এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-৩৯+৪০+৪১

0
190

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৯.

এতক্ষণ ধরে বাণীর কোলে মুখ লুকানো ছানাটা এবার ঘাড় ঘুরিয়ে মুখ তুলে পিছনে তাকালো। অপরিচিত লোকটাকে দেখে নিজের কান থেকে হেডফোনটা খুলে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে থাকলো। যেনো চোখের ইশারায় জানতে চাইছে,

“ তুমি কে বাপু? তোমাকে তো চিনলাম না৷ “

সামনে বসা মানুষটা বহ্নির না বলা প্রশ্নটা যেনো বুঝতে পারলো। একহাতে নিজের মুখে বাঁধা রুমালটা নামিয়ে কোমল স্বরে বলে,

“ হাই বহ্নি। ইট’স মি। মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়। রিমেম্বার মি? “

বহ্নি মনে করার চেষ্টা করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মনে পড়ে। এই লোকটা অনেকটা এরকমই বেশভূষায় সে আগেও দেখেছিলো। সাথে ছিলো অনেকগুলো আংকেল। ষ্টুপিড আংকেলটাও ছিলো। মনে পড়তেই বহ্নি মাথা নেড়ে বুঝায় সে চিনতে পেরেছে। দূর্জয় নিজের মুখের রুমালটা তুলে নেয় দ্রুত। হাতে বেশি একটা সময় নেই তার। সে নিজের পকেট হতে আরো দুটি রুমাল বের করে দ্রুত বাণীর হাতে দিয়ে বলে,

“ তাড়াতাড়ি মুখ বেধে নাও। বহ্নিকেও ভালো করে বেধে দাও। বাহিরে গ্যাস আছে। কাশি উঠতে পারে। “

দূর্জয়ের তাড়াটা বাণীর মস্তিষ্ক সচল করে তুলে। সে দ্রুত অশ্রু মুছে চোখের পলকে নিজের আর বহ্নির মুখটা বেধে নেয় রুমাল দ্বারা৷ এরই মাঝে বড় বড় পা ফেলে রুমে প্রবেশ করে ইউনিফর্ম পরিহিত সাইফ। তাকে দেখতেই বহ্নি প্রফুল্ল গলায় চেঁচিয়ে উঠে,

“ মাম্মা দেখো ওই স্টুপিড আংকেল। “

এইটুকু বাচ্চার মুখে বিরক্তিকর ডাক শুনে সাইফের রাগ উঠে। ইয়াসমিনের ভাইয়া ডাকের পর তার জীবনে শোনা সবথেকে বিরক্তিকর সম্বোধন বোধহয় এটাই। তবুও সে নিজের রাগটুকু চেপে দূর্জয়ের কাছে এসে নিচু গলায় জানায়,

“ স্যার পুরো বাসা সার্চ করেছি। গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটা স্কেপ ওয়ে পেয়েছি। আমাদের আগমনের আলামত দেখে হিরণ সেই পথ ধরে পালিয়েছে সঙ্গে কয়েকজনকে নিয়ে। “

দূর্জয় বিরক্তি নিয়ে বলে উঠে,

“ কাপুরষ কোথাকার! “

সাইফ সঙ্গে সঙ্গে আস্বস্ত করে জানায়,

“ চিন্তা করবেন না। পিছনে জুনায়েদ, ফারদিন আর ব্যাক আপ টিমের কিছু সদস্যও গিয়েছে। আশা করছি অসভ্যটাকে ধরতে পারবে। “

হিরণ যে পালিয়েছে এই সূক্ষ্ম কথাটুকু বহ্নি না শুনলেও বাণী ঠিকই শুনতে পেয়েছে। মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। আর কি আশা করা যায় এই পুরুষের কাছ থেকে? বিপদে পড়তেই ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে গেলো। ঠিকি নিজের গা বাঁচিয়ে পালিয়ে যেতে দ্বিধা করলো না। দূর্জয় সাইফের কথা শুনে মৃদু আশ্বস্ত হয়েই বাণীকে নিচু স্বরে বলে,

“ লেট’স নট ওয়েস্ট আওয়ার টাইম এনিমোর। “

বাণী মেয়ের হাত শক্ত করে ধরে প্রস্তুত এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু তার পূর্বেই দূর্জয় ফের একবার বহ্নির দিকে ইশারা করে বলে,

“ আই নিড টু টক টু হার। মে আই? “

বহ্নি সামান্য মাথা নেড়ে অনুমতিটুকু দিতেই দূর্জয় বিলম্ব করে না। হাঁটু গেড়ে ফের বহ্নির সামনে বসে তার হাত দুটো নিজের বড় হাতের মুঠোয় পুড়ে শুধায়,

“ বহ্নি দিজ ইজ এ গেম রুল। আপনাকে জাস্ট তিনটা রুলস ফলো করতে হবে। আপনি কি প্লিজ আমার সঙ্গে কো অপারেট করবেন? “

বহ্নি অবাক হয়। সামনে বসে থাকা লোকটার পারমিশন চাওয়ার ভঙ্গিমা দেখে সে মনে মনে লোকটাকে জেন্টালম্যান হিসেবে খ্যাত করে। অত:পর মাথা নেড়ে বুঝায় সে কো অপারেট করতে রাজি। দূর্জয় মৃদু হেসে বলে,

“ রুল নাম্বার ওয়ান হলো যতক্ষণ না আমি বলবো আপনি চোখ খুলবেন না। রুল নাম্বার টু হলো আপনি গুড গার্ল হয়ে গাড়িতে মাম্মার কোলে বসে থাকবেন, একটুও নড়াচড়া করবেন না। রুল নাম্বার থ্রি হলো আপনি কান থেকে হেডফোন খুলবেন না। “

বহ্নি রুলস গুলো শুনে দাঁত বের করে হেসে বলে,

“ এগুলো তো খুব ইজি। “

দূর্জয়ও আরেকদফা ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি ফুটিয়ে বহ্নির কানে হেডফোনটা পড়িয়ে দেয়। অত:পর উঠে দাঁড়িয়ে সাইফকে বলে,

“ নিচে যাও। আমরা আসছি। “

সাইফ চলে যায়। বাণী আচমকা কিছু একটা ভেবে দ্রুত দৌড়ে গিয়ে বহ্নির আলমারি থেকে একটা শপিং ব্যাগ বের করে নিজের হাতে নিয়ে নেয়। দূর্জয়ের কাছে এসে বলে,

“ তোমার মায়ের শাড়ি। একদম আগের মতোই আছে। “

দূর্জয় নীরবে একবার বাণীকে দেখে ফের ব্যাগের দিকে তাকায়। বাণী তালুকদার তার মায়ের শাড়ির অযত্ন করে নি। বিষয়টা কি ভালো লাগার? জানে না দূর্জয়। সে নীরব রয়। বাণীও আর কথা না বলে বহ্নিকে কোলে তুলে নিতেই বহ্নি দূর্জয়ের কথা মতো চোখ বন্ধ করে ফেলে। চোখ বন্ধ করে হেডফোন হতে ভেসে আসা গানের শ্রুতিমধুর সুর শুনতে ভালো লাগছে বেশ। দূর্জয় বাণীকে বলে,

“ চলো। “

বলেই দূর্জয় পা বাড়ায়। বাণীও পিছু পিছু বেরিয়ে আসে। সিঁড়ি হয়ে নামার সময় আচমকা বাহির থেকে ফের গুলি বর্ষণের শব্দ ভেসে আসে। আকস্মিক শব্দে বাণী ভীত হয়। ভয়ে কুঁকড়ে উঠে টাল সামলাতে না পেড়ে সে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে। চিৎকার করার সুযোগ পেলো না মোটেও। কোল থেকে বহ্নি পড়ে যেতে নিলেই সামনে থেকে দূর্জয় দ্রুত বলিষ্ঠ বাহু দ্বারা বাধা দেয়। পরপর নিজেই বহ্নিকে কোলে তুলে নিয়ে সতর্ক করে বলে,

“ সাবধানে হাঁটো তবে দ্রুত। “

ছোট্ট মানুষটা একহাতে কোলে জড়িয়ে অপর হাতে পিস্তলটাকে শক্ত করে চেপে ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে দূর্জয়। পিছু পিছু বাণীও। ফ্রন্ট ইয়ার্ডটা তখন সম্পূর্ণ সেনাদের আয়ত্তের অধীনে। দূর্জয় সবার আগে সাইফকে প্রশ্ন করে,

“ কিসের ফায়ারের শব্দ হলো? “

“ স্যার হিরণের একজন লোক ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিলো। সুযোগ পেতেই পালানোর চেষ্টা করে। সাদাত ওর পিছু পিছু গিয়েছে। ও-ই হয়তো ফায়ার করছিলো। “

দূর্জয় আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,

“ আমি ওদের নিয়ে যাচ্ছি। তোমরা কাজ শেষ করে সরাসরি হেডকোয়ার্টারে পৌঁছাবে। “

এখানেই অর্ডারের ইতি টেনে দূর্জয় দ্রুত বাড়ির সীমানার বাহিরে বেরিয়ে আসে। বাণী এই ত্রিসীমানার বাহিরে প্রথম কদম রাখতেই মনে মনে বলে,

“ আলহামদুলিল্লাহ। “

দ্রুত পা ফেলে বাড়ি থেকে মিনিট দু’য়েকের দূরে যেতেই বাণী দেখে একটা গাড়ি রাস্তার পাশে অপেক্ষমান। কালো এই জিপ গাড়িটা যে দূর্জয়ের তা চিনতে ভুল করে নি সে। দূর্জয় গাড়ির ফ্রন্ট সিটের দরজা খুলে দিতেই বাণী নীরবে গাড়িতে উঠে বসে। দূর্জয় তাড়া দিয়ে বলে,

“ সিটবেল্ট বাঁধো জলদি। “

বাণী কথাটুকু মেনে সেই অনুযায়ী কাজ করতেই দূর্জয় বহ্নিকে বাণীর কোলে দিয়ে দেয়। অত:পর গাড়ির দরজা আটকে নিজেও দ্রুত ড্রাইভিং সিটে গিয়ে উঠে বসে। এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে গাড়ি স্টার্ট দেয় সে।

__________

বড় বড় পা ফেলে জঙ্গলের মধ্যের পথ ধরে পালানোর চেষ্টা করছে এক যুবক। তাকে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে ইউনিফর্ম পরিহিত এক পুরুষ। যুবকটার চোখে মুখে আতঙ্ক এবং বিরক্তি এক সঙ্গে ফুটে উঠেছে। তাকে অনুসরণ করা পুরুষটার প্রতি সে বড্ড বিরক্ত। এই মুহুর্তে তার কাছে পিস্তল থাকলে সে মোটেও না পালিয়ে আগে এই ইউনিফর্ম পরিধেয় পুরুষটাকে খুন করতো। কিন্তু যেহেতু সে নিরস্ত্র সেহেতু পালানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হয় আপাতত।

