একঝাঁক জোনাকি পর্ব-২১

0
181

#একঝাঁক_জোনাকি
#ইশরাত_জাহান_অধরা
#পর্বঃ২১

নিহান হাসপাতালে বসে রোগী দেখছিলো।বেবি হবার অনেকদিন পর এসে কেবল হাসপাতালে বসেছে।এরমধ্যেই রোগীর বিরাট লাইন লেগে গেছে।ঠান্ডা মাথায় এক এক করে রোগী দেখা শেষে একজন দরজায় এসে নক করে বলল,

“আসব?”

নিহান কাগজ দেখতে দেখতেই বলল,

“জ্বি আসুন।”

সামনের ব্যাক্তি চেয়ারে বসতেই নিহান বলল,

“আপনার সমস্যা বলুন।”

“অনিমা আপুকে বিয়েই করে ফেললেন?”

এমন কথা শুনে নিহানের ভ্রু কুঁচকে এলো।সামনের ব্যাক্তিটা কে দেখার জন্য তাকাতেই তিথিকে নজরে আসলো।নিহান হেসে বলল,

“জ্বি একেবারে বিয়েই করে ফেললাম!আসলে বিয়ের করার জন্য আর তর সইছিলো না!”

নিহানের এমন লাগামহীন কথা শুনে তিথি শক্ত কন্ঠে বলল,

“শেষ পর্যন্ত একটা প্রেগন্যান্ট মহিলাকে বিয়ে করলেন!বাচ্চাটা তো আপনার না!”

এতক্ষন হাসিমুখে থাকলেও তিথির কথাটা শুনে নিহানের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।তবুও নিজেকে শান্ত করে বলল,

“বাচ্চাটা আমারই বাচ্চা!আমি ওকে আমার বাচ্চা হিসেবে মেনে নিয়েছি।”

তিথি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,

“আপনি মেনে নিলেই অই বাচ্চাটা সে সোহানের বাচ্চা সেটা কিন্তু বদলে যাবে না!আপনি শুধু শুধু শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছেন!”

“আমি কোন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছিনা।আমি শুধু একটা বাচ্চাকে সুস্ত একটা পরিবার দেবার চেষ্টা করছি।একজন ভালো, দায়িত্ববান বাবা দেবার চেষ্টা করছি,সমাজের নোংরা কথা শুনার কাছ থেকে ওকে রক্ষা করছি।”

“আচ্ছা আপনার কথাই মেনে নিলাম।আপনি ওর বাবা হলেন কিন্তু ওর সত্যিকারের বাবা যদি বাচ্চাকে ফেরত নিতে চায় তখন আপনি কি করবেন? আপনি যতোই ওর বাচ্চার বাবা সাজবার চেষ্ঠা করুন না কেন ওর বাবা যদি ওকে নিতে চায় তখন আপনার কোন অধিকারই থাকবে না ওকে আটকাবার!তার উপর ও যদি বড় হয়ে জানতে পারে আপনি ওর আসল বাবা না তাহলে আপনাকে ও কি পরিমান ঘৃণা করবে সেটা কি আপনি বুঝতে পারছেন?”

কথাটা শুনেই নিহান নুইয়ে পরল।আসলেই তো!ও তো কোনদিন ভেবে রাখেনি সোহানের কথা।সোহান যতো বড় অপরাধই করুক না কেন অরিনের উপর ওর পুরোপুরি অধিকার আছে।এই অধিকার যদি আদায় করতে চায় তখম নিহান কি করবে?কিছুই করার থাকবে না ওর শুধু চুপ করে বসে দেখা ছাড়া।কথাটা আগে মাথায় আসলো না কেন?

“কি হলো চুপ করে আছেন যে?কোন উত্তর নেই আপনার কাছে তাই তো?”

“পরেরটা পরে ভাবা যাবে।এখন ভেবে কোন লাভ নেই।আপনি এসব কথা কেন তুলছেন?”

“আপনাকে ছোট্ত একটা সাহায্য করতে চাই।”

“কি সাহায্য? ”

“আপনি অনিমা আপুকে বিয়ে করেছেন এতে আমার কোন অসুবিধা নেই।আমি আমার মাথার মধ্যেও এই কথা রাখব না।জাস্ট আপনি আপুকে ডিভোর্স দিয়ে আমাকে বিয়ে করুন তাহলে আপনাকে কোন ঝামেলায় জড়াতে হবে না। শুধু শুধু আপুর ঝামেলার সাথে আপনি কেন জড়াবেন বলুন?আপুর ঝামেলা আপুই সামলাক না!আপনি এত কষ্ট করে ডাক্তারি পেশায় এসেছেন।আমি জানি এই পর্যন্ত পৌছাতে কত্ত কষ্ট লাগে৷ অনেকে তো পারেও না।আপনি পেরেছেন।আপুর জন্য এত কষ্ট জলে ভাসাবেন বলুন?আপনাকে যদি কোর্টে তোলা হয় তখন?”

“আমার কিছু আসবে যাবে না!অনিমার জন্য যদি আমাকে পেশা থেকে বেরিয়ে যেতে হয় তাহলে আমি তাই করব।একটা ছোটখাটো চাকরি করব দরকার হলে।দিব্বি সংসার চলে যাবে আমাদের।আর আপনাকে বিয়ে করার অফারটা!সরি টু সে আপনার কথাটা আমি রাখতে পারছি না।একজন বোন হয়ে কি করে বোনের সংসার ভাংগতে হয়ে সেটা আপনাকে দেখে শেখা উচিত।সৎ বোন হোন বোন তো?কি করে আপনি আমাকে পরামর্শ দেন?অবশ্য আপনি তো অনিমাকে বোনই মনে করেন না।এতদিন সংসারের বোঝা মনে করে এসেছেন!আমার মনে রাখা উচিত ছিলো।”

বলেই চেয়ার থেকে উঠে রুম থেকে বের হতে হতে নার্সকে বলল,

“আজকে আর রোগী দেখবনা!কালকে আসতে বলবেন ওদেরকে।”

“জ্বি স্যার! ”

নিহান বের হয়ে যেতেই তিথি দাঁতে দাঁত চেপে রেগে সামনে থাকা পানির গ্লাসটা হাত দিয়ে ভেংগে ফেলল।এত করে চাইছে নিহানকে বশে আনতে পারছেই না!রাগে চোখ থেকে পানি বেরিয়ে আসলো।বসা থেকে উঠে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেলো।
.
.
কলিংবেলের আওয়াজ শুনেই অনিমা কাঁপড়ে ভিজা হাত মুছতে মুছতে দরজা খুলতেই নিহানের ক্লান্ত মুখ চোখ এড়ালোনা অনিমার।অনিমাকে দেখেই একটা দুর্বল হাসি দিয়ে বাসায় ঢুকলো।সোফায় বসে জুতা খুলছে।অনিমা কিচেনে গিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত বানিয়ে এনে নিহানের দিকে এগিয়ে দিলো।নিহান কিছু না বলে অনিমার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে নিমিষেই শেষ করে বলল,

“অরিন কি করছে?”

“সারাদিন ঘুমিয়েই ছিলো।একটু আগে ঘুম থেকে উঠলো। ”

“অহ আচ্ছা।আম্মু আর মারিয়া কোথায়?”

“মারিয়ার কি নাকি লাগবে অইটাই আনতে বাইরে গেছে।”

“আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

বলেই রুমের দিকে এগিয়ে গেল।নিহানের চালচলন অনিমার কাছে ভালো লাগছে।এত চুপচাপ তো থাকে না লোকটা।তাহলে আজ হঠাত কি হলো?রুমে যেতেই নিহানের চোখে পরল অরিনকে। শুয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে।এই কয়েকদিনের মধ্যে বাচ্চাটার প্রতি এক মায়া জম্মে গেছে নিহানের।নিহান এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলো অরিনের দিকে।বিছানায় বসে একটু ঝুঁকে কপালে চুমু খেয়ে বলল,

“তুই আমারই মেয়ে।দুনিয়ার সবাই বিপরীত কথা বললেও আমি চিৎকার করে হলেও বলব তুই আমার মেয়ে।”
.
.

“এইযে মিস আপনার হাতে রক্ত!”

বাসে পাশে বসা লোকটার কথা শুনে রাগে শরীর রিরি করে উঠলো তিথির শরীর।রাগটাকে চেপে দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বলল,

“আমার হাতে রক্ত তো আপনার কি?আপনার গায়ে তো আর লাগিয়ে দিচ্ছি না।”

“লাগাচ্ছেন না ঠিক তবে আমার রক্তে ফোবিয়া আছে।মাথা ঘুরাচ্ছে।”

তিথি বিরক্ত হয়ে বলল,

“তো অন্য কোন সিটে বসুন না!আমার কানের কাছে প্যান প্যান করছেন কেন?

” পেছনে সিট খালি নেই।”

তিথি একবার লোকটার দিকে তাকালো।এই মুহুর্তে না নিহানের আর না অনিমা এদের কারোর প্রতি এতো বিরক্ত লাগছেনা যতোটা না পাশে সিটে বসে থাকা লোকটার উপর লাগছে।ঘাড় ঘুরিয়ে চেক করে দেখল আসলেই সিট খালি নেই।

“আপনার ফোবিয়া কমানোর জন্য আমি কি করতে পারি?”

ছেলেটা কিছু না বলে কোলের উপর থাকা ব্যাগ থেকে একটা ব্যান্ডেজ বের করে তিথির দিকে বারিয়ে দিয়ে বলল,

“ক্ষতস্তানে বেন্ডেজটা লাগান তাহলে রক্ত আমার চোখে পরবে না।ফোবিয়াও কমে যাবে।”

তিথি ছেলেটার হাত থেকে বেন্ডেজ নিয়ে হাতে লাগিয়ে নিলো।ছেলেটাও শান্তিতে সিটে হেলান দিয়ে কানে ইয়ারফোন গুজে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো।
কিছুক্ষন বাদেই তিথির কাংক্ষিত স্টেশনে আসলে নেমে দাঁড়াতেই জানলা থেকে মাথা বের করে ছেলেটা বলল,

“সরি মিস!আপনাকে মিথ্যা বলার জন্য।আমার রক্তে কোন ফোবিয়া নেই।বেন্ডেজটা বাধবার জন্যই আপনাকে মিথ্যা কথা বলা।”

তিথি রেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই বাস স্টার্ট দিয়ে দিলো।ছেলেটা হেসে হাত নাড়িয়ে বাই বলে জানলার ভিতর মাথার ঢুকিয়ে নিলো।তিথি রাগে হাতের বেন্ডেজ খুলে ছুড়ে ফেলো রাস্তায়।তিথির মা কেবল রান্না ঘর থেকে সব কাজ সেরে রুমে এসে বসেছিলেন ফ্যান ছেড়ে।মেয়ের এমন অবস্তা দেখে বসা থেকে দৌড়ে মেয়ের কাছে গিয়ে হাতটা নিয়ে বললেন,

“কিরে?তোর হাতের এই অবস্তা হলো কি করে?”

তিথি বিরক্ত হয়ে হাত ছাড়িয়ে বলল,

“কিছু হয়নি মা!জাস্ট কেটে গেছে?কত রক্ত বের হয়েছে!তুই এটাকে জাস্ট বলছিস?”

“বাদ দাও না!ভালো লাগছে না।আমি রুমে গেলাম।তোমরা রাতের খাবার খেয়ে নিও।আমি খাবোনা।”

“কিন্তু কেন খাবি না?কিছু খেয়ে এসেছিস বাইরে থেকে?”

“নাহ!কিছু খেয়ে আসিনি।প্লিজ ডোন্ট ডিস্টার্ব মি!”

বলেই মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো।

.
.
অনিমা রাতের খাবার শেষ করে কিচেন রুম থেকে হাত ধুয়ে আসলো।অন্য দিন নিহান নিজ হাতে খাইয়ে দেয় কিন্তু আজকে খাবারটা রুমে এনে অনিমার কাছে দিয়ে সেই যে বারান্দায় গেছে আর খবর নেই।অনিমা একটু এগিয়ে বারান্দায় উকি দিয়ে দেখল নিহান রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে।অনিমা হেঁটে গিয়ে নিহানের পাশে দাঁড়ালো।নিহান এখনো কিছু টের পায়নি।

“কি ভাবছেন?”

অনিমার কন্ঠ শুনে চমকে পাশ ফিরে তাকাতেই অনিমাকে দেখে শান্ত হয়ে আবার সামনে তাকালো।

“কখন এসেছেন?”

“এইতো এইমাত্র!কি এতো ভাবছেন?”

“কিছুনা।”

“ঘুমাবেন না?”

“হুম।একটু পরে ঘুমাবো।”

কিছুক্ষন থেমে আবার জিজ্ঞেস করলো,

“অরিন ঘুমাচ্ছে?”

“হুম!”

“আপনাকে আজকে এমন লাগছে কেন?”

নিহান হেসে বলল,

“কেমন?”

“এইযে মনমরা!কেমন চুপচাপ।আপনি তো এমন না!”

“সবাই যে সবসময় ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে থাকে কথাটা কে বলেছে আপনাকে?”

“কেও বলেনি।মনে হলো।আচ্ছা কিছু কি হয়েছে?মন খারাপ আপনার?”

“মন খারাপ হলেই বা কি?আপনি ভালো করে দিবেন?”

“নাহ!বাট মনের কথা শেয়ার করলে নাকি মন খারাপ হয়ে একটু হলেও কমে!আপনি বলতে পারেন আমাকে।”

নিহান অনিমার দিকে ফিরলো।

চলবে….