একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-০২

0
192

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

২.
পার্থিব শ্রুতির সামনেই বসা৷ পায়ে বেশি কিছু না হলেও কেমন যেন একটা টনটনে ব্যথা করছে৷ আঙ্গুল কেমন যেন অসাড় অসাড় লাগছে৷ রক্ত জমেছে সম্ভবত। পার্থিব এর পায়ের দিকেই ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রুতি৷ কিছু মানুষজন মিলে তার পায়ে বরফ ঘষে দিচ্ছে৷ শ্রুতি আসলে এমন কিছু করতে চায়নি৷ আবার অন্যকিছুও মাথাতে আসেনি। সুন্দরমতো শাড়ি পরিহিতা একজন মেয়ে এগিয়ে এলো। সন্দিহান কন্ঠে বলল,
‘শ্রুতি? তুমি পার্থিব এর পায়ে ইচ্ছে করেই জগটা ফেলেছ মনে হলো আমার।’

যথাসম্ভব মাথা নুইয়ে ছিল শ্রুতি। কিন্তু মেয়েটির প্রশ্নে এমনভাবে তাকাল যেন তার মাথায় হাতুড়ি দিয়ে কেউ বারি দিয়েছে৷ চোখে ভয় স্পষ্ট। রাগী ধাঁচের হলেও নতুন জায়গায় এমন এক একটা কাজ করে বিপাকে পরে গেছে শ্রুতি৷ শুধু কোনোভাবে বাঁচতে পারলেই যেন হয়৷

‘ভাবি, নতুন ভাবি হয়তো বুঝতে পারেনি৷ ভাবি তো টেবিল থেকে ফোন নিতে চেয়েছিল। আচমকা হাত লেগে জগটা পরে গেল৷ তাই না নতুন ভাবি?’

শ্রুতি অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল৷ মেয়েটি ওকে বাঁচিয়ে দিল কেন? আর কেই-বা মেয়েটি? কী মিষ্টি মুখ! শ্রুতি অবাক হয়ে লক্ষ্য করল মেয়েটির পাশে একই রকম দেখতে আরেকজন মেয়ে৷ একদম একই রকম৷ শুধু পার্থক্য – একজনের স্বাস্থ্য ভালো কিন্তু অপরজন কিছুটা রোগা৷

‘কী হলো নতুন ভাবি? ঠিক বলেছি না আমি?’

‘হ্যা..হ্যাঁ। আসলে আমি ফোন নিতে গেছিলাম কিন্তু…’

‘হয়েছে।ছোট্ট ব্যাপার। কিচ্ছু হবেনা।’

বলেই তানহা বেগম শ্রুতি এর মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে দিলেন৷ এইভাবে হাত বুলানোতে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করল শ্রুতির, যার অধিকাংশ জুড়ে অনুতাপের বসবাস। অন্যায় কাজের বিনিময়ে আদর পেয়ে খারাপ লাগল ওর।

পার্থিব উঠে দাঁড়াল৷ তানহা চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘কীরে? তুই আবার উঠে দাঁড়ালি কেন? পায়ের ব্যথা সেড়ে গেল?’

‘হ্যাঁ মা। আমি ঠিক আছি৷’

ঠিক আছি বলেও দেখা গেল ভালোমতো দাঁড়াতে পারছে না৷ ব্যথিত আঙ্গুলের দিকে হালকা নুইয়ে আছে৷ সেই শাড়ি পরিহিতা মেয়েটি অর্থাৎ পার্থিব এর ভাবী বললেন, ‘তুমি কী শ্রুতিকে কোলে তোলার জন্য দাঁড়ালে?’

‘হুম। তো তুলব না? শ্রুতিকে কী সারারাত এখানে বসিয়ে রাখার প্ল্যান আছে নাকি? দেখো মা, তুমি তো বুঝো৷ সারাদিন কতো ঝামেলা গেছে৷ এখন এইসব নিয়মের মানে হয়?’
শ্রুতির রাগ হচ্ছে৷ সবার সামনে এমন কেন করছে লোকটা? পায়ে ব্যথা নিয়ে কোলে নেওয়ার প্রয়োজন কী? খুব মহান সাজতে ইচ্ছে হচ্ছে নাকি? সাজাচ্ছি আপনার মহান হওয়া…..

