একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব-৩৯+৪০

0
130

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৯।

প্রভাকর মশাই তার ক্রোধ ছড়াতে ব্যস্ত। আর তার এই চকচকে তকতকে প্রভায় দীপ্তমান ঘরখানা। বিছানায় লেপ্টে থাকা দেহজুড়ে সেই দ্যুতি খেলা করছে। খানিকটা নড়ে উঠে অন্বিতা। সূর্যকর বড্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে তাকে। সে পিটপিট করে তাকায়। আচমকা কোথায় আছে বুঝতে পারে না। ঝলমল জৌলুসে অপরিচিত লাগে সব। পরক্ষণেই নিউরন জেগে উঠে। মাথা তুলতেই চোখে পড়ে উদম দেহের মাহিরকে। ঘুমঘুম আর ফোলা ঠোঁটে এক গাল হাসে সে। তারপর ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে তার বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা চালায়। তবে ব্যর্থ হয় সাথে সাথেই। মাহির ঘুমের মাঝেও তার হাত এত দৃঢ় করে রেখেছে যে ছাড়ানোর জো নেই। অন্বিতা আরেকটু নড়ল। পরক্ষণেই আবার গুঁটিয়ে নিল নিজেকে। আশেপাশে ত্রস্ত চোখে চেয়ে দেখল, তার শাড়ি কোথায়। শাড়িটাকে মেঝের এক কোণে ভীষণ অসহায় অবলীলায় পড়ে থাকতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। চাঁদরটা গায়ে টেনে মাহিরের হাত সরানোর চেষ্টা করল। মাহির তো নড়ল’ই না উল্টো ঘুমের মাঝেই কপাল কুঁচকাল। অন্বিতা মিটিমিটি হাসল তা দেখে। মাহিরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘এই অভদ্র ডাক্তার, ছাড়ো। উঠব আমি।’

মাহিরের কান অবধি বোধ হয় কথাটা গেল’ই না। সে আগের মতোই নিরুদ্বেগ। অন্বিতা ঘড়ির দিকে চাইল। সেকি! দশটা বাজে। কপাল উঁচিয়ে অন্বিতা বলে উঠে,

‘দশটা বাজে, মাহির। এত বেলা অবধি ঘুমালে মানুষ কী বলবে?’

‘মানুষ জানে, কালকে রাতে আমরা ঘুমাইনি। তাই সকালে লেইট করে উঠলে কেউ কিছু মনে করবে না।’

অন্বিতাকে আরেকটু টেনে ধরে চোখ বোজা অবস্থাতেই মাহির বলল। অন্বিতা তার হাত টেনে ধরে বলল,

‘সবাইকে নিজের মতো অসভ্য ভাব নাকি?’

মাহির মাথা ঘুরিয়ে চাইল তার দিকে। চোখ কিঞ্চিৎ খোলা। কন্ঠস্বর নিভু। জড়ানো স্বরে বলল,

‘বউকে আদর করা যদি অসভ্যতা হয় তবে সেই অসভ্যতার উপর আমি পিএইচডি করব।’

অন্বিতা তার বুকের উপর হালকা হাতে চড় মেরে বলল,

‘বাজে কথা না বলে ছাড়ো তো। দাদু, ফুপি সবাই বাসায়। তোমার মান সম্মান না থাকলেও আমার আছে।’

মাহিরের সারা নেই। সে আবারও চোখ বুজে নিয়েছে। অন্বিতা নাক মুখ কুঁচকে নিল। বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,

‘কী শুরু করলে বলো তো? তোমার ঘুম আসলে তুমি ঘুমাও, আমাকে ছাড়ো।’

মাহির হাত আলগা করে চাঁদর টেনে অন্যদিকে ফিরে শু’লো। আঁতকে উঠল অন্বিতা। মাহিরের গায়ের চাঁদরে টান দিয়ে বলল,

‘আরে চাঁদর নিলে কেন? চাঁদর দাও।’

‘উফ, জ্বালাবে না তো। ঘুমাচ্ছি আমি।’

অন্বিতা নিজেকে একবার পরখ করে অসহায় সুরে বলল,

‘আমি উঠব তো, চাঁদরটা দাও।’

মাহির ফিরলও না। বরং বলল,

‘উঠলে উঠো, চাঁদর ধরে টানাটানি করছো কেন?’

অন্বিতা কপট রেগে বলল,

‘চাঁদর ছাড়া উঠতে পারব না, তাই।’

‘না পারলে শুয়ে থাকো।’

মাহির ঘাড়ত্যাড়া সেটা আর নতুন করে বোঝার কিছু নেই। সে যে এখন তার সাথে ইচ্ছে করে ত্যাড়ামি করছে সেটা অন্বিতা বেশ বুঝতে পারছে। তাই রাগ হলেও কিছু বলল না সে। ধীরে ধীরে উঠে বসল। তারপর দ্রুত গিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা শাড়িটা জড়িয়ে নিল শরীরে। যুদ্ধে যেন জয়লাভ করেছে তেমন’ই এক হাসি ফুটল ঠোঁটে। মাহিরের দিকে চেয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,

‘অসভ্য।’

গোসর সেরে বেরিয়ে এসে মাহিরকে দেখল বিছানায় বসে ফোন দেখছে। ফোনের স্ক্রিনে পূর্ণ মনোযোগ তার। অন্বিতা এক পলক তাকে দেখে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে ভেজা তোয়ালেটা নেড়ে আসে। তারপর এসে দাঁড়ায় মাহিরের ঠিক সম্মুখে। ফোন থেকে চোখ সরিয়ে মাহির তখন অন্বিতার দিকে চাইল। সদ্য গোসলে তার ভেজা চুল থেকে পানি পড়ছে টপটপ করে। গাঢ় নীল রঙা সুতি শাড়িতে নববধূর ভাবখানা স্পষ্ট। চোখে মুখে চেয়ে আছে চমৎকার শুভ্রতা। মাহির চোখ সরু করে মিহি সুরে বলল,

‘এভাবে তাকিও না তো, হৃদয় দূর্বল হয়ে পড়ছে আমার। হার্ট অ্যাটাক করে এত তাড়াতাড়ি আমি মরতে চাই না।’

অন্বিতা নাক ফুলাল। ক্ষিপ্ত সুরে বলল,

‘তুমি এত বড়ো রাক্ষস জানলে আমি তোমাকে কখনোই বিয়ে করতাম না।’

মাহির ভ্রু কুঁচকাল। অন্বিতাকে আপাদমস্তক দেখে বলল,

‘রাক্ষস হলে কি তুমি এখনও আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতে, বরং তুমি তো থাকতে আমার পেটে।’

বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসল সে। অন্বিতা ধমক দিয়ে বলল,

‘হাসবে না একদম। এসব কী করেছ, অসভ্য?’

অন্বিতা গলার সামনে থেকে চুল সরিয়ে বলল। মাহির দেখল, তার গৌর রঙা ঘাড় গলায় জায়গায় জায়গায় রক্তিম আভা। তা দেখে ঠোঁট চেপে হাসল সে। পরক্ষণেই আবার চোখে মুখে অসহায় ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল,

‘হায় হায়, কী করে হলো এসব? আমার বউয়ের ফর্সা গলা ঘাড়ের এই অবস্থা হলো কী করে?’

এইটুকু বলে আবারও ঠোঁট চেপে মুচকি হাসে সে। অন্বিতা রোষপূর্ণ চোখে চেয়ে বলে,

‘মজা করছো আমার সাথে?’

মাহির এবার সিরিয়াস হয়ে বলে,

‘মোটেও না। ঐ ড্রয়ারে দেখো ফার্স্ট এইড বক্স আছে- নিয়ে এসো ঔষধ লাগিয়ে দেই।’

অন্বিতা ভেংচি কেটে বলল,

‘লাগবে না আমার। ইচ্ছে করে এসব করে এখন এসছে ঢং করতে।’

মাহির মাথা নুইয়ে লজ্জার ভাব ধরে বলল,

‘কী করব, বলো? এত বছরের অপেক্ষার ফল তো একটু বেদনাদায়ক হবেই। স্যরি, বেশি ব্যথা পেয়েছ?’

গলার স্বর যতই নরম করুক চোখে মুখে তার দুষ্টুমি স্পষ্ট। অন্বিতা আর কথা বাড়াল না তাই। চুপচাপ গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল। মাহির উঠল বিছানা ছেড়ে। আলমারি থেকে কাপড় বের করতে করতে বলল,

‘অপেক্ষা করো, ফ্রেশ হয়ে এসে একসাথে নিচে নামব।’

________________

গাড়িতে উঠতে নিয়েও কারোর গলার স্বরে থমকে দাঁড়ায় অমিত। পেছন ফিরে চেয়ে পরিচিত এক মুখ দেখে। চিনতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি বিধায় হেসে জিজ্ঞেস করে,

‘কেমন আছেন?’

‘ভালো। আপনি কেমন আছেন?’

‘আমিও ভালো।’

আভা এগিয়ে এল খানিকটা। অমিতদের দিকে চেয়ে ইতস্তত সুরে বলল,

‘একটা অনুরোধ করব, রাখবেন?’

অমিত ভাবল ঈষৎ। মেয়েটা অন্বিতার বান্ধবী, এই মেয়েটার হঠাৎ তার কাছে কী অনুরোধ থাকতে পারে। অমিতের কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে আভা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল যেন। ক্ষীণ সুরে বলল,

‘রাখবেন না?’

অমিত প্রসন্ন হেসে বলল,

‘চেষ্টা করব। কী অনুরোধ, বলুন।’

আভা আশেপাশে একবার তাকাল। কথাটা কী করে যে বলবে, বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে তার। অমিত তাকে দেখছে। মেয়েটাকে অস্থির দেখাচ্ছে। কিছু বলতে চেয়েও হয়তো বলতে পারছে না। তাই সে আশ্বস্ত করে বলল,

‘নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, অসুবিধা নেই।’

আভা ঈষৎ হাসল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিজেকে ধাতস্ত করে বলল,

‘আপনার বন্ধু অয়নের ফোন নাম্বারটা পেতে পারি?’

চমকাল, থমকাল অমিত। চোখ পিটপিট করে কতক্ষণ দেখল আভাকে। আভা লজ্জায় আড়ষ্ট। চোখও তুলতে পারছে না। অমিত এক লহমা সময় নিয়ে বলল,

‘আপনি অয়নকে পছন্দ করেন?’

আচম্বিত এমন প্রশ্ন শুনে খানিকটা ঘাবড়ে যায় আভা। কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। মাথাটা আরো নুইয়ে ফেলে। অমিত শান্ত স্বরে বলে,

‘ভয় পাবেন না। বলুন আমায়।’

আভা অপ্রতিভ। লজ্জায় মর মর অবস্থা। তাও সাহস করে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘জি।’

মৃদু হাসল অমিত। মনে হলো, অয়নের এই ছন্নছাড়া জীবনকে গুছিয়ে দেওয়ার জন্য এখন অতি জরুরি ভিত্তিতে কাউকে প্রয়োজন। আর সেটা যদি হয় অন্বিতার বান্ধবী তবে মন্দ নয়। সে বলল,

‘ফোন বের করুন, আমি নাম্বার বলছি।’

আষাঢ়ের মেঘ সরে এক চিলতে আলো ফুটল। ঐটুকু আলো দেখে অমিত খুশি হলো যেন। মন মনে খুব করে চাইল, এই আলোর আগমনে যেন তার বন্ধুর জীবনের সমস্ত তমশা প্রশমিত হয়। যেন বসন্তের প্রথম কিরণের ন্যায় প্রস্ফুটিত হয়ে উঠে তার জীবন।

চলবে ……

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪০।

নিজের আর মাহিরের জন্য টেবিলে খাবার বাড়ছে অন্বিতা। ডাইনিং বরাবর ড্রয়িং রুম তাদের। সেখানে বসে টিভি দেখছে জিনিয়া বেগম আর শশী। অন্বিতা আসার পর থেকে শশীর নজর অবশ্য টিভির চেয়ে অন্বিতার দিকেই বেশি। অন্বিতার ভেজা চুল গায়ে জ্বালা দিচ্ছে তার। রোষপূর্ণ চোখে তাকে আপাদমস্তক দেখে কী যেন বিড়বিড় করছে। জিনিয়া বেগমও ক্ষান্ত নন। আড়চোখে অন্বিতাকে খেয়াল করলেন অনেকক্ষণ। তারপর বিদ্রুপের সুরে বললেন,

‘জমিদারের বউ কি-না, তাই সকাল এগারোটায় এসেছে নাস্তা করতে।’

আস্তে বললেও কথাটা ঠিক অন্বিতার কান অবধি গেল। তবে কিছু বলল না সে। টি শার্ট ঠিক করতে করতে নিচে নেমে এল মাহির। চেয়ার টেনে বসল। অন্বিতার দিকে চেয়ে বলল,

‘তুমিও বসে পড়ো।’

শশী নাক মুখ কুঁচকে চেয়ে আছে। জিনিয়া বেগমও তাই। নিজের সুপ্ত ক্রোধ আর ক্ষোভকে প্রশমিত করতে পারছেন না কিছুতেই। তাই তো বলে বসলেন,

‘বাবা আজ খেতে বসে অনেক কথা বলেছেন। বাড়ির বউ এত বেলা অবধি ঘুমায় না।’

‘চিন্তা করো না, ফুপি। আমি দাদুকে বুঝিয়ে বলব।’

মাহিরের এত শান্ত জবাব পেয়েও জিনিয়া বেগম ঠান্ডা হতে পারছেন না। মাহিরের পাশে অন্বিতাকে সহ্য হচ্ছে না তাঁর। উঠে চলে গেলেন তিনি। শশী একা বসে। অন্বিতা মাহিরকে বেড়ে বেড়ে খাওয়াচ্ছে। গা জ্বালা বাড়ছে তার। উঠে গেল সেও। বসার ঘরের ডানে লাগোয়া অলিন্দে গিয়ে দাঁড়াল। হাতে ফোন। অনেক খুঁজে একটা নাম্বার বের করতে সফল হলো অবশেষে।

সচরাচর বিয়ের অনুষ্ঠান সব দিনের আলোতে হলেও অন্বিতা আর মাহিরের রিসেপশনের আয়োজন হলো রাতে। উদ্ভাসিত অম্বরতল তখন পতনোন্মুখ। দিনের ম্লান অংশু ইতমধ্যেই নিরুদ্দেশ। পথে তাই জ্বলে উঠেছে হরিদ্রাভ। অন্বিতার সাজ শেষ হয়েছে মাত্রই। পার্লারের মেয়ে দুজন বেরিয়ে যেতেই ঘরে প্রবেশ করল মাহির। সৌম্যদর্শন যুবকের দিকে একপলক চেয়ে চোখ নামাল অন্বিতা। মাহির এগিয়ে এল শ্লতগতিতে। অন্বিতার অভিমুখে দাঁড়াল। সাদা রঙের জর্জেট শাড়ি গায়ে তার। মুখে প্রসাধনীর নিখুঁত ছোঁয়া। ড্রেসিং টেবিল বরাবর হেলান দিয়েছে মাহির। অন্বিতার চোখ মুখ পূর্ণ মেদুর চোখে দেখছে। সব ঠিক। তবে হঠাৎ মাথা কাত করে সে বলল,

‘অন্বি, তোমার নাক ফোড়ানো না, তাই না?’

অবাক হয়ে অন্বিতা তাকাল। বলল,

‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’

মাহির প্রসন্ন গলায় বলল,

‘নাকে ছোট্ট একটা পাথর থাকলে বেশ মানাতো।’

আয়নার দিকে তাকাল অন্বিতা। একটুক্ষণ নিজেকে দেখে নিয়ে তার টিপের পাতা থেকে একটা সাদা পাথরের টিপ তুলে নাকের বাম পাশে লাগাল। তারপর মাহিরের দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে বলল,

‘এবার ঠিক আছে?’

অন্বিতার উপস্থিত বুদ্ধি দেখে মাহির হা করে চেয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। পরক্ষণেই আবার হেসে বলল,

‘আমার বউয়ের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। চমৎকার লাগছে।’

লজ্জা পেল অন্বিতা। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘এবার যাওয়া যাক, সবাই বোধ হয় সেন্টারে চলে গিয়েছে।’

অন্বিতা পার্সটা হাতে নিল। মাহির সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ভাঁজ করা বাহুটা এগিয়ে দিল অন্বিতার দিকে। তা দেখে মৃদু হাসল অন্বিতা। মাহিরের বাহুর ভাঁজে নিজের হাত প্রবেশ করিয়ে হাঁটা ধরল দুজন।

বিয়েতে তেমন আড়ম্বরতা না থাকলেও রিসেপশনে বিরাট আয়োজন। আত্মীয়-স্বজন কেউ বাকি নেই হয়তো। মাহিরের গ্রাম আর তার নার্সিংহোম থেকে অনেক মানুষ এসেছে। অন্বিতার পরিবার থেকে এসেছে কেবল তার মা, খালা আর তাঁর ছেলে, আর এসেছে আভা। মা’কে দেখে জড়িয়ে ধরল অন্বিতা। কেবল এক রাতের ব্যবধানে মনে হচ্ছে যেন কত কাল বাদে এই দেখা। আসিয়া বেগম মেয়েকে আদর করে দিলেন। খালামনিও ভালোবাসা জানালেন। তার ছোট্ট খালাতো ভাই এবার ক্লাস থ্রি তে পড়ে। তাকে গাল টেনে আদর করল মাহির। আভা ছুটে এল বান্ধবীর কাছে। তার গলা জড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘দোস্ত, আমার আর তর সইছে না।’

‘কীসের জন্য?’

আভা ছাড়ল তাকে। লজ্জা পাওয়ার ভান করে বলল,

‘তোর বাসর রাতের গল্প শোনার জন্য।’

অন্বিতা তার হাতে আস্তে করে চড় বসিয়ে বলল,

‘খুব ফাজিল হয়েছিস। আজকেও আংকেলকে আনিসনি?’

‘বলেছিলাম তো, কিন্তু বাবা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত বলে আসেননি।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। এইদিকে আয়, কয়েকটা ছবি তুলি।’

সবাই ছবি তুলল অনেকক্ষণ। তারপর মাহির তাইভিদকে ডেকে তাদের খেতে পাঠাল। মাহিরের পক্ষ থেকে তাইভিদ সব সামলাচ্ছে। আত্মীয়-স্বজন থেকে ধরে প্রত্যেকটা মানুষকে সে আপ্যায়ন করছে সরস মুখে। হাতে একটা সফট ড্রিংকস্ এর ট্রে নিয়ে তাইভিদ ব্যস্ত পায়ে আগাচ্ছিল। অন্বিতার পরিবারের জন্য নিয়েছে এগুলো। তন্মধ্যে পেছন থেকে কেউ বলে উঠে,

‘হেই ওয়েটার, একটা ড্রিংকস্ আমাকে দিয়ে যান।’

পা থামল তাইভিদের। পেছন ফিরে তাকাল। দেখল শশী তার দিকে বক্র হেসে চেয়ে আছে। শশী নিজে থেকেই এগিয়ে এসে ট্রে থেকে ড্রিংকস্ নিতে চাইলে ট্রে’টা সরিয়ে নেয় তাইভিদ। বলে,

‘এগুলো অন্বিতা ম্যাডামের পরিবারের জন্য। আপনার প্রয়োজন হলে ড্রিংকস সেকশন থেকে নিজে নিয়ে খান।’

তাইভিদের কথায় ক্রোধ বাড়লেও শশী হাসল। বলল,

‘ঠিক আছে, উনাদের দিয়ে আমার জন্য নিয়ে আসবেন।’

‘দুঃখিত ম্যাডাম, আমি আপনার অর্ডার শোনার জন্য এখানে আসিনি।’

এই বলে ফের পা বাড়ায় সে। শশী রুষ্ট হলো ভীষণ। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা চালাল। এই ছেলেটার একটা ব্যবস্থা না করা অবধি মনে শান্তি পাবে না বোধ হয়।

বিভিন্ন রকমের পোস দিতে দিতে মহাবিরক্ত মাহির। তার কুঁচকানো মুখ দেখে ঠোঁট চেপে হাসল অন্বিতা। ক্ষীণ সুরে বলল,

‘কী ব্যাপার ডাক্তার সাহেব, এত অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠলেন যে?’

মাহির ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই দেখে অন্বিতা ঠোঁট চেপে হাসছে। সে বিরক্ত হয়ে বলে,

‘এত ছবি তুলার কী আছে?’

‘ক্যামেরাম্যান তুমিই আনিয়েছ, আমি তো আর বলিনি।’

‘শুধুমাত্র স্মৃতি রাখব বলে কয়েকটা ছবি তুলতে চেয়েছিলাম, এখন আমার জন্মের মতো ছবি তোলার সাধ মিটে গিয়েছে।’

শব্দ করে হাসল অন্বিতা। তাকে হঠাৎ এভাবে হাসতে দেখে ক্যামেরাম্যান আর ভিডিয়োগ্রাফার অবাক। ক্যামেরাম্যান সেই সুযোগে অন্বিতার হাসির কয়েকটা অকপট ছবি তুলে নিল। দূর থেকে মেয়েকে এমন প্রাণবন্ত দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন আসিয়া বেগম। খালামনি পাশ থেকে বললেন,

‘দোয়া করি, মেয়েটা আজীবন এভাবেই হাসি খুশি থাকুক।’

আসিয়া বেগম চোখের পাতা ঝাপটে বললেন,

‘আমিন।’

ফোন হাতে নিয়ে ব্যগ্র শশী। পায়চারি করছে অযথা। এক কোণে দাঁড়িয়ে দই খাচ্ছে আর শশীর শশব্যস্ত অভিব্যক্তির কারণ ঠাহর করার চেষ্টা চালাচ্ছে তাইভিদ। শশীর চঞ্চল বদনখানা দেখে মনে হচ্ছে, সে কারোর জন্য অপেক্ষা করছে হয়তো। তন্মধ্যে দ্রুত হাঁটার দরুন শশীর ওড়না গিয়ে পাশের টেবিলের কোণায় আটকে যায়। ওড়নায় টান পড়তেই মেজাজ খারাপ হয় তার। এগিয়ে এসে সেটা খোলার চেষ্টা করে। কিন্তু তার দুশ্চিন্তায় ব্যাকুল মন সহজ কাজটাও করতে দিচ্ছে না তাকে। ওড়ানাটা টানও দিতে পারছে না ছিঁড়ে যাওয়ার ভয়ে। এক ওড়না নিয়ে যুদ্ধ করতে দেখে দইয়ের গ্লাস রেখে এগিয়ে আসে তাইভিদ। নিজ উদ্যোগে টেবিলের কোণে লোহায় আটকে যাওয়া ওড়নাটা যত্ন সমেত খুলে আনে। শশীর হাতে তুলে দিয়ে বলে,

‘নতুন উপায় পেয়ে গেলেন। এবার স্যারকে সহসাই বলতে পারবেন, আমি আপনার ওড়না ধরে আপনার সাথে অসভ্যতামো করেছি।’

শশী ভ্রু কুঁচকাল। বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,

‘আপনার সাহায্যের প্রয়োজন আমার ছিল না, আমি নিজেই পারতাম।’

‘তা তো দেখছিলাম’ই। সামান্য ওড়নার সাথে না পেরে মুখ লাল করে ফেলেছিলেন।’

শশী সন্তপ্ত গলায় বলে,

‘আমাকে দেখতে কে বলেছে আপনাকে? ফলো করছেন আমায়?’

তাইভিদ ভ্রু উঁচিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

‘আমার এতটাও খারাপ সময় আসেনি যে আমি আপনাকে ফলো করব।’

শশীর রোষানলে দগ্ধ হওয়ার আগেই কেটে পড়ে তাইভিদ। রাগ হলেও সেদিকে আর নজর দিল না সে। গেইটের দিকে চেয়ে দেখল, কেউ আসছে কি-না।

ছবি তুলার পর্ব সবেই শেষ হয়েছে। ক্লান্ত হয়ে সজ্জিত সোফাটায় বসল অন্বিতা আর মাহির। তাইভিদকে ডাকল মাহির। তাকে জিজ্ঞেস করল মেহমানরা সবাই ঠিকঠাক মতো খেয়েছে কি-না। অন্বিতা কথা বলছে আভার সাথে। অয়নের নাম্বার নেওয়ার কথা শুনে অন্বিতার চোখ কপালে। এই মেয়ে তো চিতার চেয়েও দ্রুত দৌড়ায়। এত ব্যস্ততার মাঝেও সেখানে আচানক ভেসে এল পুরুষালী এক ভরাট স্বর। সেই স্বর অনুসরণ করে সামনে তাকাল সবাই। হতভম্ব, ক্ষুব্ধ হলো দুই জোড়া চোখ। বাতাবরণ তপ্ত হয়ে উঠল নিমিষেই। মাহির উঠে দাঁড়িয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল,

‘তুই এখানে?’

চলবে….