একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব-৪৩+৪৪

0
26

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৩।

রিসেপশনের পর অন্বিতার বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দাদুকে একা ফেলে যেতে মাহিরের মন সায় দেয় না। অন্বিতাও ঠাহর করতে পারে সেটা। তাই মাহিরকে আশ্বস্ত করে বলে, তারা না হয় কাল যাবে, আজ থাক।

মা, খালামনি আর আভাকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসল অন্বিতা। বেশ রাত হয়েছে। শহরের রাস্তায় ব্যস্ততা কমে এসেছে। মাহিরও এসে বসল অপর পাশের সিটে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিল।

সিটে হেলান দিয়ে বসে চোখ মুদে নিল মাহির। জানলা নামানো। সাঁ সাঁ বাতাস ঢুকছে ভেতরে। বাইরের হরিদ্রাভে মাঝে মাঝেই গাড়ির ভেতরটা আলোকিত হচ্ছে, আবার মিইয়ে যাচ্ছে খানিক বাদেই। অন্বিতা বাইরে থেকে চোখ সরাল।
তাকাল মাহিরের ব্যথিত মুখপানে। সাঁঝ বেলাতেও চোখে মুখে যে দীপ্ততা ছিল তা আর এখন নেই। কেমন শুকনো মুখ যেন। অন্বিতা তার হাতের উপর হাত রাখল। নরম উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে হাতখানা জড়িয়ে ধরল মাহির। বিমর্ষ স্বরে বলে উঠল,

‘এমনটা তো না হলেও পারত, অন্বি। আমি যে ঐ মানুষগুলোকে কখনও ক্ষমা করতে পারব না’

মাহিরের বাহুতে মাথা এলিয়ে দিল অন্বিতা। অন্যহাতে তার হাত জড়িয়ে ধরল। নরম গলায় বলল,

‘সব ভুলে যাও না, মাহির। এভাবে কষ্ট পেলে যে আমারও খারাপ লাগবে।’

মাহির অন্বিতার হাতটা উপরে তুলে হাতের পিঠে চুমু খেল। তারপর হাতখানা বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,

‘ভুলে যাওয়ার মতো কঠিন কাজ বোধ হয় দুটো হয় না। তাও চেষ্টা করব আমি। তোমার সাথে অন্যায় করা মানুষগুলোকে আমি আমার স্মৃতি থেকে মুছে দিব একেবারে, তাতে যদি নিজের অনুতাপের দহন থেকে একটু বাঁচতে পারি।’

অন্বিতা চোখ তুলে মাহিরের দিকে তাকাল। আবিষ্ট সুরে বলল,

‘এভাবে বলো না। কোনো কিছু নিয়ে তোমাকে অনুতপ্ত হতে হবে না। সব আমি ভুলে গিয়েছি। তোমার ভালোবাসা সব ভুলিয়ে দিয়েছে। আর এসব নিয়ে ভাববে না একদম।’

মাহির চোখ মেলে তাকিয়ে অন্বিতার পরিশ্রান্ত বদন দেখে মৃদু হাসল। মেয়েটা কী নিঁখুত করে তাকে ভালোবাসে, আগলে রাখে। আর সে কি-না এই মেয়েটাকেই একদিন ভুল বুঝেছিল। ঊর্ধ্বশ্বাস ফেলে অন্বিতার ললাটে এক গাঢ় চুম্বন এঁকে তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল সে। পরম আবেশে, উষ্ণ বক্ষের মাঝে নিজেকে গুঁটিয়ে নেয় অন্বিতা। চোখ বুজে চুপটি করে থাকে। মাহিরও চোখের পাতা নিমীলিত করে। প্রেয়সীকে বুকে পেয়ে চিত্তের অস্থিরতা প্রশমিত হচ্ছে তার। ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে সব বিষন্নতা। এভাবেই যদি এক যুগ পার করা যেত, তবে মন্দ হতো না।

দাদুকে একবার দেখে রুমে আসে মাহির। অন্বিতা ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে বলে,

‘দাদু শুয়েছেন?’

