একদিন নববর্ষা -৩৬
অদ্রিজা আশয়ারী
___________
বেণীমাধব, বেণীমাধব, এতদিনের পরে-
সত্যি বলো, সে সব কথা এখনো মনে পড়ে?
সে সব কথা বলেছো তুমি তোমার প্রেমিকাকে?
আমি কেবল একটি দিন তোমার পাশে তাকে
দেখেছিলাম আলোর নীচে; অপূর্ব সে আলো!
স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো
জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার, পুড়িয়ে দিলো চোখ
বাড়িতে এসে বলেছিলাম, ওদের ভালো হোক।
রাতে এখন ঘুমাতে যাই একতলার ঘরে
মেঝের উপর বিছানা পাতা, জ্যোৎস্না এসে পড়ে
তবু আগুন, বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই?
কেমন হবে, আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই?
-জয় গোস্বামী।
———-
কিছু আঘাতের আগমণ জীবনে এমন অপ্রত্যাশিত, যে সে আঘাতের রেশটুকুই জীবনচক্রের সকল স্বাভাবিকতাকে থামিয়ে দিতে যথেষ্ট। থমকে গেছে বর্ষার জীবনচক্রও। একটি কলরব’ময় বিকেলে, দোকানের সেই অভিশপ্ত কাঁচের বাইরে চোখ ফেলার পর থেকে। চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে ওর অন্তঃকরণ। কিন্তু এইবার হৃদয় ভাঙ্গার আর্তনাদ কারো কান অব্ধি পৌছাঁনোর আগেই নিজেকে সামলে নিয়েছে বর্ষা। খেপাটে মাথার মেয়েটি এবার আর কোনো পাগলামি করেনি। বরং বড় বেশি শব্দহীন হয়ে গেছে।
বাড়ি ফিরে বর্ষা শুধু ভেবেছে এরপর কি অপেক্ষা করছে ওর জন্য? নাব্য আর কতবার সারপ্রাইজ দেবে ওকে? এতো চমকের ভার যে ওর ভঙ্গুর হৃদয় বইতে পারছেনা আর! চিরকাল একেবারে ঘটনা বিহীন, নির্জীব জীবন ছিল ওর। সে জীবন বড় বেশি পাসনে লাগত বর্ষার কাছে একসময়। মাঝে মাঝে আকাশের পানে চেয়ে, খুব সঙ্গোপণে সে কিছু একটা অভিযোগ করত রবের কাছে।
বোধহয় জীবনে একটু রংধনু ছড়ানোর আবদার ছিল সেসব। রব কিছুটা বিলম্বে হলেও,, তার সেসকল আবদার কবুল করে নিয়েছেন। কিন্তু বর্ষার আবদার চাওয়ার প্রক্রিয়ায় কিছু ভুল ছিল নিশ্চয়ই! সেজন্যই বুঝি আজ ওর ছোট্ট জীবনে একের পর এক শিহরণ জাগানিয়া ব্যাপার ঘটছে!
নাহ! আজ ওর জীবনে সত্যিই আর রঙের কোনো অভাব নেই। এতো রঙ! যে বর্ষার চোখে ধাঁধা লেগে যায় একেক সময়!
সেদিন সন্ধ্যায় বেবি শপ থেকে ফেরার পর বর্ষার আচরণ কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে গেল। ওর চোখের শীতলতা, অন্তরের অনেকটুকু আসঞ্জন যাকে ঘিরে। সেই নাব্যকে ওর প্রাত্তন প্রেমিকার সঙ্গে দেখেও একফোঁটা চোখের জল ফেললো না সে।
মনের সামান্যতম অস্থিরতায় সিজদায় পড়ে, চোখের জল ছেড়ে, মনের স্থিরতার জন্য দু’আ করত যে সবসময়। আজ সে, এতো বড় ব্যাপারের পরও সিজদায় গিয়ে একটুও কাঁদল না।
এশার আযান শুনে যখন হঠাৎ ওর ঘুম ভাঙল, নিজেকে সে আবিষ্কার করল জায়নামাজে। সিজদার মতো করে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। মাগরিবের সালাত কি পুরোপুরি শেষ করেছিল কিনা সেটাও মনে পড়ল না। একটা ঘোরের মধ্যে থেকেই বর্ষা আবার উঠে ওযু করে এলো।
কিছুটা হ্যালুসিনেশান হচ্ছে বোধহয় বর্ষার। বিভিন্ন সময়ের খাপছাড়া স্মৃতি বাস্তব রূপ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখ মেললেই বর্ষা দেখতে পারছে সেসব। ঘোর লাগা মস্তিষ্কে পুরো ব্যাপারটাকেই বাস্তব মনে হচ্ছে। আতঙ্কে হাত পা জমে গেল ওর। প্রায় টলতে টলতে এশার সালাত শেষ করল, ওভাবেই স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে। প্রতিবার সিজদায় যাবার সময় ওর মনে হচ্ছিল, এটাই বোধহয় জীবনের শেষ সিজদাহ্! আর উঠতে পারবে না সে।
‘আল্লাহ আমাকে সালাত টা শেষ করার তৌফিক দাও।’ মনে মনে শুধু এই দু’আ করতে করতে বর্ষা কোনোরকমে সালাত শেষ করল। আর একটি পদক্ষেপ ফেলার মতো শক্তি অবশিষ্ট রইল না ওর দেহে। বর্ষা সেখানেই, জায়নামাযে ঘুমে তলিয়ে গেল ফের।
___________
দুঃখেরা আসে এক এক করে। কখনো হয়না ওদের দেরি। ওরা জানে না পথ ভুলতে। তাই যার জীবনকে একবার দুঃখ নিজের গন্তব্য স্থির করে নেয়, তার জীবনে সমাপ্তির ঘন্টা বাজবার আগ পর্যন্ত ওরা নিরস্ত হয় না।
এবারে দুঃখদের নির্নিমিখ গন্তব্য যেন বর্ষা নামের সরল, অপ্রগলভ মেয়েটিকে ঘিরেই….।
অথচ! দু;খের এই জটিল ঘন সন্নিবেশ ওর স্বচ্ছ জীবনে, এতো প্রখর ভাবে প্রতিফলিত হতে পারে তা ভেবেছিল কেউ কোনোদিন?
খবর টা এলো বিকেলে। রাফিয়া সালাত শেষে শাশুড়ী মায়ের ঘরে গিয়ে বসেছিলেন। বৌ-শাশুড়িতে আলাপ হচ্ছিল সংসারের একেবারে মেয়েলি ব্যাপার গুলো নিয়ে। নাব্য-নিতিনের প্রিয় দাদি বার্ধক্যের শেষ পর্যায়ে পৌছালেও এখনো যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন সব ব্যাপারে।
সহসাই বেজে উঠল রাফিয়ার হাতে থাকা ফোন। আজকাল তিনি কাছের জিনিস ঝাপসা দেখেন। ফোনটি তাই একটু দূরে সরিয়ে, ওপরের নাম পড়ার চেষ্টা করলেন। ওপরে লিখা Unknown number…
রাফিয়া ভ্রু কুঁচকে ফোন কানে তুললেন।
–‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। কে…?’
রাফিয়ার কথার পৃষ্ঠে ওপাশ থেকে বেশ অনেকগুলো উত্তর এলো। রাফিয়ার মুখটা মলিন হয়ে এলো একসময়।
দাদি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলেন।
–‘আচ্ছা, আসছি আমরা এক্ষুনি।’ বলে ফোন রাখতেই দাদি বললেন,
–‘কেডা রাফু? কি কইল যে তুমি শুইনা এহনি যাইবার লাগছো?’