আচমকা এক পাথরে পা লাগতেই সে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে। উঠে দাঁড়ানোর পূর্বেই সেই ইউনিফর্ম পরিহিত লোকটা কাছে এসে পড়ে। যুবকটা ক্লান্ত চোখ তুলে তাকায়। ভালো করে সামনের ব্যক্তিটার মুখ পরখ করে। লেফটেন্যান্ট সাদাত। অন্য এক সেনা সদস্যের মুখে নামটা শুনেছে সে।

সাদাত হাতের পিস্তলটা যুবকের দিকে তাক করে ধরে বলে,

“ সময় অপচয় করা আমার খুব অপছন্দের। এতক্ষণ দৌড়ে শুধু শুধু আমার সময় অপচয় করিয়েছিস তুই। মাথা গরম করে দিয়েছিস। “

যুবক বুঝে যায় তার বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। সে চোখ বুজে নেয়। এই সেনাদের হাতে বন্দী হয়ে অত্যাচারিত হওয়ার থেকে মৃত্যু বরণ করা উত্তম।

সাদাত ট্রিগার পুল করে শুট করতে নিবে এমন সময়ই সেখানে আরেকটা শূন্যে ফায়ারিং এর শব্দ হয়। সাদাত আর সেই যুবক চকিতেই পাশ ফিরে তাকায়। এক নারী পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের পিস্তলটা সাদাতের দিকেই তাক করা। সাদাত বিমূঢ় হয়ে সেই নারীকে পরখ করে। এই নারীকে সে আগেও দেখেছে। সাদাতের স্টকার। যার প্রতি শুরু থেকেই সাদাতের সন্দেহ ছিলো। কিন্তু এই সন্দেহভাজন নারীর অপ্রয়োজনীয় নামটা সে মনে করতে পারছে না। কি যেনো ছিলো নামটা? স্নেহা, সিয়া, সাধনা?

রণচণ্ডী সেই নারী ঝাঁঝালো স্বরে বলে,

“ লিভ হিম এলোন। “

সাদাতের ভ্রু কুচকে আসে। রাশভারী গলায় জানতে চায়,

“ হু আর ইউ? “

“ দ্যাট’স নান অফ ইউর বিজনেস। এখান থেকে চুপচাপ চলে যাও। আমি কিছুই করবো না তোমাকে। “

সাদাত বিরক্ত হয়। মেয়েটা কি তাকে দয়া দেখাতে চাচ্ছে?

“ এক্সকিউজ মি মিস। একজন সেনা সদস্যের অপারেশনে বাগড়া দেওয়ার শাস্তি সম্পর্কে আইডিয়া আছে? “

“ লুক মিস্টার, ট্রাস্ট মি আমার ব্যাপারে নাক না গলানোই এই মুহুর্তে তোমার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ। “

“ সরি? আমি নাক গলাচ্ছি? ইট’স ইউ যে প্রতিবার আমার পথে আসছো। আ’ম ওয়ার্নিং ইউ সরে যাও। ভেবো না নারী দেখে যেতে দিবো। আমার কাজে বাধা দিলে তোমাকে শুট করতে আমার মোটেও হাত কাঁপবে না। “

সাদাত আর অগ্যাত নারীর এই কথা কাটাকাটির মধ্যে সুযোগ বুঝে সেই যুবকটা ধীরে ধীরে এক পা, এক পা করে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যায়। অত:পর নিঃশব্দে সেখান থেকে পালায়। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে লালচে চুলের নারীটা চেঁচিয়ে উঠে। ক্ষোভ মিশ্রিত গলায় বলে,

“ তোমার কারণে ও আমার হাত ছাড় হয়ে গেলো। “

বলেই সেই নারী দ্রুত ওই যুবকের সন্ধানে দৌড়ে যেতে নিলেই সাদাত এসে তার হাত চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করে,

“ নিজের পরিচয় বলো মেয়ে। আমার চোখে ধূলো ছোড়ার চেষ্টা করবে না মোটেও। “

সেই নারী অপর হাতের সাহায্যে সাদাতকে আঘাত করার চেষ্টা করলে সাদাত সেই হাতও চেপে ধরে বলে,

“ নট দিজ টাইম। “

রমণী ক্ষুদ্ধ হয়। চোখ ঠিকরে যেনো তার আগুন বের হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ সে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করে। তাতে অবশ্য বিশেষ লাভ হয় না। পরিশেষে ব্যর্থ হয়ে সে সু কৌশলে নিজের পায়ের সাহায্যে সাদাতের হাঁটুর জয়েন্টে আঘাত করে। মুহুর্তেই সাদাত তাকে ছেড়ে ‘আহ’’ বলে চাপা আর্তনাদ করে মাটিতে বসে পড়ে। রমণী সামান্য হেসে বলে,

“ আগেই বলেছিলাম আমার কাজে বাধা দিবে না। আমার কাজে বাধা দেওয়ার ইনাম ছিলো এটা। “

রমণী উল্টো ফিরে এবার সেখান থেকে প্রস্থান করতে নিলেই সাদাত পিছন থেকে বলে উঠে,

“ দৃশান নামরা। এজেন্ট অফ ইন্টিলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট – ইয়েমেন। ইন্টারেস্টিং। “

দৃশান বিস্মিত হয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। সাদাতের হাতে নিজের জব সেক্টরের আইডি কার্ড দেখে আরো বিস্মিত হয়। দ্রুত সে নিজের জ্যাকেটের ভেতরের পকেটে তল্লাশি চালায়। খালি একদম। তার মানে কি কোনোভাবে সাদাতের সঙ্গে ধস্তাধস্তির সময় তার আইডি কার্ডটা পরে গিয়েছে? সাদাত ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি এঁকে দৃশানকে দেখছে। এই হাসি সাফল্যের। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই রমণীর সঙ্গে এতদিনের চোর পুলিশ খেলার অবসান ঘটলো তবে!

__________

দুই কিলোমিটার দীর্ঘ সুরঙ্গ পথের ইতি ঘটে জঙ্গলের মধ্যে এসে। টানেলের মুখ দিয়ে মাথা বের করে এক এক করে বেরিয়ে আসে পলাতকরা। এতক্ষণ মাটির নিচে ওই পথ ধরে আসতে বড্ড কষ্ট হয়েছে তাদের। একে তো অদ্ভুৎ ভ্যাপসা গরম, তার উপর যেনো অক্সিজেন স্বল্পতা। সকলেই মাটিতে হাত পা ছড়িয়ে বসে কিছুক্ষণ প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়। অত:পর ইবাত দ্রুত টানেলের দরজাটা বন্ধ করে হিরণকে তাড়া দেয়,

“ স্যার উঠুন। বেশিক্ষণ এখানে অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। “

হিরণের বুকের উঠানামার গতি অস্বাভাবিক। সে বলে,

“ ওরা আসুক। “

ওরা দ্বারা হিরণ কাকে বুঝিয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না ইবাতের। সে বড্ড বিরক্ত হয়। এই লোকটা কি নিজের ভালো বুঝে না নাকি? সে তবুও ধৈর্য্যশীল গলায় শুধায়,

“ স্যার ওরা সেফ থাকবে। চিন্তা করবেন না। এই মুহুর্তে আপনি বিপদে আছেন। বুঝার চেষ্টা করুন। নিজের কথা চিন্তা করুন একবার। “

হিরণ এবার রেগে যায়। ফুসে উঠে বলে,

“ কে বলেছে তোমাকে আমি নিজের কথা চিন্তা করছি না? নিজের কথা চিন্তা না করলে আমি কখনোই পালাতাম না। নিজের অর্জনগুলো এই কুকুরদের কাছে খোয়াতে রাজি না আমি। কিন্তু তাই বলে বাণী আর বহ্নিকে আমি ছেড়ে দিবো ভাবলে কি করে? “

ইবাত নীরব বনে যায়। স্যার ক্ষেপেছে। এই মুহুর্তে কিছু বললে উল্টো স্যারের রাগের পরিমাণ আরো বাড়বে। আচমকা টানেলের গোল মুখের ন্যায় দরজাটার অপরপাশ হতে করাঘাতের শব্দ হয়। সকলেই সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে উঠে দাঁড়ায়। হিরণ ভ্রু কুচকে দরজাটার পানে তাকিয়ে রয়। ইবাত সহ বাকিরা পরামর্শ দেয় পালানো শ্রেয়। হিরণ কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পূর্বেই দরজার অপর পাশ হতে একটা পুরুষালী গলা বলে উঠে,

“ দরজা খুলো। আমি আয়ান। কেউ আছো? প্লিজ দরজা খুলো। “

আয়ানের কণ্ঠ শুনেই চিনতে পারে ইবাত। সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে টানেলের দরজা বেয়ে বেরিয়ে আসে আয়ান। মাটিতে চিত হয়ে পড়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। হিরণ একদফা আয়ানকে দেখে নিয়ে আবার দরজার ভেতর তাকায়। কাউকে খুঁজতে মগ্ন তার চোখ জোড়া। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মুখ দুটো দেখতে না পেয়ে সে অধৈর্য্য গলায় প্রশ্ন করে,

“ বাণী কোথায়? আমার মেয়ে কোথায়? ওদের সাথে নিয়ে আসার কথা ছিলো। “

আয়ান কোনো মতে বলে,

“ স্যার আর্মিরা বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে ফেলেছিলো। আরাভ বাণী ম্যাডাম আর বহ্নিকে নিয়ে বের হতে পারে নি। আমি বহুকষ্টে টানেল দিয়ে পালিয়ে এসেছি। “

হিরণের মাথা বিগড়ে যায়।

“ বের হতে পারে নি মানে? আমার বাণী আর মেয়ে কোথায় তাহলে? “

“ হয়তো আর্মিদের হাতে ধরা পড়েছে স্যার। কিন্তু আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আসার পথে আমাদের বাহিরের লোককে ফোন করে জানিয়েছি। তিনটে গাড়ি তিন রোডে অপেক্ষারত থাকবে। জানোয়ার গুলো ম্যাডামকে নিয়ে যেতে পারবে না। আমাদের লোকেরা ম্যাডাম আর বহ্নিকে উদ্ধার করে নিয়ে আসবে যেকোনো মূল্যে। “

আয়ানের কথা শেষ হতে না হতেই হিরণ একটা কাজ করে। নিজের হাতের পিস্তলে অবশিষ্ট সবকয়টা বুলেট আয়ানের বুকে ফায়ার করে। শরীরটা বুলেট দ্বারা ঝাঁঝরা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মুহুর্তেই। ইবাত সহ উপস্থিত সকলেই ভীত হয়। হিরণ নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,

“ আমি কাউকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বেতন দেই না। বিপদ দেখতেই যারা আমাকে কিংবা আমার পরিবারকে রেখে পালানোর দুঃসাহস দেখাবে সবার পরিণতি এক হবে। “

হিরণের বলা কথাটা যে উপস্থিত সবার জন্য নীরব হুমকি ছিলো তা বুঝতে কারো অসুবিধা হলো না। হিরণ পিস্তল হাতে সেই জায়গা পরিত্যাগ করতে করতে শান্ত গলায় আদেশ দেয়,

