একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-৩২+৩৩

0
178

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৩২.
এই পৃথিবীতে বহু ধাঁচের, বহু প্রকৃতির মানুষ আছে। প্রতিটি মানুষ জন্মেছে নিজেদের আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে, আলাদা দোষ নিয়ে, আলাদা গুণ নিয়ে। কেউ কোনো অংশে কারোর থেকে কম নয়; বরং বেশি।
শ্রুতিও জন্মেছে তার ধাঁচে। সে হুটহাট রেগে ওঠে। অল্পতে চোখের পানিতে বন্যা বইয়ে দেয়। নিজের দোষ হলেও সে নিজের দোষ কম দেখে। ‘ক’ কে ‘কলকাতা’ বানানো তার প্রধান এবং প্রিয় কাজ। সবচেয়ে প্রধান কাজ অভিমান করা। তার অভিমান যৌক্তিক এর চেয়েও হয় বেশি অযৌক্তিক। এই যেমন এখন সে পার্থিবের ওপর এক আকাশ অভিমান নিয়ে ব্যাগে জামা-কাপড়ের স্তূপ বানাচ্ছে। পার্থিব অফিসে চলে গেছে। এখন সেও চলে যাবে। থাকবে না এখানে। মানছে সে ভুল করেছে তাই বলে চলে যেতে বলবে?

শ্রুতি কাউকে বলে বের হলোনা। বাড়ির গাড়িটাও সে নিলোনা। নিজেই কোনোরকমে ব্যাগ টানতে টানতে পৌঁছে গেল বাড়িতে। বাড়িতে? তার বাড়িতে? হ্যাঁ, তার বাড়িতেই। না, তার বাড়িতে নয় তো। এটা আমিন শিকদারের বাড়ি। শ্রুতি প্রথমে ভেবেছিল সে বিভার বাড়িতে যাবে। কিন্তু যায়নি। তার মাথায় এলো যে, সে যদি যায় তাহলে তো সেখানেই থাকতে হবে। আপা আসতে দিবেনা। আপার শ্বশুরবাড়ি তো তেমন বড় নয়। এমনিতেই হামিম আছে, আবার সেও যদি যায় হুলুস্থুল কান্ড হবে। কী দরকার! এর থেকে সে তার মায়ের ঘরেই থাকবে।

নিজের বাবার বাড়ি অথচ বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে শ্রুতির ভীষণ ভয় হলো। তাকে যদি থাকতেই না দেয়? তখন কী হবে?
শ্রুতির ভেতর থেকে কান্নারা ডুকরে এলো। তার কী বাড়ির এতোই অভাব! তার কী কোনো বাড়ি নেই যাওয়ায়? এতোবড় পৃথিবী অথচ তার থাকার কোনো জায়গা নেই ভাবতেই শ্রুতির চোখ ভরে উঠল, ঠোঁট ভেঙে গেল আপনা-আপনি। শ্রুতি নিজেকে ধাতস্থ করে কান্না গিলে ফেলল। ব্যাগ কোনোমতে টানতে টানতে ঢুকে গেল বাড়িতে।

বাড়িতে ঢুকেই শ্রুতি ভীষণ অবাক হলো। সোফায় বসা মায়ের আগের ঘরের তিন ছেলে, শাহিনা, শাহিনার ভাই। অন্য সিঙ্গেল সোফায় বসা আমিন সাহেব। শ্রুতির হাত-পা কেঁপে উঠল হালকা। তবুও সে নিজেকে শক্ত করে ঘরে ঢুকতে লাগল। আমিন সাহেব তা হতে দিলেন না। সামনে এসে দাঁড়াল,
‘ তুই এখানে কেন?’

‘ আমার তো এখানেই থাকার কথা, আব্বুউউউ।’ শ্রুতি তার বাবার সাথে খুশিমনে, হাসি হাসি মুখ করে কথা বলতে ভীষণ মজা পায়। মনে হয় সে তার বাবার গায়ে আগুন ছুঁড়ে মারে। আর সেই আগুনে আমিন সাহেব জ্বলে।

‘ ভালোভাবে বল তুই এখানে কেন?’

‘ এতো সহজে ভুলে গেলে হয়? আমি না কথা দিয়েছিলাম ছয় মাসের মধ্যে ফিরে আসব? এলাম আব্বু। তুমি দেখো আজকে সন্ধ্যা ৭/৮ টার দিকে কিন্তু ছয় মাস পূরণ হবে। আজ আমার আর আপার বিয়ের ছয় মাস পূরণ হবে। আমি আমার কথা রাখলাম। ছয় মাসের মধ্যে বাপের বাড়িতে ফিরে এসে তোমাকে হারিয়ে দিলাম।’ সব কথা শান্তভাবে বললেও শেষের কথাটায় প্রকাশ পেল জেদ, কঠিনত্ব।

আমিন সাহেব বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না। তার চিন্তা ঘুরে গেল। শ্রুতি তারা সত্যি সত্যি বাড়ি থেকে বের করে দিল? কিন্তু কেন? শ্রুতি কী তাদের তার সম্পর্কে কিছু বলেছে নাকি? তবে কী ব্যবসা থেকেও তাকে বাদ দেওয়া হবে? আমিন সাহেবের চিন্তার মাঝেই শ্রুতি বলল, ‘ জিতে গেছি কিন্তু। সেই হিসেবে এখন আমি এখানে থাকব। যতোদিন মন চায় ততোদিন।’

বলেই যেতে নিল শ্রুতি। শাহিনা উঠে এসে তাকে বাঁধা দিতে নিলে আমিন সাহেব চোখের ইশারায় তাকে থামতে বলল। শ্রুতি চলে গেল নিজের ঘরে।

.
‘ শ্রুতি, এইসব কী করে ফেললি তুই? এমন কেউ করে? আচ্ছা….তুই আমাকে এখন ফোন করে এইসব না বলে সকালে ফোন করতি। তাহলেই আমি এইসব হতে দিতাম না।’

‘ আপা আমি চাইনি আমিন শিকদার তার ব্যবসায় এতো লাভ করুক। তাই ছিঁড়ে দিয়েছি।’

‘ মানলাম সেটা। তবে তোরও মানা উচিত তুই নিজের অজান্তেই ভুল করেছিস। মানা উচিত না? শুধু বল উচিত কিনা?’

