একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-১২+১৩

0
162

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

১২.
গৃহিণী শব্দটা নিয়ে মানুষের কতো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যতা। অথচ এই ঘরের গৃহিণী না থাকলেই যেন ঘরটা মৃত মনে হয়। যারা গৃহিণীদের সম্মান দেয়না, তারা মূলত জানেই না গৃহিণী অর্থ কী। গৃহিণী শব্দের পিছনে খুব সূক্ষ্ণভাবে লুকিয়ে আছে এর সত্য। গৃহিণী শব্দের অর্থ — গৃহের রাণী। হ্যাঁ, গৃহের রাণী।
এই যেমন “মীর আলয়” এর রাণী “তানহা বেগম” এবং “রুমা বেগম”। বাড়ির দুই বউ। দুই অতি সাধারণ নারী। অথচ তাদের সাধারণত্বের মাঝেই অসাধারণত্ব যেন ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে আসে।
পার্থিব নিজের মা, চাচিকে দেখছে আর মনে মনে ভাবছে কথাগুলো। ভাবতে ভাবতেই বাজার নিয়ে চাচিআম্মুর হাতে দিল। বলল, ‘চাচিআম্মু, সব চেক করে নাও। দেখো, ঠিক আছে কী-না। নয়তো আবার যেতে হবে।’

পার্থিবের চাচি রুমা বাজার হাতে নিল। মুখে হাসি এনে বলল, ‘দেখতে হবেনা। তুই তো আর নিয়াজ মীর কিংবা হিমেল মীর না যে বলব ১ টা আনবি আরেকটা। তুই আমার ওয়াহাব মীর। আমার ওয়াহাব। আমি জানি আমি যা যা বলেছি সবই নিয়ে আসছিস।’
বলেই হাসল রুমা। পার্থিব মুচকি হেসে পেছনে তাকাতেই দেখল হিমেল মুখ কাচুমাচু করে দুইহাত দুইদিকে নিয়ে নিল। যার অর্থ — আমি আবার কী করলাম?
পার্থিব এইবার শব্দ করে হেসে দিল। তার মা যেমন সহজ, সরল, শান্ত। তার চাচি ঠিক তার উলটো। চিৎকার, চেঁচামেচি করা তার প্রিয় কাজ। সবচেয়ে প্রিয় কাজ বোধয় তার চাচ্চু নিয়াজ মীর এবং তার ছেলে হিমেল মীরকে নিয়ে বদনাম করা।

পার্থিব সোফার দিকে তাকিয়ে দেখল মুখটা কাচুমাচু করে শ্রুতি বসে আছে। নিঃশ্বাস ফেলল পার্থিব। আজকে বাসায় ছোটখাটো আরেক অনুষ্ঠান বলা যায়। কারণ আজকে বিভা-মাহাথির কে স্পেশালভাবে দাওয়াত করা হয়েছে। সাথে শ্রুতির বাড়ির সবাইও আমন্ত্রিত। বিভা আসবে জেনেও শ্রুতির মন খারাপ? নাকি এই মেয়ের মুখই এমন পার্থিব ভেবে পায়না।

আসাদ আজ বাড়িতেই আছেন। মেহমান আসবে বলে রয়ে গেছেন। বসে বসে চা খাচ্ছেন আর সামনের সোফায় বসা তার দুই পুত্রবধূদের দিকে তাকিয়ে আছেন।
তার সামনেই শ্রুতি বসে আছে আর তার পাশেই হিয়া বকবক করছে। আসাদের মনে একটু সংশয় কাজ করছে। এই ‘মীর আলয়’ তার বাবার অনেক শখের নিবাস। এই বাড়ির প্রতিটা ইট, কণা প্রতিমূহুর্তেই ভালোবাসা, অভিমান, শাসনের সাক্ষী দেয়।
তার বাবার শখ ছিল — মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার পরিবার একত্রে রাখা, ভাগ না হওয়া। তার বাবা মারা গেছেন ১২/১৩ বছর হয়ে আসে। এখনো পরিবারে ভাঙন ধরেনি। এক আছে। আসাদ নিজেও তার পরিবারে প্রতিহিংসার আঁচ লাগতে দেননি। ঝগড়া, রাগারাগি সবই হয়, আবার মিটেও যায়। পরিবারের বউগুলোও হয়েছে তেমন। প্রথমে তার বউ তানহা, তার ভাইয়ের বউ রুমা এরপর এলো হিয়া আর এখন সর্বশেষে শ্রুতি। সবাই তো পরিবারের অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু শ্রুতি? সে কী পেরেছে?
শ্রুতি মেয়েটা এমন গম্ভীর, শান্ত কেন? নিজেকে কেমন গুটিয়ে রাখে! তার পুত্রবধূর কী এই পরিবারে অসুবিধা হচ্ছে? মেয়েটা কী পরিবারের সাথে মানিয়ে নিতে পারছেনা?
পার্থিবের সাথে আলাদা করে কথা বলতে হবে। ভেবেই চায়ে আরেক চুমুক বসালেন আসাদ।

