#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ১৫
-তো তোমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে আমার ওয়াইফ হওয়ার যে আবারও আমায় ইগ্নোর করছো তুমি? সো লেটস ডু দ্যাট, তুমি যেহেতু আমার ওয়াইফ হওয়ার হক আদায় করতে চাও আমি তাহলে শুনবো তোমার কথা। শুধু এক বিছানায় ঘুমাবো না, আরও অনেক কিছু করবো তোমার সাথে যা প্রত্যেক হাজবেন্টই তার ওয়াইফের সাথে করে। ওয়ানা সি ইট?’
আনভীরের উথাল পাতাল নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে আমার মুখ বরাবর। আমি বিস্ফোরিত নয়নে মানুষটার দিকে তাকালাম। আমি বলতে চাইলাম কি আর উনি বুঝলেন কি। আমি উনাকে সরাতেও পারছিনা আমার হাত উনার হাতজোড়ায় আবদ্ধ থাকার কারনে। আমি বড় বড় শ্বাস নিলাম কয়েকবার। নিজেকে নিজেই বললাম, ‘বি স্ট্রং আহি! তোমায় এখন ভয় পেলে চলবেনা’। কাট কাট গলায় বললাম,
-‘আমার আপনার সাথে বিন্দুমাত্র কথা বলার শখ নেই। ছাড়ুন আমায়।’
আমি হাত মোচড়ামোচড়ি করতেই উনি ঝুঁকে এলেন একটু। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কেনো যেন মনে হচ্ছে উনার মধ্যে এমন কোনো ইনটেনশন নেই যা আমায় ক্ষতবিক্ষত করে দিবে।এই চোখজোড়াতে আর যাই হোক লালসা থাকা অসম্ভব। কোনোভাবে উনি আমায় জব্দ করতে চা্ছেন না তো? তাহলে আমিও ছাড়ার পাত্রী নই। উনি আমার সাথে যা করেছেন প্রত্যেকটা ব্যবহারের মাসুল দিতে হবে উনাকে। উনার মনের কথাগুলো বোঝার জন্য একটাই উপায় আছে আমার কাছে, ‘ইগ্নোরেন্স মিশন কন্টিনিউ রাখা’। উনি আমার কোনোরূপ কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে বিস্মিত হলেন কেমন যেন। জড়ানো গলায় বললেন,
-‘আমার কথা শুনলে তো নিজেকে গুটিয়ে ফেলো তুমি। আর এবার তো কোনো রিয়্যাকশনই দেখতে পারলাম না। বড্ড চেন্জ হয়ে গিয়েছো আহি।’
আমি উনার কথার প্রতিউত্তর দিলাম না এবার। শুধু মৌনস্বরে বললাম,
-‘ছাড়ুন আমায়।’
-‘আগে আমার কথা ঠান্ডা মাথায় শুনো আহি। আই নো সন্ধ্যার ঘটনার জন্য তুমি অনেক রেগে আছো আমার ওপর। বাট ট্রাস্ট মি, আমি বলতে চেয়েছিলাম যে তুমি আমার ওয়াইফ তবে তাকে কথাটা বলার আগেই তুমি হনহন করে চলে এলে। একটাবারও সুযোগ দিলে না আমায় এক্সপ্লেইন করার।’
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম আমি।বললাম,
-‘আমি আপনার কে হই যে আমায় এক্সপ্লেইন করবেন? আপনিই তো বলতেন যে আমি আপনার এগ্রিমেন্ট ছাড়া আর কিছু না। তাহলে কষ্ট করে এক্সপ্লেইন করতে হবে না।’
আনভীর কিছু একটা ভেবে ছেড়ে দিলেন আমাকে। উনার চেহারা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আমার কোনো কথাই উনার ওপর কোনোরূপ কোনো প্রভাব ফেলেনি। উনি এবার বিছানায় এক কোণে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
-‘যতদিন আমার সাথে আছো রাতে বিছানা ছাড়া অন্য কোথাও ঘুমাবে না। এটা আমার ওয়ার্নিং বলতে পারো।’
-‘কেনো শুনবো আমি আপনার কথা?’
-‘আমি তোমার হাজবেন্ট তাই।’
আনভীরের মৃদু উত্তর। আমি উঠে বসলাম এবার। উনার কথাবার্তাগুলো নির্ঘাত পাগল করে দিবে আমাকে।আমি ক্ষীপ্ত স্বরে বললাম,
-‘আপনি যে কি চান আপনি নিজেও মনে হয় জানেন না আনভীর। আমাদের বিয়ের শুরুর কয়েকদিন তো আমার সাথে যা তা ব্যবহার করেছেন। হ্যা মানছি যে আপনার প্রেস্টিজ আমার জন্য নষ্ট হয়েছিলো তাই বলে আমার সাথে এমন করবেন?আচ্ছা সেটাও মেনে নিলাম। তাহলে আমার ওপর এত দরদ কেনো আপনার? আমি কি পড়ে যাবো, কার সাথে কথা বলবো, আমার পড়াশোনা , আমায় নিয়ে দুশ্চিন্তা করা এগুলো সবই করেন আপনি। আমার পড়াশোনার খেয়াল রাখেন, আমি সন্ধ্যাবেলা কফি খাই সেটা পর্যন্ত নজরে রাখেন, আমার জ্বর হলে সবচেয়ে অস্থির কিন্ত আপনিই হয়ে পড়েন। এটা কি আদৌ আপনার শুধু দায়িত্ব? আপনাকে একবার দেখলে মনে হয় আপনার মতো কেউ আমার খেয়াল রাখতে পারবে না, আবার নিমিষেই আকাশের মতো রং পাল্টে দুর্ব্যবহার করেন আমার সাথে।আমি এবার গোলকধাধায় পড়ে গিয়েছি আনভীর। আপনার দুই-পাক্ষিক আচরণ আমায় উদ্বিগ্ন করে তুলছে।’
আনভীর গহীন দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। আমি কথা বলে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে থাকলাম এবার। আজ উনাকে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতেই হবে। নাহলে কিছুতেই উনাকে ঘুমাতে দেবো না। আনভীর ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর মৃদু গলায় বললেন,
-‘আমি মানুষটাই এমন।আকাশের রঙের মতো পাল্টে যাই পরিস্থিতির শিকারে। তোমার একটা প্রবলেম কি জানো?তুমি আমার সব আচরণ ধরে বসে থাকো। আমি যতবার তোমার সাথে রাগারাগি করেছি বা এগ্রিমেন্টের কথা বলেছি ততবারই সব করেছি রাগের বশে। কিন্ত তুমি তো আবার বুঝো উল্টো। খালি এটা নিয়ে পড়ে থাকো যে আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। তোমায় কেনো কষ্ট দেই জানো? যাতে তুমি নিজেকে শক্ত করতে পারো। তুমি খুবই দুর্বল ছিলে আহি। কেউ কিছু বললেই কষ্টে মন ভাসিয়ে দিতে। কারণটাও আমার অজানা নয়। তাই আমি চাইতাম যে তুমি স্ট্রং হও। সবাই সাময়িক সময়ের কথা ভাবলেও আমি চেয়েছিলাম তোমায় স্ট্রং রাখতে। তোমার এন্সার পেয়েছো? তাহলে আমায় নিয়ে গবেষণা বন্ধ করে পড়ালেখায় মন দাও।সামনে এডমিশন টেস্ট আর তুমি আমায় নিয়ে গবেষণা করছো।
আর আমি যে ঠিক কি চাই তা ভালোমতই জানা আছে আমার। সেটা তোমায় ভাবতে হবে না। নাও লেট মি স্লিপ।এখন নিজেও ঘুমাও আর প্লিজ এই মেলোড্রামা অফ করো।’
বলেই মাঝখানে একটা কোলবালিশ দিয়ে উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। আমার মনের জমানো অভিমান তিলে তিলে বেড়ে ওঠলো এবার। আমিই আসলে অনেক বেশি আশা করে ফেলেছিলাম উনার কাছ থেকে।আমি বুঝে ফেলেছি উনি যা করছেন এসব দায়িত্ববোধ ছাড়া কিছুই নয়। আমি বিছানায় হুয়ে পড়লাম এবার। কাটিয়ে দিলাম একটি নিদ্রাহীন রাত।
__________________
সকালে কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি আমি। আনভীর তখন নাস্তা শেষ করে রুমে আসলেন হঠাৎ। আমার মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর নেই। আনভীর বললেন,
-আজকে ক্লাস হবে নাকি মডেল টেস্ট?’
-‘ক্লাস হবে।’
মৃদু গলায় বললাম আমি। আমায় এতোটা কঠোর হতে দেখে আনভীর চমকে গেলেন একটু। তবে কিছু প্রকাশ করলেন না। হাতঘড়ি পড়তে পড়তে বললেন,
-‘আজকে আমি দিয়ে আসছি তোমাকে।’
-‘আপনার যেতে হবে না। ধ্রুব ভাইয়া আসছেন এখানে। উনার সাথেই চলে যাবো।’
ধ্রুব নামটি শুনে আনভীরের শান্ত মুখখানা নিমিষেই ক্রোধে ছেয়ে গেলো হঠাৎ। আমি সেদিকে একপলক তাকিয়ে নজর সরিয়ে নিলাম। আনভীর শীতল গলায় বললেন,
-‘ধ্রুব এখানে আসছে কেনো? ওর আসার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি দিয়ে আসছি তোমাকে।’
-‘বললাম তো আপনার যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া আমার কোচিং আপনার ভার্সিটির একেবারে উল্টোদিকে। তাই আমার জন্য আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করতে হবে না।’
আনভীর অপ্রসন্ন হলেন আমার কথায়। তাই বললেন,
-‘সময় লাগলে লাগুক। ওই ধ্রুবের সাথে তোমায় ছাড়ছিনা আমি। পাগল পেয়েছো আমাকে?’
আমি বিস্ময় নিয়ে তাকালাম উনার দিকে। তাজ্জব হয়ে বললাম,
-‘আপনার হয়েছেটা কি একটু বলুন তো?আমি ধ্রুব ভাইয়ার সাথে গেলে আপনার কি তাতে? জেলাস ফীল করছেন নাকি!’
আমি সন্দিহান চোখে উনার দিকে তাকাতেই ভড়কে গেলেন উনি। কিছু বলতে চেয়েও পারলেন না। এইপ্রথম দেখলাম উনাকে এতটা অপ্রস্তুত হতে। তবে মানুষটাকে জব্দ করতে পেরে ভালোলাগছে বেশ। উনাকে চুপ থাকতে দেখে বললাম,
-‘থাক! কিছু বলতে হবে না। আমি গেলাম এবার।’
বলেই আমি দ্রুত চলে গেলাম বাহিরে। আনভীরও দ্রুত আমার পিছু পিছু আসছিলো তখন ড্রইংরুমে শিউলি ভাবি উনাকে বললেন,
-‘একি আনভীর! এভাবে কোথায় যাচ্ছো।’
-‘বউয়ের বডিগার্ড হয়ে যাচ্ছি।’
আনভীর এই কথাটি বলেই দ্রুত প্রস্থান করলেন ফ্ল্যাট থেকে।আমি উনার কথা শুনেও না শোনার ভান করলাম। যতই মানুষটাকে এড়িয়ে যেতে চাই ততই কাছে আসার চেষ্টা করেন যেন। ধ্যাৎ! ধ্রুব ভাইয়ার কথাটা বলাতেই মনে হয় ভুল হয়েছে। গ্যারেজের বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি কোথাও নেই ধ্রুব ভাইয়া। পরক্ষণেই আমার মনে পড়লো যে আনভীরের থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আজ ১০ মিনিট আগেই নেমে এসেছি আমি। বিরক্তির আভাস দেখা দিলো আমার কপালে। সব দোষ ওই চশমিশ বিলাইটার! হিটলার কোথাকার! আজ তার জন্যই এই গরমে এখন দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আমাকে। হুট করে কোথোকে গাড়ি নিয়ে সামনে এসে পড়লেন আনভীর। গাড়ির কাচ খুলে স্থির কন্ঠে বললেন,
-‘ফটাফট বসে পড়ো গাড়িতে।’
আনভীরের চোখ মুখ থমথমে। হঠাৎ উনার এরকম পরিবর্তনে একটু তটস্থ হলাম আমি। এই লোকের সুবিধা নাই। পরে না বললে আবার জানি কি উল্টাপাল্টা করে বসবে।আমায় পুনরায় চোখ রাঙানি দিতেই আমি এবার দরজা খুলে বসে পড়লাম গাড়ির সিটে। সাথেসাথেই উনি আমার কাছে ঝুঁকে সন্তর্পণে লাগিয়ে দিলেন সিটবেল্টটি। একবারও জিজ্ঞেস করলেন না যে আমি লাগাতে পারবো কি-না।গাড়ি স্টার্ট করতে করতে গম্ভীর গলায় বললেন,
-‘এতোদিন একা যাওয়া আসা করেছো দ্যাটস ইট। এখন থেকে আমিই তোমায় দিয়ে আসবো আর নিয়ে আসবো। ধ্রুবের এখানে আসার প্রয়োজন নেই।তোমার জন্য আপাতত আমিই যথেষ্ট। বুঝেছো?’
-‘হুম্।’
আনমনে উত্তর দিলাম আমি।আমি বুঝিনা যে ধ্রুব ভাইয়ার ব্যাপারে উনি এমন কেনো? ধ্রুব ভাইয়া তো উনারই ফ্রেন্ড। তবুও এত ইনসিকিউর?ওহ্! আমি তো আবার ভুলে গিয়েছিলাম এতো আবার পাগল মানুষ। কখন মাথায় কোন ভুত চড়ে বসে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। শেষমেষ এক পাগলের পাল্লাতেই পড়তে হলো আমায়।
.
.
কোচিংয়ের সামনে গাড়ি থামাতেই আমি নেমে যাচ্ছিলাম তখন উনি বললেন,
-‘থামো। আমিও আসছি।’
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম এতে। জিজ্ঞেস করলাম,
-‘আপনিও আসছেন?’
-‘হ্যাঁ।’
বলেই গাড়ি থেকে নেমে আমার হাত ধরলেন তিনি। আমার কয়েকজন ক্লাসমেট অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কেননা এই এক মাসে সচরাচর একাই এসেছি আমি। আনভীর আসলেও কেউ আমাদের একসাথে এভাবে দেখেনি। তাই হঠাৎ আমার সাথে এক সুদর্শন ব্যক্তিকে দেখে সবাই একটু বিস্মিত । কোচিংয়ে এক স্যারের সাথে আমার পড়াশোনার ইমপ্রুভমেন্ট নিয়ে কথা বললেন তিনি। আমার বায়োলজিতেই জাস্ট একটু প্রবলেম হচ্ছে এটা শুনে আনভীর স্যারকে আমার একস্ট্রা ক্লাস নিতে বলে দিলেন এবার। এখানকার সব স্যারই মূলত উনার পূর্বপরিচিত। তাই স্যার যখন উনাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি উনার কে হই , উনি নির্দ্বিধায় বললেন,
-‘আমার ওয়াইফ!’
আমি বড় বড় চোখ করে তাকালাম উনার দিকে। এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়, উনি কোচিংয়ের আমার সকল ক্লাসমেটদের বলেছেন যে আমি উনার স্ত্রী। সবাই তো রীতিমতো আমায় প্রশ্ন করা শুরু করেছে যে এতদিন আমি বলিনি কেনো। ব্যাপারটা খুব সাবধানে সামলে নিলাম আমি। আনভীর এবার কোচিং থেকে যাওয়ার সময় আমায় বললেন,
-‘ছুটির সময় একা যেওনা। আমি আসবো নিতে।’
উনার রাতারাতি পরিবর্তন বেশ ভাবিয়ে তুলছে আমাকে। একদিন আগেও যেই মানুষটা আমায় সবার সামনে স্ত্রী বলে পরিচয় দিতে চাননি সেই মানুষটাই এখন সবার সামনে নির্বিকারে আমার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। আসলেই! পৃথিবীটা যেমন অদ্ভুত, আনভীর তার থেকেও বেশি অদ্ভুত!!
.
.
~চলবে……ইনশাআল্লাহ!