এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৭৭.
বেলা তখন বারোটা বাজে। আকাশ তখন ঘন কালো মেঘে ঢাকা। কেমন গুমোট, থম ধরে যাওয়া একটা পরিবেশ বিরাজ করছে চারিদিকে। বিচারকার্য শুরু হয়েছে কেবল। বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মামলার মূল এবং এক নম্বর আসামী, হিরণ। মুখশ্রী জুড়ে তার আহামরি কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ পাচ্ছে না। সাধারণ ভঙ্গিতে কেবল দাঁড়িয়ে আছে। তবে মাথা নিচু করে নয়। স্বভাবসুলভ টানটান ভঙ্গিতে সোজা হয়ে।
কাঠগড়ার একপাশেই দল বেধে দাঁড়িয়ে আছে ইবাত সহ আরো বেশ ক’জন অপরাধী। সকলে নিজেদের পাল্লা মাপতে ব্যস্ত হলেও ইবাত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে নিজের স্যারের পানে। বিচারকের সিদ্ধান্ত কি হতে পারে সেই সম্পর্কে তার খুব ভালো করে ধারণা আছে। মন বারবার উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। কোনো কি পথ খোলা নেই স্যারকে বাঁচানোর?
অবশেষে আসে সেই ক্ষণ। বিচারক এলান করেন একজন দেশদ্রোহী, আতঙ্কবাদী, খুনী, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীর পরিণতির রায়। শাস্তি হিসেবে বেধে দেওয়া হয় চূড়ান্ত শাস্তি। মৃত্যুদন্ড। রায় ঘোষণা করেই বিচারক অফিসিয়াল কোনো এক ডকুমেন্টসে কালো কালির কলমের সাহায্যে সই করে। অত:পর হাতের সাহায্যে বলপ্রয়োগ করে সেই কলমের নিবটা ভেঙে ফেলে। এই কলমের নিব ভাঙার কার্যক্রমের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন প্রাণ নেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র সৃষ্টিকর্তার, তিনি কেবল নিজের পেশাদারি দায়িত্ববোধটুকু পালন করেছে।
হিরণ কেবল ম্লান হাসে। ঘোষণা করা হয় হিরণের একে একে সঙ্গীদেরও শাস্তি। ইবাত যে কি-না প্রত্যক্ষ ভাবে হিরণের প্রত্যেকটা অপকর্মে জড়িত, যার হাতও কি-না বহু নিষ্পাপ মানুষের রক্তে রাঙা তার শাস্তিটাও তার শ্রদ্ধেয় স্যারের থেকে আলাদা হয় না।
নিজের ঘোষণা করা শাস্তি নিয়ে ইবাতের মাথা ব্যথা নেই। তার সকল অস্থিরতা নিজের স্যারের মৃত্যুদন্ডকে ঘিরে। নিজের অস্থিরতা চেপে রাখতে পারে না ইবাত। অস্থির স্বরে চেঁচিয়ে উঠে,
“ না। মৃত্যুদন্ড শাস্তি হতে পারে না। উনি এই শাস্তি ডিজার্ভ করেন না। “
হিরণকে তখন কাঠগড়া থেকে নামিয়ে পুলিশ টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো। ইবাতের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হিরণ দাঁড়িয়ে পড়ে। এক মুহুর্তের জন্য সময় চেয়ে নেয় পুলিশের থেকে। অত:পর নিজের হ্যান্ডকাফ পড়া দুই হাত বাড়িয়ে ইবাতের হাত ধরে। স্বাভাবিক স্বরে বলে,
“ থ্যাঙ্কিউ ফর এভ্রিথিং। বিগত বছর গুলোয় আমার প্রতি সবথেকে বিশ্বস্ত ছিলে তুমি। প্রতিদানে ধন্যবাদ ছাড়া আর কিছু দিতে পারছি না আমি। “
পাপে জড়িত পাপীর এমন আবেগী কথায় বিরক্ত হয় উপস্থিত পুলিশ সমাজ। ইবাতের চোখ ছলছল করছে। হিরণ আর অপেক্ষা করে না। পুলিশের সঙ্গে বাহিরের দিকে পা বাড়ায়। ইবাত নীরবে দেখে সেই দৃশ্য। ছলছল চোখের সামনে ভেসে উঠে তার কাছে দেবদূত তুল্য মানুষটার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ।
ইবাতের বয়স তখন কতই বা হবে? তেরো কি চৌদ্দ! ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটা ভিক্ষা পার্টির সদস্য ছিলো সে। ওই পার্টিতে আরো বেশ ক’জন ভিন্ন বয়সের শিশু ছিলো। প্রত্যেকের কাজই ছিলো ভিক্ষা করে যত টাকা উঠবে তা নিজেদের মালিকের হাতে বুঝিয়ে দেওয়া। বিনিময়ে দুটো ভাত তাদের কপালে জুটতো।
এরকমই কোনো একদিন জ্যামে বসে থাকা একটা গাড়ির কাছে গিয়ে সে মায়া মুখে তাকিয়ে বলেছিলো,
“ দুই দিন ধইরা না খাইয়া আছি স্যার। আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু দেন। আল্লাহয় আপনার ভালা করবো। “
কথাগুলো ইবাতের মালিকের শেখানো বুলি ছিলো। মুখটা মায়া মায়া করে টাকা চাওয়াটাও উনারই শিখানো পাঠ। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে একটা যুবক কিছুক্ষণ সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইবাতকে দেখে। প্রশ্ন করে,
“ মা বাবা কোথায় তোমার? “
“ মা বাপতো নাই স্যার। এজন্যই তো ভিক্ষা কইরা চলি। মা বাপ থাকলে কি আর রাস্তায় থাকতাম? “
হিরণ খুব সম্ভবত ওই ছেলেটার মাঝে নিজেকে দেখতে পেয়েছিলো। থমথমে স্বরে প্রশ্ন করে,
“ সারাজীবন কি ভিক্ষা করেই খেতে চাও? “
“ না স্যার। আমি টেকা জমাই তো। ওই টেকা জমায় একদিন অনেক বড়লোক হমু। তারপর আপ্নেগোর মতন সাহেব সাইজ্জা ঘুরমু। “
“ কত টাকা জমিয়েছো তুমি? “
এই পর্যায়ে ইবাতকে একটু ভাবুক দেখা যায়। সে তো টাকার হিসাব জানে না! ইবাত বলে উঠে,
“ হেইডা তো জানি না। তয় অনেকডি পাঁচ টেকার নোট জমাইসি আমি। “
কথাটা বলেই ইবাত সরল হেসেছিলো। হিরণ কিছুক্ষণ সেই মুখখানা দেখে জবাবে বলেছিলো,
“ তোমার ধারণা ভুল। এভাবে বড়লোক হওয়া যায় না। বড়লোক হতে পরিশ্রম আর বুদ্ধি দরকার। তুমি কি রাস্তা ছেড়ে ভালো বাড়িতে থাকতে চাও? “
ইবাত অবাক হয়। সাহেব বেশের লোকটা কি তাকে প্রস্তাব করছে কোনো? সে বলে,
“ তা তো চাই। কিন্তু কেম্নে? “
হিরণের সোজাসাপ্টা জবাব ছিলো,
“ আমার সঙ্গে আমার জগতে চলো। সবসময় আমার বিশ্বস্ত হয়ে থাকলে তুমি তিনটা জিনিস পাবে। থাকার জায়গা, তিনবেলা খাবার আর টাকা। “
হিরণের জগতটা কি সেই সম্পর্কে ইবাতের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলো না। তবে হিরণের লোভনীয় প্রস্তাব উপেক্ষা করার সাধ্যিও তার ছিলো না। জ্যাম ছোটার ঠিক আগ মুহুর্তে সে হিরণের সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে যায়। হিরণের হাত ধরে প্রবেশ করে এক নতুন জগতে। যেই জগৎটা অন্ধকারে মোড়ানো হলেও ইবাত সেই জগতে ভালো ছিলো। আর সেই ভালো থাকাটা সম্ভব হয়েছেই কেবল হিরণ স্যারের কারণে। এতগুলো বছর ধরে এটা মেনেই এসেছে ইবাত। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। নিজের এতো বছরের জীবনে কেবল এই একটা মানুষের কাছ থেকেই সে বড়ো ভাইয়ের ন্যায় স্নেহ অনুভব করতে পেরেছে। সেই মানুষটার মৃত্যুদন্ড মেনে নেওয়া নিশ্চিত কোনো সহজ কাজ নয়!
__________
হাই কোর্ট প্রাঙ্গণে তখন ভীড় জমিয়েছে অসংখ্য সাংবাদিক। দেশের বুকে এতগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটানো আসামীর শাস্তি জানতে মরিয়া হয়ে আছে তারা। সে কি ভীড়! নিজেদের চ্যানেলের টিআরপি বাড়ানোর জন্য মুখিয়ে আছে প্রত্যেক সাংবাদিক।
পুলিশ দিয়ে ঘেরাও দেওয়া হিরণ দূর হতে সাংবাদিকদের ভীড় দেখে। মনটা খানিকটা বিচলিত হয়ে উঠে। সাংবাদিক গুলো নিশ্চয়ই তার ছবি তুলবে! তার মুখটা প্রত্যেকটা টিভি চ্যানেলে লাইভ দেখানো হবে! আগামীকালের খবরের কাগজের ফ্রন্ট পেজেও নিশ্চয়ই তারই ছবি ছাপানো হবে। এই একটাও যদি বহ্নির চোখে পড়ে ব্যাপারটা কেমন হবে ভাবতেই হিরণের অস্থির অনুভব হয়।
কিছুটা সামনে যেতেই সাংবাদিকরা তাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে পথরোধ করলো। বিভিন্ন প্রশ্নের ঝুলি সাজিয়ে বসে থাকা তারা একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ে দিলো। পুলিশরা সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া জরুরী মনে করলো না। উপরের মহল থেকে তাদের জন্য অর্ডার আছে যত দ্রুত সম্ভব আসামীকে নিয়ে যেনো তারা কারাগারে পৌঁছায়। এক মুহুর্ত কোথাও অপচয় করা যাবে না। সাংবাদিকদের ভীড় ঠেলে পুলিশরা তীব্র নিরাপত্তার সহিত এগিয়ে যায়। আরেকদল পুলিশ এসে পিছনে সাংবাদিকদের সামনে একপ্রকার ব্যারিকেডের ন্যায় দাঁড়ায়।
পুলিশ ভ্যানের কাছাকাছি যেতেই হাজার ভীড়ের মাঝে হিরণের দৃষ্টি গিয়ে আটকায় কোর্ট প্রাঙ্গণের এক কোণায়। অবিশ্বাস্যকর দৃষ্টি মেলে হিরণ দেখে দৃশ্যটা। মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বাণী। হিরণকেই দেখছিলো তারা। বাণীর চোখে ফুটে আছে একরাশ মিশ্র অনুভূতি। রাগ, ক্ষোভ, তৃপ্তি, ভয়, ঘৃণা। হিরণ সেসব উপেক্ষা করে বাণীকে একবার মাথা থেকে পা পর্যন্ত অবলোকন করে। গায়ে একটা সালোয়ার কামিজ, মাথায় ওড়না টেনে রাখা হয়েছে, সবসময় রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে থাকা মুখটায় সতেজতার ছাপ। হিরণের দৃষ্টিতে বাণী অস্বস্তি অনুভব করে। দুইহাতে দূর্জয়ের বাম হাতের কনুইয়ের কাছটা শক্ত করে চেপে ধরে সে। দূর্জয় স্ত্রীর অস্বস্তি আর হিরণের দৃষ্টি বুঝতে পেরেই সঙ্গে সঙ্গে বাণীকে আড়াল করে তার সামনে এক দুর্বোধ্য প্রাচীরের ন্যায় দাঁড়ায়। পুরো দৃশ্যটা নিঃশব্দে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো হিরণ।
হিরণের দৃষ্টি তখনও আটকে আছে দূর্জয়ের হাত চেপে ধরা বাণীর দুই হাতের দিকে। বাণীর বা হাতের অনামিকা আঙুলের আংটিটাও তার দৃষ্টি এড়ালো না। আর দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ পেলো না হিরণ। তার পূর্বেই তাকে টেনে গাড়িতে তোলা হলো। গাড়িতে উঠে স্থির ভঙ্গিতে বসে থাকলেও হিরণের চোখের সামনে এইমাত্র দেখা দৃশ্যটাই ভেসে রইল। চোখের কপাট বন্ধ করে নেয় সে। বুকের অন্তস্থল থেকে নিঃশ্বাস টেনে গভীরভাবে ছাড়ে। তারমানে বাণী নিজের জীবন ওই মেজরটার সাথে জুড়েছে? হিরণের রক্ত গরম হয়ে দু চারটে খুন করে ফেলার কথা থাকলেও সে সেরকম কিছু করে না। বরং নীরব হাসে। ম্লান হাসিতে নিঃস্বতার ছাপ। সব হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার হাসি তা। ওই সৈন্যটাকে বাণী ভরসার যোগ্য ভেবেছে তবে! যেই ভরসা কখনো হিরণের কাছে খুঁজে পায় নি, সেই ভরসাটা শাহরিয়ার দূর্জয়ের কাছে খুঁজে পেয়েছে সে। বাণী আর হিরণের নেই। কখনো ছিলও না অবশ্য। বহ্নি? তার মেয়েটাও কি আর তার নেই? হিরণ শূন্য অনুভব করে। সেই শূন্যতা অপূরণীয়।
__________
গোধূলি লগ্ন। আজ সারাদিনই আকাশের বুকে ধূসর রঙের মেঘেদের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। খুব সম্ভবত প্রকৃতির মন খারাপ। যেকোনো সময়ই হয়তো মেঘ গুলো বৃষ্টি হয়ে বর্ষণ নামাবে। খুব ব্যস্ততার মধ্যে ঘন্টা খানেকের ফুরসত নিয়ে বন্ধুরা মিলে ভীড় করেছে এক টঙ দোকানে। গরম চায়ের ধোঁয়ায় আড্ডায় যোগ হয়েছে নতুন প্রাণ। এতো মাস পর বন্ধুকে কাছে পেয়ে হাসি থাট্টায় মেতে উঠেছে প্রত্যয়, রাফি, ফারদিন এবং জুনায়েদ। এতো আনন্দের জোয়ারে সুসংবাদ হিসেবে সাইফ বন্ধুদের আরো একটা খুশির সংবাদ দেয়। জুলফিকার মুজতবা তার এবং নিশার সম্পর্কটা মেনে নিয়েছে শুনতেই বন্ধুরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে যায়। সাইফ তাতে ভাটা দিয়ে বলে,
“ শশুর আব্বার সম্মতি পাওয়া সোজা ছিলো। ঝামেলাট হলো আমার শাশুড়ী নিয়ে। আমার ধারণা মতে নাঈমা ম্যাম ত্যাড়া গোছের মানুষ। উনি সহজে মানবে না। আর আমার হিস্ট্রিহীন ফ্যামিলি ডাটা পেলে তো ডিরেক্ট ঝামেলা বাধাবে উনি। “
ফারদিন বন্ধুর পিঠ চাপরে বলে,
“ শালা, প্যারা নিস না। আমরা আছি কি কারণে? তোর শাশুড়ীর বাড়ির সামনে গিয়ে কুচকাওয়াজের আন্দোলনে নেমে পড়বো। মেয়ে দিবে না মানে? লাখে একটা ছেলে আমাদের। নিজে এসে নিজের আদরের দুলালি তোর হাতে তুলে দিবে দেখিস। “
রাফি সুর মিলিয়ে বলে,
“ ইয়েস ব্রো। ইউর বন্ধুগণ ইজ হেয়ার, সো ডো নট ফেয়ার। “
বন্ধুদের কথার পিঠে সাইফ একগাল হাসতেই প্রত্যয় প্রশ্ন করে,
“ নিশার না আজকে এডমিশন টেস্ট ছিলো? এক্সাম কেমন হয়েছে? কথা হয়েছে? “
“ হ্যাঁ। এক্সাম শেষ করে বের হয়েই কল দিয়েছিলো। মোটামুটি ভালোই হয়েছে বললো। আপাতত ফ্রেন্ডরা মিলে টিএসসি ঘুরছে খুব সম্ভবত। “
কথাটা বলতে বলতে সাইফ একবার হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ইয়াসমিন বলেছিলো কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে তারা শপিংয়ে যাবে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই তাদের শপিং শেষ। একবার কল করে দেখবে কোথায় আছে? সাইফ ফোন বের করে ইয়াসমিনের নাম্বার ডায়াল করে। কিছুক্ষণ রিং হতেই কলটা রিসিভ হয়। ফোনের অপর পাশ হতে নিশা বলে উঠে,
“ হ্যালো? “
সাইফ বলে,
“ আপনি বাসায় পৌঁছেছেন? “
“ উহু। শপিং সেড়ে বেইলি রোডে এসেছি আমরা। রুমির কাচ্চি খাওয়ার ক্রেভিংস হচ্ছিলো। তাই কাচ্চি ভাইয়ে এসেছি। “
“ বাহ। এখন আর বিরক্ত করছি না তাহলে। ইঞ্জয় ইউরসেল্ফ। বাসায় গিয়ে তবে কল দিয়েন। আর সাবধানে থাকবেন। “
নিশা হয়তো আরো কিছু বলেছিলো। কিন্তু শেষটা শুনতে পেলো না সাইফ। ফোনের অপরপাশ হতে মানুষের হাউকাউয়ের শব্দ ভেসে এলো। পরপরই ফোনটা কেটে গেলো। সাইফ ফোন পকেটে ভরে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ শালার ঢাকার মানুষ গুলা খুব হাউকাউ করে। “
প্রত্যয় গলা ঝেড়ে বুঝাতে চায় এখানে সে-ও উপস্থিত আছে। সাইফ হেসে বলে,
“ শালা তুই এক্সেপশনাল পিস। তুই শান্তি কমিটির মেম্বার। এই কারণে প্রোপার ম্যাচ হিসেবে ঝগড়াঝাটি ভাবিকে আল্লাহ তোর সাথে মিলায় দিসে। উনি হইসে চিল্লাপাল্লা কমিটির মেম্বার। তোর পোলাপাইন গুলা কোন কমিটির মেম্বার হইবো এইটা ভাবতেসি আমি। “
প্রত্যয় বিড়বিড়িয়ে বলে,
“ চিড়িয়াখানা কমিটির মেম্বার হবে ওরা। “
গল্প আড্ডায় মেতে থাকা প্রাণ গুলো টেরই পেলো না কখন অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। হঠাৎ আড্ডায় মশগুল সাইফের টনক নড়ে দোকানের ভেতর হতে ভেসে আসা ছোট্ট টিভির ক্ষীণ শব্দে। সে কান খাড়া করে কিছু শোনার চেষ্টা করে। পরপর বলে উঠে,
“ চাচা, টিভির ভলিউম বাড়ান তো। “
মধ্য বয়স্ক লোকটা ভাঙা রিমোটের সাহায্যে টিভির ভলিউমটা বাড়াতেই এবার বাকি চার বন্ধুও সেদিকে মনযোগ স্থির করে। প্রবল চেঁচামেচির শব্দ ভেদ করে সাংবাদিকের উচ্চারণ করা বাক্যটা সাইফের মস্তিষ্কে গিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
“ আজ সন্ধ্যা নাগাদ বেইলি রোডের একটা কমার্শিয়াল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ভবনটাতে বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট আছে। তার মধ্যে কেএফসি, পিজ্জা হাট, কাচ্চি ভাইও বেশ পরিচিত। আগুনের সূত্রপাতের ঘটনা সম্পর্কে এখনো স্পষ্ট কিছু জানা যায় নি। তবে ভবনে অবস্থিত মানুষরা ভেতরে আটকা পড়ে আছে। ফায়ার সার্ভিসের একটা দল ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছেছে… “
সাইফ কিছুক্ষণ মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে সবটা শুনলো। অত:পর দ্রুত পকেট থেকে ফোন বের করে এলোমেলো ভঙ্গিতে একটা নাম্বার ডায়াল করে। ফোনটা লাগাতার বেজে যায়। কিন্তু অপর পাশের মানুষটা আর কল রিসিভ করে না। সাইফ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। একপ্রকার দিকদিশা হারিয়ে টং এর বাহিরে রাস্তা ধরে ছুটলো। বিস্মিত বন্ধুরা কিছু বুঝতে পারলো না।
তবে তারাও ছুটলো সাইফের পিছনে।
সবসময় দূরন্ত ছুটে বেড়ানো ছেলেটা বেশি দূর যেতে পারলো না। মাঝপথে মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে গেলো। বুঝ হওয়ার পর থেকেই শিকড়হীন এই পৃথিবীতে টিকে থাকার লড়াইয়ে সাইফ কখনো কাদে নি। আজও সে কাদে না। তবে চোখ ভরে উঠে। সে তো পুরো জীবন সৎ ছিলো। না খেয়ে থাকলেও কখনো কারো হক মারে নি। কখনো কারো প্রতি সজ্ঞানে বিন্দুমাত্র অন্যায় করে নি। তাহলে তার কপালে এই সামান্য সুখ সইলো না কেন? এই সুখটা কি সাইফের হক ছিলো না? নাকি তার মতো অভাগার জন্য সুখ চাওয়াটাও পাপ?
চলবে…
এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৭৮.
বেইলি রোডের রাস্তা জুড়ে তখন মানুষের ভীড়। সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ আগুনে দাউদাউ করা রেস্টুরেন্টের পানে। গত এক ঘন্টা ধরে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে আগুন নেভানোর জন্য। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখা যেনো আজ ভেতরে আটক সবগুলো প্রাণ কেড়ে নিয়ে তবেই শান্ত হবে। আগুনের মূল সূত্রপাত নিচ তলা থেকে হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। চোখের পলকেই সেই আগুন ধীরে ধীরে উপরের ফ্লোর গুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। হুট করেই ব্যস্ত শহরটায় ছড়িয়ে পড়েছে তপ্ত বিষণ্ণতা।
এতো মানুষের ভীড় ঠেলে একপ্রকার দৌড়ে এসে সেখানে হাজির হয়েছে দূর্জয় ও বাণী। আজ সকালেই তারা আফরা সমেত ঢাকায় এসেছে। প্ল্যান ছিলো আজ এবং কাল সারাটা দিন সুহালা বেগমের কাছে থেকে পরের দিনটায় চট্টগ্রাম ফিরে যাবে। এতদিন পরে ঢাকায় ফিরে এবং হিরণের চূড়ান্ত রায়ের পরে সবার মধ্যে কাজ করা খুশির অনুভূতিটায় যেনো হুট করেই ভাটা পড়ে গেলো। জুলফিকার মুজতবার কল পেয়ে নিউজটা পেতেই দূর্জয় আর বাণী এক মুহুর্ত বাসায় অপেক্ষা করতে পারলো না। আফরাকে সুহালা বেগমের কাছে রেখে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে।
বিভৎসকর পরিস্থিতিটায় দূর্জয়ের মস্তিষ্ক ঠিকঠাক কাজ করতে পারছে না। এতো ভীড়ের মাঝে নিশাকে সে কিভাবে খুঁজবে বুঝে উঠতে পারছে না। এলোমেলো ভঙ্গিতে চারিপাশে তাকিয়ে সে একজন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তার কাছে এগিয়ে যায়। শুকনো গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করে,
“ আপনারা কাউকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন এখন পর্যন্ত? আমার বোন… ও ভেতরে আছে। নাম ইয়াসমিন মুজতবা নিশা। বয়স উনিশ। এডমিশন পরীক্ষার্থী। একটু দেখুন না প্লিজ। দ্রুত উদ্ধার করুন ওকে। “
মস্তিষ্কের ন্যায় দূর্জয়ের কথা গুলোও এলোমেলো ঠেকলো। দমকল বাহিনীর কর্মকর্তা বাকি সকলের মতো দূর্জয়কেও একই জবাব দিলো,
“ আপনারা অপেক্ষা করুন। আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। “
বাণী ততক্ষণে নিজের ফোনে নিশার ছবি বের করে আরেকজন দমকল বাহিনীর কর্মকর্তাকে দেখিয়ে বলছিলো,
“ প্লিজ আপনারা একটু ভিতরে যান। এই ভয়াবহ আগুনে মেয়েটার কষ্ট হচ্ছে। দ্রুত ওকে উদ্ধার করুন। “
লোকটা বিরক্ত মাখা স্বরে বলে,
“ ম্যাডাম আপনার একার রিলেটিভ ভিতরে আটকা পড়ে নি। আরো অনেকের স্বজনই ভিতরে আটক পড়েছে। একটু ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করুন। “
দমকল বাহিনীর সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছে একদল যুবক সমাজ। যে যেভাবে পারছে আগুন নেভানোর জন্য সর্বোচ্চ সাহায্যটুকু করছে। একদিকে যখন স্বজনদের দমফাটা আর্তনাদ অপরদিকে তখন আরেকদল জনগণ ফোন হাতে সেই দৃশ্য রেকর্ড করতে ব্যস্ত। এরকম ভয়াবহ একটা অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ করার জন্য উপস্থিত আছে কেবল ফায়ার সার্ভিসের একটি মাত্র টিম। পরিস্থিতির দৃশ্যপট দেখে দূর্জয় দ্রুত পরিচিত একটা মাধ্যমে কল করে। ধমকের সুরে বলে বেইলি রোডে এই মুহুর্তে যেনো অন্তত আরো দুটো ফায়ার সার্ভিসের টিম পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এতগুলো মানুষের জীবন কে কি এরা মশকরা পেয়ে রেখেছে না-কি?
বাণী আবারও নিশার নাম্বার ডায়াল করতে ব্যস্ত। এতক্ষণ যেই ফোনটায় কল ঢুকছিলো এই মুহুর্তে সেটা বন্ধ বলছে। বাণী ভীত গলায় দূর্জয়কে বলে,
“ নিশার নাম্বার এখন বন্ধ আসছে। ইয়া আল্লাহ! মেয়েটা ভেতরে কি অবস্থায় আছে আল্লাহ জানে! আল্লাহ হেফাজত করুক। “
দূর্জয় মলিন চোখে একবার ভবনটার দিকে তাকায়। কাচের গ্লাস দিয়ে আবৃত ভবনটার কোথাও বিন্দুমাত্র ফাঁক দেখা যাচ্ছে না যেখান দিয়ে সামান্যতম অক্সিজেন প্রবেশ করতে পারবে। নিশা মেয়েটা ছোট বেলা থেকেই বড্ড নাজুক স্বভাবের। নাজুক মেয়েটা এই পরিস্থিতিতে নিজেকে কিভাবে সামলাচ্ছে কে জানে! জুলফিকার স্যার এবং সাইফ ইতিমধ্যে ঢাকার উদ্দেশ্যে বাই এয়ার রওনা দিয়েছে। তাদের সামলানোও কঠিন হয়ে পড়বে। ওই দুটো মানুষ চোখের সামনে এই আগুনের দৃশ্যটা কিভাবে সহ্য করবে ভাবতেই দূর্জয় ভীত হয়ে পড়ে। হঠাৎ ভীড়ের পশ্চিম পাশ হতে একটা কণ্ঠস্বর কানে ভেসে আসতেই দূর্জয় ও বাণী বিস্মিত ভঙ্গিতে সেদিকে তাকায়। মুহুর্তেই তারা নির্বাক বনে যায়।
__________
ফ্লাইটে পাশাপাশি দুটো সিটে বসে আছে দু’জন পুরুষ। দুজনের কারো মুখেই কোনো কথা নেই। যেনো মৌনতার ব্রত করেছে দু’জনই। ভিতরে ভিতরে দুজনের বুক থেকে রক্তক্ষরণ চললেও কেউ কারো সামনে তা প্রকাশ করার সাহস দেখাতে পারছে না। কেবল অনুভূতি শূন্যের ন্যায় বসে আছে। তাদের পাশের সারিতেই আরেকটা সিটে বসে আছে প্রত্যয়। এই পরিস্থিতিতে বন্ধুকে একা ছেড়ে দেওয়ার দুঃসাহস সে দেখালো না। কোনো মতে ম্যানেজ করে সে-ও সাইফের সঙ্গে ঢাকা যাচ্ছে। বাকিরাও যেতে চেয়েছিলো। তবে পেশাদারিত্বের কাজে বাধা পড়ায় তারা কেউ আসতে পারে নি।
শক্ত ব্যক্তিত্বের জুলফিকার মুজতবা সিটে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে একটা দৃশ্য। যুবক জুলফিকারের কোলে সদ্য জন্মানো এক নবজাতক শিশু। গোলাপের পাপড়ির ন্যায় হালকা শিশুটি। প্রথম আদুরে মাখা কান্নাতেই নিজের আব্বুর মনটা নাড়িয়ে তুলেছিলো সে। ছোটবেলা থেকেই কোমল প্রকৃতির ছিলো তার মেয়েটা। সামান্যতম পিপড়ার কামড়েও কেমন দুনিয়া ভাসিয়ে কাঁদতো। কে জানে মেয়েটা ওই উত্তপ্ত আগুনের মাঝে কি-ই বা করছে? খুব কি কষ্ট হচ্ছে তার মেয়েটার? আর্তনাদ করছে কি?
বদ্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে জুলফিকার মুজতবার। নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মেলে তাকাতেই দেখে পাশে বসা শ্যাম হাতের ছেলেটা একটা টিস্যু এগিয়ে ধরেছে। জুলফিকার মুজতবা নীরবে টিস্যুটা হাতে নেয়। অত:পর নিষ্পলক দেখে সাইফের থমথমে মুখটা। মুহুর্তেই তার মনে প্রশ্ন জাগে তার মেয়েটা কি জানে সে তিনটা মানুষের কাছে একমাত্র বেঁচে থাকার সম্বল? জুলফিকার, নাঈমা, সাইফ তিনটা মানুষই খুব একা। দিন শেষে তাদের আপন বলতে কেবল একজনই আছে। ইয়াসমিন মুজতবা নিশা।
__________
বেইলি রোডের একটা রাস্তার মোড়ে পার্ক করে রাখা কালো গাড়িটার পিছনের একপাশের দরজাটা খোলা। সেই দরজার পাশে পানির বোতল হাতে দাঁড়িয়ে আছে দূর্জয়। ভেতরে সিটে বসে আছে বাণী। তার বুকে কেমন গুটিসুটি মেরে মুখ লুকিয়ে ফোপাঁচ্ছে নিশা। বাণী অনবরত মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। সে কিংবা দূর্জয় কেউ-ই এখন পর্যন্ত একটা প্রশ্নও করে নি নিশাকে। এইটা প্রশ্ন উত্তরের সময়ও নয়। মেয়েটা সুরক্ষিত আছে সেটার জন্যই মনে মনে আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া জানাচ্ছে তারা।
বাণী নরম স্বরে বলে,
“ একটু পানি খাও। ঘেমে গিয়েছো তুমি। খারাপ লাগবে। “
নিশা কোনো জবাব দেয় না। দূর্জয় ক্লান্ত চোখ মেলে দূরে তাকায়। এখনো আগুন নিভে নি। কালো ধোঁয়া গুলো যেনো কুন্ডলী পাকিয়ে আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টায় মত্ত। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দূর্জয় ফোন বের করে জুলফিকার মুজতবার নাম্বার ডায়াল করে। কিন্তু ফোনটা বন্ধ আসছে। দূর্জয় এবার সাইফের নাম্বারটা ডায়াল করে। সেটাও বন্ধ। দূর্জয়ের ভ্রু যুগল কুচকে আসে। এতক্ষণে তো তাদের ঢাকায় পৌঁছে যাওয়ার কথা। হয়তো টেনশনে এয়ারপোর্টে নেমে ফোন অন করার কথা খেয়াল ছিলো না। দু’জনের একজনকে অন্তত নিশা ঠিক আছে খবরটা জানাতে পারলে দূর্জয় স্বস্তি পেতো। সাইফ আর জুলফিকার মুজতবাকে না পেলেও নাঈমাকে কল করে দূর্জয় ব্যাপারটা জানিয়ে দেয়। আহত মায়ের বুক মেয়ের সুস্থ থাকার খবরে বোধহয় শান্ত হয় কিছুটা।
কখনো কখনো বোধহয় প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা সইতে না পেরে পরম করুণাময় নিজেই সাহায্য পাঠান। দমকল বাহিনী যখন আগুন নেভাতে হিমশিম খাচ্ছিলো ঠিক সেই মুহুর্তে মেঘে ঢাকা আকাশ হতে ভারী বর্ষণ নামে। পৃথিবীর বুকে জ্বলমান এক টুকরো আগুনকে শান্ত করতেই যেনো সেই বৃষ্টির আগমন।
গাড়ির ভেতর ড্রাইভিং সিটে নীরব ভঙ্গিতে বসে আছে দূর্জয়। পিছনের সিটে বাণীকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে নিশা। ঠিক সেই মুহুর্তে দূর্জয়ের ফোনটা বেজে উঠে। প্রত্যয়ের কল। দূর্জয় কলটা রিসিভ করে। প্রত্যয় জানায় তারা বেইলি রোডে এসে পৌঁছেছে। দূর্জয় কেবল ছোট্ট করে কোথায় আসতে হবে বলে ফোনটা রেখে দেয়। নিশার ব্যাপারটা আর জানায় না। মানুষ দুটো নিজে এসে দেখুক যে নিশা সম্পূর্ণ সুস্থ আছে। দূর্জয় পিছনের দিকে ফিরে নরম স্বরে বলে,
“ পাকনি? কান্না থামাও ভাইয়া। স্যার এসে পড়েছেন। কাছাকাছি আছে। এখনই এসে পড়বে। সাইফও সাথে আছে। “
আব্বু আর সাইফের কথা শুনতেই নিশা ধীরে ধীরে সোজা হয়ে বসে। ততক্ষণে রাস্তার একপাশে কিছুটা দূরেই এসে একটা ক্যাব থামতে দেখা যায়। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই গাড়ি থেকে নামে দুটো বিধ্বস্ত মানুষ। নিশা গাড়ির ভেতর হতে দু’জনকে দেখে। অত:পর বিলম্ব না করে নিজেও গাড়ির দরজা খুলে নেমে যায়।
দু জোড়া পা হঠাৎই থেমে যায়। কালো গাড়িটা হতে নেমে আসা মেয়েটাকে দেখে কেমন অবিশ্বাস্যকর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে দু’জন। থমকে রয় আপন জায়গায়। তবে নিশা নিজ জায়গায় স্থির থাকতে পারে না। দৌড়ে গিয়ে নিজের আব্বুর বুকে আছড়ে পড়ে। এতক্ষণের চাপা কান্নাটা এতক্ষণে হু হু স্বরে বেরিয়ে আসে। ভাঙা গলায় কিছু বলে। কান্নার দমকে তা স্পষ্ট বুঝা যায় না।
সাইফের শরীরটা কেমন টলছে তখন। সে ভরা চোখে দেখছে অবিশ্বাস্যকর দৃশ্যটা। মনে হচ্ছে সবটা স্বপ্ন। ইচ্ছে করলো হাত বাড়িয়ে বাবার বুকে পড়ে থাকা আদুরে মেয়েটাকে ছুঁয়ে দেখতে। কিন্তু সে আর তা করলো না। কেবল চুপচাপ সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। জুলফিকার মুজতবা মেয়েকে জাপ্টে ধরে লাগাতার আওড়াচ্ছেন,
“ আম্মু? আব্বু এসেছি। কান্না থামাও মা। কিচ্ছু হয় নি। কিচ্ছু হয় নি আম্মু। “
নিশা শান্ত হতে পারে না। তার চোখের সামনে এখনো ভাসছে সন্ধ্যার দৃশ্যপট। রিকশায় করে রেস্টুরেন্টের সামনে এসে নামে চার বান্ধবী। নিশা ভাড়া মেটাতে মেটাতে তার তিন বান্ধবী রেস্টুরেন্টের ভেতর প্রবেশ করে। নিশাও ধীরে সুস্থে ভাড়া মিটিয়ে ব্যাগের ভেতর পার্সটা রাখতে নিবে ঠিক এমন সময় সাইফের কল এসেছিলো। কল রিসিভ করে নিশা ফুটপাতের এক ধারে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। ঠিক এমন সময়ই রেস্টুরেন্টের ভেতর থেকে কিছু মানুষের চিৎকারের শব্দ ভেসে আসে। নিশা বোকার ন্যায় রেস্টুরেন্টের দিকে তাকাতেই দেখে কেমন কালো ও ধূসর ধোঁয়ায় চারিপাশটা ছেয়ে যাচ্ছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখা মিলে আগুনের শিখার। ততক্ষণে আশেপাশের মানুষের চেঁচামেচি আর ছোটাছুটি শুরু হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ কার সঙ্গে ধাক্কা লেগে যেনো নিশার ফোনটা কোথাও পড়ে যায়। নিশার সেই মুহুর্তে ফোনের দিকে খেয়াল ছিলো না। ভীতসন্ত্রস্ত তার মাথায় কেবল একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছিলো, যে তার বান্ধবীরা ভবনটার মধ্যে আছে। পুরোটা সন্ধ্যা জুড়ে এতো মানুষের মাঝে ফুটপাতের ধারে বসে নিশা কেবল দেখেছে চোখের সামনে সেই ভবনটাকে একটু একটু করে আগুনে ঝলসে যেতে।
এতক্ষণে নিশার অচল মস্তিষ্কটায় খেলে যায় একটা ভাবনা। ওই মুহুর্তে সাইফ যদি কলটা না করতো, তাহলে আজ নিশাও এই মুহুর্তে ওই ভবনটার ভেতর থাকতো। এতোগুলো মানুষের ভীড়ে তার আত্ম চিৎকারও মিশে থাকতো। ওই উত্তপ্ত আগুনে আজ সে-ও দগ্ধ হতো। নিশা নিজের আব্বুর বুক থেকে মাথা না তুললেও, বদ্ধ চোখ মেলে তাকায়। মুহুর্তেই তার চোখে পড়ে বৃষ্টিতে সিক্ত সাইফের নিস্তেজ মুখটার দিকে।
সাইফ কেমন ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকে দেখছিলো। নিশাকে তাকাতে দেখেই ম্যাসকুলিন সমাজের “ A sigma male never cries. “ প্রবাদকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সে নিঃশব্দে কেদে উঠে। বৃষ্টির পানির সঙ্গে তার অশ্রু মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। এইতো কিছুক্ষণ আগেও তার নিজেকে সর্বহারা মনে হচ্ছিলো। বারবার মনে হচ্ছিলো সব হারিয়ে ফেলেছে সে। তার কপাল গড়িয়ে এই বুঝি সব সুখ গুলো পড়ে গিয়েছে। কিন্তু না। কিচ্ছু হারায় নি সে। তার সবকিছু, তার সুখের কেন্দ্রবিন্দু, তার পরিবার তার চোখের সামনেই আছে। হারিয়ে যায় নি সে। আগুন তাকে ছুঁতে পারে নি।
__________
প্রায় মধ্যরাত। আগুনে ঝলসে যাওয়া ভবন থেকে তখনও পোড়া গন্ধ বিলীন হয় নি। চারিপাশে স্বজনদের দম ফাটা আর্তনাদ। সাইরেন বাজানো এম্বুলেন্স গুলোয় একে একে তোলা হচ্ছে উদ্ধারকৃত পোড়া দেহ গুলো। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানেই ব্যস্ত নগরীর কিছু সংখ্যক জলজ্যান্ত মানুষ গুলো আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। তাদের গল্প গুলো সকলের অজানা। হয়তো তাদের প্রত্যেকেরও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জীবনের গল্প। যেই গল্পের একেকটা অধ্যায় লিখিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি দ্বারা। কোনো অধ্যায়ে রয়েছে হাসি, তো কোনো অধ্যায়ে রয়েছে মন কেমনের দিনগুলো। তবে পরিসমাপ্তিটা সকলের একই।
শোনা গিয়েছে ভবনে আটকা পড়া মানুষ গুলো বাঁচার সুযোগ না পাওয়ার প্রধান কারণ হয়েছে ভবনে ইমারজেন্সি এক্সিট নামক কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। না ছিলো কোনো খোলা ছাদ। বদ্ধ ভবনটার মধ্যে একটু একটু করে ধুকে মানুষ গুলো জীবনটা হারালো। তবে এ আর তেমন কি? এরকম ঘটনা তো কতই ঘটে! দু’দিন খবরে এসব নিউজ দেখে সাধারণ জনগণ আফসোস মিশ্রিত স্বরে ‘আহারে, আহারে’ করে। অত:পর? অত:পর ভুলে যায়।
এই ঘটনা গুলো না দেশের মানুষের টনক নড়ায়, না দেশের ক্ষমতাসীনদের। কেউ-ই কোনো ব্যবস্থা নেয় না। কেবল যার হারায় সেই স্বজনরাই এই ঘটনা গুলো ভুলতে পারে না। এই হারানোর যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হয় তাদের গোটা জীবন।
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]