রম করে ভিতরে প্রবেশ করে স্পেশাল টিমের সদস্যরা। সামরিক বাহিনীর দখলে কলেজ সীমানার বাহিরে টাঙানো তাবুর ভেতর প্রবেশ করতেই তাদের দেখা হয় সেখানে দায়িত্বে থাকা বাকি সেনা সদস্যদের সঙ্গে। মেজর দূর্জয় রেডিও ইঞ্জিনিয়ারের টেবিলের কাছে এগিয়ে যেতে যেতে প্রশ্ন ছুড়ে,

“ টিল নাও এনি নেগোসিয়েশন করা সম্ভব হয়েছে? “

“ নো স্যার। টেরোরিস্টরা আমাদের কোনো কথার বিপরীতেই সাড়া দেয় নি। তাড়া সম্ভবত নেগোসিয়েশন করতে ইন্টারেস্টেড না। ঠিক গতবারের মতো। “

উত্তরট শুনে দূর্জয় কানে হেডফোন গুজে কিছু শোনার চেষ্টা করে। কিন্তু আশানুরূপ কোনো লাভ হয় না এতে। কারণ কলেজ ভবনের কাছে গিয়ে রেডিও সিস্টেম ইন্সটল করা সম্ভব হয় নি। আতঙ্কবাদীদের গুলি ছোড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাবুতে উপস্থিত সাত লেফটেন্যান্টের মধ্যে সাইফ ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ খালি যদি কর্ণেল স্যারের অর্ডার না থাকতো তাহলে আমি এক্ষুনি ভিতরে গিয়ে সবগুলা বাঙ্গির পুতেরে পুইত্তা রাইখা আসতাম। “

সাইফের কথা বাকি ছয়জনের কানে পৌঁছায়। কিন্তু তারা কোনো জবাব দেয় না। দূর্জয় সম্পূর্ণ সিচুয়েশন অবজারভা করে নিজের পকেট হতে হ্যান্ডহেল্ড ট্রান্সিভার বের করে। মুহুর্তেই হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা এবং আরো উচ্চপদস্থ কর্ণেলদের সঙ্গে কানেক্টেড হতেই দূর্জয় তাদের এখানকার সিচুয়েশন এনালাইসিস সম্পর্কে জানায়। দূর্জয় সাহস নিয়ে বলে,

“ স্যার অর্ডার দিন। আমরা ইন্সটেন্ট প্ল্যান ম্যাপ রেডি করছি ভিতরে প্রবেশ করার। “

কর্ণেল জুবায়ের শিকদার দূর্জয়ের কথায় বাগড়া দিয়ে বলে,

“ নো দূর্জয়। এখন ভিতরে প্রবেশ করা ঠিক হবে না। এখান থেকে যেই প্ল্যান ম্যাপ রেডি করে তোমাদের পাঠানো হয়েছে কেবল সেই অনুযায়ীই তোমরা কাজ করবে। “

দূর্জয় শান্ত গলায় বলে,

“ স্যার, ৮৭ জন হোস্টেজ এই মুহুর্তে প্রাণ ভয়ে তটস্থ হয়ে রয়েছে ওই কলেজের ভেতর। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত আসার অপেক্ষা করলে খুব দেরি হয়ে যাবে। আর তাছাড়াও রাতের অন্ধকারে পাওয়ার সাপ্লাই কেটে ভিতরে প্রবেশ করাটাও সেফ না। ভবনের কোথায় কোথায় বিপদ ওঁৎ পেতে রয়েছে আমাদের জানা নেই। আমার টিম মেম্বারদের সেফটি আর থাকবে না তাতে। “

কর্নেল জুবায়ের শিকদার দূর্জয়ের কথার পিঠে তেতে উঠে,

“ ডোন্ট ফরগেট ইউর আইডেন্টিটি দূর্জয়। ইউ আর এ সোলজার। তোমার একমাত্র কাজই হচ্ছে অর্ডার মানা। আর আমাদের অর্ডার সবসময় দেশ ও জাতির সুরক্ষার উদ্দেশ্যেই হয়ে থাকে। আর ইউ আর টকিং এবাউট দ্যা লেফটেন্যান্টস সেফটি? তোমার কি মনে হয় ইট ইজ এবাউট দেয়ার লাইফ? হোস্টেজদের উদ্ধারের জন্য জীবন দিতে হলেও ওরা দিবে। এ নিয়ে এতো ভাবাভাবির কি আছে? আর তবুও যদি তুমি এই বিষয়ে ভাবতে চাও তাহলে আমাকে এই মিশনের দায়িত্ব অন্য কারো হাতে দিতে হবে। “

জুবায়ের শিকদারের বলা কথাগুলো পৌঁছায় তাবুতে উপস্থিত সকলের কানেই। দূর্জয়ের রাগে শরীর কাপছে। সচরাচর সে সর্বদাই নিজের উচ্চপদস্থ সকলকেই সম্মান করে যদি সে সম্মানের যোগ্য হয়। কিন্তু এই কর্নেল জুবায়ের শিকদারের প্রতি দূর্জয়ের একরাশ বিরক্তি ও রাগ জমা রয়েছে। স্বাধীনতার পরে এই দেশের মাটিতে এভার ভিউ রেস্টুরেন্টের সেই টেরোরিস্ট অ্যাটাকের ঘটনাটা ফার্স্ট হোস্টেজ কেস ছিলো সামরিক বাহিনীর জন্য। একটা হোস্টেজ সিচুয়েশন ট্যাকেল দেওয়ার জন্য যেরকম বুদ্ধিসম্পন্ন হতে হয় তার লেশমাত্র কর্নেল জুবায়ের শিকদারের মধ্যে খুঁজে পায় না দূর্জয়। কিন্তু এই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র টু শব্দ করার সাহস দেখাতে গেলেই জুবায়ের শিকদার অতি কৌশলে বুঝিয়ে দেয়,

“ আমার অর্ডারের বাহিরে গেলে তোমার চাকরি বিপদে পড়বে মেজর দূর্জয় শাহরিয়ার। “

দূর্জয় কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই হ্যান্ডহেল্ড ট্রান্সিভার খ্যাত ওয়াকি টকির অপরপাশ হতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা বলে উঠে,

“ ফোলো দ্যা অর্ডার মেজর দূর্জয়। “

“ বাট স্যার… “

“ আই সেইড ফলো দ্যা অর্ডার মেজর দূর্জয়। “

এবার কিছুটা তেজ মিশিয়েই কথাটুকু বলে জুলফিকার। কর্নেল জুবায়েরের অর্ডারের সঙ্গে সে নিজেও সম্পূর্ণ একমত নয়। কিন্তু তার কাছে আর কোনো উপায় নেই। দূর্জয়কে এমন কোনো কাজ করার সুযোগ দিবে না সে যাতে দূর্জয়ের চাকরি হুমকিতে পড়ে। তাই সেই পিতৃ স্নেহ তুল্য অনুভূতি হতেই তিনি দূর্জয়ের মঙ্গলের জন্যই এমন কঠোর আচরণ করেন। দূর্জয় শক্ত গলায় জবাব দেয়,

“ রজার দ্যাট স্যার। “

হ্যান্ডহেল্ড ট্রান্সিভারটা ডিসকানেকটেড করে দূর্জয় মিনিট এক পাথরের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। চোখ বুজে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ছেড়ে সে নিজের রাগটা ধাতস্থ করার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে সে রাগে হাতের কাছের একটা পানির বোতল তুলে মেঝেতে আছাড় মারে। তার এহেন আচরণে কেঁপে উঠে তাবুতে উপস্থিত সকলে। দূর্জয় কারো দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে উঠে,

“ প্রস্তুতি নাও। আমরা সন্ধ্যার পর ভবনে প্রবেশ করবো। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]