‘ হ্যাঁ।’

‘ তাহলে? তাহলে….ভুল যেহেতু করেছিস তোর কী উচিত ছিলনা ক্ষমা চাওয়া? তার চেয়েও বড় ব্যাপার পার্থিব কষ্ট পেয়ে তোকে একটা কথা বলেছে আর সেটা মেনেই তুই চলে এলি? ওকি তোকে শাসন করার অধিকারও রাখেনা? তোর ভুল ধরিয়ে দেবে না?’

‘ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলাকে তুমি শাসন বলছো?’

‘ এমনি এমনি তো বলেনি, শ্রুতি। তুই এতোদিন শুধু বলতি চলে আসবি, চলে আসবি। সেটার সূত্র ধরেই বলেছে যে ভালো না লাগলে চলে আসতে পারিস। তোর উচিত ছিল বাড়িতে থেকে পার্থিবের রাগ, মান ভাঙানো। আর তুই সত্যি সত্যিই চলে এলি? ’

‘ এলাম।’

‘ উচিত হয়েছে ওই বাড়ি যাওয়া?’

‘ খুব হয়েছে।’ ভীষণ মন খারাপ, অভিমান থেকে উত্তর দিল শ্রুতি।

বিভা হতাশ হলো। তার বোন এমন করছে কেন? নিজের স্বাভাবিক জীবনকে এইভাবে নষ্ট করছে কেন? বিভা শাসন স্বরে বলল,
‘ শ্রুতি তোর কাজে আমি আমিন শিকদারের জেদ দেখতে পাচ্ছি। যেই জেদ কারোর ভালো করেনা। শুধু ধ্বংসই করে। তুই নিজের জীবন নিজে ধ্বংস করছিস। যা ইচ্ছা কর, আমি আর কখনো কিছু বলব না।’
বিভা ফোন কেটে দিল। শ্রুতি অবাক হয়ে চেয়ে রইল ফোনের দিকে। ঘরে ঢুকেই সে প্রথমে তানহা মাকে ফোন করেছিল। বলেছে সে এই বাড়িতে চলে এসেছে আর কখনো যাবেনা। তানহাকে এই কথা বলার কারণ শ্রুতি জানেনা। তবুও বলেছে। এরপরই বিভাকে ফোন দিয়ে কালকের সব ঘটনা বলেছে। ঘটনা শুনেই শুরু হলো বিভার রাগারাগি। শ্রুতি মন খারাপ করে ফোন ফেলে রাখল বিছানায়।

.
পার্থিব ভীষণ ক্লান্ত হয়ে রুমে ঢুকল। রুমে ঢুকে তার শরীরের ক্লান্তির থেকে মনের ক্লান্তিকেই বেশি ভারি মনে হলো। ঘরটা ফাঁকা। পুরো ফ্ল্যাট টাই ফাঁকা। কেন? শ্রুতি চলে গেছে বলে? পার্থিব নিজেকে বুঝাতে চেষ্টা করল একজন মানুষ কমে গেলে কখনো ঘর-বাড়ি ফাঁকা হয়ে যায়না।

নিজেকে অযথা সান্ত্বনা দিয়ে ফ্রেশ হলো সে। বেরিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। আজ যখন সে অফিসে ছিল তখন তার মা তাকে ফোন করল। ফোন করে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে, গলায় আতংক ঢেলে বলল, ‘ বাবা, শ্রুতি নাকি চলে গিয়েছে। আর ফিরবে না ঘরে। বাবা? ওর সাথে কী ঝগড়া করেছো তুমি? মেয়েটা কাউকে না বলেই চলে গেল। এরপর গিয়ে ফোন করে জানাল। আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।’
মায়ের কথা শুনে পার্থিব মনে হলো দিন দুনিয়া এমন বিরক্তিকর কেন? এতো জঘন্য কেন? সে বিপরীতে তেমন কিছু বলতে পারেনি। শুধু শান্ত কণ্ঠে বলেছিল, ‘ তাকে নিয়ে চিন্তা করে নিজের প্রেশার বাড়িয়ো না। সে গেছে ভালো হয়েছে। আমি অনুমতি দিয়েছিলাম।’ এরপরই ফোন কেটে দিল।

পার্থিব নিজের সামনের ড্রেসিং টেবল থেকে পানি ভর্তি বোতল ছুঁড়ে মারল পিছন দিকে। ঠনঠন শব্দ তুলে কাঠের ফুলদানি পড়ে গেল। পার্থিবের মুষ্টিবদ্ধ হাত কাঁপতে লাগল। ঘরের চারদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে বলল, ‘ এতো জেদ ভালো নয় শ্রুতি। একদমই ভালো নয়।’
.

শ্রুতি বসে আছে বারান্দায়। হাঁটু জড়িয়ে ধরে বসা। মুখ মলিন, শুকনো। সারাদিনে পেটে কিছু পড়েনি তার। দুপুরের দিকে রুম থেকে বেরিয়েছিল। আশেপাশে কাউকে তেমন দেখা যায়নি, হুট করেই কোথায় থেকে যেন শাহিনার ভাই এলো। লোকটা মধ্যবয়সী। ভদ্র চেহারা। অথচ শ্রুতির কাছে সবচেয়ে নোংরা চেহারা। তাকে কোনোমতে এড়িয়ে সে রুমে ঢুকে যে দরজা বন্ধ করল, আর খুললোই না। খুলবেও না।
শ্রুতি বারান্দা থেকে উঠে ঘরে এলো। তার মায়ের ঘরে। মৃত্যুর আগে তাহিরা এই ঘরে থাকত। আমিন শিকদার থাকতেন অন্য ঘরে। দ্বিতীয় বিয়ের পরে শাহিনাও আমিন সাহেবের রুমেই থাকে। এই রুমে কেউ আসেনা। হালকা ময়লা রুমটা। তবুও শ্রুতি পরিষ্কার করেছে যতোটা পারা যায়।

শ্রুতি দরজা, জানালা বন্ধ করে দিল। সে ভূতে ভয় পায়। ভীষণ ভয় পায়। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় লাল চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। দরজা-জানালা বন্ধ করে তার ভয় আরোও বাড়তে লাগল। সে বিছানার মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে বসে পড়ল। বসে চোখ বন্ধ করে হাঁটুতে মাথা দিয়ে রইল। কিছু সেকেন্ড পরেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে চমকে উঠল শ্রুতি।
‘ কে?’ ভয়কে ঢেকে রেখে প্রশ্ন করল শ্রুতি।

উত্তর এলোনা। আরোও দুইবার শব্দ হলো। শ্রুতি উঠে দরজার কাছে গেলে শুনতে পেল পুরুষালী কণ্ঠ, ‘ দরজা খোলো তো শ্রুতি। একটু গল্প করি। আমি তোমার মামা। অনেকদিন পর দেখা হলো তাই গল্প করতে এলাম।’

