#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
লেখিকাঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
সূচনা পর্ব
শ্বশুরবাড়িতে আজই শেষদিন তিতিরের। শেষমেশ বাধ্য হলো দুই বছরের সংসার ছেড়ে আসতে। বিয়ের দুই বছর পেরোলেও তিতিরের স্বামী রাহান সেই যে বিয়ের তিনদিনের মাথায় হঠাৎ বার্তায় মি’শনের খবরে বাড়ি ছেড়েছিল আর ফেরেনি। সে একজন আর্মি অফিসার। তার কোনো খবরও কারও জানা নেই। সেদিনটা ছিল তিতির ও রাহানের বৌভাতের দিন। শ্বশুরবাড়ির আশেপাশের প্রতিবেশিরা প্রতিনিয়ত কানাঘুষা করে এমনকি তিতিরের চরিত্র নিয়ে প্রশ্নও তুলে! এতোদিন মুখ বুজে সব মেনে নিয়েছিল কারণ তার বাবা সমতুল্য শ্বশুর ছিলেন তার মনোবল কিন্তু সেই মানুষটা যে আর নেই! গতকালই যে তাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছে! অন্ধকার কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত করে রেখে এসেছে। তাই এই বাড়িতে আর থাকার মতো শক্তি বা আশা পেলো না। কার আশায়ই বা থাকবে? রাহানের? যে কীনা নতুন বউকে বিয়ে করেই ফেলে রেখে গেছে আর খোঁজ নেয়ারও প্রয়োজোন বোধ করেনি! তার অপেক্ষায়? শাশুড়িমা, ননাশও সুযোগ পেলে কথা শোনাতে ছাড়ে না। বাড়িতে দেবরের বিয়ে ঠিক হয়েছে। দেবরের বউ বিয়ে করে বাড়ি এলে হয়তো সেও সেই দলে যোগ দিবে! তাই চলে আসাই সমীচীন মনে করল।
তিতিরের শ্বশুরবাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই তার শাশুড়ি বিগত ছয়মাস যাবত উঠতে বসতে খুঁত ধরে ও খোঁটা দেয়। তাদের নজরে হয়তো তিতির অপয়া, অলুক্ষুনে মেয়ে। হবে নাই বা কেনো? সবার চোখে তো তাই! নয়তো বিয়ে করে আসার পর বৌভাতের দিনই স্বামী লাপাত্তা হয়? শ্বশুর শয্যাশায়ী হয়? বাবার বাড়িতেও বাবা-ভাই বেঁচে নেই। মা ও ভাবী আছে। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিধবা ভাবী জীবিত হয়েও যেনো মৃ’তের মতো। আর মা তো হাইপ্রেশার ও ডাইবেটিসের রোগী। তাদের খরচ তিতির দুইটা টিউশন করে চালায়। এই টিউশন করা নিয়েও কম কথা শুনতে হয় না। রাত করে বাড়ি ফিরে বলে আশেপাশের মানুষজন কু’ৎসা রটায়,
“স্বামী নিঃখোঁজ আর বউটাকে দেখো! ঢেং ঢেং করে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। রাত-দিন নেই বাড়ি ফেরার। দেখো গিয়ে নতুন আশিক জুটিয়েছে হয়তো! নাহলে স্বামীর জন্য কষ্ট তো দেখা যায় না। দিব্যি আনন্দে আছে। ভাগ্য করে এমন শ্বশুরবাড়ি পেয়েছে বটে। মেডিকেলে পড়াচ্ছে আবার এমন অপয়া মেয়েকে বাড়িতেও রেখেছে। আমি হলে কবে ঘাড় ধরে বের করে দিতাম।”
