#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪১।
বাইরের আত্মীয়-স্বজন সবাই প্রায় চলে গিয়েছে। সেন্টার মোটামুটি খালি এখন। এমন সময় নতুন ব্যক্তির আচনক আগমনে সবাই বিস্তর অবাক। খালামনি আসিয়া বেগমের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কে উনি, আপা?’
আসিয়া বেগম কাঁধ উঁচিয়ে বললেন,
‘কী জানি, আমিও চিনি না। হয়তো মাহিরের কোনো আত্মীয় হবে।’
সুঠাম দেহী পুরুষ মানুষটার মুখে লেপ্টে আছে কাষ্ঠ হাসি। পা টেনে এগিয়ে এল সে। মাহিরের সমীপে দাঁড়িয়ে বলল,
‘বিয়েটা না হয় আমাকে ছাড়াই করলি। রিসেপশনে তো অন্তত দাওয়াতটা দিতে পারতি, তাই না?’
এইটুকু বলে সে ঘাড় কাত করে মাহিরের পেছনে বসে থাকা অন্বিতাকে দেখল। যার তপ্ত, ক্ষুরধার চাহনি দেখে হাসল সে। বলল,
‘আরে ভাবি, কেমন আছেন? ভুলে যাননি তো আমায়?’
চোয়াল দৃঢ় করল অন্বিতা। অতীতের সেই বিদঘুটে মুহুর্তগুলো সহসাই তাজা হয়ে উঠল যেন। রাগে শরীর রি রি করে উঠল তাতে। কুপিতস্বরে বলল,
‘মানুষকে ভোলা গেলেও অমানুষকে ভোলা যায় না। আমি আপনাকে ভুলিনি।’
হু হু করে হাসল সে। মাহিরের কাঁধ চেপে বলল,
‘ভাই, ভাবি তো বেশ মজা করে।’
কাঁধ থেকে হাতখানা এক ঝটকা’ই সরিয়ে দেয় মাহির। দাঁতে দাঁত চেপে সে জিজ্ঞেস করে,
‘কেন এসেছিস এখানে? আমি তো তোকে ইনভাইট করিনি?’
সে দু হাত পকেটে পুরে পিঠ টানটান করে দাঁড়িয়ে বলল,
‘তুই ইনভাইট না করলেও আমার একটা দায়িত্ব কর্তব্য বলে ব্যাপার আছে না? তুই তো জানিস, তোর ব্যাপারে আমি কত সিরিয়াস।’
বলেই ফের হাসল সে। মাহিরের রাগ সপ্ত আকাশ ছুঁয়েছে বোধ হয়। সেদিনের ঐ সি সি টিভি ফুটেজ সে দেখেছিল। হোটেলের ওয়েটার বলেছিল সমস্ত সত্যটা। নিজের চোখে দেখেছিল, কীভাবে অন্বিতার ড্রিংকস্-এ ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে তাকে হেনস্থা করা হয়েছে। তবে এইসব কিছু জেনেছিল বিদেশ যাওয়ার পর। সেখানে বসে তার আর কিছুই করার ছিল না। তবে এরপর থেকেই এই বন্ধু নামের কুৎসিত মানুষটার সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে সে। কিন্তু আজ আচমকা এই মানুষটা তার বিয়ের খোঁজ পেল কীভাবে?
আভা ফিসফিসিয়ে বলল,
‘এটাই কি ঐ লোকটা, যার জন্য সব হয়েছিল?’
