এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৪.
সাদা রঙা চার দেয়ালে আবদ্ধ এই রুমটাকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবার ব্যক্তিগত কেবিনও বলা যেতে পারে। নিজের ব্যক্তিগত কেবিনে লেদারের তৈরী ইজি চেয়ারটায় আপাতত পিঠ এলিয়ে চোখ বুজে বসে রয়েছেন তিনি। গত ২১ ঘন্টা ধরে তিনি নির্ঘুম। শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ দেহটাও একটা নির্দিষ্ট সময় পর ক্লান্ত হয়ে আসে। ক্ষানিকের জন্য হলেও সামান্য আরাম খুঁজে। জুলফিকার মুজতবা এই ক্ষানিকের বিশ্রাম হতে দেহকে বঞ্চিত করেন না। আজ সারাদিনও তার ব্যাপক ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কাটবে। মোট কথা ঘুমানোর জন্য এক দন্ড সময় পাবেন না তিনি।
চোখ বোজা এবং দেহটা নিস্তেজ হলেও জুলফিকারের মস্তিষ্ক এখনো স্থির হয় নি। উনার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে রাজ্যের চিন্তা। চারজন আতঙ্কবাদী ধরা পড়েছে। সারারাত ধরে তাদের উপর চলছে সৈন্যদের বর্বর অত্যাচার। কিন্তু দেশদ্রোহী গুলো মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে। শরীরের সব রক্ত খোয়াতে প্রস্তুত তারা তবুও মুখ দিয়ে একটাও শব্দ করবে না। কেমন একগুঁয়ে ঘাউড়া স্বভাব এদের!
ওদিকে দূর্জয় সকাল সকাল হেডকোয়ার্টারে এসেই যে রইস দিলদারকে সেই ভয়ংকর সেলে নিয়ে প্রবেশ করেছে, এখনো সেখান থেকে বের হয় নি। জুলফিকার অবশ্য এতে বাঁধা দেয় নি। ছেলেটা মুখ ফুটে নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলতে কিংবা দেখাতে পারছে না। এমন অবস্থায় যদি ওই জানোয়ারটার উপর টর্চার করে এতো বড় ধাক্কা সামলে নিজেকে ধাতস্থ করতে পারে তবে তাতে কোনো ক্ষতি দেখে না জুলফিকার। অবশ্য সে মনে মনে ভেবে রেখেছে রইস দিলদারের একটা ব্যবস্থা করার কথা। কারণ অসভ্যটা দীপ্তর আসল পরিচয় জানে। ভুল করেও যদি একবার নিজের মুখ খুলে তাহলে দূর্জয়কে অযথা ভোগান্তি পোহাতে হবে। আবার এই বিষয়টার রেশ ধরে কর্ণেল জুবায়ের শিকদার দূর্জয়ের চাকরিও হুমকির মুখে ফেলতে পারে। লোকটা দূর্জয়কে খুব একটা পছন্দ করে না। তাই জুলফিকার মুজতবা এই ব্যাপারে কোনো রিস্ক নিতে চায় না।
তার উপর ডার্ক ওয়েবসাইটের সেই টেরোরিস্ট কমিউনিটি হতে পোস্ট করা দীপ্তর ছবি এবং লোকেশনের ব্যাপারটাও গোপন রেখেছে জুলফিকার। দীপ্তর বিষয়টা তিনি আজীবন গোপন রাখলেও লোকেশনের বিষয়টা নিয়ে আজ সন্ধ্যায় একটা মিটিং ডেকেছেন তিনি। সেখানে সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অনেক সদস্য উপস্থিত থাকবেন। সকলের সঙ্গে এই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই পর্যায়। এই পর্যন্ত তিনবার ট্রেস করা হয়েছে। অথচ প্রতিবারই সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দেশের নাম শো করছে। কি এক মহা মুশকিল!