এসব শুনতে শুনতে তিতিরের আর গায়ে লাগে না। প্রথম প্রথম দরজা লাগিয়ে চিৎকার করে কাঁদত তখন শাশুড়ি রোকেয়া বেগম এসে বুকে আগলেও নিতো কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আশেপাশের বাহিরের আবরণ বিচারক মানুষদের মতো সেও তিতিরের ভিতরটা দেখা ছেড়ে দিলেন। পাড়া-প্রতিবেশিদের তো যাতায়াত লেগেই থাকে বাড়িতে। তারা সান্ত্বনা দেওয়ার বাহানায় পুরোনো ঘা*তে লবন লাগিয়ে যায়। আস্তে আস্তে শাশুড়িমাও বদলে গেলেন। শ্বশুরবাবা ব্যাতিত তিতিরের দিকটা বুঝার যেনো কেউ চেষ্টাই করত না। হাতের মেহেদীর রঙ শুকানোর আগেই বিচ্ছেদ! তখনও তো জানত না, তার অদৃষ্টে সাময়িক বিচ্ছেদকে দীর্ঘস্থায়ীতে রূপান্তর করা হবে। অপেক্ষা তো সে কম করেনি! এক-দেড় মাস পেরোতেই হাসি-খুশি তিতিরের ঠোঁটকোলের হাসি যেনো মূর্ছে যেতে লাগল। সারাদিন মনম’রা হয়ে থাকা ও বিকেল হলেই ছাদে গিয়ে হাঁটু ছড়ানো চুলগুলো ছেড়ে নির্নিমেষ অম্বরপানে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। এসব দেখে তিতিরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে ওর শ্বশুরবাবা ওকে পড়াশোনায় ব্যাস্ত করার কথা ভাবে। পড়ালেখা নিয়ে ব্যাস্ত থাকলে সব ভুলে থাকবে তাছাড়া তিতিরে এইচএসসির রেজাল্টও খুব ভালো। এক প্রকার জোড় করেই তিতিরের শ্বশুর মোঃ ওসমান আলী তিতিরকে মেডিকেল কলেজের ফর্ম ফিলাপ করায়। লেখাপড়ায় ভালো হওয়াতে শেষ সময়ে রাত-দিন এক করে পড়ালেখা করে মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা দেয় অতঃপর মংমনসিংহ মেডিকেল কলেজে চান্স পায়। সেসময় জোড় করে মেডিকেলে ভর্তি করেছিল বলেই তার পড়ালেখার সুযোগ হয়েছে। এইচএসসির পরেই বাবা-মা, ভালো ছেলে ও ঘর পেয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। তাই তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় শত অবহেলা, অবজ্ঞা, লাঞ্ছনার শিকার হয়েও থেকে গেছিল। এখন সেই মানুষটা জীবিত নেই। তার শেষ সময়ে তিতির যেটুকু পেরেছে সেবা-শুশ্রূষা করেছে। মময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েও ভর্তির আগেই ফরিদপুরের মেডিকেলে এসে পরেছিল।
পেছন ঘুরে বাড়িটা দেখে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিতির ট্রলি হাতে বেরিয়ে এলো। তার এখানের সময় যে ফুরিয়ে গেছে।
__________
আধঘণ্টার মধ্যে নিজের বাবার তৈরি করা এক তালা বাড়িটির সামনে রিকশা থেকে নামে। কলিংবেল চাপ দিলে তিতিরের মা নাজমা বেগম দরজা খুলে মেয়েকে ট্রলি হাতে দেখে মলিন হেসে দরজা ছেড়ে দাঁড়ান। তিতিরও মাকে জোরপূর্বক হাসি উপহার দেয়। তিতির ট্রলিটা রেখে বলে,
“হিয়া কই মা?”
“একটু ঘুমিয়েছে। মেয়েটা খেতে পারে না জানিসই তো। খেলেই বমি হয়।”
“ওহ আচ্ছা। আমি ওর জন্য কিছু রান্না করি তবে।”
তিতিরের মা মেয়েকে নিষেধ করে বললেন,
“মাত্রই এসেছিস একটু রেস্ট কর। আজ তো ক্লাসে যাসনি। রেস্ট কর। আমি একটু পর রিয়ার জন্য সবজি দিয়ে নরম খিচুড়ি রান্নাই করতাম।”
তিতির হালকা হেসে মাকে সোফায় বসিয়ে বলে,
“কিছু হবে না। তুমি গিয়ে রেস্ট করো। আমি রান্না করছি।”
“পারবি তুই?”
