একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব-৫৬+৫৭

0
614

#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই।
৫৬
#WriterঃMousimi_Akter.

আমি ভীষণ ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছি, এমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকা মানুষটার দিকে। যেন আমি কিছুই জানি না, কী ঘটেছে সেটাও বুঝতে পারিনি। না বোঝার অভিনয়ে অটুট থেকে চোখ ঢলতে ঢলতে আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বললাম,

‘আল্লাহ! আপনি পড়ে গিয়েছেন? কীভাবে পড়লেন? ব্যাথা পেয়েছেন? শিঘ্রি উঠুন।’

উনি কোমরে হাত রেখেই উঠে দাঁড়ালেন।সেই অদ্ভুত চাহনিতে স্থির থেকে বললেন, ‘তুমি জানো না, কীভাবে পড়েছি?’

‘না তো। আপনি কি স্বপ্ন দেখেছেন কিছু?মানে উঁচু পাহাড় থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন এমন। শুনুন, আপনি বসুন, আমি ডিম সিদ্ধ করে নিয়ে আসি। আপনার শরীর দূর্বল হয়েছে। শরীর দূর্বল হলে মানুষ এসব উলটা-পালটা স্বপ্ন দেখে।’

‘রিয়েলি?’

‘হ্যাঁ, রিয়েলি।’

‘আর্জেন্টিনার পক্ষ থেকে গোল খেয়েছি, আর বিখ্যাত প্লেয়ার গোলটা দিয়েছে।সো, তোমাকে এত কষ্ট করতে হবে না। এমনিতেই অনেক কষ্ট করেছ।’

‘কী করেছি আমি?’

‘কিছুই না জাস্ট কোমরের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছ।’

‘এই বয়সে কোমরে সমস্যা আপনার?’

‘যার বউ, বরকে বল ভেবে লা**থি মা**রে তার কোমর যে এতদিন টিকে আছে সেটাই অনেক। নাও ঘুমোও এখন।’

পরের দিন ঘুম থেকে উঠে দেখি উনি বিছানায় নেই। আমি শীতের কাপড় গায়ে দিয়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেই চোখ আটকে গেল পৃথিবীর বেষ্ট হ্যান্ডসাম পুরুষেটিকে দেখে। উনার পরনে কালো ট্রাউজার, খালি গায়ে বুক ডাউন দিচ্ছেন।এই কড়া শীতে ঘেমে তিরতির অবস্থা।আমার পরনে লাল রঙের একটা উলের লং সোয়েটার,পরনে লেগিংস। দরজায় হেলান দিয়ে ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে আছি উনার দিকে। বুক ডাউনের ওঠা-নামার প্রতিটা স্টেপ দারুণ ভাবে মুগ্ধ করছে আমাকে।হঠাৎ আমার দিকে উনার চোখ পড়ল। উনি আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই বুক ডাউন দিচ্ছেন। ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসি।দুজনই দুজনের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। উনি উঠে দাঁড়িয়ে টাওয়াল নিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘ট্রাই করবে না কি আমার সাথে?’

‘করব।’

‘ওকে কাম।’

আমি পা বাড়াতেই বললেন, ‘এক সেকেন্ড, এই পোশাকে শরীর চর্চা হয় না ম্যাডাম।এত মোটা কাপড়-চোপড় পরে বুক ডাউন দিতে পারবে না।’

‘তাহলে?’

‘লুক এট মি। তুমি চাইলে আমার মতো পোশাকেও বুক ডাউন দিতে পারো।’

‘আপনার মতো মানে, খালি গায়ে?’

‘থাক কাপড় খুলতে হবে না।আমার লজ্জা করবে।’

‘ছিঃ! কী অসভ্য!’

‘টি-শার্ট পরে এসো।’

রুমে গিয়ে সাদা একটা টি-শার্ট পরে নিলাম।মনে মনে ভালো লাগছে। উনার সাথে শরীর চর্চা করাটাই যেন ভীষণ আনন্দের বিষয় আমার কাছে। টি-শার্ট পরে পেছনে তাকিয়ে দেখি উনি দাঁড়িয়ে আছেন। উনাকে দেখে বেশ ঘাবড়ে গেলাম। আমি চেঞ্জ করার সময়ে কি উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন! জড়ানো কন্ঠে বললাম,
‘এ কী! আ আপনি এখানে?আমার চেঞ্জ করা দেখছিলেন?’

‘না অন্য কিছু দেখছিলাম।’

‘অন্য কিছু মানে?’

‘দু’চোখ সার্থক হলো আজ।’

‘হোয়াট ডু ইউ মিন? আপনি এসব কী বলছেন?’

এ কথা বলেই বিছানা থেকে ওড়না নিয়ে গায়ে জড়ালাম।

উনি নিচের ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু হেসে বললেন, ‘মনে হচ্ছে আজ প্রথম দেখলাম!’
বলেই সদ্য গজানো খোঁচাখোঁচা দাঁড়িতে হাত বোলালেন।
আমি ভীষণ লজ্জা পেয়ে গায়ের ওড়না ঠিক করতে করতে বললাম,
‘মানুষ যে এত অসভ্য হতে পারে আগে জানতাম না। কী দেখেছেন না দেখেছেন কেউ জানতে চেয়েছে? পুরুষ মানুষের লজ্জা না থাকতে পারে কিন্তু লজ্জা তো নারীর ভূষণ। যান তো কোনো এক্সসারসাইজ টাইজ করব না।’

উনি ওড়না টেনে নিয়ে নিজের গলায় পেঁচিয়ে আমার দুই ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে মাদক মিশ্রিত কন্ঠে বললেন, ‘কী সারাহ! এসব কী করছ? বিয়ে করা বউ আমার তুমি।এত ওড়না প্যাঁচা পেঁচির কী আছে? তুমি চাইলে কিছু না পরেও আমার সামনে দিয়ে ঘুরতে পারো।আমার কোনো আপত্তি নেই।জাস্ট লজ্জা টজ্জা কমিয়ে ফেলো।’

‘আপনার কি লজ্জা-শরম সব উবে গেছে?

‘কীভাবে লজ্জা থাকবে?ইউ নো হোয়াট সুইটহার্ট, ইউ’র লুক সো হট।সাদা টি-শার্ট, লেগিংস,এলোমেলো চুল। জাস্ট পা*গ*ল করা, নেশা ধরানো লুক।’ বলেই জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজালেন।

লজ্জায় কী বলব বুঝতে না পেরে বললাম, ‘বার বার ঠোঁট ভেজাচ্ছেন কেন?লিপজেল ইউজ করুন।’

‘ঠোঁটে কিছু একটার অভাববোধ করছি।সেটা পেলেই ঠিক হয়ে যাবে।লিপজেলে এসব অভাব যাবে না।’

আমি বুঝতে পারলাম উনি কী বোঝাচ্ছেন।তবুও প্রশ্ন করলাম,’কীসের অভাব?’

‘তোমার ঠোঁটের উষ্ণতায় শুষ্কতা কেটে যাবে।’ বলেই গাঢ় চুমু দিলেন অনেক্ষণ ধরে।মাঝে মাঝে এই মানুষকে ভালবাসার চেয়েও বেশি ভালবেসে ফেলি। এমন রোমান্টিক হয়ে যান প্রেমে পড়তে বাধ্য হই।চুমু শেষ করে বললেন, ‘চলো।’

উনার সাথে বিভিন্ন রকম শরীরচর্চা করে বুক ডাউন দেওয়া শুরু করলাম।তাকিয়ে আছি উনার দিকে উনিও তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।দুজনেই মৃদু হেসে দিলাম।মুহূর্তগুলো যেন স্বপ্নের মতো।মাঝে মাঝে মনে হয় একটা মেয়ে কত বেশি ভাগ্যবতী হলে এমন ভালোবাসার মানুষ পায়! আমার ভাগ্য কী একটু বেশি ভালো!

দুজনে ফ্রেশ হয়ে ডায়নিং-এ বসে চা খাচ্ছি।এরই মাঝে আরিয়ান নামে সেভ করা একটা নম্বর থেকে উনার ফোনে কল এলো। উনি নম্বারটা দেখে আমার দিকে তাকালেন।চাহনিতে কেমন শীতল একটা ভাব।ফোনটা কেটে দিলেন। কেটে দিয়ে অনিচ্ছাকৃত মৃদু হাসলেন। আরিয়ান নামটা দেখে আমার বুকের মাঝে কেমন যেন একটা বাড়ি মেরে উঠল।
এটা কোন আরিয়ান! যার কথা ভাবছি সে হওয়ার কথা তো নয়। আবারও একই নাম্বার থেকে ফোন এলো। উনি ফোনটা কেটে দিলেন। সাথে সাথে মেসেজ এলো, ‘আমি ওকে একবার দেখতে চাই।জাস্ট একবার।প্রমিস অন্য কিছু বলব না।’

উনি রিপ্লাই দিলেন, ‘ও এখন আমার কাছে নেই। আর আমি এখন ঢাকা আছি।বিশেষ একটা কাজে।’

উঁকি মেরে মেসেজটা দেখলাম। উনি মিথ্যা বললেন কেন! উনি তো মিথ্যা বলেন না।কিছু একটা কাহিনি আছে, বাট কী হতে পারে সেটা? আর এটা কোন আরিয়ান! উনি চা খাওয়া শেষ করে ফোন কানে নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন । নিশ্চয়ই এই আরিয়ান নামক মানুষটার সাথে কথা বলতেই বাইরে গেলেন। কী এমন কথা যা উনি লুকাচ্ছেন! উনি তো কিছু লুকান না। আমার জীবনে আবার কোনো অশান্তি হবে না তো! এটা যদি সেই আরিয়ান হয় তাহলে কী হবে!সে উনার কাছে কী চাই! এতদিন পরে কেন উনার সাথে যোগাযোগ করবে। তার তো যোগাযোগ করার কোনো কারণ নেই। আমি ভ**য় পাচ্ছি কেন? আমি তো কিছু করিনি। তাহলে কেন ভ** য় পাচ্ছি? রোশান স্যার এসব ব্যাপারে কিছু জানলে আমাকে ভুল বুঝবেন, আমি কী সেই ভ**য় পাচ্ছি! কেন পাচ্ছি আমি ভ*য়! উনি তো সেরকম মানুষ নন যে, অকারণ আমাকে ভুল বুঝবেন।আজ আমি বুঝতে পারছি ওই মানুষটাকে আমি কত বেশি ভালোবাসি। আর ভালোবাসি বলেই এত ভ**য় হচ্ছে। ফোনটা নিয়ে আপুর নাম্বারে ডায়াল করলাম।
আপু ফোন রিসিভ করে বলল, ‘স্যারের বউ, ম্যাডাম বলেন।’

‘আপু একটু কথা ছিল।’

‘এত অস্থির কেন তুই?’

‘অস্থির হব না কেন? তুমি কি জানো, আরিয়ান ভাই কোথায়?’

‘আমি জানব কীভাবে? ওদের সাথে কথা বলি না কি আমরা, আর তুই রোশানের মতো জামাই পেয়ে ওর কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?’

‘আপু, আসলে রোশান স্যারের ফোনে আমি একটা নাম্বার দেখেছি ‘আরিয়ান’ নামে সেভ করা। আরিয়ান ভাই আবার উনার নাম্বার যোগাড় করেনি তো?’

‘তুই কি পা*গ*ল, আরিয়ান ভাই কীভাবে রোশানের নাম্বার পাবে? আর ওর উদ্দেশ্য বা কী হবে? তোর তো আর রিলেশন ছিল না তাই না? তাছাড়া আরিয়ান ভাই অতটা খারাপ ছেলেও না যে এসব করবে। মাথা থেকে ঝাড়, এসব বাদ দে।’

আপুর সাথে কথা বলেও মনটা শান্ত হলো না। কেমন যেন অস্থিরতা বেড়ে চলেছে।

এরপর কেটে গেল আরও কতগুলো দিন। অথচ ওই নাম্বার আর দেখলামই না। উনার ইনবক্স, ডায়াল বা রিসিভ কল কোথাও না।কোথায় যেন হারিয়ে গেল আরিয়ান নামক চ্যাপ্টারটা। উনিও বেশ স্বাভাবিক আছেন এ ব্যাপারে।

দিন আস্তে আস্তে এগোচ্ছে।সব কিছুই ঠিকঠাক চলছে। তরীকে আবার ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়েছে। তরী সব কিছু ভুলে লেখাপড়ায় মনোযোগী হয়েছে। একটা বিষয় কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতে পারছি। কেউ একজন তরীর গহনাগুলো সম্পূর্ণ কিনে নেয়। বেশ ৩-৪ বার এমন করার পর তরী এখন বেশ কিছু টাকার মালিক। এখন আর আমাদের ওকে হেল্প করা লাগে না। নিজের খরচ নিজেই চালাতে পারে। নিজস্ব মূলধনে এখন গহনার সমস্ত ম্যাটারিয়ালস কিনছে। তাছাড়া ওর নিজের ভেতরও এখন অনেক চেঞ্জ এসেছে। আগের সেই তরী নিজেকে বেশ খানিকটা পরিবর্তন করে ফেলেছে। চেহারায় অন্যরকম একটা মাধুর্যতা ফিরে এসেছে।

সময় ঘুরতে ঘুরতে আমাদের বিবাহবার্ষিকী চলে এলো। আমরা কাউকে কিছু বলিনি।ইচ্ছা নেই মানুষ ডেকে এই দিনটা সেলিব্রেট করার। উনার ইচ্ছা ছিল আমরা দুজন দুজনকে সময় দিব। তবুও আমার আপু, দুলাভাই, তরী, পিহু, ছোঁয়া, তন্ময়, মৃন্ময়, দ্বীপ উপস্থিত হলো। সবাই ভীষণ আড্ডা দিচ্ছিলাম; কিন্তু এরই মাঝে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেল। তরী যখন আমাদের ঘর সাজাচ্ছিল তখনই মৃন্ময় প্রবেশ করল সেখানে। আর ঘটনাটা সেখানেই ঘটল।

চলবে?..

#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই।
৫৭
#WriterঃMousumi_Akter.

তরীর পরনে নেভি ব্লু জরজেট -এর কাজ করা একটা গাউন। দুই হাত ভর্তি স্টোনের ব্লু চুড়ি, চুলগুলো সুন্দর ভাবে কাটিং করা। আগের সেই তেল চিটচিটে চুল আর নেই। এখনকার চুলগুলো দিয়ে শ্যাম্পুর একটা সুন্দর সুবাস ছড়াচ্ছে। এই শ্যাম্পুটা আমাদের দেশীয় নয়। এই শ্যাম্পুর বিশেষত্ব হচ্ছে — দারুণ সুবাস ছড়ানো। আর এটা কিছুদিন আগে তরীর জন্মদিনে মৃন্ময় উপহার দিয়েছিল সাথে এই গাউনটাও এনেছিল। এইতো কিছুদিন আগেই তরীর জন্মদিন ছিল। আমরা কেউ জানতাম না। কিন্তু মৃন্ময় আবিষ্কার করেছিল সেই দিনটি।হঠাৎ রাত সাড়ে এগারোটায় আমাকে কল করে বলল, ‘তুই কি জানিস আজ তোর জা-এর জন্মদিন?’

কথাটা শুনে বেশ অবাক হয়ে বলেছিলাম, ‘
‘তুই কীভাবে জানলি? আমাকে তো তরী এ বিষয়ে কিছুই বলেনি। তাছাড়া এসব কখনো শোনাও হয়নি।’

‘জেনেছি। আজন্মকাল থেকেই জানি। কিছু দিবস আছে— যেটা কেউ ভোলে না।’

‘হোয়াট ইজ কাহিনি, ব্রো? কিছু দিবস কেউ ভোলে না মানে?’

‘মানে— কারো হৃদয়ে কারো জন্য বিশেষ দিনগুলি আজন্মকাল ধরে গেঁথে থাকে।’

‘এই কথার মানে কী? আজন্মকাল ধরে তরীর জন্মদিনের কথা তোর মনে আছে?’

‘তোকে একটু রহস্যময় কথাবার্তা বললাম।যা এখন সারপ্রাইজ দিয়ে আয়। ডেইট তো জানিয়েই দিলাম।’

‘এখন কীভাবে সারপ্রাইজ দিব মৃন্ময়? তরী বেবির জন্মদিন এটা, বিশেষ ভাবে সেলিব্রেট করা উচিত। কেউ ওকে এসব ব্যাপার কোনদিন স্পেশালি ফিল করায়নি। ‘

‘স্যারকে নিয়ে নিচে আয়। স্যার কি রাজি হবেন আসতে?’

‘রাজি হবে না মানে, ওটা আমার বর বুঝলি? আমি যা বলি তাই শোনে।’

‘শোন সারাহ, আমি একটা ড্রেস আর শ্যাম্পু এনেছি তরীর জন্য।তোর নাম করে একটু দিয়ে দিবি প্লিজ।’

‘আমার নাম কেন? তুই নিজে দে।’

‘আমি দিলে ও কখনো ব্যবহার করবে না।জানিস তো তরী একটা সভ্য-শান্ত মেয়ে। হুট করে একটা ছেলের দেওয়া ড্রেস ও পরবে না। তুই দিলে পরবে।’

‘কী ড্রেস এনেছিস, শাড়ি?’

‘না, গাউন। ওকে গাউনে সুন্দর লাগবে।’

‘বাট গাউন ফাউন তো তরী পরবে না। ওর অভ্যাস নেই।’

‘তুই যার পিছনে লেগে আছিস, সে গাউন কেন একদিন ওয়েস্টার্নও পরবে।’

‘মানে, আমাকে অপমান করলি!’

সেদিন রোশান স্যারকে নিয়ে মৃন্ময়ের নিয়ে আসা কেক, ড্রেস, শ্যাম্পু নিয়ে গিয়েছিলাম।তরী ছোঁয়াকেও ফোন দিয়েছিল। ওই মুহূর্তে তরীকে দেওয়ার মতো কোনো উপহার ছোঁয়ার কাছে ছিল না। তবে মন থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব। ছোঁয়ার পায়ে ছিল রুপার অঙ্গুটি আর নূপুর। ছোঁয়া তরীর হাত ধরে বলেছিল,
‘জানো তরী, আমার এক জীবনের যত ঋণ তোমার কাছে! আমার কোনো বোন নেই। সারাহ ছাড়া আর কোনো মেয়ে নেই যে আমার বোনের মতো। তবে তুমি যদি চাও আমাকে তোমার বোন ভাবতে পারো। যে ক্ষতি আমি তোমার করেছি, বোনের দাবি করতেও আমার সাহসে কুলায় না।’

‘আপনি তো আমার বোন আপু।’

‘তাহলে বোনের ব্যবহৃত জিনিস নিবে তুমি?’

‘কেন নিব না।’

ছোঁয়া ওর পায়ের নূপুর জোড়া খুলে তরীর পায়ে পরিয়ে দিল। সাথে একটা অঙ্গুটও।

কিছু মুহূর্ত থাকে না ভীষণ ভালোবাসাময়, ভীষণ সুন্দর, চোখ জোড়ানো মতো দৃশ্য। সব ভালোবাসাতে প্রেমিক-প্রেমিকা লাগে না। কিছু ভালোবাসা কোনো সম্পর্ক ছাড়াই সুন্দর। আসলে সব সম্পর্কে র**ক্তে*র টান লাগে না। আত্মিক একটা টানও লাগে। তরী আর ছোঁয়া সেই ভালবাসার অন্যতম এক নিদর্শন। ওদের মাঝে অনেক বিবাদ হতে পারত। ওশানকে পাওয়ার জন্য একে অন্যর দোষ দিতে পারত। রেষারেষি করতে পারত।ম্যাক্সিমাম কিন্তু এমনটাই হয়। একটা ছেলে যখন দুটো মেয়ের সাথে গেম খেলে তখন মেয়ে দুইটা নিজেরা অশান্তি করে; অথচ ছেলেটার কোনো দোষই দেয় না। মাঝখানে ছেলেটা দুই নৌকায় পা দিয়ে চলে জিতে যায়। কিন্তু ছোঁয়া আর তরী এর ব্যতিক্রম। দুজনেই বুঝতে সক্ষম হয়েছে— এখানে ওদের দুজনের কোনো দোষ নেই। দোষটা যে গেইম খেলেছে তার। তারা দু’জনই তো ভুক্তভোগী। দু’জন নারীই একটি মাত্র পুরুষের দ্বারা প্রতারিত হয়েছে। তাই দুজনই ওশানকে ছেড়ে দিয়েছে। দুজন-দুজনের কষ্ট বুঝেছে। এটাই ছিল ওশানের জন্য উপযুক্ত শাস্তি। প্রতিটা মানুষেরই এমন করা উচিত। আসলে আমরা যাকে ভালোবাসি তাকে সব সময় ফেরেশতা মনে করি। তাকে ভালবেসে এতই অন্ধ হয়ে থাকি যে তার দোষ-ত্রুটি খুঁজি না।তার সাথে জড়িয়ে যাওয়া তৃতীয় পক্ষকেই দোষারোপ করে থাকি; অথচ এটা ভাবি না যে, ওই তৃতীয় পক্ষকে যে প্রশ্রয় দিয়েছে তার দোষটা কতখানি। নিজেদেরকে এটা বলে শান্তনা দিয়ে থাকি ফাঁদে পড়ে এমন করেছে, মানুষ মাত্রই ভুল করে, শয়তানের প্ররোচনায় এমন করেছে। পরকীয়ার মতো জঘন্য কাজের জন্য কোনো সাফাই চলে কি না জানা নেই। আমার মনে হয় এমন গর্হিত কাজ আর নেই।একমাত্র চরিত্রহীন ব্যক্তিই পারে এসব করতে। আমার মনে হয় অবশ্যই প্রতিটা পুরুষের নিজের জীবনসঙ্গীনীর প্রতি একটু বেশি কেয়ারিং হওয়া উচিত, একটু বেশি ভালোবাসা এবং যত্নশীল হওয়া উচিত। হালাল আর পবিত্র সম্পর্কের যত্ন নেওয়া উচিত। যে সময়টুকু পরনারীতে দেওয়া হয় ওই সময়টুকু নিজের ওয়াইফকে দিলে তাতে দুজনের জীবনই সুন্দর হয়। এতে মহান সৃষ্টিকর্তাও খুশি হন। হারামে কখনোই আরাম নেই। তাই ভালবাসার পবিত্রতা রক্ষা করে চলে উচিত। আর যে নারী বা পুরুষ জেনে বুঝে অন্যর সংসারে তৃতীয় পক্ষ হিসাবে ঢোকে, এরা না পায় ইহকালের সুখ না পাবে পরকালে শান্তি। ছোঁয়া আর তরী এমনই একটি সম্পর্কের জলন্ত উদাহরণ।ব্যতিক্রম দুটো চরিত্রের উদাহরণ। ছোঁয়ার মতো প্রতিটা মেয়েই সব সত্য জেনে সরে আসুক এমন জঘন্য সম্পর্ক থেকে। তরীর মতো মেয়েদের কেউ না কেউ সাহায্য করুক সুন্দর একটা জীবনে উপহার দেওয়ার জন্য।তবেই না পৃথিবীটা সুন্দর হবে। বেঁচে থাকবে ভালোবাসা।

তরী আজ মৃন্ময়ের দেওয়া সেই পোশাক পরেই আমাদের ঘর সাজাচ্ছে। ঘরে আর কেউ নেই। মৃন্ময় ধীর পায়ে আমাদের রুমে প্রবেশ করল। মৃন্ময়ের চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওর দু’চোখ জুড়ে তরীকে দেখার আকাঙ্ক্ষা-পীপাসা। মুগ্ধ নয়নে উপভোগ করছে তরীর সৌন্দর্য। মৃন্ময় যেন কেমন অন্য জগতে প্রবেশ করে ফেলছে। মৃন্ময় তরীর সামনে দাঁড়িয়ে অবাক করা চোখে তাকিয়ে আছে। তরী মৃন্ময়ের এই চাহনির কারণ খুঁজে পেল না। মৃন্ময় একটা সাদা পাথরের টিপ তরীর কপালে পরিয়ে দিয়ে বলল, ‘অদ্ভুত সুন্দর দেখতে তুমি! যেন কোনো অপ্সরী!’

তরীর কৌতুহল চাহনিতে তাকিয়ে আছে মৃন্ময়ের দিকে।

মৃন্ময় আবারও বলল, ‘অদ্ভুত সুন্দর তোমার চোখ। এই চোখে আমার সর্বনাশ দেখেছিলাম বহুকাল আগে। সেই সর্বনাশা দশা থেকে আমি আজও মুক্তি পাইনি; আর বোধহয় পাব না।’

তরী বেশ ঘাবড়ে গেল মৃন্ময়ের কথা শুনে।মৃন্ময়কে বলল,
‘এসব কী অদ্ভুত কথা বলছেন আপনি!’

মৃন্ময় তরীর হাত ধরল। হাতের মধ্যে একটা কাগজ দিয়ে বলল, ‘চাইলেই সব কিছু মুখের উপর বলা যায় না। অনেক বছরের আবেগ-অনুভূতি মেশানো আছে এই কাগজে, আশা করি পড়লেই বুঝতে পারবে।’

‘আপনি এসব কী বলছেন? আমি সত্যি বুঝতে পারছি না।’

মৃন্ময় তরীর চুলে হাত বুলিয়ে দিল, দুই গালে দুই হাত রেখে কিছুটা এগিয়ে গেল তরীর দিকে। কেমন একটা কম্পিত স্বরে বলল,
‘ তোমার প্রেমের সুধা দিয়ে আমার তৃষ্ণার্ত হৃদয়কে শীতল করবে ?’

তরী কী ভাবল জানি না। হঠাৎ ওর চোখ-মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

মৃন্ময়ের গালে থা*প্প*ড় মেরে বলল, ‘এভাবে গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন? কী ভেবেছেন, আমি ডিভোর্সি বলে সেই সুযোগ নিবেন? দুই দিন ভালো ভাবে কথা বলেছি বলে আমাকে স্পর্শ করে কথা বলবেন? এতটা প্রশ্রয় কি আমি আপনাকে দিয়েছি? পুরুষের স্পর্শে আমার শরীর ঘিনঘিন করে। আমি সহ্য করতে পারি না কোনো পুরুষের স্পর্শ। আপনি কোন সাহসে আমার মুখে হাত দিচ্ছেন? এসব বলে বলে আমাকে পটাতে চাচ্ছেন, তারপর ফায়দা উঠাবেন? পরীক্ষা করছেন, আমার দিক থেকে কেমন রেসপন্স পান? ছিঃ! আপনাকে আমি ভালো ছেলে ভেবেছিলাম। পৃথিবীর সব পুরুষ মানুষই একই রকম। সবার কি ওই একই উদ্দেশ্য থাকে, একটা মেয়েকে পটানো?’

‘তুমি ভুল বুঝছ। আই অ্যাম স্যরি, তোমাকে স্পর্শ করার জন্য।’

‘কী ভুল বুঝছি?’

‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই, পটাতে নয়।’

‘বিয়ে? পা*গ*ল পেয়েছেন আমাকে? একটা ডিভোর্সি মেয়েকে এমন একটা সুদর্শন ছেলে বিয়ে করবে! বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে শরীর চান, তাই না?’

মৃন্ময় রে’গে গিয়ে হাত উঁচু করল; কিন্তু হাত উঠাল না তরীর গায়ে। তরীর দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলল, ‘পৃথিবীর সব পুরুষকে সমান ভাবছ?’

তরী মৃন্ময়কে ধাক্কা মেরে বলল, ‘আবার আমাকে স্পর্শ করেছেন! আমার হাতে এসব কীসের কাগজ দিয়েছেন? কেন দিয়েছেন? আমি এই পৃথিবীর কোনো ছেলেকে বিশ্বাস করি না। আর ভালোবাসাও বিশ্বাস করি না। ফিলোফোবিয়া আছে আমার। আর কখনো আমার সাথে এরূপ আচরণ করবেন না।আমি আপনাদের দোকানেও আর কোনো গহনা দিব না।’

মৃন্ময় কোনো কথা না বলে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে।

চলবে?