রাফিয়া ফ্যাকাসে মুখে শাশুড়ীর দিকে ফিরলেন। সে দৃষ্টি দেখা মাত্র দাদি বুঝলেন গুরুতর বাজে কিছু ঘটেছে।
বর্ষার দিনকাল ভয়ানক খারাপ যাচ্ছে সেকথা বলাই বাহুল্য। মনের শান্তির জন্য প্রচন্ড অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও সন্ধ্যায় কুরআন নিয়ে বসলো সে। খুব ধীরে, যত্ন করে একটি একটি করে আয়াত পড়তে লাগলো অর্থ সহ।
কুরআন’কে কেউ অন্তর দিয়ে অনুভব করবে আর তার চোখে জল আসবে না এমন হতেই পারে না! বর্ষাও বোধহয় সত্যিই অনুভব করছিল সেসময়, কুরআন’এ বর্ণিত মহিমান্বিত রবের প্রত্যেকটি আয়াত কে। কারণ তার চোখ জলে পূর্ণ ছিল।
কোনো রকম পূর্বাভাস না দিয়ে আচমকা নিতিন ঘরে চলে এলো। কুরআন পড়ে বর্ষাকে কাঁদতে দেখে আজ সে কোনো প্রশ্ন তুললো না। তবে বর্ষা ঠিকই লজ্জা পেল। এবং সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছে ফেললো।
নিতিন তখনো স্থির দাঁড়িয়ে বর্ষাকে দেখছিল নিঃশব্দে। ওর চোখের কোণেও জল চিকচিক করছিল কোনো এক অজানা কারণে। বর্ষাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে একটু কাঁদবার বাসনা জাগছিল কেন যেন হঠাৎ। কিন্তু নিতিন নিজের এই অবাধ্য আবেগকে রুখতে বাধ্য হলো। কয়েক পা এগিয়ে বর্ষার বাহু চেপে ধরে স্তিমিত গলায় বলল,
–‘ভাবি, বোরকা পড়ে নাও। আমরা একটু বাইরে বেরুবো এখন। ‘
অবাক বর্ষাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না সে। নিজে গিয়ে আলমিরা থেকে বর্ষার বোরকা বের করে আনলো। তাড়া দিল দ্রুত পড়ে ফেলার জন্য।
বর্ষা কিছু বুঝতে পারছিল না। তবে খুব বেশি কিছু বললো না সে। আজকাল কথার পিঠে কথা আসে না ওর। চুপ থাকতেই ভালো লাগে। তাই নিতিনের কথা নিঃশব্দে মেনে নিয়ে তৈরি হয়ে গেল।
রিনা এবং আরও একজন মধ্যবয়সী গৃহকর্মীর দায়িত্বে দাদিকে রেখে ওরা তিনজন বেরিয়ে পড়ল। বর্ষার কাছে সবটা অদ্ভুত ঠেকছিল। এভাবে নিজ শাশুড়ী ও ননদের সঙ্গে একসাথে এর আগে কোথাও বেরোনোর সুযোগ হয়নি ওর। কোথায় যাচ্ছে সেটাও জানে না। রাফিয়া বরাবরই গম্ভীর। আজ একটু বেশিই। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা তো বহুদূর, তাকে সামনে রেখে নিতিনকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও বর্ষার ইতস্তত লাগছে।
মাগরিব পড়ে বেরিয়েছিল ওরা। নগরী ক্রমেই রাত্রির তমসায় আচ্ছন্ন হয়ে এল। হঠাৎ, একদম অকস্মাৎ বর্ষা খেয়াল করল গাড়িটা সাভারে, ওর বাবার বাড়ির দিকে যাচ্ছে। বাইরে অন্ধকার, তাই অতশত খেয়াল করেনি এতক্ষণ। সে দ্রুত পাশ ফিরল। নিতিনের হাত চেপে ধরল প্রবল ভাবে।
–‘নিতিন। কোথায় যাচ্ছি আমরা? সাভারে কার কাছে যাচ্ছি?’
নিতিনের ঠোঁট কেঁপে উঠল। তবুও শব্দ বেরুলো না। অজানা একটা আতঙ্ক ইতোমধ্যে বর্ষার মনে বিস্তার লাভ করেছে। ওর অস্থিরতা দেখে রাফিয়া বরাবরের মতো গম্ভীর মুখে বললেন,
–‘ তোমার বাবার বাড়িতেই যাচ্ছি আমরা। ‘
–‘কিন্তু কেন? এভাবে…. এভাবে হঠাৎ কিসের জন্য? কি হয়েছে? আমাকে কেউ কিছু বলছেন না কেন? আমি ভাইয়াকে ফোন করছি এক্ষুনি।’ ফোন খুঁজে না পেয়ে বর্ষা আরও অস্থির হয়ে উঠল।
–‘ফোন কোথায় গেল? নিতিন আমার…’
–‘ ফোনের ব্যাটারি ডাউন ছিল। তাই বন্ধ করে দিয়েছে ভাবি। তুমি এতো অস্থির হয়ো না। আমরা প্রায় চলে এসেছি।’
আর স্থির! বর্ষার হৃৎপিণ্ড পাকস্থলীর ভেতর সেঁদিয়ে যেতে লাগল আশংকায়, অস্থিরতায়। সে বুঝে গেছে এরা কেউ বলবে না কি ঘটেছে। তবে নিশ্চয়ই ভয়ংকর বাজে কিছু ঘটেছে।
ওর ভাই-ভাবির বাচ্চাটা…..বাচ্চাটার কিছু হয়নি তো? এমন ছোট বাচ্চাদের তো কত কিছু হয়! এত নাজুক প্রাণ। কত অল্পতেই ঝরে যায় ওরা… বাচ্চাটার যদি সত্যিই কিছু হয়ে থাকে তাহলে ওকে আগে থেকে কেউ কিছু জানালো না কেন? সত্যিই বাচ্চাটারই কিছু হয়েছে নাকি অন্যকারো। বাবা, মা, ভাই, ভাবি…. ওদের প্রত্যেককে নিয়েই বর্ষার আশংকা হচ্ছে। বর্ষার ভেতর টা তড়পাচ্ছিল যন্ত্রণায়। কিন্তু সে কাঁদতে পারছিল না। সেদিন বিকেলের পর থেকে ওর চোখের সকল অশ্রুরা যেন চিরতরে ওকে ছেড়ে গেছে। তারপর থেকে প্রতি পলে পলে বর্ষা বুঝতে পারছে। কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে না পারার যন্ত্রণা কতখানি!
আগের বারের মতোই গলির মুখে, বর্ষাদের বাড়ি থেকে প্রায় অনেকটা দূরে গাড়ি থামল। এর বেশি যাবার ক্ষমতা নেই বিশাল গাড়িটির এই সরু গলির মধ্যে দিয়ে।
আতঙ্কে জমে, কম্পিত পায়ে গলিটা পেরিয়ে, ওদের মধ্যবিত্ত বাড়ির দরজায় পৌছে বর্ষা আরেকটা ধা-ক্কা খেল।
নাব্য দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে রশু। ওদের দুজনের মুখ থমথমে। সামনে দৃষ্টি ভিড়তেই বর্ষা বুঝে গেল কি ঘটেছে। সাত আসমানের ওপর থেকে নেমে, মালাকুল মউত আজ একবার ঘুরে গেছিল ওদের বাড়ি। কারণ উঠোনে খাটিয়ায় একটি সাদা কাফনের অংশ বাতাসে কাঁপছে তিরতির করে। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরিয়ে রাস্তার ওপর পড়ে গেল বর্ষা।
চলবে…..