“আরে হ্যাঁ মা। ওই বাড়িতে প্রতিদিন রাতের জন্য রান্না ও শুক্রবার আমিই তো রান্না করি।”
তিতির মুখ ফসকে বলে ফেলে এখন নিজেই চুপ হয়ে গেছে। আর তো যাওয়া হবে না সেখানে। সব ছেড়ে এসেছে যে। নাজমা বেগম মেয়ের মাথায় হাত রেখে মলিন কণ্ঠে বলেন,
“আমাদের জন্যই আজ তোকে এই দিনটা দেখতে হলো। তোর বাবা তখন অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন বলে সময় থাকতে কন্যা বিয়ে দিতে চাইছিলেন। কে জানত? এতো ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেওয়ার পরেও…”
“বাদ দাও মা। সব কিছু সবার জন্য হয় না। আমি যাই ডাল-চাল-সবজি ঠিক করি।”
“তোকে লোকমুখে অনেক বাজে কথা শুনতে হয় তাই না?”
মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে এই পী’ড়াদায়ক প্রশ্নের জবাবে বলে,
“লোকমুখে তো কতোকিছুই বলে। সব কি আমরা করি?”
“আশেপাশের মানুষ রাস্তায় দেখলেই বাজে কথা বলে। পাড়ার মোড়ের ব*খাটে সুজনও কথা শোনায়। সে তো এখন ফুলে ফেঁপে ওঠেছে। ভয়ই হয়। হিয়া আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এখন তুইও এসেছিস। দুইটা যুবতী মেয়ে নিয়ে একা থাকাটা যেনো সমাজের চক্ষুশূল! বাড়ির আশেপাশে প্রায়ই সুজন, পলাশদের ঘুরতে দেখা যায়।”
“তুমি চিন্তা করো না মা। ওদের কাজই এসব। এই সুজনের হু’ম’কি-ধা’ম’কির জন্য বাবা আমার বিয়ে করিয়েছিলেন তাও জানি আমি। এখন আজকে আসার পথেও সে অ’শ্লীল ভাষা প্রয়োগ করছিল।”
নাজমা বেগম চিন্তিত হয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
“আমার ভয় যে আরও বেড়ে গেল। কি করব আমি? তোদের নিয়ে এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যেতে পারলে শান্তি পেতাম। কে জানত? আমার ছেলে-মেয়েদের জীবনেই যে এমন হবে আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি।”
“মা বাদ দাও। যা হয়ে গেছে তা গেছেই। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। হিয়াকে ঘুম থেকে তুলো।”
তিতির হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে গিয়ে চাল-ডাল ধুয়ে চুলোয় চড়িয়ে দেয়। তারপর সন্ধ্যা হলে মাগরিবের নামাজ পড়ে রান্নাঘরে যাওয়া ধরলেই কলিংবেল বেজে ওঠে। নাজমা বেগম আচমকা আঁৎকে ওঠেন।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
লেখিকাঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২
তিতির দরজা খোলার জন্য অগ্রসর হলে ওর মা বাধা দিয়ে ভীত কণ্ঠে বলেন,