মাহির হাত থেকে ঘড়ি খুলতে খুলতে জবাব দেয়,

‘হ্যাঁ।’

ঝাড়া শেষ করে বিছানার ঝাড়ুটা সাইডে রেখে বসল অন্বিতা। জিজ্ঞেস করল,

‘তাইভিদ কি দাদুর রুমেই শুয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, আমিই বলেছি আজ ঐ রুমে শোয়ার জন্য। দাদুকে দেখে দুশ্চিন্তা হচ্ছে, ভীষণ ভেঙে পড়েছেন।’

মাহির এসে অন্বিতার পাশে বসল। অন্বিতা বলল,

‘দাদুর সামনে তুমি আর নরম হয়ো না, তাতে দাদুর কষ্ট বাড়বে। বরঞ্চ এমন ব্যবহার করবে যেন কিছুই হয়নি, এসবে তোমার কিছু যায় আসে না।’

মাহির মাথা নুইয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,

‘ঠিক আছে, শুয়ে পড়ো এবার। রাত কম হয়নি।’

চিন্তিত সুরে অন্বিতা বলল,

‘মা আমাকে খাইয়ে দিলেও তুমি তো একেবারে কিছুই মুখে নাওনি, এখন কিছু খেয়ে নাও।’

মাহির মলিন হেসে বলল,

‘খিদে নেই এখন। ভীষণ ক্লান্ত, একটু ঘুমোলে বোধ হয় ভালো লাগবে।’

এই বলে মাহির শোয়ার আয়োজন করল। অন্বিতা শুধাল,

‘একেবারে না খেয়ে শুবে?’

ততক্ষণে বালিশ টেনে শুয়ে পড়েছে মাহির। বলল,

‘হ্যাঁ। চিন্তা করো না, আমার অভ্যাস আছে। বাতি নিভিয়ে তুমিও শুয়ে পড়ো।’

মাহিরের ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মনের কথা বুঝতে পেরে অন্বিতা আর তাকে ঘাটাল না। চুপচাপ বাতি নিভিয়ে এসে পাশে শুয়ে পড়ল। অনেক ক্লান্ত বিধায় শোয়ার সাথে সাথেই চোখ লেগে গিয়েছিল তার। তবে কাঁচা ঘুমটা ছুটে গেল মাহিরের আচমকা টানে। অতি নিবিড়, নিগূঢ় ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে সে অন্বিতাকে বুকে জড়িয়ে নিল। যেন ছেড়ে দিলেই সে পালাবে। বুকের সাথে মিশে শ্বাস টানল অন্বিতা। মাহিরের শরীরের পুরুষালী ভারী ঘ্রাণ শরীরে শিহরণ জাগায় যেন। উন্মত্ত চিত্তকে দমিয়ে রেখে অন্বিতাও হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। বিড়বিড় করে কী যেন একটা বলল, যেটা মাহিরের বোধগম্য হলো না ঠিক।

নব্য প্রত্যুষ। বাইরে বিভাবসুর দাপটে খা খা করছে বাতাবরণ। অতীতের আবলুস ভেদ করে বর্তমানের জৌলস বোধহয়। অন্বিতা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। বড়ো করে হাই তুলে দেখল পাশে মাহির নেই। উঠে পড়ল সে। ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে।

রুম এখনও ফাঁকা। মুখ মুছে অন্বিতা রুম থেকে বের হলো। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতেই দেখল সবাইকে। মাহির, দাদু আর তাইভিদ বসার ঘরের সোফায় বসে কথা বলছে। অন্বিতা দাদুকে সালাম দিল। সালামের উত্তর দিলেন দাদু। অন্বিতা প্রসন্ন গলায় শুধাল,

‘খেয়েছেন, দাদু?’

‘হ্যাঁ দাদুমনি, খেয়েছি। তুমি মাহিরকে নিয়ে খেয়ে নাও। ও তোমার অপেক্ষায় ছিল। আর তারপর মাহিরকে নিয়ে তৈরি হয়ে তোমার বাসায় চলে যেও, যদিও কাল’ই যাওয়া উচিত ছিল তোমাদের।’

অন্বিতা চিন্তিত সুরে বলল,

‘দাদু, এখানে কি আপনি একা থাকবেন? আমরা না হয় কয়দিন পর যাব।’

‘চিন্তা করো না, তাইভিদ আছে এখানে। আর আমি একা থাকতে পারতাম, গ্রামে তো প্রায়’ই থাকি। কিন্তু তোমার বর তো নাছোড়বান্দা, তাইভিদকে এখানেই রেখে দিয়েছে।’

‘এটা ভালো হয়েছে, দাদু। তাইভিদ থাকলে আমরাও নিশ্চিন্ত থাকব।’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমাদের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া তো আমার আর উপায় নেই। বেশ, মেনে নিলাম। যাও, এবার খেতে বসো।’

অন্বিতা মৃদু হেসে ডাইনিং এর কাছে গেল। মাহিরও উঠে এল সেখানে।

__________

দাদুর হাতের মোবাইল’টা বাজছে ক্রমাগত। তিনি মোবাইল হাতে নিয়ে গম্ভীর মুখে বসে আছেন। হাতে ঔষধ নিয়ে সেই রুমে এল তাইভিদ। দাদুর কাছে আসতেই বেজে যাওয়া ফোনটা দেখে বলল,

‘দাদু, কেউ বোধ হয় কল দিচ্ছেন।’

দাদু তাইভিদের দিকে তাকালেন। মোবাইলটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

‘তোমরা যে কী একটা করো না, যেটা করলে নাম্বার থেকে আর ফোন মেসেজ আসতে পারে না, ঐটা করে দাও তো।’

তাইভিদ প্রথমে বুঝল না। ফোনটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘কী করার কথা বলছেন, দাদু?’

দাদু খানিক বিরক্ত নিয়ে বললেন,

‘আরে ছেলে, কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে না করলে তার নাম্বারটা কী জানি একটা করো, নামটা তো মনে পড়ছে না আমার…’

দাদু ভাবছেন। তাইভিদের টনক নড়ে। বলে উঠে,

‘ব্লক করার কথা বলছেন?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এটাই। এই নাম্বারটা ব্লক করো।’

এতক্ষণে স্ক্রিনের দিকে তাকাল সে। জিনিয়া নামটা দেখে ফ্যালফ্যাল করে চাইল দাদুর দিকে।

‘আমার দিকে চেয়ে আছো কেন? ব্লক করো।’

তাইভিদ ইতস্তত বোধ করে। তাও দাদুর আদেশ পালনে পিছপা হয় না সে। ব্লক করে ফোনটা দাদুর কাছে ফিরিয়ে দিয়ে বলে,

‘আপনার ঔষধ নিয়ে এসেছিলাম।’

____________

মেয়ে আর মেয়ের জামাইয়ের জন্য এলাহি আয়োজন করেছেন আসিয়া বেগম। খালামনি চলে যেতে চাইলেও তিনি তাঁকে জোর করে রেখে দিয়েছেন। পাক্কা দুই দিন দুই রাত পর নিজের ঘর, নিজের কামরায় ফিরে মনটা প্রশান্তিতে যেন ভরে উঠল অন্বিতার। নিজের রুমের বিছানায় হাত মেলে শুয়ে পড়ল। তার পাশে এসে বসল মাহির। এর আগে আসলেও ওভাবে মনোযোগ দিয়ে রুমের কিছু দেখেনি সে। আজ দেখছে। দেয়ালে একটা ছবি দেখিয়ে বলল,

‘উনি তোমার বাবা?’

অন্বিতা সেদিকে চাইল। বলল,

‘হ্যাঁ।’

‘তুমি পুরো তোমার বাবার মতো হয়েছ।’

সপ্রতিভ হয়ে অন্বিতা বলল,

‘হ্যাঁ, সবাই তাই বলে।’

আশেপাশে চোখ বুলিয়ে উঠে বারান্দায় গেল মাহির। তার পেছন পেছন গেল অন্বিতাও। স্বভাবতই পাশের বারান্দায় চোখ গেল তার। মাহির জিজ্ঞেস করল,

‘অমিত আর অয়ন ঐ ফ্ল্যাটেই থাকে?’

‘হু।’

‘অয়ন তোমাকে একটা উপহার দিয়েছিল, সেটা তো খুলে দেখলে না।’

এই উপহারের কথা বেমালুম ভুলে বসেছে অন্বিতা। মনে পড়তেই বলল,

‘মনে ছিল না, বাসায় ফিরে গিয়ে খুলব।’

মাহির নয়নতারা গাছের দিকে তাকাল। গোধূলির কমলা রঙা আলোয় তাকে কমলা সুন্দরী লাগছে। ফুলের ভারে বেচারি নুইয়ে পড়েছে বোধ হয়। মাহির এগিয়ে গিয়ে সেখান থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে। তারপর নির্মল হেসে অন্বিতার সমীপে দাঁড়িয়ে যত্ন করে সেই ফুল গুঁজে দেয় তার কানে। মুচকি হাসে অন্বিতা। অস্তগামী ভানুর সমস্ত রঙে মেয়েটার সফেদ গায়ের রং চকচক করছে যেন। মাহিরের লোভ হলো বড্ড। নরম পাপড়ির ন্যায় কপোলে ঠোঁট বসিয়ে তবেই ক্ষান্ত হলো সে। হকচকিয়ে দু কদম পিছিয়ে গেল অন্বিতা। গালে হাত দিয়ে আশেপাশে চেয়ে দেখল কেউ দেখছে কি-না। অন্বিতার ভীত দৃষ্টি দেখে মাহির রগড় হেসে বলল,

‘দেখেনি কেউ।’

অন্বিতা গাল ঘঁষে বিড়বিড় করে বলল,

‘অসভ্য।’

পরক্ষণেই আবার আরেক গাল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘আরেক গালেও দাও, নয়তো বিয়ে হবে না।’

মাহির ক্ষুরধার চাহনি বর্তিয়ে তীক্ষ্ণ সুরে বলল,

‘তুমি আরো বিয়ের কথা ভাবছো?’

অন্বিতা দায়সারা ভাবে বলল,

‘ভাবতেই পারি।’

মাহির কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

‘তবে ঐ গালে জীবনেও চুমু দিব না। আজীবন এক গালেই চুমু দিয়ে যাব।’

চলবে…..

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৪।

ভো ভো শব্দ তুলে অনতবরত ফোনটা বাজছে। সেদিকে খেয়াল নেই অয়নের। সে গিটারটা কোলের উপর রেখে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে। চোখ বন্ধ। অমিত অফিস থেকে ফিরেছে বেশিক্ষণ হয়নি। ফ্রেশ হয়ে দুই মগ কফি নিয়ে বিছানায় এসে বসল সে। অয়নের দিকে চেয়ে বলল,

‘আসার পর থেকেই দেখছি গিটার নিয়ে বসে আছিস কেবল, সুর তুলছিস না কেন?’

অয়ন ক্ষীণ সুরে বলল,

‘ইচ্ছে করছে না।

‘তবে গিটার নিয়ে বসে আছিস কেন?’

উত্তর দিল না অয়ন। অমিত তার দিকে কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘নে, কফি খা।’

উঠে বসল অয়ন। গিটার’টা কোল থেকে সরিয়ে রাখল। তারপর কফির মগ হাতে নিল। অমিত অন্যটাতে চুমুক বসিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ফোন বাজছে তোর, তুলছিস না কেন?’

অয়ন দেখেছে এতক্ষণে। ফোনটা হাতে তুলে। আননোন নাম্বার দেখে কেটে দেয় সে। পরক্ষণেই আবার কল আসে। অমিত জিজ্ঞেস করে,

‘কে কল করছে?’

‘জানি না। আননোন নাম্বার।’

‘রিসিভ কর, হয়তো কারোর প্রয়োজন।’

রিসিভ করে কানে লাগাল অয়ন। ওপাশ থেকে শোনা গেল কারোর অস্থির গলার স্বর,

‘আচ্ছা মানুষ তো আপনি! সেই কখন থেকে কল করছি, অথচ রিসিভ করার নাম’ই নেই। এত ব্যস্ততা আপনার?’

অয়ন কপাল কুঁচকে একবার মোবাইলটা চোখের সামনে ধরে নাম্বার’টা দেখল। না, নাম্বার’টা চেনে না সে। আবারও কানে লাগাল। বিরক্তির সুরে বলল,

‘কে আপনি?’

মেয়েলি স্বর থামল এবার। গাঢ় নিশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেল খানিক। একপল সময় নিয়ে বলল,

‘আমি আভা।’

সঙ্গে সঙ্গেই অয়ন প্রশ্ন করল,

‘কে আভা?’

“আভা’র” নাম শুনতেই চমকে তাকায় অমিত। কফির মগ টেবিলে রেখে অতি উৎসাহে বলে,

‘আরে আভাকে চিনতে পারছিস না, অন্বিতার বান্ধবী।’

কপালের ভাঁজ দৃঢ় হলো অয়নের। এই মেয়ে তার নাম্বার পেল কোথায়? সে বীতঃস্পৃহ সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেয়েছেন?’

মুখটা চুপসে যায় অমিতের। ভয় পায় সে। আভা সত্যি বললে তার যে আর রক্ষে নেই। তবে মিথ্যে বলল আভা। বলল,

‘আপনার নাম্বার পাওয়াটা কোনো কঠিন ব্যাপার না। কী করছিলেন?’

আভা এত স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে যেন তারা কত পরিচিত। অথচ তিন আগেই প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল দুজনের। অয়নের বিরক্তির মাত্রা তরান্বিত হচ্ছে। এই মেয়ের সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র আগ্রহ পাচ্ছে না সে। তাই বলল,

‘ব্যস্ত আছি আমি, রাখছি।’

‘আরে শুনন তো। এত তাড়া কেন আপনার?’

‘বললাম তো, ব্যস্ত আছি।’

‘মিথ্যে বলছেন জানি।’

অয়ন এবার কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বলল,

‘যখন বুঝতেই পারছেন মিথ্যে বলে ফোন কাটতে চাইছি, তবে বিরক্ত করছেন কেন?’

‘আমার আপনার সাথে কথা ছিল। একটু সময় দিন, প্লিজ।’

অয়নে জোরে নিশ্বাস ফেলে বলল,

‘জলদি বলুন।’

অমিত কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। হাসফাস করছে আভার কথা শোনার জন্য। সে একটু একটু এগিয়ে গিয়ে নিজের কানটা অয়নের মোবাইলের দিকে নিল। যদি কিছু শুনতে পায়। অয়নের সম্মতি পেয়ে আভার মনের চঞ্চলতা বেড়ে যায়। কী কী বলবে মনে মনে সাজিয়ে নেয় সব। তারপর নিজেকে ধাতস্ত করে ধরাস ধরাস বক্ষে হাত রেখে বলে,

‘আমি আপনাকে পছন্দ করি, অয়ন।’

অমিতের কানে ঐটুকু যেতেই সে বিস্ফোরিত চোখে তাকায়। মেয়েটা কী চতুর আর চটপটে। অপরদিকে অয়ন নিরুত্তাপ, নিরুদ্বেগ। স্বাভাবিক গলায় বলে,

‘কিন্তু আমি করি না।’

অমিত ভ্রু কুঁচকে বন্ধুর দিকে চাইল। তার বন্ধু একটা আস্ত আহাম্মক, এক মেয়ের জন্য সারাজীবন দেবদাস হয়ে থাকার ফন্দি আঁটছে নাকি। আভা বলল,

‘এখন করেন না, ভবিষ্যতে করবেন। আমার অপেক্ষা করতে অসুবিধা নেই।’

অয়ন শক্ত গলায় বলল,

‘এমন কিছু কখনোই হবে না। অযথা আমার পেছনে সময় নষ্ট করবেন না। রাখছি।’

কল কেটে দেয় অয়ন। ঘাড় ঘুরিয়ে ক্ষুরধার চোখে অমিতকে দেখে। তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করে,

‘ঐ মেয়েকে আমার নাম্বার তুই দিয়েছিস?’

সরে বসে অমিত। আলাভোলা মুখ করে বলে,

‘অসম্ভব। এত বড়ো মিথ্যে অপবাদ তুই তোর বন্ধুকে দিতে পারিস না।’

‘তাহলে মেয়েটা আমার নাম্বার পেল কোথায়?’

অমিত কাঁধ উঁচিয়ে বলল,

‘আমি কী জানি।’

অয়নের বিশ্বাস হলো না মোটেও। সে শাণিত চোখে চেয়ে রইল কতক্ষণ। অমিত অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,

‘ওভাবে তাকাবি না, আমার লজ্জা লাগে।’

অয়ন ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু বলতে গিয়েও বলল না। উঠে বারান্দায় চলে গেল। অন্বিতার রুমে আলো দেখে অবাক হলো সে। তবে কি অন্বিতা এসেছে!

____________

মায়ের সাথে ফোনে কথা বলছিল তাইভিদ। ফোনের মাঝেই দেখল এক অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসছে বারবার। মায়ের সাথে কথা শেষ করে সে ঐ নাম্বারে কল ব্যাক করে। রিসিভ হলো তা। তাইভিদ জিজ্ঞেস করল,

‘কে বলছেন?’

‘আমি শশী। আপনি নিশ্চয় তাইভিদ?’

হকচকাল তাইভিদ। শশী তাকে কেন কল দিয়েছে। সে জানতে চাইল,

‘আপনি আমাকে কল করলেন যে? আর নাম্বার পেলেন কোথায়?’

‘মাহিরের নার্সিংহোমের ওয়েবসাইটে পেয়েছি। মাহির আর দাদুকে অনেকবার কল দেওয়া হয়েছে, কিন্তু উনারা তুলেননি। তাই বাধ্য হয়েই আপনাকে কল দেওয়া।’

তাইভিদ ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলল। বলল,

‘দুঃখিত, আমার মনে হচ্ছে না আমি আপনাকে কোনোপ্রকার সাহায্য করতে পারব বলে।’

শশী আকুতি জানাল,

‘এভাবে বলবেন, প্লিজ। মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, দাদুর সাথে মা’র কথা বলা জরুরি। দয়া করে একটু সাহায্য করুন।’

কাল অবধি যেই মেয়েটার অহমিকায় মাটিতে পা পড়ছিল না, তার মধ্যে এহেন দৈবিক পরিবর্তন দেখে অবাক হলো তাইভিদ। বলল,

‘কিন্তু দাদু উনার সাথে কথা বলতে চাইছেন না, আমি তো আর দাদুকে জোর করতে পারি না।’

‘আপনি বুঝতে পারছেন না, আমার মা অসুস্থ। দাদুকে একবার বুঝিয়ে বলুন, প্লিজ।’

মা অসুস্থ হলে সব সন্তানের মন’ই ব্যাকুল হয়ে উঠে। শশীর উদ্বিগ্ন, চিন্তিত কন্ঠে সেই ব্যাকুলতা স্পষ্ট। মুখের উপর ফোন কাটতে পারছে না তাইভিদ। এইদিকে দাদু সাফ বারণ করে দিয়েছেন, ওদের কারোর সাথেই তিনি আর যোগাযোগ রাখবেন না। তাইভিদের জবাব না পেয়ে শশী বিমর্ষ সুরে বলল,

‘নিজের জন্য না, আমি আমার মায়ের জন্য আপনার কাছে অনুরোধ করছি। আমাকে ফেরাবেন না, তার বিনিময়ে আপনি যা বলবেন তাই করব।’

তাইভিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শশীর এত আকুতি ফেলতে পারছে না সে। তাই বলল,

‘আচ্ছা, আমি দেখছি দাদুকে মানাতে পারি কি-না। পারলে এই নাম্বারে কল করব।’

‘ঠিক আছে।’

কল কেটে দিয়ে দাদুর রুমের দিকে পা বাড়াল তাইভিদ।

__________

অসিত অম্বরে এক ফালি চাঁদ মুচকি হেসে লুকোচুরি খেলছে। তার দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে মাহির। মন মেজাজ ঠিক নেই বোধ হয়। বারবার ঘুরে তাকাচ্ছে দরজার দিকে। এক রমণীর প্রতীক্ষায় হাঁপিয়ে উঠেছে সে। অথচ সেই রমণীর দেখা নেই। মা আর খালাকে পেয়ে স্বামীকে দিব্যি ভুলে বসেছে যেন।

বেশ অনেকটা প্রহর অপেক্ষায় জর্জরিত হয়ে কাটানোর পর সেই কাঙ্খিত মানুষের আগমন ঘটে। মাহির তাকে দেখে কপালে ভাঁজ ফেলে। অন্বিতা দরজা লাগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ায়। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘কী ব্যাপার, ডাক্তারসাহেব? মুখখানা অমন বাংলার পাঁচ করে রেখেছেন কেন?’

মাহির মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,

‘এলে কেন? মা আর খালামনির কাছেই থাকতে।’

অন্বিতা গাল ফুলিয়ে বলল,

‘বলেছিলাম মা’কে। কিন্তু মা আমাকে জোর করে এই রুমে পাঠিয়েছেন।’

মাহির রোষপূর্ণ চোখে চেয়ে আছে। মেয়েটা তার কথা বুঝল’ই না। অন্বিতা ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

‘ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’

‘আমার নির্দয়, পাষাণ বউটাকে দেখছি। তোমার স্বামীর প্রতি বুঝি তোমার এইটুকুও মায়া হয়না? তোমার অপেক্ষায় আমি শুকিয়ে মরছি, আর তুমি কি-না আমাকে এভাবে অবজ্ঞা করছো? তাও বিয়ের তৃতীয় দিনেই? বছর খানিক পর তো আর আমাকে চিনতেই পারবে না।’

অন্বিতা ঠোঁট চেপে হাসল। বারান্দায় দাঁড়াল গিয়ে। মাহির ঐসব বানোয়াট অভিমান ফেলে তাকে জড়িয়ে ধরল ততক্ষণাৎ। গ্রীবায় চিবুক ঠেকিয়ে বলল,

‘স্বামীর অভিমান ভাঙাতেও জানো না বুঝি?’

অন্বিতা হাসল। সুর টেনে গাইল,

“ভালোবাসি, ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশি
ভালোবাসি, ভালোবাসি…”

এইটুকু গেয়ে থামল সে। মাহির চিবুক সরিয়ে সেই স্থানে অধর ছোঁয়াল। খানিকটা কেঁপে উঠল বোধ হয় অন্বিতা। নিশ্বাস ফেলল জোরে। অতঃপর মাহির গাইল,

“আকাশে কার বুকের মাঝে
ব্যথা বাজে
দিগন্তে কার কালো আঁখি
আঁখির জলে যায় ভাসি
ভালোবাসি
ভালোবাসি, ভালোবাসি….”

নির্ঘুম এক জোড়া চোখ তৃপ্তি ভরে হাসল। তার না হোক অন্যকারোর সুরে তার প্রিয়া সুখী আছে, এইটুকুতেই বড্ড খুশি সে।

চলবে….