#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
লেখিকাঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৫
দুপুর একটার পর দুপুরের খাবার খেয়েই গাড়ি নিয়ে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে মাশরিফ। আজ আর পরনে আর্মি জ্যাকেটও নাই। সম্পূর্ণ ক্যাজুয়াল পোশাক। প্রায় আড়াই ঘণ্টার মধ্যে ময়মনসিংহ মেডিকেলে গিয়ে পৌঁছায়। তারপর মেডিকেল ক্যাম্পাসের গেইটে রাফি, অর্ককে দেখে গাড়ি সাইড করে নেমে আসে।
“কেমন আছিস?”
“সবসময় ভালো। মনে কোনো দুঃখ নাই আর লাইফে কোনো জিএফ নামক প্যারা নাই। বিন্দাস তো থাকবই।”
রাফির জবাবে মাশরিফ একটা কি**ল বসিয়ে দেয়। রাফি ব্যা’থায় বলে,
“আউউ! তোর এই শক্ত হাত দিয়ে আমাকে মা*র*বি না। অনেক লাগে। পরে দেখবি তোর তিতিরপাখিকে গিয়ে তোর নামে উলটা-পালটা কথা লাগায় দিয়ে আসব।”
মাশরিফ বাঁকা হেসে বলে,
“যা লাগা। সে তো আমাকে দেখেইনি! প্রথম দেখার দিন সে ছিল আনমনা, ব্যাস্ত! তারপর বৃষ্টির রাতে ওদের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম তখন হুট করে অন্ধকার! হলো না দুই জোড়া নয়নের প্রথম সাক্ষাত।”
“দুঃখের স্টোরি। টিসু দিবো?”
তখনি শুভ সেখানে হাজির হয়। বলে,
“কার টিসু লাগবে?”
অর্ক শুভর মা*থায় একটা চা*টা মে-*রে বলল,
“জিএফের সাথে দেখা করা শেষ?”
শুভ মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চোখ-মুখ খিঁচে বলে,
“বুঝিনা, তোদের আমার জিএফ নিয়ে এতো সমস্যা কেন? তোরা সিঙ্গেল, সেটাও কি আমার দোষ? মানা করছে কে জিএফ বানাতে? আর এই আসছে আরেক ভবিষ্যৎ দেবদাস! তোমার পারু যখন ফুড়ুত হবে তখন তুমি দুঃখে হাহুতাশ করবা। বুঝছোস!”
মাশরিফ মুখে হাত দিয়ে হেসে বলল,
“আচ্ছা। এবার ভেতরে চল। দেখে মেডাম কি করতেছে!”
ওরা ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢোকে। তিতির কই আছে খুঁজতে থাকে। তখনি মাশরিফের কর্ণকুহরে পৌঁছায় কারও মিষ্টি সুর। দর্শনেন্দ্রিয় তন্ময় হয়ে খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও যায় কাঙ্খিত উৎসটিকে।
“তুমি সুখ যদি নাহি পাও,
যাও সুখের সন্ধানে যাও।(২)
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে
আর কিছু নাহি চাই গো
আমার পরান যাহা চায়।”
তিতির পরের প্যারা গাইবে তার আগেই এক পুরুষালি কণ্ঠেস্বরে সুর ওঠল।
“আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন!
তোমাতে করিব বাস।
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ-মাস,
আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন!
তোমাতে করিব বাস।
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ-মাস।”
বান্ধবীদের জোরাজুরিতে গাইছিল হঠাৎ এক পুরুষালী কণ্ঠস্বরে থামতে বাধ্য হলো তিতির। প্রথমে ভ্রুঁ কুঁচকে চাইলেও গানের সুরের তালে মুগ্ধ হয় সে। জুলিয়া বলে ওঠে,
“হু ইজ দ্যা হ্যান্ডসাম?”
জুলিয়ার মন্তব্যে লিরা আস্তে করে চি*ম*টি কা*টে। জুলিয়া কপাল কুঁচকে ইশারা করলে লিরা ওর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে। জুলিয়া এবার বুঝতে পেরে মুচকি হেসে চুপ করে যায়।
রণক, ইমরান, আসফি করতালি দিয়ে সমস্বরে বলে ওঠে,
“দারুণ ভাই। দারুণ!”
