একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-৩০+৩১

0
173

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৩০.
মির্জা গালিবের কাব্যানুবাদে একটা কথা আছে — সন্ধ্যা কাটে না, অথচ বছর কেটে যায়। কথাটা হয়তো শতভাগ অংশে সত্যি। আমরা মানুষ প্রজাতিরা একটা সন্ধ্যা পার করতে হিমশিম খাই, কীভাবে সময় কাটাব ভেবে উঠতে পারিনা। অথচ কোথায় দিয়ে বছর চলে যাচ্ছে — সেই খবরও আমাদের রাখা হয়ে ওঠেনা। দিনের হিসাব করতে গেলে বোধহয় মিলাতেও পারব না। আচ্ছা কোথায় দিয়ে যায় সময়?
এই যে পার হয়ে গেল ১৫ দিন। চোখের পলকে। কাল বাদে পরশু বিভা-মাহাথির, শ্রুতি-পার্থিব এর বিয়ের ৬ মাস পড়বে। অথচ ভাবতে গেলে মনে হয় — দুইদিন আগে না বিয়ে হলো?

মাহাথির বের হলো অফিস থেকে। তাকে কিছুটা উদাসীন দেখাচ্ছে। সাথে চিন্তিতও। মাহাথির অফিস থেকে বের হয়েই এদিক-ওদিক তাকিতুকি করতে লাগল। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা হয়তো পেল। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল শপে। আশেপাশে আর কোনো দোকান নেই এখানে। তাছাড়া তার বাড়ির সামনে থেকে যে কিনবে সেখানেও নেই। মাহাথির শপ থেকে এক বক্স আইসক্রিম কিনে ফেলল। আইস্ক্রিম কিনে কপালের ভাঁজ আরোও দৃঢ় ভাবে ফেলল। বিভা কী চকলেট ফ্লেভার পছন্দ করে আদৌও? মাহাথির বক্সের দিকে তাকালে দেখল সেখানে দু’ফ্লেভার মিক্স করা আইস্ক্রিম। অর্ধেক চকোলেট, অর্ধেক মিল্ক ফ্লেভার, উপরে ছোট ছোট চকলেট চিপ্স। মাহাথির পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দেখল পকেটে আরোও তিনশো টাকা অবশিষ্ট আছে। সে ঘুরে যেতে নিলেই শুনতে পেল,

‘ আইস্ক্রিমের বক্স বুঝি আমার জন্য কিনলি?’
মাহাথির পাশে তাকিয়ে কিছুটা হকচকিয়ে গেল। আনাস কখন এলো? সে নিজের মনের ভাবটা গলায় প্রকাশ করল,
‘ তুই?……বাড়ি যাসনি?’
‘ উহুম! যাইনি। আসলে আমার বন্ধুকে কোন ভূ তে ধরল সেটা দেখতেই এসেছিলাম। তুই কবে থেকে আইস্ক্রিম খাওয়া শুরু করলি মাহাথির? আইস্ক্রিম খেলে না তোর ঠান্ডা লাগে?’
মাহাথির চুপ করে গেল। পলক ফেলল বার কয়েক। এই আনাস কতোক্ষণ ধরে তাকে লক্ষ্য করছে? সে আনাসকে লক্ষ্য করল না কেন? সে কি এতোই উদাসীন ছিল? একদম দিন দুনিয়া ভুলে যাওয়ার মতো উদাসীন? কিন্তু কার জন্য? বিভার জন্য?

‘ কিরে বল?’

‘ হামি…বি..বিভার জন্য। আব…নিলাম আরকি।…. বাসায় একা….। মেয়েমানুষ…। খাবে..আরকি।’ মাহাথির কী বলবে ভেবে পেল না। মাথা এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে থেমে থেমে অগোছালো কথা দিয়ে নিজের উত্তর শেষ করল। সে মিথ্যা বলতে পারে না। তার মুখ দিয়ে মিথ্যা বের হতে গেলে সত্যরা প্রতিযোগিতা করে আগে বের হয়ে যায়। ঠিক যেমনটা এখন হলো। হামিম উচ্চারণ করতে গিয়েও বিভা উচ্চারণ করে ফেলল। মাহাথির চারদিক তাকিতুকি করে উশখুশ করতে লাগল।
আনাস মাহাথিরের অবস্থা দেখে অন্যদিকে তাকিয়ে মুখ হা করে দুই হাত দিয়ে নিজের গাল চেপে ধরল। উদ্দেশ্য নিজের হাসি থামানো। নিজেকে স্বাভাবিক করে মাহাথিরের দিকে ফিরল আনাস। নিজের সাথে যু দ্ধ করে কেবল মুখ দিয়ে বের করল, ‘ ওহ! আচ্ছা।’
কথা বলতে গেলেই হাসি বের হচ্ছে। মহা ঝা মেলায় পড়ল তো আনাস। আনাস নিজের হাসি প্রকাশ করে মাহাথিরকে অস্বস্তি দিতে চাচ্ছে না। নিজের হাসিও আটকাতে পারছেনা। তাই বলল, ‘ বন্ধু, বাড়ি গেলাম।’
মাহাথির মাথা নেড়ে সায় দিয়ে অন্যদিকে ঘুরল। আনাস তা দেখে বলল, ‘ কিরে! ওই দিকে আবার কই যাস?’
মাহাথির আগের মতোই অস্বস্তি নিয়ে নিজের হাত উঁচু করে বক্স দেখিয়ে বলল,
‘ স্ট্রবেরি ফ্লেভার কিনতে যাচ্ছি।’
‘ এটা ফিরিয়ে দিবি?’
‘ না। দুটোই নিব। কোনটা খায়..জানি না আরকি। এটা না খেলে টাকা নষ্ট না?’
‘ হ্যাঁ, তাই তো, তাই তো।’ বলেই আনাস মুখ ফিরিয়ে নিল। মাহাথিরের লজিক শুনে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। হেসেই দিল। প্রাণোচ্ছল হাসি। তার বন্ধু সত্যিই একটা গর্দ ভ। যাক! আল্লাহ তাও সুবুদ্ধি দিচ্ছে — এই বা কম কী?