“ কে, বা কারা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে এক্ষুনি খোঁজ নাও ইবাত। স্পষ্ট ভাষায় তাদের বলে দাও আই ওয়ান্ট মাই ওয়াইফ এন্ড ডটার সেফ এট এনি কোস্ট। “

স্যারের আদেশ পেতেই ইবাত পকেট থেকে ফোন বের করে স্যারের পিছু ধরে। বাকিরাও তাদের পিছু পিছু অনুসরণ করে। পিছনে পড়ে রয় এক রক্তাক্ত লাশ।

___________

গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে তৈরী পাকা রাস্তা হয়ে। সু বলিষ্ঠ হাতে গাড়ি ড্রাইভে মনযোগী দূর্জয়। চেহারায় আবার পূর্বের গাম্ভীর্যটা ফুটে উঠেছে। বাণী আড়চোখে একবার দেখে নেয় সেই মুখশ্রী। এক সাগর কৃতজ্ঞতা তার দৃষ্টিতে উথলে পড়ছে। কিন্তু তা প্রকাশ করার শাব্দিক ভাষা খুঁজে পায় না সে। তাই অতি নীরবে মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করে,

“ আমাকে অন্ধকার থেকে মুক্তি দেওয়া মানুষটার জীবন চিরকাল আলোকিত রেখো আল্লাহ। “

গাড়ি সু কৌশলে চালাতে ব্যস্ত দূর্জয় আচমকা গাড়ির লুকিং মিররে তাকাতেই থমকে যায়। নীরব শুনসান রাস্তায় পিছনে অতি নিকটে থাকা গাড়ির অস্তিত্ব ও তার গতিবিধি অবলোকন করে দূর্জয়ের মুখভাব আরো গম্ভীর হয়। মাথাটা ঠান্ডা রেখে গাড়ির গতি বাড়ায় সে। পিছনের ওই সাদা রঙা গাড়িটাও পাল্লা দিয়ে গতি বাড়ায়। দূর্জয় রাস্তাটা আরেকবার পরখ করে। সর্বোচ্চ গতিতে চালানোর পরও এই জঙ্গল পেরিয়ে মূল হাইওয়েতে পৌঁছাতে আরো বিশ মিনিটের অধিক সময় লাগবে। এতটা সময় কি আদৌ তার হাতে আছে? দূর্জয়ের সচল মস্তিষ্ক জবাব দেয় ‘নেই।’’

দূর্জয় শান্ত গলায় বাণীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ একটা গাড়ি আমাদের ফলো করছে। পিছনে ফিরবে না, ভুলেও তাকাবে না। উত্তেজিত না হয়ে শান্ত থাকো। শক্ত হয়ে বসে থাকো। আমি আছি। সামলে নিবো ইনশাআল্লাহ। “

বাণী বিচলিত হয় শুরুতে। কিন্তু দূর্জয়ের বলা ‘আমি আছি’ তে সে ভরসা খুঁজে পায়। নদীর পানির মতো শান্ত রয়। কিন্তু পিছনের গাড়িটা শান্ত রয় না। হিংস্র হায়নার ন্যায় যেনো ধাওয়া করছে। কেবল ধাওয়া করেই ক্ষান্ত হয় না। দূর্জয় দেখে সাদা গাড়ির ভেতর বসা দু’জনের একজন একটা রাক্ষুসে পিস্তল হাতে নিয়ে তার গাড়ির দিকে তাক করেছে। দূর্জয় সঙ্গে সঙ্গে মৃদু চেঁচিয়ে আদেশ দেয়,

“ বাণী হেড ডাউন। “

তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে ফায়ার ছুঁড়ে হায়নার দল। বাণী বহ্নিকে সহ মাথা নিচু করে ফেলে দ্রুত। দূর্জয় খপ করে নিজের পিস্তলটা হাতে তুলে নিতেই আরেকটা গুলি ছুড়ে পিছনের গাড়ি থেকে। এবার গুলিটা এসে দূর্জয়ের গাড়ির ব্যাক সাইডের কাঁচে লাগে। মুহুর্তেই পিছনের সিটটা চূর্ণবিচূর্ণ কাঁচ দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে যায়। দূর্জয়ের এতক্ষণের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে। সে একহাতে গাড়ির স্টিয়ারিং চেপে ধরে অন্য হাতে পিছনের গাড়ির দিকে ফায়ার করতে করতে চেঁচিয়ে উঠে,

“ বাস্টার্ড! হাও ডেয়ার ইউ টাচ মাই লাভ? “

এরকম সিরিয়াস একটা সিচুয়েশনেও দূর্জয়ের বলা কথা শুনে বাণী স্তব্ধ বনে যায়। চোখ তুলে সে দূর্জয়কে দেখে, দূর্জয়ের হিংস্র রূপটা দেখে। ফের বিমূঢ় হয়। সে কি এইমাত্র ঠিক শুনলো? দূর্জয় কাউকে মাই লাভ বললো? তাও কোনো মানুষ নয় বরং একটা গাড়িকে মিন করে? আর কিছু ভাবার সুযোগ পায় না বাণী। সামনের রাস্তার দৃশ্যটা দেখে সে চেঁচিয়ে উঠে,

“ দূর্জয় সামনে দেখো। “

দূর্জয় মুহুর্তেই সামনে তাকায়। আর ভয়ংকর দৃশ্যটা দেখে সে দ্রুত স্টিয়ারিংটা সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে ফেলে। গাড়ি প্রবেশ করে অন্য রাস্তায়। বাণীর তখনও বুক কাপছে। তার চোখের সামনে ভাসছে এই মাত্র দেখা দৃশ্যটা। দূর্জয় যখন পিছনের গাড়িকে কাবু করতে ব্যস্ত সেই সুযোগে সামনে থেকে আরেকটা গাড়ি সম্পূর্ণ গতিতে তাদের দিকে এগিয়ে আসছিলো। আর এক মুহুর্ত দেরি হলেই হয়তো সংঘর্ষটা হয়েই যেতো।

ভিন্ন রাস্তায় প্রবেশ করার পরও গাড়ি দুটো ক্ষান্ত দেয় নি। এখনো দূর্জয়ের গাড়িকে ধাওয়া করে চলেছে। দূর্জয়ের একহাত স্টিয়ারিঙে এবং অপর হাতে পিস্তল ধরা। সে ব্যস্ত গলায় বাণীকে শুধায়,

“ সামনে স্টোরেজ বক্সের ভেতর আমার ফোনটা। দ্রুত নাও। “

বাণী ভয়কে পাশে রেখে মাথা ঠান্ডা করে। এই মুহুর্তে বাঁচতে হলে তার মাথা ঠান্ডা রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। দূর্জয়ের মতো। বাণী সঙ্গে সঙ্গে স্টোরেজ বক্স খুলে কালো ব্যাক কাভারের ফোনটা হাতে তুলে নেয়। ফোন অন করতেই সেখানে সিকিউরিটি হিসেবে পিন নাম্বার জানতে চায়। দূর্জয় নির্দ্বিধায় বলে,

“ ফোর ওয়ান ফোর ওয়ান। “

বাণী ফোন আনলক করতেই দূর্জয় বলে,

“ কল লিস্টে যাও। সাইফ লেখা নাম্বারটা ডায়াল করো। তারপর ফোনটা স্পিকার মুডে দাও। “

বাণী কথামতো কাজ করে। ঠিক দুইবার রিং বাজতেই কলটা রিসিভ হয়। সাইফকে হাই, হ্যালো বলার সুযোগ না দিয়ে দূর্জয় বলে,

“ আই নিড ব্যাক আপ রাইট নাও। ফোনের লোকেশন অন করা আছে। ট্র্যাক করে এই মুহুর্তে ব্যাক আপ পাঠানোর ব্যবস্থা করো। এজ ফাস্ট এজ পসিবল। “

সাইফ দ্রুত অর্ডারটা কাউকে ডেকে বুঝিয়ে দিয়েই প্রশ্ন করে,

“ স্যার ইউ ওকে? “

“ দুটো গাড়ি ফলো করছে সাইফ। শুট করে যাচ্ছে অনবরত। সিচুয়েশন আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে যাচ্ছে। “

“ স্যার আপনার কাছে বুলেট আছে পর্যাপ্ত? “

দূর্জয় এবার নীরব রয়। তার কাছে আসলেই পর্যাপ্ত বুলেট নেই। এই জন্যই সে আর পিছনের গাড়ি দুটোর উদ্দেশ্যে ফায়ার করছে না। কারণ আপাতত এই বুলেট কয়টাই তার আত্মরক্ষার শেষ সম্বল। দূর্জয়ের নীরবতা আর সেই সঙ্গে বেড়িয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস দেখে বাণীও পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পারে। সাইফও হয়তো বুঝতে পারে মেজরের নীরবতা। সে ফোনটা রেখে দেওয়ার আগে আশ্বাস দেয়,

“ চিন্তা করবেন না স্যার। “

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪০.

দূর্জয় শীতল নদীর ন্যায় চুপচাপ ভঙ্গিতে ড্রাইভ করে যাচ্ছে। সেই রাক্ষুসে গাড়ি দুটো এখনো তাদের পিছু ছাড়ে নি। অনুসরণ করে চলেছে অবিরত। তবে এখন আর গাড়ি দুটো থেকে কোনো ফায়ারিং করা হচ্ছে না। কেনো করা হচ্ছে না সেই সম্পর্কে দূর্জয়ের সুস্পষ্ট ধারণা নেই। তবে তার সচেতন দৃষ্টি লুকিং মিরর হয়ে লক্ষ্য করেছিলো যে একটা গাড়িতে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসা একজন হঠাৎ কানে ফোন চেপে ধরেছিলো। কোনো কল এসেছিলো সম্ভবত। সেই থেকে দূর্জয় ধারণা করছে হয়তো তাদেরকে এরকমই কোনো আদেশ বুলি শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এটাও খুব একটা ভালো লক্ষ্মণ নয়। অসভ্যগুলোর মাথায় নিশ্চয়ই কোনো প্ল্যান আছে?

বাণীর কোলে মুখ লুকিয়ে গান শুনতে ব্যস্ত বহ্নি এই পর্যায়ে চোখ জোড়া বদ্ধ রেখেই বলে উঠে,

“ মাম্মা, পানি খাবো। “

দূর্জয় শুনে তা। পানির বোতল একটা আছে। তবে এই সিটের ব্যাক কাভারে। সেটা নিতে হলে হয় বাণীর পিছনে ফিরতে হবে অথবা গাড়ি থামাতে হবে। এই মুহুর্তে দুটোর একটাও করা সম্ভব নয়। মোটেও সেফ নয়। দূর্জয় বাণীকে কিছু একটা ইশারা করে। বাণী ইশারাটুকু বুঝতেই বহ্নির মাথা থেকে খানিকের জন্য হেডফোনটা সরায়। সেই সুযোগে দূর্জয় বলে,

“ একটু অপেক্ষা করুন বহ্নি। জাস্ট এ ফিউ মোমেন্টস। “

বহ্নি নরম গলায় বলে,

“ ওকে। “

বাণী আবার তার মাথায় হেডফোনটা পড়িয়ে দেয়। মিনিট দু তিন পাড় হতেই আচমকা দূর্জয় জোরে ব্রেক কষে। আকস্মিক ব্রেকে বাণী সিটবেল্ট বাধা সত্ত্বেও সামনের দিকে অনেকটা ঝুঁকে পড়ে। ড্যাশবোর্ডের সঙ্গে মাথায় একটা টক্কর খেতো যদি মাঝে সেই শক্ত পুরুষালী হাতের তালুটা ঢাল হয়ে না দাঁড়াতো। বাণী মাথা তুলে সামনের পানে তাকায়। সে ভীত হয় দৃশ্যটুকু দেখে।

দুটো গাড়ি সম্ভবত কম ছিলো তাই এই আরেক গাড়ির আগমন। তৃতীয় গাড়িটা ঠিক রাস্তার মাঝখানে তাদের পথ আগলে স্থির হয়ে দাঁড়ানো। পিছনের গাড়ি দুটোও এখন স্থির ভঙ্গিতে দাঁড়ানো।

মেজর শাহরিয়ার দূর্জয় পুরো পরিস্থিতিটা পরখ করে। মনে মনে পুরো হিসাব কষে নেয় সে। তিনটে গাড়ি তাদের পথ আগলে আছে। সামনে পিছনে কোনো দিকেই আর যাওয়া সম্ভব নয়। সকল পথ বন্ধ। হাতে পিস্তল আছে তবে পিস্তলে বুলেট সংখ্যা অনেক কম। ব্যাক আপ টিম কখন এসে পৌঁছাবে সেই নিশ্চয়তা নেই। এরকম একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন দূর্জয় এর পূর্বে কখনো হয় নি। তার উপর এই মুহুর্তে সে একা নয়। সঙ্গে একজন নারী ও শিশুও আছে। তাদের নিরাপত্তার দায়িত্বও এখন দূর্জয়ের উপর। আর দায়িত্ব নিয়ে কম্প্রোমাইজ করা দূর্জয়ের স্বভাব বহির্ভূত কাজ।

অন্ধকার রাস্তা জুড়ে চারটি গাড়ির হেডলাইটের আলো জ্বলজ্বল করছে। রাক্ষুসে গাড়ি তিনটা এবার ভো ভো করে ইঞ্জিনের শব্দ তুলে ভয় দেখানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। দূর্জয় এবার মৃদু হাসে। মনে মনে বিদ্রুপ করে বলে,

“ মূর্খ চুনোপুঁটির দল। “

বাণী তখন ভয়ে কাতর। সে বুঝতে পারছে এই লোকগুলো নিশ্চিত হিরণের পাঠানো। সে কাতর দৃষ্টি মেলে পাশে তাকায়। গাড়ির ভেতরটায় কোনো কৃত্রিম আলো নেই। স্বল্প আলোয় বলিষ্ঠ মুখটা দেখে আরেক দফা তার মিশ্র অনুভূতি কাজ করে। তার পাশে বসা এই মানুষটার প্রতি যেমন ভরসাও আছে, তেমনি নিজের কারণে এই মানুষটার সম্ভাব্য বিপদের আশংকাও বাণীকে শঙ্কায় ফেলে। দূর্জয়ও সেই মুহুর্তে পাশ ফিরে বাণীর দিকে তাকায়। অত:পর নিজের শান্ত শীতল স্বরে কিছু একটা বলে। বাণী কথাটুকু শুনে, বুঝে। অত:পর চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে সে প্রস্তুত।

ব্যস! দূর্জয় সঙ্গে সঙ্গে দুই পাশের জানালা নামিয়ে দেয়। চাপাস্বরে চেঁচিয়ে হেড ডাউন বলতেই বাণী বহ্নিকে সহ সম্পূর্ণ সামনের দিকে ঝুঁকে মাথা নামিয়ে ফেলে। গাড়িটা স্টার্ট দিয়েই একহাতে গাড়ির স্টিয়ারিং চেপে ধরে এবং অপর হাতে নিজের পিস্তলটা চেপে ধরে দূর্জয়। সম্পূর্ণ বেগে চলমান গাড়িটা সামান্য আগাতেই সে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে সম্পূর্ণ একদিকে ঘুরিয়ে ফেলে। ফলস্বরূপ রাস্তার ঠিক মধ্যখানে গাড়িটা ৩৬০° এঙ্গেলে এক পাক ঘোরা শুরু করে। দূর্জয়ের কথামতো মূর্খ চুনোপুঁটির দল হয়তো তার চালটা ঠাওর করতে পারে নি। ঠিক সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে মেজর শাহরিয়ার দূর্জয় নিজের পিস্তলের কেবল তিনটে বুলেট খরচ করে। বুলেট তিনটা রাক্ষুসে গাড়ি তিনটার টায়ার ভেদ করে সম্পূর্ণ হাওয়া বের করে দিতেই, দূর্জয় মুহুর্তের মধ্যে সম্পূর্ণ বেগে ড্রাইভ করে নিজের গাড়িটা তৃতীয় রাক্ষুসে গাড়িটাকে পাশ কেটে এগিয়ে নেয়।

পরিস্থিতির সামনে নত স্বীকার না করায় ঠোঁটের কোণে অস্ফুটে হাসি ফুটে উঠে মেজর দূর্জয়ের। কোনো ব্যাক আপ টিমের সাহায্য ছাড়াই একা হাতে কেবল তিনটি বুলেটের সাহায্যেই ওই মৃত্যু ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে সে। বাণী তখনও ঝুঁকে ছিলো সামনের দিকে। এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। কেবল তার কানে ভেসে এসেছে তিনটি ফায়ারিং এর তীক্ষ্ণ শব্দ। দূর্জয় ড্রাইভ করতে করতে এবার পরিষ্কার গলায় বলে,

“ মাথা তুলো। চেয়ে দেখো এখন। উই আর সেফ নাও। “

বাণী ধীর গতিতে মাথা তুলে তাকায়। গাড়িটা এখন স্থির ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছে। সামনে পিছনে আর কোনো গাড়ির অস্তিত্ব নেই। বাণী স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। সে পাশের মানুষটার দিকে চোখে কৃতজ্ঞতা নিয়ে তাকায়। কিন্তু মুখ ফুটে আর ধন্যবাদটুকু বলতে পারে না। তার পূর্বেই দূর্জয় বলে উঠে,

“ বহ্নির হেডফোন খুলে ফেলো। চোখ খুলে স্বাভাবিক হয়ে বসতে বলো। বাচ্চাটা অনেকক্ষণ ধরে এভাবে আছে। “

বাণী মেয়ের মাথা থেকে হেডফোনটা খুলে ফেলে। কানের কাছে নরম গলায় বলে,

“ মা। চোখ খুলো। “

বহ্নি পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। এতক্ষণ এক চাপে চোখ বন্ধ করে রাখায় চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখছিলো। সে দু’হাতে চোখ কচলে ফের আবার চোখ মেলে তাকায়। একবার বাণী ও দূর্জয়ের চেহারা দেখে নিয়ে সে ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকায়। পর মুহুর্তেই চেঁচিয়ে উঠে,

“ মাম্মা! আমরা কি আবার হাইড এন্ড সিক খেলছি পাপার সাথে? “

বাণী সামান্য মাথা নেড়ে বলে,

“ হ্যাঁ মা। পাপা আর কখনো আমাদের খুঁজে পাবে না। আমরা এখন ফ্রি। “

বহ্নি খুশি হয় খুব। প্রফুল্ল গলায় চেঁচিয়ে উঠে,

“ হুররেএএ। “

দূর্জয় নীরবে সবটা শুনছিলো। সে বহ্নিকে খুশি হতে দেখে কিছুটা অবাক হয়। তার জানা মতে বহ্নি হিরণের ব্যাপারে কিছু জানে না। তার চোখে তার পাপা সুপারহিরো। তাহলে এখন এই প্রতিক্রিয়ার মানে কি? গত দু তিন দিনে কি কিছু ঘটেছে? যার ফলে বহ্নির ধারণা বদলেছে?

দূর্জয়ের ভাবনার মাঝেই বহ্নি ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

“ ইয়ো মেজর! “

দূর্জয় আর বাণী দু’জনই অবাক হয় বহ্নির পানে তাকায়। দূর্জয়ের চোখের সামনে ভেসে উঠে বহু বছর আগে এক পিছু ডাকের দৃশ্য। হাই স্কুলের ইউনিফর্ম পরিহিত এক মেয়ে তাকে ডাকছে,

“ ইয়ো টপার! “

বহ্নির কথায় ঘোর কাটে দূর্জয়ের।

“ থ্যাঙ্কিউ। “

দূর্জয় মৃদু হেসে জানতে চায়,

“ কেনো? “

বহ্নি আর কিছু বলে না। সে কেবল হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে রয়।

__________

জঙ্গলের ভেতর গাছের ডালপালার ফাঁক ফোকর দিয়ে মৃদু চাঁদের আলো দেখা যাচ্ছে। পাথরের উপর হাঁটু ভেঙে দ আকৃতিতে বসে আছে সাদাত। কৌতূহল পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখছে নিজের সামনে বসে থাকা নারীকে। দৃশান সরু চোখে দেখে সাদাতকে। অত:পর বিরক্তিকর গলায় শুধায়,

“ ক্যান ইউ গিভ মি মাই আইডি ব্যাক? “

সাদাত দৃশানের মতো একই সুরে বলে,

“ ক্যান ইউ আন্সার মাই কুয়েশ্চনস ফার্স্ট? “

“ কি প্রশ্ন? “

“ আমাকে স্টক করার কারণ বলো। “

দৃশান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। প্রশ্নের জবাব না পেলে এই বাদর ছেলে তাকে তার আইডি কার্ড ফেরত দিবে না। দৃশান বলতে শুরু করে,

“ তোমরা স্পেশাল মিশনে আছো তা জানি। মিশনটা কি নিয়ে সেই তথ্যও আমার অজানা নয়। আমি একজনকে খুঁজতে এখানে এসেছি। যাকে খুঁজছিলাম সে হিরণের লোক কেবল এতটুকু তথ্য আমার জানা ছিলো। আর নিজে দীর্ঘ এক তদন্তে জানতে পারি সেই হিরণ টেরোরিজমে যুক্ত। কিন্তু এর থেকে বেশি আর কিছু জানতে সক্ষম হই নি আমি। যেহেতু এইটা ভীনদেশ তাই এখানে আমার ক্ষমতার একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু তোমাদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা নেই। আমি এই আশায় তোমাকে স্টক করছিলাম কারণ এটাই একটা মাধ্যম ছিলো আমার হিরণ পর্যন্ত পৌঁছানোর। আর একবার হিরণের ঠিকানা জানলেই আমি ওই স্ক্রাউন্ডেলটাকে ধরে নিয়ে যেতে পারতাম। “

