#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২০।
‘মা, আমি আজকে ভুলেও শাড়ি পরতে পারব না।’
আসিয়া বেগম কপাল কুঁচকে চেয়ে রইলেন। তাঁর দৃষ্টি বলছে, তিনি বিরক্ত। শাড়িটা মেয়ের গায়ের উপর রেখে বললেন,
‘দেখ, তোকে কত সুন্দর দেখাচ্ছে।’
অন্বিতা অন্যদিকে ঘুরে বসল। মায়ের কথাকে প্রতিহার করে বলল,
‘একেবারেই না। আর সবথেকে বড়ো কথা হলো, শাড়িতে আমি অভ্যস্ত না।’
‘অভ্যস্ত হতে হবে। বিয়ের পর শাড়ি’ই পরতে হবে বেশি। এখন কথা কম বলে, চুপচাপ শাড়ি পরে সেজে নে। ছেলেটা চলে আসবে।’
আসিয়া বেগম রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। অন্বিতা শাড়ি হাতে নিয়ে বসে আছে ঠায়। শাড়ির পরার ইচ্ছে নেই। শাড়িতে অস্বস্তি হয় তার, মাহিরের সামনে গেলে সেই অস্বস্তি দ্বিগুণ বাড়ে। কিন্তু সেসব কি আর মা বোঝেন!
অগত্যাই শাড়ি গায়ে জড়াল অন্বিতা। নামমাত্র মুখে প্রসাধনী মাখল। যদিও বোঝার জো নেই, মুখে আদৌ কিছু আছে কী নেই।
শাড়ির কুঁচিগুলো টেনে ঠিক করল। তারপর আয়নায় চেয়ে দেখল নিজেকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর কী ভেবে যেন একটা ছোট্ট কালো টিপ লাগাল ভ্রু জোড়ার মাঝে। সুন্দর লাগছে। অন্বিতার হাসার চেষ্টা করে। ততক্ষণে নিচ থেকে গাড়ির হর্ণ শুনতে পায়। মাহির চলে এসেছে বোধ হয়। সে পার্সটা নিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বলে,
‘মা, মাহির চলে এসেছেন বোধ হয়, আমি আসছি।’
আসিয়া বেগম মাথা হেলিয়ে বলেন,
‘সাবধানে যাস।’
অন্বিতা বেরিয়ে গেল। সিঁড়ি বেয়ে নামল নিচে। মাহিরের কালো গাড়িটা পরিচিত তার। কাছাকাছি গিয়ে জানলায় টোকা দেয়। ভেতর থেকে দরজা খুলে দেয় মাহির। অন্বিতা উঠে বসে। মাহির গাড়ি স্টার্ট দেয়।
বেশ কিছু সময় পার হয়। দুজনেই নীরব। মাহির এক মনে গাড়ি চালাচ্ছে। দৃষ্টি তার পিচ ঢালা রাস্তার উপর। অন্বিতা কপাল কুঁচকে বসে আছে। মাহিরের হাবভাব সে বুঝতে পারছে না। আসার পর থেকে মাহির একবারও তাকে দেখেনি। আগে তো শাড়িতে দেখলে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকত, তবে আজ দেখছে না কেন? অন্বিতা জানলার কাচ গলিয়ে বাইরে চাইল। মনে মনে ভাবল, না দেখলে না দেখবে, তার কী।
আরো কিছুটা পথ পেরুলো। অন্বিতা আইঢাই করছে। সে অস্থির মন নিয়ে যেন আর বসে থাকতে পারছে না। তাই জিজ্ঞেস করে বসল,
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
মাহির জলদগম্ভীর স্বরে জবাব দিল,
‘গেলেই দেখতে পাবে।’
অন্বিতা ভ্রু কুঁচকাল। মাহিরের হলো কী, সে ঠাহর করতে পারছে না।
বেশ অনেকটা পথ গেল। এইদিকের রাস্তাটা নীরব। গাড়ির হৈ চৈ নেই খুব একটা। রাস্তার দুই পাশে সাড়ি সাড়ি গাছ। মুক্ত, নির্মল বাতাস। গাড়িতে এসি চলছে বিধায় জানলার কাচ বন্ধ। অন্বিতা ক্ষীণ সুরে বলল,
‘লক’টা খুলবেন, আমি একটু কাচটা নামাব।’
মাহির জানলার লক খুলে দিল। জানলাটা নেমে এল নিচের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে সাঁ সাঁ বাতাস হুরমুরিয়ে প্রবেশ করল গাড়ির ভেতরে। অন্বিতার খোলা চুলে নৃত্য শুরু হয়। চোখের পাতা খুলে রাখাও দুষ্কর। অন্বিতা চুল সামলাতে ব্যস্ত। এত লোভনীয় একটা দৃশ্য গাড়ি চালানোর দরুন মাহির উপভোগ করতে পারছে না ঠিকমতো। বিরক্ত হচ্ছে সে।
গাড়িটা থামল। মাহির নেমে এসে অন্বিতার জন্য দরজাটা খুলে দিল। নেমে এল সেও। আশেপাশে চোখ বুলাল অন্বিতা। কোথায় এসেছে বোঝার চেষ্টা আরকি। মাহির বলল,
‘চলো।’
মাহিরের পায়ে পা মিলিয়ে চলল অন্বিতা। কিছুটা সামনে গিয়ে থমকাল সে। একটা বড়ো গাছ। যেটা চমৎকার সুন্দর করে ফুলে সাজানো। দিনের তকতকে চকচকে আলোর মাঝেও ঝিলিমিলি বাতিগুলো দীপ্তমান। গাছের সামনেই দুই চেয়ার সমেত একটা টেবিল। তার উপর ফুলের টব। ফুলের টবে নয়নতারা। অন্বিতা হাসল কিঞ্চিৎ।
মাহির এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে অন্বিতাকে ইশারায় বসতে বলল। অন্বিতা বসল। অপর পাশের চেয়ারটায় বসল মাহির। তারা বসতেই ফরমাল গেটআপের দুজন লোক এগিয়ে এল। মাহির অন্বিতার দিকে চেয়ে বলল,
‘কী খাবে, বলো?’
‘একটা অর্ডার দিলেই হবে।’
অন্বিতার পছন্দ সম্পর্কে মাহিরের আন্দাজ আছে ভালোই। সেই অনুযায়ী’ই খাবার অর্ডার দিল সে।
‘হঠাৎ এতকিছু?’
মাহির আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
‘পছন্দ হয়নি?’
‘না হওয়ার কোনো কারণ নেই।’
‘আজকাল তুমি খুব ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উত্তর দাও।’
অন্বিতা হাসল। বলল,
‘তাতেও তো আপনার বুঝতে অসুবিধা হয় না।’
‘তা কখনো হবেও না।’
অন্বিতা চুপ রইল। জায়গাটা সুন্দর। নীরব, নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে পাখির শব্দ আসছে খানিক। মাহির বলল,
‘অয়ন নামের ছেলেটা অমিতের সাথে একই ফ্ল্যাটে থাকে?’
অন্বিতা মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘জি।’
‘ছেলেটা বেশ ভদ্র। ছেলেটা আমার গাড়িতে উঠলে আমি মাইন্ড করতাম না।’
অন্বিতার টনক নড়ল। মাহির ধূর্ত বেশ। সে কিঞ্চিৎ হেসে বলল,
‘বলেছিলাম আমি। কিন্তু আমার কথা শুনেনি।’
‘তা অবশ্য ভালোই করেছে। গাড়িতে গেলে তো আর রাস্তায় চা খাওয়াটা হতো না।’
ভ্রু উঁচাল অন্বিতা। বাহ, মাহির সব জানে। তার পেছনে কি কোনোভাবে গোয়েন্দা লাগিয়ে রেখেছে না-কি। মাহির রগড় সুরে বলল,
‘এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। স্বামী..না হবু স্বামী হিসেবে এইটুকু খবরা-খবর রাখা আমার দায়িত্ব।’
‘হু, ঠিক বলেছেন। তা আজ রাগ দেখাবেন না? নাকি ফাঁসিতে চড়ানোর আগে কয়েদিকে খাইয়ে পরিয়ে তাজা করছেন?’
মাহির হাসল শব্দ করে। বলল,
‘তুমি যে কী বলো না, এসব ব্যাপারে কেউ রাগ দেখায়? মিষ্টি দেখলে মাছি তো আসবেই, তাই বলে কি আমি মিষ্টি ফেলে দিব?’
অন্বিতা মাথা নাড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই লোকটার সাথে কথা বলে সে পারে না।
খাবার খাওয়া শেষ তাদের। ওয়েটার এসে সবকিছু নিয়ে যাচ্ছে। এরই মাঝে চারদিকটা কেমন যেন ঝিমিয়ে এসেছে। চকচকে দিনটা হঠাৎই কেমন ধোঁয়াশাময় হয়ে উঠছে। পশ্চিমে দেখা যাচ্ছে মেঘের আনাগোনা। অন্বিতা সেদিকে চেয়ে বলল,
‘বৃষ্টি হবে না-কি?’
‘হতেও পারে।’
‘চলুন, তাড়াতাড়ি রওনা দেই।’
‘উঁহু। এখানেই থাকব।’
‘বৃষ্টি এলে ভিজে কাক হতে হবে।’
‘ময়ূর পাশে থাকলে কাক হতে আপত্তি কীসের?’
অন্বিতা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বলে,
‘আপনি আমি সদ্য প্রেমে পড়া প্রেমিক প্রেমিকা নই, এসব ফ্ল্যার্ট না করলেও চলবে।’
‘প্রেমিক প্রেমিকা পুরাতন হলেও প্রেম তো আর পুরাতন হয় না, তবে ফ্ল্যার্ট করতে অসুবিধা কীসের?’
অন্বিতা উঠে দাঁড়াল। বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,
‘আপনার সাথে কথা বলে আমি কখনোই পারব না।’
অন্বিতা পা বাড়াতে নিলেই আষাঢ়ী নৃত্যে ছেয়ে যায় চারদিক। আচমকা এমন বৃষ্টিতে হতভম্ব হয়ে পড়ে অন্বিতা। ছুটে গিয়ে গাছটার নিচে দাঁড়ায়। চোখ ছোট ছোট করে দেখে মাহির এখনো আগের জায়গায় বসা। অন্বিতা গলা স্বর উঁচু করে বলে,
‘কী হলো, আসছেন না কেন? ভিজে যাচ্ছেন তো।’
মাহির জবাব না দিয়ে ঠায় বসে রয়। নির্লিপ্ত চাহনি তার। অন্বিতা বিরক্ত হলো। বলল,
‘জ্বর বাঁধানোর শখ হয়েছে? এই অসময়ের বৃষ্টিতে কত জীবাণু থাকে, জানেন না?’
মাহিরের মাঝে তাও কোনো নড়চড় নেই। এই লোকটা চাইছে’টা কী, সেটাই অন্বিতা ভাবছে।
চলবে….