.
বাইক চলছে স্বাভাবিক এর থেকে একটু বেশি গতিতে। শাঁ শাঁ আওয়াজ তুলে রিকশা, সিএনজি পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে মাহাথির। সে ভীষণভাবে চিন্তিত। তবে সে জানে যে, সে বেহুদা চিন্তায় সময় নষ্ট করছে। তবুও, চিন্তা চিন্তাই হয়। চিন্তা কখনো যৌক্তিক বা অযৌক্তিক চিন্তা হয়না। সে চিন্তার কথা মাথা থেকে ধা ক্কা মেরে বের করার চেষ্টা করল। হয়তো সফল হলো। রাস্তায় মনোযোগ দিল। তবে মানসপটে ভেসে উঠল নতুন দৃশ্য — আজ সকালে সে যখন ঘর থেকে বের হতে নিল, বিভা এগিয়ে এলো। প্রতিদিনের মতো ফুঁ দিয়ে দিল। ঠিক তখনি ঘটল বিপত্তিটা। মাহাথির যখন চোখ তুলে তাকাল, দেখতে পেল বিভার কপালের দুপাশ পেয়ে দু’ফোঁটা ঘাম পড়তে পড়তে গলায় এসে ঠেকল। এরপরই সে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। অথচ বিভার মুখটা ভুলতে পারল না। আশ্চর্যজনকভাবে সে বিভার কথাই ভেবে গেল সারাটা সকাল, সারাটা দুপুর, সারাটা সন্ধ্যা। একারণেই তো আইসক্রিম কেনা। গরমে আইস্ক্রিম খেলে ঠান্ডা লাগবে।
বলা বাহুল্য তার কিছুক্ষণ আগের চিন্তাও ছিল বিভাকে নিয়ে। তবে সে তো বিভাকে ভাবতেই চায়না, ভাবছে কেন তাহলে?

দরজা খুলল বিভা। খুলেই সড়ে গেল পাশে। মাহাথির হাতের ব্যাগ বাড়িয়ে দিল। পলিথিনে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আইস্ক্রিম। বিভা চোখ তুলে তাকাল,
‘ এসব কার জন্য?’
আবারো অস্বস্তিকর প্রশ্ন! মাহাথিরের মাথায় জেদ চাপল। বলল,
‘ কার জন্য আবার? সবার জন্য। এতো টাকা নেই যে স্পেসিফিকভাবে জনে জনে আনব।’
বিভা ঠোঁট চেপে চলে গেল।
মাহাথিরের রাগ আরোও বেড়ে গেল। আগের চিন্তা আবারো মাথাচাড়া দিতেই ঘরে গেল। ঘরে ঢুকেই বিভার ফোন খুঁজতে লাগল সে। আল্লাহ হয়তো সহায় হলো, খুব সহজেই পেয়ে গেল টেবিলের ওপর। সে গিয়ে ফোন তুলতেই দেখল ফোনে লক। আরোও বিরক্ত হলো।
খাটে বসল মাহাথির। গায়ের শার্ট খুলল ভীষণ রকমের বিতৃষ্ণা নিয়ে।
বিভা ঘরে ঢুকে দেখতে পেল মাহাথির ফ্যান না ছেড়ে বসে আছে। অবাক হয়ে ফ্যান ছেড়ে দিল। পানির গ্লাস বাড়িয়ে ধরল মাহাথিরের দিকে। মাহাথির পানির গ্লাস নিল। বিভা যেতে নিলে মাহাথির স্বাভাবিক কণ্ঠে ডাকল,
‘ বিভা, ফোনে কী কিছু হয়েছে? মানে ডিসপ্লে প্রবলেম বা সামথিং….?’

বিভা এমন প্রশ্নে তাকিয়ে রইল। বলল,
‘ না। কেন?’
‘ এমনি। যাও তুমি।’

তারমানে ফোনে সমস্যা হয়নি কোনো। তাহলে? তাহলে কী ব্যালেন্স ছিল না নাকি? মাহাথির নিজের ফোন অন করল। বিকাশে ঢুকে বিভার ফোন নাম্বারে রিচার্জ করে দিল ১০০ টাকা, সাথে দিল ১২০ মিনিট।
কাজ শেষ করেই বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। তাকিয়ে দেখতে লাগল তিন পাখার ঘূর্ণন।
মাহাথির বিয়ের এক সপ্তাহ পর থেকে অফিস জয়েন করে। আর বিভা মাহথিরের অফিস জয়েনের পর থেকে প্রত্যেকদিন ফোন দেয়। গুণে গুণে তিনবার ফোন দেয় তিন প্রয়োজনে। সকাল নয়টা বাজে দেওয়ার কারণ ফোন করেই জিগ্যেস করে — ভালোভাবে পৌঁছেছেন মাহ্থির? দুপুর দুইটা বাজে দিয়ে বলে — মাহ্থির খাবার দিয়েছি। খেয়ে নিয়েন প্লিজ। খাবারের ওপর রাগ দেখাবেন না। সন্ধ্যা ছয়টায় দিয়ে বলে — সাবধানে আসবেন। বাইক বেশি জোড়ে চালাবেন না। আপনার জন্য কেউ অনেক চিন্তা নিয়ে অপেক্ষায় থাকে।

তিন ফোনে বাড়তি কোনো কথা বিভা বলেনা। আগে যখন বাসা থেকে খাবার দিত না, তখন শুধু বলত খেয়ে নিতে।
বিভা যতটুকু বলার ততটুকু বলে ফোন কেটে দেয়। অথচ আজ প্রথমবারের মতো বিভা তাকে ফোন দেয়নি। ভাবতেই মাহাথিরের মনে হলো তার বুকে কোনো ভারি বস্তু দিয়ে চাপ দেওয়া হলো।
প্রথমত বিভার ঘর্মাক্ত মুখ, দ্বিতীয়ত ফোন না দেওয়া — সব মিলিয়ে দিনটা কাটল জ/ঘন্য, বিষা/ক্ত, তেঁতো। অথচ নিজের এমন অবাঞ্ছিত কষ্টের কারণ মাহাথির খুঁজে পেল না। সে বিভার জন্য চিন্তা করছে ভাবতেই মনে হলো সে মাহাথির নয়, অন্যকেউ। আচ্ছা তাকে কী জ্বী/ন-ভূ/ত ধরল? গ্রামে শুনেছিল খারাপ বাতাস লাগে। তারও লেগেছে নিশ্চিত। নয়তো সামান্য ব্যাপারে কেউ এতোটা উদ্বিগ্ন হয়? ফোন না করাতে কারোর বুকে চাপ সৃষ্টি হতে পারে? এমন মানুষও আছে নাকি দুনিয়াতে? আচ্ছা, সে কী পাগল হয়ে গেল? নয়তো এইসব কী হচ্ছে তার সাথে।
মাহাথির নিজের চুল খামছে ধরল। সে নিজেকে চিনতে পারছে না, নিজেকে বড্ড অচেনা লাগছে। সে মাহাথির হতে পারে না, একদমই পারেনা।

রাতে খাওয়ার সময় মাহাথির জানতে পারল হামিম আজ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। মুখ নীলবর্ণ ধারণ করেছিল। শুনে মাহাথির প্রচন্ড অবাক হয়ে গেল। আরোও জানতে পারল বিভা সারাদিন হামিমের পেছনেই ছিল। মাহাথির আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বিভা তাহলে এইকারণে তাকে ফোন দিতে পারেনি? মাহাথির ভাবল হামিমকে দ্রুতই অপা/রেশন করানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

খাওয়ার পরে উঠে মাহাথির হামিমের ঘরে গেল। হামিমের ঘর বলতে আগে মাহাথির এই রুমটাকে স্টোর রুম বানিয়েছিল। এরপর যেদিন হামিম এলো, সে নিজেই সবকিছু পরিষ্কার করে, ধোঁয়া-মোছা করে ঝকঝকে নতুন রুম বানিয়ে দিল। এরপর আনা হলো নতুন একটা সরু খাট।
একটা খাট, খাটের পাশে ক্যানভাসসহ কিছু সামগ্রী, একটা/দু’টো কৃত্রিম গাছ। সব মিলিয়ে ছিমছামভাবে রুমটা সুন্দর। বড় জানালা থেকে আলো এসে রুমটাকে আরোও প্রকৃতির সৌন্দর্যে ভরিয়ে তুলে।

মাহাথির তাকাল হামিমের ঘুমন্ত মুখের দিকে। ছোট টুল টেনে বসল খাটের পাশে। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, ‘ তুমি অসুস্থ কেন হতে গেলে ব্রাদার? তোমার জন্য তোমার আপা আমাকে ফোন করতে পারল না। আর আমি চিন্তায় চিন্তায় ভাবলাম ফোন খারাপ টারাপ হয়ে গেল কিনা, নাকি ফোনের ব্যালেন্স শেষ। অথচ সে ছিল তোমার পিছনে। এইসবের মানে হয়?’
কথাগুলো বলার পর মাহাথির হতভম্ব হয়ে গেল নিজের কথায়। সে এসব কী বলছে আশ্চর্য! সে খাওয়ার পর ভাবল হামিমকে দেখে ঘুমাবে। ভালো মন নিয়ে এলো। অথচ মুখ থেকে এসব কী বের হয়ে গেল! সে কী আসলেই পাগল হয়ে গেল? নিজেকে নিয়ে চিন্তায় মাহাথিরের মুখ শোচনীয় হয়ে উঠল।

.
শ্রুতি বসে আছে। এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। পার্থিবকে সে গত দশদিন থেকে এড়িয়ে চলছে। যেই সেই এড়িয়ে চলা নয়, ভয়ং/কর রকম এড়িয়ে চলা। পার্থিব খেতে বসলে সে পরে খায়, পার্থিব কথা বলতে এলে ঘুমের অজুহাত দেখিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে আবার রাতে পার্থিব ঘুমানোর পর চোরের মতো রুমে ঢোকে। এইসব এড়িয়ে চলার পিছনের কারণ — সে পার্থিবকে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে।

দাদী মারা গেছে পনেরো/ষোলো দিন হয়। সে যখন দাদীর মৃত্যুটা কোনোভাবে সামলে উঠল তখনি তার মাথায় কেবল ঘুর‍তে লাগল পার্থিবের স্পর্শগুলো। এর আগেও পার্থিব তার কাছে এসেছে। হাত ধরেছে, পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে, দুষ্টুমি করেছে। কিন্তু ওইদিনের জড়িয়ে ধরা, চুমু খাওয়া — সব ভাবতেই শ্রুতির গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। কী ভয়ংকর লোক!

পার্থিব রুমে ঢুকতেই শ্রুতি চমকে উঠে দাঁড়াল। ইশ! আজকে ভুলে হয়ে গেল। উনি ঘুমানোর পরে ঢোকা উচিত ছিল। ভেবেই আবার বসে পড়ল।
পার্থিব শ্রুতির সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইল। কিছু না বলেই কেবল শান্ত চোখে দেখে গেল। শ্রুতি নিজের লজ্জা সামলে রাগী কণ্ঠে ধমক দিল,
‘ এইভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? ঘুমাতে যান।’
‘ আমার সাথে ঘুমাতে চাচ্ছেন?’ পার্থিবের নির্লিপ্ত কণ্ঠে শ্রুতি মনে মনে চমকে গেল। উনার সাথে ঘুমাবে কেন শ্রুতি? শ্রুতি আবারো ধমকে উঠল,
‘ অস ভ্যের মতো কথা না বলে শুয়ে পড়ুন। রাত হয়েছে। আপনার জন্য রাত বসে থাকবে না। রাতের কাজ শেষ হলে রাত দিন হয়ে যাবে।’
‘ আপনি আমার জায়গায় বসে আছেন শ্রুতি। তাই বলছি, আপনি কী আমার সাথে ঘুমাবেন? আমার কোলে ঘুমাতে চাচ্ছেন? না চাইলে আমি আপনার কোলে ঘুমাই? আমার সমস্যা নেই।’

শ্রুতি হতভম্ব হয়ে উঠে গেল। সাথে ভীষণ লজ্জাও পেল। সে খেয়াল করেনি যে সে পার্থিবের খাট নামক উঁচু তোষকে বসে ছিল। শ্রুতি বিছানায় চলে যেতে নিয়েও গেল না। পার্থিবের দিকে তাকিয়ে নিজের দোষ পার্থিবের ঘাড়ে চাপিয়ে দিল,
‘ আমি এখানে বসেছি বলে তাতে কী হয়েছে শুনি? যখন দেখলেন আমি এখানে বসে আছি, আপনার কী উচিত ছিল না খাটে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া? না ঘুমিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আবার বড় বড় কথা বলছেন!’
ঝাঁঝালো কণ্ঠের কথা শেষ করে খাটে উঠে কাঁথা মুড়ি দিল শ্রুতি। পার্থিবের দিকে তাকাতে লজ্জা করছিল, তবুও অনেক কষ্টের রাগ ঝেড়ে এলো সে।

অন্যদিকে পার্থিব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল তোষকের দিকে। এমন আহা/ম্মক বউ তারই হতে হলো? হ্যাঁ, তারই হতে হলো। শ্রুতি শুধু তারই বউ। তার মেহমান বউ। ভেবেই নিজের ঠোঁটে হাসি ফোটাল পার্থিব। তবে চিন্তাও আছে, শ্রুতি কী কখনো তার আপন বউ হওয়ার চেষ্টা করবেনা? সারাজীবন মেহমান বউ হয়েই থেকে যাবে?

____
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ১৬৩৬
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৩১.
সোফাতে বিমর্ষ মুখে বসে আছে শ্রুতি। মাথার পিছন দিকে অসহ্য ব্যথা করছে। সবকিছু বিষাক্ত, তেঁতো, পানসে লাগছে। অথচ তার আশেপাশের মানুষের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন। সবাই কাজে ব্যস্ত। তার শাশুড়ি, চাচিশাশুড়ি থেকে সবাই টুকটাক কাজে আছে।
আজকে সবথেকে বেশি ব্যস্ত হওয়ার কথা ছিল শ্রুতির। এর কারণ আমিন শিকদার আসছে। বাবা মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে এলে মেয়ের ব্যস্ততাই হয়তো সকলের কাম্য থাকে।
ধুর! যা করার তা তো সে করেই ফেলেছে, তবে এতো তিক্ততা কেন? বরং তার বাবা না এলেই তার চিন্তা হবে।
শ্রুতি পাশে তাকাল। প্রভা-প্রত্যাশা বসে আছে। দু’জনের সাথে তার ভাব অনেক আগেই হয়েছে। প্রত্যাশা মেয়েটা একটু রাগী ধাঁচের হলেও ভালো। শ্রুতি দেখল প্রভা-প্রত্যাশার সামনে বাদাম ছড়ানো। অথচ তারা খাচ্ছেনা। দুইজন একসাথে ফোনে কিছু একটা করছে। শ্রুতি সরল প্রশ্ন করল, ‘ খাচ্ছো না কেন?’

