এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-৫৬+৫৭+৫৮

0
250

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৫৬.

ফোনের ঘন্টাটা বেজে উঠতেই সিগারেটটা মুখ থেকে নামিয়ে তা রিসিভ করে সাইফ। কানে ধরতেই অপর পাশ হতে রিনঝিনে স্বর বলে উঠে,

“ এই, জানেন আজ কি হয়েছে? “

সাইফ নিঃশব্দে হেসে বলে,

“ না। বলুন ম্যাডাম, কি হয়েছে? “

ম্যাডাম সম্বোধনটা শুনতেই নিশা লজ্জায় মিইয়ে যায়। কোমল স্বরে বলে,

“ পোলাও রান্না শিখেছি আম্মুর কাছে। আগামীকাল রোস্ট রান্নাটাও শিখে ফেলবো। “

সাইফ অবাক হয়ে বলে,

“ আজ পোলাও, আগামীকাল রোস্ট। বিষয়টা বেমানান হয়ে গেলো না? “

“ একদিনে দুটো শিখতে গেলে আমি রেসিপিতে গন্ডগোল পাকাতাম। তা-ই আলাদা আলাদা দু’দিনে শিখবো। “

“ হঠাৎ আপনি পরীক্ষার পড়াশোনা বাদ দিয়ে রান্না শেখার তোড়জোড় করছেন কেনো, বলুন তো? “

নিশা আরেকদফা লজ্জা পায়। মুখ ফুটে বলতে পারে না যে আপনার জন্য শিখছি। বরং কথা ঘুরিয়ে বলে,

“ পরীক্ষার পড়াশোনা বাদ দেই নি তো। ক্লাসও মিস দিচ্ছি না, কোচিংও না। কেবল ফ্রি টাইমটা ইউটিলাইজ করছি। “

“ সেটা না-হয় বুঝলাম, কিন্তু রান্না কার জন্য শিখছেন? “

“ বেসিক লাইফ স্কিল হিসেবে শিখছি। “

সাইফের ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি। সে ঠাট্টার সুরে বলে,

“ ওহ রিয়েলি? “

নিশা লজ্জা পেয়ে বলে,

“ আপনাকে সব কথা স্পষ্ট করে বলতে হয়, তাই-না? নিজে বুঝে নিতে পারেন না? “

“ বুঝতে পারি। তবে মুখ ফুটে সব বলতে জানাটাও জরুরী। “

“ শুনুন না। আব্বু যদি আমাদের বিষয়টা জানতে পারে, তাহলে কি হবে? আর আম্মু? আম্মু তো আমাকে শূলে চড়াবে। “

“ এতো সহজ? নিশ্চিন্তে এক্সাম শেষ করুন। তারপর এডমিশন দিন। একবার ভর্তি হয়ে গেলে আমি-ই স্যার আর ম্যামের সাথে কথা বলবো। উনারা রাজি হয়ে গেলে আর প্রমোশনটা পেয়ে গেলেই আর বাধা থাকবে না কোনো। “

“ যদি রাজি না হয়? “

সাইফ ঠাট্টা করে বলে উঠে,

“ রাজি না হলে আপনাকে তুলে নিয়ে… “

কথাটা বলতে বলতেই সাইফ ঘুরে দাঁড়ায়। মুহুর্তেই সে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। অস্ফুটে বলে উঠে,

“ স্যার। “

নিশা ফোনের অপর পাশ থেকে বলে,

“ কি বলছেন? “

সাইফ আর অপেক্ষা করে না। সঙ্গে সঙ্গে কল কেটে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষকে দেখে এতক্ষণ সে হাতে থাকা সিগারেটটাও ফেলতে ভুলে যায়। খেয়াল হতেই সঙ্গে সঙ্গে তা মাঠে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলে। জুলফিকার কেমন শীতল দৃষ্টিতে সাইফের কর্মকান্ড দেখছে। তার মেজাজটা অত্যন্ত গরম। এই মাত্র নাঈমার সঙ্গে খুব সিরিয়াস একটা ঝগড়া হয়েছে তার। জুলফিকারের রাগের মাত্রাটা আরো বেশি কারণ ঝগড়ার সময় গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট গুলো তার মনে ছিলো না। কিন্তু এখন সেইসব পয়েন্ট গুলো তার মস্তিকে ঘুরপাক খাচ্ছে।

সাইফ তখন ভেতরে ভেতরে ঢোক গিলছে। হবু শশুর ঠিক কতক্ষণ ধরে তার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলো কে জানে! উপরওয়ালা এই কোন পরীক্ষা নিচ্ছে তার?

জুলফিকার গম্ভীর মুখ করে সাইফের পাশে এসে দাঁড়ায়। গলায় সামান্য ভার রেখে প্রশ্ন করে,

“ গার্লফ্রেন্ড? “

সাইফ বিব্রতকর গলায় মাথা নেড়ে বলে,

“ হ্যাঁ। আই মিন না। মানে হ্যাঁ… “

জুলফিকার ধমকে উঠে,

“ এরকম ম্যা ম্যা করছো কেন ছাগলের মতো? “

“ সরি স্যার। “

জুলফিকার আড়চোখে পরখ করে সাইফকে। এককালে জুলফিকারও এরকম সিচুয়েশন পাড় করে এসেছে। নাঈমার সাথে প্রেম করার ওই দিন গুলো। আহ! সিনিয়রদের কাছে ধরা খেয়ে কি লজ্জাই না পেতে হয়েছিলো তার! জুলফিকার সামান্য গলা ঝেড়ে বলে,

“ তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছি না। কিন্তু একটা উপদেশ দিচ্ছি তোমার ভালোর জন্য। একটা সুস্থ জীবন যদি চাও তাহলে কখনো কোনো মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়ে বিয়ে করো না। পালানোর সময় মেয়েটা ঠিকই হাওয়াতে গা ভাসিয়ে তোমার সঙ্গে যাবে। কিন্তু বিয়ের পর সারাটা জীবন তোমাকে এই বলে খোটা দিবে যে, তুমি তাকে ফুসলে নিয়ে বিয়ে করেছো। “

সাইফ বিস্মিত ভঙ্গিতে একবার স্যারের দিকে তাকায়। বোঝার চেষ্টা করে স্যার কি নিজের ব্যক্তিগত জীবন থেকে পাওয়া কোনো জীবনমুখী শিক্ষার বুলি আওড়াচ্ছেন? সাইফ কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে,

“ চিন্তা করবেন না স্যার। আমি উনার আম্মু আব্বু দু’জনকে রাজি করিয়েই বিয়ে করবো। আর তাছাড়া উনি খুব শান্ত আর লক্ষী টাইপ মেয়ে, একটু বোকা কিন্তু মানিয়ে নেওয়ার মতো। “

জুলফিকার বলে,

“ বাহ! প্রেমিকাকে আপনি করে বলো। আই লাইক দ্যাট। “

জুলফিকারের বলা শেষের কথাটা শুনে সাইফের মনে আশার প্রদীপ জাগে। সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বলে,

“ স্যার, একটা প্রশ্ন করি? “

“ কি প্রশ্ন? “

“ স্যার আমাকে আপনি মেয়ে জামাই হিসেবে কত পয়েন্ট দিবেন? আই মিন আমাকে উনার আব্বু আম্মু পছন্দ করবে তো? আপনার জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা থেকে কি মনে হয়? “

জুলফিকার সরু চোখে সাইফের পানে তাকায়। মুখে গাম্ভীর্য নিয়েই বলে,

“ সিগারেট আছে? “

সাইফ আরেক দফা বিব্রত অনুভব করে। ভবিষ্যৎ শশুর কি-না তার কাছে সিগারেট চাইছে? দিবে কি দিবে না ভাবতে ভাবতে সাইফ নিজের পকেট হতে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে। সেটা থেকে একটা সিগারেট বের করে জুলফিকারকে দিতেই জুলফিকার বলে,

“ লাইটার? “

সাইফ সঙ্গে সঙ্গে লাইটার বের করে জ্বালিয়ে ধরে। সিগারেটের মুখে আগুন ধরিয়ে তা দু ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরে জুলফিকার। মনের রাগ গুলো ধোঁয়ার সঙ্গে উড়িয়ে দিয়ে সে সন্ধ্যার আকাশ পানে তাকিয়ে বলে,

“ পাশ মার্ক। “

সাইফ অবাক হয়ে জানতে চায়,

“ মাত্র ৩৩ কেন স্যার? “

“ তোমার এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন এবং জবের জন্য এই পাশ মার্কটা পাবে। কিন্তু সেটাও ০ হয়ে যাবে যদি কখনো মেয়েটার গার্ডিয়ানের সামনে এভাবে স্মোক করতে গিয়ে ধরা খাও। “

সাইফের আগ্রহী চেহারাটা মুহুর্তেই কালো হয়ে যায়। তার মানে সে অলরেডি ৩৩ থেকে ০ তে নেমে গিয়েছে? সঙ্গে সঙ্গেই সাইফের মনে পড়ে বাকি ৬৭ নাম্বার এখনো তার হাতে আছে। সে আবার উৎফুল্ল গলায় জানতে চায়,

“ স্যার? বাকি ৬৭ মার্ক পাওয়ার টিপস কি? “

অন্য কেউ হলে জুলফিকার কখনোই এখানে বসে টিপস বিতরণ করতো না। কিন্তু এই ছেলেটার জন্য সামান্য মায়া অনুভব করে সে। হাজার হোক ছেলেটার ফ্যামিলি নেই। বিয়ের পর যদি তার এই ফ্যামিলির অভাবটা পূরণ হয় তাতে ক্ষতি কি? তাছাড়া সাইফকে দেখে মনেও হচ্ছে না সে টাইম পাস করছে। ছেলের নিয়ত যে বিয়ের তা জুলফিকার প্রথম দর্শনেই বুঝতে পেরেছে। তাই সে গলা সামান্য ঝেড়ে বলে,