একদিন নববর্ষা -৩৭
অদ্রিজা আশআরী
__________
এমন মুহুর্তও কখনো জীবনে আসে। যখন কঠিন সময়ে, পরিস্থিতি আমাদের সুখ দুঃখ অনুভবের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে দূর থেকে দাঁড়িয়ে উপহাস করে। বর্ষার জীবনে আজ সেই ক্ষণ উপস্থিত। রুপকথার গল্পে জলজ্যান্ত মানুষ যেমন দৈব অভিশাপে পাথরে পরিনত হয়। আজকের এই রূঢ় বাস্তববাদী সময়ে বর্ষাও যেন তাই হয়ে গেল। জলোচ্ছ্বাসের ন্যায় একের পর এক হানতে থাকা আঘাতের শেষ আক্র-মণ টা ওকে একেবারে জড় পদার্থের মতো নিশ্চল করে দিল।
রাত বাড়ল। দূর দূরান্ত থেকে আসা আত্মীয়েরা রাত্রিটা কাটাবার মতো একটা আশ্রয় খুঁজে নিয়ে গুম হলো যে যার মতো। কোলাহল থেমে গেল। উঠোনের মাঝখানে খাটিয়ায় পড়ে রইল বর্ষার মৃত বাবার লাশ। অদূরে, চৌকাঠের সিড়ির ধাপে, মূঢ়ের মতো বসে রইল বর্ষা।
কান্নারও ক্লান্তি আছে। সেই ক্লান্তি নিষ্পেষিত করেছিল সকলকে। রাত্রি গাঢ় হতেই, তাই শোক’কে মুলতবি রেখে বাড়ির সকলে ঘুমে আচ্ছন্ন হলো।
এই মাঝ রাত্তিরে এভাবে একা বর্ষার উঠোনে বসে থাকা নিয়ে আজ কারো কোনো মাথা ব্যাথা রইল না।
মধ্য রাত্রির নিস্তব্ধতায়, বৃহৎ আম গাছটির নিচে, ওদের মধ্যবিত্ত বাড়ির চৌকাঠ শেষ হয়েছে যেখানে। শুরু হয়েছে কয়েক ধাপ বিশিষ্ট সিড়ি। সেখানে অবিন্যস্ত খোলা চুল, আটপৌরে ছাইরঙা শাড়ি পরিহিত, বিষাদ ক্লিষ্ট অস্বাভাবিক মুখাবয়ব নিয়ে বসে রইল বর্ষা। ওকে ঠিক সাধারণ মানবী মনে হচ্ছিল না।
মধ্য রাত্রির হিম শীতল বাতাসে ভেসে আসছিল আগরবাতির ঘ্রাণ। তখনো খাটিয়ায় ওর মৃত বাবার গায়ে পেচানো কাফনের কাপড় তিরতির করে কাঁপছে। বর্ষা গভীর মনোযোগে সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছিল বোধহীন যন্ত্রের ন্যায়। ওকে দেখাচ্ছিল অশরীরির মতো। দূর থেকে দেখলে যে কারো হৃদ স্পন্দন থমকে দিতে যথেষ্ট ছিল সে ছবি।
বর্ষার চোখে জল নেই। কাঁদেনি সে একটি বারের জন্যও। নেত্রমল বহু আগেই শুকিয়ে গেছে। অন্যসকল আঘাতের পাশাপাশি এ হলো তার উপরি পাওনা!
সন্ধ্যা রাতে উঠোনে লাশ দেখে যখন বর্ষা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিল, তখনো ওর জানা ছিলনা কাকে হারিয়েছে সে। মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়তেই ওকে ঘিরে একটা কোলাহল বাধল। নাসিমার কানে কেউ একজন পৌঁছে দিল মেয়ের আসার খবর। তিনি ছুটে এলেন। শরীরের এমন নাজুক অবস্থার ওপর সংজ্ঞাহীন হয়ে অকস্মাৎ এভাবে পড়ে যাওয়ায়, মুহুর্তে উপস্থিত সকলের চিন্তার মোড় ঘুরে গেল বর্ষার দিকে। কিছু সময়ের জন্য ওরা ভুলে গেল উঠোনে পড়ে থাকা মৃত দেহটির কথা।
নাব্য নিতিন আর নাসিমা বর্ষাকে ঘিরে বসল। ওকে ডেকে চলল অবিরত। মুহুর্তে চিৎকার, হট্টগোলে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠল। বর্ষার দেহ দ্রুত শিথিল হয়ে আসছে। হাত পায়ে টান ধরেছে ইতোমধ্যে। ওরা বুঝল বর্ষার খিঁচুনি উঠছে। সবে মাত্র একজন মারা গেছে। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর অদৃশ্য গন্ধ তখনো চারদিক জুড়ে। এর মাঝে বর্ষার বর্তমান অবস্থা দেখে ওরা স্বাভাবিক বুদ্ধি হারিয়ে বিহ্বল হয়ে পড়ল।
রাফিয়া তখনো হুশ হারান নি। ছেলেকে বললেন বর্ষাকে জলদি ভেতরে নিয়ে যেতে। এমন শীতল রাত্রিতে এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকলে অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটবে। নাব্য ওকে তুলে ভেতরে নিয়ে গেল।
চারিদিকে রোনাজারির কাতর নিনাদ। তন্দ্রাঘোরে বর্ষা সব শুনছিল। বাবা আর নেই! এই ব্যাপার টা বুঝতে ওর খুব বেশি সময় প্রয়োজন হলো না। ওকে ঘিরে বসে থাকা ত্রাসিত মুখ গুলোকে আরও উদ্ধিগ্ন করে, একেবারে অকস্মাৎ চোখ মেলে উঠে বসলো শোয়া থেকে। নাসিমা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেয়ার জন্য কাছে এগিয়ে এলেন। বর্ষা মাকে সম্পুর্ন রূপে উপেক্ষা করে বিছানা থেকে নামতে উদ্যত হলো। কারো বাঁধাই মানলো না। শাড়ির ওপর বড় ওড়না জড়িয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। বাইরে বর্ষার ভাই সোহাগের সঙ্গে নাব্য দাঁড়িয়ে ছিল। অদূরেই রাখা আছে লাশটি। লাশকে কেন্দ্র করে তখনো মানুষের ভীড়।
‘ ওইযে সাদা কাফন জড়িয়ে যে লোকটি শুয়ে আছে। সে লোকটি জীবিত থাকতে বড় নিরীহ ছিল। চিরকাল অন্যের ভয়ে ভয়ে জীবন টা কাটিয়ে দিল। মানুষ হিসেবেও ছিল বেশ অমায়িক….’ আরও কত কথা বলে চলল লোকে।
বোনকে এভাবে হঠাৎ বের হয়ে আসতে দেখে, আর পেছন পেছন নাসিমার উৎকণ্ঠিত গলা শুনে, সোহাগ লাশ ঘিরে থাকা লোক গুলোকে একটু সরে যেতে অনুরোধ করল। কিঞ্চিৎ সময়ের মধ্যে উঠোন ফাঁকা হয়ে এল। বর্ষা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ওর চিরনিদ্রায় শায়িত বাবার দিকে। নাসিমা পেছন পেছন যাচ্ছিলেন। সোহাগ মাকে রুখল।
চারপাশের জটলা কমে, ক্রমেই স্থানটা মনস্য বিহীন হয়ে এসেছে বুঝতে পেরে বর্ষা মাথার অবগুণ্ঠন একটু আলগা করল। মুখটা দৃশ্যতঃ হলো ওর। সে হাটু মুড়ে বসল বাবার মাথার কাছে। কম্পিত হাতে বাবার মুখের ওপর থেকে কাফন টা সরিয়ে দিল। বিদ্যুৎ খেলে গেল ওর সারা গায়ে। বর্ষা অকম্পিত, শীতল ফিসফিস স্বরে ডাকল,
–‘আব্বা…’
ক্রমশ চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে এলো ওর। মৃদু টলছে বুঝতে পেরে খাটিয়ার হাতল চেপে ধরল সে। অবাক হয়ে খেয়াল করল জীবনের এই ভয়ংকরতম মুহুর্তে এসে আজ একফোঁটা জল জমেনি ওর চোখে। কি পাষাণ হয়ে গেছে হৃদয়!