বাক্যগুলো শ্রুতির বোধগম্য হওয়া মাত্রই সে ছিটকে সড়ে গেল দরজা থেকে। মূহুর্তের মধ্যেই হাত-পা কাঁপতে লাগল অস্বাভাবিক ভাবে। মামা? মা…মা? ওই ভয়ংকর লোকটা! শ্রুতির মনে পড়ে গেল ছোটবেলার ঘটনা।
ছোটবেলায় এই লোক প্রায়ই আসতো শাহিনা এই বাড়ির বউ হওয়ার পরে। এমনই একদিন তাকে হুট করেই কোলে বসিয়েছিল। আদর করার নামে তাকে ভীষণ বাজে ভাবে স্পর্শ করেছিল পিঠে, বুকে। ছোট শ্রুতি বেশি কিছু ঘটার আগেই দৌড়ে গিয়েছিল দাদী, বিভার কাছে। বিভার কাছে সব বলতেই বিভা ভয়ানক ভাবে রেগে যায়। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ষোলো বছর বয়সী শান্ত বিভা ছুটে আসে রান্নাঘর থেকে দা নিয়ে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটাকে কোপ দিতে যায়। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয়ে তাকে বাঁচিয়ে দেয়। বিভার কোপ তার লাগে না। তার আগেই সে সরে যায়। ততোক্ষণে লোকটার চিৎকারে সবাই এসে জড়ো হয় বাড়ির। বিভাকে থামানো হয়। সবার সামনে আমিন শিকদারকে চিৎকার করতে করতে বিভা ঘটনা বলে। চোখ থেকে পড়তে থাকে তার উত্তপ্ত অশ্রু। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে বাবাকে আশ্রয় ভেবে সব কথা বললেও ভাগ্য বিভাকে আশ্রয় দেয়না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমিন সাহেব বিভাকে থাপ্পড় দেয় গালে। থাপ্পড়ের সাথে সাথে ভেঙে দেওয়া হয় ষোলো বছর বয়সী কিশোরীর মনে থাকা বাবার প্রতি সব শ্রদ্ধা, সম্মানকে। সেই দিন থেকে বিভা আমিন শিকদারের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। আর কখনো বিভা আমিন সাহেবকে কিছু বলতে যায়নি, শুধু দাদীর ব্যাপার ছাড়া। দাদীও নিজের ছেলের ওপর থেকে হারিয়ে ফেলে সব আশা, ভরসা। দুই নাতনিকে নিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখেন আর চোখের পানি ফেলেন। দূরে ছোট দোলনায় ঘুমিয়ে থাকে ছোট্ট হামিম।

শ্রুতির সব মনে পড়তেই অসহ্য ব্যথা হতে লাগল বুকে। এই লোক আবার এসেছে কেন? আবারো সেই রকম কিছু করবে? এতোবছর তো বিভা ছিল, দাদী ছিল; এখন তো নেই। কেউ নেই। শ্রুতির মাথা হালকা ঘোরাতে লাগল। সে দুর্বল পায়ে রুমের টেবিল টেনে দরজার সামনে বাঁধা দিয়ে দিল। ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজে পরিবেশ হয়ে উঠল আরোও বিরক্তির!
শ্রুতি নিজেকে বুঝ দিল যে, দরজা ভাঙলেও টেবিলের কারণে আসতে পারবেনা। একদম পারবেনা। শ্রুতি ক্লান্ত হয়ে বিছানায় বসে পড়ল।

.
সবাইকে খেতে দিয়ে বিভা দাঁড়িয়ে রইল। মাহাথির বসতে গিয়েও বসল না। বিভার দিকে তাকালে দেখল বিভা ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে আছে। বিভা, মাহাথির, হাসিনা, সিদ্দীক সবাই একসাথে খাওয়া-দাওয়া করেন। হামিমকে আগে খাওয়ানো হয়। মাঝেমাঝে সিদ্দীক সাহেব অসুস্থতার কারণে আগে খেয়ে নেয়। সবাই একসাথে খায় বলেই বিভার এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকা মাহাথিরের ভালো লাগল না। বিভা মাহাথিরকে প্লেট দিলে সে প্লেট নিয়ে বসে গেল। বিভা মলিনমুখে চলে গেল ঘরে।

মাহাথির ঘরে ঢুকে দেখল বিভা জানালায় মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাহাথির বিছানায় বসতে বসতে বলল, ‘ খেলে না যে? শরীর খারাপ?’
‘ মন খারাপ।’
মাহাথির তাকাল বিভার দিকে। মেয়েটা এতো অসহায় হয়ে কেন বলল? মাহাথির তাকিয়েই রইল। বিভা বাইরে থেকে চোখ ঘুরিয়ে বলল, ‘ শ্রুতি না খেয়ে আছে মাহাথির। আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না।’
মাহাথির বুঝল বিভা কান্না গিলে ফেলছে। মাহাথির নির্নিমেষ চেয়ে রইল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
‘ শ্রুতি খায়নি কেন?’
‘ ও বাবার বাড়িতে। ও আমাকে কিছু বলেনি। কিন্তু আমি বুঝেছি। ও কিছু খায়নি। জানি আমি।’

মাহাথির কিছুই বুঝতে পারল না। এরমধ্যেই বিভা মলিন স্বরে বলল, ‘ ও! আপনি তো চা খাবেন, নিয়ে আসছি দাঁড়ান।’
বিভা চলে গেল। মাহাথির বিভাকে দেখে আশ্চর্য হয়ে উঠল। এই মেয়েটা সবার কথা ভাবে কীভাবে? তাও আবার মন খারাপ নিয়ে? আচ্ছা, বিভার মন খারাপ দেখে কী মাহাথির কষ্ট পেল? সে কী ইদানীং বেশি ভাবছেনা বিভাকে নিয়ে? বিভার অসহায়ত্ব কী তাকেও স্পর্শ করল? মাহাথির শুয়ে পড়ল। ক্ষিদে লেগেছে, অথচ সে খায়নি।
.