অর্ক দাঁত কে*লিয়ে হেসে বলল,
“সুপার দোস্ত। তুই তো ফা*টি*য়ে দিয়েছিস। আর তিতির, তুমি তো দারুণ গান করো।”
“ধন্যবাদ ভাইয়া। মাঝেমধ্যে রবীন্দ্রসংগীত শোনা হয়। তাই দুয়েক লাইন পারি।”
তিতিরের জবাবে মাশরিফ প্রত্যুত্তর করে,
“আপনি বুঝি রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত?”
তিতির অচেনা পুরুষটিকে বারকয়েক পরখ করল। অতঃপর বলল,
“না তেমন না। গান তেমন একটা শোনা হয় না, তবে সুর ভালো লাগলে মাঝেমধ্যে শোনা হয়। মা রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ করেন সেই সূত্রে শোনা হয়।”
“আমারও গান শোনা হয় না। মা শোনলে শুনি একটু।”
মাশরিফের জবাবে তিতির মুচকি হাসলো। তিতিরকে নিরব দেখে শুভ বলল,
“মাশরিফ চল ক্যান্টিনে যাই।”
শুভর উদ্দেশ্য মাশরিফের নামটা শোনানো। তিতির ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল। ওর দৃষ্টির পরিবর্তন দেখে অর্ক শুধালো,
“কিছু বলবে? নিঃসংকোচে বলো।”
“না। তেমন কিছু না। এমনি।”
“তোমার কি সন্দেহবা*তিক আছে?”
শুভর আচানক কূল-কিনারাহীন প্রশ্নে তিতির অবাক হয়ে বলল,
“বুঝলাম না ভাইয়া। আমি আবার কী করলাম?”
“এইযে তুমি চোখে সন্দেহের বার্তা নিয়ে আমার অতি ভোলাভালা বন্ধুর দিকে চেয়ে আছ! কিছু তো সন্দেহ করেছোই।”
তিতির থতমত খেয়ে যায়। হতবিহ্বল কণ্ঠে বলল,
“তেমন কিছু না ভাইয়া। উনার কণ্ঠস্বর কিছুটা পরিচিত সাথে নামটাও।”
“কিন্তু আপনি তো আমার কাছে অপরিচিতা!”
মাশরিফের তাৎক্ষণিক জবাবে তিতিরের হৃদকুটিরে সূক্ষ্ম কম্পনের সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অপরিচিতা গল্পের কল্যাণীর কথা মনে পরে হুট করেই।
মাশরিফের ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা কিছু শব্দ জনসম্মুখে প্রকাশিত হলো না। বলতে পারল না, “তুমি আমার বহু আকাঙ্ক্ষিত অপরিচিতা প্রেয়সী!”
নাদিয়া প্রশ্ন করল,
“ভাইয়া আপনি কোন মেডিকেলে পড়েন?”
অর্কের জবাব,
“ও মেডিকেলে পড়ে না। ও তো..!”
অর্ককে মাঝপথে থামিয়ে মাশরিফ বলল,
“আমি ওদের সাথে মির্জাপুর ক্যাডেটে ছিলাম। সেখান থেকে ফ্রেন্ডশিপ।”
“ওহ আচ্ছা।”
রাফি বলে,
“চলো সবাই। আমাদের সাথে ক্যান্টিনে চলো। আজ মাশরিফ আমাদের ট্রিট দিবে।”
কথাটা বলেই মাশরিফের দিকে চেয়ে শ*য়*তা-নি হাসি দেয়। মাশরিফ চোখ গরম করে তাকালে প্রসঙ্গ বদলাতে তিতিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তিতির, তোমার বাসা ভাড়ার জন্য আমি খোঁজ লাগিয়ে দিয়েছি। দ্রুত আপডেট পাবে।”
তিতির কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মিষ্টি হাসে।
“চলো চলো। সবাই ক্যান্টিনে চলো। ট্রিট ফর্ম মাশরিফ।”
অর্কের উচ্ছাসিত কন্ঠে ওর বন্ধুরা সর রণক, ইমরান, আসফিও হৈ হৈ করে ওঠল। ছেলেরা সহ লিরা, জুলিয়া, নাদিয়া, জেরিন চললেও তিতির ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। মাশরিফ কয়েক কদম এগিয়েও পিছিয়ে এসে বলল,
“চলুন।”
তিতির হকচকিয়ে চেয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“আপনারা যান। আমি রুমে যাব।”
মাশরিফ এবার হাঁত উুঁচিয়ে খানিক জোড়ালো কণ্ঠে ঘোষণা করল,
“গাইজ, মিস তিতির না গেলে ট্রিট ক্যান্সেল। এখন বুঝো কী করবে।”
তিতির অবাক হয়ে বলে,
“মানে কী? আপনার ট্রিটের সাথে আমি কিভাবে সম্পর্কিত?”