“আগে ব্যালকনি দিয়ে গেইটের বাহিরে দেখে নে। প্রায়ই সুজন, পলাশরা কলিংবেল চাপে। গেইটে লা*থিও দেয় না খুললে। সন্ধ্যার পর এসব করে। হিয়ার উপরে নজর পলাশের।”
তিতির ওর মায়ের কথা অনুযায়ী বারান্দা দিয়ে দেখে নিলো। মাকে এসে আশ্বস্ত করে বলল,
“মনে হচ্ছে না সুজন, পলাশরা। অন্ধকারে গেইটের বাহিরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় না সুজনরা হবে। দরজাটা খুলে দেখে আসি কে আসলো।”
নাজমা বেগমের মনের ভয় পুরোপুরি কা*টেনি। সন্ধ্যা হলেই তার মনে ভয় হতে থাকে। তিতির মাকে দেখে নিয়ে গিয়ে দরজা খুলল। দরজা খুলে কেচিগেইটের কাছে গিয়ে দেখে বাহিরে বড়ো ব্যাগ কাঁধে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে হাতে তার একটা ছোটো বক্স। তিতিরকে দেখে লোকটা বলল,
“আপনি তানুজা নূর তিতির? ম্যাম আপনার নামে একটা পার্সেল এসেছে।”
“কিসের পার্সেল? আমি তো কিছু অর্ডার করিনি তাছাড়া হোমডেলিভারি দেয় এমন কিছু কখনোই অর্ডার করিনি।”
তিতিরের পাল্টা প্রশ্নে লোকটা বলে,
“আমরা তো জানিনা ম্যাম। আপনার পার্সেলের জন্য গুগুল ম্যাপে ঠিকানা দেওয়া ছিল কিন্তু আপনার ফোন নাম্বার দেওয়া ছিল না। হোম ডেলিভারিতে পার্সেল এসেছে।”
তিতিরের মনে সন্দেহের দানা পাঁকে। সন্দিহান কণ্ঠে বলে,
“প্রেরকের নাম-পরিচয় কী?”
“সরি ম্যাম। আপনি পার্সেলটা রিসিভ করে নিজেই দেখে নিন।”
তিতির আর কথা না বাড়িয়ে পার্সেলটা নিয়ে নিলো। পার্সেলের গায়ে নাম-পরিচয় লিখা নেই। লোকটা চলে গেলে তিতির গেইট লাগিয়ে বাসায় এসে পার্সেলের বক্সটা খুলে দেখে তাতে একটা গহনার বক্স ও একটা খাম। গহনার বক্সটা তার চেনা। চেনা তো হবেই কারণ তার বিয়ের সময় তার শাশুড়ি এই বক্সটা দিয়েছিল। বক্সটা খুলে দেখল তাতে তার শ্বশুরের দেওয়া একজোড়া বালা ও বিয়ের পরদিন রাহানের দেয়া গলার চেইন ও কানের দুল। এসব সে আসার সময় শাশুড়ির ওয়ারড্রবের উপর নিরবে খুলে রেখে এসেছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল তিতির। এসব ফেরত পাঠানোর কারণ বুঝল না। এবার খামটা খুলল। খামের ভিতর একটা চেক তাতে আড়াই লক্ষ টাকার এমাউন্ট। তিতির আর কাল বিলম্ব না করে তার শাশুড়ির নাম্বারে ফোন করে। রোকেয়া বেগম হয়তো ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলেন! রিং হওয়া মাত্রই রিসিভ হয়। তিতির সালাম বিনিময় করে বলেন,
“মা আপনি ওগুলো পাঠালেন কেনো?”
