এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-৪৮+৪৯+৫০

0
301

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৮.

আজ শুক্রবার দিন। স্কুলে যাওয়ার কোনো তাড়া নেই আজ। তাই ঘুমটাও ভাঙলো বেশ দেরি করে। ঘড়িতে সময় তখন সকাল এগারোটা। সকালের নাস্তা বানাবে নাকি দুপুরের রান্না চড়াবে ভাবতে ভাবতে বাণী চুলোয় ভাত বসিয়ে দেয়। অত:পর বহ্নিকে পাওরুটিতে অরেঞ্জ জ্যাম মাখিয়ে খাইয়ে দেয়।

বহ্নিকে নাস্তা করিয়েই বাণী রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। জীবনে কোনো দিন রান্নার ধারে কাছে না ঘেঁষা মেয়েটা গত কয়েক মাসে একটু একটু করে রান্নাটা আয়ত্তে এনেছে। খুব যে ভালো হয় তা না। তবে খাওয়ার অযোগ্যও না।

ভাতের মাড় গালতে তার সমস্যা হয় বিধায় বিকল্প হিসেবে বসা ভাত রান্না শিখেছে। এতে আর এতো ঝামেলা হয় না। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে মুরগী ম্যারিনেট করতে ব্যস্ত বাণী। প্রতি শুক্রবারে যতই কষ্ট হোক মেয়েটার জন্য স্পেশাল কিছু রান্নার চেষ্টা করে সে। আজকে ভেবে রেখেছে মুরগীর কোরমা, ভাত আর সালাদ রান্না করবে।

ভাতের পাশের চুলোটা অন করে আগুন ধরাতে নিবে ঠিক এমন মুহুর্তেই বেড রুম থেকে বহ্নির আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসে। বাণী বিস্মিত হয়। হাতের ম্যাচটা ফেলে দ্রুত দৌড়ে যায় মেয়ের কাছে।

বহ্নি তখন ফ্লোরে বিছানো পাটির উপর বাম হাত চেপে ধরে বসে আছে। দু চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে কাঁদছে। বাম হাতের তালু থেকে তার গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। তার কোলের কাছেই পড়ে আছে বাণীর পকেট নাইফটা, সেই সঙ্গে খেলনা রান্না পাতি। মেয়ের হাতে রক্ত দেখে বাণী হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। কোনো প্রশ্ন না করে সোজা মেয়েকে কাছে টেনে কোলে তুলে নেয়। কোনো মতে নিজের ওড়নাটা মাথায় টেনে পার্স আর বাসার চাবি নিয়ে সে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে।

__________

শীতের চাদরে মুড়িয়ে আছে গোটা চট্টগ্রাম শহরটা। ভার্সিটি প্রাঙ্গণে বসে আছে এক বন্ধুমহল। হাসি থাট্টায় মাতিয়ে রেখেছে চারিপাশটা। বন্ধুমহলের আড্ডাটা যে কখন জেসির বিয়ের ব্যাপারে এসে স্থির হলো তা জেসি নিজেও বুঝতে পারলো না। কথায় কথায় জেসির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মুন সবাইকে জানায় জেসির বিয়ে করতে না চাওয়ার ব্যাপারটা।

বন্ধুমহলের সবথেকে বিচক্ষণ ছেলে ফরহাদ সবটা শুনে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে,

“ এমন না যে তুই এখন বিয়ে করতে চাচ্ছিস না আবার পাশাপাশি তোর কোনও সম্পর্কও নেই। তাহলে বিয়ে করতে সমস্যাটা কোথায়? “

জেসি মুখ কালো করে বলে,

“ ছেলেটা অসভ্য। আমার একবিন্দুও পছন্দ না। “

ফরহাদ মুখের সিরিয়াসনেস এর মাত্রা আরেকটু বাড়িয়ে জানতে চায়,

“ কি অসভ্যতামি করেছে তোর সাথে? “

জেসি দ্রুত মুখ চালিয়ে কিছু বলতে নিয়েও জবাব খুঁজে পায় না। মুখ কালো করে বসে রয়। মুন নিজেই বলে,

“ একবার লাইব্রেরীতে একটা সিলি ম্যাটারে এদের ঝগড়া হয়েছিলো। আর আরেকবার এক্সিডেন্টলি রাস্তায় দেখা হয়েছিলো এদের। সেইবার জেসি ইঞ্জুরড হয়েছিলো সামান্য। কিন্তু ভাইয়া ইনটেনশন্যালি ওকে ইঞ্জুরড করে নি। আর এই সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে এই বলদি এতো তামাশা করে বেড়াচ্ছে। সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি স্বভাবটা এখনো ছাড়তে পারছে না। “

জেসি চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই মুন বলে,

“ এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? ভুল বলেছি আমি? “

ফরহাদ এবার বিজ্ঞের ন্যায় বলে,

“ তুই আমার দিকে তাকা জেসি। আমার কথা মন দিয়ে শোন। তুই নিজেই না সবসময় বলতি যে আংকেল যাকে পছন্দ করবে তুই তাকেই বিয়ে করবি? তুই ভুল পাত্র চুজ করতে পারিস কিন্তু আংকেল কখনো নিজের মেয়ের জন্য খারাপ কাউকে চুজ করবে না। এই বিশ্বাস মনে রেখেই কিন্তু তুই কখনো কোনো প্রেম ঘটিত বিষয়ে জড়াস নি। আর আজ যখন আংকেল সত্যি সত্যিই তোর জন্য কাউকে সুযোগ্য মনে করলো তখন তুই তাকে রিজেক্ট করার জন্য কেনো উঠে পড়ে লেগেছিস? তোর এই রিজেকশনের পিছনে কোনো স্ট্রং ভ্যালিড রিজনও নেই। ইট ইজ নাথিং বাট ইউর চাইল্ডিশ ইগো। গেট অভার ইট। যতদূর শুনলাম আই থিংক হি ইজ এ গুড গাই। নিজের এই ছোট সামান্য বিষয় ঘিরে বাড়াবাড়ি করার স্বভাবটা একপাশে রেখে গিভ হিম এ চান্স। “

ফরহাদের কথা শুনে জেসি চুপ রয়। উদাস চোখে আকাশ পানে তাকায়। সে কি আসলেই বেশি বেশি করে ফেলেছে? জেসি পুরনো ঘটনা গুলো চোখের সামনে রিওয়াইন্ড করার চেষ্টা করে। অত:পর মনে করে নিজের আপুর কথা। জাহানারা আপুও তো আব্বুর পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করেছে। আপু তো এখন দুলাভাইয়ের সঙ্গে বেশ ভালোই আছে। সে-ই একই আব্বু কি নিজের ছোট মেয়ের জন্য ভুল কাউকে পছন্দ করবে? এটাও কি আদৌ সম্ভব? নাকি জেসিই কোথাও ভুল করছে?