শ্রুতি বসে আছে চুপচাপ। ঘুমানোর চেষ্টা করেছিল, আসেনি। এখন বাজে রাত দুইটার মতো অথচ তার ঘুম আসছেনা। শ্রুতির ভাবনার মাঝেই দরজায় আবার আঘাত হলো। আঘাত ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকল। ভয়ে শ্রুতি নেমে গেল খাট থেকে। এরমধ্যেই দরজার বাইরে থেকে বলা হলো, ‘ শ্রুতি মা, দেখো তো আমার ফোনে কী যেন হয়েছে। বুঝতে পারছিনা। সবাই ঘুমে। তাই অযথা তোমাকে বিরক্ত করতে এলাম।’
কিছু ঘন্টা আগের ভয় আবারো মাথাচড়া দিয়ে উঠল। শ্রুতি কী করবে ভেবে পেল না। খাট থেকে ফোন নিয়ে বারান্দার দরজা খুলল। বারান্দায় ঢুকে ভিতর থেকে আটকে দিল। শ্রুতির মনে হচ্ছিল দরজা ভেঙে ফেলবে। দরজা ভেঙে লোকটা ভেতরে ঢুকে যাবে। এখন ভয় নেই। দরজার সাথে টেবিল সরাতে অনেক কষ্ট হবে। আর কষ্ট করে ঢুকেও লাভ হবেনা। বারান্দার দরজা ভাঙতে হবে। শ্রুতির মনে হলো সেদিন যদি বিভা সত্যি সত্যি লোকটাকে কোপ দিত তাহলে আজ এইসব হতোনা। ফোনের সমস্যা নিয়ে রাত দুইটায় কেউ আসে? এতোই বোকা শ্রুতি? শ্রুতি মোটেও বোকা নয়। শ্রুতি বসে পড়ল দেয়াল ধরে।
বিভার কথা ভেবে, পার্থিবের কথা ভেবে ভীষণ অভিমান হলো।

আকাশের চাঁদের দিকে মুখ দিয়ে মায়ের কাছে নালিশ করল শ্রুতি,
‘ আমাকে কেউ ভালোবাসেনা, মা। কেউ ভালোবাসেনা। পার্থিব ভালোবাসে না। আপা ভালোবাসে না। কেউ ভালোবাসে না। সবাই আমাকে বকে। আমাকে তুমি কেন নিয়ে গেলেনা? আমার এখানে অনেক ভয় লাগছে। আমি মরে যাব এখানে।’ ডুকরে উঠল শ্রুতি।

পার্থিবকে ভীষণ মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে এই মূহুর্তে পার্থিবের বুক সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। পার্থিব পাশে থাকলে তার আর কাউকে লাগবে না। কিন্তু পার্থিব কোথায়? সে কেন তাকে চলে আসতে বলল? সব ভুলের মতো এইবারও কেন তাকে ক্ষমা করল না? শ্রুতি ফুঁপিয়ে উঠল।

.
পার্থিব টি-শার্ট পরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ঘরে ভালো লাগছিল না। তাই সিদ্ধান্ত নিল বাইরে বের হবে। গাড়ি নিয়ে বের হয়েই সে নিজের অবচেতন মনে শ্রুতির বাড়ির সামনে এসেই থামল। এরপর….এরপর সেখানে দাঁড়িয়েই পার করল আড়াই ঘন্টা। এসেছিল রাত বারোটার দিকে। এখন রাত আড়াই টা। পার্থিব সিদ্ধান্ত নিল গাড়িতে গিয়ে বসবে।
গাড়িতে বসে চোখ বন্ধ করল। নিজের অবুঝ মনকে বুঝ দিল, সে শ্রুতির একদম পাশে না থাকুক, তবে কাছে আছে। তাদের মধ্যকার দূরত্ব কম না হলেও বেশি নয়। সে আর শ্রুতি এক আকাশের নিচে আছে — এই বা কম কী?
_____
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ২০৬৭
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৩৩.
সূয্যিমামার মিষ্টি আলো ধরনীতে ছড়িয়ে পড়তেই লালিমা কেটে গেল। পৃথিবীর বুক ভরে উঠল স্বচ্ছ, পবিত্র আলোয়। আলোর বাড়ার সাথে সাথে বাড়ল আলোর তীব্রতা, কমে গেল কোমলতা।
সূযের তীক্ষ্ণ আলো চোখের পাতায় পড়তেই চোখ জ্বলে উঠল। পার্থিব আড়মোড় ভেঙে উঠতে গিয়ে আবিষ্কার করল তার ঘাড়ে চাপ ধরা ব্যথা। বেহালে ঘুমিয়ে পড়ার কারণেই হয়তো। পার্থিব গাড়ি থেকে নেমে হাত-পা ছড়িয়ে ব্যয়াম করল। উদ্দেশ্য শরীরের ভাঁজে ভাঁজে থাকা ঘুমকে দূর করা। মাথাটাও ঝিম ধরে আছে। ঘুমটা ভালো হলো না। অবশ্য চোখ লেগেছেই সাড়ে তিনটা/চারটার দিকে। কানের উপরের অংশ থেকে মাথাটা ভীষণ ব্যথা অনুভব হচ্ছে।
পার্থিব নিজের কাজ শেষ করেই একবার বাড়িটার দিকে তাকাল। তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিল। তার কী ভেতরে যাওয়া উচিত? শ্রুতিকে ফিরিয়ে আনা উচিত? মন বলল, যাওয়া উচিত। সে বকেছে বলেই তো মেয়েটা চলে এলো। মস্তিষ্ক বলল, যাওয়া উচিত না। শ্রুতি তার সাথে থাকতে চায়না। কী দরকার মেয়েটাকে কষ্ট দেওয়ার?
মন-মস্তিষ্কের যুদ্ধে জিতে গেল মস্তিষ্ক। পার্থিব একরাশ অসহ্য ব্যথা নিয়ে উঠে পড়ল গাড়িতে। গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল বাড়ির উদ্দেশ্যে। তার অফিস যাওয়া প্রয়োজন। গত কালকের ঘটনার পর তার কাজ বেড়ে গেছে শতগুণ ।

শ্রুতি ভাবে তাকে কেউ ভালোবাসে না। অথচ সে জানতেও পারল না, তার জন্য কেউ সারারাত ভরে অপেক্ষা করেছে।

.
শ্রুতির ঘুম ভাঙল সকাল সকালই। দেয়াল থেকে মাথা তুলে সূর্যের আলোতে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল। তবুও শ্রুতি তাকিয়ে রইল নির্নিমেষ। সূর্যের কী সুন্দর তেজ! শ্রুতির মন ভীষণ ভালো হয়ে গেল। মনে হলো এই আলোর তেজের সাথে সাথে সে নিজের ভেতরেও তেজ অনুভব করছে। মনের সব অন্ধকার কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। শ্রুতি উঠে দরজা খুলল। ফ্রেশ হয়ে গোসল করে নিল। দরজার সামনের টেবিলটা কষ্ট করে সড়িয়ে নিল। এরপর বড় করে একটা শ্বাস ছাড়ল এবং নিল। শ্বাস ছাড়ার সাথে সাথেই যেন তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে গেল সব ভয়, যন্ত্রণা; ভেতরে ঢুকল সাহস, তেজ।
দিনের আলোর কী সুন্দর ক্ষমতা! মানুষের মনের ভয়কে দূর করার সাথে সাথে জোগায় বাঁচার নতুন সাহস, প্রেরণা। দেয় আশ্বাস, বিশ্বাস, ভরসা। শ্রুতি ঘর থেকে বের হতে নিয়েও হলোনা। বের হওয়া মানেই ঝামেলা। কী দরকার শুধু শুধু! তবে হ্যাঁ, দাদীআম্মুর ঘরে যাওয়া যায়।
শ্রুতি দাদীর ঘরে ঢুকে সব দেখতে লাগল। মানুষটা নেই, আর কখনো আসবে না — ভাবতেই ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল। মৃত্যু এতো ভয়ংকর কেন? একটা মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথে কতো মানুষ যে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে তা কী ওই মানুষটা কখনো জানবে?
শ্রুতি খাটের দিকে তাকাল। ভেসে উঠল শৈশবের স্মৃতি। এই ঘরেই তো তার দাদী একহাতে তাকে, অন্যহাতে বিভাকে জড়িয়ে ধরে রাখত।
দাদীর ছবি হাতে তুলে নিল। শাড়িতে মোড়ানো সাধারণ একটা মুখ। কিন্তু শ্রুতির মনে হলো এই পৃথিবীতে যদি সৌন্দর্যের তালিকা করা হয় তাহলে তার মা, দাদী, আপা থাকবে সবার উপরে। ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ দাদী, ফিরে আসো। দেখো আমি এসেছি। এই বাড়িতে এসেছি। কতো বড় বাড়ি! কতো মানুষ! অথচ তোমার শুতির জন্য এই বাড়িতে কেউ নেই। তোমার কী উচিত না ফিরে আসা?’
শ্রুতির ভীষণ ঘুম পেল। সে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা ভালোভাবে বন্ধ করে ফিরে এলো। দাদীর বিছানায় শুয়ে দাদীর বালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেল।

.
মাহাথির বসে আছে নিজের টেবিলে। মুখভাব স্বভাবতই গম্ভীর, শান্ত। একমনে কম্পিউটার টাইপ করে চলেছে। এরইমাঝে মনে পড়ল বিভার কথা। বিভার কথা এখনই মনে পড়ল — এটা ভুল। এখন সবসময়ই মনে পড়ে। মাহাথির মনে করতে চায়না, তবুও মনে পড়ে। সে কী কোনোভাবে মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলল? ভালোবাসা? ভালোবাসা আবার কী? ভালোবাসা কী এতোই সহজ?
মাহাথির নিজের কাজে প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে কাজে মন দিল। তাও যেন মন মানতে চাইছে না। দিন যাচ্ছে আর সে কেমন যেন বিভা কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। এই তো, আজকে সকালবেলা সে রেডি হয়ে বসে রইল। এমনকি নিজেই রান্নাঘরে গিয়ে বিভার হাত থেকে টিফিন নিল। টিফিন নেওয়ার পরেও সে গেলনা, আবার এসে বসেই রইল। মন বলল, এখনো গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ বাকি। বিভার আয়তুল কুরসি পড়ে ফুঁ দেওয়া বাকি। বিভা রান্নাঘর থেকে বেরিয়েই প্রশ্ন করল, ‘ যান নি?’
বলতে বলতেই এগিয়ে এসে মাহাথির এর মাথায় এসে ফুঁ দিয়ে দিল। মাহাথির লক্ষ্য করল, বিভা তার দিকে তাকিয়ে মলিন ভাবে হাসল। এতেও মাহাথিরের ভীষণ আপত্তি হলো। বিভা মলিন হাসবে কেন, অন্যান্যদিন তো কতো সুন্দর করে হাসে। একদম মনের ভেতর থেকে হাসে। মাহাথিরের মনে পড়ল শ্রুতিকে নিয়ে কিছু একটা হয়েছে। তবে সে ব্যাপারটা জানে না। জানতে হবে। তাতে যদি বিভার মন ভালো হয়।
বিভার মন ভালো? মাহাথির, যে কিনা কাজের সময় নিজের খাওয়ার কথাও ভাবেনা সে কিনা কাজের সময় কাজ বাদ দিয়ে ভাবছে বিভার কথা? ভাবতেই পারে। বিভা তার বউ। সংসার করছে দু’জন। তার তো ভাবা উচিত। সাধারণ কারণেই ভাবছে মাহাথির। এখানে বিশেষ কোনো কারণ নেই। ওইসব ভালোবাসা, টালোবাসা কিচ্ছু না। মাহাথির নিজেকে বুঝ দিয়ে কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করল। কতোটুকু সফল হলো কে জানে!

.
শ্রুতির ঘুম ভাঙল একদম বিকেল বেলায়। ঘুম থেকে উঠতেই মাথা চক্কর দিল। চারদিক হালকা অন্ধকার মনে হলো। ঠাসস হয়ে আবারো শুয়ে পড়ল সে। গতকাল থেকে সে না খাওয়া। পানি ছাড়া পেটে কিছু পড়েনি। মাথা তো ঘুরবেই। অস্বাভাবিক কিছু নয়।

শ্রুতি বিছানায় ঠাস হয়ে পড়ে রইল আরোও কতোক্ষণ। এরপর শক্তি জোগাড় করে উঠে বসল। সিদ্ধান্ত নিল বাহির থেকে কিছু কিনে আনবে। শ্রুতি উঠে গেল হাতমুখ ধুতে।
যেই ভাবা সেই কাজ। টাকা দিয়ে বাহির থেকে খাবার কিনে নিয়ে এলো শ্রুতি। হালকা খাবার। খাবার নিয়ে টেবিলে বসে গেল। আশপাশে মানুষ বলতে শাহিনাকে দেখা গেল। মুখ শক্ত করে কাজ করছে নিজমনে। বাকিরা কোথায় কে জানে!

শ্রুতি খেতে শুরু করল। খাওয়ার মাঝখানেই শুনতে পেল,
‘ ইবলিশ শয়তানের ঘুম ভাঙল তবে?’

শ্রুতি তাকিয়ে দেখল আমিন শিকদার দাঁড়ানো। বাসার কাপড়েই আছে। অফিসে যায়নি নাকি? শ্রুতি উত্তর দিল,
‘ শয়তান আমাকে বললেন? আমি শয়তানের ঘুম তো ভেঙেছে সবার আগে। কিন্তু ঘর থেকে বের হইনি। কারণ আপনাদের চেহারা দেখতে ঘেন্না লাগে। এরচেয়ে রুমে বসে মুরগির মতো ঝিমানো অনেক ভালো কাজ। তাই রুমে ঘুমাচ্ছিলাম। কেন? আমাকে মিস করছিলেন নাকি আমিন শিকদার?’

‘ এক টা যে চড় দিব না গাল একদম ফাটাই দিব। বান্দির বাচ্চা। শ্বশুরবাড়ি থেকে চইলা আসিস, আবার বড় বড় কথা? বাপের মুখ, আমাদের মুখ দেখতে ঘেন্না লাগে?’ শাহিনা গর্জন করতে করতে এগিয়ে এলো। এমনিতেই সে শাহিনাকে সহ্য করতে পারে না তারউপর গালাগালি। গালাগালি শুনে শ্রুতির মুখ শক্ত হয়ে গেল। এতো বিশ্রী কেন এই মহিলা? তাও হেসে দিল,

‘ বান্দি টা কে শাহিনা বেগম? আমিন শিকদার? আমিন শিকদার বান্দি হলে আমার কোনো সমস্যা নেই। সে বান্দি আই মিন গালি হওয়ারই যোগ্য।’

আমিন শিকদার এইবার অস্বাভাবিক রেগে গেল। নিজের এমন অপমানে বোধজ্ঞান হারিয়ে চিল্লিয়ে উঠল,
‘ বান্দি তোর মা।’
শ্রুতি খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। নিজের বাবার এমন নোংরা ব্যবহারে, অশ্রাব্য মুখের ভাষায় বমি পেয়ে গেল শ্রুতির। ঘৃণার শরীর রি রি করে উঠল। সাথে নিজের মৃত মায়ের কথা উঠিয়ে যেন গরম তেলে পানি ছিঁটানোর মতো কাজ করা হলো। শ্রুতি চিৎকার করল, ‘ একদম আমার মাকে নিয়ে কথা তুলবেন না। আপনার মুখে আমার মায়ের নাম মানায় না। আপনার মতো একটা নোংরা, পিশাচ, জঘন্য মানুষ যদি আর একবার আমার মাকে নিয়ে কথা বলেন তাহলে আমি আপনার জিহ্ব টেনে ছিঁড়ে দিয়ে রাস্তার কুকুরদের খাওয়াব।’

আমিন সাহেব তেড়ে এলো। শ্রুতির সামনে থেকে খাবার নিয়ে উল্টে ফেলে দিল মেঝেতে। আমিন সাহেবের আর কিছু বলার আগেই কলিংবেল বেজে উঠল অনেক জোড়ে। কমপক্ষে আট/নয় সেকেন্ড ভরে বাজল। মনে হল কেউ ভীষণ ক্ষোভ নিয়ে বাজাল। শাহিনা দ্রুত গিয়ে সদর দরজা খুলে দিল। দরজার সামনে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত মীর আসাদুজ্জামান দাঁড়ানো। শ্রুতি, শাহিনা, আমিন সবার দৃষ্টিই তখন আসাদ সাহেবের দিকে। হতবাক হয়ে চেয়ে রইল সবাই।
আসাদ সাহেব ভদ্রভাবে সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকল।

ভেতরে ঢুকে সে তার তীক্ষ্ণ চোখে সব পর্যবেক্ষণ করল। নিচে খাবার পড়া, শ্রুতির হাতে খাবারের অংশ লেগে থাকা, আমিন সাহেবের রাগের রেশভরা চেহারা। সব বিবেচনা করে সে চুপ করে রইল।

শ্রুতি আসাদ সাহেবকে দেখে মাথা নিচু করে ফেলল। এই মানুষটাকে সে অসম্ভব শ্রদ্ধা করে। তবুও, নিজের অজান্তেই কীভাবে যেন ভুল হয়ে গেছে। শ্রুতি জানলে এমনটা কখনোই করতো না। শ্রুতির ভীষণ ভয় লাগছে। আসাদ সাহেব কী তাকে বকবে? বকার জন্যই বুঝি এসেছে? অজানা ভয়ে শ্রুতির চোখে পানি জমা হতে শুরু করল।

আসাদ সাহেব এগিয়ে গেল শ্রুতির দিকে। কালই তাকে তানহা বলেছিল যে শ্রুতি চলে গেছে, আর নাকি আসবেনা এমন বলেছে শ্রুতি। সাথে ছিল তানহা বেগমের দুশ্চিন্তা ভরা কিছু কথা। তানহা বেগমের দুশ্চিন্তা দেখে তাকে ধীরেধীরে সে ঘটনা বললে তানহা বেগম ভীষণ অবাক হয়। সাথে সরল মনে নিজের মত দেয় যে, শ্রুতির কোনো দোষ নেই। বেচারি হয়তো বাবার ওপর অনেক রাগ। তাছাড়া আমিন সাহেবও শ্রুতি-বিভার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা যে বলেনা তাও জানাল। নিজের স্বামীকে শ্রুতির দাদীর মৃত্যু দিনে করা আমিন শিকদারের ব্যবহার এর কথা বলতেও ভুলল না তানহা। সব শুনে আসাদ সাহেব বুঝলেন যে আমিন সাহেবের মাঝেই সমস্যা। সেই তাদের সন্তানদের আগলে রাখতে পারেনি। যার ফলস্বরূপ শ্রুতি, বিভা, হামিম সবাই তার থেকে দূরে চলে গেছে। এছাড়া আমিন শিকদার তাকে অনেক মিথ্যে কথা বলেছে। তাকে বলা হয়েছিল শ্রুতি, বিভা, হামিম শাহিনা আর তার ছেলে-মেয়ে। অথচ বিয়ের পরে সে জানতে পেরেছে শাহিনা বেগম তার দ্বিতীয় ঘরের বউ। এমনভাবে অনেক মিথ্যে কথাই আমিন সাহেব তাকে বলেছে। সব ভাবতেই আসাদ সাহেবের মুখ শক্ত হয়ে গেল।

এরপর আজ সকালেই আসাদ সাহেব অফিসে গিয়ে ভাবছিল শ্রুতির কথা। শুধু শুধু মেয়েটা চলে গেছে রাগ করে। না জানি ওই ঘরে কতো ঝামেলা হচ্ছে! একটা ভুল করেছে তাই বলে বাড়ি ছেড়েই চলে যেতে হবে নাকি? সব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে যাওয়ার পথে শ্রুতিকে নিয়ে যাবে। তাই তো ছেলেকে অন্য গাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে সে এসে পড়ল। আসতে আসতে ঠিক করেছে বাড়িতে গিয়ে পার্থিবের গালে একটা চড় বসাবে। বউ চলে এসেছে অথচ তার কোনো চিন্তাই নেই? চিন্তা নেই ব্যাপারটা এমন নয়। পার্থিব আজ অফিসে অনেক অন্যমনস্ক ছিল যা আসাদ সাহেব লক্ষ্য করেছে। আসলে ঘরে শান্তি না থাকলে কোথাওই শান্তি নেই।

‘ বাবা, তুমি এখানে?’
সবাই পিছন ফিরে দেখল পার্থিব দাঁড়ানো। শ্রুতিসহ সবাই ভীষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল পার্থিবের পানে।

‘ তুমি এখানে কী করছো?’ আসাদ সাহেব গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করল।

পার্থিব কী বলবে ভেবে পেল না। সকালে অফিসে গেলেও কোনোমতে মন কাজে বসেনি। শুধু ভেবেছে শ্রুতি কেমন আছে, খেয়েছে কিনা, তার বাবা তার সাথে অতিরিক্ত খারাপ ব্যবহার করছে কিনা, শ্রুতি কাঁদছে কিনা। সব দুশ্চিন্তা মিলে তার অবস্থা ছিল নাজেহাল। তাই সকাল বেলা মস্তিষ্ককে জিতিয়ে দিলেও দুপুরবেলা অফিসে বসে মনকে জিতিয়ে দেয় পার্থিব। মনে মনে ঠিক করে যাওয়ার পথেই শ্রুতিকে নিয়ে ফিরবে। লাগবেনা শাস্তি দেওয়া। তাছাড়া শ্রুতি তো এতোদিন ভালোই ছিল, সেই শুধু শুধু মেয়েটাকে কষ্ট দিয়েছে। ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শ্রুতির কাছে আসবে। অফিস শেষ হতে বাবার অন্য গাড়িতে যাওয়া যেন হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো আনন্দ দিল পার্থিবকে। এইবার সে শ্রুতিকে নির্দ্বিধায় আনতে যেতে পারবে। বাবাকে একশোটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবেনা। কিন্তু একি! এখানে এসে বাবাকে দেখে নিজেই চমকে গেল পার্থিব।

‘ তেমন কিছুনা বাবা। শ্রুতির কাছে এসেছিলাম।’

আসাদ সাহেব আর ঘাঁটল না। শ্রুতির দিকে ফিরে বলল, ‘ এই বাড়িতে এসেছো কেন কাউকে না বলে?’
এতোক্ষণ শ্রুতি, আমিন, শাহিনা নিরব দর্শক হয়ে থাকলেও এখন শ্রুতিকে নিরব দর্শকের আসন ছেড়ে দিতে হলো। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছে। উত্তর দেওয়া প্রয়োজন। অথচ শ্রুতি কিছু বলল না।
আসাদ সাহেব ফের প্রশ্ন করল, ‘ রাগ করে চলে এসেছো?’
শ্রুতি মাথা নিচু করে বলল, ‘ সরি।’
‘ সরি কোন কারণে।’
শ্রুতি আবারো নিরব রইল।
‘ সরি কীসের জন্য? চলে আসার জন্য নাকি গতপরশুর বোকামোর জন্য?’
‘ দু’টোর জন্যই।’ মিনমিন কণ্ঠে বলল শ্রুতি। কথা গলা দিতে বেরই হতে চাইছেনা। কেমন আটকে আসছে।
‘ দু’টো কাজের জন্য একটা সরি?’
শ্রুতি চোখ তুলে তাকাল। আসাদ সাহেবের মুখভঙ্গি গম্ভীর। মজা তো করছে না। শ্রুতি বলল, ‘ সরি। সরি।’
‘ আরেকটা সরি তোমার বলা উচিত কাউকে না বলে আসার জন্য। বিপদ হতে পারত।’
‘ সরি।’
আসাদ সাহেব ঠোঁটে হালকা হাসি ফোঁটাল। মেয়েটা যেমন কঠিন, তেমন নরম। একটু আগে বাহির থেকে সব কথাই সে শুনেছে। আমিন শিকদার, শাহিনা বেগম, শ্রুতির সব কথাই তার কানে এসেছে। শ্রুতির কোনোপ্রকার দোষ আসাদ সাহেব দিবেনা। শ্রুতি তার জায়গায় ঠিক বলেই মনে হলো আসাদের। সে শ্রুতির মাথায় হাত দিয়ে গম্ভীরমুখে বলল, ‘ আমি তোমাকে বকা দিয়েছিলাম? রাগারাগি কিংবা ধমক দিয়েছিলাম?’
শ্রুতি তাকিয়ে না বোধক উত্তর দিল।

‘ তাহলে? রাগারাগি, ধমকাধমকি কিছুই করিনি। শুধু বলেছিলাম এমনটা আশা করিনি। এটাই কী বাবা হিসেবে ভুল হয়েছে?’

শ্রুতি আবারো না বোধক মাথা নাড়ল। আসাদ সাহেব বলল, ‘ তাহলে চলে আসা কী উচিত হয়েছে বিনাকারণে?’