জুলফিকার মুজতবার নীরব ভাবনায় ভাটা পড়ে দরজায় করাঘাতের শব্দে। তিনি চোখ মেলে তাকিয়ে সোজা হয়ে বসেন। কন্ঠে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলেন,
“ কাম ইন। “
সঙ্গে সঙ্গে দরজার নব ঘুরিয়ে রুমে প্রবেশ করে ইউনিফর্ম পরিহিত এক যুবক। জুলফিকার মুজতবাকে স্যালুট করে অভ্যাসগত ভঙ্গিতে দাঁড়ায় সে। কাটকাট চেহারার চঞ্চল স্বভাবের ছেলেটাকে দেখে নিয়ে জুলফিকার বলেন,
“ আগামী দুই ঘন্টা কি তোমার কোনো ব্যক্তিগত ব্যস্ততা রয়েছে লেফটেন্যান্ট সাইফ? “
সাইফের মনে পড়ে যায় তার প্রত্যয়ের সঙ্গে ওই স্কুটি ফেরত দিতে যাওয়ার প্ল্যান রয়েছে। কিন্তু তা নিশ্চয়ই জুলফিকার স্যারের সামনে বলার মতো বিষয় না? তাই সে উত্তর দেয়,
“ না স্যার। “
জুলফিকার মুজতবা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“ গতকাল সারাদিন আমরা কোন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছি তা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়। এসবকিছুর মধ্যে আমার অন্যার পরিবারের সঙ্গে কথা বলা হয়নি। তাই একটু পর আমি ওদের বাড়ি যাবো অন্যার ফাদারের সঙ্গে কথা বলার জন্য। রাফিকে বিষয়টা জানিয়ে দিও। ওকেও আমার সঙ্গে যেতে হবে। বিয়ের একদিন আগে বিয়ের কনেকে নিয়ে পালানো কোনো ভালো কাজ নয়। এতে মেয়েটার পরিবারকে অনেক অপমানজনক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তাই ওখানে যাওয়ার পর রাফি আগে অন্যার পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইবে, তারপর আমি ওদের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলবো। “
জুলফিকার মুজতবার বিচক্ষণ কথা এবং আশ্বস্ততায় সাইফ মুগ্ধ হয়। একগাল হেসে বলে,
“ অবশ্যই স্যার। “
“ আরেকটা দায়িত্ব দেওয়ার ছিলো তোমায় সাইফ। “
সাইফ দৃঢ় গলায় বলে,
“ আপনি অর্ডার করুন স্যার। “
জুলফিকার মুজতবা এই পর্যায়ে সামান্য শান্ত গলায় বলেন,
“ দায়িত্বটা ব্যক্তিগত। “
__________
হসপিটাল কেবিনের সিঙ্গেল বেডটায় উদাস ভঙ্গিতে বসে আছে নিশা। দৃষ্টি তার জানালা ভেদ করে দূর আকাশে স্থির। মনটা তার বেজায় খারাপ। গত কালের ঘটনার কোনটাই তার অজানা নয়। প্রিয় বান্ধুবী রুহীর জন্য তার মন ছটফট করছিলো সারাদিন। কেঁদেকেটে একাকার অবস্থা করে ফেলেছিলো সে। নাঈমার কোনো শান্তনা বাক্যও কানে তুলে নি। অথচ এখন কত ঘন্টা পেরিয়ে গেলো উদ্ধার অভিযান শেষ হওয়ার কিন্তু এখনো রুহীর সঙ্গে তার দেখা হয়নি। নিশা অবশ্য বেশ কয়েকবার রুহীর মা’র নাম্বারে কল করেছে। ভদ্র মহিলা জানিয়েছেন মেয়েটা সম্পূর্ণ ট্রমাটাইজড হয়ে আছে। মুখ ফুটে একটা কথাও বলছে না। এই অবস্থায় ওকে আগে স্বাভাবিক হয়ে উঠার সময় দেওয়া উচিত। তারপর নাহয় নিশার সঙ্গে তিনি রুহীর কথা বলার ব্যবস্থা করে দিবেন।
দৃষ্টি ফিরিয়ে নিশা নিজের পায়ের দিকে তাকায়। পা’টা এখন সুস্থ থাকলেই তার আর কোনো বাঁধা থাকতো না। দৌড়ে সে পৌঁছে যেতো রুহীর কাছে। এরকম একটা সিচুয়েশনে ওকে একা ছাড়তো না কখনো। কিন্তু নিশা নিজেই এখন অন্যের সাহায্য ছাড়া চলার মতো অবস্থায় নেই। সে কিভাবে কাউকে সাহায্য করবে?