বহু ভেবেও উত্তর খুঁজে পায় না জেসি। উত্তরের বদলে মাথাটা ভারী অনুভব করতে শুরু করে। উদাস ভঙ্গিতে ব্যাগ নিয়ে আড্ডা থেকে প্রস্থান করে। ফরহাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে দোয়া করে মেয়েটার যাতে একটু সুবুদ্ধি হয়।

__________

চমৎকার এক বিকেল। ছুটির দিন হওয়ায় শপিং মলে উপচে পড়া ভীড়। সৈন্যদের দেওয়া এলার্টকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সাধারণ জনগণ নিজেদের সাধারণ জীবনধারাকে অব্যাহত রেখেছে। স্কুল কলেজ বাদে বাকি সব চলছে আপন নিয়মে। আর দশটা সিভিলিয়ানের মতোই শপিং মলে প্রবেশ করে এক পুরুষ। শার্ট প্যান্ট পরিহিত পুরুষের মুখে খোচা খোচা দাঁড়ির আভাস। ডান হাতে কানে ফোন চেপে ধরে হাস্যজ্বল গলায় কাউকে বলছে,

“ তুমি কিন্তু দিনদিন গুন্ডাদের মতো আচরণ শুরু করেছো। “

ফোনের অপর পাশ হতে এক নারী গলা বলে উঠে,

“ একশো বার করবো। ক’টা দিন ছুটি নিয়ে বাসায় বসে থাকলে কি হয় তোমার? তুমি যতক্ষণ বাহিরে থাকো আমার উপর দিয়ে কি তুফান বয়ে যায় তুমি জানো? আজকে বাসায় আসো। তোমাকে রুম বন্দী করে রেখে দিবো। “

পুরুষটা এসকালেটর উঠে দাঁড়িয়ে হাসি চেপে বলে,

“ অন ডিউটি অফিসারকে হুমকি দিচ্ছেন ম্যাডাম। আপনার নামের পাশে চার্জ শিট বসাবো? “

ফোর্থ ফ্লোরে পৌঁছে কিডস সেকশনের দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো অজ্ঞাত পুরুষটা। তখনও ফোনালাপে মশগুল সে। নির্দিষ্ট শপটা খুঁজে পাওয়ার জন্য চারিদিকে সূক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে দেখতে থাকে। আচমকা কাধে বিশাল ব্যাগবাহী এক ছেলের পানে তার দৃষ্টি স্থির হয়। গোয়েন্দাপূর্ণ দৃষ্টিতে মুহুর্তেই ভাজ পড়ে। ফোনের অপর পাশ হতে ভেসে আসা কথাগুলোর দিকে আর তার ধ্যান থাকে না। শান্ত গলায় বলে,

“ পরে কথা বলছি। “

বলেই ফোনটা পকেটে ভরে ফেলে। ব্যাগ বাহী যুবক দূর হতে ইশারায় লাল শার্ট পরিহিত আরেকজন যুবককে কিছু একটা ইঙ্গিত দেয়। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন পুরুষের দৃষ্টি এড়ায় না তা। সে সেই যুবকদের অনুসরণ করতে এগিয়ে যায়। লাল শার্ট পরিহিত যুবকটা এবং অপর যুবকটা দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যায়। পুরুষটা ওয়াশরুমের দরজার কাছে গিয়েই দেখে দরজাটা ভেতর থেকে লকড।

মনে মনে পুরো হিসাবটা মেলাতেই সেই পুরুষ ভেতরে আতংক এবং উত্তেজনা অনুভব করে। তবে তা বাহিরে প্রকাশ না করে দ্রুত নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল লাগায়। ফোনটা রিসিভ হতেই তাড়া দিয়ে বলে,

“ বসুমতী শপিং কমপ্লেক্সে এখনই টিম পাঠাও। ইট’স এন ইমারজেন্সি। “

অর্ডারটা বুঝিয়ে দিয়েই কলটা কেটে নিজের কন্ট্যাক্ট লিস্ট হতে আরেকটা নাম্বার ডায়াল করে সে। অপর পাশ হতে ফোনটা রিসিভ হতেই পুরুষটা স্পষ্ট গলায় বলে,

“ অফিসার শোভন মুহতাশিম চৌধুরী বলছিলাম। টু সাসপেক্টেড পারসন ইজ ডিটেক্টেড। সন্দেহ করছি যেই ডুমস ডে এট্যাকের হুমকি দেওয়া হয়েছিলো সেই এট্যাক ঘটতে চলেছে। লোকেশন বসুমতী শপিং কমপ্লেক্স। দ্রুত আসুন। আপনার এবং আপনার টিমের অপেক্ষায়। “

__________

শপিং মলের সর্বত্র এনাউন্সমেন্ট করে চেঁচিয়ে বলা হচ্ছে,

“ আপনারা দ্রুত শপিং মল ছেড়ে বেরিয়ে যান। এখানে আতঙ্কবাদীদের আনাগোনার আশংকা করা হচ্ছে। “

মানুষ জন যে যেভাবে পারছে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছে। মিনিট একের মাঝেই একধরনের হট্টগোল বেধে গেলো। অফিসার শোভন নিজের পিস্তল হাতে এক পিলারের আড়াল হতে নজর রাখছে বাথরুমের দরজার পানে। তীব্র উৎকণ্ঠায় তার শরীর মৃদু কাপছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে পুরনো স্মৃতি।

আচমকা ওয়াশরুমের দরজাটা খুলে যায়। বেরিয়ে আসে চারজন যুবক। গায়ে ঝুলে আছে তাদের আত্মঘাতী বোমা। লাল শার্ট পরিহিত পুরুষটা নিজের হাতের রিমোট জাতীয় যন্ত্রটা আঙুল দ্বারা চেপে ধরতে নিলেই শোভন দ্রুত আড়াল হতে তার কপালের মাঝ বরাবর গুলি ছুড়ে।

যুবকটা মুহুর্তেই ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে। মানুষ জনের চেঁচামেচি আরো বেড়ে যায় ফায়ারিং এর শব্দে। বাকি তিনজন আতঙ্কবাদী ততক্ষণে তিনদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। শোভন দিশেহারা। কোন দিকে যাবে সে? একা হাতে সম্পূর্ণ সিচুয়েশনটা সামলানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও সে মনবল হারায় না।

আর কিছুক্ষণ! আর কিছুক্ষণ শুধু তার ট্যাকেল দিতে হবে। পুলিশ বাহিনী আসছে। সেনাবাহিনীও আসছে। সবটা সামলে নিবে সবাই মিলে। কিচ্ছু হবে না।

__________

সড়ক পথে দাপুটে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনীর গাড়ি। গন্তব্য বসুমতী শপিং কমপ্লেক্স। উৎকণ্ঠায় সবার হাত পা কাপছে। হিরণের বলা সেই ডুমস ডে এট্যাকটা তবে সত্যি হতে চলেছে। শপিং কমপ্লেক্স হতে তাদের দূরত্ব আর কেবল পাঁচ মিনিট।

গাড়ির পেছনে বসে যখন প্ল্যান সাজাতে ব্যস্ত লেফটেন্যান্টরা, ঠিক সেই মুহুর্তে সাইফের ফোনটা স্ব শব্দে বেজে উঠে। বাকি পাঁচ জন তার দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকায়। সাইফ বলে,

“ ধুর বাল। তাড়াহুড়ায় সাইলেন্ট করার কথা খেয়াল ছিলো না। ওয়েট। “

ফোন সাইলেন্ট করার উদ্দেশ্যে পকেট থেকে বের করতেই স্ক্রিনের নামটা দেখে সাইফ অবাক হয়। পরপর কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে কলটা রিসিভ করে কানে ধরে। অপর পাশ হতে একটা রমণী ব্যস্ত গলায় বলে,

“ আপনি আমায় সেদিন প্রশ্ন করেছিলেন আপনি আমার যোগ্য কিনা। সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাই নি আমি। তবে একটা নতুন প্রশ্ন সেই রাতের পর থেকে আমাকে খুব বিরক্ত করছে। “

সাইফ বিস্ময়তা চেপে গিয়ে জানতে চায়,

“ কি প্রশ্ন? “

“ আমাকে কি আপনার নিজের যোগ্য মনে হয় লেফটেন্যান্ট তামজিদ সাইফ? “

সাইফ অবাক হয়। বাকরুদ্ধের ন্যায় বসে থাকে। ফোনের অপরপাশের রমণী আবার তাড়া দিয়ে বলে,

“ আমি আপনার শেকড় হতে রাজি। যদি আপনি আমাকে নিজের যোগ্য মনে করেন। বলুন না, আমি কি আপনার যোগ্য? “

