এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-৬২+৬৩+৬৪

0
250

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৬২.

নিরিবিলি হলুদ টিমটিমে আলোয় মোড়ানো রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে আছে বাণী এবং দূর্জয়। তাদের পাশেই আরেকটা চেয়ারে বসে চারিদিকে চোখ বোলাচ্ছে বহ্নি। সে অবাক চোখে চারিদিকটা দেখছে। অনেকটা রেট্রো থিমে ডেকোর করা এই রেস্টুরেন্টটা। এরকম জায়গায় বহ্নি এর আগে কখনো আসে নি। পাপা তো সবসময় তাকে বলতো যে বাহিরের পৃথিবীটা মোটেও সেফ না, বরং খুব স্ক্যারি। কিন্তু গত কয়েক মাসে বহ্নি উপলব্ধি করেছে বাহিরের দুনিয়াটা বর্ণনাতীত সুন্দর। ওই জঙ্গলে ঘেরা বাড়িটার মধ্যে আবদ্ধ বহ্নির সেই সৌন্দর্য সম্পর্কে মোটেও ধারণা ছিলো না।

একজন ওয়েটার এসে একটা মেনু কার্ড দিয়ে যেতেই দূর্জয় তা বাণীর দিকে এগিয়ে দেয়। বাণী নিচু স্বরে বলে,

“ প্রয়োজন ছিলো না। “

দূর্জয় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,

“ অপ্রয়োজনীয় কিছু করে সময় অপচয় করার পক্ষপাতি আমি নই। আর তোমাদের সঙ্গে আমার টাইম স্পেন্ড করাটা অপ্রয়োজনীয় নয়। অন্তত আমি তা মনে করি না। “

বাণী আর কোনো কথা খুঁজে পায় না। সে কেবল আলগোছে মেনু কার্ডটা দেখে নিজের জন্য একটা থাই সেট মেনু এবং বহ্নির জন্য স্যালমন ফিশের একটা আইটেম অর্ডার করে। দূর্জয়ও নিজের জন্য অর্ডার বুঝিয়ে দেয় ওয়েটারকে।

ওয়েটার চলে যেতেই বহ্নি বলে,

“ মাম্মা, আমি একটু ওদিকটা থেকে ঘুরে আসি? “

বাণী সঙ্গে সঙ্গে বাধ সেধে বলে,

“ না, একা কোথাও যাওয়ার পারমিশন নেই। “

বহ্নি ঠোঁট উল্টে বলে,

“ প্লিজ মাম্মা। “

দূর্জয় মৃদু গলায় বাণীকে বলে,

“ অর্ডার সার্ভ করতে টাইম লাগবে। আমি বরং বহ্নিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি? ওর সঙ্গে আমার জরুরি কথাও আছে। “

বাণীর মন মানছে না। খুব অস্বস্তি কাজ করছে তার মধ্যে। বহ্নি এখনো বাচ্চা। সে এতো জটিল সম্পর্কের মারপ্যাঁচ আদৌ বুঝতে পারবে? দূর্জয় বুঝতে পারে বাণীর চিন্তাটা। সে নরম স্বরে বলে,

“ ওর অনুমতিটাও আমার জন্য জরুরি বাণী। লেট মি টক টু হার। ও রাজি না হলে আমি বিন্দুমাত্র জোর করবো না কিংবা আগাবো না। “

বাণী আমতা স্বরে বলে,

“ আমিও সঙ্গে যাই? “

দূর্জয় সামান্য হেসে নিজের হাত ঘড়ি দেখে নিয়ে বলে,

“ তোমাকে কোম্পানি দেওয়ার জন্য একজন আসছেন খুব শীঘ্রই। তুমি বরং উনার জন্য অপেক্ষা করো। “

__________

দূর্জয় বহ্নিকে নিয়ে গিয়েছে ঘড়ি ধরে দু মিনিট হলো। বাণী অস্থির অনুভব করছে ভেতরে ভেতরে। কে আসবে, কেন আসবে কিছুই বলে যায় নি দূর্জয়। কিছু না জেনে তবুও বাণী সেই অজানা ব্যক্তির জন্য অপেক্ষা করছে।

আর দু মিনিট গড়াতেই রেস্টুরেন্টের ভেতর পরিপাটি মসলিন শাড়ি পরিহিত একজন মহিলাকে প্রবেশ করতে দেখা গেলো। বয়স খুব সম্ভবত কেবল চল্লিশ কিংবা পয়তাল্লিশের কোটা পেরিয়েছে। চোখে মুখে কেমন স্নিগ্ধ একটা ভাব প্রকাশ পাচ্ছে। ভদ্রমহিলা উৎসুক নজরে এক মুহুর্তের জন্য চারিদিকে চোখ বোলাতেই বাণীর পানে এসে তার দৃষ্টি স্থির হয়। তিনি শাড়ির আঁচলটা নিজের কাধে চাপিয়ে নিয়ে বাণীর দিকে এগিয়ে আসে।

ভদ্রমহিলাকে নিজের দিকে অগ্রসর হতে দেখেই বাণীর নার্ভাসনেসটা বেড়ে যায়। সে ধীর ভঙ্গিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মহিলাটা তার সামনে এসে দাঁড়াতেই সে ধীমি স্বরে সালাম দেয়। সালামের জবাব দিয়েই ভদ্রমহিলা বলেন,

“ বাণী তালুকদার? “

“ জি। “

“ আমি সুহালা আফরিন। দূর্জয়ের মামণি। “

ভদ্রমহিলার পরিচয় পেতেই বাণী বিষম খায়। অত:পর আরো একদফা ভদ্রমহিলাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরখ করে। নিখুঁত মায়াবী মুখশ্রী, খুব সম্ভবত ডায়েট মেনে চলা শরীরের অবকাঠামো, মাথার চুলগুলো এখনো কুচকুচে কালো। এই মহিলাটাকে প্রথম দর্শনে যে-কেউ দূর্জয়ের মা কম বড়ো বোন বেশি মনে করবে।

বাণীর খচখচে মন নিজেকে নিয়ে আরো হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করে দেয়। ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই তাকে খতিয়ে দেখতে এসেছে? কিন্তু বাণীর মাঝে পছন্দ করার মতো কিছুই নেই। না আছে আহামরি রূপ, না আছে কোনো গুণ। উল্টো তার জীবনে আছে এক কালো অধ্যায়। যা কখনোই মুছবে না।

__________

বহ্নিকে চারিদিকটা ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে রেস্টুরেন্টের ওপেন টেরেসে এসে পৌঁছায় দূর্জয়। ওপেন টেরেসটাও বেশ ছিমছাম ভাবে সুন্দর করে সাজানো। টেরেসের এক কোণে থাকা একটা দোলনা দেখে বহ্নি উৎফুল্ল গলায় বলে,

“ মেজর, আমি দোলনায় বসি? “

দূর্জয় হেসে এগিয়ে যায়। নিজে দু’হাতের ভর দ্বারা একবার দোলনার ভার শক্তি পরীক্ষা করে ফের বহ্নিকে দোলনায় বসিয়ে দেয়। নিজে পিছনে গিয়ে একদম মৃদু ধাক্কায় দোলনা দোলাতে শুরু করে। বহ্নি ফের উৎফুল্ল গলায় বলে,

“ মাম্মা মিসড ইট। “

দূর্জয় এবার মনে কিছুটা সাহস নিয়ে বলে,

“ বহ্নি, আপনি জানেন পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের সম্পর্ক আছে? “

আচানক এরকম সিরিয়াস কথা বহ্নির মস্তিষ্ক প্রসেস করতে সময় নেয়। সে কিছুটা ভেবে বলে,

“ আমি বুঝতে পারছি না। “

দূর্জয় বলে,

“ ধরুন একটা বাচ্চার তার মা বাবার সঙ্গে যেই সম্পর্কটা সেটা আলাদা। আবার তার বন্ধুর সঙ্গে তার সম্পর্কটাও আলাদা। সেটাকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বলা হয়। “

বহ্নি বলে,

“ এবার বুঝেছি। “

“ ঠিক একইভাবে আপনার মাম্মার জীবনে আপাতত শুধু একটাই সম্পর্ক আছে। সেটা হলো শুধুমাত্র আপনার সাথে। আপনি উনার মেয়ে। “

“ হু। “

“ তো আপনার মাম্মার লাইফের বাকেট লিস্টে যদি আরেকটা সম্পর্কও যুক্ত হয়, তবে সেই ব্যাপারে আপনার অপিনিয়ন কি? “

বহ্নি দূর্জয়ের কথার ভাবার্থ বুঝতে পারে না। সে বোকার ন্যায় তাকিয়ে রয়। দূর্জয় এবার দোলনা ছেড়ে বহ্নির সামনে আসে। হাঁটু গেড়ে বসে প্রশ্ন করে,

“ আপনার মাম্মা যদি আপনার মাম্মা হওয়ার পাশাপাশি কারো ওয়াইফ হয়, তাতে আপনার আপত্তি আছে? আর ইউ রেডি টু শেয়ার হার উইথ এনিওয়ান? “

বহ্নি অবাক হয়ে দূর্জয়ের দিকে তাকায়। মাম্মা কারো ওয়াইফ হবে কেনো? মাম্মা তো পাপার ওয়াইফ ছিলো! আর পাপা ছিলো মাম্মার হাজবেন্ড! আর পাপা মাম্মাকে মেরেও ছিলো। সব হাজবেন্ডরাই কি এরকম হয়? বহ্নির জানা নেই। সে ফুসে উঠে বলে,

“ আমি মাম্মাকে কারো সাথে শেয়ার করবো না। হাজবেন্ডরা ব্যাড হয়। মাম্মা কারো ওয়াইফ হলে মাম্মা আবার হার্ট হবে। “

দূর্জয় বুঝানোর সুরে বলে,

“ হাজবেন্ডটা যদি আমি হই? আমার সঙ্গে আপনার মাম্মাকে শেয়ার করবেন? আই প্রমিজ ইউ আই উইল ট্রিট হার ওয়েল। “

বহ্নি আরো একদফা অবাক হয়। মেজর তার মাম্মার হাজবেন্ড হবে? সে চোখ সরু করে প্রশ্ন করে,

“ তুমি কিভাবে মাম্মাকে ওয়েল ট্রিট করবে? “

“ আপনার মাম্মা যেমন আপনাকে লাভ, কেয়ার এবং এফেকশন প্রোভাইড করে, আমিও আপনার মাম্মাকে একইভাবে সেম ট্রিটমেন্ট প্রোভাইড করবো। “

“ কেন? “

“ বিকজ শি ডিজার্ভস ইট। “

বহ্নি এবার গভীর ভাবুক হয়। সত্যিই তো! মাম্মা সবসময় তার খেয়াল রাখে, তাকে যত্ন করে, কিন্তু মাম্মার খেয়াল রাখার কেউ নেই। মাম্মারও নিশ্চয়ই কাউকে প্রয়োজন যে মাম্মার টেক কেয়ার করবে? সেই কেউ টা কি মেজর? বহ্নি জানে না। তবে মেজরকে তার সবসময় ডিসেন্ট মনে হয়। দূর্জয় এবার জানতে চায়,

“ বহ্নি, আমি কি আপনার মাম্মাকে বিয়ে করতে পারি? আপনার অনুমতি আছে? “

বহ্নি কিছুক্ষণ ভেবে বলে,

“ ওকে কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে। “

“ কি শর্ত? “

“ আমি বেশি শেয়ার করবো না। একটু মাম্মা তোমার, বাকি পুরোটা আমার। ডিল? “

বহ্নির এই সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলা অদ্ভুৎ কথা শুনে দূর্জয় ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে মুখ লুকিয়ে না চাইতেও নীরবে হেসে দেয়। ফের নিজেকে স্বাভাবিক করে বহ্নির হাত ধরে হ্যান্ডশেক করে বলে,

“ ডিল। “

__________

“ তোমার মেয়েকে দেখছি না যে? “

সুহালা বেগমের প্রশ্নের পিঠে বাণী জবাব দেয়,

“ দূর্জয়ের সঙ্গে আছে আন্টি। এসে পড়বে এখুনি। “

সুহালা বেগম বুঝতে পারছে না আর কি জিজ্ঞেস করা উচিত তার। প্রাথমিক প্রশ্ন উত্তর তো হয়েই গিয়েছে। আর তাছাড়াও তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছে বাণী নার্ভাস। তাই অযথা বাড়তি প্রশ্ন করে আরো নার্ভাস করে দিতে মন চাচ্ছে না তার। তিনি কেবল শান্ত গলায় বলে,

“ আমি তোমার ব্যাপারে সব জানি বাণী। এন্ড আই মাস্ট সে তুমি খুবই সাহসী এবং ধৈর্য্যশীল। “

সুহালা বেগম বাণীর ব্যাপারে সব জানে এতটুকু শুনতেই বাণীর অস্বস্তির মাত্রা বেড়ে যায়। মন চায় কোথাও পালিয়ে যেতে। কিন্তু সে ঠায় নিজের জায়গায় দৃষ্টি নত করে বসে রয়। সুহালা বেগম এবার বলে,

“ কিন্তু দূর্জয়ের স্ত্রী হলে তোমার সেই ধৈর্য্যের জায়গাটা আরো শক্ত করতে হবে। একজন সৈন্যের স্ত্রী হতে গেলে সবথেকে বেশি ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে হয়। কারণ একজন সৈন্য তার পরিবারকে যতটাই ভালোবাসুক না কেন, তার প্রায়োরিটি লিস্টে সর্বপ্রথম তার দেশ থাকে। “

বাণী চোখ তুলে দূর্জয়ের মা’য়ের পানে তাকায়। খানিক চুপ থেকে দেওয়ার জন্য উত্তর গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো শব্দ গুছিয়ে উঠতে পারে না। বাণীকে চুপ থাকতে দেখে সুহালা বেগম নিজ থেকে বলে উঠে,