নিশার ভাবনার অবসান ঘটে কেবিনের দরজায় কারো নক করার শব্দে। সে সঙ্গে সঙ্গে আরেকটু সোজা হয়ে বসে। এভাবে নক করে কেবল তার নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত সামরিক বাহিনীর সৈন্যরাই প্রবেশ করে। দরজার খুলে ভেতরে কেউ প্রবেশ করতেই নিশা দৃষ্টি তুলে সম্মুখ পানে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রফুল্ল গলা বলে উঠে,
“ হ্যালো মিস ইয়াসমিন। কেমন আছেন? “
নিশা মৃদু অবাক হয়ে বলে,
“ সাইফ ভাইয়া। আপনি? “
নিশার এই ভাইয়া ডাকটা সাইফের কাছে অসহ্যকর ঠেকে। তার খুব বলতে ইচ্ছে করে,
“ হ্যাঁ, আমার পাতানো বোন। আমি। আপনার পাতানো ভাই সাইফ। “
কিন্তু সাইফ তা বলে না। বরং মুখটা সামান্য পানসে করে বলে,
“ স্যার আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। উনার হাতে কিছু কাজ আছে। বলেছেন রাতে ফিরবেন। “
নিশা মুখ কালো করে রয়। আজ তাকে হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করা হবে। হসপিটাল থেকে সে যাবে তার আব্বুর কাছে আর্মি কোয়ার্টারে। এখন থেকে সেখানেই থাকবে সে। তার আব্বু আম্মুর এই দীর্ঘ ঝগড়ায় জয় আব্বুরই হয়েছে। ট্রফি হিসেবে পেয়েছেন নিজের মেয়ে ইয়াসমিন মুজতবা নিশাকে।
হঠাৎ নাঈমার এই সিদ্ধান্ত বদলের কারণ নিশা আন্দাজ করতে পারে। হয়তো তার আম্মু গত কয়েকদিনের আতঙ্কবাদীদের ঘিরে এই ঘটনা গুলোয় ভীত হয়ে পড়েছেন। হয়তো তিনি ভাবছেন যে নিশা সেনা নিরাপত্তার অধীনে বেশি সুরক্ষিত থাকবে। তবুও নাঈমার মনে খচখচ করছিলো কিছু ব্যাপার নিয়ে। জুলফিকার সারাদিন বলতে গেলে বাহিরেই থাকে। নিশাও এখনো সম্পূর্ণ সেড়ে উঠে নি৷ হাঁটাচলা কিংবা বাথরুমে যাওয়া এরকম আরো কিছু বিষয়ের জন্য তার কারো সাহায্যের প্রয়োজন। কিন্তু জুলফিকার সেই বিষয়েরও একটা সমাধান করে দেন। যতদিন না নিশা সম্পূর্ণ সাপোর্ট ছাড়া চলাফেরা করতে পারবে ততদিন তার দেখাশোনার জন্য হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে একজন নার্স নিযুক্ত থাকবে। এইটুকু শুনে নাঈমা আশ্বস্ত হয়। আর টু শব্দ করে না সে।
যাকে ঘিরে এতো বিবাদ, এতো কথা সে এসব ব্যাপারে কোনো বাঁধ সাধে নি। কারণ নিশা দু’জনকেই ভালোবাসে। জুলফিকার এবং নাঈমা দুজনের অনুভূতিকেই সম্মান করে সে। পারলে সে নিজেকে দু ভাগ করে ফেলে। অত:পর এক ভাগ থাকবে তার আব্বুর কাছে এবং অন্যভাগ থাকবে তার আম্মুর কাছে। এতে দু’জনের একজনকেও সন্তান ছাড়া থাকার কষ্ট পোহাতে হবে না। নিশার মাঝে মধ্যে খুব ইচ্ছে করে এই দোয়া চাইতে যেনো তার আম্মু আব্বু আবার এক হয়ে যায়। কিন্তু তার বিবেক তখন তাকে বাঁধ সাধে। কারণ সে খুব ভালো করেই জানে, তালাক হয়ে যাওয়ার পর স্বামী স্ত্রী একে অপরের জন্য হারাম হয়ে যায়।
দীর্ঘ সময় ভাবনায় ডুবে থাকা নিশাকে পরখ করে সাইফ। মনে মনে ভাবে জীবন কত বিচিত্র। কিছু মানুষ মা বাবা, পরিচয়, পরিবার সব থাকা সত্ত্বেও উদাসীন থাকে। আর অন্যদিকে সাইফের মতো বেহায়ারা কোনো কিছু ছাড়াই কি সুন্দর ভালো থাকছে! এতদূর ভাবতেই সাইফ নিজেকে প্রশ্ন করে,
“ আসলেই আমি ভালো আছি? “