অন্বিতা ক্ষুব্ধ হয়ে উপর নিচ মাথা নাড়ায়। আভা হকচকিয়ে উঠে বলে,
‘কী সাংঘাতিক! এতকিছু ঘটিয়ে এখন কী নির্দ্বিধায় এখানে এসে কথা বলছে। সামান্য লজ্জাটুকুও নেই।’
মাহির নিজেকে ধাতস্ত করে নিল। অন্বিতার পরিবারের সামনে সে সবকিছু খোলাসা করতে চাইছে না। তাই শান্ত স্বরে বলল,
‘এসে ভালোই করেছিস। আমি নিজেও হয়তো কোনো একদিন ডাকতাম তোকে। খুব জরুরি একটা কাজ বাকি পড়ে আছে যে।’
মাহিরের বন্ধুমহলের একমাত্র প্রিয় বন্ধু রিয়াল। নিজের সুখ দুঃখ সমস্তটাই এই বন্ধুর কাছে খোলা বইয়ের ন্যায়। তবে এই বন্ধু’ই যে কখনও তার সাথে এত বড়ো বেইমানি করবে তা কল্পনাও করেনি। সে কেন এমন করেছে সেটা এখনও অজানা। মাহির সেই সত্যিটা জানতেও চায় না। বন্ধুর প্রতি এক অন্তরীক্ষ ক্ষোভ থাকা স্বত্ত্বেও তাকে আঘাত করতে চায় না সে। তাই নিজেকে যথাসাধ্য আত্মস্থ করে ফের বলল,
‘অন্যায় করেছিলি, আজ সুযোগ পেয়েছিস ক্ষমা চেয়ে নে।’
রিয়াল কপাল কুঁচকাল। মাহির কোন অন্যায়ের কথা বলছে বোধগম্য হলো না তার। পরক্ষণেই আবার ভাবল, মাহির কি সব জেনে গিয়েছে তবে। রিয়াল একপলক শশীর দিকে চাইল। চোখের পাতা ঝাপ্টে শশী আশ্বস্ত করল তাকে। রিয়াল হেসে জানতে চাইল,
‘ক্ষুমা চাইব? কীসের জন্য?’
মাহির ঘুরে একবার অন্বিতার বিক্ষিপ্ত মুখটা দেখে নিয়ে বলল,
‘সেদিনের পুরো ঘটনা জানি আমি। অযথা কথা বাড়াস না, অন্বিতার কাছে ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে যা এখান থেকে।’
গোলমাল হয়ে গেল বোধ হয়। শশী, জিনিয়া বেগমও আঁতকে উঠলেন। মাহির জানে সব? কই কখনও তো তাদের কিছু বলেনি। রিয়াল চোয়াল শক্ত করে শশীর দিকে চাইল। শশীর জবুথবু অবস্থা। রিয়াল গুমোট স্বরে বলল,
‘সেদিন যা হয়েছিল সবই জানিস, তারপরেও ক্ষমা চাওয়ার কথা বলছিস কোন আক্কেলে?’
‘সব জানি বলেই ক্ষমা চাইতে বলছি।’
অন্বিতার মা খালা এসব ব্যাপারে অবগত নন, দাদু বা তাইভিদও না। যারা বিষয়টা জানেন না তারা হতভম্ব হয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন। রিয়াল শক্ত গলায় বলল,
‘আমি এখানে ক্ষমা চাইতে আসিনি।’
‘কেন এসেছিস তবে? নিজের কুৎসিত ফন্দি এঁটে আবার অন্বিতাকে হেনস্থা করার জন্য?’
চেঁচিয়ে উঠল মাহির। রিয়াল হাসল। বলল,
‘শুধু আমি’ই সব করেছি না-কি? আশ্চর্য! তুই শুধু আমার দিকেই আঙ্গুল তুলছিস কেন?’
মাহির রেগে বলল,
‘তোর মতো জঘন্য চিন্তা ভাবনা আর কারোর নেই। নিজের দোষ অন্যের উপর চাপাবি না।’
শব্দ করে হাসল রিয়াল। বলল,
‘মানলাম, আমার চিন্তা না হয় জঘন্য। কিন্তু তোর পরিবারের মানুষ, তাদের চিন্তা তো আমার থেকেও জঘন্য। তারা যদি এমন জঘন্য চিন্তা ভাবনা নিয়ে দিব্যি নেচে কুদে বেড়াতে পারে, তবে আমার বেলায়’ই কেন এত কঠোরতা?’
মাহির ভ্রু কুঁচকাল। ঢোক গিললেন জিনিয়া বেগম আর শশী। ইশারায় থামতে বললেন রিয়ালকে। মাহির জিজ্ঞেস করল,
‘আমার পরিবার মানে? কাদের কথা বলছিস তুই?’
বার কয়েকবার চোখের পাতা ঝাপ্টে রিয়াল বলল,
‘সেকি! তুই না বললি, সব জানিস? আর এইদিকে ঘটনার পেছনে মূল হোতা কে সেটাই জানিস না?’
কপালে ভাঁজ পড়ল লম্বালম্বি ভাবে। সিসি টিভি ফুটেজে তো সে কেবল রিয়ালকেই দেখেছিল। তাহলে এর পেছনে তার পরিবারের লোক যুক্ত হলো কী করে? উদ্বিগ্ন সুরে মাহির শুধাল,
‘খোলাখুলি বল। কাদের কথা বলছিস তুই?’
শশী মায়ের হাতটা চেপে ধরল। ধরা পড়ার ভয়ে মুখটা নিভে গেল তার। জিনিয়া বেগম থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। বাকি জনতা চেয়ে আছে উৎসুক চোখে। খালামনি আসিয়া বেগমকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘এসব কী হচ্ছে বলো তো, আপা?’
আসিয়া বেগম চিন্তিত সুরে জবাব দিলেন,
‘আমিও তো বুঝতে পারছি না কিছু।’
রিয়াল একবার শশী আর জিনিয়া বেগমকে দেখে নিল। এই স্বল্প সময়ের দৃষ্টি বিনিময়ের মাঝেও তারা দুজন চোখের ইশারায় আকুতি জানাল, যেন সে মাহিরকে সত্যিটা না জানায়। কিন্তু শয়তান কি আর একা বিপদে ফাঁসতে চায়, বিপদে পড়লে সে নিজের সঙ্গীদের সাথে নিয়েই পড়ে। রিয়ালও দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,
‘তোর ফুপি আর উনার মেয়ে শশী, এই পুরো ঘটনার মূল কারসাজি উনারাই করেছেন। উনাদের কথাতেই আমি সব করেছি। তার বিনিময়ে পেয়েছি মোটা অঙ্কের টাকা।’
মাহির থমকে গেল। চারদিক হয়ে পড়ল নিস্তব্ধ। সেদিন অন্বিতার চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলাতে পরবর্তীতে তাদের প্রতি মাহিরের ক্ষোভ থাকলেও সে এটা জানত না যে এই পুরো ঘটনা তাদের ইশারাতেই ঘটেছে। কী আশ্চর্য! তার কাছের মানুষগুলো এভাবে কষ্ট দিল তাকে। ঢোক গিলল মাহির। অন্বিতার প্রথমেই এমনটা মনে হয়েছিল, প্রমাণ ছিল না বলে কখনও এই কথা আর গলা দিয়ে বের করেনি।
জিনিয়া বেগমের দিকে তাকাল মাহির। জিনিয়া বেগমের নতজানু। চোখ তুলে তাকানোর উদ্যম নেই। পাশে শশীও শঙ্কিত বদনে দাঁড়ান। মাহির জড়ানো স্বরে বলল,
‘মায়ের পর আমি সবথেকে বেশি তোমাকেই সম্মান করতাম, ফুপি। তুমি কী করে এমনটা করতে পারলে?’
জিনিয়া বেগম শুকনো মুখে চাইলেন। কম্পিত স্বরে বললেন,
‘বিশ্বাস কর বাবা..’
বাকি কথা শেষ করার আগেই হাত উঠিয়ে তাঁকে থামিয়ে দেয় মাহির। ধরা গলায় বলে,
‘আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। ভুল আমার’ই।’
সমস্ত বিষয়টা অবলোকন করে এই পর্যায়ে দাদু লাঠি ভর করে উঠে এলেন মাহিরের সমীপে। মাহিরের কাঁধ চেপে জিজ্ঞেস করলেন,
‘দাদুভাই, কী হয়েছে? পুরো ঘটনা আমাকে বলো তো।’
মাহির বিধ্বস্ত চোখে দাদুর দিকে চাইল। এই বিদঘুটে সত্যিটা মনে ভারী আঘাত করেছে তার। অন্বিতা ফ্যালফ্যাল চোখে মাহিরকে দেখছে। তার চোখ মুখের অসহায়ত্ব তাকে পীড়া দিচ্ছে বড্ড। না চাইতেও ক্লান্ত স্বরে দাদুকে সব খুলে বলল মাহির। পুরো ঘটনা শুনে হতভম্ব, হতবাক অন্বিতার মা, খালামনি আর তাইভিদ। আসিয়া বেগম এসবের কিছুই জানতেন না। মাহিরের সাথে সম্পর্কের কথাটাও জানতেন হালকা পাতলা ভাবে। অত গভীরে কখনও হাতিয়ে দেখেননি তিনি। তাইভিদ নাক মুখ কুঁচকে শশীর দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে আওড়াল,
‘একটা মানুষ এত জঘন্য হয় কী করে?’
সব শুনে দাদু বললেন,
‘সবকিছু যে জিনিয়া আর শশীর কথাতেই হয়েছে তার কী প্রমাণ আছে তোমার কাছে, রিয়াল?’
রিয়াল রূঢ় সুরে বলল,
‘আপনার প্রমাণ লাগবে, দাদু?’
‘হ্যাঁ। এতকিছুর পর তোমাকে আমার আর বিশ্বাস হচ্ছে না।’
জিনিয়া বেগম আর শশীর মুখে কিঞ্চিৎ আশার আলো। রিয়ালের কাছে কোনো প্রমাণ নেই। আর তার মুখের কথার উপর ভিত্তি করে দাদু কিছু করবেন না, এই বিশ্বাসটুকু অন্তত আছে তাদের।
চলবে…..
#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪২।
পর্দায় নিগূঢ় ভাবে ফুটে উঠল কিছু মুখোশধারী মানুষের মুখোশের আঁড়ালের কুৎসিত চিত্রগুলো। উপস্থিত মানুষগুলো হতভম্ব, হতবাক। রা নেই কারোর মুখে। মাহিরের নিষ্পলক, নিস্তেজ চাহনি। অন্বিতার চোখে মুখে হতাশা, মাহিরের জন্য বড্ড খারাপ লাগছে তার। পনেরো মিনিটের ভিডিয়োতে সমস্ত ঘটনার আদ্যোপান্ত শোনা গেল, দেখা গেল। ঘৃণায় শরীর রি রি করছে আসিয়া বেগমের। নিজের মেয়ের বয়সী একটা মেয়ের সাথে এত বড়ো অন্যায় তারা কী করে করতে পারে। ভিডিয়োটা বন্ধ করে রিয়াল দাদুর সমীপে দাঁড়াল। নিরুত্তাপ সুরে শুধাল,
‘আপনার কি আর কিছু বলার আছে, দাদু?’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দাদু। বয়স হয়েছে উনার। এই বয়সে এসে মেয়ে আর নাতনির এহেন রূপ দেখে পীড়িত হয়েছেন তিনি। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। জিনিয়া বেগমের সামনে গেলেন। মাথা তুলে তাকানোর মতো বিন্দুমাত্র সাহস আর অবশিষ্ট নেই মা আর মেয়ের। জিনিয়া বেগম ভীত, নির্জীব। দাদু মেঘমন্দ্র সুরে বলে উঠলেন,
‘এই শিক্ষা’ই আমি দিয়েছি তোমায়? এই দিন দেখার জন্যই কি আমি বেঁচে আছি?’
শশী চোখ তুলে আকুতি করতে চাইল। বলল,
‘নানুভাই, আমরা আসলে..’
‘থামো।’
চেঁচিয়ে উঠলেন দাদু। তিনি কাঁপছেন। আদর্শবান মানুষ তিনি। গ্রামের মানুষ ফেরেশতার চোখে তাঁকে দেখে। আর আজ তার’ই মেয়ে আর নাতনির এই অধঃপতন তিনি মেনে নিতে পারছেন না। অন্বিতা মাহিরের কাছে এল। উদ্বেগ নিয়ে বলল,
‘দাদুকে সামলাও, মাহির। নয়তো উনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’
মাহির ছুটে গেল দাদুর কাছে। বৃদ্ধকে একহাতে আগলে ধরে বলল,
‘শান্ত হও, দাদু। এখানে এসে বসো।’
তাঁকে চেয়ারে বসায় মাহির। ইশারায় তাইভিদকে পানি আনতে বলে। তাইভিদ পানি এনে দেয়। মাহির দাদুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে কোমল স্বরে বলে,
‘পানি’টা খাও, দাদু।’
দাদু এক ঢোক গিললেন বোধ হয়। চোখ মুখ দৃঢ় উনার। লাঠি ধরে রাখা হাতটা ঠকঠক করে কাঁপছে। মাহির সেই হাতে হাত বুলিয়ে বলল,
‘অস্থির হয়ো না, অসুস্থ হয়ে পড়বে তো।’
দাদু শ্বাস টানলেন খানিক জোরে। সন্তপ্ত সুরে বললেন,
‘তোমরা কী করে এসব করতে পারলে? এভাবে একটা মেয়েকে অসম্মান করার সাহস হলো কী করে? বিবেক বুদ্ধি কিছু নেই? এত জঘন্য তোমরা? এসব করার আগে একবার নিজের ভাতিজার কথাও কি স্মরণে আসেনি, জিনিয়া? ও তোমাকে নিজের মায়ের জায়গা দিয়েছিল, আর তুমি? ছি:’
বাবার কথা শুনে কেঁপে উঠলেন জিনিয়া বেগম। জীবদ্দশায় কখনও বাবার এমন তোপের মুখে তিনি পড়েননি। চোখ ভিজে উঠে উনার। তিনি ছুটে এসে বাবার পায়ের কাছে পড়েন। হাত জোড় করে আকুতি জানিয়ে বলেন,
‘আমায় ক্ষমা করো, বাবা। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে।’
মাহির উঠে দাঁড়াল। দাদু মুখ ঘুরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। রূঢ় সুরে বললেন,
‘কারোর বাবা বলে আমি অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করব না। চোখের সামনে থেকে চলে যাও, আর কখনও আমি তোমাদের মুখ অবধি দেখতে চাই না।’
জিনিয়া বেগম আঁতকে উঠলেন। বাবার পাযুগল জড়িয়ে ধরলেন সঙ্গে সঙ্গে। ক্রন্দনরত স্বরে বললেন,
‘এভাবে বলো না, বাবা। তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে? এভাবে আমার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। মাহির বাবা, ক্ষমা করে দে ফুপিকে।’
মাহির দাঁতে দাঁত চেপে অন্যদিকে চাইল। এই মানুষ দুজনকে সে ক্ষমা করতে পারবে না। এত বড়ো হৃদয় তার নয়। ছোট্ট বক্ষে এত আঘাত লুকিয়ে মানুষগুলোকে ক্ষমা করা অসম্ভব।
দাদু শক্ত গলায় বললেন,
‘মাহির, ওদের চলে যেতে বলো।’
জিনিয়া বেগম ব্যাকুল হয়ে উঠেন। বাবার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে বলেন,
‘এমন করো না, বাবা। ক্ষমা করো আমাদের। আমরা আর কখনও এমন করব না। প্রয়োজন পড়লে আমরা অন্বিতার পা ধরে ক্ষমা চাইব।’
‘তা তো অবশ্যই চাইবে। এখনই চাইবে। তুমি আর তোমার মেয়ে অন্বিতাসহ তার পুরো পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়ে এখান থেকে বিদায় হবে।’
শশী ক্ষুব্ধ চোখে তাকাল। সে সবার কাছে ক্ষমা চাইতে পারবে না। তার অহমিকায় আঘাত করবে এমন কিছুই সে করবে না। জিনিয়া বেগম উঠে দাঁড়ালেন। অন্বিতার দিকে এগিয়ে গেলেন তারপর। আচমকা তার পায়ের কাছে বসে যেতেই ঘাবড়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায় অন্বিতা। কম্পিত স্বরে বলে উঠে,
‘এসব কী করছেন? উঠুন।’
জিনিয়া বেগম মাথা তুলে চেয়ে বলেন,
‘আমাকে ক্ষমা করে দাও, অন্বিতা। আমার অনেক বড়ো ভুল হয়ে গিয়েছে।’
অন্বিতা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মাহিরের দিকে তাকায় একবার। মাহিরের অভিব্যক্তির কোনো বদল না দেখে ইতস্তত সুরে বলে,
‘ক্ষমা চাইতে হবে না। উঠুন আপনি।’
‘না না, তুমি ক্ষমা না করলে বাবাও যে আমায় ক্ষমা করবেন না।’
অন্বিতা নীরব দাঁড়িয়ে থাকে। মাহির এগিয়ে আসে তখন। আমর্ষ স্বরে বলে,
‘তোমরা ক্ষমা পাওয়ার অযোগ্য। আজ থেকে তোমাদের সাথে আমার আর আমার স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক নেই, চলে যাও এখান থেকে।’
জিনিয়া বেগম অনেক ভাবে আকুতি জানালেন। সবার কাছে ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু ক্ষমা করল না কেউ। নিজের বাবাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তাঁর কাছ থেকে। ভগ্ন আর ব্যথিত হৃদয়ে মেয়েকে নিয়ে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁর চোখে মুখে কিঞ্চিৎ অনুশোচনার দেখা মিললেও তাঁর মেয়ের চোখ মুখ ছিল দৃঢ়। আমিত্বের বেড়া জালে আটকে যাওয়া ব্যক্তিত্ব ছাপিয়ে পরিতাপের কোনো দেখা মিলল না তার মাঝে।
বাতাবরণে বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসা দাদু, মেয়ের অন্যায়ের ভারী বোঝায় শৃঙ্খলিত। মাহির এগিয়ে গিয়ে রিয়ালের নিকটে দাঁড়ায়। রিয়াল ঠোঁট খুলে বলতে নেয় কিছু। থামিয়ে দেয় মাহির। যথাসাধ্য ঠান্ডা গলায় বলে,
‘তোর অপরাধও কোনো অংশে কম নয়। আমার বিশ্বাসে আঘাত করেছিস তোরা প্রতিটা মানুষ। আর তুই আঘাত করেছিস আমার ভালোবাসাতেও। এত আঘাতের পর তোকে আর ক্ষমা করা সম্ভব না। সামান্য কয়টা টাকার লোভে বন্ধুর বুক চিরতে যার হাত কাঁপেনি সে বন্ধু নামের কলঙ্ক। তোকে আঘাত করতে হাত নিশপিশ করছে আমার। নিজেকে সামলে রাখতে পারছি না। চলে যা এখান থেকে, আর কখনও আমার সামনে আসবি না।’
রিয়াল তেজ দেখিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। মাহির তাইভিদকে বলল,
‘দাদুকে নিয়ে আপনি বাসায় যান, তাইভিদ। আমরা আসছি।’
তাইভিদ মাথা হেলিয়ে দাদুকে ধরে উঠাল। লাঠি সমেত দাদু এগিয়ে গেলেন অন্বিতার মায়ের কাছে। তিনি অনুনয়ের স্বরে বললেন,
‘আমাদের ক্ষমা করবেন। এমন কিছু হয়েছে আমি জানতাম’ই না। জানলে আরো আগেই এই অন্যায়ের বিচার করতাম।’
আসিয়া বেগম ইতস্তত সুরে বললেন,
‘না না, আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে না। আমার মেয়ের বাকি জীবন যেন সসম্মানে কাটে শুধু সেইটুকু দেখলেই হবে।’
‘চিন্তা করবেন না। আমার নাতি আর নাতবউকে আমি আগলে রাখব।’
আসিয়া বেগম মলিন হেসে কৃতজ্ঞতা জানালেন। দাদু অন্বিতার দিকে চাইলেন। বললেন,
‘বুবু, এই বুড়ো দাদুকে তুমি ক্ষমা করতে পারবে তো?’
অন্বিতা দাদুর সামনে এল। নরম গলায় বলল,
‘আপনি কেন ক্ষমা চাইছেন, দাদু? এখানে তো আপনার কোনো দোষ নেই। আর যা হয়েছে আমি সব ভুলে গিয়েছি, আপনিও আর এসব ভেবে কষ্ট পাবেন না।’
দাদু অন্বিতার মাথায় হাত রাখলেন। বললেন,
‘দোয়া করি, জীবনে অনেক সুখী হও।’
তাইভিদ দাদুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বিষন্নতার ভীড়ে তলিয়ে যাওয়া মাহির চোখ তুলে তাকাল আসিয়া বেগমের দিকে। বলল,
‘মা, আমি নিজেও এতকিছু জানতাম না। ঐ মানুষগুলোর জন্য আমিও অন্বিতাকে কম ভুল বুঝেনি। অন্যায় তো আমিও করেছি। তার জন্য অন্বিতা আমাকে ক্ষমা করে দিলেও আমি নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারব না। আপনার কাছেও আজ ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই আমার।’
বিধ্বস্ত হয়ে একটা চেয়ারে বসল মাহির। আসিয়া বেগম এগিয়ে এসে মাহিরের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘মা ডেকেছ না, তাহলে মায়ের কাছে এত জড়তা দেখাচ্ছ কেন? তুমি ভুল কিছু করোনি, ঐ মানুষগুলো চোখ বেঁধে দিয়েছিল তোমার। চোখে পট্টি থাকলে মানুষ ডান বাম দেখবে না সেটাই স্বাভাবিক। যা হয়েছে এখন সব ভুলে যাও, বাবা। আমার মেয়েটাকে নিয়ে সুখী হও, এই দোয়াই করি।’
নিষ্প্রভ হাসল মাহির। বলল,
‘দোয়া করবেন, মা। আমি যেন অন্বিতাকে এক অন্তরীক্ষ সুখ দিতে পারি।’
‘পারবে তুমি। আমার বিশ্বাস আছে।’
চলবে….