“সম্পর্কিত না?”
মাশরিফের দ্বিধাহীন প্রশ্নে তিতির আবারও থতমত খেয়ে যায়। প্রশ্নের জবাব দিতে কিঞ্চিত নয়, বেশ খানিকটাই মস্তিষ্কে জোড় দিতে হবে। ওর এই হতবিহ্বল মুখাবয়ব দেখে মাশরিফ মাথা নুইয়ে হেসে আবারও তিতিরের চোখপানে দৃষ্টি স্থাপন করে বলে,
“মস্তিষ্কে বেশি জোড় দিতে হবে না ডাক্তার ম্যাম! আপনার গানের সাথেই কলি মিলিয়েছিলাম তারপর কী থেকে কী হলো তা নিয়ে আমারও মনে সংশয় আছে। তাই চলুন। আপনার বন্ধুরা যাচ্ছে তো আপনি বাদ যাবেন তা তো আমার ঘোর অ*পমান!”
“অপমান? আমি আবার আপনার অপমান করলাম কখন?”
তিতিরের সন্দিগ্ধ কণ্ঠস্বর ও প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে মাশরিফ আবারও হাসে। হেয়ালিপূর্ণ কণ্ঠে বলে,
“তা তো আমিও জানিনা। আপনি যদি জানেন তবে বলুন নয়তো চলুন। যেটা সহজ মনে হয় সেটাই করুন।”
তিতির ঘন নিঃশ্বাস ফেলল। সব তার ব্রেনের চার কাঠি উপর দিয়ে যাচ্ছে। লিরা ও জারিন এগিয়ে এলো। জারিন বলে,
“চল না। কথা বাড়াচ্ছিস কেনো? উনারা যেহেতু ট্রিট দিতে চাইছে তো তুই মানা করছিস কেনো? সিনিয়ররা এমন ট্রিট মাঝেমধ্যেই দেয়। চল তো।”
“কিন্তু!”
জারিন এবার তিতিরের হাত টেনে হাঁটা শুরু করেছে। অগ্যতা তিতির সাথে চলল।
ক্যান্টিনে গিয়ে চিকেন স্যান্ডুইচ ও চিকেন পাকোড়া বলে সেসব অর্ডার করল। অল্প অর্ডারই করল। তিনটা টেবিল পাশাপাশি সংযুক্ত করে ওরা চেয়ার টেনে বসল। মাশরিফ ভণিতা করে প্রশ্ন করল,
“মিস তিতির, শুভ বলল আপনি বাসা খুঁজছেন। কিন্তু কেনো?”
“আমার মা, ভাবী ও ভাতিজিকে নিয়ে আসতে।”
“কিন্তু মিস তিতির, এতোদিন পর কেনো? মানে নতুন বাসায় তো মাসের প্রথমে ওঠে। তার জন্য আগের মাসে ঠিক করে রাখতে হয়। তা আজ তো অক্টোবর মাসের দুই তারিখ।”
মাশরিফের প্রশ্নে তিতির লম্বাশ্বাস নেয়। অতঃপর বলে,
“আমি ফরিদপুর থেকে মাইগ্রেশন করে এখানে এসেছি কয়েকদিন হলো তাই।”
মাশরিফ কিছু মনে পরার ভান করে বলে,
“ফরিদপুর? তিন-চারবার যাওয়া হয়েছে। তা মিস তিতির, হঠাৎ চলে আসলেন কেনো?”
তিতিরের এবার খানিকটা বিরক্ত লাগে। তিতির বলল,
“বারবার মিস তিতির বলতে হবে না। আপনি সরাসরি তিতির বলতে পারেন। ফরিদপুর থেকে এখানে কিছু সমস্যার কারণেই এসেছি। মানুষ শখে তো মাইগ্রেশন করে না!”
