একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-১০+১১

0
160

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

১০.
সোফায় বসে আছে প্রভা-প্রত্যাশা। উদ্দেশ্য নেটফ্লিক্সে মুভি দেখা৷ সেই সাথে মুড়ি খাওয়া৷ সামনের সোফাতেই আছেন তানহা৷ সামনের দুটো মেলামাইন এর প্লেটে মাংস বেড়ে দিচ্ছেন৷ মেয়ে দুটো হয়েছে অকর্মার ঢেকি। একটা কাজ পর্যন্ত নিজে করে না৷ ক্লাস ১০ এ পড়ে৷ এখন করবে না তো করবে কখন? মাংস দিয়ে মুড়ি খাবে তো নিজে বেড়ে খা, নাহহ৷ তা করবে না৷ যদি বলে ‘নিজে বেড়ে খা’ উল্টো বলবে, ‘থাক এখন খাব না৷ পরে খাব৷’ সেই পরে টা আর আসে না৷ বাধ্য হয়ে সেই বেড়ে দিচ্ছেন৷
কলিংবেল বাজলো। পার্থিব ঢুকছে সদর দরজা দিয়ে৷ তানহার কী যেন মনে হলো হটাৎ৷ ছুটে গেলেন পার্থিবের কাছে৷
মাকে এইভাবে ছুটে আসতে দেখে মসৃণ হাসলো পার্থিব৷ বাসায় ঢুকে মাকে দেখলে তার ভালো লাগে৷ ভীষণ ভালো লাগে৷
‘এইভাবে ছুটে আসলে যে! কিছু বলবে মা?’

‘হ্যাঁ রে বাবা৷ বলবো তো৷ তার আগে আয় একটু বস৷’

‘না মা আগে বলো তুমি৷ যেভাবে আসলে হয়তো জরুরি কিছু৷’

‘আমি তাড়াতাড়ি এসেছি না রে? আচ্ছা বাবা শোন না, আমার না খুব চিন্তা হচ্ছে রে।’ নিজের কাজ সম্পর্কে নিজেই জ্ঞানহীন হয়ে পড়লেন তানহা৷ এইভাবে তার ছুটে আসা উচিত হয়নি৷ ছেলেটাকে বসিয়ে ধীরে সুস্থেও বলা যেত৷

‘বলো মা কী বলবে?’

‘বাবা। শ্রুতির সাথে একটু কথা বলিস তো বাবা৷ মেয়েটার মনটা বেজার হয়ে আছে৷ হয়তো বাড়ির কথা মনে পড়ছে৷ তুই একটু ওর সাথে মেশার চেষ্টা কর বুঝলি?
নিজের বাড়িঘর ছেড়ে অপরিচিত জায়গায় কতোই আর ভালো লাগবে বল? সকাল বেলা মুখটা এইটুকুন হয়ে ছিল৷ আমার বড্ড মায়া হলো, জানিস৷ তুই একটু দেখ না বাবা৷’
পার্থিবের মনটা ভালোবাসায় ছেয়ে গেল নিজের মায়ের এমন সরলতায়৷ তার মা কী একটু বেশি সরল? পার্থিব একটা কাজ করে বসলো৷ তানহার কপালে চুমু দিয়ে বলল ‘চিন্তা করোনা৷ দেখছি তোমার বউমার কী হলো…..’
পার্থিব মিষ্টি হেসে চলে গেল৷ পার্থিবের কাজে তানহা মোটেও অবাক হলেন না৷ এটা পার্থিবের স্বভাব৷ সে তার ভালোবাসা প্রকাশ করতে ভালোবাসে৷ এর আগেও এমন ঘটনা অহরহ ঘটেছে৷ এমনকি তার নিজের কাছেও তার ছেলের ভালোবাসাগুলো ভালো লাগে৷

প্রত্যাশা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল৷ সে পার্থিব-প্রভার চেয়ে আলাদা৷ একটু রাগী৷ রাগী বলতে ছোট ছোট কারণেই সে রেগে যায়৷ যেমন এখন৷ তার চোখে রাগের হালকা আভাস৷ তবুও তা মুখে প্রকাশ পাচ্ছে না৷ তবে মনে মনে সে ইতিমধ্যে শ’খানেক গালি শ্রুতিকে দিয়ে দিয়েছে। প্রত্যাশার একটা স্বভাব আছে। সে কল্পনা করে তার ভিতরে একটা ডায়েরি আছে৷ সে যা বলে তা সেই ডায়েরিতে লেখা হয়ে যায়৷ মনে মনে সে বলল, ‘আমার আম্মুকে যারা কষ্ট দেয় তাদের আমি কখনো ক্ষমা করিনা৷ তোমাকেও করবো না ভাবি।’ প্রত্যাশা কল্পনা করছে তার বলা কথাটা ধীরে ধীরে তার মনের ডায়েরীর পাতায় লেখা হয়ে যাচ্ছে৷