পার্থিব অন্যদের উদ্দেশ্য করে বলল,
‘পায়ে ব্যথা আছে তা ঠিক হয়ে যাবে৷ কিন্তু না এই দিন আসবে, আর না মূহুর্ত৷’
কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি তার আগেই হাতে তালির আওয়াজে চারপাশ মুখরিত হয়ে গেল৷ একজন এগিয়ে এসে পার্থিবে এর পিঠে থাপ্পড় মেরে গর্বের সহিত বলল, ‘শাব্বাস ভাই! শাব্বাস! এই না হলে আমার ভাই!’
মুচকি হাসল পার্থিব৷ শ্রুতি বুঝতে পারল, এই বিয়েতে সবাই অনেক বেশি খুশি৷ তার কারণ কারোর মুখের হাসি যেন সরছেই না৷

সত্যি সত্যিই শ্রুতিকে কোলে নিয়ে হাঁটা ধরল পার্থিব৷ লিফট এর সামনে আসতেই পেছন থেকে হট্টগোল এর আওয়াজ পাওয়া গেল৷ সকলে স্বমস্বরে বলছে, ‘লিফট নো এলাও! নো এলাও! কোলে যখন নিয়েছই সিড়ি বেয়েই উপরে উঠতে হবে৷’

পার্থিব মুচকি হেসে শ্রুতিকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল৷ পিছনে আছে তার দলবল৷ দ্বিতীয় তলায় ওঠার পর শ্রুতি এর মাথায় ভূত চাপল৷ ভাবল এখন যদি উনার হাতে চিমটি কাটি তাহলে? আমার চিমটি খেয়ে নিশ্চয়ই আমাকে কোল থেকে নামাবে। মহাপুরুষ, সাধুপুরুষ সাজতে চান? বের করছি আপনার ভালোগিরি…

পার্থিব এর কাঁধে রাখা হাতটা নামিয়ে আনল শ্রুতি। পিছনে তাকিয়ে দেখল সবাই ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে৷ মানে সাবধানে কাজ কর‍তে হবে এইবার৷ এইবারো যদি সে আগেরবারের মতো কাঁচা কাজ করে ফেলে তাহলে ঝামেলা হবে৷ তাই খুব সন্তপর্ণে পার্থিব এর বাহুতে চিমটি কাটল শ্রুতি৷ পার্থিব এর মাঝে কোনো পরিবর্তন না দেখে অবাক হলো৷ ফের আরো দুই তিনটা চিমটি কাটল৷ সাধারণ চিমটি নয়৷ জ্বলে যাওয়া চিমটি৷ এবার যা পরিবর্তন হলো তা হলো পার্থিব এর মুখ আগের থেকেও হাসি হাসি হয়ে গেল৷
এরই মধ্যে নিজেদের ফ্ল্যাটে এসে পড়েছে পার্থিব-শ্রুতি৷ যেহেতু নিচেই ওদের বরণ করা হয়েছে তাই এখন সেসবের কোনো ঝামেলা নেই৷ পার্থিব ঢুকে শ্রুতিকে সোফায় বসিয়ে দিল৷ আর কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘আপনি এখনো অনেক ছোট শ্রতি৷ আর আপনার বুদ্ধিগুলাও ছোট ছোট৷ নিজেও বড় হোন আর বুদ্ধিগুলাকেও বড় করুন৷’

শ্রুতি স্তব্ধরূপে পার্থিব এর পানে চেয়ে রইল। এই মুহূর্তে তার কাছে সবচেয়ে অসহ্যকর প্রাণীর নাম হলো “পার্থিব”৷ পার্থিব শ্রুতির অপ্রসন্নতা আন্দাজ করে ওর মুখপানে চেয়ে মিষ্টি করে হাসল৷
.

ছোট একটা ফ্ল্যাট নিয়ে বিভার শ্বশুরবাড়ি৷ দেখে বিভা বলতে গেলে হালকা অবাকই হয়েছিল৷ কারণ এতো বড়লোক ঘরে তার বাবা বিয়ে দিয়েছেন। সে ভেবেছিল ডুপ্লেক্স বাড়ি থাকবেই। টাকা দেখেই তো বিয়ে দিয়েছে তার বাবা। কিন্তু সেসব নিয়ে বেশি মাথা ঘামায়নি বিভা৷ কারণ এসবের প্রতি তার কোনোই আগ্রহ নেই বলতে গেলে৷ আরেকটা জিনিস অবাক করেছে বিভাকে৷ বিভার শ্বশুরবাড়িতে আহামরি মানুষজন নেই! কেবলমাত্র বিভার শ্বাশুড়ি, শ্বশুড় আর দুইজন মহিলা৷ চাচীশ্বাশুড়ী হবে হয়তো৷
হটাৎ করেই ঘড়ির দিকে নজর গেল বিভার৷ এ বাবা! রাত ১২ টা ৭ বাজে৷ সাড়ে এগারোটায় তো হামিম এর ঔষধ আছে। ও কোথায়? ঔষধ খাবে না না-কি? আর শ্রুতি’ই বা কোথায়? না জানি শ্রুতি না খেয়েই ঘুমিয়ে পরলো কি-না৷ আর হামিম? নিশ্চয়ই ঔষধ খাওয়ার কথা ভুলে গেছে৷ এই ঔষধ খাওয়া নিয়ে বড্ড ঝামেলা করে ছেলেটা ৷ মুখটা কুঁচকে বিছানা থেকে নামলো বিভা। হামিমকে ডাকতে হবে৷ ওকে ডাকার জন্য বাহিরে যেতে উদ্যত হতেই মাথায় যেন আকাশ সমান কিছু একটা ভেঙে পড়লো৷ এই ন্যানো সেকেন্ডে সে কতোকিছু কল্পনা করে নিল অথচ বুঝতেই পারল না সে এখন তার শ্বশুরবাড়ি। বুকটা ভারী হয়ে গেল৷ ব্যথা কর‍তে লাগলো খুব করে৷ অসহ নীয় এক যন্ত্র ণায় ছেয়ে গেল চারপাশ। সে কী করে হামিমকে ডাকতে পারে? সে তো এখন অন্য বাড়িতে। সে কী করে শ্রুতিকে ডাকবে খাওয়া জন্য? তার ছোটবোন শ্রুতি তো তার শ্বশুড়বাড়িতে। শক্তি যেন নিমিষেই ফুরিয়ে গেল। পরে যেতে নিলে ওয়ারড্রব ধরে নিজেকে সামলে নিল বিভা। যাদের ঘিরেই এতোদিন বেঁচে ছিল, তাদের ছাড়া কীভাবে থাকবে সে?

নিচে বসে পড়লো। বুকের ভেতর থেকে কান্নাগুলো দুমড়ে-মুচড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে৷ আজ মায়ের কথা খুব করে মনে পড়ছে বিভার। আট বছর আগে যখন তার মাকে সি জার করানো জন্য অপারেশন থিয়েটারে ঢুকানো হবে তখন তার মা মাথায় হাত রেখে বলেছিল,

‘আমার বিভা তো লক্ষী। আমার লক্ষীমা৷ বিভা, মা আমার, বোনকে দেখে রাখিস। আর আল্লাহ না করুক যদি আমি আর না ফিরি তাহলে আমার পেটে যে আছে তোর আরেক বোন বা ভাই তাকেও দেখে রাখিস৷ বড় বোন তো মায়ের মতো৷ আমি না থাকলে তুই ওদের মা হবি৷ তোরা আমার লক্ষী মা৷ আমার দুই জান্নাত৷ আর হ্যাঁ কখনো মন খারাপ করে থাকবি না। মায়ের ভালোবাসা, দোয়া তোদের সাথে থাকবে৷ মায়ের দোয়া কখনো আল্লাহ বিফলে নেয়না। ভালো থাকিস মা আমার৷’

বলেই তাহিরা জড়িয়ে ধরেছিল বিভাকে৷ সারা মুখে চুমু এঁকে দিয়েছিল৷ কেন যেন সেদিন মা-কে ছাড়তে ইচ্ছে হয়নি বিভার৷ খুব করে জড়িয়ে ধরে থাকতে মনে চেয়েছে৷ এরপর তার মা তাকে ছেড়ে শ্রুতিকে জড়িয়ে ধরলো৷ দুইজনকে একসাথে জড়িয়ে ধরে থেকে ওদের ছেড়ে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকল৷ যাওয়ার আগে ওদের দিকে তাকিয়ে হাসল আর বলল,
‘এইটা কী কান্নার সময় ? বোকার মতো দুইজন কাঁদছিস কেন? আমি তো তোদের জন্য নতুন ভাই/বোন আনতে যাচ্ছি৷ কাঁদে না মা৷’
সেই যে গেল৷ আর ফিরে এলো না৷ ডায়াবেটিস আর রক্তে সমস্যা থাকায় চলে গেল চিরনিদ্রায়। এখন কেউ হাজার কাঁদলেও বলেনা ‘কাঁদে না মা৷ আমার কষ্ট হবে তোরা কাঁদলে৷’
বিভার গলা ব্যথা করতে লাগল৷ সে কখনো হাউমাউ করে কিংবা জোরে কাঁদেনা৷ কান্না গিলে নেয়৷ এতে কিছুটা গলা ব্যথা হয়, হলে হোক….

১ টা ১০ মিনিটে বিভার স্বামী দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল৷ বিভা শান্ত চোখে মাথা উঁচু করে তাকাল। বিভাকে অবাক করে দিয়ে তার স্বামী বাথরুমে ঢুকে গেল৷ বিভা বাথরুমের দরজার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইল৷
_____

চলবে ~