“ বাকি ৬৭ মার্ক পাওয়ার টিপস হলো এফোর্ট এন্ড ডেডিকেশন। একটা মেয়ের প্যারেন্টস সবার আগে নিজের মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দেওয়ার আগে দেখবে যে তোমার এফোর্ট আর ডেডিকেশন কতটুকু। তার উপর নির্ভর করেই তারা বাকি ৬৭ মার্ক তোমাকে দিবে। “

সাইফের ঠোঁটের কোণে মিচকে হাসি ফুটে উঠে। নিজের বুদ্ধিমত্তার প্রতি নিজেই গর্ববোধ করে সে। ভবিষ্যৎ শশুরের কাছ থেকে তাকেই ইম্প্রেস করার বুদ্ধি নেওয়া একমাত্র সাইফের দ্বারাই সম্ভব।

__________

শিরশিরে হাওয়া বইছে প্রকৃতিতে। যদিও কাঁচের জানালাটা ভেদ করে তা ভেতরে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে না তবে কেবিনের ভেতরটাও কম ঠান্ডা নয়। ওয়াশরুম থেকে নিজের হসপিটালের পোশাক বদলে বের হয়েছে প্রত্যয়। গায়ে তার টি-শার্ট ও জ্যাকেট চাপানো। শীত থেকে মুক্তি পেতে গলায় একটা মাফলার এবং হাতে লেদারের হ্যান্ড গ্লাবসও পরিধান করেছে। ফিজা বেগম বারবার করে বলে দিয়েছে যেনো ভুলেও ঠান্ডা না লাগে। তাই এতো সতর্কতা।

কেবিনে পা রাখতেই প্রত্যয় দেখে রুমের এককোণে সোফায় ঝিম মেরে বসে আছে জেসি। প্রত্যয় দূর হতে নীরবে দেখে তাকে। প্রত্যয়কে আজ ডিসচার্জ করা হয়েছে। এই মুহুর্তে বাসায়ই যাবে তারা। যদিও ফিজা বেগম এবং আরাফাত সাহেবের আসার কথা ছিলো কিন্তু বিগত কয়েকদিনের দৌড় ঝাপ আর মানসিক চিন্তায় আরাফাত সাহেবের ডায়েবেটিসটা পৈ পৈ করে বেড়ে গিয়েছে। বিছানা ছেড়ে উঠার অবস্থায় নেই তিনি। পরিস্থিতি বিবেচনা করে জেসিই জেদ ধরে বলেছে ফিজা বেগমকে স্বামীর খেয়াল রাখতে। প্রত্যয়ের খেয়াল সে একাই রাখতে পারবে। তার কথাই অগ্যতা মানা হয়েছে। তবে আরাফাত সাহেব এই হাই ডায়েবেটিস নিয়েও তদারকি করে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে একমাত্র ছেলে এবং ভবিষ্যৎ পুত্রবধূর জন্য।

প্রত্যয় একটা নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে যায়। এখন যথেষ্ট সুস্থ অনুভব করছে সে। কেবল মাথার ঘা’টা শুকানো বাকি। বেডের উপর গুছিয়ে রাখা ব্যাগটা নিজের কাধে তুলে নিয়ে প্রত্যয় সামান্য গলা ঝাড়ে জেসির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। জেসি তখনও বসে ঝিমুচ্ছে। বাধ্য হয়ে এবার প্রত্যয় ডাক দেয়,

“ এক্সকিউজ মি। “

জেসি এবার চোখ মেলে তাকায়। লাল লাল চোখ জোড়া তুলে চাইতেই প্রত্যয় ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ ঠিক আছো তুমি? “

জেসি দ্রুত মাথা নেড়ে বলে,

“ হ্যাঁ। তোমার ওয়েট করতে করতে ঘুম পাচ্ছিলো। এ কি! ব্যাগ তুমি নিয়েছো কেনো? আমি নিচ্ছি, দাও। “

প্রত্যয় জেসির কথায় পাত্তা না দিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায়। নিজের শীতল হাতটা জেসির কপালে রাখতেই জেসি বিস্ময়ে পাথর বনে যায়। প্রত্যয়ের শীতল হাতটা কপালের সেই উত্তাপটুকু সহ্য করতে না পেরে দ্রুত হাত সরিয়ে নেয়। চিন্তিত স্বরে বলে,

“ জ্বর এসেছে কখন? বলো নি কেন? “

জেসি গলা ঝেড়ে বলে,

“ সিরিয়াস কিছু না। কালকে তো চট্টগ্রাম চলেই যাবো। আম্মুর কাছে গেলে এভাবেই ঠিক হয়ে যাবো। “

প্রত্যয় দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ আমার এসি অন করে রাখার কারণে জ্বর এসেছে? “

যদিও প্রত্যয় ভুল কিছু বলে নি তবুও জেসি সেটা চেপে গিয়ে বলে,

“ উঁহু। তোমাদের ঢাকার ওয়েদার আমাকে সুট করে নি হয়তো। “

অন্য সময় প্রত্যয় বিরক্ত হলেও এখন হুট করে তার বিরক্তি গায়েব হয়ে গেলো। সামান্য মায়া লাগলো, সেই সঙ্গে অপরাধবোধ। একটা মানুষ নাটক করে হোক আর দেখানোর জন্যই হোক, এ ক’টা দিন হসপিটালে তার চারিপাশে ঘুরঘুর করেছে খেয়াল রাখার জন্য। আর প্রত্যয় কি-না তারই সুবিধা অসুবিধার দিকটা খেয়াল করলো না!

প্রত্যয় আরেকবার জেসির দিকে তাকায়। প্লাজো আর কুর্তির সঙ্গে একটা উলের কার্ডিগান পড়ে আছে কেবল। প্রত্যয় কিছু একটা ভেবে মৃদু গলায় বলে,

“ হাত দাও। “

জেসি অবাক হয়ে বলে,

“ কেনো? “

প্রত্যয় জবাব না দিয়ে নিজের হাতের হ্যান্ড গ্লাবস দুটো খুলে জেসির হাতে পড়িয়ে দেয়। ছোট ছোট বিষয়ে চটে যাওয়া জেসি শান্ত নদীর ন্যায় স্থির হয়ে যায়। কিছু বলতে পারে না। কেবল পিটপিট করে হাতের গ্লাবস দুটো দেখতে থাকে। তার দু’হাতের তালু এতক্ষণ বরফের মতো শীতল হয়ে ছিলো। তবে এখন কিছুটা আরাম বোধ করছে।

প্রত্যয় আরো একটা কান্ড ঘটায়। নিজের গলায় জড়ানো মাফলারটা খুলে জেসির গলায় পেঁচিয়ে দেয়। মুখে সামান্য বিরক্তি ভাব নিয়ে বলতে থাকে,

“ সুপাত্রী হওয়ার নাটক করতে গিয়ে জ্বর বাধিয়ে বসে আছো। “

জেসির আচমকা দমবন্ধ অনুভব হয়। মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করে সে মোটেও নাটক করে নি। কিন্তু তা আর বলা হয় না। প্রত্যয় তার কথার তেমন একটা গুরুত্ব দিবে না। মন খারাপের বাতাস এসে ধাক্কা খায় জেসির লাল হয়ে যাওয়া মুখটায়। চট্টগ্রামে ফিরে গিয়ে সে ফরহাদকে সামনে পেলে খুন করে ফেলবে বলে ঠিক করে। ওই ছেলেটা সব সমস্যার মূল। জেসির মাথাটা খুব সূক্ষ্ণ ভাবে ওয়াশ করেছে ও। হ্যাঁ। সব দোষ ফরহাদেরই।

__________

বাণী রুমে গিয়ে দরজা আটকেছে এক ঘন্টার উপর হলো। দূর্জয়ও নিজের জায়গা থেকে নড়ে নি। অজানা কারণে এতক্ষণ ধরে সোফাটাতেই ঠাই বসে ছিলো। আচমকা দরজা খোলার শব্দ হতেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। বাণী বহ্নির হাত ধরে রুম থেকে বের হচ্ছে। দূর্জয়ের দেওয়া জামা কাপড় বদলে নিয়েছে দু’জন। হাতে রয়েছে কেবল নিজের পার্সটা। লিভিং রুম পাড় করে দরজার কাছে যেতে নিলেই দূর্জয় উঠে দাঁড়ায়। পিছন হতে শান্ত স্বরে বলে,

“ আমি অনুমতি দেই নি বাণী। “

বাণী থামে না। বহ্নির জুতো জোড়া নিয়ে বহ্নির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তা পড়িয়ে দিতে থাকে। দূর্জয় এবার নীরবে এগিয়ে গিয়ে বহ্নিকে বাণীর সামনে থেকে কোলে তুলে নেয়। বাণী রেগে উঠে,

“ কি করছো তুমি? “

দূর্জয় বাণীর কথার দিকে তোয়াক্কা না করে বহ্নিকে নিয়ে নিজের রুমের দরজার সামনে যায়। এক হাতে দরজাটা খুলে বহ্নিকে রুমের ভেতর নামিয়ে দিয়ে কোমল গলায় বলে,

“ আপনি ভিতরে বসে ওয়েট করুন। আমার আপনার মাম্মার সাথে একটু কথা আছে। ওকে? “

বহ্নি অবুঝের মতো কেবল মাথা নাড়ে। সে বুঝতে পারছে না হুট করে কি হলো? মাম্মা হুট করে যেতে চাইছে কেনো এখান থেকে? দূর্জয় রুমের ভেতরের লাইট ও ফ্যানের সুইচটা হাত বাড়িয়ে অন করে দেয়। অত:পর দরজাটা টেনে নব ঘুরিয়ে বাহির থেকে আটকে দেয়। বাণী তখন রাগে কাপছে। এলোমেলো স্বরে বলে,

