একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-৪৩+৪৪

0
200

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৪৩.
মনের পরিবর্তন কেবল মানুষের নয়, দিনেরও হয়। তাইতো দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুভূতির সাথে সাক্ষাৎ হয়ে যায়। ভোর যেমন তার স্নিগ্ধ আলোয় স্নান করায়, সকাল-দুপুরের মধ্যভাগ তেমন সূর্যের রণচণ্ডী রূপের দর্শন করায়। দুপুর যেমন শুনশান নিরবতায় কাটে, সন্ধে তেমনই নিঃসঙ্গ করে তোলে। সে এক ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা! সন্ধ্যাবেলার কাজই বুঝি মন খারাপ করিয়ে দেওয়া? কেমন একলা একলা অনুভব হয়। মনে হয় চারদিকে কেউ নেই, কোথাও নেই। কিছু করার নেই। অকারণেই ইচ্ছে করে বাসা ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। এক অচেনা-অজানা জায়গায় ঘর বানাতে। আর সেখানে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করে মন ভালো করতে।
নিঃসঙ্গতার সময় নিজের মনের কথা যদি কাউকে বলা যেত, তবে হালকা হওয়া যেত। কিন্তু নিঃসঙ্গতায় আমরা ভাবি সব আজগুবি, অবান্তর কথা। অবান্তর কথা যাকে তাকে বলা যায়না। বলতে হয় একান্ত, আপন মানুষদের। আর যাদের আপন মানুষ নেই তাদের সেই মন খারাপ নিয়েই পার করে দিতে হয় গোটা এক সন্ধ্যা।

এই ভর সন্ধ্যায় নিজের ছেলেকে এইভাবে বসে থাকতে দেখে ভীষণ অবাক হলেন হাসিনা। এগিয়ে এসে বললেন,
‘ আব্বা, ঘরে না গিয়ে এইখানে বইসা আছো ক্যা?’

মাহাথির চোখ তুলে তাকাল। এক গাল বাঁকিয়ে মলিন হেসে বলল,
‘ এমনিই আম্মা।’

হাসিনা মানলেন না। তার ভেতর বসবাসকারী ‘মা’ সত্ত্বা তাকে মানতে দিল না। মাহাথিরের রুক্ষ, পুরু চুলে হাত গলিয়ে দিল। স্নেহ কণ্ঠে বলল, ‘ মনটা ভালো না?’

‘ ভালো আম্মা। আপনি অযথা চিন্তা করেন।’

‘ বিভারে নিয়া চিন্তা করো?’

মাহাথির শিশু বাচ্চার ন্যায় দু’পাশে মাথা নাড়ল। যার অর্থ সে চিন্তা করেনা। হাসিনা বলল, ‘ মায়েরে কও। মনটা হালকা লাগব।’

মাহাথির চুপ করে রইল। নিজের অনুভূতি সে কাউকে বলতে পারেনা। অস্বস্তি হয়। মনে হয় মানুষটা বুঝবেনা কিংবা হাসবে। এই ভেবে সে হাজার দুঃখ, যন্ত্রণা, মন খারাপ নিজের মধ্যে পুষে রাখে। আসলে অন্তর্মুখী মানুষের স্বভাবই বোধয় এমন।

নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ মনে হয়, মনে হয় সে কে যে তার কথা কেউ গুরুত্ব দিয়ে শুনবে? সে কে যে তার অনুভূতির কেউ মূল্য দেবে?
প্রকৃতপক্ষে, দিয়েছে। মূল্য দিয়েছে। বিভা দিয়েছে। বিভা তার যত্ন, ভালোবাসায়, কথায় সবসময় মাহাথিরকে মনে করিয়েছে সে বিশেষ কেউ। তাই মাহাথিরও ভীষণ সাহস করে কেবল বিভার দিকে নিজের অনুভূতি নিয়ে এগিয়েছে। খুব সাহস করে নিজের অনুভূতি বলেছে। অথচ সে যখন এগোলো, বিভা তখন পিছিয়ে গেল। এই পিছিয়ে যাওয়াটাই মানতে পারছেনা মাহাথির। নিজের অনুভূতিই নিজেকে নিজের কাছে তুচ্ছ করে তুলছে। দুর্বল করে তুলছে। একবার মনে হয়, বিভা অভিমান করেছে। তার ভালোবাসায় সেই অভিমান ঠিক ভেঙে যাবে। আবার মনে হয়, বিভা আর কোনোদিন তাকে মানবেই না। এভাবেই দূরে সরিয়ে রাখবে। সবাই দেখবে তারা স্বামী-স্ত্রী। সবচেয়ে কাছের সম্পর্ক; অথচ তাদের মধ্যেই থাকবে সবচেয়ে বেশি দূরত্ব। ব্যাপারটা আদৌও সহনীয়?

মাহাথির শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ আমি ভীষণ খারাপ। তাই না আম্মা?’

হাসিনা ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ কে বলসে বাবা? এই কথা তোমারে কে বলসে?’

‘ আমি বুঝতে পারি, আম্মা। আমি যেমন তেমন কোনো ভালো মানুষ হতে পারেনা।’

হাসিনা মাহাথিরকে ভীষণ আদর করে বুঝাতে চাইলেন, ‘ এই দুনিয়ায় একদম পবিত্র কোনো মানুষ হয়না। মানুষ মাত্রই ভুল। মানুষ ভুল না করবে ভুল করব কে? তাই এই পৃথিবীতে যারা বিবেক অনুযায়ী কাজ করে তারাই খাঁটি মানুষ, যারা নিজেদের ভুল শুধরাই নেয় তারাই খাঁটি মানুষ। তুমি যদি কোনো ভুল কইরাও থাকো, শুধরাই নেও বাবা। তাইলেই হইয়া গেল।’

‘ কাউকে অবহেলা করার ভুল কীভাবে শুধরাব?’

হাসিনা থেমে গেলেন। মনে মনে নিজেকেই বকলেন কতোক্ষণ। তার মাথা থেকে বের হয়েই গেছিল যে মাহাথিরের ধ্যানজ্ঞান জুড়ে এখন শুধুমাত্র বিভার চিন্তা। অথচ সে কিনা এতোক্ষণ ধরে কারণ খুঁজার আশায় মরছিল। হাসিনা কিছু বলতে চাইছেনা। বিভার এই ব্যাপারটা নিয়ে সেও বেশ রাগান্বিত ছেলের উপর। তাই কিছু বলার ভাষা পেল না। ঠিক করলেন উঠে পড়বে। এই ছেলের সাথে সে বেশিক্ষণ রাগ দেখাতে পারেনা। ছেলেটার মুখের দিকে তাকালেই ইচ্ছে করে কপালে দু’টো চুমু খেতে।

মাহাথির সামনে দৃষ্টি রেখে ভাবুক কণ্ঠে বলল, ‘ আম্মা! আপনি আমাকে দেখে বুঝে ফেললেন আমার মন খারাপ। বিভা কেন বুঝেনা?’

হাসিনা নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে রইল। কী মায়াময় অভিযোগ তার ছেলের! হাসিনার মনে হলো ছোট কোনো বাচ্চা তার মায়ের কাছে যেভাবে অভিযোগ করে, মাহাথিরও ঠিক একইভাবে অভিযোগ করছে। হাসিনাকে কিছু বলতে হলোনা, মাহাথির একাই বলল,
‘ আমি কখনো কাউকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলিনি আম্মা। বিভাকে বলি। কিন্তু ও সেটা মানে না। মানলেও রাগ হয়, বিরক্ত হয় আমার উপর। আমার এতে খারাপ লাগে। ওকে ভালো-মন্দ বলার অধিকারও আমার নেই? আমি চাই নির্বিকার থাকতে। চাই বিভার ব্যবহারে কিছু আসে যায়না ধরনের ব্যবহার করতে। করিও। ওর রাগ মেনে নেই, বিরক্তি মেনে নেই। কিন্তু আমি কষ্ট পাই আম্মা। আমি সত্যি কষ্ট পাই।’

হাসিনা চুপ করে শুনতে লাগলেন ছেলের কথা। মাহাথির শান্তকণ্ঠে আবারো বলল,
‘ ও তো জানে আমি কিছু বলতে পারিনা, বুঝাতে পারিনা। তাও তো কতো চেষ্টা করছি। সেটা কেন ও দেখছে না? আমি অন্য স্বভাবের হয়েও ওর কাছে প্রকাশ করতে যাই, ওর কী উচিত না আমাকে বোঝা?’

থেমে গেল মাহাথির। মেঝের টাইলসের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। আপনমনে আবারো নিজের প্রতি অভিযোগ তুলল,
‘ আমি যতোটুকু অনুভব করি তার একাংশ’ও বুঝাতে পারিনা। আমি এমন কেন আম্মা? দোষ তো আমারই।’

হাসিনা ছেলের পিঠে হাত বুলাল,
‘ এমনে মন খারাপ করেনা। বউ রাগ করছে, মান করছে। তাই বইলা তোমারে ভালোবাসেনা এমন তো না। সে তোমারে ভালোবাসে, বাবা। তাইতো আমি খাওয়াইতে গেলে আগে জিগ্যেস কইরা নেয় তুমি খাইসো কিনা। তোমার খোঁজখবর নেয়। ভালো সেও বাসে, তুমিও বাসো। এখন রাগ কইরা আছে কিছুদিন পর ভাঙব। আর এমনেও এই সময়ে মন-মেজাজের ঠিক-ঠিকানা থাকেনা। তাইজন্য হয়তো বেশি রাগ করতেসে। তোমার ওপর রাগ না আব্বা, মাইয়াগো এই সময়ে কিছু ভালো লাগেনা। তাই সবকিছুতে বেশি বাড়াবাড়ি হয়। রাগ যেমন বেশি হয়, দুঃখ’ও বেশি হয়। তোমার উচিত বিভার পাশে থাইকা ওরে সাহস দেওয়া।’

মাহাথির মায়ের কথা শুনল। সে তো বিভার পাশে আছে; কই বিভা তো তার পাশে নেই।

.
পার্থিব রুমে ঢুকল। রুমের কোথাও তার মহারানির অস্তিত্ব নেই। পার্থিব বারান্দায় এগিয়ে গেল। শ্রুতি প্রতিদিনের মতোই বাইরে তাকিয়ে আছে। মুখ দেখা যাচ্ছেনা। তবে পার্থিব বেশ ভালোই বুঝতে পারছে শ্রুতির মুখভঙ্গি কঠিন আকার ধারণ করে আছে। তার কারণ’ও অবশ্য পার্থিব। কাল রাতে মজা করেছিল। গোটা এক দিন পেরিয়ে গেল। আজ রাত নেমে এলো অথচ শ্রুতির রাগ ভাঙল না। পার্থিব নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরল। মেয়েটা রাগের থেকেও বেশি কষ্ট পেয়েছে। মজাটা করা আসলেই উচিত হয়নি।

পার্থিব নিজের হাতের এক কাপ কফি গ্রিলে বসাল। পেছন থেকেই জড়িয়ে ধরল শ্রুতিকে। শ্রুতি বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। পাথরের ন্যায় স্থির। পার্থিব সরল কণ্ঠে বলল,
‘ রাগ করেছেন?’

‘ বেশি রাগ করেছেন?’

‘ কথাই বলবেন না?’
তিনটা প্রশ্ন থেমে থেমে করল পার্থিব। মাঝে সময় দিল উত্তরের। তবে শ্রুতি সেই সময়ের সৎ ব্যবহার করল না। শান্ত রইল আগের মতোই। পার্থিব শ্রুতির কাঁধে চুমু খেল গাঢ় করে, ‘ এই শ্রুতি…..কথা বলেন। আপনার ঝাঁঝালো কণ্ঠ না শুনলে পেটের ভাত হজম হয়না আমার। এক্ষুনি খেয়ে এলাম। হজম করতে সাহায্য করুন। প্লিজ।’
করুণ কণ্ঠের বাণী বিশেষ সুবিধা করতে পারল বলে মনে হয়না।

‘ আপনি চান না আমার পেটের খাবার হজম হোক? আপনি চান আপনার স্বামীর বদহজম হোক?’ সন্দেহপূর্ণ কণ্ঠে বলল পার্থিব। পার্থিবের এমন কথায় শ্রুতি খরখরে কণ্ঠে বলল, ‘ সমস্যা কী? ঘরে যান। একা থাকতে দিন আমাকে।’

‘ বিয়ে করে একা থাকা যায়না শ্রুতি। বিয়ের পর স্বামীর সাথে থাকতে হয়। স্বামীর পাঞ্জাবি ধরে।’ বিজ্ঞ, গম্ভীর, রসাত্মক কণ্ঠের কথায় শ্রুতি মুখ কুঁচকে ঘুরল।

পার্থিব হাসিমুখে বলল, ‘ স্বামীরা বউ এর আঁচল ধরে ঘুরতে পারলে, বউদেরও উচিত স্বামীর পাঞ্জাবি ধরে ঘোরা। তাই না?’
শ্রুতি শক্তমুখে দৃঢ়তা নিয়ে বলল, ‘ না। উচিত নয়। ইনফ্যাক্ট এটা সম্ভবই নয়। স্বামীরা যদি তাদের বাকি তিন বউ এর সাথে সময় কাটায় তাহলে পাঞ্জাবি ধরে ঘুরবে কখন আরেক বউ?’

পার্থিব ঠোঁট চেপে চেয়ে রইল তার স্ত্রীর দিকে। মেয়েটার কথাগুলো কিছুটা এলোমেলো হলেও কথার দ্বারা নিজের উদ্দেশ্য পূর্ণ করেছে। উদ্দেশ্য ছিল পার্থিবকে ঠেস দেওয়া। শ্রুতি সেখানে সফল। পার্থিব তার বউ এর বাচ্চামোতে হাসতে গিয়েও হাসল না। বলল, ‘ আমার তো একটাই বউ শ্রুতি। তিন বউ এর ঝামেলা নেই। আপনি চাইলে আমার পাঞ্জাবি ধরে ঘুরতে পারেন। তবে আমি এখন গেঞ্জি পরা। আপনি বললে পাঞ্জাবি পরে আসব।’

পার্থিবের কথায় শ্রুতির গায়ে আগুন জ্বলল, ‘ ফালতু কথা না বলে ঘরে যান। তিন বউ নেই। হতে কতোক্ষণ!’

পার্থিব আর রাগাতে চাইল না। দু’হাত টেনে আদরস্বরে বলল, ‘ ম্যাডাম, এই অধমের ভুল হয়েছে আপনার সাথে মজা করে। আর কক্ষনো আমি আপনার সাথে এই ধরনের মজা করবনা। একদম প্রমিজ। তাও আর রাগ করবেন না। অধমের ওপর একটু সহায় হোন।’

শ্রুতি নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। মুখথেকে গম্ভীর ভাব সরছে সরছে। পার্থিব আঁজলায় মুখ তুলে নিয়ে ভীষণ যত্ন নিয়ে। মন্থর কণ্ঠে বলল, ‘ আপনাকে সামলাতে গিয়েই আমি আকাশ ভরা তারা দেখি। আপনার মনে হয় আপনাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করার মতো দুঃসাহস আমি করব? জানের ভয় আছে আমার। দ্বিতীয় বিয়ে করার….’

গর্জে উঠল শ্রুতি, ‘ খু/ন করে ফেলব একদম আবার যদি বিয়ের কথা শুনি। বিয়ে করতে হলে আমাকে করবেন। একবারে মন না ভরলে হাজার বার করবেন। কিন্তু অন্য কাউকে না। কাউকে না। বুঝেছেন?’

শ্রুতি ধমকে ধমকে বললেও তার গলায় কান্নার আভাস। কান্না গিলে গিলে ভীষণ কষ্ট করে কথাগুলো বলল শ্রুতি। চোখের কোল ভর্তি পানি। পার্থিব বেতের এক চেয়ারে বসে টেনে নিল শ্রুতিকে। শ্রুতিকে কোলে বসাতেই চোখের বড় বড় অশ্রুকণা পড়তে লাগল টপটপ করে। পার্থিব নিজের আঙুলের মাথা দিয়ে ভীষণ যত্ন করে ফোঁটাগুলোকে নিজের আঙুলে তুলল। শ্রুতি চোখ মুছতে হাত উঠাতে গেলেই পার্থিব তার অন্য হাতে শ্রুতির হাত আটকে ধরল। নিজেই যত্ন নিয়ে মুছিয়ে দিল শ্রুতির চোখ। বুক টেনে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ এমন বাজে ধরনের মজা আমি আর কখনো করব না শ্রুতি। আপনার কান্না আমার একদম ভালো লাগেনা। আপনাকে কাঁদাতে চাইনি, জাস্ট জেলাস করাতে চেয়েছি। শুধু দেখতে চেয়েছিলাম আমার প্রতি পাগলামি। তবে এই যে কান ধরছি, আর জীবনেও এমন করবনা। আমি বুঝে গেছি যে আমার প্রতি আপনার অনুভূতি কতোটা প্রখর!’

শ্রুতি চোখ পাকিয়ে তাকাল পার্থিবের দিকে। পার্থিব তখনো কান ধরা অবস্থায় বসে আছে। শ্রুতি জড়িয়ে ধরল পার্থিবের কাঁধ। কাঁধে মাথা দিয়ে পরে রইল বিনাশব্দে।
বেশ কিছু সময় পর পার্থিব হাত বুলিয়ে দিল মাথায়। বলল, ‘ সরি, বলেছিতো। তাও মন খারাপ কমেনি?’

‘ আপনি সত্যিই আমাকে ভালোবাসেন?’

শ্রুতির এমন কথায় পার্থিব শ্রুতির বাহুতে, হাত উঠিয়ে হাতের পাতায় চুমু খেল। বলল,
‘ সত্যিই বাসি। আপনি ছাড়া কাকে বাসব? পার্থিব তার শ্রুতিকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসে না। বাসতে পারেই না।’

‘ আমার আব্বু কেন আমার আম্মুকে বাসল না, পার্থিব?’
শ্রুতির এমন মলিন কণ্ঠের কথায় চুপ করে ফেলল পার্থিব। বুঝতে পারল মন খারাপ টা তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও গড়িয়েছে অন্যদিকে। পার্থিব কিছু বললনা। শ্রুতিকে সুযোগ দিল। শ্রুতি কাঁধে মাথা ফেলেই বলতে লাগল,
‘ আমার আম্মুকে আমি খুব ভালোবাসি পার্থিব। খুব। আমার সবসময় আমার আম্মুকে মনে পড়ে। ৯ বছর পেরিয়ে গেছে। অথচ তাও ভুলতে পারিনা। মনে হয়, পৃথিবী এতো কষ্টের না হলেও পারতো। তাইনা? সবাই সবাইকে ভালোবাসতো। সবার ভালোবাসা পূর্ণ পেতো। তাহলে কতো সুন্দর হতো। আমার যখন মনে পড়ে, আমার আম্মু বেঁচে নেই আমার খুব অসহায় লাগে। মনে হয় এই পৃথিবীতে আমার মতো একা কেউ নেই। আপা, দাদী, হামিম থাকলেও আমি একা। কারণ আমার আম্মু নেই। আমি আমার আম্মুকে জড়িয়ে ধরতে পারিনা। আম্মুর গায়ের গন্ধ পাইনা। আম্মুর হাসি মুখ দেখিনা। আপনি জানেন, আমি মাঝেমধ্যে আম্মুর চেহারা ভুলে যাই। আমার মনেই পরেনা। কতো চেষ্টা করি, কতো ভাবি তাও মনে পড়েনা। আবার! আবার হঠাৎ করেই মনে পড়ে আমার আম্মু অপারেশন রুমে যাচ্ছে সেই দৃশ্য, মনে পরে আম্মুর কান্নার দৃশ্য। আমি মানতে পারিনা পার্থিব। একজন মানুষ ছিল অথচ নেই। ভীষণ দুঃখ, কষ্ট পেয়ে মারা গেছে ভাবলেই আমার দিন দুনিয়া অন্ধকার লাগে, মিথ্যা মনে হয় সব। বুকে ব্যথা করে।’

শ্রুতি নিজের মুখ গুঁজে দিল পার্থিবের কাঁধে। পার্থিব অনুভব করল তার গলা ভিজে উঠছে। পার্থিব আরোও আঁকড়ে ধরল শ্রুতিকে। শ্রুতি গলায় মুখ গুঁজেই বলতে শুরু করল, ‘ ছোট থাকতেই আমি বুঝেছিলাম আম্মু কেন কাঁদে, কেন কষ্ট পায়। কারণ আমার আব্বু….সরি। আমিন শিকদার আমাদের সামনেই সব বলতো। কোনো বাছ-বিচার করতো না। সে অন্য মেয়ের কথা বলতো। আম্মুকে খারাপ কথা শুনাতো। মাঝেমাঝে আম্মুকে কষ্ট দেওয়ার অন্য উপায় খুঁজত। সে বলত, আজ আমি বাসায় খাবনা, তাহিরা। আমার জন্য দুপুরে ওয়েট করোনা। আমার আম্মু যদি বলতো, কোথায় খাবে? না খেলে নিয়ে যাও। তখন আমিন শিকদার বলত, আজ শাহিনের সাথে খাব।
আমিন শিকদার বুঝতো মা জানে শাহিন নামের মানুষটাকে। তবুও মাকে বলতো, শাহিনাকে ভালোবেসে শাহিন ডাকি। বলেই হাসি দিয়ে চলে যেত। সেই হাসিতে থাকতো আমার আম্মুকে কষ্ট দেওয়ার, যন্ত্রণা দেওয়ার প্রচেষ্টা। আমি তখন সব দেখলেও কিছু অনুভব করিনি। কারণ স্বামীর ২য় বউ বা অন্য কাউকে ভালোবাসলে কেমন অনুভূতি হয় সেটা তেরো বছর বয়সে আমি বুঝিনি। শুধু দেখেছি। তখন শুধু মনে হতো, বাবাদের একটাই বউ হয়। আর সেটা মা। মা বাদে অন্যকেউ মানেই খারাপ। আমার বাবা সেই খারাপকে নিয়েই থাকতে চাইছে। তাই রাগ হতো। আমার মা কিছুই বলতো না তেমন। হয়তো বলতো। কিন্তু আমাদের সামনে না। বাবা মায়ের নিরবতাকেই দুর্বলতা ভাবতো।

সবকিছু সহ্য করতে না পেরে মা একবার ভীষণ অসুস্থ হলো। ডাক্তার বাড়ি চলে এলো। এসে মাকে দেখে বলল, উনি মানসিকভাবে ভীষণ বিধ্বস্ত, অসুস্থ। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত কীভাবে হয় আমি জানতাম না। দাদীকে জিগ্যেস করেছিলাম যে মানসিকভাবে অসুস্থ কীভাবে হয়। তাই এই ঘটনাটা খুব ভালোভাবে মনে আছে আমার।
এই সমাজ খুব খারাপ পার্থিব। খুব খারাপ। আমার মা যখন শেষ ভরসা হিসেবে মামা-মামীর কাছে গেল। সব জানাল ফোনে। তখন তারাও মুখ ফিরিয়ে নিল। মামী বলল, পুরুষদের মাঝে একটু আধটু দোষ থাকেই। তাছাড়া পুরুষদের তো চার বিয়ে জায়েজ। আমি বলিকি, তাহিরা। তুমি আমিন ভাইকে বিয়ে করিয়ে দাও।
সেই কথা শুনে আমার আম্মু কিছুই বললনা। ফোন কেটে দিল। আমি তো সব শুনেছি। সব। আপাও শুনেছিল। আমরা দু’জন ঘুমিয়ে ছিলাম। আমি যখন চোখ খুলে তাকালাম, দেখলাম আপা আমার দিকে তাকিয়ে আছে মুখে হাসি, চোখে পানি নিয়ে। আচ্ছা, পরকীয়ার মতো নোংরা কাজ কী বিয়ে দিয়ে ঢেকে দেওয়া যায়? চার বিয়ে করা যায় বলেই যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে আমিন শিকদারের মতো মানুষেরা? কোনো বিচার হবেনা?’

শ্রুতি মাথা তুলল। পার্থিব গম্ভীর চোখে তার শ্রুতিকে দেখল। চোখের পাড় ফুলে গেছে। চোখের কোণায় কোণায় পানি থৈ থৈ করছে। যেকোনো সময় পরে যাবে। শ্রুতি আবারো বলল, ‘ আমি আমার মায়ের মুখ ভুলতে পারিনা পার্থিব। আমার মায়ের হাসিমাখা মুখ আমার মনে পড়েনা। অথচ কান্নাভরা মুখ, মলিন মুখ না চাইতেও মনে পড়ে। আমার মা কেন খুশিভাবে পৃথিবী ত্যাগ করল না? সে তো খুশির প্রাপ্য। তাইনা?’

শ্রুতির প্রশ্নে পার্থিব গম্ভীরমুখে মাথা নাড়ল। মুখে পড়া চুল সড়িয়ে দিল। শ্রুতি নাক টেনে নিজেকে শান্ত করল। বিশেষ লাভ হলোনা। পার্থিবের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আপনি কী মন খারাপ করলেন এইসব বললাম বলে? আমি নিজেই জানিনা এইসব আমি কেন বললাম। আমি কিন্তু আপনাকে খারাপ বুঝানোর জন্য বলিনি। আমি জানি আপনি ভালো। আপনাকে বিশ্বাস করি। কিন্তু ভীষণ মন খারাপ হচ্ছিল আমার। তাই বলেছি।’

পার্থিব হেসে শ্রুতিকে আশ্বস্ত করতে চাইল। বলল, ‘ অবশ্যই বলবেন। যখন যা মন চায় তাই বলবেন। আমি আছিতো আপনার কথা শুনতে। আপনার ঝাঁঝালো কথা, মিষ্টি কথা, কষ্টের, যন্ত্রণার কথা সবকিছুর জন্যই আমি আছি শ্রুতি। আপনার যখন মনে হবে তখনই বলবেন। ধরেন আমি বাড়ি নেই। অফিসে। আপনি আমাকে কলে বলবেন। বুঝলেন? আপনার কথা শোনার অধিকার আমার। শুধু আমার। আর কাউকে যেন এই অধিকার না দেওয়া হয়। মনে থাকবে?’

শ্রুতি কান্নার মাঝেও হাসার চেষ্টা করল,
‘ থাকবে।’

শ্রুতি দুহাতে নিজের চোখ-মুখ মুছছে। পার্থিব শ্রুতির মন ভোলাতে চাইল। তাই হাত বাড়িয়ে কাপ এনে ঠোঁট উলটে বলল,
‘ আপনার জন্য আনা কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেল।’

‘ এক কাপ কেন?’

‘ এক কাপে খেলে ভালোবাসা বাড়ে তাই।’ হাসিমুখে বলল পার্থিব।

শ্রুতি চোখ পাকিয়ে চেয়ে রইল। পার্থিব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘ তবে এখন তো খাওয়ার মতোও নেই। রেখে দেই। আবার অন্যকোনোদিন বানিয়ে খাওয়াব।’

শ্রুতি হাত বাড়িয়ে কেড়ে নিল। এক চুমুক বসিয়ে চোখ পাকিয়ে চাইল পার্থিবের দিকে। বিরসকণ্ঠে বলল, ‘ মজা হয়েছে।’

পার্থিব হাসল। এই মেয়ে ভালো কথাও শক্তমুখে বলবে। শ্রুতি বেশ আয়েশ করে চুমুক বসাচ্ছে। যেন এর থেকে ভালো খাবার এই দুনিয়ায় নেই। পার্থিব সেদিকে খেয়াল করল না। সে চেয়ে রইল শ্রুতির দিকে। কী শান্ত, নির্মল মুখ। কান্নার রেশ কাটেনি। তাইতো থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। কে বলেছে শ্রুতি সুন্দর না? সুন্দর না হলে তার কাছে কেন মেয়েটাকে সুন্দর লাগবে? কেন মেয়েটাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে হবে?

পার্থিব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শ্রুতির কথা শুনে মনে হলো ছোটবেলা থেকে এতোকিছু সহ্য করেও তাকে যে ভালোবেসেছে – এই তো অনেক। মানুষের বিশ্বাস, মানসিকতা তৈরির সময়ই শৈশব। সেখানে শ্রুতি বেড়ে উঠেছে অস্বাভাবিক পরিবেশে। আজ পার্থিবের মনে হলো শ্রুতির করা সব কাজই হয়তো শ্রুতির জায়গা থেকে ঠিক।
পার্থিব নিজের সাথে শ্রুতির তুলনা করতে চাইল। পার্থিব তার বাবাকে অসম্ভব ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। এর কারণও রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই দেখেছে তার বাবা তার মাকে কতোটা ভালোবাসে, সম্মান করে। তার মাও তার বাবাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে। সেখান থেকেই পার্থিবের নিজের বাবার প্রতি সম্মান তৈরি হতো। মনে হতো তার বাবা একজন আদর্শ মানুষ যে কিনা স্ত্রীর অসুস্থতায় রান্না করতেও দ্বিধাবোধ করতো না। এইসব দেখেই তো পার্থিবের বেড়ে ওঠা, তার মানসিকতার বেড়ে ওঠা। সেখানে শ্রুতি ছিল একদম বিপরীত পরিবেশে। পার্থিব আমিন শিকদারকে নিয়ে কিছু ভাবতে চাইলেন না। তবুও অনুভব করল, নিজের অজান্তেই কেমন যেন শ্রদ্ধা কমে গেল মানুষটার ওপর থেকে। সে জানতো মানুষটা খারাপ, তাই বলে এমন?

পার্থিব শ্রুতির দিকে চাইলে, শ্রুতিও চাইল। কাপ বাড়িয়ে দিয়ে সুন্দর হেসে বলল,
‘ আমিই খেয়ে ফেললাম। আপনার জন্য নেই।’
হাসিমুখে চেয়ে আছে শ্রুতি। পার্থিবও নির্নিমেষ চেয়ে রইল পুরু হওয়া চোখের পাতায়, দীর্ঘসময় কান্না করার কারণে লালাভ হয়ে যাওয়া ওষ্ঠদ্বয়ে। মেয়েটার সৌন্দর্য কী বেড়ে গেল?

.
পড়ন্ত বিকেল। ঠান্ডা, নির্মল পরিবেশ। সুন্দর বাতাস আসছে দরজা গলিয়ে।
মাঝে পেরিয়েছে বেশ কিছুদিন। আটমাসে পড়বে বিভা। পায়ে পানি এসে ফুলে গেছে। শরীরও ভীষণ অবশ অবশ হয়ে থাকে। পিঠে ব্যথা তো আছেই। বিভা মাথা হেলিয়ে দিল খাটে।

বেশ কিছুক্ষণ পর অনুভব করল মাথায় ঠান্ডা লাগছে। চোখ খুলে তাকাল বিভা। ঘুম ধরে গেছিল। ভালোভাবে তাকাতেই সামনে দেখতে পেল শাশুড়ীকে। সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় তেল দিতে চেষ্টা করছে। বিভা সরে গিয়ে জায়গা দিতে চেষ্টা করল। হাসিনা বুঝতে পেরে পেছনে বসল। আরামে নিজের পুত্রবধূর মাথায় তেল মালিশ করতে লাগল।
পায়ে কিছু অনুভব হতেই বিভা সেদিকে তাকাল। মাহাথির। গম্ভীরমুখে পায়ের তলায়, পায়ে কিছু মালিশ করছে। মাহাথিরের গম্ভীর মুখে বিভা পরে-ধরে চেয়ে রইল। তার সামনে থাকা কালো রঙের টি-শার্ট পরিহিত, এলোমেলো চুলের মালিক, গম্ভীর মুখের অধিকারী পুরুষটি তার ছেলের বাবা।
বাবা। মা। কী সুন্দর শব্দগুলো! সে মা, মাহাথির বাবা। আর তাদের ছেলে মাহতিম। বিভার আল্ট্রাতে এসে তার ছেলে হবে। সংবাদ শুনেই সে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে মাহাথিরের দিকে তাকিয়েছিল। মাহাথিরও মুচকি হেসে চেয়ে ছিল তার দিকে। বিভার আশ্চর্য হওয়ার কারণ ছিল, মাহাথির ছেলের নাম ঠিক করল আর ছেলেই হবে তার? এতো টান বাবা-ছেলের যে আগেই নিজের বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে খবরটা?

বিভা নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো। তার কিছু ভালো লাগেনা আজকাল। দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায়। থেকে থেকে কান্না পায়। এই যে এখন! মা-ছেলে মিলে তার যত্ন করছে, অথচ মনটা কেমন বিষিয়ে আছে। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেও তার মনটা ভালো ছিল। ভালো লাগেনা। কিচ্ছু ভালো লাগেনা। সে এখন যে মূহুর্তে আছে সেই মূহুর্তে যে কোনো মেয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাগ্যবতীদের তালিকায় ফেলত। সে ফেলছে না কেন? বিভার মনে হলো তার চোখ ভেঙে ঘুম আসছে। ঘুমানোর চেষ্টা করল সে।

গভীর রাত। মাহাথিরের চোখে ঘুম নেই। বিভার শ্বাসে বুঝতে পারছে বিভা গভীর ঘুমে মগ্ন। দেখে শান্তি লাগছে। গত কয়েকমাস যাবত বমি, অসুস্থতা মিলিয়ে না খেতে পারছিল, আর না ঘুমাতে পারছিল। এখন একটু ঘুমাক।
মাহাথির বিভার পেটের দিকে তাকাল। বেশ ভালোই ফুলে আছে। আজ-কাল সে বাচ্চার নড়াচড়া উপভোগ করে। আবার ভেতরে ভেতরে ভয়ে কুঁকড়ে যায়। ভয়ের কারণ বিভার পেটের চামড়া কতো পাতলা হয়ে গেছে! এতোই পাতলা হয়েছে যে পায়ের ছাপ পর্যন্ত দেখা যায়! ভাবতেই বুকের মাঝে কেমন যেন করে। মা হওয়া এতো কষ্টের? কই বাবা হয়ে তো সে কোনো কষ্টই করছেনা? তারমানে কী তার প্রতি তার সন্তানের টান থাকবেনা?
মাহাথির কথাটা মানল না। কে বলেছে টান থাকবে না? অবশ্যই টান থাকবে। অবশ্যই থাকবে। সামান্য পায়ের ছাপ দেখেই তার বুকে খুশির, ভয়ের, আতংকের ঢেউ ওঠে। বাচ্চাটা কোলে এলে কেমন লাগবে? মাহাথিরের বুকটা হঠাৎ ভীষণ রকমের শীতলতায় ছেয়ে গেল।

নাহহ! আর ঘুম নয়। একটু তার রাজপুত্রের সাথে কথা বলা যাক। উঠে বসল মাহাথির। বিভার দিকে তাকিয়ে পেটের কাপড় সরাল। নিজের শীতল হাত এগিয়ে দিল পেটে। দরজার বাহিরের কেউ যেমন দরজা খোলার আশায় ঠকঠক করে। তেমনিভাবে পাতলা পর্দার ওপাশের প্রাণের উত্তরের আশায় মাহাথির তার আঙুল দিয়ে জায়গায় জায়গায় ছুঁয়ে দিল। অনেকবার একই কাজ করেও লাভ হলোনা। মাহাথির তার হাসি মুখ থেকে সরিয়ে নিল। ভ্রু কুঁচকে গম্ভীরমুখে বলল,
‘ তুমিও আব্বুকে রেখে ঘুমিয়ে গেছো? এটা কী ঠিক হলো?’

কিছুক্ষণ সেভাবেই অতিবাহিত হলো। মনে পড়ল আগের ঘটনাগুলো। সে তাহিরা, হাসিনা সবার কাছেই বিচার দিয়েছে। এমনকি হামিমের কাছেও বিচার দিয়েছিল সে হামিমের চলে যাওয়ার সময়। কিন্তু কেউ তার বিচারের সমাধান করতে পারেনি। তাই মাহাথির ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ তোমার দাদীকে, নানীকে, মামাকে সবাইকে বললাম তোমার আম্মুকে ভালো বানাতে। কেউ বানিয়ে দিল না। এখন তোমাকে বলছি শোনো, আম্মুকে ভালো করে দাও তো। সে যেন তোমার আব্বুকে বোঝে। যেন অনেক ভালোবাসে। তোমাকে বিচার দিলাম, আর কাউকে দিব না। এখন যদি তাও তোমার আম্মু ভালো না হয় তবে তুমি যখন মাইর খাবে আম্মুর হাতের, আমি তোমাকে বাঁচাব না। ইনফ্যাক্ট আমি নিজেও মারব তোমাকে। একটা মাইরও নিচে পড়বেনা। বুঝছো? ডিল করবা না মাইর খাবা?’

কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি মাহাথির স্পষ্ট দেখল বিভার পেটে ছোট ছোট পায়ের ছাপ। বুকটা ধ্বক করে উঠল। মাহাথিরের মনে হলো সে ভুল দেখেছে। দিন-দুনিয়া ভুলে সে তাকিয়ে রইল সেদিকে। তখনই কানে এলো, ঘুমের মাঝেই বিভা কঁকিয়ে উঠেছে। চোখ-মুখ কুঁচকে গেছে। বাচ্চাটা কী তবে লাথথি মারল?

মাহাথির ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল পেটে। তার ছেলে কী তার কথা পছন্দ করল না না-কি?

____
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ৩২৭৫
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৪৪.
দরজায় দাঁড়িয়ে মৃদু আওয়াজ তুলল সিদ্দীক সাহেব। বিভা সেদিকে তাকিয়ে হাসিমুখে উত্তর দিল, ‘ আসুন, আব্বা।’
সিদ্দীক সাহেবের পরনে লুঙ্গি এবং ফতুয়া ধরনের পোশাক। বিভা নিজের শ্বশুর এর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল। এতোক্ষণ যাবত রুম জুড়ে হাঁটছিল সে। শ্বশুরকে বসতে বলে নিজে দাঁড়িয়ে রইল। সিদ্দীক সাহেবের নিজের পুত্রবধূর কথা মেনে বসলেন। সরল কণ্ঠে বলল, ‘ নিচে যাইতেসি। তোমার কিছু লাগব? কিছু খাইতে মন চায়? বলো! নিয়া আসমুনে।’

বিভা হাসল। এই মানুষটা সুস্থ হওয়ার পর প্রায়দিনই হাঁটতে বাহিরে যায়। অযথাই রাস্তা দিয়ে হাঁটে। বাজারে গিয়ে ঘুরে আসে। বিভা বুঝতে পারে যে এই শহরে মানাতে তার অসুবিধা হচ্ছে। গ্রামের মানুষ শহরে এসে সহজে মানিয়ে নিতে পারেনা। গ্রামে এখানে ওখানে যাওয়া যায় এক নিমিষেই, শহরে তার ব্যবস্থা নেই। তাই তো এক ফ্ল্যাটে বন্দি থাকতে ভালো লাগেনা বলেই বাইরে বাইরে ঘুরে আসে। সে নিয়ে তার শাশুড়ীর সে কী রাগ! বিভা প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে যখনই বাইরে যায় এক প্রশ্ন করে। বিভা কিছু না বললেও এটা সেটা নিয়ে আসে। বিভা সেগুলো তৃপ্তি করে খায়। সে নিয়ে আবার মাহাথিরের রাগারাগি শুরু হয়। তবে নিজের অবচেতনেই ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করে বিভা। বিভা হাসিমুখে বলল, ‘ কিছু খাব না, আব্বা।’

সিদ্দীক সাহেব বিভার কথাটা শুনলেন। সে শুনল – কিছু খাব না, আব্বা। অথচ বুঝল – আপনার যা মনে চায় নিয়ে আইসেন। সিদ্দীক সাহেবের সামনে দাঁড়ানো মেয়েটার প্রতি অসম্ভব মায়া হলো। মেয়েটা অতিরিক্ত শান্ত প্রকৃতির। শান্ত হয়েও যথেষ্ট মিশুক। কী সুন্দর করে তার সাথে কথা বলে, গল্প করে। কী সুন্দরকরে তৃপ্তি নিয়ে তার আনা খাবার খায়। বড্ড মায়া হয়! আগে ছেলের প্রতি মায়া হতো, এখন ছেলেরবউ সেই মায়া নিয়ে গেল, কিছুদিন পর নাতি এসে নিয়ে যাবে। সিদ্দীক সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। হাসিমুখে বলল, ‘ তোমার আম্মা ঘুমায়। আমি তাইলে যাই?’
বিভা মাথা নাড়ল। সিদ্দীক সাহেব বেরিয়ে গেল। মানুষটা বেশ সহজ সরল। বিভার সাথে অতো বেশি কথা না হলেও, হয়। তবে মানুষটা বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকে। বিভা মনে মনে দোয়া করে, এই মানুষটা যেন সবসময় সুস্থ থাকে, তাদের মাঝে বেঁচে থাকে। মানুষটাকে ‘ আব্বা’ ডাকে বিভা। মন থেকে, ভালোবেসে, সম্মান নিয়েই ডাকে। বিভা জানে মাহাথিরও তার আব্বা-আম্মাকে অসম্ভব ভালোবাসে। এমনিতেই মাহথির নিজেকে একা ভাবে। আল্লাহ না করুক আব্বার যদি কিছু হয় তবে আরোও ভেঙে পড়বে। বিভাকে নিজেকে বুঝাতে চাইল। এরকম কিছুই হবেনা।
সুস্থ থাকলে সিদ্দীক সাহেব বেশিরভাগ সময় নিজের মতো ঘুরাঘুরি করেই কাটায়। বিভা হাসল। এই সংসারের প্রতিটা মানুষ, প্রতিটা জিনিসের প্রতি তার কেমন যেন মায়া। বিভার মনে হয়, মাহাথির যদি তাকে কোনোদিন ভালো নাও বাসে তবুও সে এই সংসারের প্রতি মায়া থেকেই কাটিয়ে দিতে পারবে এক জনম। এই মায়া বুঝি তার মায়েরও ছিল? প্রতি মেয়েরই হয়?
.

শ্রুতি বসে বসে হামিমকে মুড়ি খাওয়াচ্ছে। আল্লাহর রহমতে তার ভাই এখন অনেকটাই সুস্থ। ধরে ধরে হাঁটতে পারে। বুকের ঘাও শুকানোর পথে। শ্রুতির মন মেজার বেশ ফুরফুরে। তার পাশেই বসে আছে প্রভা আর প্রত্যাশা। মেয়ে দু’টো সবসময় একসাথে থাকে। কিছুক্ষণ আগেই এসেছে দু’জনে। শ্রুতি হামিমকে খাইয়ে দিয়ে প্রভা-প্রত্যাশার দিকে তাকাল। বলল,
‘ মুড়ি খাবে তোমরা? খাইয়ে দেই?’

‘ কী দিয়ে খাব?’ প্রভা বলল।

‘ দুপুরবেলা তো শুধু গরুই রান্না হয়েছে। তাই এটা ছাড়া অন্য তরকারি নেই। খাবে?’

‘ না। খাবনা।’ প্রভা বলল।

প্রত্যাশা প্রভার কথা মানল না। শ্রুতিকে বলল, ‘ আমি খাব ভাবি। প্রভাও খাবে। শুধুশুধু ঢঙ করে ও।’

শ্রুতি হেসে মুড়ি মাখল। খাইয়ে দিতে লাগল নিজের দুই ননদকে। বাইরে থেকে পার্থিবের কাছে দৃশ্যটা ভীষণ সুন্দর লাগল। তাই ঝটপট কিছু ছবি তুলে নিল। সুন্দর মূহুর্তের ছবি থাকা আবশ্যক।

পার্থিব খাটে বসে আছে অর্ধশোয়া অবস্থায়। শ্রুতি গিয়ে পাশে বসল। কাঁধে মাথা রেখে বাহু জড়িয়ে ধরল। পার্থিবের ভালো লাগল। তবে হুটহাট শ্রুতির এমন কাজে ভীষণ অবাক হয় সে। শ্রুতি বলল,
‘ ব্যস্ত ভীষণ?’
‘ উঁহু! তেমন নয়। কিছু বলবেন?’
‘ না।’
শ্রুতি কাঁধে মাথা রেখে নিজের ফোন টিপতে লাগল। বিভার সাথে মাত্র কথা বলে এসেছে। কাল একবার যাবে। মাঝেমধ্যে শ্রুতির একদম ভালো লাগেনা। শ্রুতি শুনেছিল, মেয়েদের প্রথমবার প্রেগন্যান্সির সময়ে মায়ের বাড়িতে থাকে। তার মা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই বিভাও থাকতো। যদিও এটা একটা কথার কথা। স্বামী-শাশুড়ী ভালো হলে শ্বশুরবাড়ি থেকেই যত্ন পাওয়া যায়। তাই আবার মন খারাপ করতে গিয়েও করেনা শ্রুতি। কারণ সে দেখেছে মাহাথিরসহ সবার যত্ন। কতো ভালোবাসে তার আপাকে! মাহাথির ভালোবাসে কিনা তা শ্রুতি জানেনা। তবে নিজের আপার প্রতি যত্ন দেখেই মুগ্ধ হয় শ্রুতি। মনে হয় অতোটাও খারাপ নয় তার মাহাথির ভাইয়া। এই তো শান্তি।
শ্রুতির মনে হলো শুধু বিভা নয়। সেও যথেষ্ট সুখী। শুধু সুখী নয়, বাড়াবাড়ি রকমের সুখী। তার স্বামী ভালো, শ্বশুরবাড়ি ভালো। সবাই ভালো। সবাই তাকে ভালোবাসে। এইটা কী কম? শ্রুতির মনটা ধেইই ধেইই করে নেচে উঠল। তার আপা এবং সে এতো ভালো বাড়িতে এলো কীভাবে? তার আপা তো ভালো তাই নাহয় সে ভালো একটা শ্বশুরবাড়ি পেয়েছে। কিন্তু সে! সে তো তেমন ভালো নয়। তাহলে পেল কী করে?
বেশ কিছুক্ষণ পর শ্রুতি হুট করে প্রশ্ন করল,
‘ পার্থিব, আমি বিয়ের পর আপনার সাথে অনেক খারাপ আচরণ করেছি। আপনার রাগ হয়নি?’

পার্থিব কাজ করতে করতেই বলল,
‘ না, হয়নি।’

‘ কেন?’

‘ রাগ হইনি। রাগের কারণ জানার জন্য আগ্রহী হয়েছি। আপনি এমন কেন প্রতিনয়ত সেটাই ঘুরতো মাথায়। এছাড়া ধীরে ধীরে যখন আপনার প্রতি অতিরিক্ত দুর্বল হচ্ছিলাম, তখন শুধু মনে হতো আপনি আমার প্রতি কবে দুর্বল হবেন। এতোকিছুর ভীড়ে রাগের সময় হয়ে ওঠেনি।’

শ্রুতি পার্থিবের কাঁধে নিজের মাথা ঘষে বলল, ‘ আচ্ছা মানলাম। কিন্তু আমি যখন আপনার প্রতি দুর্বল হলাম, বললাম যে আমিও আপনাকে ভালোবাসি। তখন কেন আপনি রাগ দেখালেন না? তখন তো চাইলেও আমাকে শাস্তি দিতে পারতেন। তাইনা?’
প্রশ্নটা করেই শ্রুতি ঘাড় উঠিয়ে পার্থিবের দিকে চাইল। পার্থিব ল্যাপটপ কোলে রেখেই কপাল চুলকে হাসল। বলল,
‘ আপনার ওপর রাগ করার ক্ষমতা আমার নেই শ্রুতি। রাগ উঠলেও তা দীর্ঘ সময় ধরে রাখার ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দেয়নি। এদিকে আমি ভীষণ রকমের দুর্বল। আর শাস্তি? শাস্তি দিলে আপনি ভীষণ দুঃখ পেতেন। এমনিতেই একরাত বাড়ির বাইরে থেকে যে শাস্তি হয়েছিল সেটাই আমার জন্য অনেক যন্ত্রনার ছিল। এর বেশি আমিও দিতে পারতাম না। আর দিলেও আপনি সহ্য করতে পারতেন না। আপনি এতো সবল নন।’

‘ কে বলেছে আমি সবল নই? আপনি জানেন সবাই বলে আমি অনেক শক্ত মনের অধিকারী।’ কিছুটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল শ্রুতি।

‘ ভুল বলে শ্রুতি। আমিতো বলব, কেউ আপনাকে জানেই না। কারণ আপনি উপরে উপরে যাই বলেন না কেন আপনি ভীষণ রকমের দুর্বল একটা মেয়ে। শুধু চিৎকার চেঁচামেচি করলেই কী শক্ত মনের হয়ে যায়?’

শ্রুতি চোখ পাকিয়ে বলল, ‘ আমি শুধু চিৎকার চেঁচামেচি করি?’

‘ অবশ্যই। আপনি শুধু পারেন তিড়িংবিড়িং করে ঘেটে দিতে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড রকমের দুর্বল আপনি।’ হাসিমুখে বলল পার্থিব।

‘ আপনাকে এতোকিছু কে বলেছে?’

‘ আমি বুঝতে পারি।’

‘ এতো বুঝা ভালো নয়।’

‘ ওকে বুঝব না বেশি। তাহলে আসেন প্রেম করি।’ বলেই ল্যাপটপ রেখে হাত উঠিয়ে জড়িয়ে ধরল শ্রুতিকে।

.
মাহাথির বিরসমুখে শুয়ে আছে। ভেতরে ভেতরে সে বেশ চিন্তিত। বিভার আটমাস পড়ল। এই নিয়ে মাহাথির দু’বার ছুটির আবেদন করেছে। দেওয়া হয়নি। শেষবার যখন নিজেই গেল কথা বলতে তখন ম্যানেজার গম্ভীরমুখে বলল, ‘ এখন অফিসে অনেক কাজ মিস্টার মাহাব। এই সময়ে ছুটি মোটেও গ্রাহ্য হবেনা। অফিসের কাজ কমলে আপনি টানা দু’মাসও ছুটি পেতে পারেন কোনো রকম অতিরিক্ত সেবা ছাড়াই। তবে এই মূহুর্তে তা সম্ভব নয়।’
অতিরিক্ত সেবা বলতে বুঝিয়েছে ঘুষ। ম্যানেজার সাহেব কোনো কথা রাখ-ঢাক রেখে বলে না। যা বলে সরাসরি বলে। মাহাথির ব্যাপারটা পছন্দ করে। তবে এখন তাও পছন্দ হচ্ছেনা। বিরক্তিতে মুখ তেঁতো হয়ে গেল। তার চারপাশের সবাই তারসাথে এমন বেঈমানী কেন করছে?

সামনেই বিভা হাঁটাহাঁটি করছে। সেদিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল মাহাথির। বলল,
‘ সেই কখন থেকে হাঁটছো তুমি! এতো হাঁটার কী প্রয়োজন? এসে বসো পাশে।’

বিভা মুখ কুঁচকে বলল, ‘ কতোক্ষণ বসে থাকা যায় শুনি? অতিরিক্ত বসে থাকা ভালো নয়। বাচ্চা পেটে বড় হয়ে যায়।’

মাহাথিরের কাছে ভীষণ আজব লাগল কথাটা। সন্দিহান কণ্ঠে বলল, ‘ আম্মা বলেছে?’

বিভা নিজের কাজকে ঠিক প্রমাণ করতে হালকা ধমকে বলল, ‘ কারোর বলার প্রয়োজন নেই। জানি আমি। আপনি চুপ থাকেন।’

মাহাথির চোখ বন্ধ করল। বিভা এখন প্রায়ই তাকে ধমক দেয়। মাহাথিরও গম্ভীরমুখে ধমক হজম করে নেয়। বিভার ধমক গুলাও বিভার মতোই শান্ত, মাহাথিরের বেশ মজা লাগে ধমকগুলো। মজার ধমক সবসময় খাওয়া যায়। ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা। মাহাথির কী ঘুমাবে একটু? গতকাল মা তাকে একটা আশ্চর্যজনক কথা বলেছে। বিভা নাকি মাঝরাতে প্রায়ই উঠে। উঠে রান্নাঘরে গিয়ে খাবার রান্না করে। এরপর খায়। গত পরশু তা হাসিনা দেখেছেন। এরপর কালই বলেছে মাহাথিরকে। মাহাথির ভেবেছিল কাল রাতে না ঘুমিয়ে বসে থাকবে। কিন্তু সম্ভব হয়নি। তার ঘুমই আসে মাঝরাতে। সারাদিনের ক্লান্তিতে কিছুই টের পায়না সে। এখন ঘুমালে আজ রাতে বসে থাকতে পারার সম্ভাবনা থাকবে। মাহাথির চোখ বন্ধ করল।

বিভা দেখল মাহাথির চোখ বন্ধ করে আছে। ঘুমাচ্ছে নাকি? ঘুমাক একটু। বিভা বারান্দায় যেতে নিল। ওমনি মাহাথির তড়াক করে উঠে বসল। বড় বড় পা ফেলে চলে গেল বাইরে। মাহাথির যখন ফিরল বিভা তখন বারান্দায়। এগিয়ে গেল সে। বিভার সামনে ফলের রস, স্যুপ, ফলের প্লেট রেখে বলল, ‘ দুপুরে নাকি খেতে পারোনি। এখন একটু কষ্ট করে খাও এগুলো। অল্প খাও সমস্যা নেই, কিন্তু খাও।’
স্যুপ দেখেই বিভার নাড়িভুড়ি উলটে এলো। মুখ কুঁচকে তাকিয়ে রইল মাহাথিরের দিকে।

রাত এগোরাটা। বিভা বসে আছে। পাশেই শুয়ে আছে মাহাথির। মাহাথিরের মনে হলো তার দু’চোখে সারা দুনিয়ার ঘুম জড়ো হয়েছে। নয়তো এতো ঘুম আসবে কেন? ঘুমাতেও ইচ্ছে করছে না। তার কাছে না ঘুমিয়ে থাকার কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতা থাকলে হতো। তাহলে সে সারাক্ষণ না ঘুমিয়ে বসে থাকতো।
বিভা নিজের পেটের দিকে তাকিয়ে আছে। হাত দিয়ে নিজের সন্তানকে অনুভব করতে চাইছে। আজ-কাল প্রায়ই বাচ্চাটা নড়চড় করে নিজের জানান দেয়, ব্যাপারটা এতো ভালো লাগে বিভার! মনে চায় বাচ্চাটাকে কোলে তুলে আদরে আদরে ভরিয়ে তুলতে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। আবার মাঝেমধ্যে এমনভাবে নড়চড় করে বিভার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসে যন্ত্রণায়। বিভা মলিন হাসল। অযথা ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে। আগের কথা মনে পড়ছে। তার মাও এমন সুখকর যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গেছে। কতো কষ্টই না সহ্য করেছে! আগে না বুঝলেও এখন ভালোভাবেই বুঝে বিভা। তবে তার পাশে তো সবাই আছে। কিন্তু তার মায়ের পাশে কেউ ছিলনা ভরসা দেওয়ার। বিভার মনে পড়ল আমিন শিকদারের বলা একটি বাক্য – কালো মানুষ দেখলে আমার ঘেন্না লাগে। সে, শ্রুতি কালো না হলেও শ্যামবর্ণের। তবুও আমিন শিকদার তাদের সেভাবে আদর করতো না। অবশ্য আদরের ভান করতো। শ্রুতি কতো ছুটতো আমিন শিকদারের পিছে পিছে কোলে ওঠার জন্য। কিন্তু সে তেমনভাবে আদর দিয়ে কোলে নিত না। বিভা আগেই বুঝতে পেরেছিল আমিন শিকদারকে। তাই তো নিজেই দূরত্ব তৈরি করেছিল তার সাথে। আচ্ছা, মাহাথিরও কী এমন হবে?
বিভার মন খারাপের মধ্যে কেউ যেন ভীষণ যত্ন নিয়ে ঢেলে দিল যন্ত্রণা, চিনচিনে ব্যথা; যে ব্যথা বয়ে গেল শরীরের প্রতিটা শিরা-উপশিরা দিয়ে। সে মাহাথিরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ মাহথির! আমার বাচ্চাটা যদি কালো হয় আপনি কী ভালোবাসবেন না?’
মাহাথির সবেই ভাবছিল কিছুক্ষণ ঘুমাবে। তবে বিভার এমন প্রশ্নে তার চোখ থেকে ঘুমেরা উড়াল দিল। বিভার দিকে তাকিয়ে রইল তার ভাব বুঝার আশায়।
বিভা নিজমনেই বলল,
‘ জানেন তো মাহথির, আপনি আমিন শিকদারের থেকে অনেক ভালো একজন হাসবেন্ড। তার থেকে ভালো বাবাও হবেন। কেমন?’

মাহাথির কিছু বলল না। সে জানেই না কী বলা উচিত। বিভা বলল, ‘ আপনি আমাকে ভালোবাসেননি। আপনি বলেছিলেন আমি আশেপাশে থাকলে আপনার ভালো লাগেনা। তাই দূরে থাকেন। আমাদের ছেলে হলে তাকেও কী দূরে রাখবেন? সে যদি কালো হয় তাকে ভালোবাসবেন না? কিন্তু কালো-সাদা তো আমার হাতে নেই মাহথির। আমার ছেলের হাতেও নেই। তাহলে তাকে দূরে রাখবেন কেন?’

‘ তুমি আদৌও বুঝতে পারছো কী বলছো তুমি? এতোদিনেও কী আমার প্রতি এতোটুকু বিশ্বাস তৈরি হয়নি? আর কী তোমার তোমার লাগিয়েছো? বাচ্চাটা আমারো বিভা। এতো খারাপ মনে হয় আমাকে? এতো নিচু মনে হয়?’
রেগে উঠেছে মাহাথির। তার মুখের আকার শক্ত। কপালের রক্তনালি স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। সব দেখেও বিভা ভয় পেল না। নিজের মতো নির্বিকার কণ্ঠে বলল,
‘ আমার ধারণা, আমিও আমার মায়ের মতো মারা যাব মাহথির। আমি মারা গেলে আপনি আমার বাচ্চাটাকে দেখে রাখবেন। কেমন? আগলে রাখবেন। আর যদি না পারেন…… যদি না পারেন, তবে শ্রুতিকে দিয়ে দিবেন। মোটেও কষ্ট দিবেন না আমার বাবাকে। ঠিকাছে?’

মাহাথির ব্যথিত, ক্রোধান্বিত হয়ে চেয়ে রইল। বিভার গালে হাত গলিয়ে শান্তকণ্ঠে বলল, ‘ তোমাকে ভালোবেসেছি, এরমানে এইনা রাগতে ভুলে গেছি। আমাকে রাগিওনা বিভা। কষ্ট পাবে। বাজে বকা বন্ধ করো।’

বিভা তাচ্ছিল্যের মলিন হাসল। চোখ তার ছলছল। মাহাথির চুমু খেল বিভার কপালে। আদর করে শান্তকণ্ঠে বলল, ‘ তোমার কিছু হবেনা, বিভা। অযথা চিন্তা করোনা। আমি আছি তোমার পাশে। তোমার কিছু হবেনা।’’

বিভার নির্লিপ্ত ভাবে রইলেও, মাহাথির নিজের কপাল ঠেকাল বিভার কপালে। আবিষ্ট হয়ে বলতে লাগল,
‘ এখনো আমাদের দুজন দুজনকে উজাড় করে ভালোবাসা বাকি। এখনো আমাদের মাহতিমকে পৃথিবীর আলো দেখানো বাকি। এখনো আমাদের দুষ্টু-মিষ্টি সংসার করা বাকি। এখনো আমাদের মেহেরিমার মা-বাবা হওয়া বাকি। এখনো আমাদের অনেক পথ একসাথে পাড়ি দেওয়া বাকি বিভা। এখনো আমার তোমাকে তোমার মতো করে পাওয়া বাকি। এতোকিছু বাকি রেখে তুমি কোথাও যেতে পারবেনা। আমি দিব না।’

______
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ১৮৪৫
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান