একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব-২৫

0
151

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৫।

রোগীকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করছে মাহির। দরজার বাইরেই মেয়েটা দাঁড়ান। কাঁদতে কাঁদতে এখন কান্না ভুলে অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেবল। অন্বিতা তার পাশেই। তারও মন ভার। বিড়বিড় করে কেবল আওড়াচ্ছে, “আল্লাহ, লোকটিকে বাঁচিয়ে দাও।”

বিভৎস সময়টা থমকে আছে। এক অযাচিত আতঙ্কে মেয়েটার বুকে মোচড় দিচ্ছে ক্রমাগত। শরীরে তার মৃদু আন্দোলন। মাহির বেরিয়ে এল। চোখে মুখে তার বিষন্নের ছাপ। হতাশ সুরে বলল,

‘আ’ম স্যরি, হি ইস নো মোর।’

অন্বিতার বুকের ভেতরে ধরাস করে উঠে। নিজের বাবার মৃতু সংবাদ’টাও এইভাবেই শুনেছিল। সে ভয়ে ভয়ে তাকাল মেয়েটার দিকে। দেখল, মেয়েটা নীরব। তার মধ্যে হেলদোল নেই কোনো। কেমন যেন মূর্তি হয়ে আছে। মাহির ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,

‘সৃষ্টিকর্তার উপরে যাওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, কিন্তু আল্লাহ হয়তো চাননি। নিজেকে শক্ত করুন, এই চিরন্তন সত্যিকে মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই।’

মেয়েটা ঠোঁট নাড়িয়ে ক্ষীণ সুরে বলল,

‘আমি কি বাবার সাথে দেখা করতে পারব?’

কন্ঠস্বর বলছে, মেয়েটার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মাহির বলল,

‘জি, ভেতরে যান।’

সে নৈঃশব্দে পা ফেলে। এগিয়ে যায় বাবাকে দেখতে। অন্বিতা তাকে ধরতে নিলে মেয়েটা বলে,

‘আমি একা যেতে পারব।’

অন্বিতা দাঁড়িয়ে পড়ে। আর ভেতরে যায় না। বাবা আর মেয়েকে শেষবারের মতো একান্তে কথা বলার সুযোগ দেয়। মাহির অন্বিতার দিকে চাইল। তার চোখে পানি দেখে গালে হাত দিয়ে বলল,

‘ডাক্তারদের এত দূর্বল হলে হয়?’

‘মেয়েটা একেবারে এতিম হয়ে গিয়েছে, মাহির। এই পৃথিবীতে ওর আর আপন বলে কেউ রইল না।’

বিধ্বস্ত সুরে বলল অন্বিতা। মাহির নরম সুরে বলল,

‘যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছেন, অন্বি। চিন্তা করো না, মেয়েটা ঠিক মানিয়ে নিবে। মেয়েটা বেরিয়ে এলে বলো, আমরা এখান থেকে যাওয়ার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে দিব।’

অন্বিতা মাথা হেলাল।

‘মন খারাপ করো না, এই তো সবে এসবের শুরু। কত শত মৃত্যু দেখা বাকি। বি স্ট্রং।’

অন্বিতা কোনো জবাব দিল না। মাহির তার গালে হাত বুলিয়ে নিজের কেবিনে চলে এল।

হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে অন্বিতা আর মাহির। বাকি ওয়ার্ড বয়রা মেয়েটার বাবাকে এম্বুল্যান্স-এ উঠিয়ে দিয়েছে। এখান থেকে গ্রামের বাড়ি যাবে তারা, বাবার দাফন-কাফন সেখানেই হবে। যাওয়ার আগে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে অন্বিতা কেঁদেছিল। মেয়েটার মাঝে যেন সে নিজেকে দেখতে পাচ্ছিল পুরোটা সময়।

মাহির বলল,

‘তুমি বাসায় চলে যাও। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে ঘুম দিও, দেখবে হালকা লাগবে।’

‘সমস্যা নেই, আমি থাকতে পারব।’

‘প্রয়োজন নেই এখানে। আজকে রোগীর চাপ কম। বাসায় যাও, আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি।’

অন্বিতা চলে এল। মনে যেন কেমন অশান্তি লাগছে তার। এমন করলে তো হবে না। ডাক্তার হিসেবে মানুষের মৃত্যুকে স্বাভাবিক চোখে দেখতেই হবে, কোনো ডাক্তারকে এভাবে ভেঙে পড়াটা মানায় না।সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজল সে।

‘ম্যাডাম, এখন যেতে হবে?’

….

‘আচ্ছা ম্যাডাম, আমি অন্বিতা ম্যাডামকে নামিয়ে দিয়েই চলে যাব।’

…..

‘স্যরি ম্যাডাম, উনাকে রাস্তার মাঝখানে নামিয়ে গেলে আমার আর চাকরি থাকবে না। আমার বেশি সময় লাগবে না, দশ মিনিটের ভেতরেই চলে যাব।’

….

ড্রাইভার ফোন রাখতেই অন্বিতার জিজ্ঞেস করল,

‘কোনো সমস্যা?’

‘আর বলবেন না, ম্যাডাম। স্যারের ফুপি একজন আছেন না, উনার মেয়ে না-কি এসেছেন। আমাকে এখন গিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে আনতে হবে। বললাম, আপনাকে নামিয়ে যাচ্ছি। অথচ উনি বলছেন, আপনাকে মাঝ রাস্তায় নামিয়েই যেন চলে যাই।’

অন্বিতার কপালে দৃঢ় ভাঁজ। ফুপির মেয়ে তো একজন’ই আছে, শশী। তারমানে শশী ফিরেছে আবার। চোখ মুখ অনমনীয় হয়ে উঠে তার। অনেক কষ্টের পর মাহিরের সাথে আবার সম্পর্কটা ঠিক হচ্ছে। আবার সেটা খারাপ হউক, সেটা সে চায় না।

____________

‘ভেতরে পেশেন্ট আছেন, ম্যাডাম। আপনি এভাবে ভেতরে যেতে পারেন না।’

ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে মেয়েটা। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘হাউ ডেয়ার ইউ, আপনি আমাকে আটকাচ্ছেন?’

‘স্যরি ম্যাডাম, আমি কেবল আমার দায়িত্ব পালন করছি।’

‘আপনার দায়িত্ব আপনার কাছে রাখুন। আপনার চাকরি খেতে আমার দুই মিনিটও লাগবে না।’

‘ঠিক আছে, আপাতত পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন।’

মেয়েটা আরো রাগল। এমন ভাবে সহকারীর দিকে চাইল, যেন এখনই চোখ দিয়ে ভস্ম করে দিবে। ভেতর থেকে রোগী বেরিয়ে আসতেই ভেতরে চলে গেল সে। বাইরের বাকি রোগী সব চেঁচিয়ে উঠে বলল,

‘আরে, উনি সিরিয়াল ভেঙে ঢুকলেন কেন?’

সহকারী বলল,

‘একটু অপেক্ষা করুন। উনি স্যারের আত্মীয়।’

মাহির অবাক হয়ে বলে,

‘শশী, তুই? বাংলাদেশে কবে এলি?’

শশী নামের মেয়েটা হেলেদুলে এসে চেয়ারে বসল। আহ্লাদির সুরে বলল,

‘এই যে একটু আগে। এয়ারপোর্টে নেমেই তোমার সাথে প্রথমে দেখা করতে এসেছি। আর তোমার বেয়াদব সহকারী আমাকে ভেতরেই ঢুকতে দিচ্ছিল না।’

মাহির কপাল কুঁচকে বলল,

‘ওটা বেয়াদবি না, উনার দায়িত্ব। পেশেন্ট দেখার সময় কাউকে এলাউ করা হয় না। তুই বাড়ি যা, পরে কথা হবে।’

শশী মুখ কালো করে ঠোঁট উল্টে বলল,

‘সেকি, আমি এত কষ্ট করে তোমার সাথে দেখা করতে এলাম, আর তুমি আমাকে এভাবে বাড়ি চলে যেতে বলছো?’

তখনই সহকারী নক করে ভেতরে এল। বলল,

‘স্যরি স্যার, ডিস্টার্ব করার জন্য। তবে বাইরের পেশেন্টরা সব হৈ চৈ করছেন।’

শশী ধমক দিয়ে বলল,

‘আপনি তো বড্ড মেনারলেস। মাহির, এমন একটা লোককে তুমি তোমার সহকারী হিসেবে রাখলে কী করে?’

মাহির সৌজন্যতার খাতিরে ঠিকঠাক রাগও দেখাতে পারছে না। কোনোরকমে নিজেকে সংযত করে বলল,

‘এখন বাড়ি যা, শশী। সেখানে কথা হবে। আমার পেশেন্টরা অপেক্ষা করছেন বাইরে।’

শশী রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে যেন। কোনোকালেই এই ছেলের থেকে সে পাত্তা পায়নি। অথচ বিদেশে এক মারাত্মক চকলেট বয় রেখে সে এই দেশে এসেছে শুধুমাত্র এই ছেলের জন্য। সে ধরাস ধরাস করে পা ফেলে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। মাহির সহকারীকে বলল,

‘এবার সিরিয়াল অনুযায়ী সবাইকে আসতে বলুন।’

‘আচ্ছা, স্যার।’

সহকারী বাইরে গিয়ে আবার সিরিয়াল মতো ডাকল পরের জনকে। শশীকে দেখে তার দিকে ক্ষুব্ধ চোখে চেয়ে আছে। সে খানিকটা এগিয়ে তার সামনে দাঁড়াল। হেসে বলল,

‘আপনি নিজেই তো স্যারের কেবিনে দুই মিনিট বসতে পারলেন না, আমার চাকরি আর খাবেন কী।’

আগুনে ঘি ঢালার ন্যায় জ্বলে উঠল শশী। কটমট করে বলল,

‘আপনাকে আমি দেখে নিব।’

সহকারী চুলে হাত চালিয়ে, শার্টের কলার ঠিক করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর হেসে বলল,

‘নিন, এবার দেখুন।’

শশী পারছে না তাকে গিলে ফেলতে। সহকারী ঠোঁট চেপে হেসে বলল,

‘এর আগে কোনো সুন্দরী মেয়ে আমাকে এভাবে দেখেনি। এবার আমার লজ্জা লাগছে, ইশ!’

এই বলে মেকি লজ্জা পাওয়ার ভান করল সে। শশী চটে গিয়ে আঙ্গুল তুলে কিছু বলতে নিয়েও থামাল নিজেকে। আপাতত মাহিরের কাছে নিজের ইমেইজ’টা নষ্ট করতে চায়না সে। তাই রাগের পাহাড়কে পা মাড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল হনহন করে। তার হিলের কটর কটর শব্দে হাসল সহকারী। মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,

‘বিলাতি ললিতা।’

চলবে….