“ তোমাকে একটা উদাহরণ দেই। দূর্জয় তখন আমার পেটে। সাত মাস চলছিলো। সেই মুহুর্তে দূর্জয়ের বাবার দেশের স্বার্থে ডাক পড়ে। আমাদের প্রথম সন্তান ছিলো দূর্জয়। ওর আগমনের জন্য আমরা দুজনেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু নিজের মা, স্ত্রী, অনাগত সন্তান ফেলে ওর বাবা দেশের ডাকে সাড়া দেয়। চলে যায় ফিল্ডে। ভাগ্য কি অদ্ভুৎ! দূর্জয়ের বাবা যাওয়ার কিছু দিন পরেই সাত মাসের সময়ই আমার লেবার পেইন শুরু হয়। নিজের জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়টায় আমি রিফাতিকে পাশে পাই নি। আমার ছেলে প্রি ম্যাচিওর অবস্থায় পৃথিবীতে আসে। পৃথিবীতে এসেও শান্তি পায় না। কি ভয়ংকর ঠান্ডার সমস্যা ছিলো তার! ১৫ টা দিন আমার ছেলে এনআইসিউ তে ছিলো। ইনফেকশনের সম্ভাবনার জন্য আমাকেও ওর কাছে যেতে দেওয়া হয়। সেই কঠিন সময় গুলো আমি একা পাড় করেছিলাম। কিন্তু তাই বলে ওর বাবার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র রাগ কিংবা আক্ষেপ ছিলো না। কারণ ওর বাবার পরিস্থিতিটাও আমি বুঝতে পারতাম। কোন বাবা চাইবে নিজের সন্তানের জন্মের সময় স্ত্রীর পাশে না থাকতে? “

খানিকটা বিরতি নিয়ে সুহালা বেগম ফের বলে উঠে,

“ আমি কেবল এইটুকু বলতে চাইছি একটা সম্পর্কে উভয় পক্ষ থেকেই ফিফটি ফিফটি এফোর্ট এর প্রয়োজন পড়ে। দূর্জয় যেমন নিজের তরফ থেকে তোমাকে ভালো রাখার চেষ্টা করবে, তেমনই তোমারও ধৈর্য্য ধরে ওর পরিস্থিতিও বোঝার চেষ্টা করতে হবে। পারবে না? “

বাণী এবার মাথা নেড়ে বলে,

“ পারবো, পারবো। “

সুহালা বেগম এবার হেসে বলে,

“ দূর্জয়কে ফোন করে দেখি ওরা এখনো আসছে না কেন! “

বাণী বিস্মিত স্বরে বলে,

“ আপনার কি আমার ব্যাপারে আর কিছু জানার নেই আন্টি? “

“ না। যা জেনেছি তা যথেষ্ট। “

“ সবকিছু জেনেও আপনার কোনো আপত্তি নেই? “

“ আপত্তি করার মতো কিছুই তো পেলাম না আমি। “

“ বহ্নি? “

সুহালা বেগম হেসে বলে,

“ একটা মেয়ে বাচ্চার আমার খুব শখ ছিলো জানো? কিন্তু আল্লাহ দুটো ছেলে দিলেন। এখন দূর্জয় এবং তোমার উছিলায় একটা ছোট মেয়েকে নিজের চোখের সামনে বেড়ে উঠতে দেখাটাতো আমার সৌভাগ্য। আল্লাহ ঘরে নিজের রহমত পাঠাচ্ছেন। রহমত গ্রহণ করতে আপত্তি থাকবে কেনো আমার? “

__________

গরম ধোঁয়া উঠা ডাম্পলিংস গুলোর মধ্য থেকে একটা ডাম্পলিং চপস্টিকের সাহায্যে দক্ষতার সহিত তুলে নেয় এক রমণী। অত:পর নিজের মুখের কাছে নিয়ে আলতো ভঙ্গিতে সামান্য ফুঁ দেয় গরম ভাবটা কমানোর জন্য। তার মুখোমুখি অপর চেয়ারটায় বসে থাকা যুবক মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে সেই দৃশ্য। রমণী এবার সামনের দিকে ঝুকে চপস্টিক সহ ডাম্পলিংসটা সেই যুবকের মুখের সামনে ধরে। যুবকটা সামান্য হেসে তা মুখে নেওয়ার জন্য হা করে ঠিক সেই মুহুর্তেই আষাঢ়ের বৃষ্টির ন্যায় কোথা থেকে একটা স্বর এসে হাজির হয়,

“ হাই আন্টি এন্ড ষ্টুপিড আংকেল। “

সাইফ এবং নিশা দুজনেই বিস্মিত হয়ে পাশে ফিরে তাকায়। বহ্নিকে দেখে তারা যতটা না অবাক হয় তার থেকে বেশি ভীত হয় বহ্নির পিছনে এসে দাঁড়ানো দূর্জয়কে দেখে, যে কি-না তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের পরখ করছে। সাইফ বিরক্তির সহিত মনে মনে বলে,

“ শালা চট্টগ্রাম শহরের কোনো কোণায় আমার শান্তিতে প্রেম করা লেখা নাই। “

মনের কথাটুকু শেষ করেই সাইফ সঙ্গে সঙ্গে নিশার বাড়ানো ডাম্পলিংসটা মুখে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলে,

“ আসসালামু আলাইকুম স্যার। কি অবাক কান্ড! আপনিও এখানে? আজকের ওয়েদারটাও অবশ্য সুন্দর। নাইস টু সি ইউ হেয়ার। “

নিশা তখন হতভম্ব ভঙ্গিতে একবার সাইফকে আবার দূর্জয়কে দেখছে। মনে মনে দোয়া করছে এইখানে যেনো অন্তত কোনো ঝামেলা না হয়। খুব এম্বেরিসিং হয়ে যাবে না-হয় বিষয়টা!

দূর্জয় প্রশ্ন করে,

“ তোমরা একসাথে কি করছো? “

নিশা ভীত স্বরে তড়িঘড়ি করে জবাব দেয়,

“ ভাইয়া আমাদের তো বাই চান্স দেখা হয়ে গিয়েছে। “

দূর্জয় এবার চোখ সরু করে প্রশ্ন করে,

“ তারপর তুমি বাই চান্স লেফটেন্যান্ট সাইফকে খাইয়ে দিচ্ছিলে? “

নিশা এবার আরো ব্যস্ত হয়ে বলে,

“ না, না। আমি তো উনাকে দেখাচ্ছিলাম যে চপস্টিক দিয়ে কিভাবে খেতে হয়। আসলে… “

এতদূর বলেই নিশা থেমে যায়। নিজের বোকা বোকা উত্তরের প্রতি বিরক্ত সে। প্রয়োজনের সময় তার এই ব্রেইনটা সবসময় গড়বড় করে বসে। দূর্জয় তখন ভ্রু কুচকে নিশাকে দেখছে। নিশা এবার আমতা আমতা করে বলে,

“ আই ক্যান এক্সপ্লেইন ভাইয়া। “

একটা সত্য ঢাকার জন্য হাজারটা মিথ্যা বলা সাইফের অপছন্দ। সে স্বাভাবিক গলায় বলে,

“ আমি এবং ইয়াসমিন একটা কমিটমেন্টে আবদ্ধ স্যার। “

দূর্জয় একবার সাইফের চেহারাটা পরখ করে অত:পর নিশার। সে বহ্নির দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলে,

“ আপনি এক মিনিট আন্টির সাথে থাকুন। “

বলেই সে সাইফকে ইশারা করে সাইডে আসতে। সাইফ বাধ্য সৈন্যের ন্যায় দূর্জয়ের পিছু পিছু যায়। দূর্জয় এবার গলা ঝেড়ে প্রশ্ন করে,

“ কতদিন ধরে চলছে এসব? “

“ বসুমতী শপিং কমপ্লেক্সের ওই ঘটনার সময় থেকেই। “

দূর্জয় আরেকবার তীক্ষ্ণ চোখে সাইফকে পরখ করে। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও নিশাকে সে আপন বোনের থেকে কম মনে করে না। আর তাছাড়া নিশা নিতান্তই ছোট এখনো। তাই ভাইসলুভ চিন্তাবশত বলে উঠে,

“ নিশা অত্যন্ত সহজ সরল একটা মেয়ে সাইফ। পানির মতো স্বচ্ছ ওর মন। আমি চাই না ও কষ্ট পাক। “

“ নিজের জান থাকতে কখনো ওকে কষ্ট পেতে দিবো না স্যার। আই এম সিরিয়াস এবাউট হার। ওর এডমিশন টেস্টের ঝামেলা মিটলেই আমি জুলফিকার স্যারের সঙ্গে কথা বলবো। উনাকে সবটা জানাবো। আমি জানি উনার মেয়েকে চাওয়ার যোগ্যতা এখনো আমার নেই, কিন্তু আমি নিজেকে প্রমাণ করবো। “

দূর্জয় আর কিছু বলে না। কেবল মাথা নেড়ে বলে,

“ আচ্ছা। নিজের কথা রেখো। অন্যথায় আমার তরফ থেকে নরম আচরণের আশা রেখো না। “

সাইফ এবার সামান্য হেসে বলে উঠে,

“ আপনি হয়তো আমাকে এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না স্যার। কিন্তু পুরো জীবন আপন কারো অভাবে ঘুণে খাওয়া মানুষ যখন ফাইনালি নিজের বলতে কাউকে পায়, তখন সে পুরো দুনিয়া এফোঁড়ওফোঁড় করে দিবে ওই মানুষটার জন্য তবুও গাদ্দারি করবে না। কসম করে বলছি স্যার প্রাণ থাকতে আমি কখনো ইয়াসমিনের সঙ্গে গাদ্দারি করবো না। “

সাইফের কথায় হতো আশ্বস্ত হয় দূর্জয়। সে বলে,

“ আমি স্যারকে কিছু জানাবো না। তবে সময়মতো নিজেরা সবটা জানিয়ে দিবে। বুকে সাহস নিয়ে হাত চাইতে আসবে। “

সাইফ জানে দূর্জয় স্যার যেহেতু বলেছে তিনি এই ব্যাপারে কিছু বলবে না, সুতরাং তিনি নিজের কথার বরখেলাফ করবে না। কিন্তু ওই ক্যাসেট? ওই ধানি মরিচ চুপ থাকবে তো? সাইফ বলে উঠে,

“ বহ্নি? “

দূর্জয় আশ্বস্ত করে বলে,

“ ওকে আমি বুঝিয়ে বলবো। ও কাউকে জানাবে না। “

__________

জিন্স এবং টি শার্টের সঙ্গে লম্বা ওভারকোট পরিহিত নারীটা সমুদ্রের তীর ঘেঁষে আপন মনে হাঁটছে। নিজের অত্যন্ত পছন্দের হিল শু জোড়া সমুদ্রের পানি থেকে বাঁচানোর জন্য হাতে নিয়ে রেখেছে সে। দমকা বাতাসে তার লালচে চুল গুলো উন্মাদের মতো উড়ছে। মাঝে মধ্যে সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ তীরে এসে তার পা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।

আচমকা ফোন বেজে উঠতেই দৃশানের ধ্যান ভাঙ্গে। সে জিন্সের পকেট হতে ফোনটা বের করে দেখে তার দাদীমা ভিডিও কল দিচ্ছেন। দৃশান কলটা রিসিভ করেই হাসি হাসি মুখ করে বলে,

“ আসসালামু আলাইকুম দাদীমা। “

ফোনের অপর পাশে থাকা বৃদ্ধা হাসি হাসি মুখ করে সালামের জবাব নিয়ে বলে,

“ কেমন লাগছে আমার দেশ? “

“ তোমার দেশ আর দেশের মানুষ গুলো অত্যন্ত সুন্দর দাদীমা। “

বৃদ্ধা টিপ্পনী কেটে বলে,

“ দেশে কি কোনো সুদর্শন পুরুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো নাকি তোমার? “

নিজের দাদীমার সঙ্গে দৃশানের সম্পর্কটা অত্যন্ত সহজ এবং সাবলীল। তাই সে বলে,

“ শুধু সুদর্শন নয় বরং অত্যন্ত সুদর্শন। “

বৃদ্ধা এবার অবাক নয়নে দৃশানের উজ্জ্বল দৃষ্টি পরখ করে বলে,

“ তুমি প্রেমে ট্রেমে পড়ো নি তো? “

দৃশান এবার চুপ হয়ে যায়। মুখের হাসি হাস ভাব উবে গিয়ে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। শান্ত গলায় বলে,

“ আমি তোমাকে পরে কল দিচ্ছি দাদীমা। আল্লাহ হাফেজ। “

বলেই ফোনটা কেটে দেয় দৃশান। তার বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। নির্নিমেষ সমুদ্র পানে তাকিয়ে ভাবে কি এক সর্বনাশ ডেকে আনলো সে। দুটো মানুষের মধ্যে রয়েছে কত শত পার্থক্য। বয়সের পার্থক্য, জাতীয়তার পার্থক্য। আর তাছাড়া দুটো মানুষ দুটো ভিন্ন দেশের রক্ষাকর্মী। দেশ এবং দায়িত্ব দিয়ে বাঁধা তারা। সেই শিকল ছেড়ে কেউই বেরোতে পারবে না। এই টুকরো টুকরো অনুভূতি ছেড়ে শীঘ্রই বেরিয়ে আসতে হবে নামরার। আর কোনো পথ নেই তার কাছে।

মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় যত দ্রুত সম্ভব এই দেশটা ছেড়ে তার নিজের দেশে ফিরতে হবে। তার অনুভূতিগুলো তাকে গুল্মলতার ন্যায় পেঁচিয়ে ধরার আগেই তার ফিরে যেতে হবে। ওই পুরুষটাকে আরেক বার দেখার অপ্রতিরোধ্য ইচ্ছেটা দমন করতে হবে দৃশানের। তাতে বুকের তৃষ্ণা তীব্র থেকে তীব্রতর হলেও কোনো যায় আসে না।

দৃশানের ভাবনার মাঝেই খুব কাছ হতে ভেসে আসে একদল ছেলের গলা ছেড়ে গাওয়া গানের সুর,

” ভালোবাসা বাকি আছে তোমারও আমার কাছে
যা চেয়েছো দিতে আমি পারি না।
আমারও সময় ডালে ফুরিয়ে এসেছে পাতা
এতো প্রেম কাছে এসে এলো না। ”

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৬৩.