এতদূর পর্যন্ত দৃশান শান্ত গলায় কথাগুলো বলছিলো। কিন্তু এই পর্যায়ে সে রাগী সুরে বলে,

“ স্ক্রাউন্ডেলটাকে আমি ধরেই ফেলেছিলাম, কিন্তু তোমার অযথা তর্কের ফলে ওই অসভ্যটা পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। “

সাদাত ভ্রু কুচকে তাকায়। কি অদ্ভুৎ মেয়ে মানুষ! সাদাতের মাধ্যমে নিজের লক্ষ্য পর্যন্ত পৌঁছে এখন সাদাতকেই দোষারোপ করছে! এসব চিন্তা মনে চেপে গিয়ে সাদাত প্রশ্ন করে,

“ বাংলা পারো কিভাবে তুমি? “

“ আমার দাদী বাংলাদেশী ছিলেন। আমরা ভাই বোনেরা উনার কাছ থেকে এই ভাষা আয়ত্ত্বে নিয়েছি। আই নো আমার ফ্লুয়েন্ট বাংলা শুনে যে কেউই আমাকে বাঙালি ভাববে। “

সাদাত চুপ রয়। দৃশান আবার রাগী সুরে বলে উঠে,

“ এই ছেলে। তোমার কারণে ওকে হারিয়েছি আমি। এখন তুমি আমাকে সাহায্য করবে ওকে খুঁজে পেতে। ভেবে নিও না যে আমি তোমার পিছু এতো সহজে ছেড়ে দিবো। এরকম ডাউট মনে পুষে রাখবে না। “

সাদাত এবার গম্ভীর স্বরে বলে,

“ লেফটেন্যান্ট সাদাত আমি। আর একবারও মুখে যেনো এই ছেলে, এই ছেলে টাইপ ডাক না শুনি। সম্মান দিয়ে কথা বলতে শিখো। “

“ সম্মান মাই ফুট। তোমার পুরো বায়োডাটা মুখস্থ আমার। গুণে গুণে তোমার থেকে দুই বছরের সিনিয়র আমি। সম্মান তোমার আমাকে দেওয়া উচিত। “

সিনিয়র জুনিয়রের তফাতটা মুখ ফুটে না বললেও তা সাদাতের অজানা থাকতো না। দৃশান নামরার আইডি কার্ডে তার জন্মসাল দেখেই সাদাত মনে মনে হিসেব করে ফেলেছিলো এই লোহার মতো শক্তিশালী মেয়েটা তার থেকে দুই বছরের বড়ো। সাদাতের মুখভঙ্গি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়। সে উঠে এসে নিজের হাতের আইডি কার্ডটা দৃশানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ সরি। বাট আমি কোনো রকম সাহায্য করতে পারবো না। “

দৃশান প্রশ্ন করে,

“ কেনো? “

“ কারণ আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না। তুমি একজনকে খুঁজছো কেবল এতটুকু তথ্যের উপর ভিত্তি করে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারবো না। যদি সাহায্য চাও তবে সম্পূর্ণ সত্যটা আমাকে জানাতে হবে। কাকে খুঁজছো, কেনো খুঁজছো আর সেই সঙ্গে কোনো ভ্যালিড প্রুফ। “

দৃশান সরু চোখে সাদাতকে আগাগোড়া পরখ করে বলে,

“ এতোটাও বোকা নও তুমি। “

__________

লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবার রুমে বসে আছে দূর্জয়। দূর্জয়ের মুখে তিনটি গাড়ির মিলিত অ্যাটাকের সম্পূর্ণ বিবরণই শুনেছে জুলফিকার। দূর্জয় এক গ্লাস পানি পান করে গলাটা সামান্য ভিজিয়ে নেয়। অত:পর বলে,

“ ওরা হিরণের লোক ছিলো স্যার। উদ্দেশ্য ছিলো আমাকে খুন করে বাণী ও বহ্নিকে নিয়ে যাওয়া। আল্লাহর হুকুম ছিলো বলে সফল হতে পারে নি। “

জুলফিকার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রশ্ন করে,

“ বাণী আর বাচ্চাটা কোথায়? “

“ ওয়েটিং রুমে আছে। “

জুলফিকার বলে,

“ বাণীর নিরাপত্তার দিকটা আমাদের দেখতে হবে। কেসটা বহুদূর গড়াবে। ওর স্টেটমেন্ট এর প্রয়োজন পড়তে পারে। “

“ অবশ্যই ওর সেফটি আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু এই কেসে ওর নাম আমি অযথা জড়াতে চাইছি না। “

জুলফিকার ভ্রু কুচকায়। প্রশ্ন করে,

“ মানে? কি বলছো বুঝতে পারছো? হিরণ ডিড রং টু হার। বিচারের কাঠগড়ায় এই সত্যটা বিচারকের জানা প্রয়োজন না? “

“ না স্যার। হিরণ ইজ এ টেরোরিস্ট। এই সত্যটুকু যথেষ্ট ওর শাস্তির জন্য। ওর সাথে জড়িয়ে বাণী আর বহ্নির নাম সবার সামনে আসলে বাণী প্রশ্নবিদ্ধ হবে। শি ইজ ভিক্টিম। স্টিল সবাই ওকে ক্রিটিসাইজ করবে। বহ্নির আইডেন্টিটি নিয়েও মন্তব্য করবে। দেই বোথ ডোন্ট ডিজার্ভ অল দিজ। “

জুলফিকার জানতে চায়,

“ কি করতে চাইছো তুমি? “

“ হিরণের সত্যটা সবাই জানবে। কিন্তু ওর জীবনে বাণী কিংবা বহ্নির অধ্যায়টা আমাদের পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে। এই কেসের কোথাও ওদের নাম আসবে না। “

জুলফিকার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই ছেলেকে বোঝা দায়। তিনি শীতল গলায় জানতে চায়,

“ পূর্ব পরিচিত হিসেবে স্পেশাল ট্রিটমেন্ট দিতে চাইছো? “

“ নো স্যার। ওর জায়গায় অন্য কেউ হলেও পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমি এটাই উত্তম মনে করতাম। শি ইজ লাইক এ কমন সিভিলিয়ান টু মি। “

দূর্জয়ের কাটকাট জবাব শুনে জুলফিকার বলে উঠে,

“ বাণী আর বহ্নির আপাতত তোমার বাসায় থাকাটা সেফ না। ওদের আমার বাসায় পাঠিয়ে দাও। রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া ইজ দ্যি মোস্ট সেফ প্লেস রাইট নাও। তাছাড়া আমার বাসায় শুধু নিশাই আছে। আমি কল করে ওকে জানিয়ে দিবো। বাণী আর বহ্নির ওখানে অসুবিধা হবে না মোটেও। পরে নাহয় ওদের জন্য পারমানেন্ট একটা ব্যবস্থা করবো। আর বাণীকে হিরণের আইডেন্টিটি জানানোর দায়িত্বটা তোমার রইলো। সুযোগ বুঝে কাল একবার বাড়িতে এসো। ওর সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলে সবটা জানিও। “

দূর্জয় মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে,

“ অন্য কারো প্রয়োজন নেই। আমিই ওদের তাহলে ড্রপ করে দিয়ে আসছি। “

জুলফিকার বাঁধ সাধে,

“ যাচ্ছো ভালো কথা। কিন্তু ড্রপ করে ফিরে আসতে হবে না। মেসে চলে যেও সোজা। ঘুম প্রয়োজন তোমার। গত ক’দিন ধরে ঘুমের অনিয়ম করছো। বেশ ধকলও গিয়েছে তোমার উপর দিয়ে। রেস্ট প্রয়োজন। এদিকটা আমি সামলে নিবো। “

দূর্জয় বেরিয়ে যেতেই জুলফিকার তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়। গত তিনদিন ধরে ছেলেটা নির্ঘুম থেকে যেই কাজগুলো করেছে তার চাক্ষুষ সাক্ষী জুলফিকার নিজেই। একদিকে বাণীকে খুঁজে বের করার তাড়া। অপরদিকে, অতি সুকৌশলে নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিশ্বাসঘাতককেও খুঁজে বের করেছে। সেই বিশ্বাসঘাতককে ধরার ফাঁদে আরেকটা চাঞ্চল্যকর তথ্যও জানতে পারে দূর্জয়। তা হলো এই টেরোরিস্ট অ্যাটাকের সঙ্গে হিরণের জড়িত থাকার ব্যাপারটা এবং তার ঠিকানা। এই সব কিছু সামলে বাণী নামক ওই মেয়েটাকেও উদ্ধার করে এনেছে। প্রশংসার দাবীদার ছেলেটা। সত্যিই প্রশংসার দাবীদার!

__________

দরজার কলিং বেলটা বেজে উঠতেই নিশা ধীরে সুস্থে উঠে যায় দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই সে বড়ো বড়ো চোখ মেলে তিনটা মানুষকে এক সঙ্গে দেখে নেয়। দূর্জয় সামান্য হেসে প্রশ্ন করে,

“ হাই পাকনি। কেমন আছো? “

নিশা মুখ লটকে বলে,

“ ফাইনালি আমার কথা মনে পড়েছে তোমার? “

দূর্জয়ের কোলে থাকা ছোট মানবীটা এতক্ষণ তার কাধে মুখ লুকিয়ে ছিলো। এই পর্যায়ে সে মাথা তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় নিশার দিকে। নিশা বাচ্চাটাকে দেখে। আর সঙ্গে সঙ্গেই আহ্লাদ মিশ্রিত গলায় বলে,

“ হাই কিউটি। কি নাম তোমার? “

বহ্নি সামান্য নাক টেনে বলে,

“ বহ্নি। “

কথাটা বলেই বহ্নি হাই তুলে। তার চোখ ঘুম ঘুম। ঘুমে ঢলে পড়বে যেকোনো সময়। দূর্জয় নিশাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ শি ইজ স্লিপি। রুম দেখিয়ে দাও। ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে এসে কথা বলছি। “

নিশা আঙুল দিয়ে রুমটা দেখিয়ে দিতেই দূর্জয় বহ্নিকে সহ সেই রুমের দিকে চলে যায়। বাণী তখনো দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে ইতস্তত অনুভব করছে। নিশা একবার বাণীকে দেখে হেসে শুধায়,

“ হ্যালো আপু। আমি নিশা। “

বাণী সামান্য হেসে বলে,

“ আমি বাণী। “

নিশা বলে,

“ প্লিজ ভিতরে আসুন আপু। “

বাণী বুকে একরাশ সংকোচ, লজ্জা, অস্বস্তি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে।

বহ্নিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গায়ে কাথা টেনে দেয় দূর্জয়। বহ্নি সম্পূর্ণ ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার আগে অস্ফুটে বলে,

“ গুড নাইট মেজর। “

বহ্নির কথার ভঙ্গিমা দেখে দূর্জয়ের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠে। সে নিজেও ফিসফিসিয়ে বলে,

“ গুড নাইট কিডডো। “

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪১.

বিভীষিকাময় এক অভিজ্ঞতার পরে সে রাতে নতুন এক জায়গায়, নতুন এক বাড়িতে বাণীর ঘুমটা খুব দেরি করেই এসেছিলো। কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় নি। ঘন্টা দুয়েকের মাথায়ই বাণীর ঘুমটা ভেঙে যায়। প্রহরটা তখন সুবহে সাদিকের। পূর্ব দিগন্তের ক্ষীণ প্রশস্ত আলো ফুটলো কেবল। বাণী কিছুক্ষণ নীরবে বসে থেকে উঠে দাঁড়ায়। বিড়ালের ন্যায় পা ফেলে নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।

সঙ্গে সঙ্গে সে মুখোমুখি হয় লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবার। চল্লিশার্ধো বয়সের সুঠাম দেহের পুরুষ তখন কেবল নামাজ পড়ে জগিং এর জন্য তৈরী হয়ে বেড়িয়েছে। বাণীকে দেখতেই উনি দাঁড়িয়ে পড়ে। বাণীও উনাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মাথা নত করে বলে,

“ আ’ম সরি আংকেল। ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। তাই… “

জুলফিকার মুজতবা নিজের স্বভাবসুলভ গম্ভীর স্বরের পরিবর্তে নরম স্বরে বলে,

“ সরি বলতে হবে না মা। আমার রাতে ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো। তাই তোমাদের আর বিরক্ত করি নি। ভেবেছিলাম সকালে উঠে পরিচিত হয়ে নিবো। “

ভদ্রলোকের মুখে মা সম্বোধন শুনে বাণীর মিশ্র অনুভূতি হলো। মুহুর্তেই তার মনে পড়ে গেলো যাওয়ার পূর্বে দূর্জয়ের বলা কিছু কথা,

“ যার অধীনে তোমাকে রেখে যাচ্ছি তিনি আমার কাছে পিতৃ সমতুল্য। মানুষটার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আর সম্মানের পরিধি বিশাল। এখানে তোমাদের অযত্ন, অসম্মান কিংবা নিরাপত্তার খামতি কিছুই হবে না। শুধু নিজের সংকোচ, লজ্জা, ভয়টা ভুলে যাও। আমি জানি তুমি মুক্ত নিজের মতো বাঁচতে চাও। কিন্তু কিছুদিন এখানে থাকতে হবে তোমার। একবার নিরাপত্তাটুকু নিশ্চিত করে নেই, তখন তুমি যা চাইবে তাই হবে। “

ভদ্রলোকের কথায় সম্বিত ফিরে পায় বাণী,

“ আমার তো এখন একটু বের হতে হবে। এক ঘণ্টা পরেই ফিরে আসবো যদিও। আবার নিশাও এতো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে না। তুমি চাইলে আরো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে পারো মা। অথবা সময় পাড় করার জন্য টিভিও দেখতে পারো। “

বাণী মাথা নত রেখেই বলে,

“ আচ্ছা। “

জুলফিকার মুজতবা বেরিয়ে যেতে নেয়। কিছু একটা ভেবে আবার ফিরে আসে। বাণীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ বহ্নি ঘুমাচ্ছে? “

“ জি। “

“ হাঁটতে বের হবে মা? বাহিরটা সুন্দর। ভোরের তাজা হাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুব উপকারী। “

বাণীকে সামান্য ভাবুক দেখায়। বহ্নি সকাল আটটার আগে ঘুম থেকে উঠবে না। এর মাঝে বাহির থেকে হেঁটে আসলেও সে টের পাবে না। আর তাছাড়া ভদ্রলোকের এই স্নেহপূর্ণ প্রশ্নের জবাবে না বলতেও ইচ্ছে করছে না বাণীর। তাই সে সম্মতি জানায়।

__________

রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া সম্পূর্ণটা সবুজের ভাজে আবৃত যেন। ভোরের শুদ্ধ বাতাস গায়ে লাগতেই বাণী চোখ বুজে নেয়। এই বাতাসে কি ভিন্ন কিছু মিশে আছে? মুক্তির স্বাদ? তা-ই হবে হয়তো। নাহয় এতো প্রশান্তি অনুভব করছে কেন সে?

জুলফিকার মুজতবার পায়ের গতি আজ ধীর। সাধারণত সে এই কিছুক্ষণ সময়ে কয়েক চক্কর দিয়ে ফেলতো সম্পূর্ণ এরিয়ার। কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রমের কারণ হলো বাণী। মেয়েটা তার হাঁটার গতির সঙ্গে না-হয় তাল মেলাতে হিমশিম খাবে।

হাঁটতে হাঁটতে জুলফিকার সামনে যখন যেই গাছ পাচ্ছিলেন সেটার নাম সহ সামান্য বিষয় নিয়ে বাণীর সঙ্গে আলোচনা জুড়ে বসেন। মেয়েটাকে সামান্য স্বাভাবিক করার প্রয়াশ তার। বাণী কেবল টুকটাক হ্যাঁ না দিয়ে জবাব দেয়। জুলফিকার এবার প্রসঙ্গ তুলে বলে,

“ বাণী। স্কুল লাইফে তুমি কোনো এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিসে যুক্ত ছিলে? “

বাণী আনমনে জবাব দেয়,

“ হ্যাঁ। গান করতাম তো… “

এতদূর বলেই বাণী থেমে যায়। সম্পূর্ণ নীরব বনে যায়। জুলফিকার বলে,

“ বেশ তো। দূর্জয়ও তো স্পোর্টস ক্লাবে ছিলো। তুমি তো নিশ্চয়ই দেখেছো… “

বাকি কথাগুলো আর বাণীর কানে পৌঁছায় না। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে অতীতে করা নিজের পাগলামির দৃশ্যপট। সপ্তাহে তিনদিন হাতে গুনে দূর্জয়ের দেখা মিলতো বাস্কেটবল ফিল্ডে। ক্লাস টাইমে দূর্জয়কে দেখেও যখন মন ভরতো না তখন, টিফিন টাইমের সময় বনে বাদরে ঘুরে বেড়ানো বাণী সেই সময়টুকু কেবল দূর্জয়ের জন্য বরাদ্দ করে। টিফিন পিরিয়ডের ঘন্টা বাজতেই পাখির ন্যায় উড়ে চলে যেতো সে বাস্কেটবল কোর্টে। সঙ্গে থাকতো আরমিন। কাঠের বেঞ্চিতে বসে খেলা দেখার নাম করে দূর্জয়কে দেখা, এবং তাকে দেখেই অস্বস্তিতে দূর্জয়ের মুখ ভার হয়ে আসার দৃশ্য ভেবে বাণী হাসে মৃদু। পাগল ছিলো সে। ইম্যাচিওরিটিতে ভরপুর এক পাগল। তাইতো জীবন তাকে টেনে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে যেখানে রাতারাতি তার সকল ইম্যাচিওরিটিকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে।

__________

আইনের কাছে সবাই সমান। অপরাধী যেই হোক না কেনো বিচারের কাঠগড়ার মুখোমুখি তাকে হতেই হবে। সে যদি কোনো সেনা সদস্য হয় তবুও তার নিস্তার নেই। তবে একজন সৈন্যের বিচার আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো হয় না। তার বিচার করা হয় স্বয়ং সৈন্যদের আদালতে।

আজও তার ব্যতিক্রম নয়। আদালত প্রস্তুত উপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধীকে শাস্তি দিতে। বিচারকের স্থানে বসে আছেন একজন সৈন্য। কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অপরাধীর উদ্দেশ্যে তিনি প্রশ্ন ছুড়েন,

“ আপনি কি নিজের পক্ষে কোনো যুক্তিগত সাফাই পেশ করতে চান কর্নেল জুবায়ের শিকদার? “

জুবায়ের শিকদার রক্তিম দৃষ্টি মেলে একবার বিচার কক্ষে উপস্থিত দূর্জয়কে দেখে। অত:পর দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

“ আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। দিজ ইজ অল আই হ্যাভ টু সে। “

বিচারক বলে,

“ এটা তো কোনো যুক্তিগত সাফাই নয় কর্নেল। আপনার বিরুদ্ধে সাফ প্রমাণ আমার সামনেই আছে। এই ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আপনি কিভাবে আপনার নাম ফাঁসের ভয়ে সেলে প্রবেশ করে এক আতঙ্কবাদীকে খুন করার চেষ্টা করেছেন। “

“ এইসব মেজর দূর্জয়ের চক্রান্ত। “

“ এটা যদি চক্রান্তই হয় তবে আপনি তা-তে পা দিলেন কেনো? একজন আতঙ্কবাদী মুখ খুলতে রাজি হয়েছে শুনতেই আপনি ভীত হয়ে কেনো সবার অগোচরে তার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন? আর তাছাড়াও সেই আতঙ্কবাদী স্পষ্ট সাক্ষী দিয়ে বলেছে আতঙ্কবাদীদের মূল হোতা শমসের মজুমদার এবং হিরণের সঙ্গে আপনি হাত মিলিয়েছিলেন। “

জুবায়ের শিকদার আর কিছু বলে না। শেয়ানাটা কি কায়দা করেই না তাকে হাতেনাতে ধরলো ভাবতেই তিনি আবার রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দূর্জয়কে দেখে। জুবায়ের শিকদারের সেই দৃষ্টি জুলফিকার মুজতবারও চোখ এড়ায় না। তিনি একবার পাশ ফিরে দূর্জয়কে দেখে যে গম্ভীর মুখ করে বসে আছে।

বিচারক নিজের ফয়সালা শোনায়,

“ আতঙ্কবাদীদের সঙ্গে হাত মেলানো, তাদের পক্ষ হয়ে কাজ করা দেশদ্রোহীতার সমতূল্য। আর তাছাড়াও ইনভেস্টিগেশনে আপনার বিরুদ্ধে অপারেশন চলমান অবস্থায় বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্তের অভিযোগ উঠে এসেছে। সুতরাং সকল সাক্ষী প্রমাণের ভিত্তিতে এই আদালত কর্নেল জুবায়ের শিকদারকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি এবং পদচ্যুত করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। আর সেই সঙ্গে একজন দেশদ্রোহী হিসেবে উনার মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আদেশ জারি করছে। “

বিচার কক্ষে উপস্থিত সকলেই যেনো এক প্রকার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

বিচারক আবার বলে উঠে,

“ আর শমসের মজুমদার এবং হিরণকে যতদ্রুত সম্ভব আটকের আদেশ দেওয়া হলো। “

এক এক করে সবাই হাসিমুখে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। কেবল দূর্জয় এবং জুলফিকার মুজতবা টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। জুবায়ের শিকদারকে হাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি দূর্জয়ের সামনে এক মুহুর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে। কণ্ঠে একরাশ বিদ্রুপ মিশিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ আগুন নিয়ে খেলছো মেজর দূর্জয়। হিরণ ছেড়ে দিবে ভেবেছো? প্রতিদ্বন্দ্বী কে সেই সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাও নেই তোমার। “