.
এতো এতো মানুষের সামনে বসে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছে মাহাথির। তার মানুষ পছন্দ না, তাই সবসময় লোকসমাগম এড়িয়ে চলে। অথচ বিয়ের পর থেকেই তাকে এমন সমাগমের মধ্যে উপস্থিত করা হচ্ছে। বলা যায় উপস্থিত হতে বাধ্য করা হচ্ছে। এদের আবার দাওয়াত দিতে হবে কেন? আজব! দিয়েছে ভালো কথা। তাকে ফোন দিত। একদম সাফ সাফ না করে দিত। ফোন দিয়েছে তার আম্মা কে। এখন তার আম্মা গ্রাম থেকেই তাকে কঠিনভাবে আদেশ দিয়ে দিল এখানে আসার জন্য। তাই পরে যখন তাকে ফোনে আমন্ত্রণ করা হলো তখন সে নিরুপায় হয়ে আসতে বাধ্য হলো। মাহাথির তাকিয়ে দেখল বিভা, শ্রুতি, হামিম একসাথে বসে আছে। আরোও বিরক্তবোধ করল। মাহাথির এই মেয়েটাকে সহ্যই করতে পারেনা। কিন্তু কেন? বিরক্ত হয়ে মাহাথির নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।

পার্থিব সবটাই লক্ষ্য করল মাহাথিরের বিরক্তি। বিরক্ত কী এখানে আসার জন্য নাকি অন্য কারণে তা ধরতে পারল না। পার্থিব ঘড়ির দিকে তাকাল।
আজ শুক্রবারে জুম্মার পরপরই সবাই চলে এসেছিল। এরপর খাওয়া দাওয়া হলো। এখন সবাই বসে কথাবার্তা বলছে। এরইমাঝে তানহা, রুমা একসাথে এগিয়ে এলো নাস্তার প্লেট নিয়ে। বিশেষভাবে মাহাথিরকে নাস্তা কর‍তে বলল।
মাহাথির ইতস্ততভাব পাশে রেখে বলল, ‘আন্টি, আপনারাও বসুন। একসাথে নাস্তা করি। আংকেল নিন।’ বলেই আসাদ এরপর নিয়াজের দিকে প্লেট বাড়িয়ে দিল মাহাথির।
রুমা বসলেন। হাত ধরে তানহাকেও বসালেন। এরপর মাহাথিরের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘বাবা, ফলগুলো কোন দোকান থেকে এনেছো? আপেলগুলো এতো মিষ্টি! আমিতো কেটেছি আর খেয়েছি। অনেক রস আছে ফলে। জানো তো, আমার ছেলে হিমেল, সে একদমই ফল কিনতে পারেনা। একবার কী হলো শুনো। তরমুজ নিয়ে এলো ইয়া বড় দেখে একটা। আমিতো খুশিমনে কাটতে বসলাম। কেটে দেখি সাদা ফকফকা।’
মাহাথির কথা শুনে পাশের সোফায় বসে থাকা পুরুষের দিকে তাকাল।
মায়ের কথা আর মাহাথিরের দৃষ্টিতে হিমেল কী বলবে ভেবে পেল না। ওদিকে প্রভা-প্রত্যাশা হাসা শুরু করে দিয়েছে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হিমেল বলল, ‘এক কাহিনী আর কতোজনকে শুনাবে বলো তো? এরপর তো তোমাকে একদম লাল টকটকা তরমুজ খাওয়ালাম। তাও সেই বদনামই করছো।’

রুমা ধমক দিলেন, ‘তুমি চুপ থাকো। বাবা মাহাব, সত্যিই তোমার কেনার হাত বেশ ভালো।’
পাশ থেকে তানহা বললেন, ‘হ্যাঁ মিষ্টিগুলোও খুব সুন্দর। দেখতে, খেতে দুইভাবেই দারুণ।’

এমন প্রশংসায় মাহাথির অবাক হলো বৈকি। তার অবাক হওয়ার কারণ সে ভেবেছিল তাকে লজ্জিত করা হবে তার আনা ফল মিষ্টি নিয়ে।
মাহাথির জানত না এই পরিবারে এত মানুষ, সাথে এতো বেশি সম্ভ্রান্ত। মানুষের তুলনায় নিতান্তই অনেক স্বল্প ফল,মিষ্ট এনেছে সে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী। বাসায় ঢুকে মানুষজন দেখে ভেবেছিল আবার বাইরে যাবে কিনা আরোও কেনার জন্য। কিন্তু শেষমেশ যাওয়া হয়নি, মনে মনে ভয় লাগছিল যে — কেউ হয়তো কথা শুনাবেই তাকে, আজ তাকে অপমানিত হয়ে ফিরতে হবে। তবে এমন না হওয়াতে কিছুটা অবাক হলো। সাথে প্রশংসার কারণে ভালোলাগাও কাজ করল। তবে তা একদম সীমিত পরিমাণে।

.
খুশির পরে দু:খের মূহুর্ত এসেই যায়। হয় কম, নাহয় বেশি।
সন্ধ্যা ৭ টা ৪৫ মিনিট। আমিন শিকদার তার পরিবার নিয়ে আগেই বেরিয়ে পড়েছিলেন কিছু কাজ থাকায়। এখন পালা বিভা-মাহাথিরের। যদিও ওরা আগেই বের হতো কিন্তু সবার জোরাজোরিতে পারেনি। অবশ্য সবাই এখনো বলছে আজকের রাতটা থেকে যেতে। কিন্তু মাহাথির বুঝিয়ে বলেছে যে থাকতে পারবে না, তার সাধারণ একটা চাকরি, এখানে থাকলে অফিসে যেতে পারবেনা, এতে করে ঝামেলা হবে পরে। এরপর আর কেউ জোরাজোরি করেনি।
বিভা শ্রুতিকে নিয়ে বারান্দায় এলো। বিভা শান্ত কন্ঠে বলল, ‘শ্রুতি, আসি?’
বলেই মিষ্টি হাসল। শ্রুতি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তার আপা এতো আদুরে কেন? তার আপার মুখে এতো মায়া কেন? পৃথিবীর সব মায়া কী তার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটার মুখেই আল্লাহ দিয়ে দিয়েছে?
শ্রুতি নিরব কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘তুই ভালো আছিস তো আপা? ওই লোকটা ভালো? তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করে? জানিস, উনাকে আম্মু নাকি অনেক পছন্দ করতেন। উনার আম্মু আর আমাদের আম্মু ফ্রেন্ড ছিল। দাদিআম্মু বলেছে আমাকে।’’

‘হ্যাঁ উনি ভীষণ ভালো। তুই নিশ্চিন্তে থাক। নিজের আর হামিমের খেয়াল রাখিস। হামিম আপাতত কিছুদিন তোর কাছে থাকুক, এরপর ওকে আমার বাসায় নিয়ে রাখব। মি.শিকদারের বাড়িতে আর থাকতে দিব না আমার ভাইকে।’

‘আচ্ছা আপা। তুই যেটা ভালো মনে করিস। আর আমি এমনিতেও চাইনা ভাই এখানে থাকুক।’

‘কেন? কেউ কিছু বলেছে?’’

‘না। সবাই তো ভালো মানুষের অভিনয় করে। আর পার্থিব, উনি তো আরেক অভিনেতা। আমার মনে হয় উনি আমাকে দয়া দেখাচ্ছে। কিন্তু আমার কারোর দয়া চাইনা।’

‘শ্রুতি, তারমানে তুই সত্যি সত্যি বিয়েটাকে মানিস নি?’

‘না মানিনি। ডিভোর্স দিব। এই পরিবার ছেড়ে চলে যাব। কোনো স্বামী লাগবেনা আমার।’

‘এসব কী কথা! সবাই এক না বোন, বুঝার চেষ্টা কর।’ প্রথমে রাগীস্বরে বললেও পরে শান্ত হয়ে বুঝানোর চেষ্টা করল বিভা।

‘সবাই এক-ই আপা, তুমি বোঝার চেষ্টা করো। আর নিজের সরলতা কমাও। তুমি অতিরিক্ত শান্ত যা আমার মোটেও পছন্দ না। তুমি ভালো বলেই সবাইকে ভালো ভাবো তুমি। তেমনি এদেরও ভাবছো। আমি এখন নতুন তাই হয়তো ভালোমানুষি করছে সবাই, কিছুদিন যাক, ঠিকই সবার আসল রুপ বেরিয়ে আসবে।’ শ্রুতি রেগে গেলে উত্তেজিত হয়ে বিভাকে তুমি করে ডাকে। বিভা হাপ নিঃশ্বাস ছাড়ল।

বিভা শ্রুতির কপালে আবারো চুমু দিল। ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, ‘শ্রুতি, এই পৃথিবীটা ভয়ংকর অদ্ভুত। এই পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা নেই। সব আছে। এই পৃথিবীর বুকে যদি একদম নিষ্পাপ বাবা থাকে তবে এই পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বাবাও আছে। এই পৃথিবীর বুকে যদি কোন পবিত্র স্বামী থেকে থাকে, এই পৃথিবীর বুকে তবে সবচেয়ে নোংরা স্বামীও আছে। এই পৃথিবীর কাজই মানুষকে অবাক করে দেওয়া। কেউ কেউ সবচেয়ে ভালো মানুষ দেখে অবাক হয়, কেউবা খারাপ। ভালো-খারাপ মিলিয়েই পৃথিবী। ভালো-খারাপ মিলিয়ে একটা সামঞ্জস্যতা নিয়েই পৃথিবী চলে। যদি শুধু খারাপই থাকত, তবে তো পৃথিবী সেই কবেই ধ্বংস হয়ে যেত। এতোক্ষণ মিশে যা বুঝলাম এনারা ভীষণ ভালোমানুষ। তুই এনাদের কষ্ট দিস না বোন। সবার সাথে মিলেমিশে সুন্দরভাবে জীবন টা কাটা। আমাদের শৈশব, কৈশোর নষ্ট ছিল, এরমানে এই না আমাদের পুরো জীবন নষ্ট হবে। জীবনকে সুযোগ দিতে হয়। আমি দিয়েছি, তুইও দিবি। দিতেই হবে।’
শ্রুতি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। বিভা শ্রুতির হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলো। শেষবারের মতো হামিমের সাথে দেখা করল। এরপর বিভা-মাহাথির বিদায় নিয়ে চলে গেল।
শ্রুতি তাকিয়ে দেখল পার্থিব হামিমকে মাল্টা খাওয়ানো চেষ্টা করছে কিন্তু হামিম মুখে দিতে নারাজ। শ্রুতি ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গেল।

.
বারান্দায় বসে জীবনের হিসাব কষছে মাহাথির। জীবন কতো অদ্ভুত!
এইতো কিছুদিন আগে সে এই বাড়িতে একা থাকত। অফিস থেকে ফিরে রান্না করে খেত, কিংবা কখনো বাহিরে খেয়ে আসত, কখনোবা না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়তো। তার দেখাশোনার মতো কেউ ছিলনা। তার আম্মা প্রতিনিয়ত ফোন তো করতো, তবুও কাছে থেকে দেখাশোনা আর ফোনে খোঁজখবর নেওয়ার মধ্যে বিস্তর তফাৎ। আর এখন? সারা ঘর জুড়ে ‘বিভা’ নামক কুৎসিত মেয়েটা ঘোরাঘুরি করে। কতো দ্রুত জীবন বদলে যায়, ভেবেই অবাক লাগে!
মাহাথির ফোন বের করল। ফোনে আম্মা-আব্বার ছবির দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইল। এই দুজন মানুষকে সে অসম্ভব ভালোবাসে। অসম্ভব! মাঝেমধ্যে আম্মার ওপর রাগ হয় যে বিয়েটা কেন করাল? আবার মনে হয় করিয়েছে তো করিয়েছে। তার আম্মা খুশি, আম্মার খুশিতে সেও খুশি। ভেবেই ক্রুর হাসল। যার অর্থ – মাঝখানে বিভা নামক মেয়ের জীবন কী হলো তাতে তার কিচ্ছু যায় আসেনা।

_______
চলবে~

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

১৩.
রাত ১২ টা ২০ মিনিট।
যথেষ্ট রাত। তবুও বিভার চোখে ঘুম নেই। অচেনা, অজানা এক শূন্যতা গ্রাস করে নিয়েছে নিজের মনকে। পাশে তাকিয়ে দেখল মাহাথির কপালে বাম হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। মাহাথিরের নেওয়া গভীর নিঃশ্বাস’ই বুঝিয়ে দিচ্ছে কতো গভীর তার ঘুম।
বিভা উঠে বসল। কমলা রঙের ড্রিম লাইট জ্বালানো। ড্রিম লাইট অফ করে রুমের লাইট জ্বালিয়ে নিল। হঠাৎ আলো জ্বলায় চোখ আপনাআপনিই কুঁচকে গেল বিভার। ধীরে পায়ে হেটে খাটের নিচে থেকে তার আনা ব্যাগ বের করে নিল। জামাকাপড় যদিও আলমারিতে রেখেছে কিছু, তবুও ব্যাগে কিছু জামাকাপড় আছে।
ব্যাগ থেকে কাঙ্খিত বস্তুটি বের করে ব্যাগটি আগের জায়গায় রেখে দিল।

ডায়েরির ওপর লেখা ‘তাহিরার খুশি’। ভীষণ পুরোনো ডায়েরি। কোণায় সাল লিখা ১৯…..। সালটা বুঝা যাচ্ছেনা। পুরোনো হওয়ায় তাহিরা নামটা তাহিবা হয়ে গেছে। ‘র’ এর নিচের ফোঁটার অস্তিত্ব বিলীন।

বিভা ডায়েরিটা প্রথম পাতা খুলল। ভীষণ পুরোনো ১ টা ছবি। মায়ের হাসিমুখ। বুকের মধ্যে হঠাৎ চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো। এই মানুষটা পৃথিবীতে নেই। আর আসবেনা। এইভাবে হাসবে না। মাথায় হাত রাখবে না। কেমন না? এমন আজব কেন এই দুনিয়া? মহান আল্লাহ এতো কঠিন নিয়ম না বানালেও পারত। পারত না?

মায়ের স্কুল জীবন থেকে শুরু করে সব লেখা। কিছু পাতা উল্টানোর পরপরই মায়ের ইন্টারে পড়া জীবনে চলে গেল। যেখানে আমিন শিকদারের সাথে প্রথম পরিচিতি থেকে শুরু করে কতো অনুভূতি লেখা। হঠাৎ করেই মনটা বিষিয়ে উঠল বিভার। মনে পড়ে গেল কিছু বিষাক্ত স্মৃতি।
হামিম হওয়ার সময় মা মারা যান। হামিমের ৮ বছর। ৮ বছর আগের কিছু স্মৃতি ভেসে উঠল বিভার মানসপটে। ঠাস করে বন্ধ করে দিল ডায়েরিটা। এরপর ডায়েরিটা রেখে দিল টেবিলে কিছু বই খাতার নিচে।
লাইট বন্ধ করে বিছানায় বসল বিভা। একবার মাহাথিরের দিকে তাকাল। এখন কপালে হাত নেই। সুন্দরভাবে মুখটা দেখা যাচ্ছে। শ্যামবর্ণের মানুষটার মুখ দেখে বিভা আওড়াল, ‘পৃথিবীতে ভালোবাসা না থাকলেও পার‍ত।’

.
শ্রুতি বসে আছে হামিমের রুমে।
এই বাড়ির হালচাল একটু অদ্ভুত, কিছুটা আজব।
১১ তলার বিল্ডিং। ১ম তলায় নিজস্ব গাড়ি রাখার বিশাল বড় জায়গা, ২য় তলায় ড্রইং, ডাইনিং, রান্নাঘর। যেখানে সবাই সকালবেলা, বিকালবেলা, রাত্রিবেলা মিলিত হয় এবং একসাথে খাবার গ্রহণ করে। ৩য় তলায় বাবা-মা, প্রভা-প্রত্যাশা থাকে। ৪র্থ তলায় চাচ্চু-চাচিআম্মু, হিমেল-হিয়া থাকে। সবশেষে ৫ম তলায় পার্থিব-শ্রুতির ঘর, যেখানে বর্তমানে তাদের ফ্ল্যাটে হামিমও থাকে। যদি প্রভা-প্রত্যাশা না থাকত তবে হয়তো বাবা-মার সাথে তারা ৩য় তলায় থাকতো যেমনটা হিমেল ভাইয়া, হিয়া ভাবি থাকে। আচ্ছা এমন করার কারণ কী? এমন আজবভাবে কোনো পরিবার থাকে নাকি?
প্রতি তলাতে ১ টা করে ফ্ল্যাট যেখান সব আছে রান্নাঘর থেকে শুরু করে ড্রইং, ডাইনিং, ৩ টা বড় বড় বেড সাথে এক্সট্রা রুম, যেটাকে যে যেভাবে সাজাতে পারে। শৌখিন আসবাবে ভরপুর ঘর। আসল দরজা দুটো করে। যেকোনো দরজা দিয়ে ঢুকেই পুরো ফ্ল্যাট ঘোরা যায়।
সবচেয়ে আজব বিষয় ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম তলা ফাঁকা। সেগুলো নাকি গেস্টরুম। ১১ তলায় ছাদ। এমনটাই বিকাল বেলা বলছিল প্রভা।
প্রভা। প্রভা মেয়েটার সাথে পার্থিবের অনেক মিল। দুজনেই প্রাণখোলা ভাবে কথা বলে। শ্রুতি একবার ভাবল ধমক দিয়ে উঠিয়ে দিবে কিন্তু দিল না। মেয়েটা কী সুন্দর আগ্রহ নিয়ে কথা বলছিল, সেখানে ধমক দিতে ইচ্ছে হলোনা।

শ্রুতি উঠে দাঁড়াল। হামিমের রুমে লাইট জ্বালানোই থাকে। অন্ধকার ভয় পায়। দরজা খোলা রেখে যাওয়ার সময় চোখ পড়ল খাতায় যেখানে সুন্দর ১ টি ছবি আঁকা।
সোফার মধ্যে দুজন নারী বসে হাসছে। একজনের গায়ে কালো শাড়ি, আরেকজনের গায়ে সবুজ কামিজ। শ্রুতি ফট করে নিজের দিকে তাকাল। সবুজ ড্রেস। আর কালো শাড়ি পড়ে দাওয়াত খেতে এসেছিল বিভা। সন্ধ্যার দিকে ওরা দুজন এভাবে বসেই কথা বলছিল। আর সেটা হামিম কী সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছে! শ্রুতি ভীষণ খুশি হলো।
হামিমের আঁকার হাত ভীষণ সুন্দর। শ্রুতি কল্পনা করল তার ভাই একদিন অনেক বড় আর্টিস্ট হবে, সবাই তার ভাইয়ের ড্রইং দেখবে।
শ্রুতি খুশিমনে খাতাটা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

.
শ্রুতি রুমে আসতেই দেখল পার্থিব নরম তোষক জাতীয় উঁচু বস্তু থেকে এক লাফে উঠল। হেসে দিয়ে বলল, ‘অবশেষে এসেছেন?’
শ্রুতির মনে হলো ছেলেটার হাসি ভীষণ সুন্দর। পরপরই নিজেকে ধাতস্থ করে নিল। কিছু না বলে চলে গেল বারান্দায়।
পার্থিব বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নিজমনেই বলল, ‘চল পার্থিব, নিজে নিজেই বকবক শুরু কর। বার বার ভুলে যাস কেন তোর বউকে বোবা ভূতে ধরে।’

‘এই ওয়েদারে চা টা মজা লাগবে। নিন।’’

চায়ের কাপ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পার্থিবের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ল। পার্থিব নিষ্পাপ কণ্ঠে বলল, ‘ভয় পাচ্ছেন বিষ মিশিয়েছি নাকি? দাঁড়ান।’
বলেই শ্রুতির দিকে বাড়িয়ে ধরা মগটায় শব্দ করে চুমুক দিল। এরপর নিজের কাপেও চুমুক বসাল। দু হাতের মগ সামনে বাড়িয়ে বলল, ‘দুটোই পরীক্ষা করে দিয়েছি রাণী। আপনি আপনার মন মতো একটা কাপ গ্রহণ করে রাজাকে ধন্য করুন।’’

শ্রুতি কণ্ঠে বিরক্ত মাখিয়ে বলল, ‘এতো ড্রামা আপনি কীভাবে করেন?’’

‘কী আর করার! সবার বউ তো ড্রামা করে। সেখানে আমার বউ হচ্ছে রোবটিক আচরণ করে। তাই বাধ্য হয়ে আমিই ড্রামা করে সম্পর্কের ব্যালেন্স রাখছি।’

শ্রুতি অন্যদিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে চা নিল। সামনে তাকিয়ে দেখতে লাগল তারাদের।
এইভাবে চুপচাপ থাকতে কারো ভালো লাগে? পার্থিব কী দিয়ে কথা শুরু করবে আবার ভাবতে লাগল। অবশেষে ফট করে বলে উঠল,
‘দেখলেন! কেমন বুদ্ধি করে নিজের খাওয়া চা আপনাকে খাওয়ালাম।’

কথাটা শুনে শ্রুতি ভ্রু কুঁচকে ফেলল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায়। পার্থিবের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণের মিচকে হাসি দেখে রাগের পারদ বেড়ে বোধয় একশো ছুঁলো। অবাক কন্ঠে নিজের বিস্ময় প্রকাশ করল,
‘একটা মানুষ এতোটা ফালতু কীভাবে হতে পারে!’
শ্রুতির ভঙ্গিমায় পার্থিব একইভাবে বলল, ‘১ টা মানুষের রাগ এতো সুন্দর কীভাবে হতে পারে!’

শ্রুতি চায়ের কাপ ঠাসস করে রেলিং এ রেখে দিল। পার্থিব তুলে নিয়ে সাথে সাথে চুমুক দিয়ে বাকিটা খেয়ে নিল।
এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয়না। গটগট করে রুমে চলে গেল শ্রুতি।
শ্রুতির দিকে তাকিয়ে ভীষণ মজা পেল পার্থিব। বোকা ১ টা!

.
আজকে শুক্রবার। অফিস বন্ধ। তবে দুটো কোচিং এ পার্ট টাইম জব করে সে। সপ্তাহের ২ দিন ২ ঘন্টা করে ক্লাস নেয়। ক্লাস টেনে জেনারেল ম্যাথ এবং ইন্টারের হায়ার ম্যাথ। এতে অন্তত মাস শেষে ৭ হাজার টাকা আসে। এই বা কম কীসে? শুয়ে বসে থেকে তো সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়না।

মাহাথির কাঠের সোফার দিকে তাকাল। বিভা দু হাঁটু জড়িয়ে ধরে মাঝে নিজের থুতনি রেখে চুপচাপ বসে আছে। মন খারাপ নাকি? এই মেয়েটার মন খারাপ দেখলে পার্থিবের আলাদা প্রশান্তি আসে। কিন্তু কেন? মেয়েটা তাকে পছন্দ করে বলে?
হঠাৎ মাহাথিরের মনে পড়ল হাসিনার কথা। যাওয়ার দিন মাহাথিরের হাত ধরে গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিল,
‘আব্বা, তোমার অমতে বিয়া আমি দেই নাই। তুমি মত দিসো, এরপরই দিসি। তাই মাইয়াডার সাথে কোনোপ্রকার অন্যায় তুমি করবানা। ভালোমতো মিশো, দেখবা কত ভদ্র, সভ্য সে। কষ্ট দিয়ো না বাজান। সে তোমার স্ত্রী হয়। সে সম্মানের যোগ্য।’

হাসিনা এক কথার কঠিন মানুষ। তার স্বরে প্রকাশ পায় তার ব্যক্তিত্ব। এই ব্যক্তিত্ববান মানুষটাকে মাহাথির বড্ড ভালোবাসে। ছোট থেকেই মাহাথির যেমন আদর পেয়েছে, তেমন পেয়েছে শাসন। এখনো এর কোনো হেরফের নেই। মাহাথির নিজেও মায়ের প্রতি ভালোবাসা থেকে মায়ের সব কথা মানে। কিন্তু এই প্রথমবার হয়তো সে কোনো কথা মানছে না। অবশ্য মানার চেষ্টাও করছেনা। বউকে ভালোবেসে কী হবে? সেই তো একদিন ছাড়াছাড়িই হয়ে যায় সব।
______

চলবে ~
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান
শব্দসংখ্যা – ১০৫৫