তিতিরের বিরাগী কণ্ঠে মাশরিফ দমে যায়। বুঝে যায়, তার অভিনয় একটু বেশিই বিতৃষ্ণার সৃষ্টি করেছে। কণ্ঠে অনুতাপের সুর এনে বলে,
“দুঃখিত আমার অনাধিকার চর্চার জন্য।”
এরপর সবাই কয়েক সেকেন্ড নিরব থাকে। তারপর খাবার চলে আসলে খাওয়া শুরু করে। তিতির খাবার না খেয়ে বসে আছে বলে মাশরিফ তা দেখে বলে,
“আমার উপরের রা’গ খাবারের প্রতি আনবেন না প্লিজ।”
চলবে ইনশাআল্লাহ,
#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
লেখিকাঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৬
তিতির তাও খাচ্ছে না দেখে মাশরিফ হুট করে এক কাণ্ড ঘটিয়ে বসলো। এক পিস চিকেন কাটলেট তিতিরের মুখের ভিতর ঢুকিয়ে দিতে চাইল। আচানক কান্ডে তিতির হতবাক, হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল সেই সাথে টেবিলের বাকি সদস্যরাও। অর্কর কাশি উঠে গেছে। এখন শুভ তড়িঘড়ি করে ওর সামনে পানির গ্লাস ধরে। বেচারা দ্রুত গ্লাস নিয়ে পানিটুকু খেয়ে নেয়। মাশরিফ সবার অবাক দৃষ্টি দেখে চিকেন কাটলেটটা এবার নিজের মুখে পুরে নেয়! সে হাসার চেষ্টা করে বলল,
“সরি। উনি খাচ্ছিলেন না তাই।”
রাফি এবার শা*সানোর ভান করে বলে,
“এসব কী ধরনের ব্যাবহার মাশরিফ। তুই এভাবে একটা স্বল্প পরিচিত মেয়ের মুখের সামনে খাবার ধরতে পারিস না। ভদ্র হ।”
রাফির কণ্ঠস্বর কিছুটা জোড়েই হয়েছিল, যার দরুন আশেপাশের টেবিলের স্টুডেন্টরাও ফিরে তাকিয়েছে। ওদের তাকানো দেখে এবার রাফি আবার প্রায় ধ*ম*কে বলে,
“কী? কী দেখছ সবাই? নিজেদের খাবার খেয়ে বের হও। তিতির, তুমি খাচ্ছ না কেনো? কোনো সমস্যা?”
মাশরিফ রাফির দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে আছে। রাফি ইশারায় সামনে দেখতে বললে মাশরিফ ভ্রুঁ কুঁচকে সামনে তাকিয়ে দেখে তিতির খাচ্ছে। এবার তার মুখে হাসি ফোটে। রাফির দিকে তাকিয়ে দেখে ছেলে ভাব নিয়ে বসেছে! মুচকি হেসে নিজেও খেতে থাকে।
_________
বিকেলের সময়টাতে আজ রাফি, অর্ক, শুভর ডিউটি পরাতে ওরা ডিউটিতে যায়। মাশরিফ কি করবে! সেও সাথে গিয়ে ওয়ার্ডে ঘুরতে থাকে। ফাঁকে ফাঁকে বৃদ্ধ রোগীদের সাথে কথা বলা ও হাসানো শুরু করে।
তিতিরকে, ফাইজা, নাদিয়া ও জারিন জোর করে ওয়ার্ড এড়িয়াতে নিয়ে এসেছে। সূর্য প্রায় ডুবুডুবু। কিছুক্ষণ পরেই মাগরিবের আজান পরবে। ফাইজা একটু বেশি চঞ্চল। হাঁটতে হাঁটতে সে লাফাচ্ছে। বলছে,
“আমাদের যখন ওয়ার্ড ডিউটি শুরু হবে তখন আমি শিশু ওয়ার্ডেই ডিউটি নিব। যদি দেয় আরকি। এতো ভালো লাগে ইশ! বাচ্চারা কতো কিউট হয়।”
“আমি তো রোগীদের মাঝে বয়ফ্রেন্ড খুঁজব। রণকটা আমাকে একটুও পাত্তা দেয় না।”
ফাইজা ও জারিনের কথা শুনে তিতির মুখে হাত দিয়ে হাসছে। করিডোরে রোগীদের পরিবারের লোকজন ও ওয়ার্ড বয়, নার্সরা চলাফেরা করছে। নাদিয়া বলে ওঠে,
“শাফকাত বলল, সারাদিনে নাকি ওয়ার্ডে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে পা ব্যাথা হয়ে যায়। আমার তো ভয়ই করছে।”
জারিন রম্যস্বরে বলল,
“শাফকাত! উপস! ডাঃ শাফকাতকে এখন নাম ধরে ডাকা হচ্ছে। কতো ভালোবাসা আহা!”