আবারও বাবাকে সম্মোধন করে ডাকল সে।
–‘আব্বা.. আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লহ। আপনার ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক।’ নিজ অন্তরকে খানিক শান্ত করবার জন্যই যেন সালামের অর্থটা শব্দ করে উচ্চারণ করল সে।
–‘আমি সুধারণা রাখি আপনি ওপারে ভালো থাকবেন। আমার মহান রব, আল-গফ্ফার আপনার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র সৎকাজ গুলোকে অসিলা করে, আপনাকে তাঁর নৈকট্য অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করে নিক। আমিন।
আপনার ভালো সন্তান হতে পেরেছি কিনা, আজ থেকে তার পরীক্ষা শুরু। আমি চেষ্টা করবো আমার সামান্য আমলের দ্বারা আপনার জন্য রবের রহমত প্রাপ্তির পথ সহজ করতে। আপনি আমাকে ভুলে যাবেন না। আমাদের আবার দেখা হবে। ইন শা আল্লাহ জান্নাতে।’
কথা শেষ করে বর্ষা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। দীর্ঘ সময় ধরে…
নাসিমা দূরে দাঁড়িয়ে ছেলের বুকে মাথা রেখে চাপা স্বরে কাঁদছিলেন। কিছুক্ষণ পর বর্ষার পাশে এসে হাটু গেড়ে বসল নাব্য। হাত রাখল বর্ষার হাতের ওপর।
-‘ভেতরে চলো। ‘
বর্ষা বিনা বাক্য ব্যায়ে উঠে দাঁড়ালো নাব্যর সাহায্য নিয়ে। চলে যেতে গিয়ে শেষ মুহুর্তে উবু হয়ে বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
-‘বহুবার বলতে চেয়েও একটা কথা আপনাকে কখনো বলা হয়ে ওঠেনি। আমি আপনাকে ভালোবাসি আব্বা। অনেক ভালোবাসি। এপাড়ে আর কোনোদিন আমাদের দেখা হবে না। আপনি ওপারে অপেক্ষায় থাকবেন। আমি আসব।’
_____________
বাবা মারা যাবার পর থেকে এবাড়িতেই থাকতে শুরু করল বর্ষা। নাসিমা মনে মনে খুশি হলেন। মেয়েকে নিজের কাছে রাখার একটা সুযোগ না চাইতেই পাওয়া গেছে। ঘন ঘন বাপের বাড়ি যাওয়া রাফিয়া অপছন্দ করতেন। ক্ষমতাবান বেহানের কথার বিপরীতে নাসিমার ও কিছু বলার থাকতো না। তবে এবার রাফিয়া ছাড় দিয়েছেন। তিনি নিজেই আজকাল নাব্যর সঙ্গে ঘনঘন ধানমন্ডি থেকে সাভারে আসা-যাওয়া করছেন। যদিও কিছুদিন যেতেই নিজে আসাটা কমিয়ে দিলেন। তবে শাশুড়ীর তাড়নায় ছেলেকে মাঝেমধ্যে পাঠান এখনো।
বর্ষার পরিবারের সকলে শোকাভিভূত ভাবটা ক্রমেই কাটিয়ে উঠছে। নাব্য এলে যথেষ্ট সচেষ্ট থাকেন নাসিমা। আধঘন্টার জন্য এলেও আদর আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখেন না৷ ফাবিহা আর সোহাগও সদা সতর্ক। এদের মাঝে একমাত্র বর্ষাই সবচেয়ে বিকারহীন। অনেককাল ধরে এবাড়িতে ওর জন্য নির্ধারিত, একটি ছোট্ট কুঠুরিতে সে বসে থাকে সারাক্ষণ। সালাত, জিকির আর কুরআন পাঠে সময় কেটে যায় ওর। কারো সঙ্গে বাড়তি কথা বলে না। মাঝে মাঝে ভাতিজাকে কোলে নিয়ে চোখের ইশারায় খেলা করে। নাব্য এলেও বিন্দুমাত্র অবস্থার পরিবর্তন হয়না। নাসিমা বলে বলে ক্লান্ত। তবে জোর করতে পারেন না। পিতৃশোকে কাতর মেয়েকে কিছু বলতেও বাঁধে। তিনি এখনো বর্ষার এই নির্বিকার ভাবটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিচ্ছেন। ধরে নিয়েছেন অধিক শোকে বর্ষা অমন দায়সারা গোছের আচরণ করছে। কিছুদিন পেরুলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
স্বামীকে হারিয়ে, ব্যাথা ভুলবার জন্য কিছু একটা আঁকড়ে ধরার প্রয়োজন ছিল নাসিমার। তাই আজকাল সবটুকু মনোযোগ বর্ষার ওপর নিবদ্ধ করেছেন তিনি। এবং অনেকখানি সফলও হয়েছেন বলা যায়। মাস পেরুতে না পেরুতেই স্বামীর স্মৃতি ধূসর হতে শুরু করেছে মস্তিষ্কে। বর্ষাকে তিনি যে একেবারেই ভালোবাসেন না তা নয়। তবে নানার সংস্কারের বেড়াজালে পড়ে চিরকাল ছেলে সন্তানকে বড় করে দেখতে অভস্ত্য ছিল মন। বর্ষা যেমনই হোক, সোহাগের সঙ্গে ওর তুলনা চলে না। সোহাগ যদি তার আকাশের চাঁদ হয়, বর্ষা তবে কোনো নাম না জানা বহু দূরে অবস্থিত নক্ষত্র!
তার বয়সী অন্যসকল মহিলারা নিজেদের পোয়াতি মেয়ে ও তারপর নাতি নিয়ে আহ্লাদ, আনন্দের আতিশয্যে মেতে আছে দেখে একসময় নাসিমারও খুব ইচ্ছে জেগেছিল মেয়েকে নিজের কাছে রাখবেন। একটু আদর, আহ্লাদীও নাহয় করবেন। তাই অনেকটা ঝোঁক আর উত্তেজনার বসেই বর্ষাকে নিজের কাছে রাখার জন্য জোর করেছিলেন তিনি।
কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই বুঝতে পারলেন ফাবিহা বর্ষার এখানে পরে থাকাটাকে ভালো চোখে নিচ্ছে না। আজকাল কারণে অকারণে গাল ফোলাচ্ছে সে। সময়-সুযোগে দু কথা শুনিয়ে দিতেও ছাড়ছে না।
ফাবিহার ভাইয়ের বদৌলতে চাকরিতে সোহাগের প্রমশন হয়েছে। কয়েক ধাপে বেতন বেড়েছে ওর। ফাবিহা আর আগের সেই নিরীহ মেয়েটি নেই। আজকাল ওর কথাতেই চলে নাসিমার সাজানো সংসার। ফাবিহার দাপট বেড়েছে। সোহাগেরও মৌন সম্মতি আছে তাতে। নাসিমা সব বোঝেন। তিনি এ-ও জানেন ছেলের সংসারে খেয়ে-পরে বাঁচতে হলে তাকে ওদের মর্জিমতো চলতে হবে। ফাবিহাকে অখুশি রাখা চলবে না।
ফাবিহা আজকাল যেসব কথা নিয়ে খোটা দেয়, বি-রোধ বাঁধাতে চেষ্টা করে তার অন্যতম একটি হলো বর্ষার সঙ্গে নাব্যর দাম্পত্য সম্পর্ক। ফাবিহা বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলে যে ওদের দাম্পত্য জীবন নাকি বাকি দশজনের মতো স্বাভাবিক নয়। তাছাড়া সে আধুনিক মেয়ে। চোখ কান বুজে তো আর চলে না!
কত কথাই তো বাতাসে ভেসে বেড়ায়…… বিয়ের আগে নাব্যর একটি প্রেমিকা ছিল। যার জন্য নাব্য একপ্রকার উন্মাদ ছিল। কিন্তু শেষ সময়ে এসে মেয়েটি ওকে ধোঁকা দেয়। তার পরই নাকি বর্ষাকে বিয়ে করতে রাজি হয় নাব্য। তা নাহলে বর্ষাই বা কোনদিক থেকে নাব্যর স্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রাখে?
এইযে বর্ষা দিনের পর দিন এখানে পড়ে আছে। কই, একবার তো খোঁজ নেয়ারও প্রয়োজন মনে করে না নাব্য! প্রথম কিছুদিন এসে সৌজন্যতা দেখিয়েছিল। এই যা! ভালোবাসা থাকলে এমন কখনো হতে পারতো? নাব্য আসলে বর্ষাকে আর চায় না। সে সামর্থ্যবান পুরুষ। অর্থ, মেধা, সৌন্দর্য কোনোকিছুরই অভাব নেই। ও চাইলে বাঘা বাঘা লোকের মেয়েরা ওর দ্বিতীয় স্ত্রী হতে রাজি হয়ে যাবে অনায়েসে। বর্ষাকে ওর কি প্রয়োজন!
ফাবিহার এসব কথা শুনে নাসিমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তিনি অক্ষরজ্ঞানহীন গ্রাম্য মহিলা। এতসব জটিল জালে মেয়ের জীবন আটকা পড়েছে দুঃস্বপনেও সেকথা ভাবেননি।
ফাবিহার কথা শুনে তিনি দুচোখে অন্ধকার দেখলেন । ছোট কাল থেকে এই মেয়ে তাকে শুধু জ্বালা যন্ত্রণাই দিয়ে এসেছে। এখনো শিক্ষা হয়নি। আর কতকিছু সহ্য করবেন তিনি এই অপয়া মেয়ের জন্য কে জানে!
চলবে……ইন শা আল্লাহ।
একদিন নববর্ষা -৩৮
অদ্রিজা আশআরী
____________
আনকোরা হাতে নিতিন কেকের ব্যাটার তৈরি করছে। দুপুরের এই সময় টা বাড়ি একদম নিঝুম থাকে। মা, দাদি যে যার ঘরে ভাতঘুম দেয়। অন্যদিন এই সময় নিতিন নিজের ঘরে গল্পের বই পড়ে। রিনাকে ঠেলে রান্নাঘরে পাঠায় কফি বানিয়ে দেবার জন্য। আজ অবশ্যি পরিস্থিতি ভিন্ন। রিনা যেন হুট করে এখানে চলে না আসে সে ব্যাপারে কড়া নজর রাখছে নিতিন!
ব্যাটারে কোকো পাউডার মেশাতে মেশাতে নিতিন আনমনে হাসল। ঝলমলে হাস্যজ্বল ছেলে রাশিক। ভারি দুরন্তও বটে। নিতিন কে কখনো চুপ থাকতে দেয় না। সারাক্ষণ নানান কথার জালে হাসিতে মাতিয়ে রাখে। রাশিকের মাঝে অনন্য একটা প্রভাবক ক্ষমতা আছে। এটাই রাশিককে বাকি সবার থেকে আলাদা আর আকর্ষণীয় করেছে। কিছুক্ষণ ওর আশেপাশে থাকলে আফিমের মতো ওর কথাবার্তা মস্তিষ্কে আর মনে প্রভাব বিস্তার করে ফেলে। নিতিন বহু আগেই সেই আফিমের নেশায় আকণ্ঠ অবগাহন করেছে। শুরুটা স্কুলের সামনে ফুচকার ভেন থেকে। ওর প্রতি রাশিকের একটা বিশেষ অনুভূতি আছে সেটা ওরা বন্ধুরা সকলেই টের পেয়েছিল। বন্ধুদের প্ররোচনায় তারপর একদিন রাশিকের সঙ্গে কথাও হয়ে গেল। বিনিময় হলো ফোন নম্বর।
সদ্য পনেরোতে পা রাখা চঞ্চল কিশোরী নিতিন। চোখে রঙ্গিন চশমা থাকার সুখটা সবে উপভোগ করতে শুরু করেছে ওর ঝোড়ো মন! রঙ্গিন চশমায় দুনিয়ার সবকিছুই বড় সুন্দর দেখায়। এইযে রাশিক নামের বেপরোয়া, ভবঘুরে ছেলেটি। সে যেন আফিমের মাদকতা ছড়িয়ে দিয়েছে নিতিনের দু’চোখে। ওর সঙ্গ ছাড়া নিতিনের দিনগুলো বড় দুর্বিষহ মনে হয় আজকাল।
রাশিক চকলেট খেতে খুব ভালোবাসে। প্রতিবার ওদের দেখা হলে, খানিকক্ষনের ঘোরাঘুরি শেষে যখন কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে,সবসময় নিজের জন্য চকলেট জাতীয় কিছুই অর্ডার করে রাশিক। চকলেট আইসক্রিম, চকলেট পেস্ট্রি, চকলেট শেক…।
নিতিন একবার জিজ্ঞেস করেছিল,
–‘ সবসময় শুধু চকলেট কেন রাশিক? পৃথিবীতে চকলেট ছাড়াও আরো অনেক ভালো খাবার আছে।’
রাশিক ফিচেল হেসে বলল,
–‘ পৃথিবীতে মমতাজ ছাড়াও কিন্তু অনেক সুন্দরী মেয়ে ছিল। কিন্তু শাহজাহান ওই একজনের জন্যই তাজমহল গড়েছিল। ‘
–‘ধ্যাৎ! কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা! ‘
–‘ যাই বলো। তবে তুমি নিজেও কিন্তু চকলেটের মতো। ওইযে ক্যাডবেরী ডেইলি মিল্ক বাবলি আছে না? একদম ওটার মতো। যদিও এখনো টেস্ট করে দেখা হয়নি। ‘ নিতিনের আত্মা ধক্ করে উঠল। টেস্ট কথাটা বলে রাশিক ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছে! রাশিক কথায় কোনো রাখঢাক রাখতে জানে না। তবে সে যা ভাবছে, রাশিক নিশ্চয়ই ততটা খারাপ ছেলে নয়!
ইউটিউব দেখে দেখে নিতিন শেষপর্যন্ত চকলেট কেক তৈরি করে ফেললো। রাফিয়ার কাছে পূর্বেই অনুমতি নিয়ে রেখেছিল। বিকেলে বন্ধুর বাড়ি যাবে গ্রুপ স্টাডি করতে। তাই যখন কাঁধে স্কুল ব্যাগ ঝুলিয়ে ভেতর টিফিনবাক্সে কেক নিয়ে বেরোল সে, রাফিয়া দেখেও কিছু বললেন না।
গাড়ি সঙ্গে না নিলে মা সন্দেহ করতে পারে। এরও একটা সমাধান নিতিন ভেবে রেখেছিল। কাটাবন পর্যন্ত গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল সে। সাহেদ কে বলল বন্ধু ঐশী এখানে ওকে নিতে আসবে। ঐশীর বাড়ি কাটাবনেই। মাঝেমধ্যেই আসা হয় নিতিনের। তাই সাহেদও বেশি কিছু না বলে ফিরে গেল। গাড়িটা দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করতেই নিতিন রিকশা ডাকল। গন্তব্য অদূরেই, মধুর ক্যানটিনে।
সন্ধ্যায় নিতিন ফিরল ভীষণ আনমনা হয়ে। যাবার বেলার উৎফুল্লতার ছিটেফোঁটাও আর অবশিষ্ট নেই। রাশিক আজ বেশ অদ্ভুত একটা আবদার করেছে। একেবারে প্রত্যক্ষ আবদার ঠিক নয়। ঘুরিয়ে পেচিয়ে। বলা যায় সেই আবদারটাই এখন ওর সকল দুঃশ্চিন্তার কারণ।
নিতিন বেশ হাতখোলা মেয়ে। নিতিনের উপস্থিতিতে অন্যকেউ খরচ বহন করবে ব্যাপার টা ওর ঠিক পছন্দ নয়। রাশিকের সঙ্গে ঘোরাফেরার সময়ও সর্বদা রেস্টুরেন্টের বিল সহ যাবতীয় খরচ নিতিন পরিশোধ করে এসেছে। রাশিক খানিকটা বোহেমিয়ান ধরনের জীবন যাপনে অভস্ত্য। পড়াশোনার সুবাদে শহরে একা মেসে থাকে। মাস শেষ না হতেই ওর টানাপোড়েন লেগে যায়। সেসব নিতিনের অজানা নয়। তাই নিতিন চেষ্টা করে রাশিক কে যতটা সম্ভব ভারমুক্ত রাখতে।
নাব্যর একমাত্র আদরের ছোট বোন সে। নাব্যর কাছে চাওয়া মাত্র টাকা পেয়ে যায়। কৈফিয়ত দিতে হয়না কখনো। রাফিয়া অবশ্য এসবের ঘোর বিরোধী। সেজন্য নিতিন আজকাল মায়ের অজ্ঞাতে ভাইয়ের কাছ থেকে হাত খরচের নামে মোটা অঙ্কের টাকা নেয়।
বিকেলে দেখা করতে এসে রাশিক বেশ আরম্বিক গলায় জানাল টিউশনির এই সামান্য টাকা দিয়ে ওর আর চলছে না। তাছাড়া ভবিষ্যতে নিতিনের পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার আগে ওকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে তো! এদিকে সেশন জটের খপ্পরে পড়ে আছে দীর্ঘদিন। কবে এখান থেকে বেরোবে, মাস্টার্স করবে আর তারপর চাকরিতে ঢুকবে। ততদিনে নিতিনের পরিবারে বিয়ের তোরজোর শুরু হয়ে যাবে। তাই রাশিক চায় উদ্যোক্তা হতে। সল্প পরিসরে একটা ব্যাবসা শুরু করবে সে। যেটা ওকে নিজের একটা আলাদা পরিচয় গড়তে সাহায্য করবে।
এজন্য রাশিকের অনেক টাকার প্রয়োজন। গ্রামে বাবার সঙ্গে কথা বলে কয়েক লাখ টাকার ব্যাবস্থা করেছে সে। আর কিছু টাকা হলেই এবার সে একটা কিছু শুরু করতে পারে। এতসব কথার দ্বারা রাশিক কি ইঙ্গিত করেছে নিতিন সেটা বুঝল। কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে মিনমিনে গলায় বলল,
–‘ তোমাকে সাহায্য করতে পারলে আমার খুব ভালো লাগতো রাশিক। কিন্তু আমার কাছে এত টাকা নেই, যতটা হলে তোমাকে সাহায্য করা যায়। ‘
নিতিনের কথা শুনে রাশিক কিছুটা বিরক্ত হলো।
–‘ তোমার কাছে আমি টাকা চাইছি না নিতিন। আমি শুধু আমার সিচুয়েশন টা তোমার সঙ্গে শেয়ার করলাম। রুমমেটদের কাছে ইতোমধ্যে এত বেশি ধার জমে গেছে যে সেগুলো শোধ না করলে আপাতত কোনো প্রকার সাহায্যই ওদের কাছ থেকে পাওয়ার আশা রাখা যায় না।
আর ফিনানশিয়াল হেল্প বাদ দিলাম। ওরা পাশে না থাকলে এমনিতেও আমি ব্যাবসা টা দাঁড় করাতে পারবো না। ‘
ফিরে এসে নিতিন সে’রাতে অনেক ভাবলো। সকলের বড় আদরের মেয়ে সে। প্রতিবার ওর ঈদের প্রাপ্য সালামির পরিমাণ গিয়ে অযুতে ঠেকে। সেই টাকা গুলো কখনো তেমন ভাবে খরচ করা হয়নি। কারণ মাস শেষ হবার আগেই নাব্য ওকে চাহিদার চেয়ে বেশি টাকা দিয়েছে সবসময়।
পরের দু’দিন নিতিন শুধু ভাবল। ওর মনও বেশ খারাপ রইল। কারণ সেদিন বিকেলের পর থেকে রাশিক ওর সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যাবহার করছে না। এই দু’দিনে রাশিক একবারও নিজে থেকে কল দেয় নি। নিতিন যতবার কল দিচ্ছে, রাশিক ছাড়াছাড়া ভাবে দু একটা কথা বলে কল কেটে দিচ্ছে। তাতে নিতিনের নাওয়া-খাওয়া সিকেঁয় উঠেছে। রাশিকের সঙ্গে কথা বলতে না পেরে দম বন্ধ লাগছে ওর। মনে হচ্ছে রাশিক নামক আফিমের সংস্পর্শ না পেলে এবার মা’রা পড়বে ও।
তৃতীয় দিন সকালে নিতিন বেশ উৎফুল্ল হয়ে রাশিকের নম্বরে ডায়াল করল। কল রিসিভ করে পূর্বেকার মতোই রাশিক গা ছাড়া ভাব দেখালো। তবে আজ নিতিন আর সেসবের পরোয়া করল না। উত্তেজিত গলায় বলল,
–‘ আর মুখ গোমড়া করে না থেকে এখন একটু হেসে ফেলো তো রাশিক।’
–‘ আমার হাসি পাচ্ছে না। ‘
–‘ পাবে। তোমার হাসি পাবার ব্যাবস্থা করেছি আমি। হাসির শব্দ শোনা মাত্র সবকিছু বলব তোমায়। ‘
রাশিক এবার সত্যিই হেসে ফেললো। কণ্ঠে দায়সারা ভাব বজায় রেখে বলল,
–‘ কি বলবে?’
–‘ রাশিক, টাকার ব্যাবস্থা হয়ে গেছে। যদিও খুব বেশি না। তবে ব্যাবসা টা এবার শুরু করতে পারবে হয়তো তুমি! ‘
–‘সত্যি! নিতিন তুমি সত্যি টাকা’টা ম্যানেজ করে ফেলেছো? আমি জানতাম, তুমি ঠিক পারবে।’
–‘নব্বই হাজার টাকা ম্যানেজ করেছি আমি। সরি এর বেশি সম্ভব হয়নি। টাকা নিয়ে কবে আসবো বলো?’
রাশিক কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
–‘ কষ্ট করে আজ সন্ধ্যায় একবার আসতে পারবে হাজারিবাগে? ‘
–‘সন্ধ্যায়? ‘
–‘ কেন? খুব অসুবিধা হয়ে যাবে? ‘
–‘ না না। সমস্যা নেই। আমি ম্যানেজ করে ফেলবো। ‘
মা, দাদি মাগরিবের সালাতে দাঁড়িয়েছেন। সালাতের পর মাসনুন আমল শেষে দাদির ঘরে যাবেন রাফিয়া। তারপর শাশুড়ীকে সঙ্গে নিয়ে ডাইনিং এ আসবেন। সেখানে বসবে সন্ধ্যার চা-আড্ডা। তখন হয়তো ডাক পড়বে নিতিনের। নিতিন সাড়া না দিলে রাফিয়া কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবেন। তারপর শাশুড়ীকে নিয়েই চা পান করে উঠে যাবেন।
ধাপগুলো নিতিনের মুখস্থ। যতক্ষণে নিতিনের ব্যাপারে তিনি খোঁজ শুরু করবেন সেই সময়ের আগেই নিতিন ফিরে আসবে। আর একটু দেরি হলে নাহয় বলে দেয়া যাবে নিচের বাগানে বসেছিল। ডাক শুনতে পায়নি।
নিতিন চুপিসারে গেইট খুলে বেরিয়ে এল। বাড়ির সামনে থেকে রিকশা নিল হাজারিবাগের উদ্দেশ্যে। রিকশাটা চলতে শুরু করল সন্ধ্যায় ঝাপসা আলো মাখা নগরীর মধ্য দিয়ে। নিতিনের মনে কোথায় যেন একটা খারাপ লাগা কাজ করছে। রাশিকের সঙ্গে নিজেকে জড়ানোর পর থেকে অনবরত নিজের আপন মানুষ গুলোর চোখে ধূলো দিচ্ছে সে। সম্পর্ক টা আড়াল করতে একের পর এক মিথ্যে বলতে বলতে আজকাল মিথ্যা বলাটা ওর জন্য ডালভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুদিন আগেও, গাড়ির ভেতর থেকে কাঁচের বাইরে চোখ ফেললে, শহরটাকে খুব অচেনা মনে হতো ওর। অথচ আজকাল রাশিকের জন্য একা রিকশায় চড়ে দূর দূরান্তে ছুটে যেতেও দ্বিধা করে না সে! এসব জানলে মা আর দাভাই কতো কষ্টই না পাবে!
হাজারিবাগের উদ্দেশ্যে যেতে যেতে মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা করল নিতিন, আজকের পর থেকে রাশিকের সঙ্গে এভাবে অবাধে দেখা-সাক্ষাৎ করা বন্ধ করে দেবে সে৷ রাশিক হাজার বললেও আর কখনো মায়ের চোখে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে আসবে না।
হাজারিবাগে বেশ একটা নিরিবিলি স্থানে রিকশা থামাতে বলল সে। রিকশা ওয়ালা আড়চোখে তাকাল ওর পানে। এই ভর সন্ধ্যায়, এমন নিরব রাস্তায় একা একটি মেয়ে কি প্রয়োজনে আসতে পারে ভাবছে হয়তো! ভাড়া মিটিয়ে এদিকসেদিক তাকাল নিতিন। রিকশাওয়ালা চলে যেতেই জায়গাটা আরও বেশি সুনশান মনে হচ্ছে। রাশিক কেন এরকম একটা জায়গায় আসতে বলল ওকে?
প্রায় পনেরো মিনিট পার হয়ে গেল রাশিকের আসার কোনো নামগন্ধ পর্যন্ত নেই। টাকার ব্যাগটা নিজের সঙ্গে চেপে ধরে রাশিকের নম্বরে অনবরত ডায়াল করে যাচ্ছে নিতিন। রাশিক কল রিসিভ করছে না। আতঙ্কে নিতিনের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। মা হয়তো এরই মধ্যে খোঁজ শুরু করেছেন৷ ঘরে গিয়ে ওকে না পেলে কি করবেন কে জানে! নিতিনের মনে হলো এই ভর সন্ধ্যায়, রাশিকের কথায় ভরসা করে এই অচেনা জায়গায় আসা ওর চরম ভুল হয়েছে। আশেপাশে একটা রিকশা পর্যন্ত নেই। আসার সময় ভেবেছিল রাশিক ওকে রিকশায় উঠিয়ে দেবে। তাই রাস্তাঘাটও অত খেয়াল করে আসেনি।
নিতিনের হৃদকম্পন ঝড়ের বেগে বাড়তে লাগল। রাশিক যদি না আসে তবে একা কিভাবে বাড়ি ফিরিবে সে আজ?
আরও প্রায় মিনিট দশেক পর একটা সরু গলির ভেতর থেকে আচমকা আবির্ভাব ঘটল রাশিকের। নিতিন ওকে দেখে দৌড়ে কাছে গেল। কেন এতো দেরি হলো, ফোন ওঠাচ্ছিল না কেন….. একের পর এক প্রশ্ন করে চলল সে। লক্ষ্য করল রাশিক কোনো উত্তর দিচ্ছে না। অকস্মাৎ রাশিকের পেছনে তাকিয়ে থমকে গেল সে। জমাট বাঁধা অন্ধকার ভেদ করে একেবারে যেন ভূতের মতো বেরিয়ে এল ঐশী। নিতিনের বেস্টফ্রেন্ড।
–‘ ও…ঐশী তুই এখানে?’
ঐশী নিঃশব্দে রাশিকের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিতিন হা করে তাকিয়ে রইল। ওকে আরও অবাক করে দিয়ে রাশিক হঠাৎ রুক্ষ স্বরে বলল,
–‘টাকা গুলা দে।’
–‘রাশিক তুমি এভাবে কথা বলছো কেন? ঐশী তোমার সঙ্গে কিভাবে এলো? তোমার আমার সাথে মজা করছো তাই না?’
রাশিক আবার বলল,
–‘ বেশি কথা কইস না টাকা দে।’
নিতিনের হতবিহ্বল ভাব কাটবার আগেই ঐশী এগিয়ে এসে ওর হাত থেকে টাকার ব্যাগটা ছি’নিয়ে নিয়ে ওকে ধা-ক্কা দিয়ে ফেলে দিল মাটিতে।
পড়ে গিয়ে ব্যাথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠল নিতিন। কান্নাজরিত গলায় বলল,
–‘রাশিক এসব কি হচ্ছে? তুমি কিছু বলছো না কেন? তোমার সামনে ও আমাকে….’
–‘ ও কি বলবে? খুব তো এতোদিন আমার প্রেমিককে নিয়ে শহর চষে বেড়িয়েছিস !’
–‘তোর প্রেমিক! কে তোর প্রেমিক?’
-‘রাশিক। রাশিকের সাথে আমার দুই বছরের রিলেশন। পরিবার সম্পর্ক টা মানতে নারাজ। আমরা পালানোর প্ল্যান করেছি। কিন্তু সেজন্য অনেক টাকার দরকার। তাই আমিই বুদ্ধিটা দিয়েছিলাম রাশিক কে। তোর সঙ্গে প্রেমের নাটক করার। বোকা মেয়ে! আমি জানতাম তুই ফাঁদে পা দিবি। তবে এত অল্পদিনের পরিচয়ে প্রেমিককে এতোগুলো টাকা দিতে রাজি হয়ে যাবার মতো বোকামি তুই করবি সেটা ভাবিনি। এখন চুপচাপ বাড়ি চলে যা। আমাদের খবর কাউকে জানালে তোর ছবিগুলো রঙচঙা ভাবে এডিট করে ভাইরাল করবো। মনে থাকে যেন। চলো রাশিক।’
কথা শেষ করে ঐশী ঘুরে হাটা ধরতেই রাশিক বলল,
–‘দাঁড়াও। ওর ফোন আর হাতের ব্রেসলেটটা খুলে নিয়ে যাই। বিপদে এগুলোও কাজে লাগতে পারে। ‘
রাশিক উবু হয়ে নিতিনের হাত থেকে নিষ্ঠুর ভাবে টেনে ব্রেসলেট টা খুলে নিল। হিং’স্র গলায় বলল,
-‘ফোন টা কোথায় রেখেছিস? জলদি বের কর।’ নিতিন কম্পিত হাতে পার্স থেকে ফোন বের করার সঙ্গে সঙ্গে সেটা একটানে ছি’নিয়ে নিয়ে ঐশির পেছন পেছন হাটতে আরম্ভ করল রাশিক।
নিতিন মূঢ়ের ন্যায় স্থবির হয়ে মাঝরাস্তায় বসে রইল। ঝর্ণাধারার মতো ওর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। ব্রেসলেট টা হিরের ছিল। নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করায় বাবা খুশি হয়ে ওটা ওকে গিফট করছিল। বাবার অন্যতম প্রিয় স্মৃতি ছিল এই ব্রেসলেট টা । কতবার বাবার কথা মনে করে ব্রেসলেটে চুমু খেয়েছে সে। সেটাও ওই প্রতারক নিয়ে গেল!