.
ফেসবুকিং করছে মাহাথির৷ আজকাল ভালো লাগে না কিছুই৷ সে তো একাই ভালো ছিল। কী দরকার ছিল আরেকটা মেয়ের জীবন নষ্ট করার? সে তার আম্মা আব্বা কে বলেওছিল বিয়ে করালেও সে সংসার করবে না৷ আম্মা আব্বা তার কথার কোনো গুরুত্বই দেয়নি৷ আব্বা বলেছিল, ‘যা হবে পরে দেখা যাবে৷’
হলো তো এখন৷ বিয়ে করালো৷ সংসার? সেটা কী করে করাবে? যা ইচ্ছে হোক, তার কী! সে সেটাই করবে যেটা সে চায়৷

‘মাহাথির!’
মাহাথির তাকাল। মেয়েটা কফি হাতে দাঁড়িয়ে আছে৷ মাহাথির লক্ষ্য করল, মেয়েটা অন্যদের তুলনায় খুব সুন্দর করে মাহাথির উচ্চারণ করে৷ তার আব্বা,আম্মা,বন্ধু-বান্ধবদের তুলনায় নামটায় খানিকটা মায়া মিশিয়ে উচ্চারণ করে৷ অন্য সবাই উচ্চারণ করে ‘মাহাতির’। অথচ সে! মাহাথির নামটিকে খানিকটা সময় নিয়ে বড্ড যত্ন করে উচ্চারণ করে ‘মাহ্ থিইইর’। মাঝের আ-কার টা হালকা শোনা যায়৷
বিভা কফি দিতে আসায় রাগ করলো না৷ কারণ সে নিজেই চেয়েছে৷ কফিতে চুমুক দিয়ে মাহাথির বলল, ‘আমাকে মাহাথির বলে নিজেকে আমার আপনজনদের তালিকায় ফেলার চেষ্টা করো না৷ লাভ হবেনা।’

বিভা হাসে লোকটার পাগলামি দেখে৷ নাম নিয়ে কী কাহিনীটাই না করছে বেচারা৷ আচ্ছা সে যতোবার নাম তার উচ্চারণ করবে ততোবারই কী মাহাথির তাকে নানান কথা শুনাবে? কিন্তু কেন? শুধুমাত্র কালো হওয়ার কারণে?
বিভা আয়নার সামনে গেল৷ আয়নাটা ছোট৷ শুধু তার মুখ দেখা যাচ্ছে৷ মাহাথির তার অন্য কোনো দোষ ধরলে সে তা জানপ্রাণ দিয়ে শুধরানোর চেষ্ট করতো। কিন্তু গায়ের রঙ কী করে বদলাবে? বিভা ঠিক করলো সে মাহাথিরকে অনুধাবন করাবে, কালো মানেই খারাপ মানুষ নয়৷ কালো মেয়েরাও পারফেক্ট বউ হতে পারে৷ অবশ্যই পারে৷
বিভা নিজের হাতের দিকে তাকাল৷ দাগ খুঁজতে চেষ্টা করল৷ পেল না৷ শ্যামলা হাতে দাগ পরে না৷ তবে হাতটা এখনো খানিকটা জ্বলছে। আজ সে তার হাত পাথর জাতীয় ছোট একটা টুকরো দিয়ে ইচ্ছেমতো ঘষেছে৷ যদি ফর্সা হয় সেই আশায়….সুন্দর হতে কে না চায়!

.
বিছানার একপাশে কাত হয়ে শুয়ে আছে শ্রুতি৷ হাত দুটো সামনে থাকায় তার নজর হাতের দিকে৷ হাতে তার সুন্দর দুটো চুড়ি৷ ছোট ছোট গোল গোল বৃত্ত দিয়ে বানানো পুরো চুড়িটা৷ বউ বউ চুড়ি৷ অথচ শ্রুতির মনে হচ্ছে চুড়ি দুটো ফর্সা কারোর হাতে থাকলে যতোটা মানাতো তার হাতে একদমই মানাচ্ছে না৷ তবে তার চুড়ি দুটোর কারণে তার নিজের হাত নিজের কাছেই বউ বউ লাগছে৷ আসলে চুড়ি দুটো তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে৷
শ্রুতি জানে চুড়িটা পার্থিবই দিয়েছে৷ কয়েকদিন আগেই সে ঘুম থেকে উঠে সকাল বেলা মুখ মোছার সময় চুড়ি দু’টো নিজের হাতে দেখেছে৷ পার্থিবকে কিছু বলেনি শ্রুতি৷ অযথাই তর্ক হবে৷ মানুষটার সাথে তর্কে পেরে ওঠা মুশকিল।

‘শ্রুতি,শরীর খারাপ লাগছে?’ বলার সাথে সাথে নিজের হাতটা এগিয়ে শ্রুতির কপালে ঠেকাল পার্থিব৷ গা হালকা গরম৷ তবে স্বাভাবিক তাপমাত্রা। তবুও জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কী গায়ে জ্বর?’

শ্রুতি উঠে বসল৷ নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, ‘আমার গা সবসময় এমনই থাকে৷ জ্বর না৷’

‘ও আচ্ছা বুঝতে পেরেছি৷ আপনার মাথার সাথে সাথে শরীরটাও সবসময় গরম হয়েই থাকে৷ হটে হটে হট স্কয়ার। না মানে গরম স্কয়ার৷’
শ্রুতির ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল৷ পার্থিব হেসে দিয়ে শ্রুতির সামনে বসল। সরল,নির্লিপ্ত কন্ঠে আদর মিশিয়ে বলল, ‘সকালবেলা মন খারাপ কেন ছিল আপনার? কোনো সমস্যা? সমস্যা থাকলে আমায় বলতে পারেন৷’
পার্থিবের কথা বুঝেও যেন বুঝল না শ্রুতি৷ মন খারাপ তো তার প্রায় সবসময়ই থাকে৷ শ্রুতি না বুঝে বলল, ‘মানে?’

‘মা বলল আপনার নাকি সকালবেলা মন খারাপ ছিল৷ আপনি নাকি মুখটা একদম ছোট্ট করে বসে ছিলেন৷ আপনার মুখ দেখেই মা বুঝে ফেলেছে আপনার মন খারাপ। তাইতো আমি বাসায় ফেরার সাথে সাথেই আমাকে রুমে পাঠিয়ে দিল আপনার মন খারাপের কারণ শোনার জন্যে৷ এবার বলুন তো কী কারণে আমার বউয়ের মন খারাপ ছিল?’

শ্রুতি চুপচাপ পার্থিবের দিক থেকে চোখ ফেরাল৷ পার্থিবের কথাটা ভুল৷ সে সকালবেলা মন খারাপ করে ছিল না৷ রেগে ছিল৷ আমিন সাহেবের সাথে কথা বলার কারণে সেই সময় তার রাগ ছিল আকাশচুম্বী। ঠিক সেই সময়েই তানহা তার পাশে বসে কিছু জিজ্ঞেস করছিল৷ সামনেই ছিল প্রত্যাশা৷ সে তানহাকে উত্তর তো দেয়’ইনি উলটো ধমকের স্বরে কিছু বলে উঠে এসেছিল৷ রুমে এসে নিজের কাজের জন্য নিজেই ভীষণ অনুতপ্ত ছিল শ্রুতি৷ কিন্তু এই বাড়ি থেকে চলে যেতে হলে এভাবেই সবাইকে নিজের প্রতি বিষিয়ে তুলতে হবে৷
কিন্তু মা! তার তো উলটো পার্থিবের কাছে নালিশ করা উচিত ছিল৷ উলটো সে আমার মন খারাপের কারণ জানতে চেয়েছে৷

‘আপনাকে কিছু প্রশ্ন করলে আপনি অন্য জগতে চলে যান কেন শ্রুতি? উত্তর কী অন্য জগতে আছে?’
শ্রুতি মাথানিচু করে বসে আছে৷ পার্থিব বলল, ‘বললেন না তো মন খারাপের কারণ?’

‘ভা..ভাই এর জন্য মন খারাপ ছিল আমার৷’ কন্ঠ কাঁপা শুনালো শ্রুতির৷ ভাইয়ের জন্য মন খারাপ নয়৷ তার এখন মন খারাপ তার এই মায়ের জন্য। এই মা হয়তো তাকে সত্যিই ভালোবাসে! এই যে তার মাথায় তেল দেওয়া, এটা তো তার এই মায়েরই কাজ৷ শুধু তাই নয়৷ যত্ন করে তেল দিয়ে বেনীও পাকিয়ে দিয়েছে৷ এইসব তো আর নাটক নয়। ভালোবাসা। কিন্তু শ্রুতি তো এই ভালোবাসার যোগ্য নয়৷ বড্ড অযোগ্য পাত্রী!
পার্থিব হেসে দিয়ে, ‘শ্রুতি, আপনি পারফেক্ট একজন মানুষ৷ পারফেক্ট একজন মেয়ে৷ পারফেক্ট একজন বোন৷ পারফেক্ট একজন বাড়ির বউ৷ এইবার বলুন তো, আপনি আমার জন্য পারফেক্ট বউ কবে হবেন?’

‘কোনোদিনও না৷’ মাথা নিচু করে বলে ফেলল শ্রুতি৷ কথাটা সে মনে মনে বলতে চেয়েছিল৷ কিন্তু মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল৷

‘হবেন, হবেন৷ আমার আদর্শ বউও হবেন৷ সেদিন অবশ্যই আসবে৷ আপনার মুখের আমার জন্য চিন্তা থাকবে৷ ভালোবাসা থাকবে৷ জানেন শ্রুতি, আমি স্বপ্ন দেখি, আপনি একদিন আমাকে খুব খুব খুব বেশি ভালোবাসবেন৷ ভালোবাসবেন না?’

পার্থিবের আকুতিভরা কন্ঠে শ্রুতির বুকটা ধ্বক করে উঠল৷ মানুষটা কেমন করে যেন কথা বলে। তার কথার মাঝে হারিয়ে যায় শ্রুতি৷ আচ্ছা এই পরিবার এর মানুষগুলো কী সত্যিই আলাদা? পার্থিব! সে কী আলাদা? নাকি কোনো একদিন পার্থিবও বদলে যাবে অন্যদের মতো৷ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল শ্রুতি৷ মানুষটার সামনে কেন যেন শ্রুতির নিজেকে মেলে ধরতে ইচ্ছে করে। শ্রুতি তো এমন নয়। সে তো ছিল আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতোই৷ ধীরে ধীরে কেমন করে যেন বদলে গেল সব৷ শ্রুতির কেন জানি পার্থিবের সামনে নিজেকে অসহায় লাগে৷ পার্থিবকে নিজের মনের সব কথা বলতে ইচ্ছে করে৷ কিন্তু শ্রুতি নিজের কঠোর খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না৷ আসলে বেরিয়ে আসে না৷ কারণ সে জানে পৃথিবীতে সবাই এক৷ স্বার্থপর,লোভী,অকৃতজ্ঞ! আচ্ছা পৃথিবীতে একটাও খারাপ মানুষ না থাকলে পৃথিবীটা কেমন হতো?

_________

চলবে~
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান
শব্দসংখ্যা – ১৩২০

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

১১.
পেরিয়ে গেছে ৭ দিন৷ কেমন যেন চোখের পলকে পেরিয়ে গেল৷ শ্রুতি বসে আছে। চোখের চাঞ্চল্যতা দেখেই বোঝা যাচ্ছে কারো অপেক্ষায় আছে সে৷ আজ সকালে সে বসে ছিল ছাদে। রোদের মধ্যে৷ তখনই পার্থিবের আগমন৷ এসেই বলা শুরু করল,
‘শ্রুতি, আপনার মনটা কী সবসময় খারাপই থাকে? একটা সময়ও আমি আপনাকে হাসতে দেখিনা৷ কিন্তু কেন? মাঝেমধ্যে তো একটু হাসতেও পারেন৷ তাই না?’

শ্রুতি তাকাল৷ কিছু বলল না৷ এমনিতেও পার্থিব শ্রুতির উত্তরের আশা করে না৷ পার্থিব শ্রুতির আরেকটা নাম দিয়ে দিল – ‘বোবা বউ’। ছোটবেলায় থাকতে রাতে তাকে প্রচুর বোবা ভূতে ধরতো৷ শরীরে কেমন চেপে বসতো! অসাড় অসাড় লাগতো শরীর। তখন বিভিন্ন সূরা, আয়তুল কুরসি পড়ে ভূত ছাড়াতে হতো৷ ভাবলেই কেমন গা শিউরে ওঠে! যদিও পার্থিব ভূতে ভয় পায় না তবে তার ‘বোবা ভূত’ ব্যাপারটা হজম হয় না ঠিক৷ আর এখন সেই বোবায়’ই তার বউকে ধরেছে৷ আচ্ছা আয়তুল কুরসি পড়ে ফু দিলে কী তার বউও ‘বোবা’ থেকে নিস্তার পাবে? কে জানে! যত্তোসব আজগুবি চিন্তাভাবনা!

হটাৎ করেই পার্থিব বলল, ‘শ্রুতি, আপনি তো আমার জন্য কখনো অপেক্ষা করেন না৷ আজকে করবেন? দেখবেন আজকে আমি আপনাকে চমকে দিব৷’

শ্রুতির কী হলো সে জানে না৷ পার্থিবকে দেখে মায়া হলো৷ ছেলেটা কেমন যেন! কই শ্রুতি তো ভালো করে কথাও বলে না৷ অথচ সে! কেমন করে একা একাই কথা বলে৷ শ্রুতির মন ভালো করতে চেষ্টা করে৷ মলিন হাসল শ্রুতি৷ বলল,
‘আমি আপনার জন্যে অপেক্ষা করব৷’

ছোট্ট একটা কথায় যে পার্থিব কী পরিমাণ খুশি হলো তা হয়তো কেউ জানবে না৷ পার্থিব আচমকা একটা কাজ করে বসল৷ শ্রুতি অবাক হয়ে পার্থিবের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷ পার্থিব তার ঠোঁটের হাসি বজায় রেখেই দরজার কাছে যাচ্ছে। পার্থিবের পিঠের দিকে বসে থাকা সত্ত্বেও শ্রুতি ঘাড় বাঁকা করে পার্থিবের হাসিমুখ দেখার চেষ্টা করছে৷ পার্থিব চলে গেছে৷ শ্রুতি নিজের হাতের দিকে তাকাল৷ পার্থিবের ঠোঁটের ছোঁয়া যেন হাতে এখনো লেগে আছে৷ শ্রুতি অনুভব করতে পারছে৷ মনে হচ্ছে এইতো হাতের এইখানে ঠোঁটের ছাপ৷

শ্রুতির ঘোর কাটল৷ অন্যদিন রেগে থাকে৷ অথচ আজকে সকাল থেকেই তার মনটা খারাপ৷ দুপুরবেলা দাদীকে কল দিল৷ হামিম কথা বলেনি তার সাথে। সেখানে তো মন খারাপ হলোই সাথে যখন সন্ধ্যা বেলা বিভাকে কল দিয়েও পেল না তখন আরোও মন খারাপ হলো৷

অন্যদিন আটটা, সাড়ে আটটায় চলে আসে আজকে নয়টা দশ বাজে৷ এখনো এলো না৷ শ্রুতি আজকে পার্থিবের জন্য শরবত বানিয়ে অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা যেহেতু করবেই ভালোভাবেই নাহয় করুক৷

কলিংবেল বাজল৷ শ্রুতি সুন্দরমতো উঠে রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে শরবত নিয়ে এসে নিজের রুমের টেবিলে রাখল। এতোক্ষণে কেউ না কেউ দরজা খুলেছেই৷ হালকা চেঁচামেচির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। শ্রুতি সেদিকে নিজের খেয়াল দিল না৷ এই বাড়িতে চিৎকার-চেঁচামেচি নিত্যদিনই হয়৷ সারাদিন হৈ-হুল্লোড় লেগে থাকে বৈকি।

‘শ্রুতি!’

শ্রুতি পার্থিবের গলা পেয়ে পিছনে ঘুরল৷ এতোক্ষণে সে নিজের রুমেই ছিল৷ পার্থিবকে দেখে সে মলিন হাসল৷ শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিল৷ পার্থিবের মাঝে হটাৎ করেই উৎফুল্লতা দেখা দিল৷ সে শরবতের গ্লাস শ্রুতির হাত থেকে নিয়ে রাখতে রাখতে বলল,
‘শ্রুতি, শরবত রাখুন। আমার সাথে আসুন৷ আপনি চমকে যাওয়া এখনো পাওনা আছেন৷’

মনঃক্ষুণ্ন হয়েও হলোনা শ্রুতির৷ শুধু ভাবল, শরবত টা খেয়ে যেতে পারতো৷ যাই হোক, এই সামান্য ব্যাপারে মন খারাপ করার কিছু নেই৷ শ্রুতি আমলে নিল না৷ পার্থিব শ্রুতির হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ রুম থেকে বের হওয়া মাত্রই পার্থিব শ্রুতির পিছনে গিয়ে নিজের দুই হাতের মাধ্যমে চোখ বেঁধে দিল। ধীরে ধীরে এগুচ্ছে শ্রুতি৷ সবার কথা কানে আসছে কিন্তু সে বুঝতে পারছে না৷ পার্থিব থেমে গেল শ্রুতিকে নিয়ে৷ অগত্যা শ্রুতিকেও থামতে হলো৷ মোলায়েম কন্ঠে পার্থিব বলল,
‘দেখুন তো এটা কে?’

শ্রুতি চোখ মেলল৷ চোখ মেলা মাত্রই যেন চমকে উঠে দু পা পিছিয়ে গেল৷
তার সামনের সোফাতেই হামিম বসে আছে৷ শ্রুতি একবার পার্থিব, একবার হামিমের দিকে তাকাচ্ছে৷ ঠিক দেখছে তো? হ্যাঁ ঠিকই তো৷ তার সামনেই হুইল চেয়ারে হামিম বসা। না, বসা নয়। মাথাটা হেলে পরছে৷ এরমানে ঘুমানো বা অজ্ঞান৷ অজ্ঞান কেন হবে? শ্রুতি তাকিতুকি করছে চারিদিকে৷ কী হচ্ছে মাথায় ঢুকছে না৷ মাথাটা কেমন হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেল৷

‘ও এখানে কী করছে?’

‘কী আবার করবে? বোনের বাড়িতে এসেছে৷’
শ্রুতি ভ্রু কুঁচকে তাকাল। সামনে তাকিয়ে দেখল তার শ্বশুর পরিবারের সবাই মোটামুটি উপস্থিত আছে৷ তাদের কোনো প্রশ্ন না দেখে শ্রুতির কপালের ভাঁজ দৃঢ় হলো৷ বুঝল হয়তো তারা আগে থেকেই জানতো পার্থিব এমন কিছু করবে৷ কিন্তু এসবের মানে কী?

চাচি শ্বাশুড়ি শ্রুতিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘কিছু মনে করোনা নতুন বউ৷ কিন্তু তোমাদের বিয়ে পাকাপাকির সময় তো তোমার বাবা বলেছিলেন তোমরা দুই বোন৷ তাহলে…..’

শ্রুতি চাচি শ্বাশুড়ির কথা অর্ধেক বুঝেই অস্বস্তিতে পড়ে গেল৷ মাথা নিচু করে মেঝেতে তাকিতুকি করতে লাগল৷
পার্থিব বলল, ‘চাচিআম্মু, তুমি ভুল বুঝছো৷ আমার শ্বশুরবাবা কিন্তু বলেছিল যে তার ছেলে আছে কিন্তু অসুস্থ ছিল বলে সামনে আনে নি৷ ভুলে গেছ?’

রুমা বেগম ভ্রু কুঁচকালেন৷ পার্থিবের কথা অনুযায়ী মনে করতে চেষ্টা করল, পারল না৷ তবে কী সে কানে কম শোনা শুরু করেছে? কী ভয়াবহ ব্যাপার!

‘শ্রুতি, ভাইকে ঘরে নিয়ে যাও৷ ও তোমাদের ফ্ল্যাটেই থাকুক৷ কেমন?’ তানহা জিগ্যেস করলেন৷

শ্রুতি হাসল৷ সব ছেলেরা মাত্রই বাড়ি ফিরল৷ তবে আসাদুজ্জামান এখনো ফেরেনি৷ সবাই ধীরে ধীরে নিজেদের ফ্ল্যাটের দিকে চলে গেল৷ পরে এসে দেখা করা যাবে৷ যাওয়ার আগে তানহা বলে গেলেন নিচে চলে যেতে, নাস্তা বানিয়েছেন৷ সবাই একসাথে যেন খায়৷
.

‘এইসবের মানে কী পার্থিব? আপনি এটা কী করেছেন আপনি জানেন? আমার ভাই এখানে কেন?’

পার্থিব তাকিয়ে আছে শ্রুতির দিকে৷ কিছুক্ষণ আগেই হামিমকে পাশের রুমে শুইয়ে দিয়ে এসেছে৷ এরপর নিজে অফিসের কাপড় পালটে ফ্রেশ হয়ে শ্রুতির সামনে এসে বসেছে। সে জানে শ্রুতি যে তান্ডব নাচ শুরু করবে, তাই আগে থেকেই সবকিছুর পরিকল্পনা করা ছিল৷

‘আপনাকে কিছু জিগ্যেস করছি আমি, পার্থিব?’

‘আপনার মুখে আমার নামটা ভীষণ সুন্দর শোনায়৷ আপনি অনেক ক্ষোভ নিয়ে আমাকে ডাকেন৷ শুনতে ভালো লাগে৷’

শ্রুতি তাকিয়ে রইল৷ রাগে, উত্তেজনায় তার হাত,পা কাঁপছে৷ যখন থেকে সে বুঝেছে যে যা ঘটছে সব বাস্তব, তখন থেকেই তার মাথা খারাপ৷ শ্রুতি শীতল স্বরে বলল,
‘আমার ভাই এখানে কেন?’

‘বোনের বাসায় আসতে পারে না?’

‘আমাকে জানান নি কেন?’

‘সারপ্রাইজ ছিল বলেছিলাম না? গত এক সপ্তাহ ধরে আপনাকে মুড অফ দেখতে দেখতে আমি বিরক্ত৷ আর কতো?’

আচমকা চিৎকার করে উঠল শ্রুতি, ‘আমি মরে যাইনা কেন, আপনার কী?’

পার্থিব দরজার দিকে তাকাল৷ সে আসল দরজা বন্ধ তো করেছেই, বেড রুমের দরজাও বন্ধ করে বসেছে৷ ফ্ল্যাটের বাইরে থেকে কী চিৎকার শোনা যাচ্ছে? পার্থিব উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘শান্তি, শান্তি, শান্তি৷ আসুন, বসে কথা বলি৷’
হাত ধরে খাটে বসাল৷

‘বলুন, কী জানতে চান?’

‘হামিমকে ওই বাসা থেকে আসতে দিল? আর আপনার পরিবার কোনো প্রশ্ন করল না কেন?’

‘কী আশ্চর্য! গাধার মতো কথা বলছেন শ্রুতি৷ বোনের বাড়িতে ভাই আসতে পারে না? আর আপনার বাবা আমার কথা ফেলেন না আমি যা বুঝেছি।’

‘আর আপনার পরিবার?’

‘আপনার আপনার কী? এইটা আপনারও পরিবার হয়েছে গত ২ সপ্তাহ আগে৷ আর তাদের সব বলেই রেখেছিলাম৷ তারা সবাই ভীষণ খুশি৷’

‘হামিমকে কতোদিনের জন্য আনলেন? ফিরবে কবে ও?’

শ্রুতির কথায় পার্থিব বিরক্ত হলো৷

‘আপনি এমন ভাবে কথা বলছেন যেন হামিম আমার কেউ না৷ ছোট ভাইয়ের মতো আমার ও৷ আমার বড় বোনের ভীষণ শখ ছিল৷ তাই বিভা আপাকে নিজের বড় বোন মনে করি৷ আমার কাছে সে অতি সম্মানের৷ ঠিক একইভাবে হামিম আমার কাছে অতি স্নেহের৷ আর আমার স্নেহ সম্পর্কে আপনি ধারণাও করতে পারছেন না৷’

‘হুম৷ সত্যিই ধারণা করতে পারছি না৷ তবে আপনি যে দয়া করছেন তা বুঝতে পারছি৷’

পার্থিব উঠে দাঁড়াল,
‘আপনি বড্ড বাজে কথা বলেন৷ বাজে কথা থেকে দূরে থাকা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো৷ আর যদি দূরে না থাকেন তাহলে শাসন করা শুরু করতে হবে৷নিচে আসুন, আম্মা যেতে বলেছে।’

শ্রুতি যেন পার্থিবের কথা শুনতেই পেল না৷ কন্ঠে ক্ষোভ মিশিয়ে বলল,
‘আপনি আমাকে শাসন করবেন?’

‘যদি ভালোবাসতে পারি তবে শাসনও করতে পারব৷ দোষ কোথায়?’
_______
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ১০১৫
#শারমিন_ইরান
#একগুচ্ছ_শুকতারা