ওদের ফা*জলামি দেখে তিতির হাসছে এরই মাঝে নজর যায় একটা ওয়ার্ডে। মাশরিফকে দেখা যাচ্ছে এক বৃদ্ধার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। বৃদ্ধা মহিলার সামনের পাটির একটা দাঁতও নেই। তার ফোঁকলা হাসিতে মাশরিফও হাসছে। তিতির কয়েক মূহুর্ত স্থির হয়ে দৃশ্যটা দেখল। কিছু সময় আগে ছেলেটার কর্মকাণ্ডে সে বড্ড বিরক্ত হয়েছিল কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ছেলেটা খুব প্রাণোচ্ছল। নিজের আশেপাশের মানুষকে হাসি-খুশি রাখতে ভালোবাসে। এটা দেখে তিতিরও হালকা হেসে আবার বান্ধবীদের সাথে চলতে থাকে। তার মস্তিস্কে চলছে কিছু একটা।
__________
সুজন ও পলাশ লোকমুখে জানতে পেরেছে তিতিররা বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে এবং সেই বাড়ি এক আর্মির লোক কিনেছে। আজ তাই তিতিরকে খুুঁজতে ফরিদপুর মেডিকেলে গিয়েছে। খুঁজে খুঁজে তিতিরের দুই বন্ধু হাসিব ও সাইফকে দেখল। কিভাবে এদের জিজ্ঞেসা করবে ভাবতে ভাবতে দেখে হাসিব মেডিকেল কলেজের বাহিরে যাচ্ছে। এই তো সুযোগ।
হাসিব টিউশনে যাবে বলে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে তখনি পলাশ ও সুজন পিছন থেকে হাসিবের কাঁধে হাত রাখে। হঠাৎ এমন হওয়াতে হাসিব ভড়কে ওঠে। সুজন পানের পিক ফেলে জিজ্ঞেসা করে,
“কী-রে কেমন আছোস?”
হাসিব হকচকিয়ে তাকায়। এদেরকে সে চিনে। তাই ওদের হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেয়। পলাশ খিকখিক করে হেসে বলে,
“কী হইলো তোর? এমন করোস কেন?”
“আপনারা এখানে কেনো এসেছেন?”
“পাখির টানে আইয়া পরছিরে। এখন ভালো পোলার মতো কইয়া ফালাও তো, আমার পাখিডা কই?”
হাসিব এবার রেগে বলল,
“লজ্জা নেই আপনাদের? মানুষের পিছনে এভাবে হাত ধুঁয়ে পরেছেন কেনো?”
পলাশ বলে,
“শোনো, পুরুষ মানুষের লাজ-সরম থাকে না। লাজ-সরম তো মাইয়াগো ভূষণ! আমরা পুরুষ মানুষ। আমরা হমু লজ্জাহীন। লজ্জা পাইয়া মাইয়াগো মতন লুকায় থাকুম নাহি?”
হাসিবের মেজাজ তুঙ্গে। সে বলে,
“বে*হায়াদেরও লজ্জা থাকে না। জানেন? আপনার ওই ক্যাটাগরির। পথ ছাড়ুন।”
ওদেরকে ছাড়িয়ে হাসিব সামনে একটা রিকশা পেয়ে তাতে চ’ড়ে বসে।
হাসিবকে চলে যেতে দেখে সুজন বলে,
“এই শা* কইতো না। ধরতে হইবো ময়নাপাখির মাইয়া সই গুলারে। পোলাগুলা ডরায় কম। মাইয়াগুলায়তো ডরে সব কইয়া দিবো।”
“ঠিক কইছোস।”
_________
সকালে একটা ক্লাস শেষ করে লাইব্রেরীতে বসে তিতির ও ওর বান্ধবীরা পরের ক্লাসের পড়া পড়ছে। তখন লিরার ফোনে মেসেজ আসে,
“হোয়ার আর ইউ গাইজ? তিতির কোথায়?”
শুভর মেসেজ দেখে লিরা নিজেদের লোকেশন মেসেজ করে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে রাফি, শুভ লাইব্রেরীতে হাজির হয়। প্রথমে একটু অবাক হওয়ার ভাণ করে বলে,
“ও তোমরা এখানে? আমি ও রাফি তোমাদের মনে মনে খুঁজছিলাম।”
জারিন জিজ্ঞেসা করে,
“কেনো ভাইয়া? আগে তো আমাদের এতো খুঁজতেন না। বরং আমরাই আপনাদের খুঁজে খুঁজে বের করতাম। তাও ঠিক মতো খুঁজে পেতাম না। কিন্তু ইদানীং পা*শা পালটে গেছে দেখা যাচ্ছে।”
জারিন কিছুটা জোড়েই কথা বলে ফেলেছে। যেহেতু লাইব্রেরী তাই সব সাইলেন্ট থাকে। যার ফলপ্রসূ বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীরা ঘুরে তাকিয়েছে। রাফি হালকা কেঁশে বলে,
“কাজের জন্য খুঁজছিলাম। যাইহোক তিতির, তোমার জন্য বাসা ভাড়া পেয়ে গেছি।”
তিতির অবাক ও খুশি দুটোই হয়।
“সত্যি ভাইয়া? কী বলে যে ধন্যবাদ দিবো বুঝতে পারছি না।”
“আরে ধন্যবাদ দিতে হবে না। আমরা সিনিয়র জুনিয়র। শোনো, বাসাটাতে দুইটা বেডরুম, ওয়াশরুমও দুইটা। কিচেন ও একটা ডাইনিং। ভাড়া সাত হাজার। কারেন্ট বিল নিজেদের আর সিলিন্ডার গ্যাস ব্যাবহার করতে হবে। এর নিচে পাইনি। রুমগুলো ছোটোই। ছোটো রুম ও জায়গাটা মফস্বল বলে ভাড়া তুলনামূলক কম।”
নাদিয়া বলে ওঠে,
“এরকম বাসার ভাড়া ঢাকা শহরে ১৩-১৫ হাজারের কম পাবোই না। মানে আমাদের এলাকায়। জায়গা অনুসারে সবকিছুরই মূল্য নির্ধারিত হয়।”
তিতির বলে,
“কারেন্ট বিল ও গ্যাস মিলিয়ে আট হাজারে হয়ে যাবে তবে।”
“হ্যাঁ এমনই। তোমার ভাইয়া তো নেই তাই না?”
শুভর প্রশ্নের জবাবে তিতির প্রথমে না ভেবেই বলে,
“হ্যাঁ। ভাইয়া নেই। ওয়েট, আপনি কিভাবে জানেন?”
শেষে তিতিরের সন্দিহান প্রশ্নে শুভ থতমত খেয়ে যায়। আমতা আমতা করে কিছু বলবে তার আগেই রাফি চট করে বলে ওঠে,
“তুমি বলেছিলে, তোমার মা, ভাবী, ভাতিজি সহ ওঠবে। কিন্তু ভাইয়ের কথা বলোনি। তাই হয়তো শুভ জিজ্ঞেসা করেছে।”
“ওহ। আসলে ভাইয়া মা*রা গেছেন। ভাতিজির জন্মের আগেই। তাই এই তিনজনই আমার পরিবার।”
“সরি। আমার প্রশ্ন করাটা ঠিক হয়নি।”
“ইটস অকে ভাইয়া। আপনারা আমার জন্য এতোকিছু করেছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।”
রাফি ও শুভ হালকা হেসে সেখান থেকে চলে যায়। কিন্তু কেউ একজন যে এসব দেখে কথা লাগাতে চলে গেছে তা ওদের ধারণাও নাই।
চলবে ইনশাআল্লাহ,