বলেই সামান্য হাসে জুবায়ের শিকদার। দূর্জয় কোনো প্রতুত্তর করে না। জুবায়ের শিকদারকে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জুলফিকার মুখ খুলে,

“ বাণীর সঙ্গে কথা বলো। সত্যটা জানাও। ওর নিজের সতর্ক থাকাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। “

__________

আধঘন্টা হয়েছে দুপুরের খাবার সেড়ে নিজের রুমে এসে বসেছে নিশা। সঙ্গে নিয়ে এসেছে বহ্নিকে। খাবারের টেবিলেই বসে বাণীর ঘুম ঘুম চোখ জোড়া দেখে সে হেসে বলেছিলো,

“ আপনি লাঞ্চ সেড়ে একটু ঘুমিয়ে নিন আপু। বহ্নি ততক্ষণ নাহয় আমার কাছে থাকলো। আমরা মোটেও আপনাকে বিরক্ত করবো না। “

বাণী প্রথমে আপত্তি জানায়। নিশা মেয়েটার বয়স নিতান্তই কম। তার উপর ওর পায়ে অপারেশনের ব্যাপারটাও সকালে জুলফিকার আংকেলের কাছে শুনেছে সে। যদি বহ্নিকে সামলাতে হিমশিম খায়? কিন্তু নিশা বাণীকে আশ্বস্ত করে ঠেলেঠুলে রুমে পাঠিয়ে দেয়।

বেশ ক্ষানিকটা সময় বহ্নি আর নিশা মিলে ফোনে গেমস খেলে সময় কাটায়। হঠাৎ ফোনের স্ক্রিনে তামজিদ সাইফ নামক আইডি হতে একটা ম্যাসেজ এসে ভীড় জমাতেই নিশা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ফোনটা সেই মুহুর্তে বহ্নির হাতে ছিলো। চ্যাট হ্যাডে পরিচিত মুখটা দেখেই বহ্নি বলে,

“ ষ্টুপিড আংকেল। “

নিশা অবাক হয়ে জানতে চায়,

“ তুমি উনাকে চিনো? “

“ হ্যাঁ আন্টি। এই আংকেল তো অনেক ষ্টুপিড। আমাকে স্পাই ভেবেছিলো। তুমি বলো, ফাইভ ইয়ারসের বেবি কি কখনো স্পাই হয়? “

বহ্নির আদর মাখা স্বরের প্রশ্ন শুনে নিশা সামান্য হাসে। বহ্নি নিজেই আবার প্রশ্ন করে,

“ তুমি এই আংকেলকে কিভাবে চিনো? “

নিশার মনে পড়ে যায় এই মাথা নষ্ট লোকের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাতের কথা। সে ফিসফিসিয়ে বহ্নিকে বলে,

“ সেটা সিক্রেট। “

বহ্নি বোকার ন্যায় তাকিয়ে থাকে। বড়দের এতো সিক্রেট কেনো থাকে তা তার জানতে ইচ্ছে হয়।

নিশা ফোনটা নিয়ে ম্যাসেজ চেক করে। একটা ছবি পাঠিয়েছে সাইফ। একটা কাগজের পত্রিকার উপর কাঁচা আমের ভর্তার ছবি। ছবির সঙ্গে ছোট বার্তাও রয়েছে।

“ মামার হাতের আম ভর্তা অমৃত। ট্রাই করে দেখতে পারেন ইয়াসমিন। “

লোকটা এখনো অনলাইনেই আছে। ফ্রি নিশ্চয়ই? নিশা কিছু না ভেবে কল দেয়। কিছু মুহুর্তের মধ্যেই কলটা রিসিভ হয়। ফোনের স্ক্রিনে ইউনিফর্ম পরিহিত মুখটা ভেসে উঠতেই বহ্নি ও নিশা একসঙ্গে বলে উঠে,

“ হাই ষ্টুপিড আংকেল,
হাই ভাইয়া। “

একমুঠ আম ভর্তায় দু মুঠো চিনি ঢেলে দিলে এর স্বাদ যতটা বিদঘুটে হবে, ঠিক ততটাই বিদঘুটে ঠেকে এই ভাইয়া এবং ষ্টুপিড আংকেল ডাকটা সাইফের কাছে। সে মুখ কালো করে বলে,

“ আপনাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্ব দিচ্ছি ইয়াসমিন। এই ছোট নাগাকে একটু ম্যানারস শিখাবেন প্লিজ। ওর এই ষ্টুপিড আংকেল ডাকটা আই জাস্ট হেইট ইট। “

বহ্নি মুখ লটকে বলে,

“ আই ডোন্ট লাইক ইউ অলসো। “

সাইফ রাগে জিভ বের করে বহ্নিকে ভেঙায়। বহ্নিও সাথে সাথে একই ভঙ্গিতে সাইফকে ভেংচি কাটে। নিশা ওদের কাহিনী দেখে হাসছিলো। হাসতে হাসতেই সে বলে,

“ এই ভর দুপুরে আপনি ভাত ছেড়ে কাঁচা আম খেতে কেনো বের হলেন? “

সাইফ নিশ্চুপ হয়ে যায়। নিশার বান্ধবীর মৃত্যুর খবর তার অজানা নয়। সেই রাতের পর থেকে মেয়েটা আর তাকে নিজে ম্যাসেজ করে নি। এমনকি অনলাইন আসাই বন্ধ করে দিয়েছিলো। এই ক’টা দিনে সাইফ এক নতুন অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। তার নাম হলো অস্থিরতা। এই অস্থিরতাটা গত ক’টা দিনে তাকে বেশ জ্বালাতন করেছে। সাইফ বুঝতে পারে ইয়াসমিন নামক মেয়েটা তার এক বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই মেয়ের সঙ্গে ক্ষনিকের কথাপোকথন যেমন সাইফকে স্বস্তি দেয়, তেমনই মেয়েটার অনুপস্থিতি তাকে পীড়া দেয়। আজ দুপুরে যখন সে একটু কাজে বেরিয়েছিলো তখন আচমকা রাস্তার পাশে একটা লোককে বিভিন্ন মৌসুমে ফলের ভর্তা এবং আচার বিক্রি করতে দেখে সাইফের ইয়াসমিনের কথা মনে পড়ে। সে দ্রুত বিশ টাকার আম ভর্তা কিনে নিয়ে সেটার ছবি তুলে ইয়াসমিনকে পাঠায়। সেই ছুতোয় সঙ্গে জুড়ে দেয় ছোট ম্যাসেজ।

নিশার ডাকে সাইফের ঘোর কাটে। নিশা প্রশ্ন করে,

“ কোথায় হারিয়ে গিয়েছেন ভাইয়া? “

সাইফ ছোট্ট করে জবাব দেয়,

“ হু? আছি৷ “

__________

দুপুর গড়িয়ে নেমে আসা বিকালটা আজ অন্য রকম। আকাশ জুড়ে বিরাজ করছে কমলা রঙা উত্তাপহীন সূর্যের আভা। আর কেবল এক ঘন্টা বাকি। ঠিক এক ঘন্টা পরই বাংলাদেশ থেকে আগত সৈন্যরা নিজ মাতৃভূমির উদ্দেশ্যে রওনা হবে।

শেষবারের মতো নিজের ব্যাগেজ আরেকবার চেক করে নেয় রিদওয়ান। সব আছে। তবুও তার মনে হচ্ছে কিছু একটা ভুলে যাচ্ছে সে। রিদওয়ান বিষন্ন মনে বসে রয়। এরই মধ্যে প্রত্যয় এবং রাফি তার তাবুতে প্রবেশ করে। রিদওয়ানকে এভাবে বসে থাকতে দেখে রাফি মশকরা করে বলে,

“ কি মামা! তোরে এমন বিধবা বিধবা লাগতেসে কেন? “

রিদওয়ান চোখ গরম করে তাকায়। রাফি মুখ টিপে হেসে বলে,

“ সরি ব্রো। আমি তোর পেইন বুঝতেসি। অন্যাকে রেখে আসার সময় আমারও এমন বিধবা বিধবা ফিল হইতেসিলো। তুইও তো এই দেশে নিজের প্রিয়াকে ফেলে রেখে যাবি। কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। “

এই পর্যায়ে প্রত্যয়ও সামান্য হাসে। রিদওয়ান বিরক্ত মাখা গলায় বলে,

“ শালা তোরা জীবনেও ভালো হবি না। “

বলেই রিদওয়ান উঠে দাঁড়ায়। হাঁটু ভেঙে বসে নিজের পায়ের জুতার ফিতা বাধতে থাকে। আচমকা তার কিছু একটা মনে পড়ে। চকিত্যসে উঠে দাঁড়ায়। দ্রুত নিজের ব্যাগ খুলে একটা ভারী জ্যাকেট বের করে নেয়। প্রত্যয় ও রাফি এতক্ষণ নীরবে ওর কার্যকলাপ দেখছিলো। এই পর্যায়ে রাফি প্রশ্ন করে,

“ কি করতেসোস? “

রিদওয়ান জ্যাকেটটা হাতে নিয়ে ফোনের ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে একবার নিজের চেহারাটা দেখে নেয়। ইউনিফর্ম পরিহিত তাকে আজ কিছুটা অন্যরকম দেখাচ্ছে। সেই অন্য রকমটা কি তা ঠিক ঠাওর করতে পারে না রিদওয়ান। সে ফোনটা অফ করে পকেটে ভরে নিয়ে সামান্য হেসে বলে,

“ এখুনি চলে আসবো। “

প্রত্যয় বলে উঠে,

“ এই! রওনা হতে হবে আমাদের কিছুক্ষণ পরে। কোথায় যাচ্ছিস? “

রিদওয়ান দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,

“ চিন্তা করিস না। আমাকে ছাড়া দেশে ফিরতে হবে না তোদের। সময়মতো পৌঁছে যাবো। “

প্রত্যয় পিছু ডাকতে নিলেও রিদওয়ান আর কোনো কিছুর তোয়াক্কা করে না। দৌড়ে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে একজনের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করাটা হুট করেই তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। এই শেষ সাক্ষাৎটা না হলে হয়তো তার মনও তৃপ্ত হবে না।

__________

প্রত্যয় ও রাফি তাবু থেকে বের হয়ে দাঁড়ায়। গল্প করতে করতে দু জনে চোখ মেলে দেখতে থাকে চারিপাশটা। মনে মনে এই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়া ভূখন্ডের জন্য প্রার্থনাও করে। দেশটা যেনো মুক্তির স্বাদ পায়। এই দেশের মানুষ গুলো যেনো মুক্তির স্বাদ পায়।

আচমকা অদূরে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাফি অবাক সুরে বলে,

“ জারিয়াহ না? “

রাফির কথা শুনে প্রত্যয়ও সেই দিকে তাকায়। শালীন বেশভূষার মেয়েটাকে দেখে সে মুহুর্তেই চিনতে পারে। আর চিনতে পেরে বেশ অবাকই হয়। বিস্ময় নিয়েই দু’জন এগিয়ে যায় সেই পানে। জারিয়াহর সামনে গিয়েই প্রত্যয় প্রশ্ন করে,

“ তুমি এখানে? “

জারিয়াহ সামান্য হাসি হাসি মুখ করে বলে,

“ আপনাদের বিদায় জানাতে এলাম। “

রাফি মশকরা করে বাংলায় বলে,

“ আমাদের বিদায় জানাতে নাকি প্রিয় ভীনদেশীকে বিদায় জানাতে? “

জারিয়াহ বুঝতে না পেরে বোকার ন্যায় তাকিয়ে থাকে। প্রত্যয় রাফির কথায় পাত্তা না দিয়ে হেসে বলে,

“ বিদায় জানাতে আসার জন্য ধন্যবাদ জারিয়াহ। সাহায্যের জন্যও ধন্যবাদ। তোমার সাথে পরিচয় হয়ে ভালো লেগেছে খুব। “

জারিয়াহ মৃদু হাসে কেবল। পর মুহুর্তেই সন্ধানী দৃষ্টি মেলে চারিদিকে তাকায়। কাউকে খুঁজছে যেনো। রাফি ও প্রত্যয় বুঝতে পারে। বুঝতে পেরে রাফি হেসে জানায়,

“ যাকে খুঁজছো সে তোমাকে খুঁজতে বেরিয়ে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। “

জারিয়াহ অবাক হয়ে তাকায়। পর মুহুর্তেই ধরা পড়ে যাওয়ায় লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে। প্রত্যয় বলে,

“ এখানেই অপেক্ষা করো। খুঁজে না পেয়ে এখানেই ফিরে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। তখন… “

কথাটুকু সম্পূর্ণ করার আগেই তীব্র শব্দে তিনজন চমকে উঠলো। চমকে উঠলো আশেপাশের সবাইও। প্রত্যয়ের ভ্রু জোড়া কুচকে এলো। সে চোখ তুলে আকাশ পানে তাকালো। পরিষ্কার আকাশটার কমলা আভা যেন আচমকা ছাই রঙা ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। অদূরে একজন সেনা সদস্য চেঁচিয়ে উঠলো,

“ বোমা ফেলছে বর্বরগুলো। “

প্রত্যয় ও রাফির মুখ মুহুর্তেই পাংষণ্ডে বর্ণ ধারণ করে। বাংলায় বলা কথাটার অর্থ বুঝতে পারে না জারিয়াহ। সে প্রশ্ন করে,

“ কি বললো? “

রাফি কাঁপা গলায় উচ্চারণ করে,

“ গ্যানোসাইড। “

রাফির কথাটুকু শেষ হতে না হতেই তাদের মাথার উপর দিয়ে আগুনের গোলা চোখে পড়লো। মুহুর্তে সেই আগুনের গোলাটা খুব কাছেই কোথাও গিয়ে পড়তেই আরো একবার বিকট শব্দে চারিদিকটা কেঁপে উঠলো। প্রত্যয়ের বিচক্ষণ মস্তিষ্ক মুহুর্তেই সজাগ হয়ে উঠলো। পরিস্থিতি আঁচ করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না তার। বাকি সৈন্য সদস্যরা চেঁচিয়ে তাদের ডাকছে,

“ লেফটেন্যান্ট চলুন। নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। “

প্রত্যয় ও রাফির কানে সেই কথা এসে পৌঁছালেও তাদের মন বন্ধুর দিকে টানছে। ভাইকে ছাড়া নিজেরা নিরাপদ স্থানে ঠাই খোঁজার মতো স্বার্থপর তারা নয়। তারা কিছু বলার পূর্বেই জারিয়াহ নিজের বোনের নাম নিয়ে চেঁচিয়ে উঠে। অত:পর ছুট লাগায় নিজের বাড়ি যাওয়ার পথ ধরে। প্রত্যয় এবং রাফিও তার পিছু পিছু ছুটে যায়। হয়তো! হয়তো রিদওয়ানকে জারিয়াহর বাসার আশেপাশেই খুঁজে পাবে তারা।

একের পর এক আগুনের গোলা উড়ে এসে পড়ছে শহরটার বুকে। মানুষ জন এলোমেলো ভাবে ছোটাছুটি করছে। নিজের বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই জারিয়াহ বোনকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও খুঁজে না পেয়ে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। ছোটাছুটি করা মানুষদের মধ্যে একজনের হাত চেপে ধরে নিজ ভাষায় প্রশ্ন করে,

“ আপা! জুবেদা কোথায়? আমার বোনকে দেখেছেন? “

মাঝ বয়সী নারী অস্থির গলায় বলে উঠে,

“ তুমি বের হওয়ার পরই তো ও তোমার পিছু পিছু যাওয়ার জন্য দৌড়ে বের হয়। কিন্তু রাস্তায় পড়ে হাত ছিলে ফেলে। একজন সৈন্য তখন তোমার খোঁজে এসেছিলো। তোমার বোনকে এই অবস্থায় দেখে দ্রুত কাছের হসপিটালে নিয়ে গিয়েছে। “

জারিয়াহ আরো কিছু প্রশ্ন করতো। কিন্তু তার পূর্বেই সেই নারীর স্বামী এসে তাকে টেনে দ্রুত নিয়ে যায়। প্রত্যয় এবং রাফিও বন্ধুর খোঁজে এসেছিলো। কিন্তু বন্ধুকে এখানে না পেয়ে তারা আশেপাশে সবাইকে ইংরেজিতেই বিভিন্ন প্রশ্ন করছিলো। কিন্তু কেউই সেদিকে তোয়াক্কা করে না। সবাই ছুটছে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে। জারিয়াহ প্রত্যয়ের সামনে এসে জানায় রিদওয়ান আর তার বোন হসপিটালে আছে।

এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে তারা তিনজন ছুটে হসপিটালের দিকে। এই এলাকায় কেবল একটিই বিশাল সরকারি হসপিটাল আছে। যার দূরত্ব জারিয়াহর বাসা থেকে কেবল আট মিনিটের মতো। হসপিটালের মুখ্য দরজার সামনে আসতেই জারিয়াহর পা জোড়া থেমে যায়। সে থমকে দূরে হসপিটাল বিল্ডিংয়ের প্রবেশ দ্বারে দাঁড়িয়ে থাকা মুখটার দিকে তাকিয়ে একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।

জংলী ছাপের ইউনিফর্ম পরিহিত রিদওয়ানও দূর হতে জারিয়াহকে দেখে থমকে যায়। একবার জারিয়াহকে দেখে ফের তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই ভাইকেও দেখে। তাদের দেখে রিদওয়ানের মুখে সামান্য হাসি ফুটে উঠে। মনে মনে আওড়ায়,

“ শালা তোরা জীবনেও ভালো হবি না। “

রিদওয়ানের কোলে থাকা আট বছরের মেয়েটা দূর হতে বোনকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠে। তার গায়ে রিদওয়ানের জ্যাকেটটা জড়ানো। জুবেদা এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে কোল থেকে নেমে বোনের দিকে ছুটে যায়। বিশাল মাঠের ন্যায় জায়গাটুকু পেরিয়ে বোনের বুকে গিয়ে হামলে পড়ে। বোনকে সহি সালামতে পেতেই জারিয়াহ মনে মনে রবের নিকট শুকরিয়া আদায় করে। অত:পর কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টি মেলে সামনে তাকায়। রিদওয়ান তখনো তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। চোখে চোখ পড়তেই জারিয়াহ মৃদু হাসে। রিদওয়ান এগিয়ে আসার জন্য পা বাড়াবে ঠিক সেই মুহুর্তে একটা আগুনের গোলা ছুটে এলো। একটা বিধ্বংসী শব্দ তুলে কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই চোখের পলকে চারিদিকটা ঝাপসা হয়ে উঠে।

ঠিক কতক্ষণ পর জারিয়াহ নিজের সম্বিত ফিরে পেয়েছে তা তার জানা নেই। কিন্তু মস্তিষ্ক সচল হতেই সে দেখতে পায় ধোঁয়ার কারণে চারিদিকটা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অদ্ভুৎ বারুদের গন্ধ। চারিদিকে শোনা যাচ্ছে মানুষের আহাজারি। জারিয়াহ জোরে জোরে শ্বাস টেনে দাঁড়িয়ে পড়ে। অত:পর সবকিছু ভুলে সামনের দিকে ছুটে। সে যত সামনে এগুচ্ছে ততই দৃশ্যটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

নেই। হসপিটালটা নেই সামনে। ওই মানুষটাও নেই। যা আছে তা হলো কেবল ধ্বংস স্তুপ। এই দৃশ্যটুকু স্পষ্ট হতেই জারিয়াহ আর এক পা-ও সামনে বাড়াতে পারে না। সেখানেই থমকে যায়। পরপর মাঠে বসে পড়ে।

জারিয়াহ নিশ্চুপ বনে গেলেও প্রত্যয় ও রাফি চুপ থাকে না। তারা দৌড়ে এগিয়ে যায়। চিৎকার চেঁচামেচি করে বাতাসটা ভারী করে তুলে। খালি হাতে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ধ্বংস স্তুপ সরানোর চেষ্টায় মত্ত হয়। আশেপাশের আরো মানুষ এগিয়ে আসে। স্বজন হারার শোকে সবাই পাগলামি শুরু করে।

কেবল জারিয়াহই পারে না কিছু করতে। ওই মানুষটা তার স্বজন ছিলো না। খুব কাছের কেউও ছিলো না। না ছিলো জারিয়াহর স্বদেশী মানুষ। তবুও জারিয়াহ তার জন্য এক বিন্দু অশ্রু বিসর্জন করলো। কেন করলো জানা নেই। কিসের ভিত্তিতে করলো তা-ও জানা নেই। লোকটাকে নিয়ে তার অনুভূতিও তার জানা নেই। জুবেদা এতক্ষণ দূর হতে বোনের এই রূপটা দেখে। অত:পর এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে,

“ লোকটা কে ছিলো আপা? “

জারিয়াহ অস্ফুটে মাথা নেড়ে বলে,

“ জানি না। “

দুটো শব্দ উচ্চারণ করেই জারিয়াহ ফুঁপিয়ে উঠে। অন্যায় হলো। ঘোর অন্যায়। ওই লোকটার তো আজ নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার কথা ছিলো। লোকটা ফিরতে পারলো না কেন? কিসের দায়ে লোকটা ছুটে এসেছিলো? জারিয়াহর জন্য নাকি লোকটার মৃত্যুই তাকে টেনে এখানে নিয়ে এসেছে?

রিদওয়ান দেখতে পেলো না। সমুদ্র নীল চোখের মেয়েটার চোখের এক বিন্দু অশ্রু তার জন্য বিসর্জন করা হয়েছে তা দেখার বিন্দুমাত্র অপেক্ষাও করলো না। কেবল হারিয়ে গেলো। এক ধ্বংস স্তুপের ভীড়ে। এক ভিনদেশের মাটিতে। এক রমণীর নয়নে।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]