“ ও আমার মেয়ে দূর্জয়। এভাবে অধিকার খাটানোটা বন্ধ করো। যেতে দাও। “

দূর্জয় শান্ত রয়। উত্তেজিত হয় না। টেবিলের ওপর থেকে একটা গ্লাসে পানি ঢেলে বাণীর কাছে এগিয়ে এসে ঠান্ডা গলায় বলে,

“ বসো। পানি খাও। মাথা ঠান্ডা করো। “

বাণী একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস করে। উত্তেজিত হলে চলবে না তার। বহ্নি ভেতরেই আছে। এটা ভেবে বাণী সরে এসে লিভিং রুমে একটা সোফায় বসে। দূর্জয়ও পিছু পিছু আসে। হাতের গ্লাসটা এগিয়ে ধরে বাণীর দিকে। বাণী চুপচাপ গ্লাসটা নিয়ে পানিটুকু খায়। দূর্জয় এবার খুব অদ্ভুৎ একটা কাজ করে। নিজেদের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেই এক হাঁটু ভেঙে বাণীর সামনে বসে। বাণী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। দূর্জয় অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিতে নরম স্বরে বলে,

“ শুনো বাণী। তোমার আত্মসম্মান অবশ্যই তোমার ফার্স্ট প্রায়োরিটি হওয়া উচিত। আই রেস্পেক্ট ইউ ফর দ্যাট। বাট ট্রাস্ট মি আমি এরকম কিছু বলছি না বা করছি না যেটাতে তুমি অস্বস্তি ফিল করবে। বিয়ের কথা বলছি আমি। সম্পর্কটাও যেরকম পবিত্র, আমার নিয়ত এবং অনুভূতিও সেরকমই শুদ্ধ। তাই ফর গড সেক আমার প্রস্তাবের পিছনে কোনো দয়া কিংবা করুণা খুঁজতে যেও না তুমি। আই মিন এভ্রি ওয়ার্ড। “

বাণী মাথা নিচু করে বসে রয়। দূর্জয় বলে,

“ লুক এট মি। “

বাণী মাথা তুলে না। দূর্জয় ফের বলে,

“ তাকাও বাণী। “

বাণী আবার মাথা তুলে তাকায়। তাকাতে বাধ্য হয়। দূর্জয় শান্ত গলায় বলে,

“ বর্তমানটা দেখো। আমি জানি তুমি যোগ্য। তুমি একা নিজেকে এবং বহ্নিকে সামলাতে পারবে। আমাকে ছাড়া চলতেও তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু আমি নিজের জন্য তোমাদের চাইছি। আমার জীবনে দুটো সম্পর্কের ঘর এখনো শূন্য আছে। সেই শূন্যস্থান পূরণের জন্য চাইছি তোমাদের। “

বাণী নীরবে শুনে সবটা। অত:পর অন্যরকম গলায় প্রশ্ন করে,

“ আমার ভেঙে ফেলে আসা গিটারটা মেরামত করে নিজের কাছে রাখার কারণটা কি? “

দূর্জয় চমকায়। পরমুহূর্তেই স্বাভাবিক স্বরে বলে,

“ কোনো কারণ নেই। “

ওই গিটারটা নিজের কাছে রাখার পিছনে দূর্জয়ের সত্যিই বিশেষ কোনো কারণ নেই। বারো বছর আগের সেই বৃষ্টিস্নাত বিকেলে সে কেবল দূর হতে দেখেছিলো বাণী কিভাবে অবহেলার সঙ্গে নিজের সবথেকে প্রিয় জিনিসটা রাস্তার পাশে ফেলে চলে গিয়েছিলো। এক মুহুর্তের জন্য দূর্জয়ের মনে হয়েছিলো তার প্রত্যাখ্যানের রাগটা যেনো বাণী ওই জড় বস্তুটার উপর ঝাড়লো।

বাণী ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয়। হুট করে বুক ভরা বিষাদ নিয়ে ধরা গলায় বলে,

“ আমি কাউকে গ্রহণ করার পরিস্থিতিতে নেই দূর্জয়। আমার মরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই, বেঁচে থাকারও নেই। যেই জীবটা আমি টেনে নিয়ে যাচ্ছি না? সেটা বাধ্য হয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। আমার চারিপাশে সবকিছু অনর্থক মনে হয়। মধ্যরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে যখন ঘুম ভাঙে না? তখন নিজেকে পাগল মনে হয়। স্বাভাবিক নই আমি। শারীরিক, মানসিক দুইদিক দিয়েই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছি। তোমার রুটিন মাফিক সুন্দর জীবনের শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য তুমি সুন্দর আর স্বাভাবিক একটা মানুষ ডিজার্ভ করো। আমার দোয়া থাকবে যেনো সেই মানুষটাকে অতি শীঘ্রই তুমি পেয়ে যাও। “

কথাটুকু শেষ করেই বাণী নিঃশব্দে উঠে চলে যায়। দূর্জয় নড়ে না একবিন্দু। নিজের জায়গায়ই স্থির রয়। বাণীর বলা প্রতিটা কথা সে মনযোগ দিয়ে শুনেছে। এই-যে শুদ্ধ অনুভূতি গুলো দূর্জয়ের মনে এসে ধীরে ধীরে ভীড় করছে, এটাতো দূর্জয়ের দোষ নয় তাই-না? আর দূর্জয় কাকে ডিজার্ভ করে সেই সিদ্ধান্তটাও নিশ্চয়ই বাণী নিতে পারে না, তাইনা?

দরজা খোলার শব্দ কানে ভেসে আসে দূর্জয়ের। সে স্পষ্ট টের পাচ্ছে দুটো মানুষের অতি শান্ত ভঙ্গিতে তার ঘরের বাহিরে পদার্পণ।

দূর্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সে আর বাঁধা দিবে না বাণীকে। অধিকারটুকু নিজের জিম্মায় না নিয়ে মানুষ দুটোর জীবনে আর বিন্দুমাত্র কর্তৃত্ব খাটাবে না সে। তার জীবনের খালি ঘরে এই দুটো মানুষের নামই বসাবে সে। বাণীর চারিপাশটা অনর্থক থেকে অর্থবহ করার চেষ্টা করবে।

ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে দূর্জয় উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। টেবিলের ওপর থাকা গাড়ির এবং বাড়ির দরজার চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৫৭.

টেবিলের উপর স্তুপ করে রাখা বাচ্চাদের পরীক্ষার খাতা। টিচারস রুমের প্রতিটা টেবিলেরই একই দশা। বাণী মনযোগ দিয়ে খাতা দেখতে ব্যস্ত। তার পাশেই আরেকটা চেয়ারে বসে ফোনে গেমস খেলছে বহ্নি। স্কুলে প্রতিদিন বহ্নিকে সঙ্গে করেই নিয়ে আসে বাণী। এছাড়া আর উপায় নেই তার। যতক্ষণ ক্লাস টাইম চলে ততক্ষণ বহ্নিকে কলিগ ম্যামদের কেয়ারে রেখে যায়। যদিও এতে বাণীর মনে খচখচানিটা রয়েই যায়। তবুও এছাড়া আর কোনো পথ নেই তার কাছে।

দূর্জয়ের বাসা থেকে পরশুদিন চলে এসেছে সে। যদিও সেদিন রাতে দূর্জয় তার পিছু পিছু এসেছিলো গাড়ি নিয়ে। অত:পর নিজেই তাকে নতুন বাসায় এনে ড্রপ করে দিয়ে গিয়েছিলো। তারপর আর দূর্জয় বাণীর সামনে আসে নি। কলও দেয় নি একবারও।

কিন্তু পরের দিন সকালেই তার বাড়ির দ্বাড়ে একটা ফার্নিচার কোম্পানির কিছু লোক এবং দু’জন ইলেক্ট্রিশিয়ান এসে হাজির হয়। বাণী বাকরুদ্ধ হয়ে একবার লোকগুলোকে দেখে অত:পর বারান্দায় ছুটে যায়। বারান্দা হতে দেখে নিচে একটা বিশাল ট্রাক বোঝাই করে বাসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সকল ফার্নিচার আনা হয়েছে। বাণী লোকগুলোর কাছে জানতে চেয়েছিলো এসব কে পাঠিয়েছে। দূর্জয়ের নাম শুনেই সে একপ্রকার ক্ষেপে দূর্জয়কে কল করেছিলো। দূর্জয় তখন বেশ ঠান্ডা গলায় বলে,

“ আপাততর জন্য সাহায্য গ্রহণ করো। প্রতি মাসে নাহয় একটু একটু করে পরিশোধ করে দিও। তবুও জেদ দেখিও না এই মুহুর্তে। “

দূর্জয়ের কথার পিঠে বাণী চুপ হয়ে গিয়েছিলো। ওই মুহুর্তে সাহায্যটুকু গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিলো না তার। নিজের কাছে যত টাকা ক্যাশ ছিলো তা কেবল বাজার করেই শেষ হয়ে যেতো। তাই মনে মনে ঠিক করে প্রতি মাসে সে নিজের সাধ্য অনুযায়ী এই সাহায্য পরিশোধ করে দিবে।

খাতা দেখতে দেখতে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে বাণী। ব্যাচে আপাতত চার জন স্টুডেন্ট পড়ে তার কাছে। চারজনের গার্ডিয়ানই আপাতত বাণীর প্রতি সন্তুষ্ট। বাসায় বাড়তি কাজ না থাকায় দেখা যায় প্রায়ই বাণী অতিরিক্ত এক ঘন্টাও সবাইকে পড়িয়ে দেয়। তাই এই স্টুডেন্ট গুলো আপাতত হাত হাতছাড়া হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু দূর্জয়ের ওই টাকা পরিশোধের জন্য আরো তিন চারটে স্টুডেন্ট পেলে বাণীর সুবিধা হতো।

অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় বাণীর মাথাটা হঠাৎ ভারী অনুভব করে। ঘাড়ের কাছটা কেমন ঝিমঝিম করছে। প্রেশারটা আবার ফল করেছে সম্ভবত। বাণী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বোতল থেকে কিছুটা পানি খেয়ে নেয়। এবরশনের পর থেকেই শরীরটা হুটহাট খারাপ হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে প্রেশারটা। কন্ট্রোলেই থাকছে না একদম। এবরশনের কথা মনে পড়তেই বাণীর বাচ্চাটার কথা মনে পড়ে। সে অবহেলায় নিজের পেটের দিকে তাকায়। বাচ্চাটা থাকলে এখন কত মাস চলতো তার? চার মাস নাকি পাঁচ মাস? হিসাব খেয়াল নেই বাণীর। আজকাল বহু কিছুই খেয়াল থাকে না তার।

__________

ঘড়ির কাটা ঘুড়ছে আপন গতিতে। সময়ের সঙ্গে যেনো পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতের বৈরী হাওয়া। সেই হাওয়াটা গায়ে লেগে শরীরের প্রতিটা লোমকূপ ছুঁয়ে যাচ্ছে। ঘরময় ভর করছে এক ভয়ানক নিস্তব্ধতা। ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাতের আকাশটা দেখছে প্রত্যয়। মনের মাঝে তার অদ্ভুৎ এক অস্বস্তি এসে ভীড় করেছে।

জেসি চট্টগ্রাম ছেড়েছে আজ সম্পূর্ণ একদিন হলো। এই একদিনে আর জেসির সঙ্গে কথা হয় নি প্রত্যয়ের। আজ সন্ধ্যায় প্রত্যয় মা’য়ের কাছ থেকে জানতে পেরেছে যে ওই মেয়ের জ্বর নাকি এখনো কমে নি বরং ভালো করেই জেকে ধরেছে। খবরটুকু শুনে প্রত্যয়ের মনে হয়েছে একবার তার কল করে খবর নেওয়া উচিত। মানবতার খাতিরেই অন্তত্য। তবে পরমুহূর্তেই আবার মনের মধ্যে অস্বস্তি কাজ করছে।

এই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে প্রত্যয় অস্থির অনুভব করে। সেই অস্থিরতাটা মেটাতেই মনের সকল দ্বিধা একপাশে রেখে সে কল লিস্ট হতে slang user jesi লিখে সেভ করা নাম্বারটা ডায়াল করে। সময় গড়ায়। কলটা বেজে নিজস্ব সময়ের গন্ডি পেরিয়ে কেটে যায়। অপর পাশ হতে আর ফোনটা রিসিভ হয় না।

প্রত্যয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার আকাশ পানে তাকায়। খুব বেশিই কি অসুস্থ? পরমুহূর্তেই নিজেকে এই ভেবে শান্তনা দেয় যে, সে তো কল করেছে। কেউ অন্তত্য বলতে পারবে না যে প্রত্যয় অকৃতজ্ঞের মতো একটা বারও খোঁজ নেওয়ার উদ্দেশ্যে কল দেয় নি।

নিজেকে এই বুঝ দিয়ে রুমের ভেতরে যাওয়ার জন্য প্রত্যয় পা বাড়ায়। ঠিক সেই মুহুর্তেই তার ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখতে পায় জেসি কল ব্যাক করেছে। প্রত্যয় সামান্য গলা ঝাড়ে কলটা রিসিভ করে। স্পষ্ট গলায় বলে,

“ হ্যালো। “

অপর পাশ হতে ক্ষীণ জবাব আসে,

“ হাই। কেমন আছো? “

“ আলহামদুলিল্লাহ। তুমি? “

“ ভালো আছি। “

আর কোনো কথা খুঁজে পায় না প্রত্যয়। আবার সেই দমবন্ধকর অস্বস্তি তাকে জেকে ধরেছে। কি বলা উচিত এই সিচুয়েশনে তা-ও তার বিচক্ষণ মস্তিষ্ক ঠাওর করতে পারছে না। ফোনের অপর পাশে থাকা জেসি তখন নীরব। এই তীব্র জ্বরে তার মন কেমন যেনো ন্যাকা হয়ে উঠেছে। ইচ্ছে করছে যেনো প্রত্যয় কিছু বলুক। অন্তত্য চট্টগ্রামের বর্তমান আবহাওয়ার খবর নেওয়ার ছলেও কিছু বলুক।

বেশ কিছুক্ষণ গাঁইগুঁই করে প্রত্যয় বলে,

“ আচ্ছা। ডিস্টার্ব করার জন্য সরি। খেয়াল রেখো। বাই। “

বলেই ঠাস করে ফোনটা কেটে দেয় প্রত্যয়। জেসি অবাক হয়ে ফোনটা মুখের সামনে এনে স্ক্রিনের পানে তাকিয়ে রয়। তার ন্যাকা আত্মাটা আচমকা আরো ন্যাকামি করে বসে। চোখ টলমল করে উঠে। শরীরের দূর্বলতা, চট্টগ্রামের আবহাওয়া, ঢাকার বাসিন্দা ওই ছেলেটা সবকিছুই অসহ্যকর ঠেকছে তার। সে রাগে ফোস ফোস করতে করতে ফরহাদের নাম্বারটা ডায়াল করে। ফরহাদ কল রিসিভ করেই উৎফুল্ল গলায় বলে উঠে,

“ দোস্ত! এখন কেমন… “

বাকি কথাটা আর সম্পূর্ণ করতে পারে না ফরহাদ। তার আগেই জেসি আগুনের মতো গর্জে উঠে,

“ অসভ্য, ফাজিল, ইতর, কুত্তা, বান্দর। ভুলেও তুই আমার সামনে আসবি না আর কখনো। তোকে সামনে পেলে আমি টুকরা টুকরা করে একদম তোর শশুরবাড়ি পার্সেল করে দিবো। শালা জোচ্চোর কোথাকার। আই হেইট ইউ। “

বলেই ফোনটা কেটে দেয় জেসি। ফোনের অপর প্রান্তে থাকা ফরহাদ তখন হতভম্ব। সে আবার কি করলো? জেসি কাথা টেনে মুখ ঢেকে পড়ে রয়। ভাবী খাবারের জন্য ডাকতে এলেও সে রাগারাগি করে বলে খাবে না। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার।

__________

ফিল্ডের সবুজ ঘাসের উপর বসে আছে সাইফ। আকাশ জুড়ে তখন তারার মেলা। ঘাসের ডগা গুলো শীতের কারণে শিশির জমে আদ্র হয়ে আছে। ফিসফিসিয়ে প্রেম আলাপে মগ্ন সাইফ। তার কথার স্বর আশেপাশের কোনো মানুষও শুনতে পারবে না, এতটা ক্ষীণ স্বরে বলছে। অবশ্য আশেপাশে খুব একটা মানুষও নেই। কেবল ফারদিন, জুনায়েদ এবং রাফিই রয়েছে। তারাও কিছুটা দূরে গোল হয়ে বসে উনো খেলছে।

আচমকা কথার মাঝে আরেকটা কল আসতে দেখে সাইফ ভ্রু কুচকে স্ক্রিনের পানে তাকায়। প্রত্যয়ের নামটা দেখতেই সে বিড়বিড়িয়ে বলে,

“ শালা সিঙ্গেলরা মিঙ্গেলদের সবথেকে বড়ো শত্রু। চব্বিশটা বছর সিঙ্গেল থাকার পর ফাইনালি জীবনে প্রেম আসলো। কিন্তু এই শালাদের যন্ত্রণায় সেটাও শান্তিতে করতে পারমু বইলা মনে হয় না। “

সাইফ নিশার থেকে বিদায় নিয়ে প্রত্যয়ের কলটা রিসিভ করে। সাইফ বলে,

“ তোর বিয়ের রাইতে যদি আমি প্রতি ৩০ সেকেন্ড পর পর তোর রুমের দরজা নক না করসি, তাহলে আমার নাম বদলায় আমি কুদ্দুস রাখমু। “

প্রত্যয় সাইফের কথায় তেমন একটা গুরুত্ব না দিয়ে সিরিয়াস গলায় বলে,

“ আই নিড হেল্প দোস্ত। “

“ কি হইসে তোর? “

“ আমি একজনের সঙ্গে কথা বলতে নিয়েছিলাম। কিন্তু শুধু কেমন আছে জানতে চাওয়ার পর আর কথা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি না। মানে কথা খুঁজে পাচ্ছি না। কিন্তু কথা না বললেও অস্থির লাগছে। মোটকথা খুব দ্বিধার মাঝে আছি। এটা কি কোনো সিরিয়াস সমস্যা? “

সাইফ ভ্রু কুচকে পুরোটা শুনে। পরপর সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করে,

“ তুই কি ঝগড়াঝাটি ভাবীর কথা বলতেসিস? “

প্রত্যয় বিরক্তি নিয়ে বলে,

“ ওর নাম জেসি। এসব ঝগড়াঝাটি ভাবী আবার কেমন শব্দ? “

সাইফ সুর টেনে বলে,

“ ওহ আচ্ছা। “

প্রত্যয় বলে,

“ যা জিজ্ঞেস করেছি তা বল। “

সাইফ সিরিয়াস গলায় বলে,

“ তোর কথা শুনে যা বুঝলাম, লক্ষ্মণ ভালো না। খুব সিরিয়াস একটা সমস্যা এটা। “

প্রত্যয় বিস্ময় নিয়ে বলে,

“ কি সমস্যা এটা? “

“ দিজ ইজ লাভ বন্ধু। “

প্রত্যয় সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠে,

“ ভালো হবি না তুই। “

বলেই প্রত্যয় ফোন কেটে দেয়। সাইফ হতাশ গলায় আকাশ পানে তাকিয়ে বলে,

“ হে খোদা, দুনিয়ায় তুমি আমার আশেপাশে মানুষ রূপী একদল বলদ পাঠাইলা। আর এদের পথ দেখাইতে আমারে পাঠাইলা। কিন্তু শালারা একটাও আমার কথা সিরিয়াসলি নেয় না। এতে আমার কি দোষ? দুনিয়ায় বুদ্ধিমানের কদর দিন দিন কমে যাইতেসে। “

__________

রাত তখন ক’টা বাজে কে জানে। ঘুমে আচ্ছন্ন বাণী হঠাৎ ঘামতে শুরু করে। তীব্র শীতের মাঝেও তার পুরো শরীর ঘামছে। দুই চোখ খিচে বন্ধ করে আছে সে। ডুবে আছে স্বপ্নের জগতে। যেই স্বপ্নে তার বাস্তবতাটা তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। বিভীষিকাময় সেই রাত, শিমুল গাছ, গাছের নিচে রক্তাক্ত সায়াহ্নের লাশ, সেই লাশের বুকে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে থাকা বাণী। হঠাৎ কোথা থেকে হিরণ আসলো। এক থাবায় বাণীর হাত ধরে তাকে টেনে তুলে। বাণী যেতে চায় না। পা দিয়ে মাটি খামচে ধরতে চায়। কিন্তু পারে না। নিথর সায়াহ্নের লাশ হতে ক্রমে ক্রমে দূরে সরে যায় সে। বাকিটা… বাকিটা বদ্ধ আখির সামনে ভেসে উঠতেই বাণী অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। ঘুমের মাঝেই ভাইয়া, ভাইয়া বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে সে। কাঁদতে কাঁদতে বিছানার চাদর খাঁমচে ধরে।

বাণীর কান্নার শব্দে বহ্নির ঘুম ছুটে যায়। সে চোখ মেলে পাশ ফিরে বাণীর এই অবস্থা দেখতেই ভীত হয়ে পড়ে। দ্রুত উঠে বসে দূরে সরে যায়। ভয়ে কাঁপতে থাকে। পরপর ভীত গলায় ডাকে,

“ মাম্মা। মাম্মা উঠো। মাম্মা। উঠো না। “

বাণীর কানে পৌঁছায় না সেই ডাক। সে অন্য এক দুনিয়ায় আছে আপাতত। বহ্নি ভয়ে এবার নিজেও ঠোঁট উল্টে নিঃশব্দে কেঁদে দেয়। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে সে আশেপাশে তাকায়। রুমের ড্রিম লাইট অন থাকায় চারিপাশটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বহ্নি দ্রুত বিছানা ছেড়ে নেমে গিয়ে টেবিল
থেকে বাণীর ফোনটা হাতে নেয়। কনট্যাক্ট লিস্টে গিয়ে সে সামনে নিশার নাম্বার দেখে সেটাই ডায়াল করে।

__________

মধ্যরাত হওয়ায় নিশা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কলের শব্দে তার ঘুম ভাঙলেও ঘুম ঘুম ভাবটা দূর হয় না। সে চোখ বোজা অবস্থায়ই বালিশের পাশ হতে হাতড়ে ফোনটা রিসিভ করে। সঙ্গে সঙ্গে ফোনের অপর পাশ হতে ফোপাঁনোর শব্দ শুনতে পায় সে। নিশার ঘুম ভেঙে যায়। এক লাফে উঠে বসে সে। স্ক্রিনে বাণীর নাম্বারটা দেখেই সে ভীত স্বরে বলে,

“ হ্যালো? “

বহ্নি কাঁদতে কাঁদতে ভীত গলায় বলে,

“ আন্টি, মাম্মার যেনো কি হয়েছে। “

নিশা উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে আম্মু? “

“ মাম্মা ঘুমের মাঝে জোরে জোরে কান্না করছে। ডাকছি কিন্তু উঠছে না। আমার ভয় করছে। “

মাত্র ঘুম থেকে উঠায় নিশার মস্তিষ্ক তখন কাজ করছে না। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সে কিছু না ভেবেই বলে বসে,

“ তুমি ওয়েট করো। আন্টি আসছি। পীপহোল দিয়ে আন্টি ছাড়া অন্য কাউকে দেখলে দরজা খুলবে না। ওকে আম্মু? আন্টি এখুনি আসছি। “

নিশা তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ায়। তখনই তার মনে পড়ে সে কেবল বাণীর নতুন বাসার এরিয়ার নামটুকুই জানে৷ কোন বাসা সেটা চিনে না। আর নাঈমার বাসা থেকে বাণীর বাসার দূরত্ব প্রায় ঘন্টা খানিকের। নিশা বোকার মতো দাঁড়িয়ে রয়। কি করবে সে এখন? আব্বুও চট্টগ্রামে নেই। এই মুহুর্তে কি করবে সে? বাচ্চাটা ওইখানে একা ভয় পাচ্ছে। নিজের প্রতি বিরক্তিতে নিশা রাগে পায়চারি শুরু করে। আচমকা তার মনে পড়ে দূর্জয় ভাইয়া চট্টগ্রামে আছে। ভাইয়া বাণী আপুর বাসাও চিনে। ভাইয়াকে একটা কল দিবে?

ভাবতে ভাবতেই নিশা দূর্জয়ের নাম্বারে কল লাগায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই কলটা রিসিভ হতেই নিশা উদ্বিগ্ন গলায় শুধায়,

“ ভাইয়া তুমি ফ্রি আছো? ফ্রি থাকলে এখনই প্লিজ বাণী আপুর বাসায় যাও। “

__________

কলিং বেলের শব্দ পেতেই বহ্নি দ্রুত ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট অন করে রুম থেকে বের হয়। খাবার টেবিলের কাছ থেকে একটা চেয়ার টেনে দরজার সামনে রাখে। অত:পর চেয়ারে উঠে দাঁড়িয়ে পীপহোল দিয়ে বাহিরে তাকায়। পরিচিত মুখ দেখতেই সে চেয়ারে দাঁড়িয়ে পা উঁচু করে আগে উপরের ছিটকিনিটা নামায়। তারপর চেয়ার ছেড়ে নেমে নিচের ছিটকিনিটাও খুলে নব ঘুরায়। দূর্জয়
ভীত বহ্নিকে দেখতেই তাকে কোলে টেনে নিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“ ইট’স ওকে। এসে পড়েছি। আর কান্না করবেন না। “

বলতে বলতে দূর্জয় দ্রুত বাসায় প্রবেশ করে দরজাটা আটকে দেয়। সোজা চলে যায় ড্রিম লাইটের মৃদু আলো ভেসে আসা রুমটার দিকে। রুমে পা রাখতেই ড্রিম লাইটের আলোয় দেখা দৃশ্যটা দেখতেই দূর্জয়ের শরীরটা অবশ হয়ে আসে।

বাণী তখনও হাউমাউ করে কাঁদছে। অস্পষ্ট স্বরে ভাইয়া ভাইয়া বলে আওড়াচ্ছে। কান্নার দমকে পুরো শরীর কাঁপছে তার। মুখটা কেমন রক্তশূণ্য দেখাচ্ছে।

দূর্জয়ের লাইট অন করার কথা খেয়াল রইলো না। সে বহ্নিকে বিছানার এক কোণে বসিয়ে দিয়ে দ্রুত বাণীর দিকে এগিয়ে যায়। বাণীর পাশে বসে ডাকে,

“ বাণী গেট আপ। “

বাণী উঠে না। বরং কান্নার প্রকোপ আরো বাড়ে। দূর্জয় হাত বাড়িয়েও থেমে যায়৷ অনুভব করে সে বাণীকে ছোঁয়ার সাহসও খুঁজে পাচ্ছে না। ঘুমের ঘোরে যদি আরো ভয় পেয়ে যায়? নারী কণ্ঠের হৃদয়বিদারক কান্নার স্বরটা দূর্জয়ের মস্তিষ্কে আঘাত করছে। সে ডাকার জন্য গলায় জোর খুঁজে পায় না। মাথা ঘুরিয়ে বহ্নির পানে তাকায়। বাচ্চাটাও ভয়ে সিটিয়ে আছে। কেমন নীরবে কেঁদে চলেছে।

দূর্জয় বুক ফুলিয়ে শ্বাস টেনে নেয়। তার দূর্বল হয়ে পড়লে চলবে না। সে গলায় সামান্য জোর এনে ডাকে,

“ বাণী উঠো। স্বপ্ন থেকে বের হও। উঠো। বহ্নি কান্না করছে। ওয়েক আপ প্লিজ। “

কথাটা বলতে বলতেই দূর্জয় হাত বাড়িয়ে বাণীর গাল ছোঁয়। সঙ্গে সঙ্গে বাণীর স্বপ্ন ভেঙে যায়। আচ্ছন্নের ন্যায় চিৎকার করে সে চোখ মেলে তাকায়। দূর্জয়কে সামনে দেখতেই এক লাফে উঠে বসে দূরে সরে যায়। অশ্রুসিক্ত সেই দৃষ্টি দেখতেই দূর্জয়ের বুকের ভেতর তুমুল ভাঙচুর শুরু হয়। সে যথাসাধ্য স্বাভাবিক গলায় বহ্নিকে বলে,