সে-কি ব্যস্ত চারটা দিন পাড় করলো সুহালা। একটা মাত্রই ছেলে আছে এখন তার। সেই ছেলের বিয়েতে কোনো কিছুই কমতি রাখতে চান নি তিনি। যদিও প্রতিটা ব্যাপারেই বাণীর সিদ্ধান্ত জেনে তবেই তিনি এগিয়েছেন।

এই যেমন বিয়েটা কেমন পরিবেশে করতে চায় জানতে চাওয়ার পর বাণী অত্যন্ত বিনয়ী স্বরে কেবল বলেছিলো ঘরোয়া এবং ছিমছাম ভাবে কাছের ক’টা মানুষ নিয়ে হলেই সে খুশি। বাণীর সঙ্গে দূর্জয়ও একমত ছিলো। অহেতুক অতিরিক্ত মানুষের ভীড় তার পছন্দ নয়। সুহালা বেগম তাই নিজের লম্বা অতিথির তালিকা বাদ দিয়ে কেবল হাতে গোণা কিছু মানুষকে দাওয়াত দিলেন। বিয়ের আয়োজনটাও করা হলো রেসিডেন্সিয়াল এলাকার অন্তর্ভুক্ত মসজিদটায়।

বিয়ে উপলক্ষে আর দশটা বধূর মতো বাণীর মনে কোনো সাধ আহ্লাদ ছিলো না। সেজন্য শপিং করতে গিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছিলেন সুহালা। বাণীকে তিনি যা-ই দেখাচ্ছিলো বাণী কেবল জবাবে বলছিলো,

“ আপনার যা ভালো মনে হয় আন্টি। “

সুহালা বেগম তখন হার মেনে নিজের ছেলেকে ফোন করে। সবটা জানিয়ে বলে,

“ তোদের কথায় এনগেজমেন্ট, গায়ে হলুদ, রিসিপশন প্রতিটা ইভেন্টের আইডিয়া আমি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম। শুধু বিয়ের অনুষ্ঠানটার আয়োজন করলাম। সেটা নিয়েও তোরা এতো হেয়ালি করছিস। তোদের থেকে তো বহ্নিই ভালো। অন্তত কাউকে তো আমি পেলাম যে আমার মতো আগ্রহী বিয়েটা নিয়ে। “

দূর্জয় ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ আমি মোটেও বিয়ে নিয়ে হেয়ালি করছি না মামণি। বিয়েটার গুরুত্ব আমার কাছে অত্যাধিক। আর রইলো বাণীর কথা, ওর সিচুয়েশন থেকে এরকম সাজসজ্জা কিংবা অনুষ্ঠানের প্রতি ওর অনাগ্রহটা স্বাভাবিক। তুমি এক কাজ করো, আমাকে বরং ওর ড্রেস আর জুয়েলারির ছবি পাঠাও। ওয়াইফ যেহেতু নিজে কিছু পছন্দ করতে পারছে না, তাহলে আমি-ই ওর হয়ে সে-ই কাজটা করে দেই। “

সুহালা বেগম ছেলের কথা শুনে অত্যন্ত খুশি হয়। ছেলের বলা শেষ কথাটা শুনে তার নিজের মরহুম স্বামীর কথা মনে পড়ে। ওই লোকটাও এরকমই ছিলো। ভদ্রতায় মোড়ানো।

__________

প্রায় মধ্যরাত। শীতের রাতের আদুরে চাদরে বহ্নি তখন ঘুমিয়ে কাদা। ঘুম নেই কেবল বাণীর চোখে। ঘড়ির কাটা বারোটার ঘর পেরিয়ে যাওয়ার দরুণ আজকে মাসের এগারো তারিখ। শুক্রবার। বাণীর বিয়ে আজ। এইতো আর ঘন্টা কয়েক পরেই ভোরের আলো ফুটবে। শুরু হয়ে যাবে বিয়ের চূড়ান্ত তোড়জোড়।

রুমে জ্বলমান ল্যাম্পের মিঠে হলুদ আলোয় চারিদিকটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রুমের একপাশে থাকা সুন্দর সিঙ্গেল সোফাটার উপর জায়গা দখল করে আছে একটা বিশাল মখমলের কাপড় দ্বারা মোড়ানো কালো বাক্স। বাক্সটা মূলত বাণীর বিয়ের জামার। সুহালা বেগমের মুখে বাণী শুনেছে জামাটা নাকি দূর্জয়ের পছন্দের। কেবল জামাটাই নয় তার সঙ্গে জুয়েলারি গুলোও দূর্জয় নিজেই পছন্দ করেছে।

কি অদ্ভুৎ! এই মানুষটাকেই তো একদিন নিজের ভাগ্যের সঙ্গে জুড়তে চেয়েছিলো বাণী। তখন কেনো জুড়ে নি? আর আজ এমন পরিস্থিতিতে জুড়ছে, যখন বাণী সর্বহারা। ভাগ্য কি বাণীর সঙ্গে খুব ভয়ানক কোনো উপহাস করলো? কে জানে!

বিছানার হেড সাইডে হেলান দিয়ে বসে থাকা বাণী নিজের দু’হাতের পানে তাকায়। শুভ্র রঙা হাত দুটো মেহেদীর কালচে রঙে রাঙা হয়ে আছে। সন্ধ্যা বেলায় নিশা এসে এক প্রকার জোড় করেই বাণীকে মেহেদী দিতে চায়। বাণী রাজি হলেও বলে খুবই মিনিমাল কোনো ডিজাইন দিতে। নিশা বাণীর কথা শুনে। দু হাতের তালুর মধ্যিখানে সুনিপুণ পদ্মফুলের নকশা আঁকে। তাছাড়াও দু হাতের সরু লম্বা আঙুল গুলোর তিনভাগের একভাগ জুড়েও মেহেদী লেপ্টে দেয়।

মেহেদীর নকশাটা অত্যন্ত সুন্দর হলেও বাণীর মনটা বিষণ্ণ। অস্থিরতা তার পিছুই ছাড়ছে না। রুমের দখিন দিকের বড় আয়নাটায় চোখ পড়তেই বাণী নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নিজেকে দেখে। হুট করে নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে শ্রীহীন নারী বলে বোধ হয় তার। লাবণ্যহীন এই মুখটার কোথাও বধূ বধূ ভাবটা স্পষ্ট নয়। এরকম আরো বহু উদ্বেগ বুকে গুটি পাকিয়ে জমা করতে করতেই সারাটা রাত পাড় করে দেয় বাণী। রাত গিয়ে আগমন হয় ভোরের প্রথম আলোর।

__________

মেসের রুমে থাকা আয়নাটায় নিজেকে ঘুরে ফিরে দেখছে সাইফ। তার তামাটে রঙের গায়ে শোভা পাচ্ছে এক প্লেইন হোয়াইট শার্ট। সেই সঙ্গে কালো রঙা প্যান্ট এবং জুতো। শার্টটা গায়ে জড়িয়েই সাইফের মনটা অত্যন্ত ফুরফুরে হয়ে গেলো। হাজার হোক ইয়াসমিনের উপহার বলে কথা! আর দশটা শার্টের মতো এই শার্টটার প্রতি বিন্দুমাত্র অযত্ন যে খাঁটে না!

নিজের শু জোড়া পড়ার মাঝে আড়চোখে উড়ু উড়ু মনের সাইফকে পরখ করছিলো সাদাত। বন্ধুর সুখ দেখতেও ভালো লাগে তার। যতই হাসি ঠাট্টা করুক না কেনো, দিনশেষে তার এই একাকী বন্ধুর জীবনেও যে চলার কোনো সঙ্গী এসেছে তাতে সাদাতরা পুরো বন্ধুমহলটা অত্যন্ত খুশি। সাদাত হেসে শুধায়,

“ তোকে এখন অত্যন্ত ভদ্রলোক দেখাচ্ছে। “

সাইফ অবাক হয়ে বলে,

“ তাই নাকি বন্ধু? তাহলে এই রূপে শশুরের সামনে গিয়ে হাজির হবো? আমার এই ভদ্র বেশ দেখে পটে নিজের কন্যাকে আমার হাতে তুলে দেওয়ার কোনো চান্স দেখছিস? “

সাদাত হঠাৎ ‘কিছু মনে পড়েছে’ এমন মুখভঙ্গি করে বলে,

“ বাই দ্যা ওয়ে তুই এখনো ভাবীর সাথে আমাদের পরিচয় করাস নি। ব্যাপার কি বল তো? আমাদের কারো বোনকে লুকিয়ে পটিয়ে ফেলেছিস নাকি? “

শেষের কথাটা মজার ছলেই বলে সাদাত। সাইফ বলে,

“ নো ব্রো। তোদের বোন মানে আমার বোন। নিজের এক কবুলের বউ বাদে দুনিয়ার সব বেডি মানুষকে আমি মা-বোন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করে দিসি। “

“ খুব ভদ্র হয়ে গিয়েছিস। “

“ তোরা চাপ নিস না। আজকে আমার এক কবুল বলা বউয়ের সাথে তোদের পরিচয় করায় দিবো। “

সাদাত আর কিছু বলতে নিবে এর পূর্বেই তার ফোনটা শব্দ তুলে বেজে উঠে। সাইফও রুম থেকে বেরিয়ে যায়। স্ক্রিনে নিজের মা’য়ের নামটা দেখতেই সাদাত ফোন রিসিভ করে। ফোনের অপর পাশ হতে এক পৌর নারী
বলে উঠে,

“ আমার বাবাটা কেমন আছে? “

“ আলহামদুলিল্লাহ মা। তুমি ভালো আছো? সাওদা, সায়রা ওরা ভালো আছে? “

“ আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছি আমরা। শুক্রবার দেখে আজকে তেহারি রান্নার আয়োজন করছিলাম। চাল ধুতে নিয়ে হঠাৎ তোর কথা মনে পড়লো। তোকে রেখে তেহারি খেতে ইচ্ছে করছে না। “

“ এভাবে বলছো কেন? আমি কি না খেয়ে আছি নাকি? আজকে আমাদের মেজরের বিয়ে। দাওয়াত আছে। এভাবেই জম্পেশ খাওয়া দাওয়া হবে আমাদের। তুমি এতো কিছু না ভেবে রান্না বসাও তো। সাওদা আর সায়রাও খুব পছন্দ করে এটা। “

“ তোকে কতদিন ধরে দেখি না! বোন দুটোর জন্য বাপের মতো দায়িত্ব পালন করছিস। মাসে মাসে টাকা পাঠাচ্ছিস, কিন্তু ঘরের জন্য একবারও মন পুড়ে না তোর? “

সাদাতের মনটা আচানক খারাপ হয়ে যায়। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ আমি তো খারাপ নেই মা। দূরে থাকলেও যখন দেখি তোমরা ভালো আছো তখন স্বস্তি পাই। তোমাদের ভালো থাকাটাই আমার কাছে শান্তি। “

“ মাঝেমধ্যে মন চায় তোকে বলি এসব বেতনের টাকা পয়সা লাগবে না। সব ফেলে ছুড়ে বাড়ি চলে আয়। আমার চোখের সামনে থাক। “

“ ধ্যাৎ! এটা হয় না-কি? আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করছি। ইনশাআল্লাহ দেখো সাওদা আর সায়রাও নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে। আমার বোন দুটো এভাবেই লক্ষী। তার উপর পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী। দু’জনেরই ঠিকই একটা গতি হবে। তুমি দেখে নিও… “

বলতে বলতেই সাদাত থেমে যায়। হুট করে মনে পড়ে যায় বাণী আপুর কথা। কি ভেবে যেনো সে বলে উঠে,

“ মা, সম্ভব হলে সাওদা আর সায়রার দিকে একটু বেশি খেয়াল রেখো। একা রাস্তা-ঘাট কিংবা প্রাইভেট, কোচিং-এ ছেড়ো না। আমি তো দূরে, কিন্তু তুমি ছায়ার মতো পাশে থেকো। যুগটা খুব ভয়ংকর মা। মুখোশধারী অনেক অমানুষ আমাদের চারিদিকে প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়াচ্ছে। “

সাদাতের মা হয়তো কথার আড়ালের সূক্ষ্ম ইঙ্গিতটা ধরতে পেরেছে। তিনি কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই কোথা থেকে সাওদা আর সায়রা উড়ে এসে ফোনটা ছোঁ মেরে নিয়ে পালা ধরে ভাইয়ের কাছে একে অপরের নালিশ নিয়ে বসে। সাদাত কেবল মুচকি হেসে বোন দু’টোর অভিযোগ শুনতে থাকে।

__________

জুম্মার নামাজ কেবল শেষ হলো। অতিথিদের মধ্যে সকল পুরুষরা এক সঙ্গে জামাতে জুম্মার নামাজ আদায় করেছেন। পূর্ব আলোচনা অনুসারে এখনই বিয়েটা পড়ানোর কথা। অত:পর খাওয়া দাওয়ার পর্ব শুরু হবে। অতিথিরা ইতিমধ্যে আসা শুরু করে দিয়েছে। দূর্জয়ের খুব কাছের ক’জন সিনিয়র, তার স্পেশাল ফোর্সের লেফটেন্যান্টরা, তাছাড়া তার ফুফু এবং তার পরিবার। দূর্জয়ের লেফটেন্যান্টদের বাগদত্তা হিসেবে অন্যা এবং জেসিও নিমন্ত্রণ পেয়েছিলো। তারাও সময়মতো এসে হাজির। অপেক্ষা কেবল এখন কনে পক্ষের।

কনে পক্ষ এলো ঘড়ি ধরে ঠিক বিশ মিনিট পরে। মসজিদের বাহিরে প্রধান ফটকে তখন লাল রঙের ফিতা বাঁধা। ফিতার এপাড়ে রয়েছে দূর্জয়ের ছয় লেফটেন্যান্ট এবং দুই ফুফাতো ভাই। গাড়ি থেকে সবার আগে নামে নিশা। গায়ে তার অত্যন্ত সুন্দর এক হালকা গোলাপি রঙের শিফন কাপড়ের অরগানজা থ্রি পিস। গেটে ফিতা দেখতেই নিশা বিস্ময়ে হতবাক। এ-কি কান্ড? এটা না কনে পক্ষের পালিত প্রথা? প্রথা কি উল্টে গেলো না-কি?

