#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৯।
শরীরের অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে জিনিয়া বেগমের। তিনি এখন কথা বলতে পারেন, হাত পা নাড়াতে পারেন। তবে হাঁটতে অসুবিধা হয় খানিক। উনাকে নিয়ে শশী মাহিরের নার্সিংহোমে এসেছে। রেগুলার চেকআপের জন্য। হুইলচেয়ারে মা’কে বসিয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই তাইভিদকে দেখে। হাতে ফাইল নিয়ে সে হয়তো মাহিরের কেবিনের দিকেই যাচ্ছিল। শশীকে দেখে থামে তাইভিদ। প্রসন্ন হেসে এগিয়ে আসে। বলে,
‘চলে এসেছেন। স্যারের কেবিনে বসুন। স্যার ওয়ার্ডে গিয়েছেন, কিছুক্ষণের মাঝেই চলে আসবেন।’
শশী মুচকি হেসে মাথা হেলিয়ে মাহিরের কেবিনে গেল। তাইভিদ ফাইল রেখে গেল মাহিরকে ডাকতে।
কিছুক্ষণ পর কেবিনে এল মাহির আর অন্বিতা। মাহির এগিয়ে এল ফুপির কাছে। বলল,
‘অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত, ফুপি। ওয়ার্ডের এক পেশেন্ট হঠাৎই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাই আসতে একটু সময় লেগেছে।’
জিনিয়া বেগম কোমল স্বরে বললেন,
‘তুমি তো তোমার কাজ করছিলে, এতে দুঃখ প্রকাশ করার কিছু নেই।’
মাহির এবার অন্বিতার দিকে চেয়ে বলল,
‘অন্বি, তুমি ফুপিকে নিয়ে চেকআপ রুমে যাও। আমি আসছি।’
ফুপিকে নিয়ে চেকআপ রুমের দিকে আগাল অন্বিতা। তাইভিদের দেওয়া ফাইলটা বুঝিয়ে দিয়ে মাহিরও সেদিকে গেল। শশী বসে রইল সেখানে। চেকআপ রুমে বাইরের কারোর ঢোকার অনুমতি নেই। ফাইল গুছিয়ে এসে পাশে বসল তাইভিদ। সপ্রতিভ হয়ে চাইল শশী। তাইভিদ মুচকি হেসে বলল,
‘কফি খাবেন?’
‘আপনি বানালে খেতে পারি।’
তাইভিদ বিষন্ন সুরে বলল,
‘এখানে আমি কফি বানাব কী করে?’
শশী অন্যদিকে চেয়ে বেখেয়ালির স্বরে বলল,
‘আপনি চলে আসার পর থেকে আপনার বানানো কফিটা বেশ মিস করি।’
‘আর আমাকে মিস করেন না?’
ভ্রু কুঁচকে সরু চোখে তাকাল শশী। তাইভিদ মাথা চুলকে মুচকি হাসল। রগড় সুরে বলল,
‘মজা করছিলাম। চাইলে স্যারকে নালিশ করতে পারেন।’
শশী ঘুরে বসল ভালোভাবে। ক্ষিপ্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কথায় কথায় বারবার আপনার স্যারকে নালিশ করতে বলেন কেন? আমি কি নালিশ করা ছাড়া আর কিছু পারি না? ঐ তো একবার’ই শুধু নালিশ করেছিলাম, তার জন্য এখনও কথা শুনানোর কোনো মানে হয় না।’
শেষ উক্তিতে শশীর উপচে পড়া অভিমান। গাল ফুলাল সে। সরু ভ্রু জোড়া কুঁচকানো। ঘাড় কাত করে শশীকে কতক্ষণ দেখে ফের হাসল তাইভিদ। না তাকালেও শশী বুঝল, ছেলেটা হাসছে। একটা মানুষ এত হাসে কী করে তার জানা নেই। বীতঃস্পৃহ কন্ঠে শুধাল,
‘হাসছেন কেন? আমি হাসির কথা বলিনি।’
‘আমার উপরও আপনার অভিমান হয়, সেই ভেবেই হাসছি।’
শশীর সম্বিত ফেরে। অভিমান? সে তাইভিদ উপর অভিমান করেছে? কেন? ভারী চিন্তার বিষয়। তাইভিদ ঐ বাড়ি থেকে চলে আসার পর থেকেই অদ্ভুত সব চিন্তা হচ্ছে তার। আর সেই সব চিন্তার কেন্দ্র বিন্দু হলো তাইভিদ। শশী মাঝে মাঝে অবাক হয়। তাইভিদকে নিয়ে এত চিন্তার কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ সে বর্তাতে পারে না। তাও বেরিয়ে আসতে পারে না এসব থেকে। কী আশ্চর্য!
তাইভিদ উঠে দাঁড়াল এবার। বলল,
‘আমি কফি নিয়ে আসছি।’
‘না, আমি ক্যান্টিনের কফি খাব না। আজ কাজ শেষ করে বাড়িতে আসবেন। এসে কফি বানাবেন আমার জন্য।’
কথার সুরে অনুরোধ নয়, বরং যেন অধিকার খুঁজে পেল তাইভিদ। সে পূর্ণ মেদুর চোখে দেখছে শশীকে। সেই প্রথম শশী আর এই শশীর মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ। কাউকে এভাবে বদলে যেতে সে আগে কখনও দেখেনি। সেদিনের সেই প্রশ্নে প্রথমবারের জন্য শশীর প্রতি দূর্বলতা ঠাহর করেছিল সে। যদিও সেসবকে প্রশ্রয় দেয়নি। কিন্তু কথায় আছে, মন মস্তিষ্কের কথা শুনে চলে না, মন চলে নিজের গতিতে। সেই গতি রোধের ক্ষমতা কারোর নেই। তাইভিদেরও না। সে পরাস্ত স্বীকার করেছে অনেক আগেই। তবে প্রকাশ করেনি কখনও। কিন্তু আজকাল শশীর এহেন ব্যবহার তার দমিয়ে রাখা মনকে উস্কে দিচ্ছে ক্রমাগত। এমতবস্থায় সে কতক্ষণ মনকে শৃঙ্খলিত করে রাখতে পারবে সেটা অনিশ্চিত।
তাইভিদকে অপ্রস্তুত দেখাল। শশী বলল,
‘কী হলো, যাবেন না?’
‘এভাবে হুটহাট ঐ বাড়িতে গেলে স্যার কী ভাববেন?’
‘কিছুই ভাববেন না। বলবেন, নানাভাই অথবা মা’কে দেখতে গিয়েছেন।’
তাইভিদ চকিত স্বরে বলল,
‘মিথ্যে বলব?’
‘হ্যাঁ।’
তাইভিদ উত্তর দিল না আর। বেরিয়ে এল কেবিন থেকে। বড়ো করে শ্বাস টানল। চোখ বুজে ধাতস্ত করল নিজেকে। বেহারা মনকে এখনই সামলানো উচিত। দেরি হলে কেলেঙ্কারি হবে যে।
__________________
নির্মল অম্বরে শভ্র বারিদের বৈঠক বসেছে। মার্তন্ড মশাই তাদের কর্তা। তিনি বুক ফুলিয়ে হেলে আছেন পশ্চিম দিকে। স্বীয় রাজ্য, ক্ষমতা আর প্রজা নিয়ে তার অহংকারের শেষ নেই। বাতাবরণ উষ্ণ চঞ্চল। সমীরণের দেখা মেলা ভার। সুদর্শনা ভারী মুখে বারান্দায় এসে উঁকি দিচ্ছে বারবার। ঘড়িতে চারটা বিশ। লোকটা এখনও আসছে না কেন?সে ভারী বিরক্ত। এত অপেক্ষা করা যায় না-কি?
রুমে ফিরে এল আবার। আয়নায় দেখল নিজেকে। কপোল আরক্ত হতেই বুঝল সে লজ্জা পাচ্ছে। গায়ে নীলাভ রঙা সুতি শাড়ি। কপালে ভেসে ছোট্ট কালো টিপ। অধর রাঙাবে না ভেবেও রঙ মাখল খানিক। চুলে খোঁপা করল। একি, বউ লাগছে তাকে। লজ্জায় মুখ ঢাকল দুই হাতে। কলিং বেল বাজল তখনই। আভা আজ খুলতে গেল না। সে পরিপাটি হয়ে হারমোনিয়াম নিয়ে বসল বিছানায়। কয়েক ক্ষণ পর তার কাঙ্খিত পুরুষ শ্লথগতিতে তার সমীপে এসে বসল। আভা লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। আজ বড্ড আয়োজন করে নিজেকে গুছিয়েছে সে। অনেক ভেবে আত্মস্থ করেছে সব।
আভা আজ নীলাঞ্জনা সেজেছে কেন? তার জন্মদিন বলে? ভাবল অয়ন। জন্মদিনের কথা স্মরণে আসতেই সে আভার দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘শুভ জন্মদিন।’
হকচকিয়ে তাকায় আভা। অয়ন জানে, আজ তার জন্মদিন? আভার বিশ্বাস হচ্ছে না। আভার অমন ফ্যালফ্যাল চাহনি দেখে অয়ন অস্বস্তিতে পড়ল বেশ। ইতস্তত সুরে বলল,
‘না, আসলে অমিত আপনার বন্ধুর থেকে জেনেছিল আজ আপনার জন্মদিন। অমিত’ই বলেছে আমায়।’
আভা মিষ্টি হেসে অয়নের উপহার গ্রহণ করে ধন্যবাদ জানায়। অয়ন বলে,
‘এবার তাহলে শুরু করা যাক।’
আভা চাইল। কাজল চোখের এই নিগূঢ় চাহনি নিশ্বাস আটকে ফেলার ক্ষমতা রাখে। মেয়েটা বারবার এভাবে তাকায় কেন? এত কাজল দেয় কেন চোখে? এসব অয়নকে বড্ড অপ্রস্তুত করে তুলে। অয়ন হারমোনিয়াম বাজায়। আভার চোখের দৃষ্টি এখনও তার দিকেই স্থির। অয়ন মনোযোগ দিতে পারছে না। পারছে না সুর তুলতে। তাই হাত থামিয়ে শুধাল,
‘কিছু বলবেন?’
আভা মাথা নাড়াল উপর নিচ। অয়ন বলল,
‘কী, বলুন।’
দীর্ঘ দুই নিশিত নির্ঘুম কাটিয়ে যা কিছু মনে সাজিয়েছিল এই মুহুর্ত আভা তা সব ভুলে বসেছে। এত আয়োজন করেও কিছু মনে রাখতে পারেনি সে। নিখুঁত সুন্দর কথাগুলো বেমালুম ভুলে বসেছে সব। নিজের উপর যারপরনাই বিরক্ত হলো সে। এখন কী বলবে? কী বলে ব্যক্ত করবে সব? অয়ন আবারও বলল,
‘চুপ করে আছেন যে? বলুন, কী বলবেন?’
এলোমেলোই সই, আজ বলেই ক্ষান্ত হবে। মনের অত্যাচার আর নেওয়া যাচ্ছে না। তাই নিজেকে ধাতস্ত করে আভা বলে বসল,
‘আমি আপনাকে ভালোবাসি, অয়ন।’
অয়ন থমকাল তবে চমকাল না। ভালোবাসা চোখে প্রকাশ পায়। এই ভালোবাসা মেয়েটার কাজল রাঙা চোখে আরো আগেই দেখেছিল। তবে নির্লিপ্ত ছিল সে। ভালোবাসার দহনে একবার পুড়ে ছাই হয়ে দ্বিতীয়বার আর সাহস করার সায় মন দেয় না। সে নিরুত্তাপ, নিরুদ্বেগ। আভার চোখে মুখে অস্থিরতা। অয়ন প্রলম্বিত শ্বাস টেনে বলল,
‘আপনার বান্ধবী নিশ্চিয় আপনাকে সব বলেছেন?’
আভা ত্বরিতে মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘আমি জানি সব। আর সবকিছু জেনে আর মেনে নিয়েই আমি আপনাকে ভালোবেসেছি।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল অয়ন। মেয়েটার আত্মবিশ্বাস আছে। তার মতো ভীতু নয় অন্তত। এইটুকু ভেবে খুশি হলো সে। নরম স্বরে বলল,
‘এক মনে কয়জনকে ভালোবাসা যায়?’
‘চাইলে অনেকজন আর না চাইলে একজনকেও না।’
‘আমার ক্ষুদ্র হৃদয়ে এত ভালোবাসা নেই। আপনার ভবিষ্যতে আফসোস হবে।’
আভা মুচকি হেসে বলল,
‘আপনার হৃদয়ে যতটুকু আছে তার সাথে আমার হৃদয়ের ভালোবাসা মেশালেই অনেক হয়ে যাবে। এক সমুদ্র না হোক, এক ঝিল হলেও চলবে আমার।’
অয়ন পরিশ্রান্ত বদনে চেয়ে রইল। মেয়েটা কী চমৎকার! সে যেভাবে অন্য একজনকে ভালোবেসে ছিল, এই মেয়েটাও তাকে ঠিক সেইভাবেই ভালোবাসে। তাও ভীত মন তার। এক আঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়েছে, আর আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা নেই। তাই বলল,
‘আমি বড্ড ভীতু, আভা। একপাক্ষিক ভালোবাসার যন্ত্রণায় এত তড়পিয়েছি যে এখন ভালোবাসার শব্দ শুনলেই গায়ে কাটা দেয়। তবে আমার জন্য তো আর আপনাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আপনি ভীষণ ভালো মেয়ে। কিন্তু এই ভালো মেয়েকে ভালোবাসার মতো ক্ষমতা আমার মতো অধমের নেই।’
আভা ব্যাকুল সুরে বলল,
‘এভাবে বলবেন না। যে একপাক্ষিক ভালোবাসার যন্ত্রণা আপনি পেয়েছেন সেটা আমাকে দিবেন না দয়া করে। আমি আপনার মতো অত শক্ত নই, আমি দূর্বল। মরে টরে গেলে সেই দোষ কিন্তু আপনার।’
কী অবলীলায় সাংঘাতিক এক কথা বলে বসল। অয়ন হতভম্ব, হতবাক। মেয়েটা মরার কথা বলছে! তার জন্য কেউ মরার কথা বলতে পারে এটা যে তার কাছে অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
চলবে…