‘ মা এলে খাব।’ প্রভা উত্তর দিল।

‘ কেন? মায়ের কী বাদাম খুব প্রিয়? তাহলে রেখে দাও। এলে দিয়ে দিও।’

‘ না। বাদাম প্রিয় না। আমাদের ছুলে দিবে। ছুলে খেতে ইচ্ছে করেনা। তাই বসে আছি।’

শ্রুতি তাদের কথা শুনে একবার প্রভা-প্রত্যাশার জায়গায় নিজেকে বসাতে চেষ্টা করল। হলো না। তবে শ্রুতির মা না থাকলেও তার আপা আছে। তার আপা তাকে যথেষ্ট আদর-যত্নে রেখেছিল, সাথে তো দাদী ছিলই। দাদী….? শ্রুতির মনটা ভীষণভাবে খারাপ হয়ে গেল। শ্রুতির ইচ্ছে করল উঠে চলে যেতে। সে গেল না।
ভয়ংকর মন খারাপ নিয়ে সে নিজের দুই ননদকে বাদাম ছুঁলে দিতে লাগল। শুধু ছুঁলেই ক্ষান্ত হলোনা, উঠে গিয়ে পাশে বসে মুখে তুলে দিল। প্রভা-প্রত্যাশা অবাকের পাশাপাশি ভীষণ খুশি হলো। দু’জনে ফোন রেখে তাদের ছোটভাবির সাথে গল্প করতে করতে বাদাম খেতে লাগল।

পার্থিব তৈরি হচ্ছিল। এরমধ্যেই শ্রুতি রুমে ঢুকল। শ্রুতিকে দেখে পার্থিব স্বচ্ছ এক হাসি উপহার দিল। শ্রুতি ঢোক গিলে অন্যদিকে তাকাল। এরপর আবার পার্থিবের দিকে তাকালে দেখল পার্থিবের চোখ এখনো তার উপরই নিবদ্ধ। শ্রুতিও ঠোঁট এলিয়ে হাসার চেষ্টা করে বারান্দায় চলে গেল।
শ্রুতি বারান্দায় এসে শ্বাস নিল। এতোক্ষণ যেন কেউ তার শ্বাস আটকে রেখেছিল। শ্রুতি আবিষ্কার করল, সে এখন শুধু পার্থিবকে লজ্জা নয় সাথে ভয়ও পায়। অজানা এক ভয়। যেই ভয়ে পার্থিব আশেপাশে থাকলে তার ভীষণ লজ্জা লাগে। শ্রুতি চোখ বন্ধ করল। সে আরেকটা ভয়ংকর বিষয় আবিষ্কার করেছে। আর তা হলো — সে পার্থিবের প্রতি দুর্বল। যেন তেন দুর্বল নয়; ভয়ংকর রকমের দুর্বল। এখন পার্থিব ঘুমালে সে বেহায়া, নির্লজ্জের মতো পার্থিবের দিকে তাকিয়ে থাকে। আবার হাসলেও না তাকিয়ে পারে না। পার্থিবের চেহারা না দেখলে তার একটু অস্থির অস্থির লাগে। একারণে পার্থিব বাসায় যতক্ষণ থাকে শ্রুতি তার আশেপাশেই থাকে। তবে পার্থিবের অগোচরে, যাতে পার্থিব বুঝতে না পারে। সে পার্থিবকে এড়িয়ে চলেও কাছাকাছি থাকে — ব্যাপারটাকে কী নাম দেওয়া যায় তা শ্রুতি ভেবে পেল না।

আমিন শিকদার সহ তিন জন লোক এসেছে বাড়িতে। সবাই তাদের আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত। শ্রুতিও এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছে। সবাই ভীষণ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। দৃশ্যটা দেখতে শ্রুতির যত ভালো লাগছে ততো রাগ হচ্ছে। শ্রুতি পার্থিবের দিকে তাকাতেই দেখল পার্থিব খেতে খেতে তার দিকে একপলক তাকিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। শ্রুতি উপলব্ধি করল পার্থিবের তাকানোও সে সহ্য করতে পারছেনা। কালো পাঞ্জাবিতে তার স্বামীকে ভয়ংকর সুন্দর লাগছে। সে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। ড্রইংরুমে বসে অপেক্ষা করতে লাগল খাওয়া শেষ হওয়ার। ব্যবসা করতে এসেছে, ব্যবসা করবে। এতো খাওয়া-দাওয়ার কী আছে আশ্চর্য! খেয়েই যদি সময় পার করে, কথা বলবে কখন?

শ্রুতিকে নিজের অজান্তেই খুশি করে দিয়ে ড্রইংরুমে বসা হলো ব্যবসা বিষয়ক কথা বলতে। শ্রুতি সরাসরি সোফায় না বসলেও দূরে কাঠের দোলনায় বসল প্রভাকে পাশে বসিয়ে। শ্রুতি দেখতে পেল কথার এক পর্যায়ে আসাদ সাহেব উঠে গেলেন। নিশ্চয়ই তার ঘরে যাবে। শ্রুতি খুশি হয়ে গেল। সুন্দর সময়টা বোধহয় চলেই এলো। ভেবেই শ্রুতির মুখ হলো হাসি হাসি। এইবার সে নিজের মনে গল্প করতে শুরু করল প্রভার সাথে।
আসাদ সাহেবের পরে, পার্থিবও উঠে গেল। পরিবেশটা বেশ শান্ত হয়ে এলো। আসাদ সাহেব আবার এসে তানহার সাথে কথা বলতে লাগলেন। শ্রুতির ধারণা তার শাশুড়িকে কাগজ বিষয়ক প্রশ্ন করা হচ্ছে যে শ্রুতি জানে কিনা। কিছুক্ষণ পর আমিন সাহেবও উঠে গেল। কেবল বসে রইল বাকি তিনজন লোক। শ্রুতি বুঝল এইবার তার যাওয়া উচিত।
শ্রুতি শ্বশুরের ঘরে যেতে যেতে ভাবতে লাগল সে আশা করেছিল কাগজ না পেয়ে বাড়িতে ভীষণ চিৎকার চেঁচামেচি হবে। হয় করবে আসাদ নাহয় আমিন। আশ্চর্যের বিষয় কোনো চিৎকার চেঁচামেচি হলোনা।

শ্রুতি ঘরে গিয়ে দেখল কাগজ ছড়ানো-ছিঁটানো। কিছু ফাইল টেবিলে, কিছু চেয়ারে, কিছু খাটে। পার্থিব, আসাদ, নিয়াজ সবাই মিলে কিছু খুঁজছে। পার্থিব ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,
‘ বাবা, ঠিক করে মনে করো কোথায় রেখেছিলে? এখানে এই প্রজেক্টের কোনো অংশও নেই।’
আমিন শিকদার শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রুতি এগিয়ে গেল। বলল,
‘ শুধু শুধু খুঁজে কষ্ট করতে হবেনা। কাগজ আমি ছিঁড়ে ফেলেছি। ছিঁড়ে মোয়া বানিয়েছি।’
পার্থিবের হাত থেমে গেল। শ্রুতির দিকে তাকাল। পার্থিবের মনে হলো সে শ্রুতির কথাটা স্পষ্ট শুনেনি। হয়তো ভুল শুনেছে। মাথাটা কেমন নিমিষেই ফাঁকা হয়ে গেল। কাগজ ছিঁড়ে ফেলেছে? পার্থিবের মাঝে কেমন প্রতিক্রিয়া এলো পার্থিব বুঝল না। সে নিজেকে ধাতস্থ করার জন্য আওড়াল,
‘ গত একমাস ধরে যেই প্রজেক্টের জন্য আমি এতোকিছু করেছি সেটা শ্রুতি ছিঁড়ে ফেলেছে!’
পার্থিব শান্তচোখে তাকিয়ে রইল।

আসাদ সাহেব বললেন, ‘ তুমি এখানে কী করছো? আর কী আজেবাজে বকছো সে কাগজ ছিঁড়ে ফেলেছো? শুধুশুধু কাগজ ছিঁড়ে তোমার কী লাভ?’

শ্রুতি নমনীয় কণ্ঠে বলল, ‘ আমি সত্যিই ছিঁড়ে ফেলেছি, বাবা। শুধুশুধু খুঁজে লাভ নেই।’

‘ কেন ছিঁড়েছেন, শ্রুতি?’ পার্থিবের ঠান্ডা প্রশ্ন।

‘ এই প্রজেক্টে আমার বাবা আছে তাই ছিঁড়ে ফেলেছি। ভালো করেছিনা আব্বু?’
উত্তর দিয়েই আমিন শিকদারের দিকে তাকাল। আমিন সাহেব লক্ষ্য করলেন তার হাত-পা কাঁপছে। তার কোটি টাকার প্রজেক্ট ছিল, আর এই মেয়ে কিনা কাগজপত্র ছিঁড়ে ফেলেছে? সবার কাছে ব্যাপারটা আজব লাগলেও আমিন সাহেবের কাছে লাগল না। সে নিজের মেয়ের ব্যবহারে পরিচিত।

‘ শ্রুতি, আমি তোমাকে নিজের মেয়ে ভাবি। স্নেহ করি। তাই বলে এই নয় তুমি এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে মজা করবে।’ আসাদ সাহেব বললেন।

‘ আমি মজা করছিনা বাবা। আমি সত্যিই ছিঁড়ে ফেলেছি। আমিন শিকদার আছে বলে ছিঁড়েছি। সে লাভবান হোক তা আমি চাইনা। যার কাছে ছেলেমেয়ের জন্য টাকা থাকেনা, নিজের মায়ের জন্য টাকা থাকেনা তার কাছে টাকা যাওয়ার প্রয়োজনও নেই। তাকে রাজার আসনে নয়, ভিক্ষুকের আসনে ভালো মানাবে।’

আমিন সাহেব শ্রুতির বাহু ধরে ঘুরিয়ে গর্জে উঠল, ‘ খুব বেশি বার বেড়েছিস! আজ বুঝতে পারছি জন্মের পরপরই তোকে গলা টিপে খুন করা উচিত ছিল জা নোয়ার কোথাকার!’ বলেই নিজের হাত উঠিয়ে থাপ্পড় মারতে এল।
শ্রুতি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখল একটি নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেল তার সামনে। পার্থিব ‘থামুন’ বলে ধমক দিয়ে আমিন সাহেবের হাত আটকে ফেলল। ঘটনার আকস্মিকতায় শ্রুতি বুঝতে পারল না সে যে পার্থিবের চিৎকার ছিটকে উঠেছে।

‘ আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমার বউকে অসম্মান করার অধিকার আপনার নেই। সে ভুল করুক, অন্যায় করুক কিংবা মানুষ খুন করুক; যা শাস্তি দেওয়ার আমি দেব। আপনি না। আপনি বাবা হলেও আমি স্বামী। অধিকার কোনো অংশে কম নয়, বরং বেশি।’ শান্তভাবে শক্তকণ্ঠে নিজের কথা শেষ করল পার্থিব।
শ্রুতি পার্থিবের শক্ত মুখে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। আসাদ সাহেব গম্ভীর মুখে চেয়ারে বসলেন। নিজের ভাই নিয়াজকে বলল নিচে গিয়ে সব সামাল দিতে। তাদের বলতে আজ কোনো মিটিং হবেনা। নিয়াজ সাহেব বেরিয়ে গেলেন। এমনিতেও তার মাথা ঘুরছে।

আসাদ সাহেব আমিন শিকদারকে বলল,
‘ আপনি চলে যান আজকের মতো। ব্যবসা নিয়ে পরে কথা হবে।’

আমিন শিকদার মনে মনে একটু ভয় পেল। যদিওবা তার রাগ এখনো কমেনি, তবুও এতো বোকার মতো কাজ সে করল কীভাবে? আসাদ সাহেবের সামনে এমন ব্যবহার করা ঠিক হলোনা। তাকে কতো ভালো জানতো, অথচ আজ যদি শ্রুতি তাকে উল্টোপাল্টা কিছু বলে ফেলে?
আমিন শিকদার কিছু বলতে গেলেও আসাদ সাহেব শুনল না। অগত্যা তাকে বেরিয়ে যেতে হলো। আমিন শিকদার যেতে যেতে নিজেকে গালি দিতে লাগল। বিজনেসের শেয়ার থেকে যদি কোনোভাবে আসাদ সাহেব তার কম্পানি সড়িয়ে নেয়, তাহলে বিশাল লস হয়ে যাবে। তাছাড়া এই কম্পানির সাথে থাকার লোভেই তো শ্রুতিকে বিয়ে দিয়েছিল যাতে সম্পর্ক পাকাপোক্ত হয়। এখন যদি সব ভেস্তে যায়? ভাবতে ভাবতেই আমিন সাহেব ঘেমে উঠল চিন্তায়।

পার হলো কিছু মিনিট। পিনপতন নীরবতা ভীষণ ভয়ানক লাগল শ্রুতির। আসাদ সাহেব উঠে এসে তার সামনে দাঁড়াল। শান্তকণ্ঠে গম্ভীরভাবে বলল, ‘ এমন কিছু তোমার থেকে আশা করিনি। একবার বলতে পারতে।’
শ্রুতি কেঁপে উঠে চোখ তুলে তাকাল। কিছুক্ষণ আগের তার বাবার গর্জনেও সে কাঁপেনি, অথচ শ্বশুরের গম্ভীর কণ্ঠ যেন তার বাবার চিৎকার চেঁচামেচির থেকেও ভয়ানক ঠেকল! আসাদ সাহেব রুম থেকে বের হয়ে গেল।

পার্থিব শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘ কাজটা কী ঠিক হলো শ্রুতি?’

শ্রুতি মিনমিন কণ্ঠে বলল, ‘ আমার বাবার সফলতা আমি চাইনা।’

‘ বাবার সফলতায় ব্যাঘাত ঘটাতে গিয়ে, নিজের স্বামী-শ্বশুর এর সফলতায় বাঁধা হয়ে গেলেন।’

শ্রুরি অশ্রুসিক্ত চোখে চাইল, ‘ মানে?’

‘ এই কাজের দায়িত্বে ছিলাম আমি। এই প্রজেক্টে আমার কতোটুকু শ্রম গেছে তা আপনি জানেন না। এই কাজ কমপ্লিট হলে হয়তো আপনার বাবা লাভবান হতো কিন্তু এর সাথেই জড়িয়ে আছে আমাদের আরেকটা প্রজেক্ট। যেটা আমার ড্রিম। আমার বাবার ড্রিম। আপনি আপনার বাবাকে ভাঙতে গিয়ে আমাকে ভেঙে দিলেন শ্রুতি।’

পার্থিব তার স্বভাব অনুযায়ী শান্তভাবে চলে গেল। রুমে দাঁড়িয়ে রইল কেবল শ্রুতি। মাথা আপনাআপনি নিচু হয়ে গেল। সে কী সত্যিই তার আব্বুকে কষ্ট দিতে গিয়ে বাবা, পার্থিবকে কষ্ট দিয়ে ফেলল? কিন্তু সে তো কাজটা করেছে বাবার প্রতি রাগ থেকে। যে বাবা তার ভাইয়ের অপারেশনে টাকা দিতে নারাজ, যে বাবা নিজের মাকে চিকিৎসা করাতে নারাজ তার সফলতা চায়না শ্রুতি। সে তো চায়নি অন্যকারো ক্ষতি হোক, তবুও কেন হলো? সে সবসময় কেন ভুল কাজ করে ফেলে? আচ্ছা সে তো কাগজগুলো না ছিঁড়লেও পারতো! তাহলে তো পার্থিব এতো কষ্ট পেত না। পার্থিবের কষ্ট তাকে এতো কেন কষ্ট দিচ্ছে? আর বাবা! সেও নিশ্চয়ই ভীষণ কষ্ট পেয়েছে?

সময়গুলো খুব দ্রুতই পার হলো। দুপুর থেকে বিকেল, বিকেল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে রাত। প্রতিটা সময় শ্রুতি আতংকে রইল কেউ তাকে বকবে — এই ভেবে। একবার মাথায় এলো, তানহা তাকে ভীষণ বকবে। আবার মনে হলো আসাদ সাহেব তাকে বকবে। অথচ কেউ বকলোই না। আচ্ছা বাড়ির বাকি সবাইকে কী জানানো হয়েছে যে সে এতোবড় একটা অন্যায় করেছে? শ্রুতির মনে হলো জানানো হয়নি।

শ্রুতির মন খারাপ হলো। আজ বিকালে সে আসাদ সাহেবকে চা দিয়ে যায়নি। অন্যান্য দিন যায়। কাজটা তার কাছে আবশ্যিক ধরনের একটা কাজ। কাজটা করে সে ভীষণ আনন্দ নিয়ে, যত্ন নিয়ে। অথচ আজ করতে পারেনি। আরোও কষ্টের ব্যাপার আসাদ সাহেব ডাকেনওনি। কেন ডাকল না? রাগ করেছে ভীষণ? রাগ করেছে বলেই ডাকেনি নয়তো ডাকতো। কিছুদিন আগেও তো সে ভুলে গেছিল চা নিয়ে যেতে। তানহা বেগম এসে তাকে ডেকে নিয়ে গেছে। শ্বশুর এর রুমে ঢুকতেই প্রশ্ন করেছিল, ‘ আজ আসছিলে না কেন, মা? ব্যস্ত ভীষণ?’
শ্রুতির ভীষণ রকমের মন খারাপ হলো।

শ্রুতির পাশে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল পার্থিব। শ্রুতি বুঝেও কিছু বলল না। লজ্জা লাগছে ভীষণ! এতো বড় অন্যায় সে না করলেও পারত। পার্থিব শ্রুতির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ গল্প শুনবেন শ্রুতি?’
শ্রুতি প্রশ্নটা বুঝেও বুঝলনা। কেবল তাকিয়ে রইল পার্থিবের দিকে। পার্থিব কৃত্রিম হেসে বাইরে তাকিয়ে বলতে লাগল,
‘ শ্রুতি, আমি আপনাকে ভালোবেসে বিয়ে করিনি। বিয়ের পর ভালোবেসেছি। একটু একটু করে। প্রথমে ভালোলাগা, পরে মায়া। এরসাথে যত্ন, দায়িত্ব, রাগ, অভিমান সব মিলে কীভাবে যেন ভালোবাসা হয়ে গেল শ্রুতি! আমি বুঝতেই পারলাম না। বুঝলাম চট্টগ্রাম গিয়ে। চট্টগ্রাম গিয়ে বুঝতে পারলাম আপনাকে ছাড়া আমার চলবে না। মানুষ বলে প্রথম দেখায় হুট করে যে ভালোবাসা হয় সেটাই নাকি গভীর ভালোবাসা। আমি কথাটা মানিনা। প্রথম দেখায় হয়তো ভালোবাসা হয় তবে সেখানে কোনো মায়া থাকেনা।’

কথার এই পর্যায়ে পার্থিব থেমে গেল। শ্রুতির দিকে তাকিয়ে আবারো বলতে শুরু করল, ‘ আমি আপনাকে অনেক যত্ন নিয়ে ভালোবেসেছি শ্রুতি। আপনার প্রতি নিজের ভালোবাসা রেখেছি একদম স্বচ্ছ পানির মতো। নিজের সবটুকু দিয়ে খেয়াল রেখেছি আমার ভালোবাসাতে যাতে ছোট্ট ময়লাও না পড়ে। অথচ… অথচ আমি হয়তো আপনাকে ঠিকঠাক ভাবে ভালোবাসতে পারিনি।

আপনি আজ যা করেছেন তা তে আমার বাবা কতোটুকু কষ্ট পেয়েছে তা আর বলতে চাইছিনা। আমার কাছে আপনি যেমন সত্য, তেমনি আবার বাবা, আমার পরিবারও সত্য। আমি কখনো চাইনি আমার পরিবার আমার কারণে কষ্ট পাক। অথচ আজ তাই হলো। আমার উছিলায় আপনার কারণে কষ্ট পেল। আপনি আমাকে ভেঙে দিলেন শ্রুতি…। বাবার সামনে আমাকে ছোট করলেন।’
পার্থিব ভীষণ বড় করে শ্বাস নিল যার আওয়াজ এলো শ্রুতির কান পর্যন্ত। শ্রুতি বারান্দায় রেলিং ধরল শক্ত করে। পার্থিব রুমে যেতে গিয়েও থেমে গেল। শ্রুতিকে ঘোরাল নিজের দিকে।
শ্রুতি এতোক্ষণ পার্থিবের দিকে তাকায়নি। তাকিয়ে দেখল পার্থিবের গায়ে এখনো সেই পাঞ্জাবি। পার্থিব শ্রুতির গালে ভীষণ আদুরে ভঙ্গিতে হাত রেখে বলল,
‘ আপনি এখানে ভালো নেই শ্রুতি। খারাপ থাকুন কখনো চাইনি, চাইবোওনা। আপনি চাইলে চলে যেতে পারেন। আমি আপনাকে অনুমতি দিলাম। কেউ আপনাকে কিচ্ছু বলবে না। আপনি শুধু ভালো থাকুন। তাছাড়া আপনিতো আমাকে ভালোওবাসেন না….শুধু শুধু এখানে থেকে কষ্ট করছেন।’

শ্রুতি স্তব্ধ হয়ে পার্থিবের কথা শুনল। পার্থিব যেতেই দু’চোখ বেয়ে নেমে গেল ঢল। এটা কী বলল পার্থিব? তাকে চলে যেতে বলল? এতো রাগ তার! ভীষণ অভিমান হলো শ্রুতির। ঠিক করল সকালবেলাতেই চলে যাবে। থাকবে না সে এখানে, লাগবে না কারোর ভালোবাসা। ভাবতে ভাবতেই নিজের চোখের পানি মোছার চেষ্টা করল। একি! এতো পানি পড়ছে কেন?

_____
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ১৮৫৬
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান