#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৮।
সিতুল সাবলীল ভঙিতে বলল,
‘তোমার বাবাকে কে না ভালোবাসেন? এই গ্রামের সবাই ভালোবাসেন। কত ভালো মানুষ তিনি। গ্রামে হাসপাতাল করেছেন। গ্রামের সবাই তো উনাকে ফেরেশতা ভাবেন।’
তারা তীক্ষ্ণ চোখে চাইল কিঞ্চিৎ। সিতুল নামের মেয়েটার সাথে তার ভারী ভাব। গ্রামে একমাত্র বান্ধবী তার। মায়ের চাচাতো বোন হিসেবে সম্পর্কে সে তারার আন্টি হলেও তারা তাকে আন্টি কম বান্ধবীই ভাবে বেশি। সিতুলও তাই। সেই বোঝার বয়স থেকেই গ্রামে আসলেই তারাকে সে যত্ন করে আগলে রাখে। বয়সে সে তারার চার বছরের বড়ো হলেও তাদের চাল চলনে তা বোঝা দায়।
তারার জহুরি চোখের পর্যবেক্ষণ শেষ হতেই সে বলল,
‘আমি ছোট, কিন্তু বোকা নই, সিতুল। আমাকে এটা ওটা বলে বোঝাতে পারবে না। তুমি বাবাকে পছন্দ করো, এটা আমি আরো আগে থেকেই বুঝেছি।’
ধরা পড়া চোরের ন্যায় সিতুলের মুখ চুপসালো। চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে বলল,
‘ভালো মানুষকে তো সবাই পছন্দ করে।’
‘এই পছন্দ সেই পছন্দ না, সিতুল। আমি সব বুঝি। তুমি এবার সত্যিটা স্বীকার করো।’
ভীষণ বিপাকে পড়ল সিতুল। আর মিথ্যা বলে পার পাওয়া যাবে না বোধ হয়। তারা মেয়েটা দুরন্ত, এতদিন যে তার থেকে লুকিয়ে আসতে পেরেছে সেই ঢের। সে ঠোঁট ভিজিয়ে ইতস্তত সুরে বলল,
‘হ্যাঁ, আমি তোমার বাবাকে পছন্দ করি। ভালোও বাসি। কিন্তু ওয়াদা করো, তুমি এই কথা কাউকে বলব না।’
‘ওয়াদা করলাম, বলব না। কিন্তু, আমাকে বাবাকে তুমি কেন পছন্দ করলে? তুমি জানো না, আমার বাবা বিবাহিত, তার একটা মেয়ে আছে?’
সিতুল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলল,
‘জানব না কেন? সব জেনেই আমি তোমার বাবাকে ভালোবেসেছি।’
তারা হাসল। হাসলে মেয়েটার চোখ ছোট হয়ে আসে। সিতুলের এই হাসি ভারী পছন্দ। তারা বলল,
‘বোকা মেয়ে তুমি। তুমি জানো, আমার বাবা আমার মা’কে কতটা ভালোবাসে? জানো না। কী করে জানবে, তুমি তো আমার মায়ের লেখা ডায়েরিটা পড়োনি। একদিন ডায়েরিটা নিয়ে আসব। তুমি পড়বে, আর সেদিন বুঝবে তুমি কত বোকার মতো এক কাজ করেছ।’
সিতুলের মনঃস্তাপ হলো। সে ক্ষীণ সুরে বলল,
‘মানুষ কি দ্বিতীয়বার ভালোবাসতে পারে না?’
‘মানুষ পারে, কিন্তু আমার বাবা পারবে না। আমার বোঝার বয়স হওয়ার পর থেকে দেখেছি, বড়ো আব্বু কত করে বাবাকে বিয়ে দিতে চাইলেন, কত মেয়ে দেখালেন, কত বোঝালেন, কিন্তু বাবাকে কখনও না থেকে হ্যাঁ করাতে পারলেন না। এই আফসোস নিয়েই মারা গেলেন তিনি। আর বাবা এখনও তার সিদ্ধান্তেই অটুট। কারণ আমার বাবা নিজেকে কখনও একা ভাবেন’ইনি। মা পাশে না থাকলেও মায়ের ভালোবাসা সবসময় আমার আর আমার বাবার পাশে আছে। তাই আমাদের কখনও একা বোধ হয় না।’
সিতুল এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কতক্ষণ। তারপর জিজ্ঞেস করল,
‘তোমার বাবা মা একজন অন্যজনকে খুব ভালোবাসত, তাই না?’
‘ভালোবাসত কী বলছো; বলো- ভালোবাসে। উনাদের এই ভালোবাসার কোনো অন্ত নেই, সময়সীমা নেই।’
সিতুল মুচকি হেসে বলে,
‘তুমি খুব সুন্দর কথা বলো।’
‘হ্যাঁ, আমার বাবাও বলে- আমি না-কি মায়ের মতো করে কথা বলি।’
সিতুল মলিন হাসল। তারা বলল,
‘যাকে পাবে না, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখো না। আমার বাবার এখন শুধু বেঁচে আছে আমার জন্য। আর আমি বেঁচে আছি বাবার জন্য। অথচ আমরা দুজনেই অপেক্ষা করছি এক সুন্দর মৃত্যুর। যেই মৃত্যু’ই আমাদের জন্য পথ বানাবে, যে পথের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকবে আমার মা, আর বোন। আমরা তো প্রতিদিন ভোর দেখি, এই একটাই আশা বুনে।’
কিশোরী মনের প্রথম প্রেম দুমড়ে মুচড়ে গুঁড়ো হলো। আহত হলো হৃদয়। ভীষণ কষ্টে ভার হলো মন। তাও সিতুল হেসে বলল,
‘চিন্তা নেই। আমি তোমাদের আশায় ব্যাঘাত ঘটাব না।’
তারা হেসে জড়িয়ে ধরল তাকে। বলল,
‘এইজন্যই তোমাকে আমার এত পছন্দ।’
ঘাটের কাছটায় এসে মন চনমনে হয়ে উঠল তারার। পদ্ম ফুল দেখা যাচ্ছে। যদিও মজে গিয়েছে তা। তাতে কী, তারার সেটাই চায়। সে পা ভেজাল ঘোলা পানিতে। সিতুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘সিতুল, আমাকে একটা বড়ো লাঠি এনে দাও তো।’
‘কী করবে?’
‘ঐ যে পদ্মফুলটা আনব।’
সিতুল দেখল পদ্মফুল পুকুরের অপর পাশে। সে বলল,
‘লাঠি দিয়েও এটা আনতে পারবে না, দূরত্ব অনেক।’
তারা মন খারাপ করে বলল,
‘তাহলে উপায়?’
সিতুলও তার পাশে পা ভিজিয়ে বসল। বলল,
‘মন খারাপ করো না। কাল আমি গোসলের সময় তোমার জন্য নিয়ে আসব।’
‘কিন্তু আমরা তো আজ রাতেই ফিরে যাব।’
সিতুল চেয়ে দেখল, মেয়েটার শুভ্র মুখে মেঘের আনাগোনা। সে স্মিত হেসে বলল,
‘তোমার ফুলটা এখন চাই?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু আনার তো কোনো উপায় নেই।’
সিতুল উঠে দাঁড়াল। ওড়নাটা ভালোভাবে কোমরে পেঁচিয়ে বলল,
‘দাঁড়াও, আমি আনছি।’
তারা পুনশ্চ প্রশ্ন ছোড়ার আগেই সিতুল ঝাঁপ দিল পুকুরে। তারা হতভম্ব, হতবাক। মেয়েটা কী করল এটা! সে চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘সিতুল, তুমি পুকুরে নামলে কেন? পাগল হয়েছে?’
সিতুল সাঁতার কেটে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
‘তুমি দাঁড়াও, আমি ফুলটা আনছি।’
তারা তার মাথা চাপড়ায়। কেন যে সে ফুলের কথা বলতে গেল। এখন তার জন্য মেয়েটাকে এই অবেলায় এভাবে ভিজতে হচ্ছে।
ফুল নিয়ে উঠে এল সিতুল। বেশ বড়ো পুকুর, এই মাথা থেকে ঐ মাথা সাঁতার কেটে সিতুলের শ্বাস পড়ছে ঘনঘন। সে তারার হাতে ফুল দিয়ে বলল,
‘এবার খুশি তো?’
তারা বিস্ময়াবিষ্ট সুরে বলল,
‘পাগল তুমি! এভাবে কেউ পানিতে ঝাঁপ দেয়?’
সিতুল হেসে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ওড়না খুলে শরীর ঢেকে বলল,
‘তুমি তো ফুলের জন্য মন খারাপ করছিলে, তাই এনে দিয়েছি। এবার মন ভালো হয়েছে তো?’
তারা খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠে বলে,
‘ভীষণ ভালো হয়েছে। এবার যাও, তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টাও, নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে।’
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে সিতুল বলে,
‘তুমি যে কী বলো না। রাত বিরেতে কত পুকুরে গোসল করি আমি, এসবে আমার কিছুই হবে না।’
তারা তার হাত টেনে বলল,
‘দেখেছ, হাতের ব্যান্ডেজ’টাও ভিজে গিয়েছে। আবার ব্যান্ডেজ করতে হবে।’
সিতুল একপলক তা দেখে বলল,
‘না না, কিচ্ছু করতে হবে না। এমনিই ঠিক হয়ে যাবে।’
____________
সন্ধ্যার পূর্ব মুহুর্ত। বিভাবসুর বাড়ি ফেরার পালা। বাতাবরণ শান্ত, নীরব। আগরবাতির এক তীব্র ঘ্রাণ এসে ঠেকছে মাহিরের নাকে। এই ঘ্রাণে গায়ে কাটা দেয় তার। মনে পড়ে সেই বীভৎস মুহুর্তের কথা। যখন তার অন্বিতাকে কাফনের শুভ্রতায় সাজানো হয়েছিল। এমনি’ই এক তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসছিল তার চারপাশ থেকে। সেই বিদঘুটে মুহুর্ত এখনও যন্ত্রণা দেয় তাকে। নিশ্বাস রোধ করে। সে ঢোক গিলে। অন্বিতার কবরের দিকে চেয়ে মেঘমন্দ্র স্বরে বলে,
‘মৃত্যুর অপেক্ষায় আমি ক্লান্ত, অন্বি। এই একটাই তো উপায়, তোমাকে আবার পাওয়ার। সেই মুহুর্তটাও যে আসছে না, আর কত অপেক্ষা করব, বলো তো?’
মাহির ঠোঁট চেপে ধরে। অন্বিতা মারা যাওয়ার পর থেকে সে ভীষণ ছিঁচকাঁদুনে হয়ে পড়েছে, কথায় কথায় তার কান্না পায়। সে সংযত করল নিজেকে। নয়নতারা গাছের কয়টা ফুল এনে অন্বিতার কবরের উপর ছিটাল। অস্ফুট স্বরে বলল,
‘মৃত্যু কেন ভালোবাসায় বিচ্ছেদ ঘটায়, বলতে পারো? কেন আমাদের ভাগ্য এত নির্মম হলো? কেন আমি তোমাকে আর কয়টা দিন বেশি ভালোবাসতে পারলাম না? তোমার জন্য জমিয়ে রাখা এক আকাশসম ভালোবাসার ভারে তোমার ডাক্তারসাহেব যে দূর্বল হয়ে পড়েছে, অন্বি। তোমাকে একটু ভালোবাসার জন্য, একটু কাছে পাওয়ার জন্য যে সে প্রতিনিয়ত তড়পাচ্ছে। তুমি কি দেখতে পাচ্ছো, অন্বি? শুনতে পাচ্ছো, তোমার ডাক্তারসাহেব তোমায় ভীষণ ভালোবাসে।’
গাছের আঁড়াল থেকে সরে এল সিতুল। এই পৃথিবী কত নির্মম! কত জঘন্য ভাবে ভালোবাসাকে খন্ড বিখন্ড করে ফেলে। তার অন্বিতার জন্য আফসোস হয় খুব। কী চমৎকার এক ভালোবাসা ফেলে অসময়েই হারিয়ে যেতে হলো তাকে। এর থেকে দুর্ভাগ্যের আর কিছু বোধ হয় হতে পারে না।
চলবে…..