#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৩২
সত্যি সত্যি মেডিক্যালে চান্স পায়নি আমি। আমি যেন কথাটি কোনোক্রমে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তাছাড়া আনভীরের মুখভঙ্গি দেখেও মনে হচ্ছিলো যে উনি বিষয়টা নিয়ে সিরিয়াস।আমার কথাগুলো কেমন যেন দলা পেকে আসছে। শ্বাস টেনে নিলাম বার কয়েকবার। কোনোমতে নিজেকে সামলে আমি পাথরের ন্যায় খাটে বসে রইলাম। শিউলি ভাবি অপ্রস্তুত কন্ঠে বললেন,
-‘এত মন খারাপ করার কিছুই নেই আহি। হাল ছেড়ে দিও না। আল্লাহই হয়তো চাননি যে তোমার ভাগ্যটা ওই প্রান্তে যাক। হয়তো তিনি আরও ভালো কিছু রেখেছেন।
আমি জানি ভাবি যা বলছেন সবটুকুই বলছেন আমায় শান্তনা দেওয়ার জন্য। আনভীর আমার হাত স্পর্শ করে কিছু বলতে যাবেন আমি শূণ্যমস্তিষ্কে বারান্দার দিকে পা বাড়ালাম। মিহি স্বরে বললাম,
-‘আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।’
আমার এই কথা শোনার পর আনভীর বা ভাবি কেউ আর এগিয়ে আসলেন না। না আসাতেই ভালো হয়েছে। হয়তো তারা দুজনেই বুঝেছেন আমার একা থাকাটা খুব প্রয়োজন ছিলো। নিরবিচ্ছিন্ন আধার। দূর দূর বড় বড় বিল্ডিংয়ের টিমটিমে আলোরাশির সমাহারে চকচক করছে প্রাণের শহর ঢাকা। আমি ডিভানে বসে রেলিংয়ে মাথা এলিয়ে অপলক দৃষ্টিতে সে দৃশ্য দেখতে থাকলাম। পাথর্ক্য শুধু একটাই , আগে আনন্দের সহিত দেখতাম , এখন দেখছি প্রাণহীনভাবে। আসলে আমার কান্নাগুলো কেমন যেন আটকে আসছে। আমার এতদিনের পরিশ্রম , পড়াশোনা , আনভীরের আশা সবকিছুই বৃথা হয়ে গেলো। সেই সাথে ছারখার হয়ে গেলো সেই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নটুকু। এভাবে কতক্ষণ বসে ছিলাম আমি জানিনা। তবে বেশ কিছুণ পর অনুভব করলাম আমার পাশে আনভীর বসে আছেন ডিভানে হেলান দিয়ে। আমার দৃষ্টি বাহিরে থাকলেও আমি বুঝতে পারছি যে উনার প্রগাঢ় চোখের চাহিনী আমাতে আবদ্ধ। আনভীর এবার ডাকলেন ,
-‘আহি?’
আমি এবার উনার দিকে তাকালাম। এই ‘আহি’ ডাকটিতে অজস্র অনুভূতি আর ভালোবাসা মেশানো ছিলো যা আমার পক্ষে কখনোই এড়ানো সম্ভব না। কি আছে এই মানুষটার কন্ঠে? যা রীতিমতো আমায় তোলপাড় করে দেয়?আনভীর এবার বলে ওঠলেন,
-‘তোমার এই অপ্রাপ্তিতে আমার কতটা কষ্ট হয়েছে জানো?আমি ভার্সিটিতে রেজাল্ট খারাপ করলেও এতটা কষ্টপেতাম না যা তোমার জন্য আমি উপলদ্ধি করতে পারছি। তবুও আমি মেনে নিয়েছি যে এটা হয়তো তোমার ভাগ্য ছিলো। তাহলে তুমি কেনো মানতে পারছো না?’
আমি নীরব থাকলাম। উনি নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলেন,
-‘কষ্ট হচ্ছে?’
আমার তখন কি হলো আমি জানিনা। রাগ, দুঃখ, অভিমান সবকিছু দূরে ঠেলে আমি ঝাপিয়ে পড়লাম উনার বুকে। চোখের বাধ ভেঙে তখন গড়িয়ে পড়লো অজস্র ধারায় পানি। আমি সশব্দে কেদে উঠলাম এতে। আমার এই কান্না আনভীরের প্রখর হৃদয় গলাতে পারছে কি না তা আমার অজানা থাকলেও উনি নিজের বলিষ্ঠ হাত দিয়ে পরম যত্নে আমায় আগলে রেখেছেন। আমি এবার কাদতে কাদতে বললাম,
-‘আমার সাথে সবসময় এমন কেনো হয় বলতে পারবেন? যা আমি মনে প্রাণে চাই সেটা কখনোই আমি পাইনা। আমি,,,,, আমি খুব আশাবাদী ছিলাম এ ব্যাপারে। নিজের আশা তো ভেঙেছি সাথে আপনার পরিশ্রম এক্সপেক্টেশন সবকিছু ধুলিস্যাৎ করেছি। চাচি ঠিকই বলে, আমি আসলেই একজন ব্যর্থ মানুষ। আমার জীবনে ব্যর্থতা ছাড়া,,,,,,’
আমায় কথা বলতে না দিয়েই উনি আমার কানের নিকট গম্ভীরভাবে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠলেন,
-‘হুসসস! এখন এসব কথা বলে মন খারাপ করো না তো! যা হয়েছো ভুলে যাও৷ তাছাড়া তোমার এই ফলাফলের জন্য আমিও কিন্ত দায়ী আছি তা তুমি জানো?’
আমি উনার বুক থেকে মাথা না উঠিয়েই বললাম,
-‘কিভাবে?’
উনি আমার চুলে নিজের আঙুলের বিচরণ চালিয়ে বলতে থাকলেন,
-‘আমি বেশি স্ট্রিক্ট হয়ে গিয়েছিলাম তোমার পড়াশোনার প্রতি যা আমার এতটাও হওয়া হয়তো উচিত ছিলো না। আমি জানি যে তোমার মায়ের মৃত্যুর পর তোমার জীবন টা তিক্ত ছিলো তাই আমি সবসময়ই চাইতাম তোমায় স্ট্রং করতে। তুমি ভাবতে যে আমি এগুলো সব করছি দায়িত্ববোধের জন্য কিন্ত এমনটা আসলে না আহি! আমি,, আমি তোমার জন্য চিন্তা করতাম। সবাই শুধু আমার ওপরের ব্যবহারটাই দেখে গিয়েছে, দেখেছে ক্ষণিকের ফলাফলটা, কিন্ত আমি যে তোমার ক্যারিয়ার গঠনের দিকে ফোকাস করেছিলাম সেটা কারও নজরে পড়েনি।’
আমি মৌনতা কাটালাম উনার কথা শুনে। কেননা আমার আর এখন কিছুই বলার নেই। উনি আবার বললেন,
-‘তোমার প্রিপারেশন যথেষ্ট ভালো ছিলো আহি, আমি কনফার্ম ছিলাম তোমার মেডিকেলে চান্সের ব্যাপারটি নিয়ে। তবে পরীক্ষার আগে আমার ব্যাবহারটাই তোমার হতাশার কারন । আর ডিপ্রেশন নিয়ে আর যাই হোক কখনও ভালো পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব না। এটা তুমি মানো?’
আমি ছোট করে মাথা নাড়ালাম। আমার অবচেতন মনে ছোট করে গড়ে উঠেছে উনার জন্য একপ্রকার সুক্ষ্ণ অনুভূতি। সাথে মনে প্রশান্তিও বয়ে চলছে যে উনি চিন্তা করেন আমার জন্য। আমার এতটা স্ট্রং হওয়ার পেছনে আমি মানতে বাধ্য যে আনভীরের অবদান অনেক। আমার কান্নার পরিমাণ আগের তুলানায় কমে এসেছে এবার। তবুও একটু একটু কেপে উঠছি। আনভীর আমায় নিজের বুকে আগলে পরম যত্নে চুলে হাতের বিচরণ চালাতে থাকলেন। উনার উষ্ণ নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে চুল ভেদ করে গলার প্ারন্তে। উনি আচমকা আবার ডাকলেন,
-‘আহি!’
আমি চুপ রইলাম। বুঝাতে চাইলাম যে আমি উনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছি।আনভীর আবার নিজের ঠোঁটজোড়া নাড়িয়ে কিছু একটা বলতে থাকলেন আড়ষ্ট কন্ঠে। বরাবরের মতোই চুলে নিজের হাতের বিচরণ চালিয়ে আমার কাপুনি বন্ধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমার ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহে এবার ঘুম নেমে এলো ধীরে ধীরে। উনার কোনো কথাই আমার কানে যাচ্ছিল না। আমি তারপর উনার বুকে মাথা দিয়েই ধীরে ধীরে ঘুমের রাজ্যে ঢলে পড়লাম।
_______________________________________________________
হসপিটালে ডক্টরের চেম্বারে বসে অপেক্ষা করছি আমি। আনভীর নার্সের সাথে কথা বলতে গিয়েছেন। হয়তো কিছুক্ষণ পরেই আমার ডাক পড়বে। পায়ের ক্ষতটা গভীর হওয়ার কারনে ইনফেকশন হয়ে গিয়েছে পায়ে। সেই সাথে শারীরিক দুর্বলতা তো আছেই৷ আনভীর বেশ কিছুক্ষণ পর পাশে এসে বসলেন আমার। আমার হাত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বললেন,
-‘বেশি খারাপ লাগছে?’
উনার একই প্রশ্ন বারবার শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গিয়েছে আমার। বাড়ি থেকে এখানে আসা পর্যন্ত কমপক্ষে দশবার মহাশয় এই প্রশ্নটা করে ফেলেছেন৷ আমি এবার দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
-‘আমার পায়ে জাস্ট ইনফেকশন হয়েছে, প্রেগন্যান্ট হয়ে যাইনি।’
বলেই আমি নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলাম। উনি সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। এ ধরনের কথাবার্তা আমায় বলতে দেখে অবাকও হয়েছেন বেশ। আমার সিরিয়াল নম্বর আসার পরেই আমি দুর্বল পা চালিয়ে প্রবেশ করলাম ডাক্তারের কেবিনে। উনি আমার পায়ের ক্ষতস্থানটি পর্যবেক্ষণ করে বেশ কিছু মেডিসিন দেওয়ার পর পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। নার্স ইতিমধ্যে আমার ব্লাড প্রেশার চেক করে দেখলো প্রেশার আমার একেবারেই লো। আনভীর এটা শুনে এমন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন যেন পারলে একদিনেই নিজেরটার সহ আমার প্রেশার হাই করে ফেলবেন। পায়ে সেভলন দিয়ে মুছে দেওয়ার সময় আমার ব্যাথার জায়গাটা প্রচন্ড জ্বালাপোড়া করছিলো কিন্ত পুরোটা সময় আনভীর আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানে। নার্সের ব্যান্ডেজ করাতে গিয়ে আমার মুখে একটু উহ্ শব্দ হলেই আনভীর কড়া গলায় বলে দেন আমি যেন কোনো ব্যাথা না পাই। উনি এমন ভাব করছিলৈন যে যেন উনার পায়ে ব্যান্ডেজ হচ্ছে। ডাক্তার তারপর গ্যাসট্রিক আর ব্যাথার ওষুধ প্রেসক্রাইব করে দিলেন আমায়। বললেন নিয়মমাফিক খাওয়া দাওয়া করতে। আমি আর আনভীর চলেই যাচ্ছিলাম তখন ডাক্তার বললেন আনভীরের সাথে কিছু কথা আছে উনার। আনভীর তাই ইশারায় বললেন আমায় একটু বাহিরে গিয়ে বসতে। আমি তাই বাহিরে গিয়ে বসে পড়লাম।
আমার কোনো ইনটেনশন ছিলো না ডাক্তারের কথাগুলো শোনার জন্য কিন্ত আমি যেহেতু দরজার সামনেই বসেছিলাম তাই অনিচ্ছাবশতই তাদের কিছু কিছু কথোপকথন আমার কানে ভেসে আসে ,
-‘লিসেন মিঃ আনভীর ! আপনি যদিও আপনার ওয়াইফের ব্যাপারে আমায় কিছু বলেননি তাই আমি আপনাদের পার্সোনাল লাইফে ঢুকতে যাবো না। তবে এজ এ ডক্টর হিসেবে আমি আপনাকে সাজেস্ট করবো উনাকে একজন ভালো সাইক্রেটিস্ট দেখানোর জন্য।’
-‘কেনো?’
-‘উনার পায়ের ইনফেকশন উনার দুর্বলতার কারন না। মিস আহির মেইন সমস্যা ঘুম নিয়মিত হয়না। সেটা হতে পারে হতাশা , টেনশন , উদ্রেকের জন্য। উনি কি কিছুদিন ডিপ্রেসড ছিলেন?’
-‘হ্যাঁ। তবে গতকাল মেডিকেল রেজাল্ট বের হয়েছিলো যেটাতে ও চান্স পায়নি দেখে একটু বেশিই হতাশ হয়েছে।’
-‘আমি বলবো উনাকে একজন ভালো সাইক্রেটিস্ট দেখাতে। আর সবসময় উনার সাথে থাকার চেষ্টা করবেন।’
ডাক্তার আরও কিছু বলছিলেন কিন্ত নার্স তৎক্ষণাৎ আমায় অন্যদিকে বসতে বললেই আমি উঠে দাঁড়ালাম সেখান থেকে। বেশ কিছুক্ষণ পর আনভীরের সাথে আমি হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলাম। পথে উনি পুরোটা সময় গম্ভীর ছিলেন। এমনকি বাড়িতেও। এর মধ্যে বাড়িতে গিয়ে একটি সুসংবাদ পেয়ে গেলাম যে শিউলি ভাবি প্রেগনেন্ট। গতকিছুদিন যাবৎই উনার শরীরের কন্ডিশন একটু খারাপ ছিলো। পরে আজরান ভাইয়া ভাবির জন্য প্রেগনেন্সি কীট আনতেই ভাবি টেস্ট করে দেখেন যে দুই দাগ উঠেছে। মা-বাবা , আজরান ভাইয়া সবার চোখমুখই চকচক করছিলো খুশিতে। আমার অন্ধকারছন্ন মুখেও আনন্দের একটা প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠলো। অথচ সেসময়ও আনভীর গম্ভীর। যেই ছেলে নিজের মায়ের পর ভাবিমণিকে সবচেয়ে সম্মান করে সেই ছেলের এমন শীতল প্রতিক্রিয়া দেখে সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলো। কিন্ত ভাবি এতে কোনো রূপ কোনো কষ্ট পেলো না। বলে ওঠলো ,’আরে ও তো এমনই। নিজের খুশি ভালোবাসা কিছুই প্রকাশ করতে পারেনা!’
কিন্ত আমার মনে সন্দেহের দানা বাধছে। এমন কি কথা হয়েছিলো ডক্টরের সাথে যে উনি এমন শান্ত হয়ে গেলেন?
.
.
.
~চলবে……..ইনশাআল্লাহ !