__________
কোলাহল পূর্ণ গার্লস হোস্টেলের সামনে রাস্তার ওপাশে একটা স্কুটি নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রত্যয়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে সে পরখ করছে হোস্টেলে প্রবেশ করা এবং ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা সকল মেয়ে গুলোকে। সবাই কেমন কৌতূহলী চোখে প্রত্যয়কে মাথা থেকে পা পর্যন্ত স্ক্যান করছে। খুবই বিব্রতকর এবং বিরক্তিকর অনুভব করে প্রত্যয়। মেয়ে গুলোর কি ঘরে বাপ ভাই নেই নাকি? তার উপর এই সাইফটা এক উটকো ঝামেলা তার কাধে ঝুলিয়ে দিয়ে নিজে এখন পালিয়ে গিয়েছে।
বিরক্তি এবং শেষ বিকেলের হুট করে অনুভূত ভ্যাপসা গরমে যখন প্রত্যয় তিক্ত অনুভব করছে, ঠিক সেই মুহুর্তে হোস্টেলের গেট দিয়ে একটা স্কার্ট এবং টপস পরিহিত মেয়েকে প্রবেশ করতে দেখে সে। উক্ত মেয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য প্রত্যয় সামান্য গলা ছেড়ে ডাকে,
“ এক্সকিউজ মি জেসিয়া ফাইরোজ লাবণ্য। “
স্পষ্ট পুরুষালি গলায় উচ্চারিত নিজের নামটা জেসির কান পর্যন্ত পৌঁছায়। সে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় নীল রঙা শার্ট এবং ছাই রঙা জিন্স পরিহিত এক যুবককে। সঙ্গে সঙ্গে জেসির মেজাজ বিগড়ে যায়। সে দ্রুত পায়ে রাস্তা পাড় করে প্রত্যয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠে,
“ ইউ ব্লাডি চোর! কুত্তা। আমার স্কুটি নিয়ে কই পালাইসিলি তুই? “
ভরা রাস্তায়, এতগুলো কৌতূহলী দৃষ্টির ভীড়ে নিজের থেকে কম বয়সী এক মেয়ের মুখে এরকম আজেবাজে গালি শুনে অপমানে প্রত্যয়ের মুখ থমথমে হয়ে আসে। সে নিজের রাগটা চেপে গিয়ে স্কুটির উপর একটা চাবি রেখে গরম গলায় বলে উঠে,
“ হেয়ার ইজ ইউর স্কুটি এন্ড ইউর কি। “
এতটুকু বলে প্রত্যয় নিজের ওয়ালেট থেকে গুণে গুণে পাঁচটা হাজার টাকার নোট বের করে সেই চাবির নিচে রেখে বলে,
“ এন্ড দিজ ইজ ফর ইউ। আই থিংক ইউ নিড সাম হেল্প। গো এন্ড ভিজিট এনি সাইকিয়াট্রিস্ট। “
এতদূর বলেই প্রত্যয় আর অপেক্ষা করে না। গমগম পায়ে হেঁটে সেখান থেকে প্রস্থান করে। ভিতরে ভিতরে তার শরীর জ্বলছে। তাকে কিনা চোর বলে? প্রত্যয়ের কিসের এতো ঠ্যাকা পড়েছে যে এই মাথানষ্ট মেয়ের স্কুটি চুরি করার? যেখানে কিনা প্রত্যয়ের এক কলেই তার জন্য রোয়েল রন্সে এসে হাজির হতে প্রস্তুত।
__________
ভাঙাচোরা বিহীন সুন্দর রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসে আছে ড্রাইভার এবং সাইফ। আর পিছনের সিটে বসে রয়েছে নিশা এবং তার জন্য নিযুক্ত করা নার্স কলি। যাকে ইতিমধ্যে নিশা কলি আপু বলে সম্বোধন করে। গাড়ি যত এগোচ্ছে ততই নিশার জগৎ ভুলে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কোনো কিছুই তার ভালো লাগছে না। আজ সকাল থেকে আম্মু হসপিটালে তার সঙ্গে দেখা করতে আসে নি। কেবল দু’বার ফোন করেছে। তাও নিশাকে নয় বরং কলি আপুকে। সাধারণত এসব বিষয় নিয়ে নিশা কখনো খুব একটা মন খারাপ করতো না। কিন্তু এই অপারেশনের পর থেকেই তার ছোট ছোট বিষয়ে খুব মন খারাপ হয়। বলা হয়ে থাকে মানুষের নাকি শারীরিক অবস্থা নড়বড়ে হলে তার মানসিক দৃঢ়তা এভাবেই দূর্বল হয়ে পড়ে। নিশার বেলায়ও তা হচ্ছে। মন খুলে হাঁটতে না পারা, সামান্য পায়ে ভর দেওয়ার চেষ্টা করলেও সেলাইয়ে টান খাওয়া এইসব কিছু তাকে খুব পীড়া দিচ্ছে। যার প্রভাব তার মানসিক অবস্থায় পড়ছে।
ফ্রন্ট সিটে বসে থাকা সাইফ অগোচরে লক্ষ্য করে সেই অশ্রুতে টইটম্বুর করা চোখ জোড়া। চোখের পলক পড়লেই সেই অশ্রু গুলো গাল গড়িয়ে পড়তে বিন্দুমাত্র সময় নেবে না। ছন্নছাড়া, শেকরহীন সাইফের আচমকা খুব মায়া লাগে মেয়েটার জন্য। পর মুহুর্তেই সে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। নিজের অবচেতন মনকে শাসায় ভুল পথে পা বাড়ানো থেকে। শেকরহীন সাইফ কভু সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হয় নি। সে মুক্ত পাখির ন্যায় আকাশ জুড়ে উড়ে বেড়ায়। যার নীড়ে ফেরার কোনো তাড়া নেই। এরকম মুক্ত পাখিকে খাঁচা বন্দী করার অস্ত্র একটাই। মায়া। কিন্তু সাইফ কখনো খাঁচা বন্দী হতে চায় না। তাই এসকল মায়াকে অগ্রাহ্য করাই উত্তম মনে করে সে।
__________
দু দিন মেয়েকে ছাড়া বেশ হাপিয়ে উঠেছে বাণী। আর অপেক্ষা সম্ভব নয় তার দ্বারা। অতি শীঘ্রই তার এখান থেকে যেতে হবে। সাপের গুহা থেকে নাগ মণি চুরি করার মতো কঠিন কাজ সম্পন্ন করে তার পালাতে হবে।
রাত তখন কয়টা বাজে কে জানে। বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে যখন বাণী এসব ভাবতে ব্যস্ত তখনই কলিংবেলটা বেজে উঠে। বাণী নড়েচড়ে উঠে বসে। এই সময় কে আসতে পারে তা সে আন্দাজ করতে পারে। শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে নিয়ে সে বিছানা ছেড়ে নামে। মেইন দরজার কাছে গিয়ে সে পীপহোল দিয়ে একবার শনাক্ত করে দরজার অপর পাশের মানুষটাকে। নিশ্চিত হতেই সে দরজা খুলে সড়ে দাঁড়ায়। দূর্জয়কে দেখতে আজ গতকালের তুলনায়ও বেশি বিধ্বস্ত লাগছে। বাণী আগ বাড়িয়ে আর কোনো কথা বলে না। সে নীরবে মেইন দরজাটা আটকে দিয়ে নিজের জন্য নির্ধারিত রুমের দিকে পা বাড়াতে নিলেই একটা থমথমে স্বর বলে উঠে,
“ আমার সামনে এসে বসো বাণী। “
বাণী ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকায়। দূর্জয় ইতিমধ্যে সোফায় গিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে পড়েছে। বাণী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অত:পর দূর্জয়ের কথামতো তার মুখোমুখি অপর পাশের সোফায় গিয়ে বসে। দূর্জয় বেশ শান্ত তবে গম্ভীর গলায় বলে,
“ শুরু করো। “
বাণী মাথা নিচু করে রয়। সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে দূর্জয় কি শুরু করতে বলেছে। তবে সে বুঝতে পারছে না ঠিক কোথা থেকে শুরু করা উচিত। বাণীর নির্লিপ্ততা দেখে দূর্জয় এবার বলে,
“ আমি কোনো অন্তর্জামী নই বাণী। কারো নীরবতা পড়ার মতন অলৌকিক ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দেয় নি। তাই কষ্ট করে তোমাকে মুখ ফুটে আমাকে সবটা বলতে হবে। ট্রাস্ট মি, আমি এখানে তোমার এই নত দৃষ্টি দেখতে আসি নি। তাই আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না। “
দূর্জয়ের এতদূর কথার পিঠে বাণী শুকনো গলায় বলে উঠে,
“ তেষ্টা পাচ্ছে। একটু পানি খেয়ে নেই? “
চলবে…