জুলফিকার মুজতবা গাড়ি ছেড়ে নেমে এই অবস্থা দেখে বাণীকে বলে সে যেনো আপাতত গাড়ির ভেতরই বসে থাকে। গেটের এই বাকদ্বন্দে বেশ সময় লাগবে। বাণী চুপচাপ গাড়ির ভেতর বসে থাকলেও বহ্নি থাকতে পারে না। সে বলে সে দ্রুত ভেতরে যেতে চায়। জুলফিকার মুজতবা আর কথা না বাড়িয়ে বাণীর অনুমতি নিয়ে বহ্নিকে গাড়ি থেকে নামায়। বহ্নি আজ সাদা রঙের একটা ফ্রক পড়েছে। চুলগুলো পরিপাটি করে আঁচড়ে মাথায় একটা সোনালি রাউন্ড ব্যান্ডও পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ম্যাচ করে পায়েও পড়েছে সোনালী রঙের জুতো। এই উৎসব উৎসব ভাবটা তার খুব পছন্দ হচ্ছে। সে খুশি মনে জুলফিকার মুজতবার হাত ধরে অন্য গেট দিয়ে মসজিদের ভেতর চলে যায়।

__________

নিশার হয়েছে মাইনকার চিপায় পড়ার মতো অবস্থা। বর পক্ষের দামড়া দামড়া আট পুরুষ কি সুন্দর গেট রুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বিপরীতে কনে পক্ষের একা নিশা বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। মুখটা তার প্রায় কাদো কাদো। রাফি তখন গলা ঝেড়ে বলছে,

“ ছোট্ট আপু, আমাদের ছেলে কোটিতে একটা। আর তাছাড়াও বিয়ে বাড়িতে প্রবেশের জন্য একটা মিনিমাম টিকিট কাটার তো প্রয়োজন আছে, কি বলুন? সিনিয়র এবং জুনিয়র বাদ দিয়ে যদি শুধু আপনার এবং আমাদের মেজরের হবু বউয়ের কথাই চিন্তা করি তবুও পার পারসন টিকিট পরবে বিশ বিশ মিলিয়ে চল্লিশ হাজার টাকা। আর সঙ্গে ভ্যাট ট্যাক্স মিলিয়ে আরো দশ হাজার। সব মিলিয়ে পঞ্চাশ হাজার মাত্র। “

নিশা শুকনো মুখে বলে,

“ ভাইয়া নিয়মটা উল্টো হয়ে গেলো না? “

নিশার শুকনো মুখটা মেনে নিতে সাইফের কষ্ট হয়। সে দুঃখী দুঃখী গলায় বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলে,

“ দোস্ত, ছেড়ে দে না। একা পেয়ে উনাকে বিরক্ত করছিস কেন? “

ফারদিন অবাক হয়ে বলে,

“ এই কথা তুই বলছিস সাইফ? “

জুনায়েদ আবারও হাত ঘড়ি দেখে বলে উঠে,

“ ছোট্ট আপু, দেখেন সময় যত অপচয় করবেন ততই নগদ পঞ্চাশের সঙ্গে আরো জরিমানা যুক্ত হবে। তাই দ্রুত আমাদের বেয়াইগত হক আদায় করে ফেলুন। আমরা আপনাদের ফিতা কাটার সুযোগ দিয়ে চমৎকার স্বাগতম জানানোর অপেক্ষায় আছি। “

নিশা কূল কিনারা না পেয়ে নিজের হাতের পার্স চেক করে। পার্সের ভেতর তার ফোন, বাসার চাবি, লিপস্টিক, আইলাইনার, একটা ক্রেডিট কার্ড এবং খুচরো কিছু টাকা ছাড়া আর কিছুই নেই। সে আরেকবার অসহায় চোখ মেলে সাইফের দিকে তাকায়। সাইফ আর উপায়ন্তর না পেয়ে বন্ধুদের ভীড় থেকে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে কাউকে কল করে। মিনিটের মধ্যে আবার ফিরে এসে নিজের আগের জায়গা দখল করে দেখতে থাকে বন্ধুদের কাহিনী।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে এসে উপস্থিত হয় জেসি এবং অন্যা। তারা অপর পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে নিশার পাশে দাঁড়ায়। জেসি নিজের স্বভাবসলুভ স্বরে বলে উঠে,

“ কি চলে? “

প্রত্যয় আগ বাড়িয়ে বলে,

“ তুমি একদম এসবের মাঝে পড়বে না জেসি। তুমি কিন্তু ছেলে পক্ষ। “

“ চুলোয় যাক তোমার লজিক। আমি মনে প্রাণে এই মুহুর্ত থেকে কনে পক্ষ। এবার সাহস থাকলে তোমাদের ডিমান্ড কতো বলে দেখাও। “

জুনায়েদ বলে,

“ নগদ পঞ্চাশ। “

জেসি অবাক হয়ে বলে,

“ সিরিয়াসলি? মাত্র পঞ্চাশ? তোমাদের ডিমান্ড লেভেল এতটাও কম আশা করি নি আমি। পঞ্চাশ আর কি এমন বিষয়! প্রতিদিন রাস্তায় আসতে যেতে কত গরীবকেই তো পঞ্চাশ টাকার নোট দেই। তোমাদেরও না-হয় দিলাম! “

মুহুর্তেই অপমানে চুপসে যায় আটটি মুখ। অন্যা দ্রুত নিজের পার্স থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে ছেলে পক্ষকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ শুক্রবারে দান করলে শুনেছি নাকি নেকির পরিমাণ বেশি হয়। এই নিন আপনারা। মুক্ত হস্তে দান করিলাম। “

জেসি এবং অন্যার আগমনে দীর্ঘক্ষণের বাকবিতন্ডার ইতি ঘটে। থমথমে মুখ সহিত ছেলে পক্ষ পাঁচশো টাকার নোট নিয়েই গেট ছাড়তে বাধ্য হয়।

__________

মসজিদের ভেতরে প্রবেশের দরজা হতে ঠিক মাঝ বরাবর সম্পূর্ণটাই গালিচার ন্যায় বধূর প্রবেশপথ হিসেবে সাজানো হয়েছে। তারই দু’পাশের জায়গা জুড়ে সাদা চাদরে মোড়ানো অতিথিদের বসার জন্য গদি সাজানো। পুরুষ এবং নারীদের বসার ব্যবস্থা আলাদা আলাদা করা হয়েছে। তাছাড়া গালিচা হয়ে হেঁটে সামনে গেলেই বর বধূর আলাদা বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাঝখানে পর্দা হিসেবে লম্বা বেলি ফুলের মালা গুলো সারি আকারে ঝুলানো। ডেকরশনটা সম্পূর্ণ বেলি, সাদা গোলাপ এবং বিভিন্ন সাদা রঙের ফুল দ্বারাই করা হয়েছে।

আচমকা দূর্জয়ের কাজিনদের একজন ‘বউ এসেছে, বউ এসেছে’ বলে ভেতরে প্রবেশ করে। সকলের মনযোগ তখন দরজার পানে স্থির। বহ্নি আগেভাগে ভেতরে প্রবেশ করে দূর্জয়ের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে-ও এই মুহুর্তে আগ্রহী নয়নে দরজার দিকে তাকিয়ে।

সবথেকে বেশি আগ্রহী হলো সাদা পাঞ্জাবি এবং তার উপর সাদা কাপড়ে সূক্ষ্ণ সোনালী সুতার জারদোজি কাজ করা কোটি পরিহিত পুরুষটা। শান্ত দৃষ্টির আড়ালে গোপন উদগ্রীব নয়ন মেলে দরজার পানে তাকিয়ে আছে নিজের বধূর অপেক্ষায়। তার অপেক্ষার ইতি ঘটে দরজা দিয়ে সাদা এবং হালকা সোনালী মিশেলের বিয়ের জোড়া গায়ে জড়ানো স্নিগ্ধ নারীর আগমনের মাধ্যমে। দৃষ্টি তার বরাবরের মতোই নত। গলা, কানে এবং মাথায় রয়েছে দূর্জয়ের পছন্দ করা কুন্দনের অলংকার। মাথার চুলগুলো অত্যন্ত পরিপাটি ভঙ্গিতে মাঝখানে সিথী করে খোপা করা হয়েছে। সেই খোপায় গুজে দেওয়া হয়েছে বেলী ফুলের মালা। সেই খোপা শুদ্ধ অর্ধেক মাথাটা একটা পাতলা সাদা ও সোনালী রঙের আঁচলে ঢাকা। হাতেও মুঠো ভর্তি চুড়ি নেই। বরং কেবল দু হাতে দুটো কেবল চুড়ি। এই স্নিগ্ধ বধূকে দেখেই দূর্জয় থমকায়। পরপর সবার আড়ালে ঘাড় অন্যদিকে ফিরিয়ে মৃদু হাসে। এই স্নিগ্ধ নারী এবং এই নারীর স্নিগ্ধতার ছোট অংশ হিসেবে বহ্নি এখন পুরো জীবনের জন্য দূর্জয়ের নামে লিখিত হবে ভাবতেই মনে শীতল অনুভূতি এসে ভর করলো। নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে হলো।

__________

বিয়ে পড়ানো সবে শুরু হবে। ইতিমধ্যে কাজী সাহেব এসে উপস্থিত হয়েছেন। ঠিক এরকম একটা মুহুর্তে দূর্জয়ের ফুফু এসে সুহালা বেগমের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ ভাবী, সুন্দরী হলেও ডিভোর্সী মেয়ে মানা যেতো। কিন্তু মেয়ের সাদা গায়ের রঙ ছাড়া তো রূপের কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। তার উপর বয়সটাও পঁচিশের ঘর পেড়িয়েছে। আমাদের দূর্জয়ের জন্য কি দেশে মেয়ের এতোই অকাল পড়েছিলো? ছেলে আমাদের কিসে কম ছিলো? “

সুহালা বেগম বিরক্তি নিয়ে দূর্জয়ের ফুফুর পানে তাকায়। এই মহিলা গতকাল আসার পর থেকে সুযোগ পেলেই সুহালা বেগমকে খোঁচাচ্ছেন শুধু। সুহালা বেগম ইচ্ছে করেই সবাইকে জানিয়েছেন যে বাণী ডিভোর্সি। তার ঘরের বউ সম্পর্কে সে আর তার ছেলে অবগত থাকাটাই যথেষ্ট। অন্যথা দূর্জয়ের ফুফু যদি জানতে পারতো যে বাণী সিঙ্গেল মাদার, তাহলে এতক্ষণে তিনি কথার ধারে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে ফেলতেন।

সুহালা বেগম মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় বাণী কিংবা বহ্নিকে এক মুহুর্তের জন্যও এই মহিলার সাথে একা ছাড়া যাবে না। কখন কোন আজেবাজে কথা বলে বসে সেই ভরসা নেই।

বাণীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বহ্নি, জুলফিকার, নিশা, জেসি, অন্যা এবং আরো বেশ ক’জন। মসজিদে প্রবেশের পর থেকে এখনো একদফা চোখ তুলে কারো পানে তাকায় নি বাণী। অতিথি সংখ্যা নিতান্তই কম হওয়া সত্ত্বেও বাণী অস্বস্তি বোধ করছে। পরিচিত-অপরিচিত সকলের আগ্রহের মূলকেন্দ্র বিন্দু হয়ে দমবন্ধকর অনুভব হচ্ছে তার। তীব্র দমবন্ধকর অনুভূতির চাপে পেটের খিদেটাও কেমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তার। সকাল থেকে অস্থিরতায় দুমুঠো ভাত মুখে তুলতে পারে নি সে। আর এই মুহুর্তে কি-না খিদের চোটে মাথা খালি অনুভব হচ্ছে।

বাণীর দমবন্ধকর পরিস্থিতির মাঝেই কাজী এসে উপস্থিত হলো। কাজীর বলা প্রতিটা কথাই নীরবে মনযোগ দিয়ে শুনে বাণী। নিজের মুখটা সে খুলে একদম কবুল বলার মুহুর্তে। ধরা গলায় কেবল তিন বার উচ্চারণ করে কবুল। চারিদিক থেকে সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে। বাণীর বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই কাজী উঠে দূর্জয়ের কাছে যায়। দূর্জয় কবুল বলার আগ মুহুর্তে একবার ফুলের পর্দার ফাঁক গলে বাণীর মুখটা দেখে নিয়ে নির্দ্বিধায় কবুল বলে দেয়। সইয়ের মাধ্যমে নিজেদের সম্পর্কের নাম, পরিচয় এবং অধিকার বোধটুকু আরো শক্ত করে পাকাপোক্ত করে নেয়।

__________

খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই লেফটেন্যান্টরা এককোণে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল ছিলো। তাদের সঙ্গে ছিলো জেসি এবং অন্যাও। সবাই যখন গল্পে মশগুল এরকম সময় সাদাত সাইফকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ কি রে! তুই না বলেছিলি আজ ভাবীর সাথে পরিচয় করাবি? কখন করাবি? “

সাদাতের কথা শুনে সবাই উৎসুক হয়ে সাইফের পানে তাকায়। সাইফ নিজের হাতের বোরহানির বোতলে চুমুক বসানোর আগে বলে,

“ ওয়েট এ মিনিট। “

মিনিট এক দুইয়ের মাঝেই তাদের মাঝে এসে হাসি হাসি মুখ করে উপস্থিত হয় নিশা। সাইফের পাশে এসেই দাঁড়িয়েছে সে। সাইফ এবার সামান্য গলা ঝেড়ে বলে,

“ লেডিস এন্ড জেন্টালম্যান, হেয়ার ইজ মাই হবু বউ ইয়াসমিন। “

সাইফের কথার পিঠে সবগুলো মুখ হা হয়ে গেলো। নিশা লজ্জায় দৃষ্টি লুকাতে ব্যস্ত। প্রত্যয় বিস্মিত গলায় বলে,

“ শি ইজ আওয়ার ভাবী? “

জুনায়েদ একটা ঢোক গিলে বলে,

“ লেফটেন্যান্ট কর্নেলের একমাত্র মেয়ে তোর প্রেমিকা? ওহ মাই গড! আমার বিশ্বাসই হইতেসে না মামা! “

রাফি ভীত গলায় বলে,

“ তোর কি স্যারের বন্দুকের গুলি খাওয়ার এতো শখ জাগসে? পুরা দুনিয়ায় কি মাইয়্যা মানুষের আকাল পরসিলো? তোর জরুরী ভিত্তিতে প্রেমিকা লাগলে আমাকে বলতি। আমি আমার শালীর সাথে তোরে ভাগাইতে হেল্প করতাম। কর্নেল তো নিজের মাইয়্যা জীবনেও তোরে দিবো না, আমরাও ভাগাইতে হেল্প করতে পারমু না। তাইলে কেম্নে কি মামা? “

রাফির কথা শেষ হতে না হতেই অন্যা পাশ থেকে চোখ রাঙিয়ে বলে,

“ তুমি আমার বোনকে ভাগতে হেল্প করবা? “

রাফি মিনমিনিয়ে বলে,

“ দুলাভাইগত একটা দায়িত্ব তো আছে আমার। “

সাদাত কিছু বলার সুযোগ পায় না। তার আগেই তার ফোনে একটা কল আসে। সে পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে সামান্য দূরে সরে আসে। স্ক্রিনে সেভ করা নাম্বারটা দেখতেই বিলম্ব না করে সে রিসিভ করে। ফোনের অপর পাশ হতে দৃশান বলে উঠে,

“ আমাদের আর কখনো দেখা হবে না লেফটেন্যান্ট সাদাত। “

পিছনে বাকিদের শোরগোলের কারণে কথাটা স্পষ্ট শুনতে পেলো না সাদাত। সে একহাতে কান চেপে ধরে প্রশ্ন করে,

“ কি বলছো দৃশান? শুনতে পাচ্ছি না কিছু। “

“ আমি ফিরে যাচ্ছি সাদাত। আমাদের আর কখনো দেখা হবে না। তুমি কোনো আশা মনে রেখো না। “

সাদাত এবারও স্পষ্ট পুরোটা কথা শুনতে পারে না। সে কথা বলার জন্য আরো দূরে যেতে পা বাড়ায়। কিন্তু ততক্ষণে দৃশানের ফ্লাইট টেক অফ করার এনাউন্সমেন্ট দিয়ে দেয়। সবার ফোন সুইচ অফ কিংবা এরোপ্লেন মুড অন করতে বলা হয়। শেষ বারের মতো দৃশান বলে,

“ সবসময় ভালো থেকো। “

কথাটুকু বলেই দৃশান ফোন কেটে দেয়। পরপর সুইচ অফ করে দেয় ফোনটা। সাদাত কল ডিসকানেকটেড হতে দেখে অবাক হয়। সে তো কিছু শুনতেই পেলো না! সাদাত আবার দৃশানের নাম্বার ডায়াল করে। কিন্তু নাম্বার আনরিচেবল বলছে বারবার। সাদাত ব্যর্থ হয়ে ফোনটা পকেটে রেখে দেয়। মনে একটা খচখচানি ভাব রয়েই যায়। দৃশান নামরা কি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে তাকে কল করেছিলো?

__________

নিজের মায়ের আলমারি হতে মেরুন রঙের একটা জামদানী শাড়ি পড়েছে আজ জেসি। শাড়ির সঙ্গে বাধ্যতামূলক হিসেবে হিল জুতো পড়েছে। যেনো ভুলেও শাড়ির কুচি তার পায়ে না আটকায়। কিন্তু সচারাচর হিল পড়া হয় না বলে খুন আনইজি ফিল করছে সে। জুতার সামনের অংশটা মোটেও আরামদায়ক নয়। জেসির পায়ের চামড়া ইতিমধ্যে ছিলে গিয়েছে নতুন জুতার ধারে। মেজাজ তার অত্যন্ত গরম। এখান থেকে তারা নাকি মেজর দূর্জয়ের বাসায় যাবে, বধূ বরণের অনুষ্ঠানে সামিল হতে। অর্থাৎ বাকি সারাটা দিন জেসির এই হিল জুতো জোড়াকে সহ্য করতে হবে। কি বিরক্তিকর ব্যাপার!

সবাই যখন রওনা হচ্ছে তখন প্রত্যয় জেসিকে খুঁজতে খুঁজতে মসজিদের পিছনের দিকে এগিয়ে আসে। কাছে এসে প্রশ্ন করে,

“ মুখ লটকে দাঁড়িয়ে আছো কেন? “

“ এই জুতা পড়ে আর এক কদম চলাও আমার পক্ষে সম্ভব না। আই এম ডান। পা ব্যথায় মরে যাচ্ছি। “

প্রত্যয় ভ্রু কুচকে জেসিকে পরখ করে বলে,

“ এখন কি করতে পারি? কোলে তুলে নিবো? এতে পা ব্যথা কমবে? “

প্রত্যয়ের হাঁটুর নিচের বুদ্ধি দেখে জেসি বিরক্তিকর গলায় রাগ সংবরণ করতে বিড়বিড়িয়ে উঠে,

“ ইয়া আল্লাহ, আমাকে ধৈর্য্য দাও। “

প্রত্যয় কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে জেসিকে দেখে নিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে হিল জুতার ফিতে খুলতে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে জেসি আঁতকে উঠে,

“ কি করছো? “

“ এক মিনিট কাকতাড়ুয়ার মতো স্থির হয়ে দাঁড়াও। “

জেসি বিরক্ত হয়। সে তো স্থিরই আছে! ফিতে দুটো খুলেই প্রত্যয় বলে,

“ এখন জুতা খুলো। “

জেসি কিছু না বলে জুতা ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে সে যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে। এতক্ষণ মনে হচ্ছিলো তার পা কোনো কাঁটাতারে পেঁচানো। প্রত্যয় জুতা জোড়া নিজের একহাতে ধরে আরেক হাতে জেসির হাত ধরে সামনে এগোতে এগোতে বলে,

“ সবাই হয়তো রওনা দিয়ে দিয়েছে। তাড়াতাড়ি চলো। “

জেসি অবাক গলায় বলে,

“ আমি কি এখন খালি পায়ে এভাবে জুতা ছাড়া হাঁটবো? “

প্রত্যয় হাঁটা থামিয়ে আবার ভ্রু কুচকে পিছনে ফিরে তাকায়। জেসিকে এক মুহুর্ত দেখে নিয়ে বলে,

“ তাহলে কি কোলে নিবো? “

“ তোমার মতলব তো ভালো না। বারবার কোলে নেওয়ার কথা বলছো কেনো? বিয়ের আগে কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করলেও কিন্তু মেরে শরীরের হাড্ডি সব ভেঙে দিবো। “

“ এতটাও সুন্দর লাগছে না তোমাকে যে আমি কাছে ঘেঁষবো। উল্টো তুমি আমার প্রেমে পিছলে পড়েছো। আর পড়ে এমনভাবেই আহত হয়েছো যে আর উঠে দাঁড়াতে পারো নি। আমার মতো সুদর্শন যুবক দেখলে যে কেউই প্রেমে পিছলে পড়বে। স্বাভাবিক ব্যাপার এটা। “

“ ওহ ওয়াও! এই! তুমি প্রেম ট্রেমে পড়ো নি তাই না? আমি তাহলে বাসায় গিয়ে আজকেই বিয়ে ভেঙে দেই? কি বলো? “

নিত্যদিনের ঝগড়া চলমান রেখেই দু’জন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে। প্রকৃতি সাক্ষী রয় সেই খুনসুটি ময় সম্পর্কের।

__________

সন্ধ্যার দিকে সুহালা বেগম খুব আয়োজন করে ছেলে এবং ছেলের বউকে বরণ করে ঘরে তুললেন। পুরো বাড়িটা কি সুন্দর অতিথিদের সমাগমে গমগম করছে। আর কেবল কিছু ঘন্টার ব্যবধানেই পুরো বাড়িটা খালি হয়ে যাবে। অতিথিরা নিজ নিজ বাসায় ফিরে যাবে। দূর্জয়ের ফুফা এবং ফুফুও দুই ছেলে সহ রাত ৮ টার ফ্লাইটে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবে। হুট করে বিয়ের আয়োজনটা হওয়ায় কেউই ছুটি ম্যানেজ করতে পারে নি। সবারই আগামীকাল অফিস এবং ক্লাস আছে।

বাসায় ঢুকার আধঘন্টার মধ্যেই দূর্জয় সুযোগে নিজের মা’কে ডেকে বলে বাণীকে রুমে নিয়ে বসিয়ে দিয়ে আসতে। সারাদিন এতো ধকল এবং এতো মানুষের ভীড়ে মেয়েটা দম ফেলারও সুযোগ পাচ্ছে না। সুহালা বেগম এর কাছে দূর্জয়ের কথা যুক্তিপূর্ণ মনে হয়। তিনি বাণীকে নিয়ে দূর্জয়ের রুমে বসিয়ে দিয়ে আসে।

দূর্জয়ের এই রুমটা বাণীর কাছে নতুন নয়। আগেও একবার বহ্নির উছিলায় সে এই রুমে প্রবেশ করেছিলো। তখন তার কোনো আলাদা অনুভূতি ছিলো না। কিন্তু এই মুহুর্তে অদ্ভুৎ অনুভূতি মনে কাজ করছে। মনে হচ্ছে এই রুমটায় এখন থেকে তারও অধিকার আছে। ঠিক যেমন দূর্জয়ের এখন তার উপর অধিকার আছে।

পরিপাটি রুমটায় বাড়তি সাজসজ্জা না থাকলেও রুমের বেশ কিছু জায়গায় ফুলদানিতে শোভা পাচ্ছে সাদা রঙের লিলি ফুল। সাদা চাদর বিছানো বিছানাটার ঠিক মধ্যিখানে আরেকটা জ্যান্ত সাদা ফুলের ন্যায় জামা ছড়িয়ে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছে বাণীকে।

বাণী মনে মনে বহ্নিকে নিয়ে ভাবছে। মেয়েটাকে আজ সারাদিন এক মুহুর্তের জন্য কাছে পায় নি সে। তার মেয়েও উড়ন্ত পাখির ন্যায় বারবার মানুষের ভীড়ে মিশে যাচ্ছে। এই ভারী জামা নিয়ে এবং এতো মানুষের ভীড়ে বাণীর পক্ষে মেয়ের পিছনে দৌড়ানোও সম্ভব হচ্ছে না। যদিও সে লক্ষ্য করেছে সুহালা বেগম বহ্নির বেশ খেয়াল রাখছে। তবুও… আচ্ছা আজ রাতে না-হয় বহ্নি সুহালা বেগমের কাছে থাকলো। কিন্তু কাল থেকে? বাণী কি বহ্নির সঙ্গে ঘুমানোর আর সুযোগ পাবে না? দূর্জয় অনুমতি দেবে তো? এরকম বিভিন্ন চিন্তায় ডুবে যায় বাণী। দূর্জয় ভুল মানুষ নয় সে জানে, তবুও ভয় হয়। সেই ভয়ের উৎস কি তা বাণীর জানা নেই।

__________

সুহালা বেগম তখন বহ্নিকে কোলে বসিয়ে দূর্জয়ের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাপারে আলাপ করছিলো। লেফটেন্যান্টরাও সোফায় বসে নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল। ঠিক এরকম একটা মুহুর্তে জুলফিকার মুজতবা ফোন কানে চেপে ব্যস্ত পায়ে লিভিং রুমে প্রবেশ করে। গম্ভীর উদ্বেগ মিশ্রিত স্বরে কাটকাট কথা বলছেন তিনি।

মুহুর্তেই সম্পূর্ণ লিভিং রুমে উপস্থিত মানুষ নীরব বনে যায়। সবার মুখের হাসিই মিলিয়ে গিয়েছে। চেহারায় ফুটে উঠেছে কৌতূহল। জুলফিকার মুজতবা ফোনে কথা বলতে বলতেই চারিদিকে নজর বুলায়। টিভির কেবিনেট এর একপাশে থাকা রিমোটটা হাতে নিয়ে টিভি প্লে করে। খবরের চ্যানেল অন করতেই সবগুলো দৃষ্টি টিভির স্ক্রিনে নিবদ্ধ হয়।

জুলফিকার মুজতবা ততক্ষণে ফোন কেটে দিয়েছেন। দূর্জয় সহ সকল লেফটেন্যান্টরা বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। টিভির স্ক্রিন হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে জুলফিকারের পানে তাকাতেই জুলফিকার শান্ত গলায় বলে,

“ অর্ডার এসেছে। এই মুহুর্তে যেতে হবে। কিছু করার নেই। “

সুহালা বেগম কিছু বলার পূর্বেই দূর্জয় দ্রুত পায়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। বাকি লেফটেন্যান্টদেরও এই মুহুর্তে বের হতে হবে। নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। প্রত্যয় বেরিয়ে যেতে নিলে জেসি শক্ত করে তার হাত চেপে ধরে। প্রত্যয় থামে। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,

“ একা বাসায় ফেরার দুঃসাহস দেখাবে না। আমি পথে জাঈদ ভাইয়াকে কল করে জানিয়ে দিবো। জাঈদ ভাইয়া এসে তোমাকে পিক করে নিয়ে যাবে। “

প্রত্যয় আর অপেক্ষা করে না। দ্রুত বেরিয়ে যায়। পরপর বেরিয়ে যায় সাদাত, ফারদিন, জুনায়েদ এবং রাফিও। সাইফ বের হতে নিয়েও রুমের এককোণে তাকায় মুহুর্তের জন্য। নিশা দূর হতে ছলছল চোখে দেখছিলো সাইফকে। সাইফের আচমকা নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে এলো। শুকনো গলায় ঢোক গিলার চেষ্টা করলো। সাইফ নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়ে।

__________

শান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় বসে আছে বাণী। আচানক রুমে কারো প্রবেশ ঘটতেই সে চোখ তুলে তাকায়। দূর্জয়কে দেখেই সে অপ্রস্তুত অনুভব করে। দূর্জয় এ সময় রুমে এসেছে কিসের জন্য? দূর্জয় রুমে প্রবেশ করেই সময় অপচয় না করে আলমারি খুলে নির্দিষ্ট জামা হাতে দ্রুত ওয়াশরুমে চলে যায়। বাণী বোকার ন্যায় তাকিয়ে রয়। এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনার কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ের পোশাক বদলে গায়ে ইউনিফর্ম জড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে দূর্জয়। বাণী তখন বিস্ময়ে হতবাক। হচ্ছে টা কি? দূর্জয় কোনো ভনিতা না করে বাণীর সামনে এসে বসে। নিজেই হাত বাড়িয়ে বাণীর বাম হাতটা আলতো করে ধরে তার অনামিকা আঙুলে একটা আংটি পড়িয়ে দিতে দিতে বলে,

“ যেতে হবে আমার। এই মুহুর্তে। আংটিটা তোমার জন্যই, নিজ হাতে না পড়িয়ে গেলে শান্তি পেতাম না। “

বাণী অস্ফুটে প্রশ্ন করে,

“ কোথায় যাবে তুমি? “

দূর্জয় প্রশ্নের জবাব দেয় না। বরং নিঃসংকোচে বাণীর হাতের পিঠে ঠোঁট ছোঁয়ায়। বাণী সেই নির্মল, পবিত্র ছোঁয়ায় চমকে উঠে। অজানা কারণে তার চোখ জলে পরিপূর্ণ হলো। দূর্জয় চোখ তুলে খানিক সময় নির্নিমেষ সেই দৃশ্য দেখে। প্রথমবারের মতো তার মনে আফসোস জাগে। আজকে অঘটনটা না ঘটলে কি খুব বড়ো কোনো অসুবিধা হতো?