সাইফ এলোমেলো গলায় আওড়ায়,

“ হ্যাঁ। আপনি যোগ্য। একটু বেশিই যোগ্য। “

রমণী এবার লাজুক হেসে শান্ত গলায় বলে,

“ দ্রুত ফিরে আসুন। অপেক্ষায় থাকবো। “

অপর পাশ থেকে ফোনটা কেটে গেলেও সাইফ অবিশ্বাস্যকর দৃষ্টি মেলে বসে রয়। বাকি পাঁচ জন অবাক হয়ে তাকে দেখছে। জুনায়েদ সাইফের পাশে বসা ছিলো। সে ওকে সামান্য ধাক্কা মেরে বলে,

“ কে কল করেছিলো? “

সাইফ ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি মেলে জুনায়েদের দিকে তাকায়। পরপর অস্ফুটে উচ্চারণ করে,

“ আমার এই মিশন শেষ করে ফিরতে হবে। “

আর কিছু বলতে পারে না সাইফ। শব্দ গুলো তার গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে যায়। পিছুটান হীন সাইফ যে কিনা প্রতিটা অপারেশনে যাওয়ার সময় দোয়া করতো যেনো সে শহীদের মর্যাদা লাভ করতে পারে, সে প্রথমবারের মতো বেঁচে থাকার স্পৃহা অনুভব করে। কেউ একজন আছে যে এখন তার অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকবে। তার তাগিদে সাইফের ফিরতে হবে।

__________

সেনাবাহিনী তিনটা গাড়ি বসুমতী শপিং কমপ্লেক্সের সামনে এসে থামতেই সৈন্যরা গাড়ি থেকে ঝাপিয়ে নিচে নামে। দৌড়ে এগিয়ে যায় কমপ্লেক্সের এন্ট্রেন্সের দিকে। সবুজ ও খাকি রঙের মিশেলের ইউনিফর্ম পরিহিত মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়ও যখন এন্ট্রেন্সের দিকে পা বাড়াতে নিবে ঠিক এমন মুহুর্তে তার ফোন ভাইব্রেট করে উঠে। জুলফিকার মুজতবার কল হতে পারে ভেবে দূর্জয় দ্রুত পকেট থেকে ফোন বের করে। কিন্তু সেভ করা নাম্বারটা দেখতেই তার কপালে ভাজ পড়ে। চেহারায় অদ্ভুৎ উদ্বেগ ফুটে উঠে। দ্রুত কলটা রিসিভ করে কানে চেপে ধরতেই অপরপাশ হতে এক পুরুষ তীব্র উৎকণ্ঠা মিশ্রিত স্বরে বলে উঠে,

“ স্যার। মিস বাণীর এপার্টমেন্টে সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়েছে। আগুনে দাউদাউ করছে। মিস বাণী আর বহ্নি… “

বাকিটা আর শুনতে পেলো না দূর্জয়। শপিং কমপ্লেক্সের ভেতর হতে বোমা বিস্ফোরণের তীব্র শব্দে চারিদিকটা ভারী হয়ে উঠে। মেজর শাহরিয়ার দূর্জয় থমকে রইলো। বিচক্ষণ মস্তিষ্ক শূন্য তখন তার। অদ্ভুৎ ভাবে সারা শরীর টলে উঠলো। পাশ ঘেঁষে দৌড়ে যাওয়া এক সৈন্যের ধাক্কায় ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেলো। দূর্জয় নিষ্পলক স্ক্রিন চুরমার হয়ে যাওয়া ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকে। আচমকা উপলব্ধি করে সে গন্তব্য নিয়ে দোটানায় আছে। একজন সৈন্য হিসেবে এই শপিং কমপ্লেক্সের ভেতরের মানুষগুলো তার দায়িত্ব। অপরদিকে অন্য শহরে থাকা ওই মানুষ দুটোও তার অঘোষিত দায়িত্বের অংশ। কোনদিকে পা বাড়াবে সে? শক্ত মানব খ্যাত মেজর শাহরিয়ার দূর্জয় প্রথম বারের মতো নিজেকে চরম দিশেহারা আবিষ্কার করে।

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৯.

দু মাসের দুটো বাচ্চার কান্নায় ঘর তখন মুখোরিত। জমজ হওয়ার দরুণ এই একটা দারুণ কানেকশন রয়েছে তাদের মধ্যে। একজন কান্না শুরু করলে অপরজনও তার দুঃখে সামিল হতে তাল মিলিয়ে কান্না শুরু করে। কিন্তু তাদের এই গলা ফাটিয়ে কান্নায় সবথেকে নাজেহাল অবস্থা যার হয়, সে হলো বাচ্চা দুটোর মা এবং অফিসার শোভন মুহতাসিম চৌধুরীর স্ত্রী মধুমিতা। সে কাকে ফেলে কাকে ধরবে বুঝতে পারে না। তার শাশুড়ী মা সাদিকা বেগম নাতি নাতনির কান্না শুনেই রান্নাঘর থেকে দৌড়ে আসে। মধুমিতা তখন নিজের মেয়ে মহুয়াকে কোলে তুলে কান্না থামানোর চেষ্টায় মত্ত। সাদিকা বেগম নাতি সোহানকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,

“ ছেলেটা কখন ফিরবে? জানিয়েছে কিছু? “

মধুমিতা অভিযোগের সুর তুলে বলে,

“ আপনার ছেলে শপিং মলে গিয়েছে। ছেলে মেয়ের জন্য নাকি কি কিনবে। এরকম একটা আতঙ্কিত পরিস্থিতির মধ্যে বাহিরে থাকার কোনো মানে হয় আম্মা? “

সাদিকা বেগম পুত্রবধূর সাথে সুর মিলিয়ে বলে,

“ শান্তি দিবে না এরা আমাকে। এদের চিন্তায় তোমার শশুর আর আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। এদের সেদিকে ধ্যান নেই। “

নিচ থেকে তখন ঘরের কর্তা আফজাল সাহেবের আওয়াজ ভেসে আসে। সে গলা উঁচু করে ডাকছে,

“ পার্থর আম্মা! “

সাদিকা বেগম মৃদু রাগ দেখিয়ে বলে,

“ এই লোকটাও আমাকে শান্তি দিলো না। দেখলো নাতির কাছে এসেছি। এখন ডাকার কোনো মানে হয়? “

মধুমিতা মৃদু হেসে বলে,

“ হয়তো আব্বার কিছু লাগবে। আপনি একটু বাচ্চাদের কাছে বসুন মা। আমি দেখে আসছি। “

মহুয়া ও সোহানকে শাশুড়ীর পাহারায় রেখে মধুমিতা নিচে যায়। লিভিং রুমের কাছে যেতেই তার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। আফজাল সাহেবের মনযোগও তখন টিভিতে চলমান নিউজের পানে। হেডলাইনে তখন বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা ‘এইমাত্র পাওয়া খবর। রাজধানীর বসুমতী শপিং কমপ্লেক্সে আতঙ্কবাদীদের হামলা। শপিং মলের ভেতর থেকে ভেসে আসছে গোলাগুলির শব্দ।’

মধু অস্ফুটে বলে উঠে,

“ আপনার ছেলে এই শপিং মলে আছে আব্বা। আরো একবার… “

আফজাল সাহেব পুত্রবধূর কথা শুনে বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয়। পরপর এলোমেলো হাতে ছোট ছেলের নাম্বার ডায়াল করে। অপর পাশ হতে কলটা রিসিভ হয় না। আফজাল সাহেব দ্রুত নিজের বড়ো ছেলের নাম্বারে কল করে। এবার মুহুর্তের মধ্যেই কল রিসিভ হয়। আফজাল সাহেব এলোমেলো নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ তোমার ভাই ওই শপিং মলটায় আছে, যেখানে হামলা হয়েছে। ভাইকে যেভাবে পারো বাড়ি ফিরিয়ে আনো। “

__________

দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেড়ে ভাতঘুম দিয়েছিলো জেসি। আচমকা কানের কাছে তীব্র চেঁচামেচিতে তার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম কাতুরে ফোলা ফোলা চোখ মেলে তাকিয়ে সে দেখে ভাবী তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে কেমন চিন্তার রেশ লেপ্টে আছে। জেসির ঘুম তড়াক করে উধাও হয়ে যায়। সে বালিশ ছেড়ে উঠে বসে প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে ভাবী? “

চারু বলে,

“ টিভিতে নিউজ দেখাচ্ছে। ঢাকার কোন শপিং মলে নাকি হামলা হয়েছে। সেনাবাহিনীরা ওখানে পৌঁছেছে। প্রত্যয়ও ওই সেনাদের মধ্যে আছে। “

জেসি অবাক হয়। বিস্মিত গলায় বলে,

“ ও ঢাকায় আছে? “

জেসির থেকেও বেশি অবাক হয় চারু। পাল্টা প্রশ্ন করে,

“ তুমি জানো না? এই কয়দিন তোমাদের কথা হয় নি? “

জেসি কেবল ডানে বামে মাথা নাড়ায়। চারু চরম বিরক্ত হয়। সে কাকে খবর দিতে এসেছে? যে কিনা নিজের ভবিষ্যৎ বাগদত্তা কোথায় আছে সেই খবরটা পর্যন্ত জানে না! চারু বিরক্তিকর মুখ নিয়ে বলে,

“ তুমি ঘুমাও। তোমার কিসের চিন্তা! ছেলেটার বেঁচে ফেরার জন্য আমাদের দোয়াই যথেষ্ট। “

বলেই চারু রুম থেকে চলে যায়। জেসি চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে। ভাবী তার উপর এরকম চটে গেলো কেনো? ওই ছেলেটা যেহেতু একজন আর্মি, সেহেতু এসব সিচুয়েশনে পড়াটা ওর জন্য স্বাভাবিক বিষয়। এতে জেসির কি দোষ? সে কি ওই প্রত্যয়কে বলেছে যে তুমি আর্মি হও? জেসি বিরক্তিতে বলে,

“ হাও রুড! “

বলেই সে বালিশ দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়ে। একটু পর নিজেই আবার উঠে বসে। ঘুম আসছে না আর। অস্থিরতা আর টেনশন হলো একটা ছোঁয়াচে রোগ। এইযে ভাবী এইমাত্র এসে টেনশনের বীজ জেসির ভেতর রোপণ করে দিয়েছে। এখন জেসির অস্থির অস্থির লাগছে।

সে অস্থিরতা নিয়েই ফোনটা হাতে নেয়। কি মনে করে যেনো গ্যালারিতে প্রবেশ করে। স্ক্রল করে কিছুটা নিচে যেতেই চারমাস আগের কিছু ছবি তার সামনে আসে। সেদিনকার ছবি যখন প্রত্যয় নামক ছেলেটা প্রথম তাকে দেখতে এসেছিলো।

কি নিখুঁত হাসি মুখে ফুটিয়ে ভদ্র ছেলে সেজে জেসির আব্বু আর ভাইয়ার পাশে বসে আছে। চেহারা দেখে বুঝা যায় ছেলেটা একটা মিচকে শয়তান? পরমুহূর্তেই জেসির ফরহাদের বলা কথাগুলো মনে পড়ে যায়। সে ছবি কিছুটা জুম করে প্রত্যয়ের চেহারা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকে। আনমনে বলে উঠে,

“ মেবি ইউ আর নট রং ওর মেবি আ’ম নট রাইট। “

পরপর সে প্রত্যয়ের নাম্বারে একটা ছোট খুদেবার্তা পাঠায়,

“ আব্বুর অতি পছন্দের সুপাত্র,
স্টে সেফ। “

__________

তীক্ষ্ণ বোমা বিস্ফোরণের শব্দে সবার কান ঝিম ধরে আসছে। সৈন্যরা একতলা একতলা করে চেক করে উপরের দিকে এগিয়ে আসছে। চতুর্থ তলায় পৌঁছাতেই সৈন্যের দল দূর হতে দেখে পিলারের আড়াল হতে সিভিল ইউনিফর্ম পরিহিত একজন পুলিশ অফিসার নিজের পিস্তলের জোরে একা দু’জন আতঙ্কবাদীকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সৈন্যদের মধ্যে একদম সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটা ইশারা দিতেই সৈন্যদল দু ভাগে বিভক্ত হয়ে দুটো ভিন্ন রাস্তা ধরে চলে যায়। এদের এক দল উল্টো পথ দিয়ে ঘুরে এসে আতঙ্কবাদীদের মোকাবেলা করবে। আর বাকি একদল উপরের ফ্লোর গুলোয় যাবে।

দুটো দল প্রস্থান করতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটা অতি কৌশলে এক একটা পিলারের পিছনে আড়াল হয়ে পৌঁছে যায় অফিসার শোভন মুহতাসিম চৌধুরীর কাছে। আড়াল হতে আতঙ্কবাদীদের উদ্দেশ্যে গুলি ছুড়তে ছুড়তে শীতল স্বরে বলে,

“ লং টাইম নো সি অফিসার শোভন। “

শোভন অবাক হয়ে পাশ ফিরে তাকায়। পরপর উজ্জ্বল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

“ অবশেষে আমাদের আবার দেখা হয়েই গেলো মেজর। “

দূর্জয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আতঙ্কবাদীদের দিকে স্থির রেখেই বলে উঠে,

“ নিচে অল ক্লিয়ার। আপনি চাইলে আমি ব্যাক আপ দিয়ে আপনাকে এস্কালেটর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারি। ইউ ক্যান গো হোম। “

শোভন আত্মবিশ্বাসের সুরে বলে,

“ বাসায় অবশ্যই ফিরবো। পরিবার অপেক্ষায় আছে। তবে আগে অসভ্য গুলোর শেষ দেখতে চাই। “

দূর্জয় আর কিছু বলতে পারে না। তার হাত আপনাআপনি কাজ করলেও মস্তিষ্কটা এখনো কাজ করছে না। ফিরতে তো তার-ও হবে। দুটো মানুষের অবস্থা জানার জন্য তার ফিরতে হবে। মানুষ দুটো আদৌ বেঁচে আছে নাকি সেই খবরটুকুও দূর্জয়ের জানা নেই। সেই সুযোগটুকুও পেলো না। বেছে নিলো নিজের দেশের প্রতি দায়িত্বকে। আর ওই দুটো মানুষকে আল্লাহর ভরসায় উনার আমানতে ছেড়ে দিলো। কিছু ঘন্টার অপেক্ষা শুধু!

__________

সাইফ, সাদাত, জুনায়েদ ও প্রত্যয় দ্বিতীয় দলের অংশ। তারা পঞ্চম তলা পাড় করে ষষ্ঠ তলায় এসে পৌঁছাতেই দেখে চারিদিকটা ফাঁকা। কেবল একটা আউটলেটের ভেতর থেকে ভেসে আসছে মৃদু গুঞ্জনের এবং ফোপাঁনোর শব্দ। সাইফরা সেদিকে আগায়। একটা বিশাল ম্যানস শু কালেকশনের আউটলেটের ভেতর লুকিয়ে আছে প্রায় পঞ্চাশের অধিক সাধারণ মানুষ। উপরের তলা গুলো থেকে ভেসে আসছে বোমা বিস্ফোরণের শব্দ। নিচের তলা থেকে ভেসে আসছে গোলাগুলির শব্দ। এরা সবাই কোনো পথ খোলা না পেয়েই বাধ্য হয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু সৈন্যদের দেখতেই সবার চোখে আশার আলো ফুটে উঠে।

সাইফ পরিস্থিতি আন্দাজ করে দ্রুত নিজের হ্যান্ডহেল্ড ট্রান্সিভারটা কানেক্ট করে বলে,

“ ডুমস ফোর কলিং। “

ট্রান্সিভারের অপর পাশ হতে শীতল স্বরটা ভেসে আসে,

“ ডুমস ওয়ান হেয়ার। “

“ স্যার, সিক্সথ ফ্লোরে পঞ্চাশ জনের অধিক সিভিলিয়ান আছে। দেই আর নট সেফ হেয়ার। উপরের ফ্লোরের আতঙ্কবাদীরা এনিটাইম এই ফ্লোরে এসে পৌঁছাবে। “

দূর্জয় দ্রুত আদেশ বর্তায়,

“ ইমারজেন্সি স্টের ওয়ের পথটা সেফ। আমি এদিকে কাভার করছি। দ্রুত সবাইকে স্টের ওয়ে ধরে নিচে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। “

“ রজার দ্যাট স্যার। “

সাইফ ট্রান্সিভারটা রেখে নিজের দলের সদস্য সংখ্যার দিকে তাকায়। সে সহ পুরো দশজন সৈন্য আছে। সাইফ দ্রুত প্ল্যান কষে নিচু গলায় সবার উদ্দেশ্যে বলে,

“ আপনাদের সেফলি এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হবে। ইমারজেন্সি স্টের ওয়ে ধরে আপনারা নিচে যাবেন। একটুও শব্দ করবেন না দয়া করে। আমাদের চারজন সৈন্য আপনাদের সেফটি নিশ্চিত করার জন্য সঙ্গে যাবেন। প্লিজ কো অপারেটর উইথ দেম। আর হট্টগোল না করে সবাই একটা সিকুয়েন্স মেইনটেইন করে দাঁড়ান। মহিলা আর বাচ্চাদের মাঝখানে যায়গা দিন। পুরুষরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যান। অর্ধেক সামনে থাকুন, বাকি অর্ধেক পিছনে থাকবেন। “

বাঁচার আশায় কেউ টু শব্দ করলো না। মুহুর্তেই সবাই সাইফের কথা মতো সিকুয়েন্স মেইনটেইন করে দাঁড়িয়ে পড়ে। সাইফ জুনায়েদ এবং সাদাত সহ আরো দু’জন সৈন্যকে সিভিলিয়ানদের নিচে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটা বুঝিয়ে দেয়। সাদাত যাওয়ার আগে কেবল বলে,

“ ছয়জন যথেষ্ট হবে? তোরা সামলে নিতে পারবি? “

সাইফ আত্মবিশ্বাসের সুরে বলে,

“ উই আর মোর দ্যান এনাফ। “

জুনায়েদ বলে,

“ হোল্ড অন। সবাইকে নিচে পৌঁছে দিয়ে আমরা দ্রুত ফিরে আসবো। “

সিভিলিয়ানদের নিয়ে সাদাতরা প্রস্থান করতেই সাইফরা উপরের ফ্লোরের দিকে রওনা হয়। নিচের ফ্লোর গুলোর মানুষরা দ্রুত বেরিয়ে যেতে পারলেও উপরের ফ্লোরের মানুষ গুলো আটকা পড়েছে। তাদের উদ্ধার করার উদ্দেশ্যেই সৈন্যরা পা বাড়ায়।

__________

নিশার বুক কাঁপছে। টিভির দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছে সে। আব্বুর মুখে যখন শুনলো ঢাকায় এট্যাকের খবর তখন থেকেই অদ্ভুৎ এক ভয় আর শূন্যতা তাকে জেঁকে ধরেছে। সেই ভয়ের রেশ ধরেই সে সাইফকে কল করেছিলো। সেই মলে প্রবেশের পূর্বে মানুষটাকে জানিয়েছে যে সে অপেক্ষায় থাকবে। ছন্নছাড়া, লাগামহীন মানুষটা কি নিশার উৎকণ্ঠা বুঝতে সক্ষম হয়েছে? সে কি বুঝেছে নিশা কতটা কাতর হয়ে পথ চেয়ে আছে?

গত ক’টা দিন নিশার মনে যে ভূমিকম্প বয়ে গিয়েছে সম্পর্কে কি তার ধারণা আছে কোনো? নিশা ভেবে রেখেছিলো মানুষটা ফিরলে সে মুখোমুখি কথা বলবে। কিন্তু পরিস্থিতির জন্য তার আর তর সইলো না। আজই কল করে সাইফকে জানিয়ে দিলো সবটা। ছোট বাক্যে, ছোট পরিসরে।

নাঈমা অবাক হয়ে মেয়ের চিন্তিত মুখশ্রী পরখ করছে। জুলফিকার চট্টগ্রামের বাহিরে যাবে বলে নিশাকে সে ক’টা দিনের জন্য নিজের কাছে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এখানে আসার পর থেকেই সে মেয়ের মধ্যে অদ্ভুৎ এক অস্থিরতা টের পাচ্ছে। আর আজ তো তার মেয়ে আরো বেশি অদ্ভুৎ আচরণ করছে। বিকেল বেলা থেকে টিভির সামনে থেকে সরছেই না। ছলছল করা চোখ দিয়ে যেকোনো সময় অশ্রু গড়িয়ে পড়বে।

নাঈমা মেয়ের কাধে হাত রেখে বলে,

“ এই নিশা! কান্না করে দিবে মনে হচ্ছে। কি হয়েছে? “

নিশা মায়ের দিকে তাকায় করুণ মুখ করে। জানতে চায়,

“ আব্বু যখন মিশনে যেতো তখন তুমি কিভাবে শান্ত থাকতে আম্মু? “

নাঈমা অবাক হয়। পরমুহূর্তে তার মনে পড়ে যায় অতীত। জুলফিকার যখন মিশনে থাকতো, তখন কি বিভৎসকর দিন-ই না পাড় করতে হয়েছে তার! সেই দিনগুলো এখন কেবল অতীত। নাঈমা নরম গলায় বলে,

“ আব্বুর জন্য চিন্তা হচ্ছে? “

নিশা আনমনে বলে উঠে,

“ আরেকজনের জন্যও। “

নাঈমা অবাক হয়ে জানতে চায়,

“ কে? “

নিশা সম্বিত ফিরে পায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

“ দূর্জয় ভাইয়া। “

নাঈমা আর ঘাটায় না বিষয়টা। সে মনে মনে কেবল দোয়া করে সৈন্যরা সকলেই যেনো অক্ষত অবস্থায় নিজ নিজ নীড়ে ফিরে যেতে পারে।

__________

অষ্টম তলায় তিনজন আতঙ্কবাদী ছিলো। তাদের দলে আরো দু’জন ছিলো। তারা উপরের ফ্লোর গুলোতে সফলভাবে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ করতে সক্ষম হয়েছে। এই অষ্টম তলায় বোমা বিস্ফোরণ করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য এখন। এই ফ্লোরে বেশ অনেকজন সিভিলিয়ানই আছে। সবাই কোথাও না কোথাও লুকিয়ে আছে। লুকানো ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার তাড়া নেই তাদের মধ্যে। বোমা বিস্ফোরিত হলে আশেপাশে লুকিয়ে থাকা একজনও বাঁচবে না। সবাই মরবে। একসঙ্গে মরবে।

তিনজন আতঙ্কবাদী তিনটা ভিন্ন পয়েন্টে দাঁড়িয়ে যখন নিজেদের হাতের রিমোট চাপতে প্রস্তুত ঠিক সেই মুহুর্তে ছয়জন সৈন্য সুকৌশলে পিছন থেকে এসে তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে।

সাইফ যার উপর ঝাপিয়ে পড়েছে সে এক আত্মঘাতী বোমার পোশাক পরিধান করেছিলো। হাতে ছিলো তার রিমোট। রিমোটের লাল রঙা বাটনটায় চাপ দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অবিরত। সাইফ একহাতে সেই আতঙ্কবাদীর ঘাড় পেঁচিয়ে ধরে রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“ নট ইয়েট চান্দু। আজকে একদমই মরার মুড নেই আমি। বউ এক কবুল বললো আজ। বাকি দুই কবুল না শুনে তাকে কিভাবে বিধবা হতে দেই? “

কথাটুকু বলেই অপর হাতের সাহায্যে সেই যুবকের হাতের রিমোটটা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় সাইফ। অত:পর রিমোটটা দূরে ছুড়ে ফেলেই সেই যুবককে নিজের দিকে ফিরিয়ে এলোপাথাড়ি ঘুষি মারতে শুরু করে। নিজের শক্ত হাতের শক্তি দ্বারা মুহুর্তেই আতঙ্কবাদীর মুখের নকশা বদলে দেয়।

ঠিক সেই মুহুর্তেই অষ্টম তলার অন্য প্রান্তে একটা বিকট বিস্ফোরণ হয়। সাইফ সহ সকলেই সেদিকে চমকে তাকায়। তাদের থেকে ঠিক আনুমানিক পঞ্চাশ/ষাট হাত দূরে যেই আতঙ্কবাদী ছিলো বিস্ফোরণটা তার মাধ্যমেই হয়েছে। সাইফ এক ঘুষিতে সেই অর্ধ চেতনাহীন আতঙ্কবাদীকে অজ্ঞান করে এলোমেলো দৃষ্টি মেলে চারিপাশে তাকায়। দ্বিতীয় আতঙ্কবাদীর শিওরে দু’জন সৈন্য আছে। বাকি একজন সৈন্য ওয়াশরুম এরিয়ার ধারে সিভিলিয়ানদের খুঁজতে ব্যস্ত। নেই কে? চকিতে সাইফের মস্তিষ্কে দুটো নাম আলোড়িত হয়। তাদের সঙ্গে আসা ব্যাক আপ টিমের হারুন এবং প্রত্যয়!

মুহুর্তেই থমথমে হয়ে গেলো সাইফের মুখ। সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট। ধোঁয়ার ভীড়ে লুকিয়ে আছে দুটো মানুষের জীবন প্রদীপের সত্যতা।

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৫০.

চতুর্থ তলায় উপস্থিত আতঙ্কবাদীদের অস্ত্র শক্তি ধূলিসাৎ করে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়ের আওতায় পরিচালিত সৈন্যদল। অফিসার শোভন মুহতাশিম চৌধুরীর মুখে তখন জয়ের হাসি। দূর্জয়ের পানে তাকিয়ে তিনি বলেন,

“ সফল হয় নি মেজর। আমরা হতে দেই নি। “

দূর্জয় মলিন স্বরে বলে,

“ আলহামদুলিল্লাহ। “

সিভিলিয়ানদের নিচে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত চারজন লেফটেন্যান্ট তখন চতুর্থ তলায় এসে উপস্থিত হয়। তাদের দেখে দূর্জয় জানতে চায়,

“ সবাইকে সেফলি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে? “

সাদাত স্পষ্ট গলায় বলে,

“ ইয়েস স্যার। “

দূর্জয় এবার শোভনের পানে তাকিয়ে বলে,

“ পুলিশ ফোর্স বাহিরে অপেক্ষারত আছে অফিসার। আমাদের উপরে যেতে হবে। ইউ শুড গো ব্যাক টু ইউর ফ্যামিলি নাও। “

শোভন মৃদু হাসে। হেসে মাথা নেড়ে দূর্জয়ের দিকে হাত বাড়ায়। নিজের বুকের অস্থিরতা চেপে দূর্জয়ও হাত বাড়ায়। হাতে হাত মিলিয়ে প্রস্থানের পূর্বে অফিসার শোভন মুহতাশিম চৌধুরী বলে,

“ মেজর, বিদায় মুহুর্তে আপনি যেনো কি বলেন সবসময়? “

দূর্জয় মৃদু ভ্রু কুচকে রয়। তার মস্তিষ্ক মনে করতে পারছে না। কি বলে সে? শোভন কিছুটা মনে করার চেষ্টা করে প্রফুল্ল গলায় বলে উঠে,

“ ওহ ইয়েস! মে আওয়ার কান্ট্রি লিভ লং। “

দূর্জয় ম্লান হেসে নিজেও বলে,

“ মে আওয়ার কান্ট্রি লিভ লং। “

অফিসার প্রস্থান করতেই দূর্জয় দুইজন সৈন্যকে বলে নিহত দুই আতঙ্কবাদীর কাছে থাকতে। আর বাকিদের নিজের সঙ্গে আসার জন্য ইশারা দেয়।

বুট শু পরিহিত শক্ত পায়ের দাপুটে আওয়াজে চলন্ত এস্কেলেটরটা মৃদু কেপে উঠে। দূর্জয়রা যখন ষষ্ঠ তলায় পৌঁছায় ঠিক সেই মুহুর্তে আচমকা অষ্টম তলা হতে বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে। বিকট সেই শব্দ। সকলে এক মুহূর্তের জন্য থামে। হতবিহ্বল হয়ে একে অপরের মুখ পানে চায়। অত:পর একপ্রকার দৌড়ে দ্রুত অষ্টম তলায় পৌঁছায়।

অষ্টম তলার যে পাশটায় বিস্ফোরণ ঘটেছে সেদিকে সৈন্যদের হৈ চৈ। বিস্ফোরণের ফলে সম্পূর্ণ একটা স্টোরের অনেকাংশ ধ্বসে পড়েছে। ধোঁয়ার ফলে তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবুও সৈন্যরা নিজেদের দুই সাথীকে খুঁজে ফিরতে ব্যস্ত।

দূর্জয়রা অষ্টম তলায় এসে উক্ত পরিস্থিতি দেখে স্তব্ধ বনে যায়। রাফি জানতে চায়,

“ কি হয়েছে? “

সাইফ এলোমেলো গলায় বলে,

“ প্রত্যয় আর লেফটেন্যান্ট হারুন আতঙ্কবাদীর সাথে ছিলো। বিস্ফোরণ হয়েছে। “

দূর্জয় এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না। মুখে রুমাল বেঁধে দ্রুত এগিয়ে যায় ধোঁয়ার ভেতরে। তার দেখাদেখি বাকিরাও একই কাজ করে। কেউ রুমাল বেঁধে, কেউবা নাক মুখ খোলা রেখেই। ধোঁয়ার তীব্রতা কিছুটা কমে আসতেই ফারদিন ধ্বংস স্তুপের মধ্যে একটা দেহ দেখতে পায়। সে চিৎকার করে উঠে। সকলে এগিয়ে আসে। রক্তাক্ত সেই দেহ। জীবিত নাকি মৃত বুঝার সাধ্যি নেই। জুনায়েদ এগিয়ে গিয়ে দেহটাকে জাপটে ধরে। চেঁচিয়ে ডাকে,

“ মেডিক্যাল হেল্প প্লিজ! “

দূর্জয় ফাঁকা মস্তিষ্ক নিয়ে দেহটা দেখে। লেফটেন্যান্ট হারুনের দেহ। গুরুতর অবস্থা উনার। তার কাছেই রয়েছে নিথর আতঙ্কবাদীর দেহ। বিস্ফোরণের সময় সে আতঙ্কবাদীর নিকটে ছিলো বলেই হয়তো ক্ষয়ক্ষতির ভারটা বেশি সইতে হয়েছে।

সবাই যখন লেফটেন্যান্ট হারুনকে স্ট্রেচারে তুলতে ব্যস্ত সেই মুহুর্তে সাইফ অস্থির হয়ে চারিদিকে প্রত্যয়কে খুঁজতে থাকে। আউটলেটের দ্বার প্রান্তে তখনও সাদা কালো ধোঁয়ার মেলা। সেই ধোঁয়ার মধ্যে থেকেই কারো চাপা আর্তনাদ ভেসে আসে। সাইফ চকিতে সেই পানে তাকায়। এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে সেদিকে এগিয়ে যায়।

একটা বিশাল সাইনবোর্ডের নিচে চাপা পড়ে আছে অর্ধেক দেহ। ডান পা টা বেকায়দায় আটকে আছে। চোখ মুখ কুচকে ব্যথায় চাপা আর্তনাদ করছে প্রত্যয়। দৃশ্যটুকু স্পষ্ট হতেই সাইফ চেঁচিয়ে উঠে। কাছে গিয়ে একা হাতে সেই সাইনবোর্ড টেনে তোলার চেষ্টা করে। ধাতব সাইনবোর্ডটা আকারে বেশ বড় এবং ওজনে অত্যাধিক ভারী হওয়ায় সাইফ প্রথম চেষ্টায় তা তুলতে পারে না। দ্বিতীয় দফায় চেষ্টা করতে নিবে সেই মুহুর্তে দেখে চারিদিক থেকে আরো পাঁচ জোড়া হাত এগিয়ে এসেছে সাহায্যর জন্য। সাইফ চোখ তুলে পাঁচ জোড়া হাতের মালিকের পানে তাকায়। দূর্জয়, সাদাত, রাফি, জুনায়েদ ও ফারদিনকে দেখে ভরসা খুঁজে পায়।

‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’ উক্তিটাকে সত্য প্রমাণ করে ছয়জন মিলে সাইনবোর্ডটা তুলে দূরে ছুড়ে ফেলে। প্রত্যয়ের কাছে এগিয়ে যায়। সাইফ প্রত্যয়ের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নেয়। কপালের একপাশ ফেটে রক্ত ঝরছে। শরীরটা কেমন নেতিয়ে পড়েছে। চেতনা তখন আধো আধো আছে। সাদাত ডাকে,

“ প্রত্যয়! শুনতে পাচ্ছিস ভাই? “

প্রত্যয় অস্ফুটে বলে,

“ আমার পা। “

রাফি চিন্তিত স্বরে শুধায়,

“ পা ব্যথা করছে? “

“ অনুভব করতে পারছি না কিছু। “

সবাই ভীতিকর দৃষ্টি মেলে একে অপরের দিকে তাকায়। ততক্ষণে আরেকটা স্ট্রেচার এসে হাজির। দূর্জয় শীতল গলায় বলে,

“ ভারী সাইনবোর্ড পায়ের উপর ছিলো, তাই হয়তো নাম্ব ফিল করছে। হসপিটাল নিয়ে যেতে দাও। কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ। “

__________

ঘড়ির কাটা অলস ভঙ্গিতে চলছে। লিভিং রুমে একত্রিত হয়ে বসে আছে গোটা পরিবার। দৃষ্টি তাদের টেলিভিশনের পানে স্থির। নিজের রুমের দরজার সামনে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা রমণী দূর হতে দেখছে সেই দৃশ্য। সামনে যাওয়ার সাহস করছে না ভুলেও। গেলেই মা আর ভাবী সবার আগে তার পিঠে তবলা বাজাবে। দুমাদুম কিল ঘুষিও পড়তে পারে!

ফোনটা চিৎকার করে বেজে উঠতেই জাঈদ এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে ফোনটা রিসিভ করে। সবাই উদগ্রীব হয়ে জাঈদের পানে তাকিয়ে থাকে। জাঈদ ফোন রেখে মুখটা থমথমে করে রয়। চারু চিন্তিত স্বরে জানতে চায়,

“ কি বলেছে আংকেল? প্রত্যয়ের কোনো খবর পাওয়া গিয়েছে? “

“ বিস্ফোরণ হয়েছে। ইঞ্জুরড। হসপিটালে নেওয়া হয়েছে। “

মেয়ের জন্য পছন্দ করা সুপাত্রের ব্যাপারে এমন একটা করুণ খবর জানতে পেরে আলাউদ্দিন সাহেব আহত হয়। বন্ধুর প্রতিও সহমর্মিতা অনুভব করেন। বন্ধু নিজের মনের কথা প্রায়ই আলাউদ্দিনের সাথে আলাপ করেন। এক পুত্রশোকই এখনো কাটিয়ে উঠতে পারে তিনি লোকটা। এই পরিস্থিতিতে নিশ্চয়ই খুব ভেঙে পড়েছে?

আলাউদ্দিন সাহেব স্থির থাকতে পারেন না। উদ্বেগ মিশ্রিত স্বরে বলে,

“ আমি ঢাকা যাবো জাঈদ। এয়ার টিকিটের ব্যবস্থা করো। নেক্সট ফ্লাইটেই যেতে চাচ্ছি। “

জাঈদ অমত জানায় না। আগামীকাল তার খুব গুরুত্বপূর্ণ বিজনেস মিটিংটা না থাকলে সে-ও এই মুহুর্তে আব্বুর সাথে যেতো। আলাউদ্দিন সাহেব রেডি হওয়ার জন্য রুমের ভেতর যেতে নিবে ঠিক সেই মুহুর্তে বাড়ির ছোট মেয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে লিভিং রুমে এসে উপস্থিত হয়। অদ্ভুৎ অধিকারবোধ মিশিয়ে বলে,

“ আমিও আব্বুর সাথে যাবো। আমার জন্যও একটা টিকিট বুক করো ভাইয়া। “

আলাউদ্দিন সাহেব মেয়ের দিকে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। পুত্রবধূর কাছে মেয়ের অসামাজিকতা এবং কাণ্ডজ্ঞানহীনতা সম্পর্কে জেনেছেন তিনি। আর জানার পর থেকেই তিনি মেয়ের প্রতি অসন্তুষ্ট। তবুও তিনি কথা না বাড়িয়ে বলেন,

“ জাঈদ, তোমার বোনের জন্যও টিকিটের ব্যবস্থা করো। “

__________

চারপাশে মৃদু ফিনাইলের গন্ধ। এয়ারকন্ডিশনের আওতাভুক্ত স্থানে থেকেও তিরতির করে ঘামছে সাইফ। অস্থির পায়ে ইমারজেন্সি এরিয়ার বাহিরে পায়চারি করছে। শুধু সে একা নয়। আরো চার জন সৈন্যও একই অস্থিরতার ভেতর সময় পাড় করছে। করিডর হয়ে হেঁটে যাওয়া প্রতিটা মানুষই ঘুরে ঘুরে বারবার তাদের দেখছে। আচমকা ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই সাইফ পকেট থেকে ফোনটা বের করে। স্ক্রিনে নামটা দেখতেই দ্রুত সবার অগোচরে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসে। কলটা রিসিভ করে কানে ধরতেই আতঙ্কিত রমণী শুধায়,

“ ঠিক আছেন আপনি? “

সাইফ চোখ তুলে একবার চারিপাশে তাকায়। চারিপাশে কেমন দুঃখ দুঃখ ভাব মিশে আছে। হসপিটাল প্রাঙ্গণ বলে হয়তো! সাইফ ধীমি স্বরে বলে,

“ ঠিক আছি। “

“ আব্বুর সাথে কথা হয়েছে মাত্র। আলহামদুলিল্লাহ সিভিলিয়ানরা ঠিক আছে। চিন্তা করবেন না প্রত্যয় ভাইয়াও ঠিক হয়ে যাবে। “

সাইফ এবার মাথা তুলে আকাশের পানে তাকায়। মেয়েটা হয়তো জানে না এই মিশনে একজন লেফটেন্যান্ট শহীদও হয়েছে। লেফটেন্যান্ট হারুন। অবশ্য কেউই হয়তো এখনো জানে না এই ব্যাপারে। কিছুক্ষণ পূর্বে ইমারজেন্সি ইউনিট থেকে বেরিয়ে আসা ডক্টর সাইফদের এই ব্যাপারে নিশ্চিত করেছেন।

ফোনের অপর পাশ হতে নিশা নিজেই আবার বলে,

“ আপনি কি ক্লান্ত? “

বিষন্নতায় মোড়ানো পরিবেশের মধ্যে এই তিন বাক্যের প্রশ্নতে সাইফ সুখ খুঁজে পায় আচমকা। সে কোমল স্বরে বলে,

“ আমি সুখী ইয়াসমিন। আপনি আজকাল সুখ হয়ে ধরা দিচ্ছেন। আমার ছন্নছাড়া জীবনের সুখ হওয়ার জন্য আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। “

__________

রাত তখন সাড়ে আটটার কাটা পেরিয়েছে কেবল। ব্যস্ত নগরীর শান্ত রাস্তার ধারে গাড়ি এসে থামে। গাড়ি হতে নেমে আসে প্রায় চার ঘন্টা নিঃশ্বাস আটকে বসে থাকা মানুষটা। মস্তিষ্কটা তার তখনও ফাঁকা। আকাশপথে ঢাকা হতে চট্টগ্রাম রওনা দেওয়ার পূর্বেই সে কাঙ্ক্ষিত খবরটুকু পেয়েছে। তবুও পুরোটা সময় হৃৎপিণ্ড একপ্রকার হাতে নিয়েই বসে ছিলো সে।

পথের ধারে পিচ ঢালা রাস্তা থেকে সামান্য উঁচু ফুটপাতে স্থবির হয়ে বসে থাকা মানবীকে দেখে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সেই পানে। সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে। ক্লান্ত দেহী মানবী এতক্ষণ মাথা নিচু করে বসে ছিলো। সামনে কারো উপস্থিতি টের পেতেই সে চোখ তুলে তাকায়। থমথমে মুখের স্থির দৃষ্টি দেখতেই ফের চোখ নামিয়ে ফেলে।

দূর্জয় একটুও শব্দ করে না। কিছু বলেও না। কেবল হাত বাড়িয়ে বাণীর ঘাড়ে মুখ লুকিয়ে রাখা বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটা আতংকে কেপে উঠে। আরো শক্তপোক্ত ভাবে মা’কে জড়িয়ে ধরে। বাণী শান্ত গলায় বলে,

“ এখনো ভয় থেকে বের হতে পারে নি। “

দূর্জয় দমে না। আবারও হাত বাড়িয়ে বহ্নির মাথায় হাত রাখে। কোমল স্বরে ডাকে,

“ আমি মেজর। লুক এট মি বাচ্চা। দেখুন, ভয়ের কিছু নেই। “

বহ্নি মাথা তুলে তাকায় না। মায়ের কোলেই পড়ে রয়। শেষ অপরাহ্নে দেখা দৃশ্যটা এখনো তার ছোট মস্তিষ্ক প্রসেস করতে পারে নি। হাতে ব্যান্ডেজ করিয়ে, ওষুধ পত্র নিয়ে যখন মাম্মার সাথে ফিরে কেবল রিকশা থেকে নামলো ঠিক সেই মুহুর্তে বিভৎসকর ঘটনাটা ঘটেছে। চোখের সামনে বহ্নি দেখলো তাদের এপার্টমেন্টটা আগুনে দাউদাউ করে উঠলো। সেই সঙ্গে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ। আর তারপর… তারপর আর কিছুই বহ্নি বুঝতে পারে নি। বারবার ওই দুপুরের ঘটনাটাই তার চোখের সামনে প্লে হচ্ছে। আর সঙ্গে সঙ্গে সে ভয়ে সিটিয়ে যাচ্ছে।

দূর্জয় এবার বাণীর উদ্দেশ্যে বলে,

“ চলো। “

বাণী ক্লান্ত স্বরে জবাব দেয়,

“ আমাকে আমার পরিস্থিতিতে ছেড়ে দাও। “

“ সরি বাট রাস্তার মাঝে ছেড়ে দিতে পারছি না। রেস্ট দরকার তোমাদের। সঙ্গে চলো। “

বাণী নড়ে না। উঠেও না। দূর্জয় বাধ্য হয়ে হাত বাড়িয়ে বহ্নিকে কোলে তুলে নেয়। বহ্নি ভয়ে গুটিয়ে যেতে নিলেই সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা বুকে চেপে ধরে বলে,

“ ইট’স ওকে, ইট’স ওকে। ভয় পাবেন না। আমি। “

বহ্নি আশ্বস্ত হলো কিনা বুঝার উপায় নেই। সে নীরব হয়ে আবার মুখ লুকায় দূর্জয়ের কাধে। বহ্নিকে কোলে নিয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দূর্জয় অপর হাত বাড়িয়ে দেয় বাণীর দিকে। সেই বাড়ানো হাতে বিন্দুমাত্র সংকোচ কিংবা অস্বস্তি নেই। এই দুটো মানুষের চিন্তায় ঘন্টা খানেক আগেও দূর্জয়ের শ্বাস আটকে ছিলো। বিশাল একটা মিশন চলাকালীন সম্পূর্ণ সময়টায় মস্তিষ্ক জুড়ে এই দুটো মানুষের আধিপত্য ছিলো। অদ্ভুৎ সেসব অনুভূতি! অদ্ভুৎ সব হিসাব! সেসব নাহয় দূর্জয় পরে মেলাবে।

দূর্জয়ের বাড়ানো হাতের দিকে ফিরে তাকালো না বাণী। নিজের জায়গায় অনড় রইলো। দূর্জয় ডাকে,

“ চলো বাণী। “

কারো মুখে নিজের নামটুকু শুনে বাণীর চেপে রাখা দলা পাকানো অনুভূতিরা যেনো আশকারা পেলো। ঠেলেঠুলে তা অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসে। বাণী দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে। নিজেকে বড্ড দোষী মনে হচ্ছে। সকালে তাড়াহুড়োর করা ভুলের ফলে একটা লোকের সম্পূর্ণ প্রোপার্টিজ জ্বালিয়ে দিলো সে। কেবল বাড়িওয়ালার বাড়িটাই না, সেই সঙ্গে বাণীর মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে একটু একটু করে সাজিয়ে নেওয়া সুখ গুলোও আগুনে জ্বলে ছাঁই হয়ে গিয়েছে। একটা জীবনে আর কতবার তিক্ততার স্বাদ ভোগ করতে হবে তার?

দূর্জয়ের চোখেও নেমে আসে বেদনার ছায়া। সামনে বসে থাকা এই মেয়েটার জন্য আজকাল তার মায়া হয়। হুটহাট চিন্তাও হয়। সেই চিন্তার সঙ্গে দমবন্ধকর অনুভূতিও হয়। নিঃশ্বাসও রুদ্ধ হয়। দূর্জয় থমকায়। কিন্তু সেসব কিছু দূর্জয় পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থেকে। কিছু বলা হয় না। ঠিক যেমন এই মুহুর্তে সে বলার জন্য কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না। ঠিক কোন শান্তনাটা এই মেয়েকে দেওয়া যায় তা-ও তার মাথায় আসছে না।

দূর্জয় এবার নিজের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধীরে ধীরে বাণীর মাথায় রাখে আলতো করে। এইটুকু আশ্বাস বাণীর বেদনার সামনে খুব কম তা সে ভালো করেই জানে। তবুও সে নিজের হাতটা সরায় না। যদি মেয়েটা সামান্য ভরসা খুঁজে পায়! যদি মেয়েটা বুঝতে পারে সে কারো অঘোষিত দায়িত্বের তালিকায় নিজের নামটা লিখেছে! যদি মেয়েটা উপলব্ধি করে কখনো কখনো কংক্রিটেও গাছ জন্মায়! সেই গাছে ফুটে কোনো নাম না জানা ফুল।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]