একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান
৪৯. (শেষ পর্ব)
দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে দুই মাস। মাহতিমের বয়স ছয়মাসে পড়ল। বিভাও এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। মন দিয়ে সংসার করছে সে। মাঝেমধ্যে ভাবলে নিজেই অবাক হয় যে এতো সুন্দর জীবন তার? এতো পরিপূর্ণ? এতো পরিপূর্ণ জীবন কারো হয় বুঝি? উঁহু! সে পরিপূর্ণ নয়। তার জীবনেও কোনো না কোনো কমতি আছে, দুঃখ আছে। তার জীবনেও সুন্দরের মাঝে অসুন্দর বিষয় আছে। তবুও, সে তা মনে রাখেনি। ভুলে গেছে। ভালো রেখে মন্দকে ধরে বসে থাকলে জীবন চলেনা। জীবন তখনই সুন্দর যখন আমরা খারাপের মাঝেও ভালো খুঁজে খুশি থাকব। বিভাও আছে। শুধু বিভা নয়। বিভা, মাহাথির, শ্রুতি, পার্থিব সবাই তাদের ছোটবড় দুঃখ ভুলে খুশিকে আপন করেছে বলেই ভালো আছে। জীবন যেমন সুখের, তেমনি দুঃখের। শুধু সুখ নিয়ে থাকলেও যেমন চলেনা, তেমনি শুধু দুঃখকে আপন করে নিলেও চলেনা।
বিভা তার ছয় মাসের বাচ্চাকে তৈরি করিয়ে বিছানায় শুয়ে দিল। এরপর হাপ ছেড়ে মাহাথিরের দিকে তাকাল। মাহাথিরও চোখে হাসল। বিভা তার বাচ্চার দিকে তাকিয়ে নিজেই ঘাবড়ে গেল। মাহতিমকে তুলে মাথায় সামান্য থুথু ছেটাল। আম্মা বলেছে কেউ মাহতিমের প্রশংসা করলে এইভাবে থুথু ছেটাতে। এতে নাকি নজর লাগবেনা, সাথে মনে মনে মাশ-আল্লাহ বলা তো আছেই। বিভা যতোই শিক্ষিত হোক না কেন, ছেলের বেলায় সে সকল কুসংস্কার মানতে রাজী। তাইতো এখন নিজের ছেলের ওপর নিজেই মুগ্ধ হয়ে থুথু ছিটিয়ে দিল। মনে মনে মাশ-আল্লাহ বলতেও ভুলল না। ছেলেকে লক্ষ্য করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল যে কোনো সমস্যা আছে কি না। তবে মাহতিমকে দেখা বলতে সে শুধু পেল ভাল্লুকের জ্যাকেট পরিহিত জ্যাকেটের ভেতর ছোট্ট একটা টলটলে মুখ। যেই মুখের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো চোখজোড়া। চোখজোড়া যেন মাহাথিরের কার্বন কপি। দু’ বাপ-বেটা চোখের মায়ায় ফেলে তাকে মারতে চায় নাকি? ভেবেই মুখ সামান্য কুঁচকে নিল বিভা।
বিভা নিজের ছেলেকে শুইয়ে দিল। বিভাকে অবাক করে দিয়ে আজ তার ছেলে তেমন কাঁদল না। রেডি করানোর বেলায় যাও একটু কেঁদেছিল মাহাথির সামলে নিয়েছে। তার ছেলে কী বুঝতে পেরেছে নাকি যে তারা ঘুরতে যাবে?
বিভা ব্যগ্র কণ্ঠে বলল,
‘ আমি রেডি হতে গেলাম। বাবুকে দেইখেন।’
‘ বিভা। মাহতিমকে তো রেডি করালে। মাহতিমের আব্বুকে কে রেডি করাবে?’
বিভা মুখ কুঁচকে তাকাল। এই লোক জীবনে ভালো হবেনা। মাহাথির বিভার প্রতিক্রিয়ার ধার ধারল না। হাত বাড়িয়ে গম্ভীরমুখে বলল, ‘ঠিক করে দাও।’
বিভা এগিয়ে গিয়ে পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে দিল কুনুই পর্যন্ত। বলল, ‘ এবার যাই?’
‘ পারফিউম লাগিয়ে দাও।’
বিভা তাও করল। বলল, ‘ এবার?’
‘ উঁহুম। চুল আচড়ে দাও।’
বিভা হাত বাড়িতে চুলগুলো এলোমেলো করে দিল। প্রফুল্ল কণ্ঠে বলল, ‘ আপনি এভাবেই সুন্দর।’
মাহতিম গম্ভীরমুখে বলল, ‘ ঠিকাছে। মাহতিমকে রেডি করিয়ে যেভাবে চুমু খেলে সেভাবে আমাকেও চুমু খাও।’
বিভা চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রইল। মাহাথির শান্তকণ্ঠে বলল, ‘ এই যে প্রমাণ! তুমি যে আমাকে ভালোবাসোনা সেটা বুঝাতে পারলাম তো? প্রমাণ পেলে?’
.
শ্রুতি সুন্দর একটি শাড়ি পরে তৈরি হয়ে নিল। আয়নায় নিজের মুখ দেখতেই আপনা আপনি মুখটা কুঁচকে গেল তার। টকটকে লিপস্টিকে মোটেও ভালো লাগছেনা তাকে। হাতের এক ঘষায় মুছে ফেলল ঠোঁটের রঙ। পার্থিব বলল,
‘ এটা কী করলেন আপনি?’
‘ আমাকে ভালো দেখাচ্ছেনা। তাই মুছে ফেলেছি।’
পার্থিব নিজের পাঞ্জবীর পকেট থেকে রুমাল বের করল। ধীরেসুস্থে মুছে ছিল হাতের রঙ। বলল, ‘ আপনি অযথাই বিরক্ত হচ্ছেন। কে বলেছে আপনাকে ভালো লাগছিল না? পার্থিবের শ্রুতিকে সব ভাবেই ভালো লাগে।’
শ্রুতি মলিনকণ্ঠে বলল,
‘ আমি লিপস্টিক লাগাব না।’
‘ ওকে। লাগাতে হবেনা। আর এমনিতেও লিপস্টিকের টেস্ট আমি পছন্দ করিনা।’
শ্রুতি চোখ গরম করে তার হাতে থাকা পাউডারের বক্স দিয়ে বাড়ি দিল পার্থিবের মাথায়। ধমকে বলল, ‘ অসভ্য কথা ছেড়ে আমাকে তৈরি হতে সাহায্য করুন।’
পার্থিব সামনে থেকে লিপগ্লস তুলে নিল। বলল, ‘ এটা লাগাতে পারেন।’
শ্রুতি বিনাবাক্যে মেনে নিল।
শ্রুতি সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে নিতেই পার্থিব পেছন থেকে শ্রুতিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ আপনাকে মাহাথির ভাইয়ার দেওয়া পোশাকে কিন্তু দারুণ মানিয়েছে। একদম পারফেক্ট মাহাথির ভাইয়ার শালি লাগছে।’
বলেই গভীরভাবে চুমু খেল পার্থিব। পার্থিবের এমন কান্ডে শ্রুতি হুরমুর করে সরে গিয়ে রাগী চোখে তাকাল। পার্থিব হেসে দিয়ে বলল, ‘ এইবার পার্থিবের বউ লাগছে।’
.
জীবনের একঘেয়েমি, ক্লান্তি, নির্জীবতা বিলীন হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সান্নিধ্যে এলে। তাইতো জীবনের মলিন পাতা উলটিয়ে সতেজ পাতা খুলতে সবাই চলে এসেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা একটি পার্কে। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ সৌন্দর্যে ভরা। জায়গায় জায়গায় দেখা যাচ্ছে সিমেন্টের তৈরি বসার জায়গা। তবে কোনো কৃত্রিমতায় গেল না তারা। সবাই মিলে চলে গেল গাছের নিচে।
আজ বিকেল থেকেই তারা ঘুরোঘুরি করে কাটিয়েছে। প্রথমে বাচ্চাদের পার্কে গেল। উদ্দেশ্য ছিল হামিমকে খুশি করা। হামিম সেখানের প্রতিটা খেলনায় উঠল ভীষণ উৎসাহ, উৎফুল্ল হয়ে। একেকটা জিনিসে ওঠে আর তার হাসিমুখের উজ্জ্বলতা আরোও বৃদ্ধি পায়। হাসি যেন সরেই না মুখ থেক। তাইতো দোলনা, হাঁস কিছুই বাদ যায়নি। সবাই মিলে নৌকাতেও ঘুরেছে। সবশেষে কৃত্রিমতার আনন্দ নিয়ে, সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া করে এসেছে সতেজ জায়গায়। বসেছে গাছের নিচে। প্রাকৃতিক সতেজতার সাথে নিজেদেরও সতেজ করে তুলছে তারা।
পার্থিব হামিমের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ কী ছোটভাই, দিন কেমন কাটল?’
‘ অন্নেক সুন্দর। আমি অনেক খুশি।’
মাহাথির বলল, ‘ আমি কিন্তু কথা রেখেছি। বলেছিলাম নড়চড় হাতিতে উঠাব। উঠিয়েছি কিন্তু।’
হামিম দৌড়ে এসে গলা জড়িয়ে ধরল মাহাথিরের। গালে চুমু খেয়ে বলল,
‘ থ্যাংকিউ বড়ভাইয়া।’
পার্থিব ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ আমার থ্যাংকিউ কোথায়? আমি যে নড়চড় করা ক্যাকটাস গাছ কিনে দিলাম?’
হামিমের মনে হতেই সে দৌড়ে দূরে থাকা কিছু ব্যাগের কাছে গেল। ব্যাগ থেকে ক্যাকটাস বের করে আবৃত্তি করল,
‘ কাঠবিড়ালি কাঠবিড়ালি পান্তা তুমি খাও?
ফুচকা-মুড়ি খাও? ডালভাত খাও? ছবি আঁকতে পারো?’
নিজের মতো কিছু আজগুবি প্রশ্ন করল হামিম। সে থামার সাথে সাথেই ক্যাকটাস গাছটিও তারমতো করেই বলতে শুরু করল। হামিম চোখ বড় বড় করে ফেলল। কেনার পর থেকেই সে এই গাছের সাথে কথা বলছে। তবুও তার মুখের উৎফুল্লতা দেখে মনে হলো এইবার যেন সে প্রথম শুনল ক্যাকটাসের কথা। লাফিয়ে উঠল। দৌড়ে এসে বলল,
‘ কাঠবিড়ালি চেয়েছিলাম। কাটাকাটা গাছ চাইনি।’
পার্থিব হতাশ হলো। হামিমের দৌড় দেখে সে ভেবেছিল, দৌড়ে এসে তাকে থ্যাংকিউ দিবে। পার্থিবের প্রতিক্রিয়া দেখে শ্রুতি, বিভা দু’জনেই হেসে ফেলল।
এরপর সবাই বসে বিশ্রাম নিতে লাগল কিছুক্ষণ।
.
হামিম যেখানে যায় তার ক্যানভাস-রং নিয়ে যায়। আজও ব্যতিক্রম নয়। তাইতো সে তার মাঝারি ধরনের ছোট ক্যানভাস নিয়ে বসে গেছে ড্রইং করতে। দূরে বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য নিবদ্ধ করতে ব্যস্ত সে।
শ্রুতি মোটাসোটা একটা গাছের সাথে গা হেলিয়ে দিয়ে আছে। দৃষ্টি জ্যোৎস্নার আলো সৃষ্টিকারী উৎসের দিকে। তবে তার দিকে যে তার থেকেও ভীষণ গভীরচোখে কেউ তাকিয়ে আছে সে খেয়াল তার নেই। সে ব্যস্ত নিজের কাজে। পার্থিব শ্রুতির হাসিমুখের দিকে চেয়ে ছিল। ওমনি শ্রুতি বলে উঠল, ‘ আমার ওপর থেকে যদি কখনো আপনার মন উঠে যায়। তখন কী হবে?’
পার্থিব কপালে ভাঁজ ফেলল। এতো সুন্দর একটা মূহুর্তে এই কথার খুব দরকার ছিল? আবার ভালোও লাগল শ্রুতির কথায়। মেয়েটা সবসময় তাকে হারানোর ভয় পায়। পার্থিব বলল,
‘ উঠবে না।’
‘ কেন উঠবে না? উঠতেও তো পারে। তাইনা?’
‘ ভালোবেসে ফেললে মন উঠানো ভীষণ কঠিন শ্রুতি।’
‘ উঁহুম। মোটেও কঠিন নয়। মন উঠানো তেমন কোনো কঠিন কাজ নয় পার্থিব। এই পৃথিবীতে সব সম্ভব। আর আমিও তেমন বিশেষ কেউ নই। আমার ব্যবহারও ভালো না। শুধু রাগ করি, চিৎকার করি, ধমকে উঠি। আপনার তো খারাপ লাগে। আমি জানি।’
পার্থিব হেসে ফেলল। বলল, ‘ আপনার মনে হয় আমি আপনার ব্যবহারে কষ্ট পাই?’
‘ পান না?’
‘ জ্বী না মহারানি। মোটেও কষ্ট পাইনা আমি। বরং আপনি এমন ব্যবহার না করলেই আমার সন্দেহ হয় যে আপনি আসলেই শ্রুতি তো। আমার শ্রুতি তো? কারণ পার্থিব তার শ্রুতির রাগেই অভ্যস্ত।’
পার্থিব হাত বাড়িয়ে শ্রুতি এক পাশ থেকে জড়িয়ে নিল। চুলের মাঝে মুখ গলিয়ে বলল, ‘ আপনাকে বলেছিলাম না শ্রুতি যে আমি আপনাকে একটু একটু করে ভালোবেসেছি? আমি সত্যিই আপনাকে একটু একটু করে ভালোবেসেছি। তাই আপনার উপর থেকে ভালোবাসা সরানো মোটেই কোনো সহজ কাজ নয় আমার জন্য। ভালোবাসা সরাতে গেলে আগে যত্ন সরাতে হবে, এরপর মায়া সরাতে হবে, সবশেষে ভালোলাগা, মুগ্ধতা সরাতে হবে। বিস্তর পরিকল্পনার কাজ বুঝলেন তো। এতো কাজ করতে আমি অনাগ্রহী। কারণ আপনার স্বামী নিতান্তই প্যাঁচগোছহীন অলস মানুষ।’
পার্থিবের কথার ভঙ্গিতে খিলখিল করে হেসে ফেলল শ্রুতি। তার হাসির ছন্দে পার্থিব তাকিয়ে রইল। শ্রুতি বলল,
‘ ওকে মহারাজ। আপনাকে বিশ্বাস করল শ্রুতি। এখন আপনি আমাকে কথা দিন যে আপনি সারাজীবন অলস থাকবেন।’
পার্থিব হাসল। বলল, ‘থাকব।’
‘ সাথে আমার করা দোষ নিজের মাথা পেতে নিবেন।’
‘ যথা আজ্ঞা মহারানি।’
শ্রুতি হাসল। পার্থিবের গালে চুমু দিয়ে বলল, ‘ এই না হলে শ্রুতির পার্থিব।’
পরক্ষণেই আবার নিজের মুখ গম্ভীর করল শ্রুতি। ধমকে বলে উঠল, ‘ হাসছেন কেন আপনি? শুনুন! আমি কিন্তু আপনাকে ভালো-টালো বাসিনা।’
পার্থিব শ্রুতির নাক টেনে দিল। বলল,
‘ ভালোবাসতে হবেনা। আমার হয়ে থাকলেই চলবে।’
.
বিভা বসে আছে মাহাথিরের বুকে মাথা ঠেকিয়ে। টুকটাক কথা বলছে মাহথিরের সাথে। মাঝে মাহতিম একবার ঘুমিয়ে উঠল। উঠতেই পার্থিব-শ্রুতি নিয়ে গেল অন্যদিকে। জায়গাটা বেশ নির্জন। নির্জনতার কারণ হিসেবে সময়কেও ধরা যেতে পারে। রাত দশটার মতো বাজে। তবুও তারা বাসায় ফেরেনি। খোলামেলা জায়গা হওয়ায় এখানে সারারাত বসে থাকলেও কেউ কিছু বলবেনা। তাদের উদ্দেশ্য আজ সারারাত এখানে কাটানো। তবে উদ্দেশ্য হয়ত পূরণ হবেনা। আরেকটু পরেই রওনা হবে তারা সবাই।
দূরে হামিম ড্রইং করছে। সেই কখন থেকে ড্রইং করছে ছেলেটা! এতো যে কী আঁকছে আল্লাহ মা’বুদ জানে।
বিভা মাথা উঠিয়ে মাহাথিরের দিকে তাকাল। বলল, ‘ আপনি কিন্তু ভীষণ অন্যায় একটা কাজ করেছেন।’
মাহাথির বিভার চুড়ি নড়চড় করছিল। সেদিকে তাকিয়েই বলল, ‘ কী অন্যায়?’
‘ আপনি ছেলের নাম নিজের নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছেন।’
মাহাথির ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ এখানে অন্যায়ের কী হলো?’
বিভা রোষানল কণ্ঠে বলল, ‘ অবশ্যই অন্যায় আছে। শুধু যদি ছেলের নাম নিজের নামের সাথে মিলিয়ে রাখতেন তাও নাহয় মানতাম। কিন্তু আপনি আমাদের ভবিষ্যত মেয়ের নামও নিজের নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছেন। এটা কী ঠিক?’
মাহাথির মুচকি হাসল, ‘ ঠিক না কেন? অবশ্যই ঠিক। মাহাথিরের ছেলে মাহতিম। মাহাথিরের মেয়ে মেহেরিমা।’
বিভা মন খারাপ করে বলল,
‘ একটা নাম অন্তত আমার সাথে মিলাতেন। খারাপ কোথাকার!’
মাহাথির বিভাকে টেনে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। বিভাকে জ্বালাতে চাইল। বলল, ‘ আমি ইচ্ছেকরে ওদের নাম আমার নামের সাথে মিলিয়েছি। যেন মানুষেরা শুনলেই বুঝতে পারে ওরা আমার ছেলেমেয়ে। বিভা! সে আবার কে!’
বিভা সামনে মাহাথিরের হাত। তার মাঝে হটাৎ করেই গর্ভকালীন সময়ের একটি ইচ্ছে উদ্যত হলো। মুখ এগিয়ে কামড় দিল বেশ জোরে-সোরেই। মাহাথির হেসে ফেলল বিভার কাজে। বিভার চুল আলতো মুঠোয় পুরে নিজের কাছে এনে জড়িয়ে ধরল। বিভা রাগী গলায় বলল, ‘ যে নিজের ছেলেকে হিংসা করে তার আবার বড় বড় কথা। হুহ…’
মাহাথির এবার শব্দ করে হাসল। মেয়েটাকে রাগলে তো দারুণ লাগে। বিভার গালে শব্দ করে চুমু খেল মাহাথির। রাগী চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ আমার বিভাকে আমি কারোর সাথে ভাগ করবনা। নিজের ছেলের সাথেও না।’
মাহাথির বিভার গাল চেপে ধরে নিজের দিকে ঘুরাল। বলল, ‘ শুনে রাখো। মাহতিমকে ভালোবাসার আগে তোমার মাহথিরকে ভালোবাসতে হবে। বুঝেছো?’
বিভা কিছু বলল না। মাহাথির নিজে থেকেই আবারো বলল, ‘ একটা আইডিয়া পেয়েছি বিভা। আমরা অনেকগুলা বাচ্চা নিব। আর প্রতিটা বাচ্চাকেই তো তুমি ভীষণ আদর করতে চাইবা। কিন্তু পারবানা। কারণ শর্ত হিসেবে থাকবে বাচ্চাদের আদর করার আগে বাচ্চার বাবাকে আদর দিতে হবে তোমার। এতে করে আমি কতো আদর পাব ভাবতে পারছো তুমি!’
মাহাথিরের এমন কথায় বিভা ভীষণ লজ্জা পেল। মুখ লুকাল মাহথিরের বুকে। সেও নিজের স্ত্রীর মাথায় হাত বুলাতে লাগল সযত্নে। বেশ কিছুক্ষণ বাদে বিভা মাথা তুলল। মায়াময়, কাতর চোখে চেয়ে বলল,
‘ আগে তো শুধু বলতেন আপনার কেউ নেই, কেউ নেই। এখন? এখনো কী নিজেকে একা লাগে আপনার?’
মাহাথির বিভার হাতে চুমু খেয়ে বলল,
‘ পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ মনে হয় নিজেকে। আল্লাহকে প্রতিমুহূর্তে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করে আমার এতো সুন্দর জীবনের জন্য।’
.
সবাইকে একযোগ করা হয়েছে। কাজটা করেছে হামিম। উদ্দেশ্য নিজের আঁকা ড্রইং সে সবাইকে একসাথে দেখাবে। দেখাবে বলেও আবার সে উধাও। দূরে গিয়ে আবার আঁকতে বসেছে।
বিভা চারদিকে তাকাল। দূরে হামিম আঁকছে, পাশে মাহাথির। তার সামনের কিছু দূরে শ্রুতি-পার্থিব বাবুকে নিয়ে খেলছে। ছবি তুলছে। বিভার ভীষণ আফসোস হলো। মনে হলো এতো সুন্দর দৃশ্যের পিছনের অবদানে কোথাও না কোথাও আমিন শিকদার রয়েছে। হ্যাঁ, অবশ্যই রয়েছে। সে ছিল বলেই শ্রুতি পার্থিবকে, সে মাহাথিরকে পেয়েছে। যতোই ভাগ্যে থাকুক না কেন, উছিলা তো আমিন শিকদারই ছিল। বিভা ভাবল বাসায় গিয়ে একদিন মানুষটাকে ফোন করবে। ফোন করবে বলবে, আব্বু থ্যাংকিউ।
কথাটা ভাবতেই বুকটা ধ্বক করে উঠল। আজ কতোদিন পর সে আমিন শিকদারের উদ্দেশ্যে আব্বু উচ্চারণ করল তার হিসাব নেই। বিভা হাপ ছাড়ল।
হাত বাড়িয়ে পাশে থাকা ব্যাগ থেকে বের করল তার মায়ের ডায়েরি। পেজ উলটিয়ে সর্বশেষ লেখা পাতায় গেল। চোখে পরল তার আগের পৃষ্ঠার গোটা গোটা অক্ষরের লেখা –
| তুমি সবসময় ভালো থাকো আমিন। তুমি তোমার ভালোবাসার ভালোবাসায় ভালো থাক। এতোকিছুর পরেও আমি তোমাকে ভয়ংকরভাবে ভালোবাসি।|
এবার সে পাতা উলটিয়ে উলটিয়ে সর্বশেষ পেজে গেল। সেখানে লেখা –
| আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি আর কখনো ফিরব না। এই সুন্দর দুনিয়া দেখতে পারব না। আমার মৃত্যুর কষ্টের থেকেও বেশি কষ্ট এই ভেবে যে আমি আমার সন্তানদের আগলে রাখার জন্য এই দুনিয়ায় থাকব না। কী হবে ওদের? ওরা কী ভীষণ কাঁদবে আমাকে ছাড়া? হে আল্লাহ! তুমি ওদের ভালো রেখ। ওদের চোখ থেকে এক ফোঁটা পানিও পরতে দিওনা। ওরা যেন ভালো থাকে। ভীষণ ভালো থাকে। ওদের পৃথিবীতে যেন কোনো দুঃখ, কষ্ট, বিশ্বাসঘাতকতা না থাকে। ওদের দুনিয়া জুড়ে তুমি ভালোবাসা দিয়ে ভরে দিও। আমার সন্তানেরা খুব দুর্বল আল্লাহ। ওরা কষ্ট সহ্য করতে পারবেনা। ওদের তুমি কষ্ট দিওনা। আমার তিন জীবন্ত পুতুলকে তুমি ভালো রেখ।|
বিভা হাপ ছাড়ল। ডায়েরির সর্বশেষ লেখা পাতার বিষয়বস্তু জুড়ে আছে তারা তিন ভাইবোন। বিভা কলম তুলে লেখা শুরু করল –
মায়ের তিন জীবন্ত পুতুল ভালো আছে। বিভা, শ্রুতি, হামিম সবাই ভীষণ ভালো আছে। যে বিভার কাছে মাহাথিরের মতো স্বামী আছে, যে শ্রুতির কাছে পার্থিবের মতো স্বামী আছে তারা কখনো খারাপ থাকতেই পারেনা। হামিম। সেও ভালো আছে। সে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। হাঁটাহাঁটি করে, দৌড়াদৌড়ি করে। পাখির মতো উড়ে বেড়ায়। সবার চোখের মণি সে।
সবশেষে, তাহিরার তিন জীবন্ত পুতুলকে সৃষ্টিকর্তা ভীষণ ভালো রেখেছে। আজ তারা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
বিভা ডায়েরি বন্ধ করল। পাশে তাকাতেই দেখল মাহাথির তাকিয়ে আছে। মাহাথির এগিয়ে এসে বিভার কপালে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিল।
‘ কোনটা বেশি ভালো হয়েছে? এটা? নাকি এটা?’
হামিমের প্রশ্নে সবাই ভীষণ মনোযোগ দিয়ে দু’টো ছবি পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে তাদের সবাইকে। একটি গাছের সাথে বিভা, মাহাথির বসে। অন্য একটি গাছের সাথে পার্থিব, শ্রুতি দাঁড়িয়ে। পার্থিবের কোলে মাহতিম। দূরে হামিম নিজেও আছে। বাস্তবের মতো ছবির ভেতরেও সে ড্রইং এ ব্যস্ত। এই ছবির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু হলো আকাশের উজ্জ্বল চাঁদ এবং তারকারাজি।
অন্যদিকে, আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে ভীষণ সুন্দর আকাশ। রাতের আকাশ। আকাশে স্বাভাবিকভাবে চাঁদ-তারার খেলা চলছে। এই ছবির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো ছবির মধ্যেও প্রাকৃতিক পরিবেশে জ্যোৎস্নার আলো ঠিকরে পড়ছে। তবে এই ছবির নক্ষত্রগুলো একটু অন্যরকম ধরনের সুন্দর আর আকাশের দু’পাশে দু’টো চাঁদ সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার।
দু’টো ছবি দেখেই সবাই ভীষণ বিমোহিত হলো। দ্বিধায় পড়ল কোনটা সুন্দর বলবে সে ব্যাপারে। শ্রুতি অবাক হয়ে শুধাল,
‘ এই ছবিতে দু’টো চাঁদ কেন?’
হামিম গম্ভীরমুখে বলল, ‘ একটা আম্মু, একটা দাদী।’
শ্রুতি খুব সুন্দর করে হাসল। একদিন সেই তার কল্পনার আকাশ তার ভাইকে শুনিয়েছিল। আর আজ কিনা সে সেই আকাশই এঁকে ফেলেছে!
মাহাথির বলল,
‘ দু’টোই ভীষণ সুন্দর হয়েছে ব্রাদার। একদম চমৎকার দু’টো ছবি হয়েছে।’
পার্থিবও হাসিমুখে বলল,
‘ একদম। একশোতে একশো। ছবিগুলোর থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছেনা একেবারে। কোনো আর্টিস্টের থেকে কম নয়। বরং বেশি। আজ থেকে তোমার নাম হলো ভবিষ্যত শিল্পী।’
বিভা হাত বাড়িয়ে দু’টো ছবি নিল। রাতের আকাশের ছবির দিকে তাকিয়ে দেখল জ্বলজ্বল করা তারাদের মাঝে তাদের সবার নাম লেখা। বিভার কাছে দারুণ লাগল ব্যাপারটা। হাসিমুখে বলল, ‘ এগুলো আমরা?’
হামিম উপর-নিচ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিল। শ্রুতি উৎফুল্ল হয়ে বলল,
‘ এগুলো নাহয় আমরা। কিন্তু পাশের তারাগুলো কারা? এইগুলোও তো জ্বলজ্বল করছে।’
হামিম ভীষণ বিজ্ঞ কণ্ঠে বলল,
‘ তোমরা কিচ্ছু জানো না। এই তারাগুলো হলো তোমাদের বাড়ির মানুষেরা আর তোমাদের বাড়ির মানু্ষেরা।’ প্রথমে বিভাকে ইঙ্গিত করে এরপর শ্রুতিকে ইঙ্গিত করে বলল হামিম। মাহাথির, পার্থিব বুঝল যে হামিম তাদের বাড়ির মানুষদের বুঝাচ্ছে।
হঠাৎ করেই শ্রুতি বলে উঠল,
‘ একি! তুই তো বাবুর নামই লিখিসনি ভাই।’
হামিম এগিয়ে এলো। বাবুর নাম সে লিখেছে। সবার উপরের সুন্দর তারাটার মাঝে বাবুর নাম লিখেছে। সেটাই দেখাতে উদ্যত হলো সে। কিন্তু তখনি শ্রুতির কোল থেকে শক্তি দেখিয়ে মায়ের কোলে হামলে পড়তে চাইল মাহতিম। মাহতিমের এমন আক্রমণ শ্রুতি আশা করেনি। ভড়কে গিয়ে টেনে আনল সে। কিন্তু আনার পর ঘটে গেল আরেক কান্ড। মাহতিমের হাতে ড্রইং এর অর্ধেক কাগজ। আসার সময় কাগজ ধরে টান দেওয়াতে মাঝখান থেকে ভাগ হয়ে গেছে। সাথে অর্ধেক মাহতিমের হাতে চলে এসেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতভম্ব হয়ে গেল।
নিজেদের অবাকের উচ্চতা থেকে নামিয়ে স্বাভাবিক হলো সবাই। হামিমের দিকে লক্ষ্য করতেই দেখা গেল ইতিমধ্যে তার চোখ ভরে উঠেছে। পার্থিব, মাহাথির তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গেল। পার্থিব বলল,
‘ কাঁদেনা হামিম। কাঁদেনা। দেখ ও তো ছোট তাইনা? ও বুঝতে পারেনি।’
হামিমের পরিবর্তন হলোনা। তাই মাহাথির নিজেও ব্যগ্র কণ্ঠে বলল,
‘ কেঁদোনা প্লিজ। ভাইয়া তোমার পেটে নড়চড় হাতি দিব। তাও কেঁদোনা।’
হামিম কাঁদল না। কাঁদোকাঁদো মুখে বলল,
‘ দেও তাহলে।’
মাহাথির হতাশ হলো। আবার সে ভুলভাল বলে ফেলেছে। পরিস্থিতি বুঝে আসতেই সবাই হেসে ফেলল। হাসল মাহাথির নিজেও। সবার একযোগের হাসি পরিবেশে প্রতিধ্বনিত হলো ছন্দের মতো সুর তুলে। আকাশ জুড়ে লক্ষ কোটি তারা থাকলেও নিস্তব্ধত রাত্রিতে তাদের হাসিমুখ তারাদেরও হার মানাল। জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোয় তারাদের মতো জ্বলজ্বল করতে লাগল তারা সবাই। প্রকৃতির কাছে মনে হলো আকাশের তারাগুলো যেন মানুষরূপে জমিনে পতিত হয়েছে। সবাই যেন আকাশের জ্বলজ্বল করতে থাকা তারা। একগুচ্ছ শুকতারা।
সমাপ্ত
_______