দূর্জয় গাঢ় স্বরে বলে,

“ ভালোবাসার সাতটা ধাপ আছে বাণী। আগ্রহ, বিশ্বাস, মায়া, চিন্তা, ভালোবাসা, আসক্তি, ভালো রাখা। আমি পঞ্চম ধাপে আছি বাণী। তুমি কি তা বুঝতে পারছো? “

বাণী জবাব দিতে পারে না। এরকম নিঃসংকোচ স্বীকারোক্তির পিঠে অসহনীয় অনুভূতির দাবানলে তার কাদতে মন চাইছে খুব। সে নিজের দৃষ্টি নত করে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে। দূর্জয় আর দেরি করে না। উঠে সামান্য এগিয়ে এসে বাণীর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,

“ অযথা চিন্তা করবে না। খাওয়া দাওয়া করে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ো। আল্লাহ হাফেজ। “

ব্যস! চলে যায় দূর্জয়। আর পিছনে ফিরে তাকায় না। দেশের ডাকে সাড়া দেওয়া মানুষদের যে পিছনে ফিরে তাকানোর অনুমতি নেই। পরিপাটি রুমটায় একা রয়ে যায় তার নববধূ। একজন সৈন্যের স্ত্রী হওয়ার পরীক্ষাটা এতো দ্রুত শুরু হয়ে যাবে তা সে কখনোই কল্পনা করে নি।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৬৪.

“ ঢাকার রবীন্দ্র সরোবরে আজ সন্ধ্যা ছয়টা তেতাল্লিশ নাগাদ একজন যুবক আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। উক্ত সময় আশেপাশে সাধারণ মানুষ না থাকায় ব্যাপক কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও, হামলাকারী যুবক নিহত হয়েছে। পুলিশ দল ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে নিতে সক্ষম হয়েছে। তবে ভীত গোটা দেশবাসী। এই হামলার শেষ কোথায়?… “

নিউজ চ্যানেলে সাংবাদিকের আওড়ানো বুলি গভীর মনযোগ দিয়ে শুনছে বাণী। গায়ে তার এখনো বিয়ের পোশাক। সে জানে এসবের পিছনে দায়ী কে। হিরণ। বাণীর জীবনের কাল। লোকটা বাণীর জীবনে না থেকেও বাণীকে এক মুহুর্তের জন্য শান্তি দিচ্ছে না। আজ বিয়ের দিনটাতেই বাণীর সুখে নজর লাগিয়ে দিলো। ওই কঠোর নিরাপত্তায় ঘেরা জেলটাও এই লোকটাকে দমাতে পারলো না। বাণীর মাথার উপর থেকে আশ্রয় কেড়ে নেওয়ার জন্য আবার উঠে পড়ে লেগেছে।

লিভিং রুমের সোফায় বসে থাকা সুহালা বেগম আড়চোখে বাণীকে পরখ করে। পুরো ঘরটা এখন খালি। দূর্জয়ের ফুফু এবং ফুফাও বেশ কিছুক্ষণ আগে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। বাড়িতে আছে কেবল বাণী, বহ্নি, নিশা এবং সুহালা বেগম। নাঈমা শহরে নেই। তাই জুলফিকার মুজতবা ফেরার আগ পর্যন্ত নিশাকে এখানেই থাকতে বলেছেন সুহালা। মেয়েটাকে এই পরিস্থিতিতে একা বাসায় যেতে মন চাচ্ছিলো না তার।

সাংবাদিক তখনো বিভিন্ন কথা বলতে ব্যস্ত। বাণীর মনযোগ ভাঙে সুহালা বেগমের ডাকে,

“ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও আম্মু। আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি। খেয়ে একটু রেস্ট নাও। “

বাণী কোমল স্বরে বলে,

“ দূর্জয় রাতে ফিরলে? আমি ঠিক আছি আন্টি৷ আপনি একটু খাবার বেড়ে দিবেন? বহ্নিকে তাহলে একটু খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতাম আমি। “

সুহালা বেগম বাণীকে আপাতত আর জোর করে না। কেবল আশ্বস্ত করে বলে,

“ আমি-ই খাইয়ে দিচ্ছি ওকে। তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না। সারাটা দিন ধকল গিয়েছে তোমার উপর দিয়ে। “

কিছুক্ষণের মধ্যেই সুহালা বেগম প্লেটে খাবার নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বহ্নিকে খাওয়াতে বসে। উনার মুখভঙ্গি অত্যন্ত স্বাভাবিক। যেনো কিছুই হয় নি। বাণী নীরবে সেই দৃশ্য দেখে। অত:পর টিভি বন্ধ করে উঠে নিজের রুমে চলে যায়। সে সুহালা বেগমের মতো এতটা শক্ত থাকতে পারছে না। মেহেদী রাঙা বাম হাতের অনামিকা আঙুলে জ্বলজ্বল করা আংটির পানে তাকাতেই বাণী উপলব্ধি করে চারিপাশটা কেমন হাহাকার করছে। বিয়ে বাড়ির আনন্দ মুখোর পরিবেশে ভাটা পড়েছে। মনে জাগছে বারবার একটাই প্রশ্ন,

“ মানুষটা সুস্থ অবস্থায় ফিরবে তো? “

__________

বিরিয়ানির পাত সামনে নিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করে দেখছে শাহানা বেগম। মেয়েদের আবদারে আজ তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেতে বসলেও মস্তিষ্ক তার অন্য ভুবনে ডুবে আছে। আচমকা মেয়ের ডাকে তার ধ্যান ভাঙে। সাওদা বিস্ময় নিয়ে মা’কে প্রশ্ন করে,

“ তুমি খাচ্ছো না কেন? তেহারিটা এতো মজা হয়েছে না! আর তুমি কি-না না খেয়ে বসে আছো! “

সায়রা পাশ থেকে বলে,

“ সবাই কি তোর মতো রাক্ষস নাকি আপু? সারাদিনে কয় প্লেট খেয়েছিস হিসাব আছে? তোর খাওয়া দেখেই মনে হয় মা’য়ের পেট ভরে গিয়েছে। “

সাওদা রেগে উঠে। রাগী স্বরে ছোট বোনকে দুটো ধমকও দেয়। সায়রাও নিজের মতো মজা লুটতে থাকে। শাহানা বেগম নিষ্পলক দুই মেয়েকে দেখে কিছুক্ষণ। অত:পর শুকনো গলায় বলে,

“ খেতে ইচ্ছে করছে না হঠাৎ করে। গলা দিয়ে খাবার নামবে না মনে হচ্ছে। অস্থির অস্থির লাগছে। “

দুই বোনের ঝগড়া থেমে যায় মুহুর্তে। সাওদা চিন্তিত গলায় বলে,

“ শরীর খারাপ লাগছে? এলাকার ফার্মেসী থেকে ওষুধ এনে দিবো? ওষুধ খেলে ভালো লাগবে তোমার। “

শাহানা বেগম বাঁধ সেধে বলে,

“ না, কোনো দরকার নেই। তোদের ভাইয়া বলসে রাস্তা ঘাটে তোদের একা না ছাড়তে। জামানা বহুত খারাপ রে মা! মানুষ রূপী হায়না চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জ্বালা যত আমার মতো মেয়ের মায়েদের। মেয়েদের নিরাপত্তার চিন্তায় আমাদের পাগল প্রায় অবস্থা। “

সাওদা আর সায়রা চুপ হয়ে যায়। মা এবং ভাইয়ের চিন্তা তারা বুঝে। কিন্তু কি করবে তারা? বেঁচে থাকার তাগিদে একা চলা ছাড়া কোনো পথ নেই তাদের কাছে। একে তো মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। তার উপর মাথার উপর বাবার ছায়াটাও নেই। তিনটা মানুষের খরচ তাদের ভাই একা হাতে বইছে। এসবের মাঝে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে তো তাদের ভবিষ্যৎ আর গড়তে পারবে না তারা।

ভাইয়া যতই টাকা পাঠাক না কেনো, সেই টাকায় সংসার খরচ সামলে সাওদা আর সায়রার প্রয়োজনীয় আরো অনেক খরচই বাকি রয়ে যায়। সেই বাকির খাতা পূরণ করতে সাওদা বাসা থেকে গোপন করে তিনটে স্টুডেন্ট পড়ায়। সেই টাকা দিয়ে নিজের আর সায়রার পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় টুকটাক খরচ গুলো নিজেই পরিশোধ করে। এই খবরটা সায়রা বাদে আর কেউ জানে না। মা আর ভাইয়া জানলে খুব রাগ করবে।

শাহানা বেগম খাবারের পাত সামনে নিয়েই শুকনো মুখে বর্তমান যুগের বিভিন্ন ভয়ংকর এবং নির্মম সত্যগুলো নিয়ে বিলাপ পাড়তে থাকে। সাওদা আর সায়রাও এবার খাবার রেখে মুখ কালো করে বসে রয়। হঠাৎ করেই খাবারের স্বাদ খুব বিতৃষ্ণাময় লাগছে তাদের কাছে।

ছোট সায়রা মন খারাপ করে মনে মনে দোয়া করে ভাইয়া যেনো খুব শীঘ্রই বাড়ি ফিরে আসে। ভাইয়া বাড়িতে ফিরলেই এই ঘরের উপর থেকে এই কালো মেঘপুঞ্জি গুলো সরে যায়। মা’য়ের মুখে হাসি ফুটে। সাওদা আপুর নামে নালিশের ঝুলি সাজিয়ে বসতে পারে সে। আর এবার তো ভাইয়া ফিরলে আরো আনন্দ হবে। সায়রা নিজের দু ঈদের সালামি জমিয়ে ভাইয়ার জন্য নতুন পাঞ্জাবি কিনেছে। তার সুদর্শন ভাইয়াকে ওই কালো রঙের পাঞ্জাবিটায় একদম নায়কের মতো দেখতে লাগবে! ভাইয়া যখন গায়ে পাঞ্জাবিটা জড়িয়ে এলাকার মসজিদে নামাজ পড়তে বের হবে তখন এলাকাবাসী বারবার ঘুরে ঘুরে তার ভাইয়াকে দেখবে। আর সায়রার নাকটা তখন গর্বে উঁচু হয়ে যাবে।

__________

মিটিং রুমে নিজেদের প্ল্যান ম্যাপ সাজাতে ব্যস্ত সৈন্যরা। আয়তাকার আকৃতির বিশাল টেবিলটার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন কাগজ। সেই টেবিলের দিকে ঝুকে কাগজ দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যাপার ব্যাখ্যা করছে জুলফিকার। টেবিলের দু ধার ধরে দাঁড়ানো বাকি সৈন্যরা। প্রত্যেকের মুখেই চিন্তার ছাপ। রবীন্দ্র সরোবরে ওই আত্মঘাতী বিস্ফোরণ কেবল একটা এলার্ম ছিলো তা বুঝতে পেরেছে সকলেই।

আপাতত চাঞ্চল্যকর বিষয় হচ্ছে এই রবীন্দ্র সরোবরের ঘটনার পরপরই আজ সন্ধ্যায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কোতোয়ালি শাখায় একটা বেনাম চিঠি পাঠানো হয়েছে। কে পাঠিয়েছে সেসব কিছুই জানা নেই কারো। খাম খুলে ভেতরের কাগজটা দেখতেই উক্ত থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার বিস্মিত হোন। বিলম্ব না করে দেশের প্রতিটি থানায় এবং সৈন্যদের হেডকোয়ার্টারে সেই কাগজের কপি ফ্যাক্স করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কাগজের লেখা গুলো অনেকটা এরকম ছিলো,

ডুমস ডে মিশন প্ল্যান ম্যাপ –
ডেট – এগারো ডিসেম্বর।
প্লেস – ১. পান্থপথ, ঢাকা।
২. বায়েজিদ বোস্তামি রোড এবং ও আর নিজাম সড়কের মোড়, চট্টগ্রাম।
৩. কাদিরগঞ্জ মোড়, রাজশাহী।

ব্যস! এটুকুই। আর কিছু লেখা নেই। এই চিঠিটা যে ইচ্ছাকৃত ভাবে পাঠানো হয়েছে তা বেশ বুঝতে পারছে সৈন্যরা। হিরণের পলাতক কুকুর গুলো এই চিঠির মাধ্যমে নিরাপত্তা বাহিনীদের যেনো ওপেন চ্যালেঞ্জ করলো। সাহস থাকলে এই হামলা আটকে দেখানোর চ্যালেঞ্জ। হিরণের জটিল বুদ্ধি দেখে সেনাবাহিনীর সকলেই ক্ষোভে ফুসছে। ডেট ব্যতীত কোনো নির্দিষ্ট সময়ের কথা উল্লেখ নেই। তার উপর তিনটা জায়গার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে একই সময় তিনটা ভিন্ন জায়গায় অঘটন ঘটাবে এই জানোয়ার গুলো।