“দেখো তিতির, তোমার স্বামীর কোনো খোঁজ নেই এবং শ্বশুরও আর বেঁচে নেই। তোমার বিয়ের দেনমোহর চার লক্ষ টাকা ছিল। দেনমোহরের চার লক্ষ টাকার আওতায় এই গহনা গুলোও ছিল। খুব কম সময়ের মধ্যে বিয়ে হওয়াতে তখন বেশি গহনা গড়াতে পারিনি কিন্তু আমার ছেলে তোমার দেনমোহরের টাকা আগেই তার বাবার কাছে দিয়ে রেখেছিল। আজ তুমি বাড়ি ছেড়েছ তাই তোমার হক তোমাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার ছেলের নামে যা আছে তাও তুমি চাইলে অধিকার নিয়ে আসতেই পারো।”
“না মা। তার দরকার পরবে না। আপনার ছেলেই নেই তো আমি তার সম্পত্তি দিয়ে কি করব? আমাদের তো কোনো সন্তানও নেই। দুই বছরে মিশন থেকে ফিরল না। হেডকোয়াটারেও তার খবর জানে না। সে মিশন শেষে কোথায় গেছে কেউ জানেনা। সবই আমার ভাগ্য।”
রোকেয়া বেগম বললেন,
“ভালো থেকো। এতোদিন গা*লমন্দ করেছি। না চাইতেও করেছি। তোমার ভবিষ্যৎ ভালো হোক। অতীতের ছায়া না পড়ুক।”
তিতিরও আর কথা বাড়ালো না। শ্বশুরবাবা মা*রা যাওয়ার পর শাশুড়িমা আজকেই ফোনে তার সাথে এটুকু কথা বললেন। কাল থেকে তিনি তিতিরকে কিচ্ছুটি বলেননি। তিতির উপরের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে নিজের সব হতাশা উড়িয়ে দিতে চাইল। সে প্রাণখুলে বাঁচতে চায়। তিতিরের মা নাজমা বেগম তিতিরের সব কথাই শুনেছেন। তিনি মৌন রইলেন। মেয়েকে নিজে নিজে সামলে নিতে দিলেন।
শ্রাবণের শেষ সপ্তাহ। আকাশে প্রায়শই মেঘের আনাগোনা। ক্ষণে ক্ষণে মেঘের দল ফাঁকা গর্জন করে ওঠে। তিতির খিচুড়ির অবস্থা দেখে বুঝলো পানি আরেকটু শুকাবে তাই বাগাড়ের জন্য আগে থেকে পেঁয়াজ, রসুন কা*টছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়াচ্ছে। সবাকে বোঝাতে চাইছে এই জলের ধারা পেঁয়াজ কা*টার দরুণ। আজ সে সব ছেড়ে যে এসেছে। মায়ের চোখ তো আর ফাঁকি দিতে পারে না! নাজমা বেগম ঠিক বুঝে গেলেন। মেয়ের হাত থেকে জোর করে পেঁয়াজ নিয়ে নিজে কা*টতে আরম্ভ করলেন আর বললেন,
“ছাদের দরজাটা বা’ড়ি দিচ্ছে। একটু যা দেখে আয়। দুপুরে মেঘ ডাকছিল বলে তড়িঘড়ি করে আচারের বয়াম গুলো আনার সময় মনে হয় লাগাইনি। আমার হাঁটুতে ব্যাথা করছে। তুই যা দেখ একটু।”
তিতির নিঃশব্দে ছাদের সিঁড়িতে ওঠল। ছাদের দরজা ভীড়ানোই ছিল। ধীর পায়ে ছাদের ভেজা মেঝেতে পা রাখল। কেমন অদ্ভুত শিহরণ। মাঝ বরাবার গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দুইহাত প্রশস্ত করে আকাশপানে মুখ করে নয়নজোরা মুদিত করল।
______
বিয়ের রাতে তিতির রাহান আসার আগেই ঘুমিয়ে পরেছিল। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার দুইদিন পরেই বিয়েটা হয় তার জন্য ক্লান্তি একটু বেশিই। তাছাড়া রাত দেড়টা অবধি অপেক্ষায় জেগে ছিল পরে না পারতে বসে বসেই ঘুমিয়ে গেছিল। পরদিন সকালে উঠে দেখে হাতের চুড়ি ও গলার হারগুলো খুলে পাশের টেবিলে রাখা। পাশ ফিরে রাহানকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেই বুঝেছে রাহান এগুলো খুলে দিয়েছে যাতে ঠিক মতো ঘুমাতে পারে। তিতিরের কিশোরী মনে তখন প্রথম প্রখর ভালো লাগার উদ্রেক ঘটে। কলেজের দুয়েকজন বান্ধুবীর মুখে বিয়ের প্রথম রাত নিয়ে ভয়ংকর অভিঙ্গতা শুনে সে ভয়েই ছিল।
সেইদিন আরো একবার রাহান তিতিরকে রক্ষা করেছিল। যখন শাড়ি পড়ে ছাঁদ থেকে নামার সময় পরে যেতে নিয়েছিল তখনি রাহান তাকে বাহুডোরে আগলে নিয়েছিল। তারপর রাহানের বন্ধুত্বের প্রস্তাব। সবকিছুই তিতিরকে মুগ্ধ করছিল কিন্তু কে জানত ওগুলোই শেষ!
________
দীর্ঘশ্বাস ফেলল তিতির। নেত্রকোন বেয়ে গড়ালো নোনাজল। এই স্মৃতিগুলোই তার দুই বছরের অপেক্ষার সঙ্গী। আর্মি হেডকোয়াটার থেকেও কোনো খোঁজ দিতে পারছে না। হঠাৎ ঢুকরে কেঁদে উঠে জড়ানো স্বরে বলতে থাকে,
“আমার সাথেই এসব কেনো হয়? স্বামী, বাবা, ভাই তারপর শ্বশুরবাবা। সবাই কেনো আমাকে একা করে চলে যায়? হারাতে হারাতে আজ আমি ক্লান্ত। মা ও হিয়াকে হারাতে চাইনা। আমার আপন বলতে ওরাই।”
খোলা আকাশের নিচে কিছুক্ষণ দুঃখবিলাস করে গায়ে গুঁড়ি বৃষ্টির ছাঁট লাগামাত্রই চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় অতঃপর ছাদের দরজা লাগিয়ে নেমে আসে। বাসায় ঢুকে দেখে মা হিয়াকে খাবার টেবিলে এনে বসিয়েছেন। তিতির গিয়ে হিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“কেমন আছিস? আর মাত্র এক মাস। তারপর আমাদের সোনামণি চলে আসবে।”
হিয়া মলিন হেসে বলল,
“আমার বাচ্চাটা জন্মের আগেই এতিম হয়ে গেলো। ঠিকই আছে। মাও এতিম, বাচ্চাও এতিম। কী মিল!”
“চুপ। একদম আজেবাজে ব*কবি না। এসব ভেবে নিজেকে কষ্ট দিবি না।”
“কষ্ট! ওটা নিজেই আমার কাছে আসে। নিজের চোখের সামনে নিজ স্বামীকে খু*ন হতে দেখেছি। ওটা অ্যাকসিডেন্ট ছিল না রে। ইচ্ছাকৃত ছিল।”
হিয়ার কথার প্রত্যুত্তরে তাচ্ছিল্য করে তিতির বলে,
“ইনভেস্টিগেশনই হচ্ছে না। কিছু করার নাই রে। টাকা ছাড়লে সব হতো কিন্তু যেখানে বেঁচে আছি কোনোমতে সেখানে আর কি করার আছে!”
নাজমা বেগমকে আসতে দেখে হিয়া ও তিতির চুপ করে গেলো। তিনজনের জন্য খিচুড়ি ও ডিম ভাজা করে এনেছেন।
খাওয়ার মাঝপথে আবারও কলিংবেলের শব্দে হিয়া আৎকে ওঠে। তিতির বিরক্তি নিয়ে বলে,
“আবার কে?”
তিতির উঠে যেতে ধরলে হিয়া তোঁতলানো স্বরে বলল,
“যাস না তিতির। তুই যে এসেছিস ওরা খবর পেয়ে গেছে।”
“খবর পাবে কি! আমাকে আসতেই দেখেছে।”
“কেচিগেইট না খুলে দেখি কে এসেছে।”
হিয়া ও নাজমা বেগমকে কিছু বলতে না দিয়ে দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দেখে বাহিরে কেউ নেই। আরেকটু ভালো করে দেখতে সিঁড়িরঘরের বাতি জ্বালালো। কেচিগেইটের কাছ পর্যন্ত গিয়ে দেখে ফিরে আসবে তখনি দেখে একটা খাম। খামটা গেটির ফাঁকা দিয়ে হাতড়ে নিলো। ওটা নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে খাবার টেবিলের কাছে এসে বলে,
“এটা পেলাম। কেউ ছিল না।”
“খুলে দেখ।”
“হু”
তিতির খামটা খুলল অতঃপর যা দেখল অবাক না হয়ে পারল না।
চলবে ইনশাআল্লাহ,