“ মাম্মা ঠিক আছে বহ্নি। আপনি একটু লিভিং রুমে গিয়ে বসুন। আমি আসছি এখুনি। “

আকস্মিকতায় বহ্নির দিকে খেয়াল ছিলো না বাণীর। দূর্জয়ের কথা শুনে নিজের পায়ের পাশটায় তাকাতেই দেখে বহ্নি বিছানা ছেড়ে নীরবে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। বহ্নির অশ্রুমাখা মুখটাও বাণীর দৃষ্টির অগোচর হয় না। মনটা তার আরো বিষিয়ে উঠে। বাণী দু’হাতে নিজের চুল খামচে ধরে। হাঁটুর মাঝে মুখ গুজে ফের ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। পুরনো ক্ষতটা আবারও জীবন্ত ও রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে। নিজেকে সম্পূর্ণ নিঃস্ব অনুভব করছে সে। অস্ফুটে বলে উঠে,

“ চলে যাও তুমি। “

দূর্জয় না চাইতেও করুণ গলায় বলে বসে,

“ এই জীবনটা তুমি ডিজার্ভ করো না। এটাকে ভালো থাকা বলে না। তুমি ভালো নেই বাণী। “

বাণী ধরা গলায় বলে,

“ লিভ মি এলোন। “

“ তুমি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখেছো। একটু শান্ত হও। শরীর কাঁপছে তোমার। “

বাণী এবার অশ্রুসিক্ত মুখটা তুলে আর্তনাদ করে বলে,

“ স্বপ্ন ছিলো না। সত্যি ছিলো। পুরোটা সত্যি ছিলো। ওই… “

কান্নার দমকে বাণী আর কিছু বলতে পারে না। বলতে পারে না যে বাস্তব জীবনে সে হিরণের কবলে কেবল দু’বার পরলেও স্বপ্নে সে হাজারবার হিরণের শিকার হয়েছে। স্বপ্নটা এতটাই জীবন্ত হয় যে বাণীর পুরো স্বত্তা তা অনুভব করতে পারে। দূর্জয় তা বুঝতে পারলো কি-না বুঝা গেলো না। কেবল নিষ্প্রভ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয়। শান্ত গলায় বলে,

“ নিজেকে ঠান্ডা করার জন্য স্ট্রেস রিলিফিং বল খুব কার্যকরী। আমার কাছে আপাতত সেটা না থাকলেও হাতটা আছে। যদিও রুক্ষ কিন্তু ভরসার। “

বাণী ফ্যালফ্যাল করে একবার দূর্জয়ের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা দেখে ফের ড্রিম লাইটের সবুজ আলোয় দূর্জয়ের মুখটা দেখে। পরপর তার বুকে চিনচিনে ব্যথা হয়। বাণী যখন এই ভালোবাসা নামক অনুভূতি গুলোকে স্বাগতম জানানোর জন্য দু হাত মেলে দিয়েছিলো তখন ভাগ্য কেনো তার সঙ্গ দিলো না? আর আজ যখন বাণী পুরোপুরি নিঃশেষ, মনের কোণে বিন্দুমাত্র ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই বিলানোর জন্য, তখন ঠিক কিসের আশায় এই পুরুষটা তার দিকে ভরসার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে? কেন?

চলবে..

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৫৮.

সকাল সকাল ফোনের নোটিফিকেশন বারে জেসির পাঠানো ম্যাসেজটা ভীড় করতেই প্রত্যয় অবাক হয়। ম্যাসেজটা ওপেন করতেই দেখে সেখানে গোটা বাংলায় লেখা,

“ তোমার কষ্ট করে আর অপেক্ষা করতে হবে না। বিয়ে নিয়ে অযথা চিন্তাটাও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। আমি আজকে বাবা আর ভাইয়া বাসায় ফিরলে মানা করে দিবো। চিন্তা নিও না। তোমার সুপাত্রের ইমেজটা নষ্ট করবো না। “

সবেমাত্র নাস্তার টেবিলে এসে বসেছিলো প্রত্যয়। ম্যাসেজটা দেখতেই কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রয়। ফিজা বেগম তখন নিজ হাতে ছেলের জন্য বানানো স্যুপ নিয়ে টেবিলে এসে হাজির হোন। ছেলের সামনে নাস্তা সার্ভ করতে করতে আপনমনে বলতে থাকে,

“ ভাবীর কাছে শুনলাম জেসির নাকি সাইনুসাইটিসের সমস্যা আছে। মেয়েটার জন্য এতো মায়া লাগছে। আমার আর তোমার আব্বুর কথা চিন্তা করে নিজে এই ঠান্ডার মাঝে ক’টা দিন হসপিটালে ছিলো। এখন কি জ্বরটাই না বাঁধিয়ে বসে আছে! আজ নাকি ভাবী ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। “

প্রত্যয় চুপচাপ শুনে। প্রত্যুত্তর করে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরাফাত সাহেব এসে নাস্তার টেবিলে উপস্থিত হয়। ছেলের শরীরের খবর নিয়ে বলে,

“ পরের সপ্তাহেই তোমার চট্টগ্রামে না ফিরলে হচ্ছে না? আরো একটা সপ্তাহ ছুটি নাও। বাসায় থেকে রেস্ট নাও, মা’য়ের যত্ন নাও। “

প্রত্যয় এবারও কিছু বলে না। সে নীরবে নাস্তায় মনযোগ নিবেশ করেছে তখন। আচমকা খাওয়া থামিয়ে আরাফাত সাহেবের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ জেসিকে কি তুমি শুধু নিজের বন্ধুর মেয়ে হিসেবেই পছন্দ করেছো? “

আরাফাত সাহেব খাওয়া থামিয়ে হতভম্ব দৃষ্টি মেলে একবার ছেলের দিকে তাকায়। অত:পর সামনের চেয়ারে বসা নিজের স্ত্রীর পানে তাকায়। ফিজা বেগম তখন ঠোঁট টিপে হাসতে ব্যস্ত। যাক! ছেলের অবশেষে ইন্টারেস্ট জাগলো!

আরাফাত সাহেব স্বাভাবিক গলায় বলে,

“ আমি নিজের বাড়ির জন্য পুত্রবধূ খুঁজছিলাম। আর আমার পুত্রবধূ হওয়ার জন্য আমার বন্ধুর মেয়ে হওয়া ম্যান্ডাটরি ছিলো না, বরং সুপাত্রী হওয়া জরুরী ছিলো। “

প্রত্যয় দ্বিধাপূর্ণ গলায় প্রশ্ন করে,

“ তোমার কাছে ওকে সুপাত্রী মনে হয়? “

“ হ্যাঁ। কোনো সন্দেহ নেই তাতে। “

প্রত্যয় এবার নিজের মা’য়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ তুমিও কি আব্বুর সাথে একমত? “

“ হ্যাঁ। মেয়েটা প্রাণোচ্ছল, কথাবার্তাও সুন্দর আর সবথেকে জরুরি কথা হচ্ছে সৎ। আমাদের ইম্প্রেস করার জন্য বিন্দুমাত্র কৃত্রিম আচরণ করে নি। তোমার ভাইয়া মারা যাওয়ার পর আমাদের এখন একমাত্র সম্বল তুমি। তোমার জন্য নিশ্চয়ই আমরা কোনো যেনো তেনো মেয়ে পছন্দ করবো না? “

প্রত্যয় এবার মাথা নিচু করে আরো দু চামচ স্যুপ মুখে দেয়। অত:পর আচমকাই খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ফোনটা হাতে নিয়ে উপরের দিকে যেতে নিলেই ফিজা বেগম পিছু ডাকে,

“ স্যুপটা তো শেষ করে যাও। “

“ পরে খাবো আম্মু। “

নিজের রুমে ফিরেই প্রত্যয় দ্রুত একটা নাম্বার ডায়াল করে। প্রথমে নাম্বারটা বিজি দেখালেও কিছুক্ষণের মাঝেই কলব্যাক করে। প্রত্যয় কিছু বলবে তার পূর্বেই অপর প্রান্ত হতে ক্ষিপ্ত স্বর বলে উঠে,

“ তোর কি দুনিয়াতে আর কাম নাই বাপ? জানি ঘরে আজাইরা শুইয়া বইয়া আছোস। করার মতো কিছু পাইতাসোস না। তাই বইলা তুই আমারে শান্তিতে প্রেমটাও করতে দিবি না? “

প্রত্যয় প্রথমে অবাক গলায় জানতে চায়,

“ তুই প্রেম করছিস? কবে থেকে? আমি জানি না কেনো? “

“ তুই এইসব বাদ দিয়া আগে বল ফোন কেন দিসোস। আমার কাম আছে। বেশি সময় নাই হাতে। “

“ দোস্ত, ধর কেউ নিজের সমস্যার কথা চিন্তা না করে আগে আমার কথা চিন্তা করলো, আমার কথা ভাবলো, আমার খেয়াল রাখলো, এইটা কিসের লক্ষ্মণ? “

সাইফ তখন চরম বিরক্ত। এই ছাগল মার্কা প্রশ্ন করার জন্য এই ছেলে তারে ফোন দিসে? কাজের ফাঁকে ১২ মিনিট ফ্রি টাইম পেয়েছিলো সাইফ। সেই ১২ টা মিনিট একটু নিজের মতো করে না কাটিয়ে সে নিজের ইয়াসমিনের জন্য বরাদ্দ করে রেখেছিলো। আর এই ছেলে সেই বরাদ্দকৃত সময়ের মাঝে এসে বাগড়া দিলো শুধুমাত্র এই প্রশ্ন করতে। সাইফ চোখ মুখ কুচকে বলে,

“ এইটা পাগল হওয়ার লক্ষ্মণ। যে এইসব করসে সে-ও পাগল, আর যার জন্য করসে সে-ও পাগল৷ তাদের অতিব জরুরী ভিত্তিতে বিয়ে দিলেই একমাত্র এই সমস্যার সমাধান মিলবে। “

প্রত্যয় এবার সিরিয়াস স্বরে বললো,

“ একদম ফাইজলামি করবি না। আই এম সিরিয়াস। “

“ এই শালা! তোর কি মনে হয় আমি আমার মূল্যবান সময় অপচয় কইরা এনে মশকরা করতেসি? মশকরা তো তুই করতেসোস। এতো বছর বিএমএতে কামলা খাইটা আর্মি হইলাম কারণ ভাবসিলাম এই সেক্টরে বলদ কম। কিন্তু তুই বলদে আমারে বারবার কোনটা কিসের লক্ষ্মণ জিগায় মাথা খাইতেসোস। আমারে কি তোর ডাক্তার মনে হয়? নিজের লক্ষ্মণ নিজে মিলা। আমার প্রেমে আরেকবার বাগড়া দিলে তোর পোলাপাইন দুনিয়ার মুখ দেখার সঙ্গে সঙ্গে ওই গুলারে শিখায় দিমু তোরে যাতে বাপ না ডাইক্কা মামা ডাকে। বালছাল যত্তসব। “

বলেই ফোনটা কেটে দেয় সাইফ। প্রত্যয়ের মুখের বিরক্তির ভাবটা বেড়ে যায়। ছেলেটা প্রেমে পড়ে খুব রুড হয়ে গিয়েছে। নিজের রুম জুড়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করে প্রত্যয়। হাসফাস করছে সে। কিছুক্ষণ পায়চারি করে ধপাশ করে বিছানায় বসে পড়ে। কি ভেবে যেনো গুগলের সার্চ অপশনে গিয়ে লিখে,

“ what does it mean when a girl cares about me genuinely? “

আধুনিক উত্তরদাতা গুগল যেই উত্তর প্রদর্শন করে তা দেখে প্রত্যয় নিশ্চুপ হয়ে বসে রয়। মনে মনে কয়েকবার আওড়ায় উত্তরটা,

“ It simply means she’s worried about you. Having said that, she definitely has feeling for you. Don’t overthink it. Go get her and you’ll have your answer. “

প্রত্যয় এবার ফোনটা রেখে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। সূক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে একবার আগাগোড়া নিজেকে পরখ করে। তার হাইট যথেষ্ট ভালো, ওয়েটটাও পারফেক্ট, মুখশ্রীর অবকাঠামো নজরকাড়া, চুলগুলোও খুব ভদ্র স্টাইলে কাটা, কেবল কপালের পাশে ক্ষতের যা দাগ রয়েছে। তবে সেটাও দেখতে মোটেও কুৎসিত নয়, বরং প্রত্যয়ের সাহসিকতার চিহ্ন বহন করছে এই ক্ষত। নিজেকে খুব ভালো করে পরখ করে প্রত্যয়ের মনে হয় গুগলের উত্তর সত্য হওয়া কোনো অসম্ভব জাতীয় বিষয় নয়। তার মতো সুদর্শন ছেলেকে দেখে যে-কেউ গালাগালি ছেড়ে সুপাত্রী হয়ে যাবে।

আচমকা প্রত্যয় কিছু একটা ভেবে দ্রুত নিজের ওয়ালেট আর ফোনটা পকেটে ভরে নেয়। আলমারি খুলে নিজের পাসপোর্টটাও সঙ্গে নিয়ে সে আরেক বার আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। যথেষ্ট ডিসেন্ট দেখাচ্ছে তাকে। জামা বদলিয়ে সময় অপচয় করার কোনো প্রয়োজন নেই।

আর এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে প্রত্যয় দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে যায়। খাবার টেবিলটা ক্রস করে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই আরাফাত সাহেব ডাকেন,

“ কোথায় যাচ্ছো তুমি? “

“ চট্টগ্রাম যাচ্ছি আব্বু। চিন্তা করো না, ফ্লাইটেই যাবো। এয়ারপোর্টে গিয়ে টিকিট বুক করে নিচ্ছি আমি। “

জবাব দিতে দিতে হন্তদন্ত ভঙ্গিতে পায়ে শু পড়ে নিয়ে প্রত্যয় বেরিয়ে পড়ে। টেবিলে বসে থাকা দম্পতি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রয় ছেলের যাওয়ার পানে।

__________

বাণী নতুন যেই বাসায় উঠেছে সেটা ছাদের সঙ্গে লাগোয়া। সাত তলার বাসাটিতে কোনো লিফট নেই। সিঁড়ি ধরে উঠতে নামতেই জীবন আঙ্গার হয়ে যায়। কিন্তু এতো কম ভাড়ায় আপাতত অন্য কোথাও বাসা পাওয়াও সম্ভব ছিলো না তার জন্য।

গতরাতের ঘটনার পর থেকেই বাণী আরো নীরব বনে গিয়েছে। মুখটা গুমোট হয়ে আছে তার। চুপচাপ বহ্নিকে নাস্তা করিয়ে, রেডি করিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছে কেবল। সিঁড়ি ধরে দ্বিতীয় তলায় নামতেই মুখোমুখি হয় রিহাব ভাইয়ের। রিহাব হলো সিথীর হাজবেন্ড, এই বাড়ির প্রকৃতি বাড়িওয়ালা।

রিহাবকে দেখতেই বাণী ক্ষীণ স্বরে সালাম দেয়। রিহাব সালামের জবাব দেয় না, বরং বাকা চোখে বাণীকে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করে। সঙ্গে সঙ্গে বাণীর পুরো শরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠে। সে দ্রুত বহ্নিকে নিয়ে পাশ কাটিয়ে নিচে নেমে আসে।

এ আর নতুন কিছু না তার জন্য। গত কয়েক মাসে এরকম বহু সিচুয়েশনের সম্মুখীন হয়েছে সে। যখনই কেউ শুনে যে বাণী সিঙ্গেল মাদার তখনই তাকে বাকা নজরে দেখে। পিছনের ঘটনা না জেনেই সবাই নিজের মনে আলাদা আলাদা ঘটনা সাজিয়ে ফেলে বাণীকে ঘিরে। বাণী তা জানে, বুঝে। কিন্তু এড়িয়ে চলা ছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পায় না সে। নিজের মেয়েটাকে এই সমাজের বাহিরে নিয়ে বড়ো করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়ে এসব দেখেও না দেখার ভান করে চলে। যত সম্ভব নিজেকে গুটিয়ে রাখে সবার থেকে। লোকচক্ষু এড়িয়ে চলার যথাসাধ্য চেষ্টা করে।

__________

দিনে দুপুরে ঢাকা এসে পৌঁছেছে দূর্জয়। মেজাজটা বেজাই গরম তার গতরাত থেকে। তবে সেই গরম মেজাজটা কারো সামনে প্রকাশ করছে না সে। সঠিক জায়গায় ক্ষোভ মেটানোর অপেক্ষায় তা মনে পুষে রেখেছে। তার মেজাজ গরমের কারণ গতকাল রাতে দ্বিতীয় দফা বাণীর থেকে পাওয়া রিজেকশন নয়। যতক্ষণ মন না চাইবে বাণী অমত জানাতেই পারে। তা-তে বিন্দুমাত্র অসুবিধা নেই দূর্জয়ের। তার সমস্যা অন্য জায়গায়, অন্য কারণে।

সেলের সামনে এসে দাঁড়াতেই সে গম্ভীর স্বরে শুধায়,

“ লক খুলো। “

সেলের পাহারায় নিযুক্ত নিরাপত্তা কর্মী আমতা আমতা করে বলে,

“ স্যার, ভেতরের লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেসে। আপনার ভিতরে না যাওয়াই ভালো। “

দূর্জয়ের কপালের মাঝে ভাজ পড়ে। সে তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,

“ যা বলার সরাসরি বলো। “

“ স্যার ভেতরের আসামীটা খালি আত্মহত্যা করতে চায়। অর্ডার অনুযায়ী আমরা ওর হাতে হ্যান্ডকাফ আর পা শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছি যাতে আত্মহত্যা করার চেষ্টা না করতে পারে। “

“ বুঝেছি। লক খুলো তুমি। “

“ স্যার আপনার সেফটির কথা ভেবেই বলছিলাম। “

দূর্জয় এবার কিছুটা রেগে বলে,

“ আমার সেফটি সম্পর্কে আমি যথেষ্ট কনসার্ন। তোমাকে যা বলা হচ্ছে চুপচাপ তা করো। “

নিরাপত্তা কর্মীটা এবার নীরবে সেলের দরজাটা খুলে দেয়। দূর্জয় স্বাভাবিক পায়ে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় মেঝেতে বসে থাকা মানুষটাকে। দু হাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ পড়ানো। পা দুটোও শিকল দ্বারা বাঁধা। দূর্জয়ের যদি জানা থাকতো যে প্রেগন্যান্সির সময় বাণীকে কিভাবে বেঁধে রাখা হতো তাহলে ওর ক্ষিপ্ত মন এই মুহুর্তে এই দৃশ্যটা দেখে খুব শান্তি অনুভব করতো।

কারো অস্তিত্ব অনুভব করতেই হিরণ চোখ তুলে তাকায়। দু চোখ লাল রক্তবর্ণের ধারণ করেছে তার। নির্ঘুম রাত কাটানোর জন্য নাকি কে জানে!

হিরণের মুখটা দেখতেই দূর্জয়ের গত রাতের কথা মনে পড়ে যায়। বাণীর সেই ভীত দৃষ্টি, বিভৎস চিৎকার। সঙ্গে সঙ্গে দূর্জয়ের মনে সুপ্ত ইচ্ছে জাগে শক্ত রডের আঘাতে এই ক্রিমিনালটার শরীরের সবগুলো হাড় গুড়ো গুড়ো করে দিতে।

হিরণকে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় দেখাচ্ছে। সে আনমনে প্রশ্ন করে,

“ ওই আগুনের উত্তাপে ওদের খুব কষ্ট হয়েছিলো, তাই না? “

দূর্জয় জবাব দেয় না। সে নীরবে নিজের শার্টের হাতা গোটাতে থাকে। হিরণ তখন একের পর এক প্রশ্ন করে বিলাপ পাড়তে ব্যস্ত।

“ আচ্ছা কেউ ওদের বাঁচালো না কেন? আশেপাশে কোনো মানুষ ছিলো না? পৃথিবীর এতো গুলো মানুষের মাঝে একটা মানুষের কানেও ওদের আর্তনাদ পৌঁছালো না? “

দূর্জয় একটাও প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। ক্রিমিনালদের সঙ্গে সে মুখ কম হাত চালাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। শার্টের হাতা দুটো কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে গলা হাকিয়ে বাহিরের নিরাপত্তা কর্মীকে ডাকে। উক্ত কর্মী ভেতরে উঁকি দিতেই শীতল গলায় অর্ডার শুধায়,

“ দরজাটা লক করে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকো। ভেতর থেকে যতই আওয়াজই আসুক না কেনো, কেউ যেনো প্রবেশ না করে। আই রিপিট কেউ না। “

নিরাপত্তা কর্মীটা আদেশটা মাথা পেতে নিয়ে বেরিয়ে যায়। দূর্জয় এগিয়ে যায় ধীর পায়ে। মনের ক্ষোভ মেটাতে আলাদা কোনো সরঞ্জামের প্রয়োজন নেই তার। তার দানবীয় শক্তির হাত এবং পা দু’টোই যথেষ্ট। হিরণের উদ্ভ্রান্তের ন্যায় কথা থেমে যায় প্রচন্ড শব্দে বাম গালে প্রথম চড়টা পড়তেই। কানটা যেনো তব্দা লেগে গেলো। চোখের সামনে সবটা ঝাপসা দেখতে শুরু করে সে। সে দুপুরে আকাশে উত্তপ্ত সূর্য না থাকলেও সেলটার ভেতর থেকে উত্তপ্ত চিৎকারের আওয়াজ ভেসে এসেছে। যেই চিৎকারে যেকারো শরীরে কাঁটা দিয়ে যাবে।

__________

বিশাল এপার্টমেন্টটার গ্যারেজে এসে থামলো গাড়ি। সন্ধ্যা তখন নেমেছে কেবল। জেসি ধীর গতিতে বের হয় গাড়ি থেকে। তার পিছু পিছু চারু ও আকাশও নামে। যদিও জেসির মা’রই আজ তার সঙ্গে হসপিটালে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আর যান নি। চারুই গিয়েছে। সঙ্গে আকাশকেও নিয়ে গিয়েছিলো। কারণ চারুর ধারণা তার ছেলেটা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। সারাদিন এই দু’জনকে নিয়ে বিভিন্ন টেস্টের জন্য হসপিটাল জুড়ে দৌড়াতে দৌড়াতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।

লিফটে উঠে দাঁড়াতেই চারু আপন মনে বলতে থাকে,

“ এখুনি বাসায় গিয়ে আমি ছয়টা ডিম সিদ্ধ বসাবো। দুইজন চুপচাপ মুখ বন্ধ করে তা খাবে। সামান্য নাক ছিটকালে আমি আজকে আব্বুর কাছে বিচার দিবো। সারাদিন খাবার নিয়ে প্যাঙছামি দু’জনের। ডিম দুধ না খেয়ে শরীরের এই অবস্থা করেছো তোমরা। “

চারুর কথা শুনে আকাশ চোখ মুখ থমথমে করে আড়চোখে নিজের ছোট ফুপ্পির দিকে তাকায়। জেসিও তখন বিরক্তি নিয়ে লিফটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার সুন্দর শিক্ষিত ভাবীটা বিয়ের পর টিপিক্যাল বাঙালি মায়েদের মতো হয়ে গিয়েছে। সমস্যা যা-ই হোক না কেনো তার আলটিমেট সলিউশন হচ্ছে ডিম সিদ্ধ, গরম দুধ, ভাত বাড়িয়ে খাওয়া ইত্যাদি।

লিফট এসে পৌঁছায় নির্দিষ্ট ফ্লোরে। কলিংবেল বাজিয়েই জুতা খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তিনজন। জেসির মা আফসানা বেগম হাসি হাসি মুখ করে দরজা খুলে। চারু দরজা থেকেই নালিশ শুরু করে,

“ আপনার মেয়ে আর নাতিকে ভাত বাড়িয়ে দিবো আজকে থেকে আম্মু। ওদের কোনো নাখরা আমি আর সহ্য করবো না। দুইজনের… “

বাকি কথাটা অসম্পূর্ণ রয়ে যায় চারুর। লিভিং রুমে বসে থাকা প্রত্যয়কে দেখতেই মুখটা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। জেসি তখন পিছন পিছন প্রবেশ করতে করতে বলে,

“ থামলে কেনো ভাবী? আরো বলো। শুনতে ভালো লাগছিলো। “

বাড়ির ভেতর পা রাখতেই জেসির মুখটাও আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। প্রত্যয় তখন ফালুদার বাটি হাতে বসে। আকাশ তাকে দেখতেই দৌড়ে গিয়ে বলে,

“ হ্যালো আংকেল। “

“ হাই। “

চারু আর জেসি কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ঘরে প্রবেশ করে। আফসানা বেগম তখন বলে উঠে,

“ সেই বিকেল থেকে বসে আছে ও। তোমাদের কল করতে চেয়েছিলাম। মানা করে বললো একদম ডাক্তার দেখিয়ে আস্তে ধীরে আসুক। “

জেসি শুকনো মুখে হ্যালো বলে নিজের রুমে চলে যায়। চারু প্রত্যয়ের শারীরিক অবস্থার কথা জেনে নিয়ে আকাশকে সহ রুমে চলে যায় হাত মুখ ধুয়ে আসতে। আফসানা বেগম তখন নাস্তা নিয়ে হট্টগোল কান্ড বাঁধিয়ে বসেছেন। প্রত্যয় আচমকা সাহস করে নমনীয় স্বরে বলে,

“ আন্টি কিছু মনে না করলে, জেসির সাথে একটু কথা ছিলো আমার। বলা যাবে কি? “

আফসানা বেগম সঙ্গে সঙ্গে বলে,

“ হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি। তুমি বসো। “

আফসানা বেগম তড়িঘড়ি করে জেসির রুমের দিকে এগিয়ে যায়। জেসি তখন জামা কাপড় বদলে সবে বসেছে। আফসানা বেগম এসে শুধায়,

“ প্রত্যয় নাকি তোমার সাথে কথা বলবে। গিয়ে দেখো কি বলে। খুব জরুরী কিছু হয়তো। আমিও তো ভাবছিলাম যে এই অবস্থায় ছেলেটা চট্টগ্রাম এসে পড়লো কেনো? “

জেসি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্কার্ফ গায়ে জড়িয়ে রুম থেকে বের হয়। ধীরে সুস্থে হেঁটে গিয়ে প্রত্যয়ের সামনে বসে বলে,

“ তোমার নামে উল্টাপাল্টা কিছু বলি কি-না তা পর্যবেক্ষণ করতে এসেছো? এতো অবিশ্বাস? “

“ উঁহু। তোমাকে পর্যবেক্ষণ করতে এসেছি। “

“ আমাকে মানে? “

“ সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করবো, উত্তরটাও সোজাসাপ্টা চাই। ইউ লাইক মি? বিয়েতে মত আছে তোমার? মত না থাকলে বলে দাও, এখুনি চলে যাবো। আর মত থাকলে জানাও, এনগেজমেন্টের ডেট ফিক্স করে যাবো। “

আচানক কথায় জেসি হতবাক হয়। বুদ্ধিহীনের ন্যায় বসে রয়। বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পায় না সে। প্রত্যয় মাথায় আঘাত পেয়েছে তা জেসির অজানা নয়। কিন্তু মাথায় আঘাত পেলে সেটার প্রভাব এতদিন পর দেখা যাচ্ছে কেনো? প্রত্যয় ফের বলে,

“ দ্রুত উত্তর দাও। “

জেসি ফট করে উঠে দ্রুত পায়ে নিজের রুমে চলে যায়। প্রত্যয় হতভম্ব হয়ে বসে রয়। গুগলের মতে তো এই মেয়েটা তাকে পছন্দ করে। তাহলে এভাবে উঠে চলে গেলো কেন? এভাবে উঠে চলে যাওয়াকে কি প্রত্যয় রিজেকশন ধরে নিবে? আর কিছু ভাবার পূর্বেই প্রত্যয়ের ফোনে নোটিফিকেশনের শব্দ বেজে উঠে। ফোন হাতে নিয়ে ম্যাসেজ ওপেন করতেই দেখে সেখানে লেখা,

“ ভেবে দেখলাম তুমি এতটাও খারাপ না। সারাজীবন সহ্য করার মতো বিরক্তিকর তুমি। তাই তোমার উপর দয়া করে মতটা দিয়েই দিলাম। “

প্রত্যয় চোখ মুখ কুচকে বসে রয়। একটা মত দিতে গিয়েও এই মেয়ে এমন অভিনয় করছে যেনো সে প্রত্যয়কে দয়া করে বিয়েতে রাজি হয়েছে! অথচ মনে মনে ঠিকই পছন্দ করে। মানে সাপ মারবে কিন্তু লাঠি ভাঙতে রাজি নয়।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]