উপর মহলের নির্দেশ মতে এই তথ্যটা সাংবাদিক এবং সাধারণ জনগণের থেকে লুকানো হয়েছে। এই তথ্য সবার মধ্যে ছড়িয়ে গেলে আতঙ্কবাদীদের প্ল্যান চেঞ্জের আশংকা রয়েছে তাই। আর তাছাড়াও সাধারণ সিভিলিয়ানরা এতে আতংকিত হয়ে উত্তেজনামূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। সেই পরিস্থিতি সামাল নেওয়া নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে।

হামলার স্থান তিনটা হওয়ায় উপর মহলের অর্ডার অনুযায়ী স্পেশাল ফোর্সকে তিনটি ভাগে ভাগ করে সঙ্গে আরো ব্যাক আপ ফোর্স মিলিয়ে তিনটা টিম গঠন করার আদেশ এসেছে। আদেশ অনুযায়ী টিম গঠন হতেই তিন টিমকে তিনটি বিভাগের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

দূর্জয় যেই টিমের অংশ তারা চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামি এবং ও আর নিজাম সড়কের মোড় কাভার করবে। তার টিমের অংশ হিসেবে আরো রয়েছে রাফি এবং জুনায়েদ। ফারদিন, প্রত্যয়রা আরেক টিমের সদস্য হিসেবে সেনাবাহিনীর বিশেষ হেলিকপ্টারে করে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা হবে। সবশেষে সাদাত এবং সাইফ এই মুহুর্তে রওনা হবে ঢাকার পান্থপথের উদ্দেশ্যে।

জরুরী অস্ত্র সরঞ্জাম সহ রওনা হয় প্রত্যেকে ভিন্ন গন্তব্যে তবে একই লক্ষ্যে।

__________

বিজনেস ক্লাসের নিরিবিলি সিটটায় জায়গা দখল করে বসে আছে এক রমণী। এসির শীতল হাওয়ায় চারিপাশটায় হীম আবহাওয়া বিরাজ করছে। দুই পা সিটে তুলে অনেকটা দ আকৃতিতে বসে আছে সে। হাঁটুর সঙ্গে ঠেক দিয়ে রাখা স্কেচবুকটায় ভিন্ন ভিন্ন শেডের পেন্সিলের সাহায্যে এক জোড়া তীক্ষ্ণ চোখ আঁকতে ব্যস্ত সে। গভীর মনযোগে তার ভাটা পড়ে একজন ফ্লাইট এটেন্ডেটের ডাকে,

“ ম্যাম, শ্যাল আই সার্ভ ইউর ডিনার নাও? “

দৃশান আঙুলের সাহায্যে চুলগুলো কানের পিছনে গুজে পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসে। মাথা নেড়ে বলে,

“ শিওর। “

ফ্লাইট এটেন্ডেট খাবার সার্ভ করতে করতে দৃশানের কোলের স্কেচবুকের অর্ধ সম্পন্ন স্কেচটা দেখে হেসে শুধায়,

“ দোজ আইজ আর সো এট্রাকটিভ! ইউর স্কেচিং স্কিল ইজ এডমায়ারেবল ম্যাম। “

দৃশান মৃদু হেসে বলে,

“ থ্যাঙ্কিউ। “

ড্রিংকস সার্ভ করতে করতে ফ্লাইট এটেন্ডেট এবার আগ্রহবসত প্রশ্ন করে,

“ আর দেই রিয়েল ওর জাস্ট ইউর ইমাজিনেশন? “

দৃশান এবার নিষ্পলক কিছুক্ষণ স্কেচটার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে উঠে,

“ এই চোখ জোড়ার অস্তিত্ব আছে। “

ফ্লাইট এটেন্ডেট আর দৃশানের বলা কথাটা স্পষ্ট শুনতে পেলো না। সে নিজের কাজটুকু সম্পন্ন করে চলে যায়। দৃশান তখনো নীরবে নিজের স্কেচটা দেখছিলো। আর সাত ঘন্টা বাকি তার ইয়েমেনে পৌঁছাতে। স্কেচবুকটা একপাশে রেখে দৃশান কিছুটা খাবার মুখে তুলে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায়। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ত্রিশ পয়ত্রিশ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থান করায় নিচে মেঘ ব্যতীত আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তার উপর রাতের বেলা হওয়ায় এখন বাহিরে চারিদিকটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। দৃশানের মনে আচমকা প্রশ্ন জাগে, ওই ছেলেটা এখন কোথায় আছে? কি করছে? ভালো আছে তো?

পরমুহূর্তেই দৃশান নিজেকে শাসায়। ভালো থাকবে না কেন? অবশ্যই ভালো থাকবে। ভালো থাকার জন্যই তো দৃশান আর নিজেদের মাঝের ব্যাপারটা বেশিদূর গড়াতে দেয় নি। তার আগেই টুকরো টুকরো অনুভূতি গুলো কুড়িয়ে ওই দেশ ছেড়ে চলে এসেছে। আর কখনো ওই দেশে ফিরবে না সে। কখনোই না।

__________

রিমান্ডে আনা আসামীকে আজ স্বয়ং জুলফিকার মুজতবা নিজের জিম্মায় নিয়েছেন। শিকলের সঙ্গে উল্টো করে বেধে এতক্ষণ পেটানোর পরও হিরণ নিজের মুখ খুলে নি। আজকাল পার্থিব কোনো কিছুই তাকে ছুঁতে পারে না। কেমন রোবটিক তার আচরণ। এইযে এই মুহুর্তে তার দুই হাতের তিনটে করে আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা হচ্ছে তবুও সে মুখ দিয়ে একটা টু শব্দও করছে না। বরং চোখ খিচে বন্ধ করে, দাঁতে ঠোঁট চেপে রেখেছে।

উপস্থিত আরেকজন সৈন্য অবিশ্বাস্য স্বরে জুলফিকারকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ এতকিছুর পরও কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের চুপ থাকার কথা না স্যার। এই লোকটা মোটেও সুস্থ না। এরকম একটা রক্তের খেলা শুরু করে কেমন নিশ্চুপ হয়ে আছে দেখুন। হি ইজ এ সাইকো। হি ইজ সিক। “

সৈন্যের বলা কথাগুলো হিরণের কানে পৌঁছায়। মনে পড়ে আজকে ১১ ডিসেম্বর। তার সাজিয়ে আসা খেলাটা আজ বাস্তবে রূপান্তর হওয়ার দিন। সেই খেলায় শুধু সাধারণ সিভিলিয়ানই নয় বরং অসংখ্য সৈন্যেরও রক্ত ঝড়বে। এজন্যই তো হিরণ সেই বেনাম চিঠি পাঠানোর প্ল্যান করেছিলো। যেনো ঠিকানা মতো গিয়ে সৈন্যরা পাহারার জন্য উক্ত স্থান গুলোতে উপস্থিত হতে পারে। আর একবার সকলে উপস্থিত হলেই, বুম!

আহ! এই রক্তের খেলায় তো হিরণ তৃপ্তি পেতো। আজ তবে কেনো তৃপ্তি অনুভব করছে না? সবকিছু অনর্থক মনে হচ্ছে তার। আর কোনো কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না। সব মরে যাক। ধ্বংস হয়ে যাক। হিরণের ফাঁসি হয়ে যাক। যেই পৃথিবীতে ওই মানুষ দুটোর অস্তিত্ব নেই সেই পৃথিবীতে আর এক মুহুর্তও নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছে করে না তার।

জুলফিকার মুজতবা তখন রাগে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলছে। মাথায় ঘুরছে এতো গুলো মানুষের চিন্তা। সেই সঙ্গে নিজের সৈন্যদের চিন্তা। দেশটা কিংবা দেশের মানুষ গুলো ওই সৈন্যদের জন্য চিন্তা না করলেও জুলফিকার চিন্তা করে তাদের জন্য। প্রত্যেকটা ছেলেই তার সন্তানের ন্যায়।

জুলফিকার এবার চোখের ইশারায় উপস্থিত অপর সৈন্যকে বেরিয়ে যেতে বলে। আদেশ মতো সেই সৈন্য বেরিয়ে যেতেই এবার জুলফিকার এগিয়ে যায়। শক্ত হাতের থাবায় হিরণের চুলগুলো মুঠি করে ধরে। মাথাটা উঁচু করে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

“ আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিস না আর। যা যা প্রশ্ন করা হয়েছে জবাব দে। “

হিরণ নীরব রয়। চোখ বুজে ফেলে। কোনো উত্তর দেবে না সে। জুলফিকার এবার বাধ্য হয়ে বলে,

“ তোর হামলার মাশুল শুধু নিষ্পাপ মানুষ গুলো নয় বরং বাণী এবং বহ্নিও গুণবে। “

হিরণ পিলে চমকে উঠে। চকিতে চোখ মেলে তাকায়। জুলফিকারের কথার অর্থ বুঝতে পারছে না সে। অবিশ্বাস্যকর স্বরে কিছু জিজ্ঞেস করতে চায়। কিন্তু গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে তার। চেষ্টা করেও একটাও শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না সে।

জুলফিকার মুজতবা এবার নিজ থেকেই বলে,

“ ওরা জীবিত আছে। সুস্থ আছে। কিন্তু কতক্ষণ সুস্থ থাকবে সেই নিশ্চয়তা আমি দিতে পারছি না। আমার ধৈর্য্যের চরম পরীক্ষা নেওয়ার মাশুল ওরা গুণবে। তোর কি মনে হয় এতগুলো নিষ্পাপ মানুষ খুন করার পরও আমি ওদের ছেড়ে দিবো? সেনাবাহিনীর হাতে ওদের তুলে দিবো। ওদের পরিচয় সবার সামনে টেনে আনবো। সেনাবাহিনী ওদের কি অবস্থা করবে তা কি তুই ভাবতে পারছিস? “

জুলফিকার মুজতবা আদৌতে কথাগুলো মন থেকে বলছে না। কিন্তু আপাতত পরিস্থিতি অনুযায়ী হিরণের মুখ খোলার জন্য এর থেকে উত্তম আর কোনো পন্থা তার মাথায় আসে নি। হিরণের পেট থেকে কথা বের করার জন্য উনি বাধ্য হয়ে এই হুমকি গুলো দিচ্ছে। কখনো কখনো ঘি সোজা আঙুলে না উঠলে, আঙুল বাকা করা খুব প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।

__________

বায়েজিদ বোস্তামি সড়কে অবস্থিত রাজস্থান আউটলেটের সামনে দিয়ে টহল দিচ্ছে দূর্জয় সহ আরো দুজন। এ ছাড়াও আরো বহু সৈন্য সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান করছে। দূর্জয়ের নজর বারবার ঘুরেফিরে সামনের সড়কের মোড়ের পানেই স্থির হচ্ছে। তার কেন যেনো মনে হচ্ছে কিছু ঘটলে সেটা এই মোড়েই ঘটবে। এই সড়কেই রয়েছে তাজনুর বেকারি এন্ড কনফেকশনারি এবং রয়্যাল কাবাব। মানুষের চলাচল বেশ ভালোই। আর আতঙ্কবাদীদের লক্ষ্য থাকে অধিক নাগরিক সম্পন্ন জায়গায় হামলা চালানো।

আচানক ফোন বেজে উঠতেই দূর্জয় পকেট থেকে ফোন বের করে। জুলফিকার মুজতবার নাম্বার দেখতেই সে দ্রুত কলটা রিসিভ করে। দূর্জয়কে কিছু বলতে না দিয়ে জুলফিকার নিজেই ব্যস্ত গলায় বলে উঠে,

“ ঠিক ৯ টা বাজে এক্সপ্লোশন ঘটবে দূর্জয়। বি ফাস্ট। হাতে সময় নেই। আতঙ্কবাদী খুঁজে সময় অপচয় করো না। ওখানে কোনো আতঙ্কবাদী আসবে না। ওরা অলরেডি টাইম বোম্ব সেট করা তিনটা গাড়ি তিন জায়গায় পার্ক করে রেখেছে। ঢাকা, রাজশাহীতে অবস্থানরত প্রতিটা ইউনিটকে ইনফর্ম করো। বোম্ব ডিফিউজাদের প্রস্তুত থাকতে বলো। তিন ইউনিট মিলে দ্রুত গাড়ি তিনটা খুঁজে বের করো। দিজ ইজ এ লাইফ এন্ড ডেথ ম্যাটার। “

জুলফিকারের বলা কথাগুলো শুনে দূর্জয় স্তব্ধ বনে যায়। পরপর সম্বিত ফিরে পেতেই কাটকাট গলায় বলে,

“ রজার দ্যাট স্যার। “

__________

রাত ৮ টা ৪৫ তখন। পান্থপথের সম্পূর্ণ রাস্তার পয়েন্টে পয়েন্টে সেনাবাহিনীর নীরব টহল। তীক্ষ্ণ নজরে তারা চারিপাশের প্রতিটা মানুষকে পরখ করছে। এখন পর্যন্ত সন্দেহজনক কেউ তাদের নজরে পড়ে নি। স্কয়ার হসপিটালের সামনের দিকে চারিদিকটা নজরে রাখছে সাইফ এবং আরেকজন সৈন্য। মনের মধ্যে সকলের কাজ করছে চরম উৎকণ্ঠা। এই বুঝি আতঙ্কবাদীরা কোনো একটা অঘটন ঘটালো। এই বুঝি বিশাল কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেলো। সবসময় হাসি থাট্টায় মেতে থাকা সাইফটাও হঠাৎ খুব অস্থিরতা অনুভব করছে।

সাইফ নিজের কানের ব্লু টুথ ডিভাইসের সাহায্যে বলে উঠে,

“ সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েছে লেফটেন্যান্ট সাদাত? “

সাদাত সেলিম সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে নীরবে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে জবাব দেয়,

“ আপাতত সব ঠিকঠাক এখানে। “

মনে মনে সাদাত প্রার্থনা করছে এই রাস্তা জুড়ে মানুষের সমাগম যেনো কিছুটা হলেও কমে যায় ধীরে ধীরে। যত লোক সমাগম বেশি, তত ক্ষয়ক্ষতি বেশি হওয়ার ভয়।

ঠিক সেই মুহুর্তে প্রত্যেক সৈন্যের হ্যান্ড ট্রান্সিভারটা বেজে উঠে। প্রত্যেকে কলটা রিসিভ করতেই গম্ভীর ত্রস্ত পুরুষালি স্বরটা বলে উঠে,

“ মেজর শাহরিয়ার দূর্জয় স্পিকিং… “

দূর্জয়ের বলা সম্পূর্ণ কথাটা শুনতেই সকলে ভীত বনে যায়। ৯ টা বাজে এক্সপ্লোশন হবে মানে কি? সাদাত নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘড়ির কাটা ইতিমধ্যে ৮ টা ৪৭ মিনিট ইঙ্গিত করছে। দূর্জয়ের অর্ডার দেওয়া শেষ হতেই সকলে ট্রান্সিভারটা ডিসকানেকট করে পার্ক করা গাড়ি গুলোর দিকে ছুটে যায়। প্রতিটা গাড়ি চেক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তারা। সাদাত হঠাৎ উপলব্ধি করে এভাবে গাড়ি খুঁজে বের করে বোম্ব ডিফিউজ করতে করতে খুব সময় পেরিয়ে যাবে। তাই সে দ্রুত আশেপাশের সৈন্যদের উদ্দেশ্য করে বলে,

“ এভাবে হবে না। মানুষ প্রচুর। এলাকা খালি করতে হবে। ডু সামথিং। “

সাদাতের কথা শুনতেই সাইফ সহ একদল সৈন্য দ্রুত ছুটে যায়। বাকিরা মিলে সবকটা রাস্তা জুড়ে পার্ক করা প্রতিটা গাড়ি চেক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সাদাতরা যখন গাড়ি চেক করছে তখন সাইফ কোথা থেকে যেনো একটা মাইকের ব্যবস্থা করে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে রাস্তার সকল পথচারীর উদ্দেশ্যে বলছে,

“ আপনারা সকলে দয়া করে এই মুহুর্তে এই এলাকা ছেড়ে বের হোন। আমাদের সঙ্গে কো অপারেট করুন। আমাদের কাছে খবর এসেছে এই রোডে কোথাও টাইম বোম্ব সেট করা আছে। সবাই দ্রুত করুন। আমাদের কথা শুনুন… “

সাধারণ মানুষের মাঝে ইতিমধ্যে হট্টগোল অবস্থা। ইউনিফর্ম পরিহিত একজন সৈন্যের মুখের এমন কথা তো আর ফেলা যায় না। সাইফ যখন এনাউন্সমেন্ট করতে ব্যস্ত সেই মুহুর্তে একজন পুলিশ এগিয়ে এসে সাইফের কানে ফিসফিস করে বলে,

“ খবরটা জনগণকে জানানোর অনুমতি আমাদের দেয় নি উপর মহল থেকে। কাজটা কি আপনি ঠিক করলেন? কোনো ঝামেলা হলে? “

তীব্র উৎকণ্ঠাপূর্ণ মুহুর্তে এরকম একটা কথায় সাইফের মেজাজ বিগড়ে যায়। সে রাগে গিজগিজ করে বলে উঠে,

“ শালার উপর মহলের অনুমতির টুট টুট টুট। এই জায়গায় মানুষের জীবন মরণের ঠিক নাই, এন্ড ইউ গাইস কেয়ার এবাউট উপর মহল আমাদের কোন বাল ছিড়বে? “

সাইফের রাগী রূপ দেখে উক্ত পুলিশ নীরব বনে যায়। আর কিছু বলার সাহস দেখায় না। হাতে তখন আর কেবল তিন মিনিট সময় বাকি। সৈন্যরা সকলে দিশেহারা উন্মাদের ন্যায় প্রতিটা গাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছে। পান্থপথের ন্যায় একটা ব্যস্ত সড়কে এতো এতো গাড়ির মাঝে নির্দিষ্ট গাড়িটা খুঁজে বের করা বেশ কঠিন কাজই। মানুষের হট্টগোলে রাস্তায় এলোমেলো ভঙ্গিতে জ্যাম বেধে গিয়েছে। পুলিশের একটা দল সেই জ্যাম ছোটাতে ব্যস্ত। মোদ্দা কথা এরিয়াটা তখনো পুরোপুরি জনমানবশূন্য হয় নি। অবশ্য এতো কম সময়ে তা সম্ভবও না।

তীব্র মানুষের বিশৃঙ্খলার মাঝে সাদাত দৌড়ে আরেকটা গাড়ির কাছে আসতেই গাড়ির পিছন দিকে একটা মেয়ে বাচ্চাকে রাস্তায় গুটিসুটি মেরে বসে থাকতে দেখে। বাচ্চাটার গায়ের পোশাক এবং হাতে একটা লাঠিতে ঝুলানো ফুলের মালার গুচ্ছ দেখে সাদাতের বুঝতে বাকি থাকে না যে বাচ্চাটা ফুল বিক্রেতা। সে দ্রুত বাচ্চাটাকে টেনে তুলতে তুলতে বলে,

“ এখানে বসে আছো কেন? দ্রুত দৌড়াও। যেতে বলা হয়েছে না সবাইকে? “

বাচ্চাটা জবাব দেয় না। ভয়ে কেমন সিটিয়ে আছে। সে তো কিছু চেনে না। কোথায় যাবে? তার আব্বা তাকে এখানে বিকালে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে। বলেছে রাতের মধ্যে সবগুলো মালা বিক্রি করতে। রাত দশটার দিকে এসে তার আব্বা তাকে নিয়ে যাবে।

সাদাত বাচ্চাটার দিকে তেমন একটা খেয়াল না করে দ্রুত ভঙ্গিতে চারিপাশ হতে গাড়িটা ঘুরে চেক করে দেখছিলো। হঠাৎ গাড়ির বোনাটের কাছে আসতেই সে থমকে যায়। আরো কিছুটা কাছে গিয়ে কান পেতে গাড়ির বোনাটের ভেতর থেকে ভেসে আসা সূক্ষ্ণ বিপবিপ জাতীয় শব্দটা শোনে। তার আর বুঝতে বাকি থাকে না এটাই সেই মরণ ফাঁদের গাড়ি। সে দ্রুত গাড়ির বোনাট খোলার চেষ্টা করে। কিন্তু লাভ হয় না। গাড়িটা লকড। সাদাতের বুক ঢিপঢিপ করছে। সে নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখে আর মাত্র এক মিনিট বাকি। সঙ্গে সঙ্গে সাদাত আশেপাশে তাকিয়ে দেখে এখনো বেশ কিছুজন মানুষ হট্টগোল লাগিয়ে বসে আছে। আশেপাশের দোকানদার গুলোও নিজের দোকানে কেমন গা ছাড়া ভাবে বসে আছে।

সাদাত মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে, তার কাছে কি ডিফিউজার টিমকে কল করে এই বোম ডিফিউজ করার মতো সময় হাতে আছে? সাদাতের মস্তিষ্ক জবাব দেয়, না নেই। সাদাত সঙ্গে সঙ্গে ট্রান্সিভারটা হাতে নিয়ে কানেক্ট করে চিৎকার করে বলতে থাকে,

“ লেফটেন্যান্ট সাদাত হেয়ার, দ্যা বোম ইজ ডিটেক্টেড। বাট উই ডোন্ট হ্যাভ এনাফ টাইম টু ডিফিউজ ইট। সেলিম সেন্টারের অপজিটে গার্লস স্কুলের রোডের সামনে গাড়িটা আছে। প্লিজ এভ্রিওয়ান লিভ দিজ প্লেস। “

কারো উত্তরের অপেক্ষা না করে সাদাত ট্রান্সিভারটা রেখেই বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত গলায় বলে,

“ তুমি এখনো যাও নি কেন? “

বাচ্চাটা কোনো জবাব দেয় না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সাদাত এবার চিৎকার করে চারিদিকে সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

“ এই গাড়িটায় বোম্ব আছে। হাতে এক মিনিটের তুলনায়ও কম সময়। প্লিজ সবাই এই জায়গা ছাড়ুন। “

বলেই সাদাত আর অপেক্ষা না করে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে দ্রুত দৌড়ে রাস্তা ক্রস করতে যায়। কিন্তু আচমকা ছোটাছুটি করা একদল মানুষের ধাক্কায় রাস্তায় পড়ে যায়। সর্বোচ্চ দশ সেকেন্ড সময় লাগে সাদাতের নিজেকে সামলে নিতে। সে দ্রুত বাচ্চাটা সহ উঠে আবার দৌড়াতে নেয় ঠিক সেই সময় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ তরঙ্গ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

__________

বাতাসে তখন বারুদের সঙ্গে বিষাদের গন্ধ। রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাড়ি গুলোর অবস্থা শোচনীয় নয়। বিস্ফোরণের ফলে বোমবাহী গাড়িটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। রাস্তা জুড়ে রক্তাক্ত মানব দেহ গুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। কি বিভসৎকর সেই দৃশ্য!

পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাতেই সাদাতের চোখ জ্বলে উঠে। ফুসফুসে জমা হওয়া ধোঁয়ার ফলে তীব্র কাশি উঠে তার। সে ঝাপসা চোখে চারিপাশটা দেখে। কালো ধোঁয়ার ভীড়ে পুড়ে যাওয়া গাড়ি, রাস্তায় পড়ে থাকা বেশ কতগুলো বেলী ফুলের মারা আর চারিদিকে আহত, নিহত অসংখ্য মানুষ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলো না সে। সাদাত পিটপিট করে আকাশের পানে তাকায়। তীব্র গতিশক্তির আঘাতের ফলে পুরো শরীরটাই তার অবশ মনে হচ্ছে। আচ্ছা সে কি মরে যাচ্ছে? জানা নেই সাদাতের।

সাদাতের চোখের সামনে ভেসে উঠে পরিবারের প্রিয় মুখ গুলো। সে কাঁপা কাঁপা হাতে পকেট হাতড়ে নিজের ফোনটা বের করে। আবার কাশি উঠে তার। এবার অনুভব করতে পারছে সে। বুকে তীব্র ব্যথা হচ্ছে। ফুসফুসের পাশটার অসহনীয় যন্ত্রণাটা দাঁত খিঁচে সহ্য করে এলোমেলো হাতে কোনোমতে সাওদার নাম্বারটা ডায়াল করে। ফোনটা স্পিকারে দিয়ে মাথার কাছটায় রেখে এবার আকাশের পানে তাকায়। মুহুর্তেই ফোনের অপর পাশ হতে একটা উৎফুল্ল রমণী বলে উঠে,

“ ভাইয়া! হাজার বছর বাঁচবে তুমি। আমি মাত্র তোমার কথাই ভাবছিলাম। “

সাদাত কথা বলার জন্য সামান্য অক্সিজেনের আশায় নিঃশ্বাস টেনে নেয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আরো কালো ধোঁয়া তার ফুসফুসে প্রবেশ করে। সাদাত কাশতে কাশতে কোনো রকম বলে,

“ সাওদা, মা কোথায়? “

ফোনের অপর পাশের সাওদার হাসি মিলিয়ে যায়। সে চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে,

“ তুমি ঠিক আছো ভাইয়া? কাশি হচ্ছে কেনো? তোমার কণ্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন? “

“ ভাইয়া ঠিক আছি। মা… মা কোথায়? “

সাওদা তখন বাড়ির সামনের উঠানে হাঁটতে বের হয়েছিলো কিছুক্ষণের জন্য। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে কিছু ঠিক নেই। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,

“ মা নামাজ পড়ছে। তোমার কি হয়েছে ভাইয়া? বলো না। “

“ শুন। ঘরের টিভির লাইন খুলে রেখে দে। মা’কে খবর দেখতে দিবি না। তুই… তুই লক্ষ্মী বোন না আমার? মা আর সায়রার খেয়াল রাখবি। ঠিক আছে বাচ্চা? একদম কাঁদবি না। “

সাওদা এবার উঠোন ধারের সিঁড়িতে ধপ করে বসে পড়ে। তার গাল গড়িয়ে ইতিমধ্যে অশ্রু ঝড়ছে। সাওদা ওড়না দিয়ে মুখ চেপে ধরে কান্না থামানোর জন্য। ধরা গলায় বলে,

“ তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া? কি করেছে ওরা তোমার সাথে? ও আল্লাহ… আমার ভাই! ভাইয়া! ও ভাইয়া, কেমন লাগছে তোমার? কথা বলো… “

সাদাত আর জবাব দিতে পারে না। চাইলেও গলা দিয়ে কথা বের করতে পারছে না আর। সাওদার করা প্রশ্ন গুলো কানে ভেসে আসছিলো। হঠাৎ ফোনের অপর পাশ হতে কানে ভেসে আসে শাহানা বেগমের গলা,

“ সাওদা? এই রাতের বেলা চুল ছেড়ে উঠোনে গেছিস আবার? আর ফোনে কার সাথে কথা বলতেছিস? “

সাদাত এবার চোখ বুজে নেয়। নিজের মায়ের কণ্ঠটাই সে সর্বশেষ শুনতে পেলো। তারপর আর কোনো শব্দই তার কানে পৌঁছাচ্ছে না। কি অদ্ভুৎ! বিস্ফোরণটা তীব্র ভাবে সাদাতের ফুসফুস এবং ফাঁপা অঙ্গ গুলোতে আঘাত এনেছে। যার ফলস্বরূপ সাদাতের কানের ভেতর হতে লাল তরল গড়িয়ে পড়ছে। সাদাত স্পষ্ট টের পাচ্ছে তার ডান কান গড়িয়ে রক্ত বের হচ্ছে।

মৃত্যুর ঠিক আগ মুহুর্তে সাদাতের মনে প্রশ্ন জাগে দৃশান নামরা দুপুরে কি খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা বলতে কল করেছিলো? কে জানে! আফসোস রয়ে যায় সাদাতের। শেষ বার ওই নারীর মুখে ‘এই ছেলে’ ডাকটা না শোনার আফসোস। বুকে ছোট্ট আফসোসটা পুষেই স্মরণ করে নিজের শপথ বাক্য,

“ সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা
সর্বত্র আমরা দেশের তরে। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]