শ্রুতি আসাদ সাহেবের পাশে দাঁড়ানো পার্থিবের দিকে তাকাল। পার্থিব শ্রুতির দিকেই তাকিয়ে ছিল। শ্রুতি পার্থিবকে চারশো বিশ বোল্টের শক দিয়ে পার্থিবের দিকে আঙুল তাঁক করে উত্তর দিল,
‘ উনি। উনি আমাকে বকা দিয়েছে।’

শ্রুতির কথায় পার্থিব ভ্রু কুঁচকে ফেলল। শ্রুতি কারোর ধার ধারল না। পার্থিবের দিকে আঙুল তাঁক করে বলতেই থাকল,
‘ উনি আমাকে সেদিন অনেক বকেছে। রাগারাগি করেছে। ধমকাধমকিও দিয়েছে। বলেছে আমি যাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। আর কোনোদিনো যাতে ওই বাড়িতে না যাই। আরোও বলেছে ওই বাড়িতে দেখলে আমাকে মারবে। মেরে খুন করবে।’

শ্রুতির অনর্গল মিথ্যে কথায় পার্থিব মুখ হা করে ফেলল। কী বলা যায় তার ভাষা খুঁজে পেল না। একবার নিজের বাবা, একবার শ্রুতির দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে কিছু বলতে চেষ্টা করলেও হলোনা।
অন্যদিকে আসাদ সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়ল শ্রুতির কথা শুনে। তার ছেলে এইসব করেছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আসাদ সাহেব মনে মনে হেসে ফেলল। শ্রুতি মেয়েটা একটু বেশিই বলে ফেলেছে। রাগারাগি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলে আসাদ সাহেব বিশ্বাস করতো। কিন্তু মারামারি পর্যন্ত চলে যাওয়ায় সে বুঝল শ্রুতি মিথ্যা বলছে। আসাদ সাহেব পার্থিবের দিকে শক্ত কণ্ঠে বলল,
‘ তোমার থেকে এমনটা আশা করিনি। এই শিখিয়েছি এতোদিন? নিজের বউকে মারতে চাও? ধমক দাও? এই তোমার ব্যক্তিত্ব? যাও ক্ষমা চাও।’
পার্থিব নিজের বাবার দিকে একবার তাকিয়ে শ্রুতির দিকে তাকাল। কী পরিমাণ বদমাইশ মেয়ে! মিথ্যা বলে নিজের স্বামীকে বকা খাওয়াচ্ছে। পার্থিব রা করল না। যদি বিনাদোষে ক্ষমা চাইলে শ্রুতি তার সাথে যায় তবে তাই সই। পার্থিব শ্রুতিকে বলল,
‘ ক্ষমা করে দিন শ্রুতি। রাগ করে ঠিক করিনি।’

শ্রুতি মাথা নিচু করে নিল। একদম উচিত কাজ হয়েছে। আমাকে বাসায় চলে আসতে বলা তাইনা? অসভ্য লোক!
‘ এইবার বাড়ি যাওয়া যাক?’ নরম কণ্ঠে বলল পার্থিব। শ্রুতি কিছু বলল না। অভিমান, রাগ নিয়ে মাথা নিচু করে রইল। এইবার আসাদ সাহেব বলল,
‘ যাবেনা বাড়ি?’
‘ আপনার সাথে যাব বাবা। উনার সাথে না। উনি আমাকে গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে।’
পার্থিব অস্বস্তিতে বার কয়েক চোখের পলক ফেলল। এই মেয়ে শুরু করেছেটা কী! মান-সম্মান তো কিছু রাখবেনা দেখছি।
‘ আচ্ছা তাহলে আসো।’ আসাদ বলল।
‘ দাঁড়ান। হাত ধুয়ে আসি।’
শ্রুতি হাত ধুয়ে এসে বলল, ‘ চলুন, বাবা।’

দু’ কদম এগিয়ে গিয়েও থেমে গেল শ্রুতি। পিছন ফিরে বলল, ‘ বাবা, আমার ব্যাগ আনতে হবে। উনাকে বলুন আম্মুর রুম থেকে ব্যাগ নিয়ে আসতে।’
শ্রুতির বাধ্য বাবা হয়ে আসাদ সাহেব পার্থিবকে তাই বলল। পার্থিবও উঠে গেল উপরে।
পার্থিব ব্যাগ নিয়ে ফিরতেই শুনতে পেল আসাদ সাহেবের কণ্ঠ, ‘ বেয়াই, আমাদের সম্পর্ক পারিবারিক, ব্যবসায়িক দুই ভাবেই। তবে আমি আর চাইছিনা ব্যবসায়িক সম্পর্ক রাখতে। আজ থেকে আপনার সাথে আমার ব্যবসায়িক কোনোপ্রকার লেনদেন নেই। যা আছে পারিবারিক। আশাকরি বুঝতে পারছেন কী বলছি। আর শুনুন, সময় থাকতে নিজের ভিত্তি গড়তে হয়। যাতে মৃত্যুর সময় ভিত্তির উপর বাঁচা যায়। আমরা মানুষেরা বৃদ্ধ বয়সে ভালোবাসা, যত্ন খুঁজি। অথচ তার জন্যেও যৌবন বয়সে সময় ব্যয় করতে হয় পরিবারের পিছনে। মৃত্যুর সময় আমি এইটার হিসাব নিবনা যে কোন ব্যাংকে কতো টাকা আছে, কতো জমি কিনেছি। মৃত্যুর সময় আমি খুঁজব ভালোবাসা। স্ত্রীর ভালোবাসা, সন্তানের ভালোবাসা, ভাই-বোনের ভালোবাসা। তাদের ভালোবাসাতে আমার মৃত্যু সুন্দর হবে। টাকা, পয়সাতে নয়। তাছাড়া ধার্মিক নিয়মাবলি তো আছেই। টাকার পেছনে না ছুটে আমাদের উচিত সম্পর্কের পিছনে ছুটা। একটা সময় পরে গিয়ে আমার সম্পর্কের ভালোবাসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠি, টাকার জন্য না। আসছি, ভালো থাকবেন। এমন কিছু আমাদের করা উচিত নয় যাতে পরে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়।’

শ্রুতি, পার্থিব, আসাদ সাহেব বেরিয়ে গেল একসাথে।
আমিন, শাহিনা রণমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমিন সাহেবের মন চাইল আসাদ সাহেবকে থাপ্পড় মেরে তার জ্ঞানী কথা বের করে দিতে।
.

শ্রুতি বেরিয়ে দেখল দু’টো গাড়ি। পার্থিব শ্রুতির ব্যাগ নিয়ে নিজের গাড়ির পেছনের অংশে তুলল। তা দেখে শ্রুতি আসাদ সাহেবের কাছে এসে বলল, ‘ বাবা, আপনার গাড়িতে যাই?’
ব্যাগ রেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল পার্থিব। এই মেয়েটা শুরু করেছে কী!
পার্থিবকে অবাক করে দিয়ে আসাদ সাহেব তার আদরের পুত্রবধূকে নিয়ে গায়েব হয়ে গেল। পার্থিব আহাম্মক বনে দাঁড়িয়ে রইল। ভ্রু কুঁচকে বসতে বসতে বলল,
‘ দোষ করেও জিতবে, রাগ দেখিয়েও জিতবে। ভাগ্যগুণে বউ পেয়েছি।’

______
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ২৪১৯
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান