এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-৪৫+৪৬+৪৭

0
199

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৫.

কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে গন্তব্য স্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে সারিবদ্ধ ছয়টি সেনাবাহিনীর গাড়ি। তৃতীয় গাড়িটার ভেতর রয়েছে দু’জন আতঙ্কবাদী। ইতিমধ্যে সকল হেডকোয়ার্টারে খবর পৌঁছে গিয়েছে যে, এভার ভিউ রেস্টুরেন্ট এবং চট্টগ্রাম গার্লস মডেল কলেজে আতঙ্কবাদী হামলার মূল হোতা হিরণ এবং তার সাহায্যকারী ইবাত মোশতাক নামক দু’জনকে আজ রাত নয়টা নাগাদ চট্টগ্রাম শহরের এক মফস্বল এলাকা থেকে আটক করেছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

সেনাবাহিনীর সবুজ রঙা দ্বিতীয় গাড়ির ভেতর পিছনের দিকে মুখোমুখি বসে আছে ছয়জন লেফটেন্যান্ট। নজর তাদের তৃতীয় গাড়িটার পানে স্থির। সকলেই চোখ রাখছে চারিদিকে। এই দু’জনকে নিয়ে ঝামেলা বিহীন ভাবে একবার হেডকোয়ার্টারে পৌঁছাতে পারলেই সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে।

সাইফ নিচু গলায় বলে উঠে,

“ আমি আশা করি নাই যে এই শালা এতো সহজে সারেন্ডার কইরা দিবো। “

সাইফের কথার বিরোধিতা করে না কেউ। কারণ তারাও এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত। এতো বড় এক ক্রিমিনাল কিনা বিনা বুলেট খরচ করেই সারেন্ডার করে দিলো? এটা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? কে জানে!

রাফি নিচু গলায় বলে,

“ ওই লোকটা কি বলছিলো তখন? বাণী আপুকে নিজের সন্তানের খুনী বলছিলো। ওয়াজ শি প্রেগন্যান্ট? “

বাণীর জীবনের কালো অধ্যায় সম্পর্কে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা ও নিশা ব্যতীত ছয়জন লেফটেন্যান্টকেও অবগত করেছে দূর্জয়। জানাতে সে বাধ্য ছিলো। যারা ওতপ্রতভাবে এই মিশনের সঙ্গে জড়িত, যাদের সঙ্গে নিয়ে দূর্জয় বাণীকে উদ্ধার করেছে, তাদের কাছ থেকে এই সত্যটা লুকানো সম্ভব ছিলো না। আরো একটা কারণ হচ্ছে দূর্জয় ছেলে গুলোকে ভরসা করে। এতো মাস একসঙ্গে একটা মিশন পরিচালনা করতে গিয়ে সবাইকেই সে ধীরে ধীরে জেনেছে, বুঝেছে। এরা একেকজন ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে একেক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তবে যেই একটা বৈশিষ্ট্য সবার মধ্যেই আছে তা হলো বিশ্বস্ততা।

সাদাত গম্ভীর স্বরে বলে উঠে,

“ শি ইজ আনম্যারিড। আর ওই বাস্টার্ড এতো বছর উনাকে কিভাবে আটকে রেখেছিলো তা আমরা সবাই জানি। তাছাড়া উনি হচ্ছেন ভিক্টিম। আর একজন রেপ ভিক্টিমের সম্পূর্ণ রাইট আছে চাইলে প্রেগন্যান্সি টার্মিনেট করার। “

প্রত্যয় ভাবুক গলায় বলে,

“ উনার মেয়ে। বহ্নি। ওই বাচ্চাটাকে তো উনি ঠিকই ভালোবাসে। “

ফারদিন এবার সিরিয়াস স্বরে বলে,

“ গাইস। আই থিংক আমাদের এই ব্যাপারে ডিসকাস না করাই বেটার। কারণ ফার্স্ট অফ অল দিজ ইজ হার লাইফ। আর বাণী আপু যেই সিচুয়েশনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে সেই সম্পর্কেও আমাদের কোনো ধারণা নেই। উনার এরকম ডিসিশনের পিছনে নিজের পয়েন্ট অফ ভিউ থাকতেই পারে। এটা আমাদের ম্যাটার অফ কনসার্ন না। “

জুনায়েদ বলে উঠে,

“ আই এগ্রি। আর তাছাড়াও আমাদের এখন মেজরকে নিয়ে কথা বলা উচিত। উনি কি সুন্দর বাজিমাত মারলেন। “

বলে জুনায়েদ দাঁত বের করে হাসে। প্রত্যয় বলে,

“ এক্স্যাক্টলি! স্যারের প্ল্যান ওয়ার্ক আউট করে গিয়েছে। উনার বিশ্বাস ছিলো যে কখনো না কখনো হিরণ অবশ্যই বাণী আপু আর বহ্নির খোঁজে আসবেই। ভাগ্যিস উনি ২৪ ঘন্টা আড়াল হতে আপুর সেফটি ইনশিওর করার জন্য লোক নিযুক্ত করেছিলেন। নাহয় এই মুহুর্তে আমরা কখনই হিরণের আগমনের খবরটা পেতাম না আর ওর মতো রাস্কেলকে আটক করাও সম্ভব হতো না। “

সাইফ তাল মিলিয়ে বলে,

“ আই অলসো এপ্রিশিয়েট হিজ আইডিয়া। কিন্তু উনি কি শুধুমাত্র মিশনের খাতিরেই ওই লোককে নিযুক্ত করেছিলো নাকি এছাড়াও ব্যক্তিগত ভাবে আপুর সেফটি নিয়ে চিন্তিত ছিলো? “

সন্দিহান গলায় প্রশ্নটা ছুড়ে দিতেই পাঁচটা মুখ চোখ বড় করে সাইফের পানে তাকায়। প্রত্যয় বলে,

“ বুলশিট। স্যারকে আমরা চিনি না? উনার মন জুড়ে উনার চাকরি আর উনার কালো রঙের জিপ গাড়ির স্থান আছে শুধু। সেখানে কোনো নারীর এক্সেস পাওয়া অসম্ভব বিষয়। “

সাইফ হাই তুলে বলে,

“ সম্ভব বন্ধু, সবই সম্ভব। রাফির সাথে যেমন অন্যার বিয়েটা সম্ভব, ঝগড়াঝাটি ভাবীর সাথে যেমন তোর প্রেম হয়ে যাওয়াটা সম্ভব, তেমনই মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়ের মনেও কোনো নারীর এক্সেস পাওয়া সম্ভব। “

প্রত্যয় চোখ গরম করে তাকায়। সাইফ সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বলে,

“ গরীবের কথা বাসি হলেও ফলে। “

__________

বিছানায় শুয়ে বহ্নির সঙ্গে বিভিন্ন আকাশ কুসুম গল্পে মশগুল ছিলো নিশা। আচমকা ফোনের রিংটোনের শব্দ কানে ভেসে আসতেই সে নিজের ফোনটা হাতে নেয়। স্ক্রিনে সেভ করা নামটা দেখেই দ্রুত কল রিসিভ করে। ফোনের অপর পাশের মানুষটার বলা কথা শুনে দ্রুত উঠে বসে। কল কেটে ফোনটা বহ্নির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,

“ তুমি শুয়ে ফোনে গেমস খেলো। আন্টি একটু আসছি। ওকে? “

বহ্নি মাথা নেড়ে গেমসে মগ্ন হয়। নিশা দ্রুত ওড়নাটা গলায় জড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। মেইন দরজাটা খুলে সিঁড়ির পানে তাকায়। মিনিট দুয়েক পেরোতেই দেখে দূর্জয় উঠে আসছে। পাজাকোলে রয়েছে বাণী। নিশা আঁতকে উঠে। দূর্জয় ভাইয়া তাকে ফোন করে বলেছিলো শুধু এসে দরজা খুলে দাঁড়াতে। সঙ্গে যে বাণীও আছে আর তা-ও এই অবস্থায় তা তার ভাবনার বাহিরে ছিলো। দূর্জয় ততক্ষণে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠে আসে। জুতা পায়েই ঘরে প্রবেশ করে বাণীকে নিয়ে অপর বেড রুমটায় প্রবেশ করে। নিশাও পিছু পিছু আসে৷ চাপা স্বরে প্রশ্ন করে,

“ ভাইয়া, আপুকে কোথায় পেলে? কি হয়েছে? “

দূর্জয় বাণীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলে,

“ হিরণ এসেছিলো। “

নিশা ভীত স্বরে বলে,

“ হোয়াট! “

দূর্জয় এবার সরাসরি নিশার চোখে চোখ রেখে বলে উঠে,

“ লুক নিশা, আমি জানি লাস্ট কয়েক মাসে বাণী শুধুমাত্র তোমার সাথেই একটু স্বাভাবিক ভাবে মিশেছে। তাই সরাসরি তোমাকেই প্রশ্ন করছি। প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলে শুধু হ্যাঁ বা না হিসেবে উত্তর চাই। “

নিশা ভীত হয়। ভাইয়া হঠাৎ এতো সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা বলছে কেনো?

“ ওয়াজ বাণী এক্সপেক্টিং? “

নিশা অবাক হয়। তবে মিথ্যা বলে না।

“ হ্যাঁ। “

“ ও এবরশন করেছে? “

এবারও নিশা সত্যিটা বলে,

“ হ্যাঁ। “

দূর্জয় আর কোনো প্রশ্ন করে না। জানতে চায় না কোনো কারণ। নিশা নিজেই প্রশ্ন করে,

“ ভাইয়া, ওই লোকটা কি কোনোভাবে এই খবরটা জানতে পেরেছে? “

দূর্জয় নিজের ফোন বের করে কিছু একটা ম্যাসেজ পাঠাতে পাঠাতে মাথা নেড়ে শুধু হ্যাঁ বলে। নিশা সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে বলে,

“ লোকটা আপুকে দোষারোপ করেছে তাই-না? বাচ্চাটাকে মেরে ফেলার দোষ দিয়েছে তাই-না? কিন্তু আপু তো এবরশন করাতে বাধ্য ছিলো। উনার ফিজিক্যাল কন্ডিশন… “

বাকি কথাটুকু শেষ করতে পারে না নিশা। দরজায় বহ্নির উপস্থিতি দেখে নীরব বনে যায়। দূর্জয়ও ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার পানে তাকায়। বহ্নি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

“ মেজর? “

দূর্জয় নিশাকে ইশারায় বাণীর সাথে থাকতে বলে বহ্নির কাছে এগিয়ে যায়। কোলে তুলে নিয়ে সোজা চলে যায় বসার ঘরে। একটা সোফায় বসে বহ্নির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,

“ হাই। “

বহ্নি ভাবুক স্বরে প্রশ্ন করে,

“ মাম্মার কি হয়েছে? “

দূর্জয় বহ্নির কপাল ছুঁয়ে তাপমাত্রা পরখ করে বলে,

“ কিছু হয় নি। ঘুমোচ্ছে। “

বহ্নি মুখ কালো করে বলে,

“ আমি ভেবেছিলাম পাপা এসেছে। আবার মাম্মাকে মেরেছে। “

বহ্নির কথা শুনে দূর্জয়ের ভ্রু দ্বয়ের মাঝে ভাজ পড়ে। মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। সন্দিহান গলায় জানতে চায়,

“ মেরেছে? “

__________

চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীদের অধীনস্থ উচ্চ নিরাপত্তা সম্পূর্ণ বিশেষ এক সেলে স্থান হয়েছে হিরণের। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ রাতটা ওকে এখানেই রাখা হবে। আগামীকাল ইবাত সহ হিরণকে ঢাকায় সেনাবাহিনীর প্রধান প্রাণকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে।

ঢিলে হয়ে নিচে নেমে আসা শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গোটাতে গোটাতে সেই সেলের ভেতর প্রবেশ করে দূর্জয়। অঙ্গভঙ্গি বেশ স্বাভাবিক। রুমের ঠিক মাঝখানটায় মেঝেতে বসা পুরুষটাকে শান্ত দৃষ্টি মেলে দেখে। হিরণ চোখ তুলে তাকায়। অত:পর দাঁত কেলিয়ে হাসতে শুরু করে। কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে বলে,

“ আমি জানতাম তুই আসবি। “

দূর্জয় অত্যন্ত ভদ্রলোকের মতো রুমের এককোণ থেকে একটা চেয়ার টেনে হিরণের মুখোমুখি বসে। ফের শান্ত দৃষ্টি মেলে দেখে হিরণকে। হিরণ এবার হাসি বাদ দিয়ে নিজেও মুখভঙ্গি গম্ভীর করে। দূর্জয়ের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে,

“ বাণী ঠিক আছে? “

দূর্জয় শীতল গলায় বলে,

“ কিসের তৈরি তুই? আঘাত দিয়ে পরে মিছে মলম লাগানোর অভিনয় করে কি হাসিল করতে চাস? বাণীর মন? “

হিরণ নিঃশব্দে মৃদু হেসে বলে,

“ মিছেমিছি অভিনয় করে ওর মন পাওয়া গেলে আমি সেরা অভিনেতা হতেও পিছুপা হটতাম না। ট্রাস্ট মি। “

দূর্জয় এবার নিজের হাত ঘড়ি দেখতে দেখতে বলে,

“ আমি এখানে আসার পথে খুব ভেবেছি, যে তোর জন্য উপযুক্ত শাস্তি কি হতে পারে। তোর মতো একজন আতঙ্কবাদী, খুনী, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী, রেপিস্ট ও নিকৃষ্ট মানুষকে ঠিক কোন শাস্তিটা দিলে তোর বিচার হবে! ঠিক কোন শাস্তিটা দিলে ভিক্টিমদের সঙ্গে জাস্টিস হবে! কিন্তু বিশ্বাস কর, তোকে যদি আমি পৃথিবীর সবথেকে কষ্টদায়ক মৃত্যুদন্ডটাও দেই তবুও কোনো ভিক্টিমের এক তিল পরিমাণও ক্ষতিপূরণ হবে না। বাকি ভিক্টিমদের হিসাব আপাতত একপাশে রেখে না-হয় বাণীর কথাই বলি। হোয়াট ডু ইউ থিংক? তোর থেকে দূরে থেকে ও ভালো আছে? শি ইজ নট ওকে এট অল। একটা মৃত দেহ বয়ে বেড়াচ্ছে ও। কি বলছিলি তুই? ও তোর বাচ্চাকে খুন করেছে, তাই-না? তুই কি করেছিস? খুনী তো তুইও। বাণীকে খুন করেছিস। ইউ ডিস্ট্রোয়েড হার মেন্টালি। শুধু ডিস্ট্রোয় করে ক্ষান্ত হস নি, এই অসহনীয় জীবনের ভার ওকে বয়ে বেড়াতে বাধ্য করেছিস। স্টিল তুই ক্লেইম করিস ইউ লাভ হার? এভ্রিথিং ইউ ডিড টু হার ওয়াজ বিকজ অফ লাভ? টু হেল উইথ ইউ, এন্ড টু হেল উইথ ইউর লাভ। “

শেষ কবে একসঙ্গে এতগুলো কথা বলেছে দূর্জয়ের খেয়াল নেই। আপাতত সে সেসব দিকে খেয়াল করতেও চায় না। নিজের অতিমাত্রার রাগটাকে শীতলতার চাদরে মুড়িয়ে শান্ত স্বরে বলে,

“ ওহ। আমি হয়তো আসল কথা থেকে সরে আসছি। কথা হচ্ছিলো তোর শাস্তির হিসাব নিকাশ নিয়ে। তো বাণীর সাথে কিংবা সকল ভিক্টিমদের সাথে তুই যা করেছিস তার বিনিময়ে ওদের সকলকেই একটা লাইফ টাইম ট্রমা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এই-যে ওদের সকলকে যেই ট্রমাটা দিয়েছিস না তুই, এর বিনিময়ে তোর একমাত্র যোগ্য শাস্তি হলো সেম মেন্টাল ট্রমা। কারণ মৃত্যু তোর জন্য কোনো শাস্তি নয়, প্রতিদিন একটু একটু করে মানসিক যন্ত্রণায় ধুকে ধুকে মরাটাই তোর জন্য সবথেকে বড়ো শাস্তি। আর এই শাস্তির শুরু কোথা থেকে জানিস? বহ্নির মাধ্যমে। শি হেটস ইউ। ওর কাছে তুই একটা এবিউসার ছাড়া আর কিছুই না। যদিও এতো ছোট একটা বাচ্চার জন্য এবিউজিং শব্দের ভার বওয়াটা কষ্টকর। কিন্তু ও খুব সুন্দর করেই বুঝে গিয়েছে যে তুই ওর মাম্মার এবিউজার। চিন্তা করিস না। আপাতত তোকে ঘৃণা করার জন্য ওর এতটুকু জানাই যথেষ্ট। বড় হতে দে ওকে। বুঝতে শিখুক। তখন ও সম্পূর্ণ সত্যটা জানবে। জানবে যে তোর এই গুড ফাদার ইমেজের পিছনে কি ভয়ংকর একটা পরিচয় লুকিয়ে ছিলো! কেমন হবে যখন ও জানবে যে তুই ওর মাম্মা’র রেপিস্ট? “

হিরণের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। দুই চোখ ঠিকরে ক্রোশ ও আক্রোশ ঝড়তে থাকে। উত্তেজিত হয়ে বলে,

“ কিচ্ছু জানবে না আমার মেয়ে। কিচ্ছু না। “

“ অবশ্যই জানবে। “

দূর্জয় খেয়াল করে হিরণের শরীর মৃদু কাঁপছে। কপালের শিরা ফুলে কেমন দপদপ করছে। সম্ভবত রাগে। হাত দুটো হ্যান্ডকাফ দিয়ে পিঠের পিছনে নিয়ে আটকানো। পা দুটোও এক জোড়া শক্ত শিকল দ্বারা বাঁধা। সেজন্যই বোধহয় রাগ মেটানোর পথ খুঁজে পাচ্ছে না। হিরণ মেঝেতে অনেকটা দ আকৃতির মতো করে বসে ছিলো। চোখ জোড়া বুজে সে সামনের দিকে উবু হতেই তার মাথা গিয়ে ঠেকে হাঁটুর সঙ্গে।

দূর্জয় নীরবে দেখে সে-ই দৃশ্য। জায়গা মতো আঘাত করেছে সে। পাচ্ছে। শয়তানটা মানসিক যন্ত্রণা পেতে শুরু করেছে। আগুনে ঘি ঢালতে দূর্জয় বলে উঠে,

“ এতো গুলো পরিবারের সুখ নষ্ট করে ভেবেছিলি নিজের পরিবার গড়তে পারবি? এতো সহজ? তোর মতো মানুষ পরিবারের সুখ ডিজার্ভ করে না। তুই একা ছিলি, একা আছিস আর আজীবন একাই থাকবি। “

নিজের কথাটুকুর ইতি টেনেই দূর্জয় উঠে দাঁড়ায়। প্রস্থানের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় ঠিক সেই মুহুর্তে হিরণ শীতল গলায় বলে,

“ দেশের সাহসী সৈন্য দেশের চিন্তা কর, শেষ হামলা রুখে দেওয়ার প্রস্তুতি নে। “

দূর্জয়ের ভ্রু দ্বয়ের মধ্যে ভাজ দেখা যায়। সে পিছু ফিরে তাকায়। হিরণ ঠোঁট বাকা করে হাসে,

“ কি মনে হয়? মানসিক যন্ত্রণা শুধু তুই-ই দিতে পারিস? আমার দেওয়া যন্ত্রণার ভার বইতে না পেরে মানুষ পাপের বাপ ডাকে আমাকে। অন্যের সন্তান নিয়ে মাথা না ঘাটিয়ে মস্তিষ্কটাকে একটু খাটা। ভাব, শেষ হামলাটা কোথায়, কখন এবং কিভাবে হবে। ভাব আর মাথার চুল ছিঁড় শালা। “

দূর্জয়ের ধৈর্য্যের বাধ ভাঙ্গে। সে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে নিজের শক্তপোক্ত হাতে সজোরে হিরণের গালে একটা চড় বসায়। ডান কানটা সঙ্গে সঙ্গে যেনো ঝিম ধরে যায় হিরণের। তবুও সে অদ্ভুৎ ভঙ্গিতে নির্লজ্জের মতো হাসতে থাকে। বোকা বাঘের দল। হিরণ কি এতটা কাঁচা খেলোয়াড়? সে জানতোই ভালো যে তার ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু বাণীর সাথে মুখোমুখি না হলেও সে শান্তি পেতো না। তাইতো সব ব্যবস্থা করে রেখেই সে এসেছে। দেখুক লোকে, জানুক লোকে। হিরণকে বন্দী করেও তারা এই দেশের বুকে আরেকটা হামলা থামাতে পারবে না।

__________

রাত্রির শেষ প্রহর তখন। অন্ধকারে নিমজ্জিত গোটা ঘরটা। পাশের রুমে নিশা ও বহ্নি একসঙ্গে ঘুমোচ্ছে। বাণী একা এই রুমটায় অন্ধকারের মাঝে বসে আছে। বিছানার হেড সাইডটায় ওর পিঠ ঠেকে আছে। তার হুশ ফিরেছে দূর্জয় যাওয়ার ১০/১৫ মিনিট পরেই। তারপর থেকে বহ্নি আর নিশা এক দন্ড তাকে একা ছাড়ে নি। কিন্তু ওরা ঘুমিয়ে পড়তেই এই অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে শুরু করেছে। কানের কাছে বাজছে হিরণের বলা কথাগুলো।

মনে পড়ে যায় নিজের প্রেগন্যান্সির নিউজ জানতে পেরে ওর অনুভূতি। আর দশটা সাধারণ নারীর মতো বাণী খুশি হতে পারে নি বাচ্চাটার অস্তিত্বের কথা জানতে পেরে। কেমন যেনো অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছিলো নিজেকে। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না। নির্লিপ্ত ছিলো।

কিন্তু তার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ হয়ে যায় যখন ডক্টর তাকে জানায় ওর ফিজিক্যাল কন্ডিশন এই বেবি ক্যারি করার মতো স্ট্যাবল নয়। আর যদি বাণী এই প্রেগন্যান্সি কন্টিনিউ করতেও চায় তবে এতে তার লাইফ রিস্কে রয়েছে। বাণী নিশ্চুপ ছিলো সেই মুহুর্তে। এটা সত্য যে আগে তার নিজের জীবনের প্রতি কোনো মায়া ছিলো না। কিন্তু এখন আছে। নিজের জন্য না বরং নিজের মেয়ের জন্য। বহ্নি আছে। ওই বাচ্চাটার জন্য হলেও তাকে বেঁচে থাকতে হবে। নিজের মেয়েকে কারো ভরসায় রেখে মরার ফুরসতটাও বাণীর হাতে নেই।

তাই সে ডক্টরের কথা মেনে নিয়েছিলো। এবরশন করাতে রাজি হয়ে যায়। এই পুরোটা সময় বাণী অনুভূতিহীনের ন্যায় আচরণ করলেও মাইনর ওটির রুমটায় আর শান্ত থাকতে পারে নি। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে সে। বারবার নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিলো। মহিলা ডাক্তারটা খুব অমায়িক ছিলো বিধায় মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করেছিলো ওই পরিস্থিতিতে।

হিরণের মুখোমুখি অবস্থায় তখন ওইভাবে বাণীর কথাগুলো বলার একটাই কারণ ছিলো। তা হলো হিরণকে কষ্ট দেওয়া। কিন্তু হিরণের বলা কথাগুলো বাণীর ক্ষতে লবণ ছিটানোর মতো কাজ করেছে। অপরাধবোধ আবার পিষ্ট করে দিচ্ছে তাকে। চারপাশটা কেমন অসহায় লাগছে হুট করেই। বাণীর খুব মন চাচ্ছে এই মুহুর্তে আবারও হাউমাউ করে কাঁদতে। পৃথিবী সমান দুঃখগুলো নিজের আত্ম চিৎকারে ভাসিয়ে দিতে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। চাইলেও বাণীর কেঁদে বুক ভাসানোর অনুমতি নেই।

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৬.

সকাল সকাল অনাকাঙ্ক্ষিত নাম্বার থেকে কল পেতেই প্রত্যয় ভ্রু কুচকে স্ক্রিনের পানে তাকায়। ফোনটা একবার রিং হয়ে নিশ্চুপ হয়ে যেতেই পরক্ষণে আবার চিৎকার করে বেজে উঠে। প্রত্যয় এবার অনেকটা বাধ্য হয়েই ফোন রিসিভ করে কানে ধরে বেরস সুরে বলে উঠে,

“ হ্যালো। “

প্রত্যয় ঠিক যতটা বেরস গলায় হ্যালো বলেছে ঠিক ততটাই কণ্ঠে মধু মিশিয়ে অপর পাশের মানুষটা বলে উঠে,

“ গুড মর্নিং। “

প্রত্যয়ের ভ্রু জোড়ার মধ্যিখানে ভাজটা আরো গভীর হয়। সে চোখ মুখ কুচকে ফোনটা চোখের সামনে ধরে আরো একবার নামটা দেখে নেয়। সে কি ভুল দেখছে নাকি ভুল শুনছে? গালিগালাজের মুখ থেকে সকাল সকাল মধু ঝরছে? রহস্য কি? প্রত্যয় ফোন কানে ধরে অভ্যাসবশত সুরে বলে,

“ কি সমস্যা? “

অপর পাশের ব্যক্তিটি কণ্ঠস্বর এবার আরো নমনীয় করে শুধায়,

“ শুনো না, আম্মু বলছে আজ সন্ধ্যায় তোমাকে বাসায় আসতে। রাতের ডিনারটাও আমাদের সাথে করে যেতে। তুমি কি ফ্রি আছো? “

প্রত্যয় প্রশ্ন করে,

“ বিশেষ কোনো কারণ? “

“ আজ আমার জন্মদিন। এই ছোট বিষয়টাও তোমার মনে নেই? “

প্রত্যয় অবাক হয়। এই ছোট বিষয় নামক তথ্যটা কি আসলেই তার মনে রাখার কথা ছিলো? উহু। প্রত্যয়কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জেসি নিজেই বলে উঠে,

“ দেখলে আম্মু? একটা সামান্য বার্থ ডেট মনে রাখতে পারছে না আর এর সাথে নিজের সম্পূর্ণ লাইফ আমি স্পেন্ড করবো? অসম্ভব! “

অভিযোগের সুরে কথাটুকু উচ্চারণ করে জেসি ফোন কাটে। প্রত্যয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার মানে ওই মধুর সুরে কথা বলাটা সম্পূর্ণ নাটক ছিলো। আন্টি সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো বিধায় এই গালিগালাজের কণ্ঠে এতো নম্রতা এসে ভর করেছিলো। কি চতুর মেয়ে! সুযোগে প্রত্যয়কে বিয়ের জন্য অযোগ্য ক্যান্ডিডেটও প্রমাণ করে দিলো।

ভাবনা ছেড়ে উঠতে না উঠতেই আবারও শব্দ তুলে প্রত্যয়ের ফোনটা বেজে উঠে। এবার আর জেসি নয় বরং প্রত্যয়ের মা জননী ফোন করছে। প্রত্যয় কল রিসিভ করতেই তার মা’য়ের প্রথম প্রশ্ন হলো,

“ বাবা কি আজ সন্ধ্যার পরে ফ্রি আছো? “

“ সকাল থেকে সবাই এই এক প্রশ্ন কেনো করছো? “

“ আসলে হয়েছে কি, আলাউদ্দিন ভাই আর ভাবী কল করেছিলো আমাদের গতকাল। জেসির জন্মদিন উপলক্ষে দাওয়াত দিতে। তোমাকেও নাকি গতকাল কয়েকবার ফোন করেছে। কিন্তু তুমি সম্ভবত ব্যস্ত ছিলে। আমাদের এই মুহুর্তে চট্টগ্রাম যাওয়া তো সম্ভব নয়। তুমি না-হয় গিয়ে দাওয়াতটা রক্ষা করলে। আর যাওয়ার সময় জেসির জন্য ভালো কিছু উপহারও নিও। “

প্রত্যয় খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলে,

“ এতো বড় একটা মেয়ের জন্মদিন নিয়ে এতো আদিখ্যেতা করার কি আছে? আর আমি কি কোনো মর্নিং টু ইভিনিং জব করি যে সন্ধ্যার পরে আমি ফ্রি থাকবো? উনারা কি আমার প্রফেশনটা সম্পর্কে জানেন না? “

নিজের কথাটুকু শেষ করেই ফোনটা কেটে দেয় প্রত্যয়। সদ্য জগিং শেষ করে একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে ছিলো সে। উঠে দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরতেই মুখোমুখি হয় সাইফের। সাইফ সরু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ কার সাথে কথা বলছিলি? “

প্রত্যয় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ আম্মুর সাথে। “

কথাটুকু বলতে দেরি, সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যয়ের পিঠে স্বশব্দে একটা শক্ত হাতের চাপড় পড়ে। প্রত্যয় ভ্রু কুচকে চাপা আর্তনাদ করে উঠে। বিরক্ত মিশ্রিত স্বরে বলে,

“ মারছিস কেন? “

“ শালা মা আছে তো তাই মা’য়ের কদর বুঝস না। তুই আন্টির সাথে এই টোনে কথা বলতেছিলি? এত বছর আর্মিতে থেকেও ন্যূনতম ডিসিপ্লিন শিখলি না। তোদের মতো পোলাদের এভাবেই কিল ঘুষি মাইরা ডিসিপ্লিন শিখানো উচিত। “

সাইফের কথার পিঠে প্রত্যয় নীরব রয়। মাথা নিচু করে ফেলে। হঠাৎই খুব বড়ো একটা রিয়েলিটি চেক পেলো সে। আসলেই তো! সাইফ পরিবারহীন বলেই হয়তো পরিবারের গুরুত্ব এতো ভালো করে বুঝে!

প্রত্যয়কে চুপ থাকতে দেখে সাইফ প্রসঙ্গ বদলে বলে,

“ বাই দ্যা ওয়ে সকাল সকাল তোর মেজাজ এতো হট কেনো? “

প্রত্যয় পুরো ঘটনা খুলে বলতেই সাইফ বলে,

“ আরে বলদ! চার মাস পরে দুইজন দুইজনকে বিয়ের জন্য রিজেক্ট করবি ভালো কথা। কিন্তু তুই নিজে অযোগ্য প্রমাণিত হয়ে কেনো রিজেক্টেড হবি? ইজ্জত বলতে কিছু নাই নাকি তোর? “

প্রত্যয় ভ্রু কুচকে বলে,

“ তাহলে কি করবো? “

“ নিজের প্রেস্টিজ ঝগড়াঝাটি ভাবীর হাতে ছেড়ে না দিয়ে রক্ষা কর। নিজেকে অযোগ্য প্রমাণ করিস না। চার মাস পরে পুরো দোষ ঝগড়াঝাটি ভাবীর উপরে চাপিয়ে দিয়ে এনগেজমেন্ট অমত জানিয়ে দিবি। ফিনিশ। “

সাইফের কথা শুনে প্রত্যয় ভাবুক হয়। আসলেই তো! ওই গালিগালাজ মেয়েটার হাতে নিজের ইজ্জত এভাবে ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না। প্রত্যয়েরই কিছু একটা করতে হবে। নাহয় ওই মেয়ে প্রত্যয়ের নামের পাশে একশো একটা গালি বসিয়ে তার প্রেস্টিজ নিলামে তুলবে।

প্রত্যয়কে ভাবুক হতে দেখে সাইফ মনে মনে কিঞ্চিৎ হাসে। পোলাডা আসলেই বলদ! নাহয় কি এতো সহজে সাইফের কথায় ভাবনায় ডুব দিতো? এই সেম ভাবনার বীজ এখন ঝগড়াঝাটি ভাবীর মাথায় রোপণ করতে পারলেই কেল্লাফতে। এই দুইজনের নিজেকে যোগ্য প্রমাণের চক্করে প্রেমটা আপনাআপনিই হয়ে যাবে। তারপর আর কি? এদের বিয়েতে মুরগির লেগ পিসে সাইফ কামড় বসাতে বসাতে দোয়া করে দিবে দুটো বাচ্চাকাচ্চা ফুটিয়ে যেনো এরা সুখী থাকে। চারটা হলেও মন্দ হয় না!

__________

পুলিশের আওতায় রিমান্ড যতটা না ভয়ংকর তার থেকেও ভয়ংকর সেনাদের আওতায় রিমান্ডে যাওয়াটা। সেই রিমান্ডে করা টর্চারের ফলস্বরূপ অপরাধীদের করা ভয়ংকর চিৎকার যেকোনো সাধারণ মানুষের গায়ে কাটা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু অপরাধীরা কাল বৈশিষ্ট্য ভেদে ভিন্ন ভিন্ন দলের অন্তর্ভুক্ত। এদের মধ্যে একদল হলো বেহায়া ধরনের। এই বেহায়া জাতের অপরাধীরা ধরা পড়ার পরও এদের মধ্যে ভয় কিংবা কোনো চিন্তা কাজ করে না। ইবাতও সেই গোত্রের অংশ। রিমান্ডে আনার পর থেকে কেমন বেহায়া ধরনের হাসি মুখে লেপ্টে রেখেছে। কোনো আঘাতের বিপরীতে একটাও কথা পেট থেকে বের করছে না।

শীতের আমেজে মোড়ানো দুপুর তখন। সবুজ এবং খাকি রঙের মিশেলের ইউনিফর্ম পরিহিত দূর্জয় ভুতুড়ে ধরনের সেলে প্রবেশ করতেই আহত ইবাত চোখ তুলে তাকায়। এতক্ষণ ধরে সেলে উপস্থিত থাকা জুনায়েদ ও ফারদিন সঙ্গে সঙ্গে এককোণে সড়ে দাঁড়ায়। স্যারের ইশারা পেতেই তারা সেল থেকে বেরিয়ে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু দূর্জয় তাদের বেরিয়ে যেতে বললো না। বরং সরাসরি ইবাতের সামনে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট গলায় বলে,

“ সোজা সাপ্টা প্রশ্ন করবো। সোজা সাপ্টা উত্তর চাই। এক প্রশ্ন দ্বিতীয় বার রিপিট করবো না। “

জুনায়েদ ও ফারদিন আড়চোখে একবার স্যারকে দেখে। গতকাল রাত থেকেই স্যারের মেজাজ বিগড়ে আছে। এই চামচা যদি এখন স্যারের মেজাজ আরো বিগড়ে দেয় তাহলে স্যার এর কি অবস্থা করবে আল্লাহই জানে!

“ হিরণের নেক্সট টার্গেট কোথায় এবং কবে? “

ইবাত নিজের বিচ্ছিরি হাসি বহাল রেখে বলে,

“ ভুল মানুষকে ভুল প্রশ্ন করছেন মেজর। আমি বিশ্বাসঘাতক না। যার নুন খেয়েছি তার প্রতি বিশ্বস্ত আমি। পুরো দুনিয়া স্যারের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও আমি কখনো করবো না। এজন্যই আমাদের পাপের জগতে স্যারের নামের সাথে একমাত্র আমার নাম উচ্চারিত হয়। হিরণ ও ইবাত… “

পুরো কথাটা শেষ করার সুযোগ পায় না ইবাত। তার পূর্বেই একটা সিমেন্টের ন্যায় শক্ত হাতের চড় এসে বসে তার ডান গালে। আহত ইবাত আগে থেকেই দূর্বল ছিলো। এই শক্ত চড়ের ভার বইতে না পেরে সে মুহুর্তেই জ্ঞান হারায়।

ফারদিন নিচু গলায় বলে,

“ স্যার আর আধঘন্টার মধ্যে হেলিকপ্টার এসে পৌঁছে যাবে। “

দূর্জয় বেরিয়ে যাওয়ার আগে শুধু বলে,

“ বরফ ঠান্ডা পানিতে চুবিয়ে রাখো। জ্ঞান ফিরে যাবে। “

দূর্জয়ের কথা শুনে জুনায়েদের ঠোঁটের কোণে মিহি হাসি এসে ভীড় করে। শীতকালে কাউকে ঠান্ডা পানিতে চুবাতে পারার মধ্যে একটা পৈশাচিক আনন্দ আছে। আর সেই কেউটা যদি এরকম নেড়ি কুকুর হয় তাহলে আনন্দের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যায়।

__________

ইবাত ও হিরণকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ আছে দুটো হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টারে উঠার ঠিক আগ মুহুর্তে দূর্জয়ের মুখোমুখি এসে থামে হিরণ। মুখে তার অদ্ভুৎ শিসের সুর। ঠোঁটের কোণে হাসি। দূর্জয় নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে রয়। আচমকা হিরণ মুখ কিছুটা সরু করে বলে উঠে,

“ বুমম! “

অত:পর হাসতে হাসতে হেলিকপ্টারের দিকে এগিয়ে যায়। ক্রিমিনালবাহী হেলিকপ্টার দুটো আকাশ পথে যাত্রা শুরু করতেই দূর্জয় জুলফিকারের দিকে তাকায়। অত:পর তাকায় উপস্থিত বাকি সকলের পানে। সকলের মুখই কালো হয়ে আছে। এইমাত্র যেনো হিরণ তাদের সঙ্গে মশকরা করে গেলো।

মশকরা নয়তো কি? একজন টেরোরিস্ট, যে কিনা সৈন্যদের কাছে আটক, সে কিনা জেলের ভেতর আটক থেকেও দেশে আরেকটা ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য প্রস্তুত।

__________

ঠিক সন্ধ্যা নাগাদ কলিংবেলের শব্দ পেতেই বাড়ির বড়ো ছেলে দৌড়ে গেলো দরজা খুলতে। শার্ট প্যান্ট পরিহিত ভদ্র বেশে প্রত্যয়কে দেখতেই হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে ভেতরে আসার তাড়া দিলো। প্রত্যয় মুখে ভদ্রতাসূচক হাসি বজায় রেখে লিভিং রুমে প্রবেশ করতে করতে বলে,

“ ভালো আছেন ভাইয়া? “

জেসির বড়ো ভাই জাঈদ হেসে বলে,

“ আলহামদুলিল্লাহ। “

ততক্ষণে লিভিং রুমে এসে উপস্থিত হয় আলাউদ্দিন সাহেব, তার স্ত্রী এবং জাঈদের বউ চারু। প্রত্যয় সবার সাথে কুশল বিনিময় করে লিভিং রুমের সোফায় বসে। সঙ্গে করে আনা বিশাল ফ্লাওয়ার বুকেটা জাঈদের সাত বছরের ছেলে আকাশের হাতে তুলে দিতেই বাচ্চাটা বুকে হাতে নিজের ছোট ফুপ্পির রুমের দিকে দৌড়ে যায়।

আলাউদ্দিন সাহেবের তিন ছেলে মেয়ে। জাঈদ, জাহানারা, জেসি। বড়ো ছেলে আর ছোট মেয়েকে নিয়ে তিনি নিজের এই এপার্টমেন্টটায় থাকেন। বড়ো মেয়ে স্বামীর সঙ্গে দেশের বাহিরে থাকেন। বহু মাস হয়ে গিয়েছে দেশে আসার সুযোগ পাচ্ছে না। তবে ঠিক করে রেখেছে জেসিটা একবার বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেলেই তার এনগেজমেন্টর এক সপ্তাহ আগে দেশে এসে উপস্থিত হবে।

প্রত্যয় যখন আলাউদ্দিন সাহেব এবং জাঈদের সঙ্গে আলাপে মশগুল তখন জেসি ফুলের বুকে হাতে লিভিং রুমে এসে উপস্থিত হয়। বিস্ফোরিত দৃষ্টি তার। প্রত্যয় তাকে দেখে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,

“ হাই। হ্যাপি বার্থডে। বুকে পছন্দ হয়েছে? “

ভদ্র ছেলেটার ভদ্রতা সহিত করা প্রশ্নে আলাউদ্দিন সাহেব গদগদ হয়ে উঠেন। তার মন গেয়ে উঠে,

“ সুপাত্র! সুপাত্র! “

জেসি নিজের বিস্ময়তাটুকু চেপে গিয়ে হাসি মুখে বলে,

“ আমি ভেবেছিলাম তুমি ব্যস্ত থাকবে। আসবে না। “

“ ব্যস্ততা তো জীবনেরই অংশ। তাই বলে তোমার লাইফের ইম্পোরট্যান্ট একটা ডে মিস করবো? “

জেসির পুরো মুখ রাগে লাল হয়ে যায় মুহুর্তে। কুত্তাটার মতলব কি? এমন চিজি লাইন কেনো ছাড়ছে? আব্বু আর ভাইয়ার সামনে জেসিকে কাবু করতে চাইছে?

জেসি মুখ ফুলিয়ে নিজের রুমে ফেরত যায়। বিছানায় বসে কিছুক্ষণ কিছু একটা ভাবে। অত:পর ফ্লোরে রোবো কার নিয়ে খেলতে ব্যস্ত নাদুসনুদুস আকাশকে কাছে ডেকে বলে,

“ লিভিং রুমে গিয়ে ওই আংকেলকে ডেকে নিয়ে আয় তো। বলবি না আমি ডেকেছি। নিজের কথা বলে ডেকে আনবি। “

আকাশ সরু চোখে কিছুক্ষণ জেসিকে দেখে বলে,

“ তুমি আমাকে মিথ্যা বলা শিখাচ্ছো ছোট ফুপ্পি? “

জেসি ধমকে বলে,

“ কানের নিচে একটা দিবো আমার সত্যবাদীর বাচ্চা। চুপচাপ যা বলেছি তা কর। “

আকাশ সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যয়কে ডাকতে চলে যায়। ছোট ফুপ্পির কোনো ভরসা নেই। দেখা গেলো সত্যি সত্যিই আকাশের দু কানের নিচে তবলা বাজানো শুরু করে দিলো।

মিনিট পাঁচেকের প্রত্যয়কে সহ রুমে এসে উপস্থিত হয় আকাশ। ঠোঁট উল্টে বলে,

“ আংকেলকে ডেকে এনে দিয়েছি। এখন আমাকে সালামি দাও ছোট ফুপ্পি। “

জেসি চোখ রাঙিয়ে বলে,

“ দুই ঈদে যে আমার সালামিতে ভাগ বসাস সেটা যথেষ্ট না মোটু? একদম চুপচাপ বসে খেল এখন। কেউ আসলে আমাকে ডাক দিবি। “

বলেই প্রত্যয়ের হাত ধরে টেনে তাকে বারান্দায় নিয়ে যায়। প্রত্যয় বিরক্ত মিশ্রিত গলায় বলে,

“ বাচ্চাদের সাথেও এতো রুড তুমি? “

জেসি প্রত্যয়ের কথায় পাত্তা না দিয়ে তাকে রেলিঙের দিকে ঠেলে দাঁড় করিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্ন করে,

“ এইযে গলির মোড়ের শাকিব খান। তোমার শয়তানি পেটে কোন খিচুড়ি পাকাচ্ছো, আমাকে বলো। মতলব কি, হ্যাঁ? “

প্রত্যয় বিরক্ত হয়। এই পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চের মেয়ে তাকে রেলিঙে ঠেলে ভয় দেখাতে চাচ্ছে এই ব্যাপারটা আরো বিরক্তিকর। সে বেরস গলায় বলে,

“ এসব আজগুবি কথা বলার জন্য তুমি কি আলাদা কোনো কোর্স করেছো? “

“ কথা ঘুরাবে না একদম। তুমি আমার বাসায় কি করছো? আমার বার্থডে নিয়ে তোমার আগ্রহ জেগেছে কবে থেকে? “

প্রত্যয় এবার উল্টো ঘুরে জেসিকে রেলিঙের দিকে ঠেলে দিয়ে বলে,

“ তুমি কি ভেবেছিলে, আমাকে সবার সামনে অযোগ্য প্রমাণ করে, সেই এক্সকিউজ দেখিয়ে তুমি বিয়েতে অমত করবে? আর আমি তা বসে বসে দেখবো? “

মুহুর্তেই জেসির কলিজা ধক করে উঠে। খোলা রেলিঙের এই নয় তলা বারান্দা থেকে ভুল করেও পরে গেলে সে সোজা ইন্না-লিল্লাহ হয়ে যাবে। কুত্তাটা কি তাকে হার্ট এট্যাক দিয়ে মারতে চায় নাকি? প্রত্যয় নিজ থেকেই আবার বলে উঠে,

“ আই ওন্ট লেট দ্যাট হ্যাপেন। “

“ তাই বলে আজকের দিনে নিজের এই কুত্তামার্কা চেহারা নিয়ে আমার সামনে হাজির হয়ে আমার দিনটা নষ্ট করবে তুমি? “

প্রত্যয়ের মেজাজ বিগড়ে যায়। তার ভদ্র সুপুরুষ গড়নের চেহারাকে কিনা কুকুরের সাথে মিলালো? এই মেয়ের সাথে তর্কে জড়ানো মানে আরো একশোটা গালি খাওয়া। নিজের ইজ্জতের মায়া করে প্রত্যয় গম্ভীর স্বরে বলে,

“ আর দেখতে হবে না এই চেহারা। চলে যাচ্ছি কাল। আশা করছি তোমার সকাল, দুপর, রাত সুন্দর কাটবে আগামীকাল থেকে। “

আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না প্রত্যয়। প্রস্থান করে। জেসিও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচে। পরমুহুর্তেই তার মনে পড়ে প্রত্যয়ের এই মাত্র বলে যাওয়া কথা। যাবে মানে? কোথায় যাবে? নিজের উৎসুক হাবভাব দেখে জেসি নিজেকেই গালি দেয়। এই ছেলে জাহান্নামে যাক। তার কি আসে যায়?

__________

হেডকোয়ার্টার থেকে পিতৃ নিবাসে ফিরছে দূর্জয়। সুঠাম হাতটা গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে নিবদ্ধ। অদ্ভুৎ এক রজনী! আকাশে চাঁদের অস্তিত্ব নেই। চারিদিকটা কেমন অন্ধকার। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় যা একটু আলোকিত হয়ে আছে। মধ্য পথে আচমকা তার গাড়ির গতি ধীরে ধীরে কমে আসে। একটা পর্যায়ে সম্পূর্ণ থেমে যায়। সে গাড়ির জানালা ভেদ করে দৃষ্টি স্থির করে রাস্তার অপর পাশের দালানটার দিকে। তিন তলার বাম পাশের ইউনিটের বারান্দায় তাকিয়ে মনে মনে কিছু একটা ভাবে।

তার ব্যক্তিগত গুপ্তচর খবর দিয়েছে বাণী আজ স্কুলে গিয়েছিলো। দেখতে খুব স্বাভাবিকই নাকি লাগছিলো। কিন্তু দূর্জয়ের সাব-কনশাস মাইন্ড বলছে বাণী ঠিক নেই। তুফান চলছে মেয়েটার ভেতর। কিন্তু সেই তুফান সে ভিতরে চেপে রেখেছে। দেখানোর মতো মানুষ নেই বলেই কি? যদিও এখন আর বাণীর উপর হয়তো নজর রাখার জন্য গুপ্তচরের প্রয়োজন নেই। কিন্তু তবুও দূর্জয় রিস্ক নিচ্ছে না। গতকাল বহ্নির মুখে যা শুনেছে তার পরে তো আরো আগে না।

দূর্জয়ের ভাবনার মাঝেই অন্ধকার বারান্দাটায় উপস্থিত হয় এক নারী কায়া। দূর হতে দেখেই বুঝা যাচ্ছে তার কোলে ছোট বাচ্চা মেয়েটা মিশে আছে। হয়তো ঘুমোচ্ছে। সেই নারী অবয়বটা ধীর গতিতে বারান্দা জুড়ে পায়চারি করতে থাকে। দূর্জয় আচমকা দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। মেয়েটা আজকাল তাকে পথের মাঝে থামতে বাধ্য করছে। এ কেমন দাপুটে অধিকারবোধ?

আচমকা দূর্জয়ের চিন্তা হয়। আগামীকাল তার টিম সহ ঢাকা যেতে হবে। জুলফিকার মুজতবাও তাদের সঙ্গে যাবে। কবে ফিরবে নিশ্চয়তা নেই। বিশাল একটা বিপদ অপেক্ষা করছে সামনে। কিন্তু কোথায়, কখন, কিভাবে অপেক্ষা করছে তা জানা নেই দূর্জয়ের। এই ক’দিন এই দুটো মানুষ নিরাপদ থাকবে তো আদৌ? হুট করেই দূর্জয় দেশের পাশাপাশি এই দুটো মানুষের নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তিত হয়। একদম হুট করেই।

__________

অনেকটা চোরের মতোই আব্বুর চোখ ফাঁকি দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে নিশা। পড়নে তার বাসার একটা টপস আর স্কার্ট। ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া পেরিয়ে কিছুটা দূরে আসতেই একটা রিকশায় চড়ে বসে সে। চলে যায় বায়েজিদ সবুজ উদ্যানের সামনে। ভাড়া মিটিয়ে রিকশা থেকে নেমে সে আশেপাশে উৎসুক দৃষ্টি মেলে তাকায়। সে জানে না সে এখানে এই রাতের বেলা কেনো এলো। কিন্তু সাইফের জরুরি তলবকে সে সম্পূর্ণ এড়িয়েও যেতে পারে নি।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা রিকশায় চড়ে সেখানে উপস্থিত হয় সাইফ। গায়ে তার সাদা রঙের একটা শার্ট। ভাড়া মিটিয়ে রিকশা থেকে নামতেই নিশা বলে,

“ আমি ভেবেছিলাম আপনি আগে থেকেই এখানে উপস্থিত আছেন ভাইয়া। “

সাইফ এক পলক দেখে নিশাকে। তার বলতে ইচ্ছে করে সে নিশার পিছন পিছন অন্য রিকশায় করেই এসেছে। এই রাতের বেলা নিশাকে একা একটা জায়গায় ডাকার মতো ইনসেন্সিবল নয় সে। রাস্তায় বিপদ আপদের বালাই নেই।

নিশা প্রশ্ন করে,

“ খুব জরুরি কোনো কথা ভাইয়া? “

সাইফ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ চলুন হাঁটা যাক ইয়াসমিন। “

নিশা আর কোনো প্রশ্ন করে না। নীরবে সাইফের সঙ্গে কদম মিলিয়ে হাঁটতে থাকে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে নীরবতা ভেঙে নিজেই বলে উঠে,

“ ভাইয়া, ওদিন আমার একটা ফ্রেন্ডের সঙ্গে ছবি পাঠিয়েছিলাম আপনাকে। মনে আছে? “

সাইফ নিচু স্বরে বলে,

“ হু? “

“ কেমন? “

সাইফ আনমনে জবাব দেয়,

“ সুন্দর। “

নিশা সঙ্গে সঙ্গে খুশি হয়ে যায়। প্রফুল্ল গলায় বলে,

“ ওর নাম ঐশী। খুব নম্র, ভদ্র মেয়ে। আপনার সাথে সুন্দর মানাবে। আপনি ওকে বিয়ে করবেন? “

সাইফ আচমকা চোখ বড়ো বড়ো করে নিশার দিকে তাকায়। নিশা ভীত হয়। অযাচিত ঘটকালিতে কি লোকটা ক্ষেপে গেলো নাকি? কে জানে! কিন্তু নিশার নিয়ত তো খারাপ ছিলো না! এই লোকটার জন্য তার মায়া হয়। মনে হয় লোকটা আপন একটা নিজের মানুষ ডিজার্ভ করে। তাই তো নিশা এই লোকের কি ধরনের মেয়ে পছন্দ সেই হিসাব কষে নিজের চারিদিকে মেয়ে খুঁজে বেড়ানো শুরু করেছিলো। ঐশী মেয়েটাও তো খারাপ না। দেখতে সুন্দর, নমনীয় ব্যবহার, বেশ সংসারীও হবে দেখে বুঝা যায়। সাইফের মতো মানুষকে বেশ আগলে রাখতে পারবে।

সাইফের পরিষ্কার জবাবে নিশার ঘোর কাটে,

“ আমি ওই মেয়েকে বিয়ে করবো না। “

নিশা মুখটা একটুখানি করে নুইয়ে ফেলে। সে কি বেশি অধিকারবোধ দেখিয়ে ফেললো? তার ভাবাবেগকে ভুল প্রমাণ করে আচমকা সাইফ বলে উঠে,

“ আপনাকে চাচ্ছি ইয়াসমিন। শিকড়হীন মানুষটাকে কি আপন করে নিতে পারবেন? “

নিশা মুহুর্তেই চোখ তুলে তাকায়। দৃষ্টি গিয়ে আটকায় সাইফের চোখের পানে। মশকরা ও দুষ্টুমি ভর্তি সেই দৃষ্টিতে আচমকা নিশা এক আকাশ অসহায়ত্ব খুঁজে পায়। কেমন অদ্ভুৎ সেই দৃষ্টি! গল্প সিনেমার মতো মুহুর্ত থমকালো না, চারিদিকে হাওয়া বয়ে গেলো না, আকাশ হতে বর্ষণও নামলো না। তবে নিশার বুকে অদ্ভুৎ এক কম্পন শুরু হয়। যেই কম্পন রিখটার স্কেলের মাত্রা পেরিয়ে তীব্র থেকে তীব্রতর গতিতে বাড়ছে। সাইফের কণ্ঠে অস্থিরতা। সে ফের প্রশ্ন করে,

“ আমাকে আপনার নিজের যোগ্য মনে হয় ইয়াসমিন? “

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৭.

তামাটে রঙের, মেদহীন, লম্বাদেহী পুরুষের অসহায় মাখা গলায় করা সেই প্রশ্নের পিঠে নিশার কণ্ঠনালী বিদ্রোহ করে বসলো। বোকা বোকা চোখ মেলে তাকিয়ে থেকে ইতস্তত গলায় জবাব দেয়,

“ কিন্তু ভাইয়া… “

সাইফ এবার অধৈর্য্য গলায় নিশাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে,

“ ট্রাস্ট মি ইয়াসমিন, আপনার মুখের এই ভাইয়া ডাকটা পৃথিবীর সবথেকে বিষাক্ত শব্দ আমার কাছে। “

নিশা বিব্রত অনুভব করে। ভাইয়া ডাকটা চেপে গিয়ে নম্র স্বরে বলে,

“ আমার সময় চাই। “

সাইফ এবার শীতল গলায় বলে,

“ এক জীবন সময় দিলাম। তবে জীবন কতদিনের সেই ধারণা দিতে পারছি না। জীবন ফুরানোর আগে আমাকে জবাবটুকু দিলে মেহেরবানি হতো। “

সেই রাতটায় নিশা আর একটা কথাও বলতে পারে নি। সাইফ তাকে ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। রিকশা থেকে নেমে যখন নিশা সামনে এগোনোর জন্য পা বাড়াচ্ছিল তখন কেবল সাইফ পিছু ডেকে বলেছিলো,

“ আগামীকাল ঢাকা যাচ্ছি ইয়াসমিন। কোথাও যাওয়ার পূর্বে বিদায় নেওয়ার অভ্যাসটা আমার মধ্যে নেই। এর অবশ্য কারণ আছে। এতদিন আমার কাছে বিদায় নেওয়ার মতো কাছের মানুষ ছিলো না। আজও নিবো না। তবে আজ কারণ ভিন্ন। আর সেই কারণটা হলো আমি শীঘ্রই ফিরবো। আপনার জবাবটা শোনার জন্য ফিরবো। ভালো থাকবেন। “

__________

আকাশে মেঘপুঞ্জির ভীড়ে আড়াল হয়ে আছে চাঁদ। প্রকৃতিতে বইছে হিম বাতাস। পর্দাযুক্ত খোলা জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে সেই ঠান্ডা বাতাস। সেই গা হিম করা বাতাসের দিকে ধ্যান নেই নিশার। গায়ে কাটা দেওয়া ঠান্ডার মাঝে সে বালিশ বুকে চেপে চোখ বুজে বসে রয়েছে। বুকের মধ্যে বহমান ভূমিকম্পটা এখনো থামে নি। তবুও প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে সে। তবে সাইফের করা প্রশ্নের উত্তর নয়। বরং অন্য এক প্রশ্নের উত্তর।

ওই লোকটা এমন কাউকে ডিজার্ভ করে যে কিনা যত্নের চাদরে মানুষটাকে মুড়িয়ে রাখতে পারবে। যে কিনা মানুষটার ভরসার স্থান হবে, নির্ভরতার আশ্রয় হবে। নিশার মনের কোণে প্রশ্ন উঁকি দেয়। সে কি আদৌ সাইফের যোগ্য? প্রশ্ন উত্তরের দ্বন্দ্বের মাঝে হারিয়ে যায় নিশা। হয়ে যায় শান্ত, স্থির, বিষণ্ণ। কর্ণকুহরে বেজে উঠে সাইফের করা সেই প্রশ্নটা,

“ আপনাকে চাচ্ছি ইয়াসমিন। শেকড়হীন মানুষটাকে কি আপন করে নিতে পারবেন? “

শেকড়হীন শব্দটা মনে পড়তেই নিশার বিষণ্ণতার মাত্রা আরেকটু বেড়ে যায়। চারিপাশে বয়ে যায় আঁধার রাতের দীর্ঘশ্বাস।

__________

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সদর দপ্তরে একত্রিত হয়েছে টেরোরিজম মিশনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত সকল সেনা সদস্যরা। দুপুর থেকে চলছে তাদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। দীর্ঘ এই মিটিংয়ের শেষ হয় এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে। অতি শীঘ্রই তারা দেশ জুড়ে রেড এলার্ট জারি করবে। গণমাধ্যমের সামনে প্রকাশ করবেন আটককৃত অপরাধীর দেওয়া হুমকি। আসন্ন পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে এবং পুরনো হামলা গুলোকে নজিরা হিসেবে উপস্থাপন করে সর্ব প্রথম সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের জন্য হাই কোর্টে আপিল করবে। সেই সঙ্গে ঘর থেকে সবাইকে বের হওয়ার জন্যও নিরুৎসাহিত করা হবে।

অন্তত এক থেকে দুই সপ্তাহ জনগণকে সচেতন অবস্থান করার জন্য জোর দিবেন। এই এক দু সপ্তাহের মধ্যে সৈন্যরা নতুন এক অপারেশন পরিচালনা করবেন। হিরণের লুকায়িত আতঙ্কবাদীদের ঘাটি খুঁজে বের করার অপারেশন। সেই সঙ্গে সাধারণ জনগণদেরও আহবান করবে যেনো সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লেই ইমারজেন্সি হেল্পলাইন ৯৯৯ এ কল করে তা জানায়।

__________

হিরণের জবানবন্দি থেকে এতদূর জানতে পেরেছে সৈন্যরা যে শমসের মজুমদারকে তন্নতন্ন করে খুঁজে লাভ নেই। সে মৃত। হিরণ নিজ হাতে খুন করেছে তাকে। হিরণের জবানবন্দী নিশ্চিত করতে চট্টগ্রামে উপস্থিত একদল সৈন্যকে পাঠানো হয় হিরণের বিভিন্ন প্রোপার্টিসের তালাশে। সেই প্রোপার্টিস গুলোর মধ্যে এক খামারবাড়ির উঠোন হতে উদ্ধার হয় এক মরদেহ। এতো মাসে লাশ পঁচে কেবল দেহখণ্ড গুলোই অবশিষ্ট ছিলো। সেই দেহাংশ বিশেষ ব্যবহার করে মেডিক্যাল ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত হয় যে লাশটা শমসের মজুমদারেরই। শমসের মজুমদারের মৃত্যুর এই ছোট তথ্যটুকু বাদে আর একটা টু শব্দ উচ্চারণ করে নি হিরণ। ইবাতও নিজের স্যারের অনুসারী। তার মুখ দিয়েও বের হলো না একটা শব্দ।

তবে আটককৃত আতঙ্কবাদীদের মধ্যে কিছুজন রিমান্ডের অত্যাচারের মাত্রা সইতে না পেরে মুখ খুলেছে। জানিয়েছে সম্ভাব্য কিছু ঠিকানা। সৈন্যরা মুহুর্ত অপেক্ষা না করে উক্ত স্থান গুলোতে পৌঁছায়। কিন্তু প্রতিটা জায়গাই মানব শূন্য। সৈন্যরা আশাহত হয় না। উক্ত স্থানগুলো হতে বিভিন্ন ক্লু কালেক্ট করে। সেগুলোর রেশ ধরে চিরুনি তল্লাশি চালানো শুরু করে।

__________

দূর্জয়রা ঢাকায় এসেছে আজ দু’দিন হলো। এই দু’দিন দু দন্ডের জন্যও ফুরসত পায় নি তারা। অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে সময় পাড় করছে। শেষ বিকেলের দিকে আচমকা বেয়ারা ফোনটা বেজে উঠতেই দূর্জয় অভ্যাস সলুভ ধীর গতিতে ফোনটা রিসিভ করে। অপর পাশ হতে এক নারী কণ্ঠ বলে উঠে,

“ খুব বেশি ব্যস্ত তুমি? “

“ হ্যাঁ। “

“ ঢাকায় থেকেও বাসায় আসার জন্যও এক মুহুর্ত সময় হবে না? “

“ সময় পেলে অবশ্যই আসবো। “

নারী কণ্ঠটা এবার নীরব হয়ে যায়। আর কোনো প্রশ্ন ছুড়ে দেয় না। দূর্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ তুমি ভালো আছো মামণি? “

“ আছি আলহামদুলিল্লাহ। “

কিছুক্ষণ ইতস্তত করে এবার নারী কণ্ঠটা বলে উঠে,

“ বাড়ি ফিরলে এবার অন্তত হাতে দু’দিন সময় নিয়ে এসো। “

“ বিশেষ কোনো কারণ? “

“ হেনা আপাদের আসতে বলতাম তাহলে। “

দূর্জয় চোখ কুচকে ফেলে। হেনা আপা নামক কোনো পরিচিত মানুষের কথা এই মুহুর্তে তার মনে পড়ছে না। সে জানতে চায়,

“ হেনা আপা কে? “

“ তোমার ফুফুর ননাশ। “

দূর্জয়ের কপালের ভাজ দৃঢ় হয়। সে কৌতূহল মিশ্রিত স্বরে জানতে চায়,

“ উনাদের বাসায় আসার সঙ্গে আমার বাড়ি ফেরার কি কানেকশন? “

“ তোমার ফুফু খুব প্রশংসা করেছে উনাদের পরিবারের। হেনা আপার মেয়েটা নাকি অত্যন্ত সুন্দর এবং মার্জিত। কানাডা থেকে কম্পিউটার সাইন্সের উপর মাস্টার্স করে দেশে ফিরেছে সবে। বয়সটাও একদম নাদান নয়, তোমার সঙ্গে মানানসই। তোমার আপত্তি না থাকলে একবার দেখা করার ব্যবস্থা করতাম। “

মায়ের সূক্ষ্ণ ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেই দূর্জয় স্পষ্ট গলায় বলে,

“ মেয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো তবে আমি ইন্টারেস্টেড নই। “

মিসেস সুহালা ছেলের উপর কখনোই নিজের কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় না। তবে এইবার তিনি স্বভাবের বাহিরে গিয়ে খানিকটা রাগ দেখিয়ে বলে,

“ তোমার ইন্টারেস্টটা কবে আসবে শুনি? এই বয়সে তোমার আব্বু দুই ছেলের বাপ ছিলো। আর তুমি? ইউ আর ইম্পসিবল! “

দূর্জয় মায়ের রাগ দেখে এবার চাপা কৌতুক করে বলে,

“ তোমার অভিযোগটা ঠিক কি নিয়ে মামণি? আমি এখনো বিয়ে করছি না সেটা নিয়ে? নাকি আমি এখনো বাপ হচ্ছি না সেটা নিয়ে? “

সুহালা বেগম বাকরুদ্ধ বনে যায়। তার ছেলে কৌতুক করার পাত্র না। তবে আজ ঠিক সময়মতো নিজের কৌতুক দ্বারা সুহালা বেগমকে চুপ করিয়ে দিয়েছে একদম। অত:পর ভদ্র ছেলের মতো কোমল স্বরে বলে,

“ এখন রাখছি মামণি। খেয়াল রেখো। আল্লাহ হাফেজ। “

__________

অন্ধকারাচ্ছন্ন আর্মিদের আওতাভুক্ত সেলে জীবনটা বেশ দূর্বিষহ কাটছে হিরণের। এতো বছরের পাপের জীবনে কেউ তার গায়ে হাত দেওয়ার সাহস পায় নি কখনো। যে হাত তোলার সাহস করেছে সে নিজের হাতের সঙ্গে জীবনটাও খুইয়েছে। কিন্তু এখন! রোজকার টর্চারের ফলস্বরূপ আঘাতে আঘাতে সম্পূর্ণ দেহ জর্জরিত। কোমড়ের আঘাত গুলো খুব গুরুতর। মেঝেতে শুতে নিলেই তা টের পায় হিরণ। তবে গায়ে মাখে না সে। শারীরিক আঘাত তো সে কম সয় নি জীবনে। শেষ রাতে যখন মেঝেতে শরীরটুকু এলিয়ে দেয় তখন চোখের সামনে ভেসে উঠে অদ্ভুৎ এক শৈশব।

বয়স হয়তো তখন কেবল সাত ছিলো হিরণের। যখন থেকে বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই নিজেকে আবিষ্কার করে চার দেয়ালে আবদ্ধ ভিন্ন এক জগতে। পিতৃ মাতৃ পরিচয়হীন এক অনাথ হিসেবে অনাথ আশ্রম টুকুতেই তার ঠাই হয়েছিলো। অনাথ আশ্রমের মালিক ছিলো কালো বাজারির সঙ্গে জড়িত। সমাজে নিজের সনামধন্য খ্যাতির পিছনে লুকিয়ে ছিলো তার কুলষিত এক রূপ। সেই রূপটা জড়িত ছিলো হাজারো অপকর্মের সঙ্গে।

