এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-৪২+৪৩+৪৪

0
201

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪২.

কাঠের তৈরী কফিনের বাক্সটা লাল সবুজ কাপড়ের পতাকা দ্বারা মোড়ানো। বাক্সের ভেতর শুয়ে থাকা মানুষটার জানাজা তার স্ব দেশের মাটিতেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জানাজায় শরিক হয়েছেন বিভিন্ন পদস্থ সেনা। সঙ্গে রয়েছে স্বজনদের আহাজারি।

কাঠের বাক্সটা জড়িয়ে ধরে কাদছেন যে ভদ্র মহিলা তিনি এক শহীদের গর্বিত মা। ভদ্র মহিলার জীবনে কোনো কিছুরই অভাব ছিলো না কখনো। তিন মেয়ে এবং স্বামী নিয়ে বেশ সুখের সংসার ছিলো তার। কিন্তু বহু বছর পর একটা পুত্রের অভাব পূরণ করতেই বোধহয় আল্লাহ ছেলেটাকে তার কোল জুড়ে পাঠিয়েছিলেন। সেই একমাত্র ছেলের মৃত্যুর ধাক্কা সামলানো ভদ্র মহিলার জন্য চারটে খানি কথা না।

দূরে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছে ছয় জন যুবক। সংখ্যাটা সাত থেকে ছয়ে এসে নেমেছে। এই সাত থেকে ছয়ে নামার যাত্রাটা ছিলো বিষন্ন, বিভৎসকর এবং বিষাদ মাখা। বন্ধু কম ভাইকে হারিয়ে ভিনদেশের মাটিতে প্রত্যয় ও রাফি করেছে পাগলামি, দেশে সেই খবর পেতেই পুরুষালি নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ডুকরে কেঁদেছে ফারদিন ও জুনায়েদ। সাদাত ও সাইফ এই ক্ষেত্রে বিপরীত স্বভাবের। কাছের কাউকে হারানোর বেদনাও এই দুই পুরুষের চোখে জল আনতে পারে নি। তারা শোক পালনের জন্য কেবল খুঁজে নিয়েছে কিছুটা একাকিত্ব।

মেজর শাহরিয়ার দূর্জয় নীরবে দেখছে এক মায়ের আহাজারি। বুকে এক অদ্ভুৎ ভূমিকম্পের আলোড়ন চলছে তার। আচমকা সে রিদওয়ানের মায়ের জায়গায় নিজের মামণিকে কল্পনা করে। সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠে। দীপ্তটা যদি দেশের বিপক্ষে না গিয়ে দেশের পক্ষেও জীবনটা দিতো তাহলে তার মামণিও নিজের ছেলের জন্য শোক পালন থেকে কখনো বঞ্চিত হতো না।

রিদওয়ানের জন্য কষ্ট হচ্ছিলো দূর্জয়ের। কিন্তু এই মুহুর্তে দীপ্তর কথা মনে পড়তেই তার কষ্টের মাত্রা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। দীপ্ত তার এক গোপন ব্যথা। ভাই হারানোর যন্ত্রণা বুকে বয়ে বেড়ানোটা এখন দূর্জয়ের নিত্যদিনের সঙ্গী। এই যন্ত্রণার কথা সে কখনো কাউকে বলতে পারবে না। পুরুষ বলে নয় বরং সে দূর্জয় বলেই। তার সকল যন্ত্রণা সে চাপা স্বভাবের আড়ালে লুকিয়ে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বলেই।

__________

জুলফিকার মুজতবার অধীনে তার বাড়িতে বাণী আছে আজ প্রায় এক মাস হতে চললো। এই এক মাসে কেবল একদিন দূর্জয় এই বাড়িতে এসেছিলো। তা-ও বাণীকে এক গুরুত্বপূর্ণ সত্যি জানাতে। যেই সত্যিটুকু শুনে বাণী খুব একটা অবাক হয় নি। হিরণ একজন আতঙ্কবাদী। এই সত্যটুকু বিশ্বাস করতে বাণীর মোটেও কষ্ট হয় নি। তবে তার মনে ভয় উঁকি দিয়েছিলো। একজন আতঙ্কবাদীর সঙ্গে নিজের এবং নিজের মেয়ের পরিচয় জড়ানোর ভয় তাকে জেকে ধরেছিলো। কিন্তু মেজর শাহরিয়ার দূর্জয় তাকে আশ্বস্ত করেছে। এই কেসের কোথাও বাণী কিংবা বহ্নির নাম আসবে না। দূর্জয় কাউকে সেই অনুমতি দিবে না।

বাণী সেদিনও মুখ ফুটে ধন্যবাদ বলতে পারে নি। কেবল কৃতজ্ঞতা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে ছিলো। সেই বিকেলের পর কি হলো কে জানে! দূর্জয় আর এমুখো হয় নি। হারিয়ে গেলো না নিজেকে গুটিয়ে নিলো বুঝা গেলো না। তবে নিশার মুখে বাণী শুনেছে, একজন সৈন্য শহীদ হয়েছে। দূর্জয়ের অধিনস্থ স্পেশাল ফোর্সের লেফটেন্যান্ট ছিলো সে। লেফটেন্যান্টের মৃত্যু ঘটেছে ভিনদেশের মাটিতে। বর্বরদের বোমা হামলায়।

একমাস এই বাড়িতে বাণীর সময় যে খারাপ পাড় হয়েছে তেমনটা নয়। নিশা মেয়েটা খুব লক্ষ্মী আর মিশুক স্বভাবের। বহ্নির সাথে ভালো খাতির জমেছে তার। জুলফিকার মুজতবাও যেইটুকু সময় বাসায় থাকে বাণী ও বহ্নিকে অত্যন্ত স্নেহপূর্ণ ভাবে ট্রিট করেন। মাঝে একদিন কেবল নিশার মা এসেছিলো। ভদ্রমহিলা যথেষ্ট স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করলেও উনার ভাব ভঙ্গিমায় স্পষ্ট ফুটে উঠে যে তিনি বাণী আর বহ্নির এই বাসায় থাকার বিষয়টা নিয়ে সন্তুষ্ট নন। বাণী তা বুঝতে পেরেছিলো। বুঝতে পেরে তার মোটেও খারাপ লাগে নি। এটাই তো স্বাভাবিক!

আজ খুব সাহস করে বাণী একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জুলফিকার মুজতবা রাতে বাড়ি ফিরতেই সে লিভিং রুমে গিয়ে নিজের সিদ্ধান্তটা জানায়। সে এখন বহ্নিকে নিয়ে নিজের মতো থাকতে চায়, একটু নিজের মতো বাঁচতে চায়। বড়দের কথার মধ্যে বাগড়া দেওয়া নিশার স্বভাবে নেই। সে নীরবে বহ্নিকে নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।

জুলফিকার মুজতবা কিছুক্ষণ চুপ থাকে। অত:পর শান্ত স্বরে বলে,

“ এই বাসায় কি তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে বাণী? “

বাণী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়,

“ না আংকেল। মোটেও সেরকম কিছু নয়। কিন্তু একদিন তো আমাকে যেতে হবেই। “

জুলফিকার মুজতবা বলেন,

“ আমি তোমার পয়েন্ট অফ ভিউ বুঝতে পারছি মা। নিজের জীবন গুছিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আমি সবসময় তোমাকে এপ্রিশিয়েট করবো। কিন্তু আমার চিন্তা তোমার এবং বহ্নির সেফটি নিয়ে। হিরণ পলাতক এখনো। “

বাণী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ উনার ভয়ে তো আজীবন আমি লুকিয়ে থাকতে পারবো না আংকেল। সেটা সম্ভব নয়। “

বাণী ইনিয়ে বিনিয়ে আরো কিছু কথা বলে। তবুও জুলফিকার মুজতবার মন মানছিলো না। তিনি অবশেষে বাধ্য হয়ে দূর্জয়কে ফোন করে। সবটা জানাতেই দূর্জয় বলে,

“ ওর জীবনে হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমাদের নেই স্যার। জীবনটা ওর, সিদ্ধান্তও ওর। লেট হার লিভ এজ শি ওয়ান্টস। “

__________

সেনাবাহিনীর তরফ থেকে দেশীয় গণমাধ্যমে আতঙ্কবাদীর হামলার সঙ্গে জড়িত দেশের নাম প্রমাণ সহ প্রকাশ করতেই এক প্রকার হুলুস্থুল বেধে যায় সাধারণ জনগণের মধ্যে। দেশীয় গণমাধ্যম থেকে খবরটা আন্তর্জাতিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগে না। সোশ্যাল মিডিয়া ভরপুর হয়ে যায় বিভিন্ন হ্যাশট্যাগ দিয়ে। রাতারাতি সেই দেশে অর্থ জোগানকারী সকল কোম্পানির পণ্য বাতিল করে সাধারণ জনগণ।

এগিয়ে আসে এশিয়া এবং মিডেল ইস্টের আরো বেশ কয়েকটি দেশ। যেসকল দেশ গত একবছরে বিভিন্ন টেরোরিস্ট অ্যাটাকের শিকার হয়েছে। সকলেই মত্ত হয় তীব্র প্রতিবাদে। ইউরোপীয়ানরা এমতা অবস্থায় সম্পূর্ণ নীরব বনে যায়।

দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় আরো দুটি তথ্য। এই টেরোরিস্ট অ্যাটাকের মূল হোতা শমসের মজুমদার এবং হিরণের ছবি। যাদের একজন নিখোঁজ এবং অন্যজন পলাতক। এই দু’জনকে দেখতেই যেনো তাদের আইনের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

__________

হুট করে নিজের জীবন সাজিয়ে নেওয়া কোনো চারটে খানি কথা নয়। জুলফিকার মুজতবা বাণীর সিদ্ধান্তের সামনে পরাজিত হয়ে শর্ত দিয়েছিলো আগে বাণীর কোনো চাকরি খুঁজে নিতে হবে। তারপরই কেবল তিনি বাণীকে ঘর ছাড়ার অনুমতি দিবেন।

কেবলমাত্র ও লেভেল এবং এ লেভেল এক্সামের সার্টিফিকেটধারী এক নারীর জন্য চাকরি খুঁজে পাওয়া অনেকটা অসম্ভব বিষয়। কিন্তু এই অসম্ভব বিষয়টাকে সহজ করে দেন জুলফিকার মুজতবা। উনার পরিচিত এক পুরনো বন্ধু চট্টগ্রামে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের প্রধান। জুলফিকার মুজতবা উনার কাছে বাণীকে রেফার করে। শিক্ষকতার চাকরিটা পাকাপোক্ত করার জন্য বাণীর একটা ইন্টারভিউ নিতে চায় তিনি। জুলফিকার মুজতবা আপত্তি করে না। বাণী ইন্টারভিউটা দেয় এবং সানরাইজ হোপ স্কুলের ও লেভেলের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষিকা পদে নিযুক্তও হয়।

ভাগ্যিস! ভাগ্যিস দূর্জয়ের উছিলায় হলেও বাণী পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস হয়েছিলো। আর তার পাশাপাশি ইংরেজি মাধ্যমের স্টুডেন্ট হওয়ার বদৌলতে এখানকার পড়ালেখার ধরণ সম্পর্কেও তার ধারণা আছে। নাহয় এই চাকরিটা কখনো তার পাওয়া হতো না।

বাণীর চাকরি পাওয়া নিয়ে জুলফিকার মুজতবা খুশি হলেও নিশা খুশি হতে পারে না। সে আড়ালে নিজের আব্বুকে কিছুটা শাসায়,

“ তুমি আপুকে চাকরি খুঁজে পেতে হেল্প করলে কেনো আব্বু? তুমি হেল্প না করলে আপু কখনোই চাকরি খুঁজে পেতো না। তখন আপুকে আমাদের সাথে রেখে দিতে পারতাম। “

মেয়ের কথা শুনে জুলফিকার মুজতবা সামান্য হাসেন। নিজের আবেগী মেয়েকে পাশে বসিয়ে বুঝায়,

“ ওভাবে তোমার আপু কখনো খুশি থাকতে পারতো না মা। চিন্তা করো না। আব্বু তো আছি। “

চাকরি পাওয়ার সপ্তাহ খানিকের মধ্যেই একটা দু রুমের বাসা খুঁজে ভাড়া নেয় বাণী। মা মেয়ের জন্য এই দুই রুমের বাসাটাই তার কাছে সবচেয়ে পারফেক্ট মনে হয়েছিলো। আর তাছাড়াও বাসার লোকেশনটাও জুলফিকার মুজতবার পছন্দ হয়েছে। স্কুল এবং হেডকোয়ার্টারের কাছাকাছিই অনেকটা।

নতুন বাসায় উঠার জন্য প্রয়োজনীয় যত ফার্নিচার, আসবাবপত্র, যাবতীয় ইলেকট্রনিকস আছে সব কিছুর ব্যবস্থা করে জুলফিকার নিজেই লোক ঠিক করে বাসাটাকে থাকার উপযুক্ত করে সাজিয়ে দিয়েছে। বাণী বারবার বারণ করছিলো। তার ভীষণ লজ্জা লাগছিলো। জুলফিকার মুজতবা ইতিমধ্যে বাণীর আর বহ্নির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই বাড়ির সামনে দু’জন পাহারাদার নিযুক্ত করেছেন। যতদিন না হিরণ ধরা পড়ছে ততদিন এই পাহারার মধ্যেই বাণীকে থাকতে হবে। মানুষ গুলো বাণীর জন্য কম করে নি। সে আর ঋণী হতে চায় না। জুলফিকার মুজতবা তার মনের কথা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি কেবল বাণীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

“ এসব কিছু আমার আর নিশার তরফ থেকে উপহার মা। মানা করো না প্লিজ। “

__________

রিদওয়ানের মৃত্যুর কেবল দু মাস সম্পন্ন হলো। বন্ধুর মৃত্যু শোক তখনো কাটিয়ে উঠতে পারে নি প্রত্যয়। এরই মাঝে একদিন তার আব্বু মতিউর আরাফাত এবং আম্মু ফিজা রেহানা এসে উপস্থিত হয় চট্টগ্রামে। জরুরি তলবে ছেলেকে ডাকে এক শপিং মলে। প্রত্যয় বিরক্ত হয়। তার আব্বু আম্মু এতো উদ্ভট কেনো? কখনো কফি শপে দেখা করতে চায় তো কখনো শপিং মলে!

প্রত্যয় শপিং মলে যেতেই তার আম্মু তাকে নিয়ে একটা জেন্টস শো রুমে প্রবেশ করে। নিজের পছন্দ মতো ছেলেকে বিভিন্ন শার্ট ট্রায়াল দেওয়ায়। অবশেষে একটা ধূসর নীল রঙের শার্ট এবং সেই সঙ্গে একটা জিন্স পড়িয়ে ছেলেকে নিয়ে বের হয় মল থেকে।

প্রত্যয় বারবার জানতে চায় তারা কোথায় যাচ্ছে। মতিউর আরাফাত কেবল হাসি হাসি মুখে জানায়,

“ আমার এক বন্ধুর বাসায় আজ আমাদের ডিনারের দাওয়াত আছে। সেখানেই যাচ্ছি। “

প্রত্যয় আর কোনো প্রশ্ন করে না। তার মোটেও ইচ্ছে করছে না এই মুহুর্তে কোনো গেদারিং এ যেতে। কিন্তু আম্মু আব্বুকে তা বোঝানো সম্ভব হবে না তার দ্বারা। তাই সে নীরব রয়।

__________

বারো তলা ভবনটার লিফটে উঠতেই ৮ এ চাপে মতিউর আরাফাত। প্রত্যয় তখন লিফটে দাঁড়িয়ে নিজের শার্টের হাতা গোটাতে ব্যস্ত। লিফট এসে অষ্টম তলায় থামতেই তারা বের হয়। মতিউর আরাফাত বলতে থাকে এই অষ্টম তলার পুরোটা নিয়ে তার বন্ধুর এপার্টমেন্ট। কথাগুলো যদিও তিনি প্রত্যয়কে শোনানোর জন্যই বলছিলো কিন্তু প্রত্যয়ের ধ্যান সেদিকে নেই। সে ফোনে ফারদিনকে ম্যাসেজ পাঠাতে ব্যস্ত। মতিউর আরাফাত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কলিং বেল চাপে।

বন্ধুর বাসায় ডিনারের দাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য কি তা প্রত্যয় বুঝতে পারে যখন সেই বাড়ির ছোট কন্যা সালোয়ার কামিজ পড়ে পরিপাটি সেজে মাথায় এক লম্বা ঘোমটা টেনে চায়ের ট্রে হাতে তাদের সামনে উপস্থিত হয়। হালকা গোলাপি রঙের কামিজ পরিহিতা মেয়েটার চেহারা দেখতেই প্রত্যয়ের ভ্রু কুচকে আসে। মেয়েটাও সেই মুহুর্তে ট্রে থেকে একটা কাপ তুলে প্রত্যয়ের দিকে এগিয়ে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে দুই জনের দৃষ্টি বিনিময় হয়। প্রত্যয়কে দেখতেই মেয়েটাও বিস্ফোরিত চোখ করে তাকায়। বেখেয়ালিবশত তখন তার হাতের কাপ সামান্য বাকা হয়ে গরম ধোঁয়া উঠা চা প্রত্যয়ের হাতের পিঠে পড়ে। বিরক্তিতে প্রত্যয় চ বর্গীয় শব্দ করে উঠে। একবার অগ্নিদৃষ্টি মেলে সামনের মেয়েটিকে দেখে অত:পর আবার নিজের আব্বুর দিকে তাকায়।

মেয়েটার চোখ থেকেও ততক্ষণে বিস্ময়তা কেটে গিয়ে রাগী ভাব এসে ভর করেছে। পৃথিবীতে ৭ বিলিয়ন মানুষের বসবাস। সেই ৭ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে যদি ৩ বিলিয়ন মানুষ পুরুষ হয়, আর সেই ৩ বিলিয়ন পুরুষের মধ্যে ১ বিলিয়ন যদি বিবাহিত এবং আরো ১ বিলিয়ন যদি ইন এ রিলেশনশিপ পুরুষ হয় তবুও তো আরো ১ বিলিয়ন পুরুষ সিঙ্গেল অবশিষ্ট থাকে। তার শ্রদ্ধেয় পিতা আলাউদ্দিন সাহেবের চোখে সেই ১ বিলিয়ন সিঙ্গেল পুরুষের মধ্যে এই কুত্তাকেই নিজের কন্যার উপযুক্ত মনে হলো?

__________

হাত ঘড়িটার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে সাইফ। বিকাল সবে ৪ টা বেজে ৩২ মিনিট। গতরাতে ইয়াসমিন ম্যাসেজ করে বলেছিলো আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৪ টা বাজে যেনো সাইফ গুলিয়াখালী সি বিচে ইয়াসমিনের জন্য অপেক্ষা করে। সাইফ জানতে চেয়েছিলো কি কারণে। কিন্তু ম্যাডাম তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সেই যে অফলাইন হলো তারপর সারাদিনে আর একবারও অনলাইন আসে নি।

সময়জ্ঞানহীনতা সাইফের অতি অপছন্দনীয় একটা ব্যাপার। কিন্তু এই অপছন্দনীয় ব্যাপারটাও আজ আর তার বিরক্তির কারণ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কিছু অপেক্ষা অদ্ভুৎ সুন্দর হয়। অস্থিরতা মেশানো, আকুলতা মেশানো কিংবা বেনাম অনুভূতি মেশানো।

ঘড়ির কাঁটা যখন ৪ টা ৪৫ এ ঠেকে তখন নিশার আগমন ঘটে। একহাতে শপিং ব্যাগ এবং অন্য হাতে স্কার্ট সামলে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে। আবার মাঝপথে থেমে বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুল ঘাড় নেড়ে পিছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সাইফ মিনিট খানিকের জন্য মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় দেখে সবুজের বুকে বিচরণ করা সেই রমণীকে। অত:পর নিশার তাড়াহুড়ো ভঙ্গিমা দেখে কপাল কুচকে ফেলে। এই মেয়ের এতো তাড়া কিসের? দু’দিন হলো না পা ঠিক হয়েছে তবুও সেদিকে কোনো ধ্যানজ্ঞান নেই।

নিশা সামনে এসেই হেসে বলে,

“ সরি দেরি করে ফেলেছি। এক রিকশাওয়ালা মামাকে পথ চেনাতে চেনাতেই সময় লেগে গিয়েছে। “

সাইফ মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে বলে,

“ ওহ আচ্ছা। “

নিশা আনমনে সাইফের হাত ধরে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,

“ তাড়াতাড়ি চলুন ভাইয়া। নাহয় এখানে বেস্ট ভিউ এর জায়গা গুলো দ্রুত বুকড হয়ে যায়। “

সাইফের কানে আর সেই কথা পৌঁছায় না। সে বিস্মিত দৃষ্টি মেলে সেই দুধে আলতা রঙের হাতের মুঠোয় নিজের রোদে পুড়ে যাওয়া তামাটে হাতটা দেখে। অত:পর চোখ তুলে ফের নিশাকে দেখে।

নিরিবিলি এক গাছের নিচে সবুজ ঘাসের বুকে বসে আছে দু’জন। অদূরে দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের স্তব্ধতা। সূর্যটা সবে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়তে শুরু করেছে। নিশা খুব মনযোগ দিয়ে শপিং ব্যাগটা থেকে সাবধানে একটা বক্স বের করে খুলে সাইফের সামনে ধরে। আর প্রফুল্ল গলায় বলে,

“ হ্যাপি বার্থডে। “

সাইফ আরেকদফা চমকায়। বিস্মিত দৃষ্টি মেলে একবার নিশার হাতের কাপকেক-এর দিকে তাকায় ফের নিশার দিকে তাকায়। অবাক গলায় জানতে চায়,

“ আপনাকে কে বললো আজ আমার জন্মদিন? “

নিশা মুখ হাসি হাসি করে বলে,

“ আপনার আইডির এবাউট ইনফো তে দেখেছি। ভাববেন না আবার স্টক করছিলাম। আউট অফ কিউরিওসিটি আরকি! “

সাইফ এক মুহুর্ত সরল মুখশ্রীটা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ ওটা ফেক বার্থ ডেট মিস ইয়াসমিন। “

নিশা অবাক হয়ে জানতে চায়,

“ হ্যাঁ? ফেক? আসল ডেট কবে তবে? “

“ জানি না। “

নিশা ভাবে সাইফ মজা করছে। সে বিদ্রুপের স্বরে বলে,

“ নাইস জোক। “

সাইফ এবার শীতল স্বরে বলে,

“ আ’ম সিরিয়াস। “

নিশা সাইফের কণ্ঠের গাম্ভীর্যতা টের পায়। অবাক স্বরে জানতে চায়,

“ জানেন না কেনো? “

“ এতিমদের জন্মদিন বলতে কিছু হয় না ইয়াসমিন। এসব বিলাসিতা কেবল। “

নিশা চোখ বড় বড় করে সাইফকে দেখে। সাইফের কণ্ঠ কি সামান্য কাঁপলো? কে জানে! কিন্তু সেই স্বর নিশাকে আঘাত করে। অজান্তে, খুব গভীরে।

__________

সবে মাত্র চারজন স্টুডেন্টকে বিদায় দিয়ে বসার ঘরে সোফায় এসে বসলো বাণী। নিজের এই নতুন জীবনের প্রায় এক মাস পাড় হলো। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় স্কুলের জবটার পাশাপাশি বাসায়ও পড়ানোর জন্য চারটা স্টুডেন্ট পেয়ে গিয়েছে বাণী। এতে অবশ্য তার জন্য ভালোই হয়েছে। সপ্তাহে ছয় দিন তিনটা সাবজেক্ট পড়ায় সে। বিনিময়ে মাস শেষে প্রত্যেক স্টুডেন্টের থেকে পাঁচ হাজার করে পাবে। স্কুলের বেতন এবং প্রাইভেটের বেতন মিলিয়ে আপাতত মা ও মেয়ের একার সংসার বেশ স্মুথলিই যাচ্ছে।

মাথার উপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে অলস চোখে তাকায় বাণী। সম্পূর্ণ গতিতে ঘুরতে থাকা ফ্যানটাও আজকাল কেনো জানি বাণীকে স্বস্তি দিতে পারে না। এক অদ্ভুৎ অস্থিরতা কাজ করছে শরীর জুড়ে। শরীর কেমন তিরতির করে ঘামছে।

ভেতরের রুম থেকে বহ্নির ডাক ভেসে আসছে,

“ মাম্মা। “

বাণী উঠে দাঁড়াতে নিলেই আচমকা মাথা চক্কর মেরে উঠে। সে সঙ্গে সঙ্গে ধপ করে সোফায় বসে পড়ে। নিস্তেজ শরীরটা পিছনের দিকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে ফেলে সে। মনে মনে নিজেকে বুঝ দেয় হয়তো প্রেশারটা ফল করেছে।

__________

দু’দিন পরের ঘটনা। কোনো এক অলস দুপুরে নিজের কালো গাড়িতে করে হেডকোয়ার্টার যাওয়ার পথে সানরাইজ হোপ স্কুলের সামনে এসে মনের অজান্তে গাড়িটা থামায় দূর্জয়। স্কুলের ভেতর থেকে ছেলে মেয়েরা দৌড়ে বের হচ্ছে। ছুটি হয়েছে খুব সম্ভবত।

এতো এতো ছেলে মেয়ের ভীড়ে এক নারীকে দেখতেই সেই পানে মনযোগ স্থির হয় দূর্জয়ের। মলিন রঙা কামিজ পরিহিতা নারী ধীর পায়ে হেঁটে বের হচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে তার ৫ বছরের কন্যা। বাচ্চাটা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে অনেক কথা বলতে ব্যস্ত। কিন্তু সেই নারীর সেদিকে মনযোগ নেই।

দূর্জয় নীরবে সেই নারীর মুখপানে তাকিয়ে থেকে উপলব্ধি করে অন্য সময়ের তুলনায় আজ বেশি রুগ্ন দেখাচ্ছে বাণীকে। একা হাতে সব সামলাতে কি বেশ হিমশিম খাচ্ছে মেয়েটা? নাকি অসুস্থ?

আচমকা নিজের এতো কৌতূহল দেখে দূর্জয় চমকায়। পরমুহূর্তেই চোখ ফিরিয়ে নেয় সে। মুখভঙ্গি ফের গম্ভীর করে গাড়ি স্টার্ট দেয়। আজকাল ভুল স্টপে গাড়ি থামানোর বদভ্যাস হয়েছে তার।

__________

চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৫০১ কিলোমিটার দূরে রাজশাহী শহর। রাতের নিস্তব্ধতায় লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে জঙ্গলের মাঝে এক দুই কক্ষের কুটিঘরটাকে বাহির থেকে দেখতে অনেকটা ভুতুড়ে লাগছে। বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছে কেমন অদ্ভুৎ এক শব্দ।

শ্বেত চামড়ার এক পুরুষকে টিমটিমে হলুদ আলোয় দেখতে বেশ ভয়ংকর লাগছে। সে অতি মনযোগের সহিত চাপাতি দিয়ে টেবিলের উপর আঘাত করতে ব্যস্ত। কিছু একটা কাটছে।

জ্বলজ্যান্ত এক মানুষকে কেটে টুকরো টুকরো করে পলিথিন বন্দী করে সে কুটিঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বাড়ির সামনে কিছু গাছের ডাল ও পাতা জোরো করে আগুন জ্বালিয়েছে ইবাত। সেই আগুনের ধারেই একটা মোড়ায় বসে ছিলো সে। স্যারকে বেরিয়ে আসতে দেখেই মাথা তুলে তাকায় সে।

সবসময় ছোট ছোট করে কেটে রাখা দাড়ি গুলো কিছুটা ঘন হয়েছে। চেহারার মধ্যেও অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। বোকা সৈন্যের দল ইবাতের স্যারের এই নতুন লুক দেখে উনাকে চিনতে ভুল করবে।

হিরণ নীরবে এসে আগুনের ধারে আরেকটা মোড়া টেনে বসে। শান্ত শীতল স্বরে বলে,

“ পলিথিনটা নিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিবে। “

ইবাত কাঁপা গলায় বলে,

“ স্যার ভাসিয়ে দিলে তো পুলিশ জেনে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। জঙ্গলেই টুকরো গুলো দাফন করে দেই? “

“ জানুক। আমি চাই সকলে এই জানোয়ারের পরিণতি দেখুক। আমার বাণীকে কুপ্রস্তাব দেওয়ার ফল এরকম ভয়াবহই হবে। “

ইবাত ভীত দৃষ্টি মেলে হিরণকে দেখতে থাকে। স্যার আজকাল আগের তুলনায় আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। এই দু-মাস তা-ও মোটামুটি শান্ত হয়ে ছক কষছিলো। নতুন প্ল্যান ম্যাপ রেডি করছিলো। কিন্তু যখনই নিজের গুপ্তচরের মাধ্যমে খবর পেলো যে বাণী ম্যামকে স্কুলের এক স্যার কু প্রস্তাব দিয়েছে আর এই নিয়ে বাণী ম্যাম একা বসে কান্নাকাটিও করেছে তখনই উনার মাথা বিগড়ে যায়। তিন দিনের মধ্যে সেই লোককে চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহীতে তুলে আনে। অত:পর নিজ হাতে কুপিয়ে হত্যা করে।

ইবাত সামান্য ইতস্তত করে বলে,

“ স্যার, অসীম কল করেছিলো। “

হিরণ আগ্রহী দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে বলে,

“ কি বললো? বাণী আর বহ্নি ঠিক আছে? “

“ ম্যাডামকে নাকি আজ সন্ধ্যায় হসপিটাল যেতে দেখা গিয়েছে। “

হিরণ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ হসপিটাল মানে? ঠিক আছে ও? “

“ ঠিক আছে। উনি নাকি শুধু ডক্টর দেখিয়ে বাসায় চলে গিয়েছে। “

হিরণ কপালে চিন্তার ভাজ রেখেই বলে,

“ অসীমকে ফোন করো দ্রুত। কোন ডিপার্টমেন্টের ডাক্তার দেখিয়েছে এসব ডিটেইলস জেনে আমাকে জানাতে বলো। কুইক। “

__________

সারাদিনের কাজ শেষে আজ আর মেসে ফিরে গেলো না দূর্জয়। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে ফিরে এলো নিজের পৈতৃক নীড়ে। সব সময় লক করে রাখা নিজের ব্যক্তিগত রুমে প্রবেশ করে হলুদ টিমটিমে আলোর সুইচটা চেপে জ্বেলে দেয়। নিজের গলার কাছের দুটো বোতাম খুলতে খুলতে এগিয়ে যায় আলমারির কাছে। আলমারির একটা দরজা খুলতেই ভেতর থেকে একটা ফোটো এলব্যাম বের করে সে। সেই সঙ্গে বের করে সযত্নে তুলে রাখা গিটারটা।

বিছানার সঙ্গে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে সে। এলব্যামটা খুলতেই বেরিয়ে আসে স্মৃতিচিত্র। কত শত ছবি। এতো ছবির ভীড়ে দূর্জয়ের চোখ আটকায় একটা বাচ্চা ছেলের ছবিতে। খেলনা বন্দুক হাতে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে দাঁত বের করে। ছবির নিচে এককোণে কলমের কালি দ্বারা লেখা ইংরেজি পাঁচ অক্ষরের একটা নাম। দীপ্ত।

দূর্জয় আর এলবাম ঘাটে না। এলবামটা একপাশে রেখে গিটারটা কোলে তুলে নেয়। আনমনে কিছুক্ষণ গিটারে টুংটাং শব্দ করে। একবার সুর তুলতে সক্ষম হলেই খালি গলায় গেয়ে উঠে,

“ তবু এই দেয়ালের শরীরে
যত ছেঁড়া রং, ধুয়ে যাওয়া মানুষ
পেশাদার প্রতিহিংসা তোমার চেতনার
যত উদ্ভাসিত আলো রং
আকাশের মতন অকস্মাৎ নীল
নীলে ডুবে থাকা তোমার প্রিয় কোনো মুখ
তার চোখের কাছাকাছি এসে কেনো পথ ভেঙে

দু’টো মানচিত্র এঁকে, দু’টো দেশের মাঝে
বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ।

তবু এইখানে আছে অবলীল হাওয়া
জানালা বদ্ধ ঘরে আসে যায়
দেয়াল ধরে বেড়ে ওঠে মধ্যরাত
তোমার ছায়ায় জমে এসে ভয়
আলোকে চিনে নেয় আমার অবাধ্য সাহস
ভেতরে এখন কি নেই কাপুরষ অন্ধকার একা?

তোমাকে ঘিরে পথগুলো সব সরে যায়
রাত্রির এই একা ঘর ঝুলে আছে শূন্যের কাঁটাতারে
দু’টো মানচিত্র এঁকে, দু’টো দেশের মাঝে
মিশে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ। “

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৩.

বিষন্ন কোনো এক রজনীতে সোনালী আভা ছড়ানো চাঁদের পানে তাকিয়ে আছে একজোড়া সমুদ্র নীল চোখ। নির্লিপ্ত সেই দৃষ্টি কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে না। কেবল নির্নিমেষ দেখতে থাকে সেই চাঁদের মলিনতা। আজকাল ভাঙা জানালার পাশে বসে রাত কাটিয়ে দেওয়াটা জারিয়াহর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সারা রাত পেরিয়ে যায় তবে দু চোখের পাতায় ঘুমের হদিস মিলে না। মনে হয় একবার চোখ বুজলে পরের দিন সূর্যোদয় দেখাটা যদি আর নসিব না হয়?

ফিনফিনে বাতাস গায়ে এসে ধাক্কা খেতেই শরীরের সব গুলো পশম ঠান্ডায় কাটা দিয়ে উঠে। জারিয়াহ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালার ধার থেকে উঠে যায়। অত:পর একটা জলপাই রঙা জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে ফের জানালার ধারে এসে বসে। দুই হাত জানালার রেলিঙে রেখে তার উপর মাথাটা এলিয়ে দিয়ে আবারও আকাশ পানে তাকিয়ে থাকে। জ্যাকেটের উষ্ণতা গায়ে ছড়িয়ে পড়তেই জারিয়াহর নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে এবার বিষণ্ণতা ফুটে উঠে।

পৃথিবীর সবথেকে নিষ্ঠুর এক সত্য হলো মানুষের হারিয়ে যাওয়া। সুন্দর এই পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় রাখতে যেমন প্রতিদিন নতুন প্রাণের আগমন ঘটছে, তেমনই বহু প্রাণের ইতি ঘটছে কোনো এক নির্দিষ্ট ঘটনার মধ্য দিয়ে। কিন্তু যা হারায় না তা হলো কোনো এক ব্যক্তিকে ঘিরে কিছু স্মৃতি। সময় মতো সেই স্মৃতি ঠিকই মনে করিয়ে দেয় নির্দিষ্ট এক ব্যক্তির কথা।

__________

রাত আটটা কি নয়টা বাজে কেবল! নভেম্বর মাস। শীতের আমেজ প্রকৃতিকে মুড়িয়ে রেখেছে। এই শীত শীত আবহাওয়ার মধ্যে হঠাৎ বৃষ্টি বেশ অনাকাঙ্ক্ষিতই বটে। যেনো তেনো বৃষ্টি নয়। রাস্তায় হাঁটু জল তুলে দেওয়ার মতো দীর্ঘ সময়ের লাগাতার বৃষ্টি। পথঘাট প্রায় ফাঁকাই বলতে গেলে। মাঝে কেবল এক দুটো গাড়ি সজোরে ছুটে যেতে দেখা যাচ্ছে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে অপ্রত্যাশিত ভাবে পথিমধ্যে কালো জিপ গাড়িটার টায়ার পাঙচার হয়ে গেলো।

দূর্জয় বিরক্ত হয় মারাত্মক। টায়ারটা তার গন্তব্যের কাছাকাছি গিয়ে পাঙচার হলে কি খুব বড়ো কোনো ক্ষতি হয়ে যেতো? বিরক্তি নিয়েই কাউকে ফোন করতে নেয় দূর্জয়। সেই মুহুর্তে ঠিক তার পাশে এসে উল্টো পথগামী এক সাদা গাড়ি থামে। গাড়ির পিছনের সিটের একপাশের জানালা নামিয়ে এক রমণী মুখ বের করে গলা উঁচিয়ে ডাকে,

“ ভাইয়া? দূর্জয় ভাইয়া! “

পরিচিত ডাকটা কানে এসে পৌঁছাতেই দূর্জয় পাশ ফিরে তাকায়। অত:পর গাড়ির কাঁচের জানালাটা নামিয়ে বলে,

“ এই বৃষ্টির মধ্যে বাহিরে কি করছো নিশা? “

“ আমি তো বাণী আপুর বাসায় যাচ্ছিলাম। তুমি এদিকে কি করছো? “

“ মেসে ফিরছিলাম। গাড়ির টায়ার সম্ভবত পাঙচার হয়ে গিয়েছে। “

নিশা আশেপাশে তাকিয়ে বলে,

“ এখন তো কোনো রিকশা বা উবার পাবে না তুমি। “

“ সমস্যা নেই। আমি কাউকে কল করছি গাড়ি নিয়ে আসতে। তুমি সাবধানে যাও। “

নিশা বৃষ্টির বেগ দেখে বলে,

“ গাড়ি নিয়ে আসতে সময় লাগবে ভাইয়া। তুমি বরং গাড়ি লক করে আমার সাথে চলো। গাড়ি আসার আগ পর্যন্ত না-হয় বাণী আপুর বাসায় ওয়েট করবে। “

বাণীর বাসায় যাওয়ার কথা শুনেই দূর্জয় বলে উঠে,

“ শুধু শুধু এতো ঝামেলার দরকার নেই পাকনি। তুমি যাও। আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি। “

নিশা এবার মুখ ভার করে বলে,

“ আমি বিকেলে আপুকে কল করেছিলাম। বহ্নির নাকি খুব জ্বর এসেছে। আব্বুরও রাতে বাসায় ফিরতে দেরি হবে। তাই ভাবলাম বাসায় একা বসে না থেকে বহ্নিকে দেখে আসি। তুমিও চলো না। বাচ্চাটা তোমাকে দেখে খুশি হবে অনেক। “

দূর্জয় মিনিট খানেক নীরব রয়। অত:পর কিছু একটা ভেবে গাড়ির চাবি আর ফোন নিজের পকেটে ভরে নেমে আসে। নিশার পাশে উঠে বসতেই নিশা মুখে জয়ের হাসি ফুটিয়ে সামনে বসে থাকা ড্রাইভারকে বলে,

“ চলুন। “

__________

তিন তলার এ থ্রি ইউনিটের দরজায় পরপর দু’বার কড়া নেড়ে দাঁড়িয়ে আছে দূর্জয়। টানা দুই ঘন্টা ধরে চলমান এই বৃষ্টিতে বিদ্যুৎও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। চারিদিকটা কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকারে তলিয়ে আছে।

মিনিট একের মধ্যেই ভেতর থেকে দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে যায়। দরজার ধারে মোম দানি হাতে দাঁড়িয়ে আছে কালো রঙের থ্রি পিস পরিহিতা নারী। মোমের আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠে সেই নারীর মলিন মুখশ্রী। চোখের কার্নিশে জল জমে আছে মৃদু।

মোমবাতির স্বল্প আলোতে সেই মুখখানি দেখে দূর্জয় থমকায়। পরপর প্রশ্ন করে,

“ সব ঠিক আছে? “

বাণী মুখ ফুটে বলতে পারে না কিচ্ছু ঠিক নেই। সে নীরব রয়। এরই মাঝে একটা কাপড়ের ব্যাগ ও ফোন হাতে তিন তলায় এসে পৌঁছায় নিশা। বাণীকে দেখেই দ্রুত জুতো খুলে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলে,

“ আপু। জ্বর কমেছে বহ্নির? “

প্রশ্নটুকু করে নিশা আর অপেক্ষা করে না। নিজেই হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে ভেতরের রুমে চলে যায়। দূর্জয় বাণীর মুখপানে তাকিয়ে ধীরে সুস্থে ভিতরে প্রবেশ করে। নিচু স্বরে বলে,

“ আমার গাড়ির টায়ার পাঙচার হয়ে গিয়েছিলো। পথিমধ্যে নিশার সাথে দেখা হয়। ও বললো বহ্নির জ্বর। তাই দেখতে এলাম। “

বাণী মাথা নত করে দরজা আটকে দিয়ে বলতে নেয়,

“ তুমি… “

বাকি কথাটুকু সম্পন্ন করতে পারে না বাণী। তার আগেই ভেতরের রুম থেকে নিশা চেঁচিয়ে উঠে,

“ আপু! “

চেঁচানো শুনে বাণী দ্রুত পায়ে ভিতরের রুমের দিকে যেতে নিলেই দূর্জয় শান্ত স্বরে শুধায়,

“ ক্যান আই কাম? “

বাণী এক পলকের জন্য ফিরে তাকায়। মাথা সামান্য নেড়ে সম্মতি জানিয়ে এগিয়ে যায়। দু’জন একসঙ্গে রুমে প্রবেশ করতেই দেখে নিশা বহ্নির পাশে বসে কপাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। জ্বরে কাবু বাচ্চাটা বিছানার সঙ্গে মিশে আছে যেনো। দুই চোখ উত্তাপে খুলতে পারছে না। কেমন করে কাতড়াচ্ছে! নিশা বাণীকে দেখতেই বলে,

“ পুড়ে যাচ্ছে একদম। ভয়াবহ অবস্থা। “

দূর্জয় এগিয়ে যায়। নিশা বিছানা ছেড়ে নেমে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। দূর্জয় বহ্নির মাথার কাছে বসে কপাল ছুঁয়ে দেখে। সঙ্গে সঙ্গে সে আঁতকে বলে উঠে,

“ মারাত্মক জ্বর এসেছে। “

বাণী মাথা নত করে বলে,

“ দুপুরে জোর করে কিছুটা খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলাম। বমি করে সব উগড়ে দিয়েছে। এরপর থেকে আর কিছু খাওয়াতে পারি নি। জলপট্টিও দিতে দিচ্ছে না। “

নিশা সামান্য রাগ দেখিয়ে বলে,

“ এরকম একটা অবস্থা আর তুমি কলে বলছিলে যে সিরিয়াস কিছু না। আমি নিজে না আসলে তো এই অবস্থার কথা জানতামও না। “

দূর্জয় সিরিয়াস গলায় বলে উঠে,

“ হসপিটাল নিয়ে যেতে হবে। “

বাণী সঙ্গে সঙ্গে বাধা দেয়,

“ না। প্রয়োজন নেই। কিছু খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলেই জ্বর কমে যাবে। “

নিশা বলে উঠে,

“ আমি আরো বৃষ্টি দেখে ভুনা খিচুড়ি আর বেগুন ভেজে নিয়ে এসেছিলাম। বেড়ে নিয়ে আসছি। জোর করে হলেও একটু খাইয়ে দাও। “

বাণী মানা করতে চাইলো। কিন্তু নিশা অপেক্ষা করলো না। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটের আলো ধরে চলে গেলো খাবার টেবিলের কাছে।

বাণী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দূর্জয়ের দিকে তাকায়। বলে,

“ এরকম একটা সময় এসেছো। একদিকে বহ্নির এই অবস্থা অপরদিকে কারেন্ট নেই। পানি দেবো তোমাকে? “

দূর্জয় ঘাড় ঘুরিয়ে একপলক বাণীকে দেখে থমথমে গলায় বলে উঠে,

“ প্লিজ বাণী। ফরমালিটির প্রয়োজন নেই। “

দূর্জয়ের একহাত বহ্নির গালে ছিলো। জ্বরের ঘোরে বহ্নি সেই হাত জড়িয়ে ধরে পাশ ফিরে অস্ফুটে বলে,

“ পাপা। “

বাণী এবং দূর্জয় দু’জনেই চমকে তাকায় বহ্নির পানে। বাণীর চোখ মুহুর্তেই টলমল করে উঠে। গত চার মাসে তার মেয়ে এক মুহুর্তের জন্য ওই লোকটার নাম মুখে নেয় নি। কিন্তু আজ! সন্ধ্যা থেকেই জ্বরের ঘোরে বারবার পাপাকে খুঁজছে। বাণী গত দুই ঘন্টা ধরে অসহায়ের ন্যায় মেয়ের পাশে বসে ছিলো। একটা পর্যায়ে যখন পরিস্থিতি অসহনীয় ঠেকে তখন বসে নীরবে ডুকরে কেঁদেছে।

দূর্জয় ঘাড় ঘুরিয়ে আবার বাণীর পানে তাকায়। বাণী সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারে নিজের মুখ লুকিয়ে ফেলে। দূর্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বহ্নির মাথার কাছে সামান্য ঝুকে কোমল স্বরে শুধায়,

“ পাপা নই। ইট’স মি কিডডো। মেজর। “

বহ্নি কি তা শুনতে পেলো কিনা জানা নেই। কেবল আরেকটু দূর্জয়ের হাত জড়িয়ে মিশে গেলো। কারো অযাচিত স্পর্শে বিরক্ত অনুভব করা দূর্জয় হয়তো জীবনে প্রথমবার কারো স্পর্শে বিরক্তবোধ করলো না। বহ্নির এই জ্বরের ঘোরের আহ্লাদকে প্রশ্রয় দিলো।

__________

একটা কফিশপে মুখোমুখি বসে আছে দুজন যুবক ও যুবতী। যুবতী নিজেদের ডান পাশের টেবিলে বসা আরো পাঁচ যুবককে দেখেই মুখ কালো করে বলে উঠে,

“ একা আসবে ভেবেছিলাম। “

প্রত্যয় ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের বাম পাশের টেবিলে বসা এক রমণীকে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ তুমিও তো একা আসো নি। “

ডান পাশের টেবিলে বসা পাঁচ যুবকের মধ্যে সবথেকে চঞ্চল স্বভাবের যুবকটা বলে উঠে,

“ ঝগড়াঝাটি ভাবী। আমরা কিছু দেখছি না। ইউ গাইস ক্যারি অন। “

জেসি চোখ মুখ কুচকে ফেলে। প্রত্যয় নামক এই কুত্তার সাঙ্গ পাঙ্গ গুলোর মধ্যে এই সাইফ নামক লোকটাকেই সবথেকে বিরক্তিকর লাগে তার। কোনো ম্যানারস নেই। জেসি বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ ম্যানারলেস কোথাকার। “

জেসির বিড়বিড়িয়ে বলা কথাটা প্রত্যয়ের কানে পৌঁছায়। সে চোখ গরম করে বলে,

“ তোমার ফ্রেন্ড তো খুব ম্যানারসের দোকান, তাই না? পাশের বাড়ির আন্টির মতো আমাদের টেবিলে আড়ি পেতে রেখেছে। “

“ অন্তত তোমাকে ঝগড়াঝাটি দুলাভাই তো ডাকছে না। “

প্রত্যয় বলে,

“ না ডাকাই ভালো। কারণ তোমার হাজবেন্ড কিংবা তোমার ফ্রেন্ডের দুলাভাই হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। “

জেসি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ আওয়ার ফিলিং ইজ মিচুয়্যাল। “

“ আর মাত্র চার মাস সহ্য করে নিতে হবে। ফ্যামিলি থেকে বেধে দেওয়া ছয় মাস পাড় হলেই আমরা ক্লিয়ারলি জানিয়ে দিবো যে উই ট্রাইড টু নো ইচ আদার। কিন্তু আমাদের মেন্টালিটি ম্যাচ করে না। সো কোনো এনগেজমেন্ট হবে না। “

জেসি বিদ্রুপ করে বলে,

“ এক্স্যাক্টলি। তোমার মতো কাউকে বিয়ে করার আগে আমি দরকারে হারপিক খেয়ে মরে যাবো। তবুও তোমাকে বিয়ে করে নিজের প্রেস্টিজ নষ্ট করবো না। “

পাশের টেবিল হতে খাবার খেতে ব্যস্ত সাইফ কারেকশন করে দিয়ে বলে,

“ হারপিক খেয়ে সুইসাইডের ট্রাই করলে এভাবেও আপনার প্রেস্টিজ বলতে আর কিছু থাকবে না ভাবী। আর তাছাড়া হারপিক খেয়ে কেউ মরে না, বড়জোর পেটে গন্ডগোল দেখা দিবে। আপনি বরং ফিনাইল খেয়ে দেখতে পারেন। “

সাইফের কথার পিঠে সেই টেবিলে বসা বাকি চারজন সরবে হেসে উঠে। জেসি চোখ গরম করে সামনে তাকাতে দেখে প্রত্যয়ও অন্যদিকে ফিরে মুখ টিপে হাসছে। এবার সে নিজের বাম পাশে তাকাতে দেখে তার সো কল্ড বেস্ট ফ্রেন্ডও সাইফের কথা শুনে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মুহুর্তেই জেসির শরীরে যেনো আগুন ধরে যায়। সে শব্দ করে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“ এ বাঞ্চ অফ ইডিয়টস। “

বলেই সে গটগট পায়ে হেঁটে সেখান থেকে প্রস্থান করে। সাইফ অবাক সুরে বলে,

“ ঝগড়াঝাটি ভাবী চেতে গেলো কেনো? আমি তো ভালো সলিউশন দিলাম। মানুষ আজকাল উপকারের দাম দেয় না। “

__________

একটা পেস্ট্রি শপে দাঁড়িয়ে অর্ডার হাতে পাওয়ার অপেক্ষা করছে বাণী। পেস্ট্রি শপটা এই এলাকায় নতুন। কিছুদিন আগে স্কুল থেকে ফেরার পথে বহ্নিকে এখান থেকে ডোনাটস কিনে দিয়েছিলো বাণী। বাচ্চাটা মিষ্টি খাবার খুব একটা পছন্দ করে না কখনো। কিন্তু আজ মুখে অরুচি নিয়েও নিজ থেকে এই শপের ডোনাটস খেতে চেয়েছে। তাই বাণী আর অপেক্ষা না করে দ্রুত পার্স হাতে বেরিয়ে এসেছে।

বাসা থেকে অবশ্য বেশি একটা দূরে না এই শপটা। আর তাছাড়াও বাসায় বহ্নি একা নেই। সঙ্গে নিশাও আছে। তাই মোটামুটি নিশ্চিন্তেই আছে বাণী। গতকাল রাতে যে এসেছিলো মেয়েটা তারপর আর ফিরে নি। ফোন করে জুলফিকার মুজতবার থেকে অনুমতি নিয়েই বহ্নির কাছে রয়ে গিয়েছে। বহ্নির জ্বরের কথা শুনে আজ বিকেলে জুলফিকারও একবার এসে বাচ্চাটাকে দেখে গিয়েছে।

অর্ডার প্যাক করে দিতেই বাণী পেমেন্ট করে হাতের ফোনে সময়টা দেখে নেয়। রাত ৯ টা বেজে ২৭ মিনিট। বাণী দ্রুত শপ থেকে বের হয়। বাসায় ফিরে বহ্নিকে খাইয়ে ওষুধও খাওয়াতে হবে।

ফুটপাথ ধরে বাড়ির পথে হাঁটছিলো বাণী। আচমকা পাশের এক গলি থেকে একজোড়া হাত তার মুখ চেপে ধরে টেনে অন্ধকারে নিয়ে যায়। আকস্মিক ঘটনায় বাণী হতভম্ব হয়। হাত থেকে পার্স এবং পার্সেলের ব্যাগটা পড়ে যায়। হাত পা ছোড়াছুড়ি শুরু করে। কিন্তু সেই সুবলিষ্ঠ হাতের শক্তির সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে পেরে উঠে না সে।

এই গলিটা নির্জন। কোনো মানুষ নেই। কেবল সারি সারি করে কিছু গাড়ি পার্ক করে রাখা। সম্ভবত পার্কিং এরিয়া কোনো। গলির শেষ মাথায় যেতেই সেই বলিষ্ঠ হাতের বাধন আলগা হয়। বাণী তৎক্ষণাৎ নিজেকে ছাড়িয়ে পিছনে ঘুরে তাকায়।

গলির এক কোণে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বাণী দেখতে পায় একটা পুরুষালী অবয়বকে। সাধারণ দশটা পুরুষের মতোই শার্ট এবং প্যান্ট পরিহিত। তবে সেই পরিধেয় পোশকের অবস্থায় কোনো যত্নের ভাজ নেই। শুভ্র রঙা মুখের অর্ধেকটা কালো মাস্কের আড়ালে ঢাকা। তবে উন্মুক্ত চোখ জোড়া দেখে বাণী জমে যায়। ভয়ে দু’পা পিছিয়ে যায়। রক্ত হিম করা সেই দৃষ্টি দেখে চিৎকার করার কথা ভুলে বসে।

উক্ত পুরুষ বাণীর হাবভাব দেখে নীরবে নিজের মুখের মাস্কটা খুলে। এক কদম এগিয়ে যায় বাণীর দিকে। বাণী সঙ্গে সঙ্গে আরো দু কদম পিছিয়ে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে গলির মাথায় তাকায়। পথ খোলা নেই। গলির মাথায় একই বেশ ভূষায় দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন যুবক। যেনো পাহারা দিচ্ছে। বাণী পালানোর চেষ্টা করলেই খপ করে তাকে ধরে ফেলবে।

বাণী ভীত চোখ জোড়া মেলে আবার সামনে তাকায়। ঘামছে সে। এই শীতল আবহাওয়ার মধ্যেও সে তিরতির করে ঘামছে। ঘামে ভেজা চুল গুলো গাল ও ঘাড়ে লেপ্টে আছে। অজ্ঞাত পুরুষ নীরবে এগিয়ে আসে। একহাতে বাণীর গালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরাতে সরাতে অতি শান্ত গলায় বলে,

“ খুনি তো আমি ছিলাম বাণী। তুমি কেনো তোমার হাত নোংরা করলে? “

বাণী ভয়ে কাপছে। অতি শান্ত গলায় বলা কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে আরো ভীত হয়ে পড়ে সে। সেই পুরুষ এবার গাল থেকে হাত নামিয়ে বাণীর গলা চেপে ধরে। চোখে চোখ রেখে বলে,

“ আমার বাচ্চাকে কেনো মারলে? “

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৪.

হিরণের উচ্চারণ করা প্রশ্ন শুনতেই বাণী চোখ জোড়া বুজে নেয়। প্রাণ ভরে একটু নিঃশ্বাস কুড়িয়ে নেয়। সঙ্গে কুড়িয়ে নেয় কিছুটা সাহস। বুকের ভেতর সঞ্চার হওয়া জোরটুকুকে হাতিয়ার করে সে চোখ মেলে তাকায়। দুঃসাহসিক জবাবে জানায়,

“ আপনাকে সন্তানহারা এক ভঙ্গুর পুরুষে পরিণত করতে। “

হিরণের ক্ষিপ্র আগুন চোখের দৃষ্টিতে যেনো এক বালতি পানি ঢেলে দিলো বাণী। থমকে রইলো সে। বাণীর গলা চেপে ধরা হাতটা খানিকটা আলগা হয়ে আসলো। বিমূঢ় ভঙ্গিতে কেবল একটা শব্দ উচ্চারণ করে প্রশ্ন ছুড়ে,

“ কেনো? “

“ ভাইয়ের রক্তের দাম নিতে ভুলে যাবো ভেবেছিলেন? “

প্রশ্নের পিঠে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বাণী ঠোঁটের কোণে মিহি হাসি ফুটিয়ে তুলে। হিরণ দেখে তা। অবিশ্বাসের লেশ তার দৃষ্টি থেকে বিলীন হচ্ছে না। নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীকে চিনতে অসুবিধা হচ্ছে তার। এটা বাণী হতে পারে না। তার বাণী নিজের সন্তানের প্রতি নমনীয় ছিলো। নিষ্ঠুর ছিলো না। এ কেমন অদ্ভুত শাস্তি? কি অদ্ভুৎ নিষ্ঠুরতা! হিরণ ভঙ্গুর স্বরে বলে,

“ ও নিষ্পাপ ছিলো। “

“ আমার ভাইয়ের কি পাপ ছিলো? “

“ এতটা অমানবিক কিভাবে হলে? “

“ আপনি মানবিকতা দেখিয়েছিলেন? “

“ তোমার বিবেক তোমাকে বাঁধা দেয় নি? “

“ না। “

বাণীর স্পষ্ট জবাবের পিঠে হিরণ অস্থির হয়ে উঠে। বিস্ময়তা ছেড়ে হিংস্র হয়। শক্ত করে বাণীর গলা চেপে ধরে তাকে পিছনের দিকে নিয়ে যায়। পার্ক করে রাখা একটা গাড়ির বোনাটে গিয়ে বাণীর পিঠ ঠেকে। হিরণ ঝুঁকে তার মুখের উপর। পরপর আরো শক্ত করে গলার রগটা চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“ এতো সাহস? প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে এতো বড় একটা কাজ করলে? আমার বাচ্চার অস্তিত্ব মিটিয়ে দিলে। তুমি… “

কথা আটকে আসে হিরণের। রাগে সমস্ত শরীর কাপছে তার। মুখের অসম্পূর্ণ কথাটুকু পুরো করতে বলে,

“ সন্তানহারা হই নি আমি। আমার বহ্নি আছে। আমার মেয়ের পাপা আমি। “

গলা চেপে ধরায় বাণী জবাব দিতে পারে না মুখ ফুটে। নাহয় সে মুখের উপর বলে দিতো,

“ আপনি বহ্নিকেও হারিয়েছেন। আমার মেয়ে আপনাকে ঘৃণা করে। নিজের মা’য়ের প্রতি অন্যায়কারীকে ও কখনোই পাপা বলে স্বীকৃতি দিবে না। “

হিরণের ক্ষোভ মিশ্রিত নিঃশ্বাস যখন বাণীর মুখ জুড়ে আছড়ে পড়ছে ঠিক সেই মুহুর্তে সরু গলির মাথায় দাঁড়িয়ে পাহারা দেওয়ার দায়িত্বে নিযুক্ত ইবাত তার কাছে দৌড়ে আসে। ভীত গলায় বলে,

“ স্যার চলুন। কেউ আসছে। “

হিরণ একচুল পরিমাণ নড়ে না। বাণীকেও ছাড়ে না। অনড় রয়। ইবাত ভীত দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকিয়ে হিরণকে পিছন থেকে জাপটে ধরে টানা শুরু করে। তবুও ছাড়াতে পারে না। বাণীর দুই চোখের কার্নিশে তখন অশ্রু এসে ভীড় করলেও তার ঠোঁটের কোণে লেপ্টে রয় হাসি। হিরণকে শারীরিক ভাবে আঘাত করেও কখনো এরকম শান্তি অনুভব করে নি সে। কারণ শারীরিক আঘাতে হিরণের কখনোই কিছু যায় আসতো না। কিন্তু এইবার বাণী জায়গা মতো বাজিমাত মেরেছে। হিরণ ভেঙেছে। নড়বড়ে হয়েছে তার পিতৃক সত্তার অনুভূতিগুলো।

হিরণকে সরিয়ে আনতে না পেরে ইবাত ঘাড় ঘুরিয়ে একবার গলির শেষ মাথার বাউন্ডারির দিকে তাকায়। একটা গাড়ি বেয়ে উঠে এই বাউন্ডারি টপকে পালিয়ে যাওয়া ইবাতের জন্য বড়ো কোনো বিষয় নয়। কিন্তু তার ভৃত্য স্বত্তা তাকে সেই অনুমতি দেয় না। সে ঠায় হিরণের পাশে দাঁড়িয়ে রয়। অসহায় দৃষ্টি মেলে একবার নিজের স্যারকে দেখে পরমুহূর্তেই ক্ষোভ মিশ্রিত দৃষ্টিতে দম প্রায় ফুরিয়ে আসা বাণীকে দেখে। এই মহিলা! এই মহিলা তার স্যারের জীবনের সবথেকে বড়ো ঝামেলা। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ইবাতের মনে হচ্ছে তার উচিত ছিলো বহু পূর্বেই স্যারের জীবন থেকে এই মহিলাকে সরিয়ে দেওয়া।

“ গেট এওয়ে ফ্রম হার। “

বজ্রধ্বনির মতো স্বর কানে পৌঁছাতেই হিরণ চোখ তুলে পাশে তাকায়। গলির মাথায় এক পুরুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। দু’হাত তুলে কিছু একটা তাক করে ধরে রেখেছে। তবে কৃত্রিম আলোর অভাবে তার মুখখানা স্পষ্ট নয়। হিরণ মানুষটাকে না চিনলেও বাণী কণ্ঠ শুনেই তাকে চিনতে পারে। সে স্বস্তিতে চোখ বুজে নেয়। অবয়ব ধারী মানুষটা ধীর পায়ে সামনে এগোতেই ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তার মুখ পরিষ্কার দেখা যায়। কালো শার্ট প্যান্ট পরিহিত বলিষ্ঠ দেহের পুরুষটা আবার বাজিখাই গলায় ধমকে উঠে,

“ ছাড়তে বলেছি ওকে। “

আগত পুরুষের মুখ দেখেই হিরণ আরো হিংস্র হয়ে উঠে। একটানে বাণীকে নিজের সামনে ঢাল হিসেবে দাঁড় করিয়ে নিজের অতি শখের পিস্তলটা বের করে নেয়। চোখের পলকেই তা তাক করে বাণীর মাথার ডানপাশে। আগ্রাসী গলায় বলে উঠে,

“ আর এক পা সামনে আসবি না কুত্তার বাচ্চা। “

হিরণকে অনুসরণ করে ইবাতও নিজের পিস্তল বের করে সামনের মানুষটার দিকে তাক করে। দূর্জয় বিচলিত হয় না। একপলক বাণীর চেহারা দেখে দূর হতে নিশানা তাক করে হিরণের কপালের মাঝ বরাবর। ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠে,

“ নারীর পিছনে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করতে চাচ্ছিস। কাপুরষ কোথাকার। “

“ তুই মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়। চিনি তোকে। তোর সাথে ব্যক্তিগত হিসাব মেটানো বাকি আছে আমার। “

দূর্জয় আত্মবিশ্বাসের সুরে বলে,

“ অবশ্যই। হিসাবের হালখাতা খুলে বসবো। কোনো হিসাব বাকি রাখবো না। “

দূর্জয়ের কথা শেষ হতে না হতেই ইবাত পিছন থেকে ভীত স্বরে বলে,

“ স্যার, আমাদের ঘিরে ফেলেছে। “

হিরণ নিজের দৃষ্টি বুলিয়ে একবার দেখে চারিদিকটা। গলির দুই পাশে দুটো চারতলা বিল্ডিং রয়েছে। দুই বিল্ডিংয়ের ছাদে রাতের আঁধারে কিছু মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকেই স্পাইনার রাইফেলের নিশানা তাক করে রেখেছে হিরণ ও ইবাতের পানে। উপর পান থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখে গলির মাথা দিয়ে আরো ছয়জনের এক দল অস্ত্র হাতে দৌড়ে এগিয়ে আসছে। প্রত্যেকেই সেনা কর্মকর্তা। তাদের পোশাকই তাদের পরিচয় বহন করছে।

হিরণ হাসে। অদ্ভুৎ সেই হাসি। ফিসফিসিয়ে বাণীর কানের কাছে বলে,

“ এই মাত্র বুঝতে পারলাম আমি সন্তানদের থেকেও তোমাকে বেশি ভালোবাসি। নাহয় এই মুহুর্তে নিজের বন্দুকের একটা বুলেট তোমার শরীরে খরচ করতে দ্বিতীয় বার ভাবতাম না। অন্য কেউ হলে খুন করে ফেলতাম। “

বলেই বাণীকে ছেড়ে দেয় হিরণ। নিজের পিস্তলটা হাত থেকে ফেলে দেয়। আত্মসমর্পণ করে। করতে বাধ্য সে। অন্য কোনো পথ অবশিষ্ট নেই। বাণী ধীরপায়ে পিছু হটতে হটতে হিরণের থেকে দূরে সড়ে যায়। ইবাতের চোখে তখন অবিশ্বাস। এতো সহজে স্যার আত্মসমর্পণ করে দিলো? একটা বুলেটও ছুড়লো না এই অসভ্যদের দিকে?

হিরণ আত্মসমর্পণ করতেই এক মুহুর্ত অপেক্ষা করলো না সেনাদল। দ্রুত পায়ে দৌড়ে এগিয়ে আসে। হিরণ ও ইবাতকে আটক করে। হ্যান্ডকাফ পড়ায় পাপিষ্ঠ দু হাতে। হিরণ পুরোটা সময় নির্লিপ্ত দৃষ্টি মেলে বাণীর দিকেই তাকিয়ে রয়। চোখ ফেরায় না এক মুহুর্তের জন্য। বাণী একটা গাড়ির সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দেখে সেই দৃশ্য।

হাতের হ্যান্ডকাফে টান পড়তেই হিরণ মুখ খুলে। বাণীর চোখে চোখ রেখে স্বাভাবিক গলায় উচ্চারণ করে,

“ আমাদের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য নেই বাণী। তুমি নিজ হাতে আমাদের মধ্যের পার্থক্য মিটিয়ে দিয়েছো। “

হিরণের কথা উপস্থিত সবার কানেই পৌঁছায়। দূর্জয় সহ ছয় লেফটেন্যান্টের কেউই সেই কথার মর্মার্থ ঠাওর করতে পারে না। হিরণ এবার গলার স্বর আরেকটু উঁচু করে বলে,

“ তুমিও খুনী। আমি যদি অন্যের সন্তানের খুনী হই তাহলে তুমি নিজের সন্তানের খুনী। পাপ তুমিও করেছো। “

দূর্জয় চমকায়। বড়ো বড়ো চোখ মেলে বাণীর পানে তাকায়। বাণী নিরুত্তর রয়। কথাগুলো তার শরীরে কাঁটার মতো বিঁধছে। তার মাতৃস্বত্তা কেপে উঠে। হিরণ আবারও চেঁচিয়ে উঠে,

“ সন্তান হারানোর যন্ত্রণায় আমি একা ভুগবো না বাণী। তুমিও ভুগবে। কারণ যাকে তুমি মেরেছো ও তোমারও অংশ ছিলো। “

হিরণকে আর কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হয় না। লেফটেন্যান্টরা তাকে টেনে সেখান থেকে নিয়ে যায়। দূর্জয় ঘাড় ঘুরিয়ে একবার সেই দৃশ্য দেখে বাণীর দিকে ফিরে তাকায়। বাণী নিথর ভঙ্গিতে তখন দাঁড়িয়ে ছিলো গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে।

দূর্জয় ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। বাণীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শীতল স্বরে ডাকে। বাণী চোখ তুলে তাকায়। নিষ্প্রাণ গলায় বলে,

“ পাষাণ হয়েছি। অনাগত সন্তানকে খুন করেছি। আমিও এখন খুনী, তাই-না? “

কথাটা বলতে বলতে বাণী বোধশক্তি হারায়। দূর্বল দেহটা হেলে পড়তে নিলেই দূর্জয় এগিয়ে যায়। নিজের সংকোচ শিক্ত মন নিয়ে একহাতে আগলে ধরে। জীবনের সমীকরণ কঠিন সেই সম্পর্কে দূর্জয় অবগত। কিন্তু বাণী তালুকদারের জীবনের সমীকরণ গুলো কি একটু বেশি-ই এলোমেলো না?

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]