ভালো মানুষীর মুখোশ পড়ে তিনি অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের দ্বারা দু ধরনের ব্যবসা করতেন। প্রথমটা হলো বাচ্চাদের শরীরে অস্ত্রোপচার করে অবৈধভাবে অরগ্যান ডোনেশন। আর দ্বিতীয়টা হলো বাচ্চাদের দিয়ে শহরের ব্যস্ত মোড় গুলোতে ভিক্ষা করানো। হিরণের ভাগ্য ভালো ছিলো নাকি খারাপ তা তার জানা নেই। তবে সে ছিলো ভিক্ষা করানো দলের অংশ। সেই ভিক্ষার রেশ ধরেই একদিন তার পরিচয় হয় শমসের মজুমদারের সঙ্গে।

মিরপুর ১০ এর সামনে বিলাসবহুল গাড়িতে বসে থাকা শমসেরকে দেখেই হিরণ বুঝেছিলো লোকটা সম্ভ্রান্ত ঘরের। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন হিরণ দুটো টাকা বেশি লাভের আশায় নিজের কথার দ্বারা লোকটার মনযোগ পেতে সক্ষম হয়েছিলো। তবে তার বুদ্ধিমত্তা শমসেরকে এতটাই মুগ্ধ করে যে তিনি পরের দিনই সেই অনাথ আশ্রমে এসে হাজির হয়। উদ্দেশ্য এই সুন্দর দেখতে বুদ্ধিমান বাচ্চাটাকে দত্তক নেওয়া।

দত্তকের মানে কি তা বুঝতে অসুবিধা হয় নি হিরণের। তবুও এই নিয়ে আলাদা কোনো প্রতিক্রিয়া ছিলো না তার। তবে যখন দেখলো অনাথ আশ্রমের বাকি বাচ্চাগুলো তাকে ঈর্ষাপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখছে তখন মনে পৈশাচিক এক আনন্দ অনুভব করে সে। জীবনে প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করে অন্যের ঈর্ষার কারণ হওয়া কতটা আনন্দপূর্ণ। মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় একদিন সে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাবে যেখানে সবাই তাকে এবং তার ক্ষমতার মাত্রাকে ঈর্ষা করবে।

শমসের মজুমদারের হাত ধরে এক বিলাসবহুল বাড়িতে পা রেখে হিরণের চোখ চিকচিক করে উঠেছিলো। ভেবেছিলো এই বুঝি তার জীবনটা সুন্দর হবে। অন্ধকার চিরে আলোর জগৎ বোধহয় একেই বলে। অবশেষে হয়তো সে একটা পরিবার পাবে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন।

সেদিন রাতে আউট হাউসে যাওয়ার পথে শমসের তার কাধে হাত রেখে গম্ভীর স্বরে বলেছিলো,

“ শুনো ছেলে। জীবন অনেক নির্মম এক খেলার মঞ্চ। এই মঞ্চে প্রতিটা জিনিসই তোমার নিজ যোগ্যতা এবং চেষ্টায় জিতে নিতে হবে। এখানে কেউই তোমাকে সোনার থালায় সাজিয়ে সব দিয়ে দিবে না। এটা হলো আমার তরফ থেকে তোমার প্রথম শিক্ষা। “

হিরণ অবুঝের ন্যায় তাকিয়ে ছিলো। লোকটার মুখের সেই কথার অর্থ বুঝতে পারছিলো না। তবে বুঝতে পারে, যখন শমসের মজুমদার আউট হাউসের ভেতর তাকে ঠেলে দিয়ে দরজাটা বাহির থেকে বন্ধ করে দেয়। হিরণ বিস্মিত হয়েছিলো। ভেতরটা ছিলো গুটগুটে অন্ধকার। আঁধারকে হিরণ ভয় পেতো না। তবে সেকেন্ড পাঁচেক পেরোতেই যখন রুমের লাইট জ্বলে উঠে তখন সে ভীত হয়। রুমের দুই কোণে লোহার শিকল গলায় ঝুলানো দুটো কালো রঙের স্বাস্থ্য সম্মত কুকুর বাধা ছিলো। ক্ষুধার্ত কুকুর দুটোর এক হাত সমান জিভ মুখের বাহিরে ঝুলছিলো। হিরণ ভীত হয়ে চিৎকার করে দরজা ধাক্কানো শুরু করে। তার চিৎকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কুকুর দুটোও লেজ নাড়িয়ে সোল্লাসে মেতে উঠে। যেনো ভীত হিরণকে দেখে তারা খুব মজা পাচ্ছে।

রুমের এককোণে ছিলো একটা জানালা। সেই জানালার বাইরে থেকে শমসের অদ্ভুৎ হাসি দিয়ে বলেছিলো,

“ এইমাত্র যেই শিক্ষার বুলি আওড়িয়েছি তার জীবনমুখী ক্লাস এটা। এই রুমটা হলো পরীক্ষার হল, কুকুর দুটো তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী আর রুমের মাঝখানটায় রাখা একটুকরো বনরুটি হলো পুরুষ্কার। আমি জানি তোমার অনেক খিদে পেয়েছে। দুপুর থেকে না খাওয়া। তাই বনরুটিটা কুকুর দুটোর সামনে থেকে ছিনিয়ে নাও। তাহলে তোমার রাতের খাবারটাও তুমি উপার্জন করে নিতে পারবে আর এই বন্ধ রুমটা থেকেও বের হওয়ার সুযোগ পাবে। “

সে রাতে হিরণ বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছিলো। বুঝতে পেরেছিলো এক অন্ধকার জগত থেকে বের হয়ে সে অন্য এক অন্ধকার জগতে পা রেখেছে। যেখানে টিকে থাকাটা তার জন্য সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামে জয়ী সে কেবল তখনই হবে যখন কি-না, সে এই শমসের মজুমদার নামক লোকটাকে টপকে গিয়ে নিজের স্থান তৈরী করতে পারবে।

হিরণ জয়ী হয়েছিলো শেষ পর্যন্ত। শমসের মজুমদারকে টপকে গিয়েছিলো সে পাপের জগতে। রাজ্য জয় করেছিলো। সেই রাজ্যে এক রমণীকেও রাণী বেশে আনতে চেয়েছিলো। নিজের অন্ধকার রাজ্যে এক শুভ্র মুক্তার দানার ন্যায় যে আলো ছড়াবে। রমণীকে রাণী করে আনার জন্য এক সুন্দর ছক সাজায় হিরণ। রমণীর পিতা মহোদয়কে টাকার বিনিময়ে কন্যা দানের প্রস্তাব দেয়। রমণীর পিতা সেই প্রস্তাবে রাজি হয়। তবে জেদি রমণী সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

হেরে যাওয়ার অভ্যাস হিরণের কোনো কালেই ছিলো না। জেদি রমণীর প্রত্যাখ্যানকে থোড়াই কেয়ার করে সে তাকে ছিনিয়ে আনে। জগৎ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আশা ছিলো একদিন না একদিন ঠিকই রমণীর মনে ঠাই খুঁজে পাবে। কিন্তু জেদী রমণী ভুল করে। হিরণের বিধ্বংসী রাগের শিকার হয়। অত:পর? অত:পর রাণী না পেলেও হিরণ এক রাজকন্যা পেয়েছিলো।

রাজকন্যা তার ঘর আর জীবন দুটোই আলোকিত করে রেখেছিলো। জীবনের পাঁচটা বছর যেনো চোখের পলকেই কেটে গেলো। অকস্মাৎ একদিন রাজকন্যা হিরণের নিকৃষ্ট রূপটার সাক্ষী হলো। আর তারপর? তারপর পৃথিবীটা কেমন মলিন হয়ে গেলো হিরণের।

মেয়ের ঘৃণার মাধ্যমেই যেনো হিরণের পাপের সাম্রাজ্যের ধ্বংস শুরু হয়েছে। বাণী আর বহ্নিকে হারিয়ে ফেলা, তার সত্যটা গোটা দুনিয়ার সামনে আসা অত:পর পলাতক হয়ে জীবন পাড় করা। হিরণ দেখতে পেয়েছিলো, নিজের ভবিষ্যৎ স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলো সে। সৈন্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে যে বেশিদিন পালিয়ে বেড়ানো তার পক্ষে সম্ভব হবে না তা সে বুঝতে পেরেছিলো। তাই তো শেষবারের মতো দেশের কালো অধ্যায়ে নিজের নাম লেখার জন্য আরো একটা হামলার প্ল্যান ম্যাপ রেডি করে।

এবারের হামলার সঙ্গে জড়িত নেই কোনো বহিরাগত শক্তি। নেই কোনো আলাদা মুখ্য হোতা। এই হামলা একান্তই হিরণের কারুকার্য। একান্তই তার।

এই পথের শেষ কোথায় তা-ও হিরণ ভালো করেই জানে। কিন্তু মানসিক অশান্তি ধীরে ধীরে তাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। প্রতি মুহুর্তেই সে কানে শুনতে পায় বহ্নির বলা,

“ আই হেইট ইউ পাপা। “

শব্দ চারটা কর্ণগোচর হতেই হিরণের মাথার ভেতর একশো পিপড়া যেনো দংশন করা শুরু করে। সেই যন্ত্রণায় সে মাঝেমধ্যে দেয়ালে জোরে জোরে নিজের মাথা ঠুকে। কিন্তু বিন্দু পরিমাণ যন্ত্রণা কমে না। উল্টো যন্ত্রণা তাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলে যখন সে উপলব্ধি করে, এই পৃথিবীতে আর কেউই তাকে চায় না। বাণীর সাথে নিজের দুটো সন্তানকেও হারিয়ে ফেলেছে সে। পথ আলাদা হয়ে গিয়েছে তাদের। কোনো ক্ষমতা খাটিয়েও সেই পথ আর এক হবার নয়!

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]