নিতিনের কাছে মনে হলো যেন ঐশীর দেয়া ধা-ক্কাটার সঙ্গে সঙ্গে রাশিক নামক আফিমের কড়া আবেশ থেকে বেড়িয়ে এসেছে সে। ওর এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে রাশিক এমনটা করেছে ওর সঙ্গে! রাশিক ছিল ওর জীবনের প্রথম আবেগ। রাশিকের মোহ ওর রন্ধে রন্ধে এমন ভাবে মিশে গেছিল যে ওকে ছাড়া নিজের অস্তিত্বও কল্পনা করতে পারতো না সে। সেই রাশিক এতো জঘন্য ভাবে ওকে ঠকালো!
সত্যি মিথ্যের পরোয়া না করে রাশিককে বিশ্বাস করে এতো গুলো টাকার ব্যাবস্থা করেছে সে। বলাই বাহুল্য এর জন্য কিছুটা অসৎপথ অবলম্বন করতে হয়েছে তাকে। কিন্তু সেসব কিছুকে রাশিকের ভালোবাসার কাছে তুচ্ছ মনে করে নিতিন নির্দ্বিধায় কাজটা করেছিল। নব্বই হাজার টাকার মধ্যে মাত্র ত্রিশ হাজার ছিল নিতিনের নিজের সঞ্চয়। ঈদের সালামির টাকা গুলো জমিয়েছিল সে।
নিতিনের ভাবলেও লজ্জা করছে বাকি ষাট হাজার টাকা দাভাইয়ের আলমিরা থেকে সরিয়েছে।
ব্যাবসার কাছে ব্যাবহৃত বেহিসেবী টাকা নাব্যর আলমিয়ার থাকে। নিতিন সেখান থেকেই গোপনে সরিয়েছিল টাকা। ভেবেছিল যে করেই হোক, নাব্য টের পাওয়ার আগেই স্বস্থানে রেখে দেবে। হুট করেই ষাট হাজার সংখ্যা টা বড় বেশি ভারি মনে হলো নিতিনের। এমন একটা নিকৃষ্ট কাজ সে কিভাবে করে ফেললো!
কৈশোরের প্রথম প্রেমের এতো জঘন্য সমাপ্তি আর নিজের বোকামির কথা ভেবে রাস্তায় বসেই নিতিন হাউমা’উ করে কেঁদে উঠল। ঠিক করল আর কখনো বাড়ি ফিরবে না। এই কলুষিত মুখ আর কখনো দেখাবে না মা, দাদি আর দাভাইকে। যা খুশি ঘটে যাক আজ, সে এখানেই বসে থাকবে। খুব বাজে কিছু যদি হয় ওর সঙ্গে, তবে ধরে নেবে সেটা ওর চরম পাপের শাস্তি!
—————–
দ্বিতীয় বারের মতো ফোন বেজে ওঠায় নাব্য রিসিভার কানে তুললো।
–‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।’
সালামের উত্তর দিয়ে ওপাশ থেকে বর্ষা রিনরিনে স্বরে একটু হাসির ঝংকার তুলে বলল,
–‘ কি করছিলে?’
নাব্য দায়সারা গোছের উত্তর দিল,
–‘কাজ।’
–‘ এখনো অফিসে? অসময়ে ফোন দিয়ে ফেললাম বোধহয়!’
নাব্য কিছু বলল না।
বর্ষাই ফের বলল,
–‘ তোমার বউ কেমন আছে?’
–‘ বোধহয় ভালোই আছে।’
–‘ এখনো কি বাবার বাড়িতেই? আচ্ছা.. বাচ্চা কি হবে ডক্টর বলেছে কিছু? ছেলে নাকি মেয়ে?’
–‘ জানি না। ‘
–‘সত্যিই জানো না!’
–‘ না। কি বলতে ফোন করেছ এখন জলদি সেটা বল। আর… তোমাকে তো আমি বলেছিলাম যেকোনো দরকারে আমাকে ফোন না করে রশু জানাতে। ‘
বর্ষার গলায় মন খারাপের সুর ভেসে এলো,
–‘ সেকথা ভুলিনি। আসলে বর্ষন কিছুদিন ধরেই তোমাকে দেখার বায়না করছিল তাই…..। সেদিন যে বর্ষনের অনুরোধে তুমি আমাদের ঘুরতে নিয়ে গেলে। তাতেই ওর মনে বড় লোভ বেড়েছ। সারাক্ষণ শুধু বাইরে যাবার জন্য বায়না….’
সেদিন’টার কথা মনে পড়ল নাব্যর। একটু বেশিই বদান্যতা দেখিয়েছিল সে। যার ফলাফল হয়েছিল ভয়ংকর। বর্ষনের কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটার জন্য ওরা ভাইবোন বেড়িয়েছিল। মার্কেট থেকে ফেরার পথে রাস্তা হারিয়ে ফেললো বর্ষা। কল করল নাব্যকে। রশু তখন চট্টগ্রামে। তাই বাধ্য হয়ে নাব্যকেই আসতে হলো। বর্ষন বায়না করছিল কোথাও বেড়াতে যাবার জন্য। ওরা উত্তরার কাছাকাছি থাকায় নাব্য গাড়ি ঘোরালো দিয়াবাড়ির দিকে।
সেখান থেকে ফেরার সময় সন্ধ্যার রাস্তায় শ্বাসরোধী যানজটে আটকা পড়ল ওরা। গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল একটা বেবিশপ কে সামনে রেখে। হঠাৎ নাব্য খেয়াল করল, মলের পাশে পার্কিং লটে বাবার প্রিয় গাড়িটা। ভেতরে সাহেদ সিটে গা এলিয়ে শুয়ে আছে।
রাতে বাড়ি ফিরে নিতিন কে জিগ্যেস করে জানলো বর্ষাকে নিয়ে ওই বেবিশপে গেছিল নিতিন।
নিতিন নাব্যকে দেখেনি এই ব্যাপার নিশ্চিত। কিন্তু বর্ষাও যে দেখেনি সে ব্যাপারে নিশ্চয়তা কোথায়! নাব্যর মনে খচখচানিটা বাড়ল যখন দেখল সেদিন থেকে বর্ষা ওকে এড়িয়ে চলছে।
অথচ বর্ষার ওকে উপেক্ষা করে যাবার ব্যাপার টা যে ওকে খুব বেশি কষ্ট দিল তা নয়। নাব্য জানে না মনের এই অদ্ভুত অবস্থার নাম কি! যেদিন গরানবনের সেই পুরনো বর্ষা ম্লান মুখে, মলিন পরিচ্ছদে ওর অফিসে এসে পা রাখল, সেদিন থেকেই সব ওলটপালট হয়ে গেল! বর্ষা যেন বসন্তের মতোই রঙিন ফুলের পসরা নিয়ে এসে, যাওয়ার বেলায় রাশি রাশি ঝরা পাতাবিছিয়ে দিয়ে গেল ওর মনের নরম মাটিতে।
তারপর থেকেই স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক টা ফিঁকে হয়ে আসতে শুরু করেছে ওর। ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে একটা প্রচ্ছন্ন অভিমানের দেয়াল। কতবার…কতবার নাব্য সেই দেয়াল ভেঙে ওপারে প্রবেশের পথ খুঁজেছে। কিন্তু প্রতিবার হেরে গেছে সে নিজের কাছে। বর্ষার ফেলে যাওয়া সেই ঝরা পাতা বিছানো ধূসর পথ, দিনরাত ওকে টেনেছে একটা ভুল, আচ্ছন্নতায় পূর্ণ অপরিচিত পথের দিকে। নাব্য বার বার ফিরে আসতে চেয়েছে। কিন্তু প্রতিবার আরও বেশি জালে জড়িয়ে গেছে…
–‘হ্যালো.. হ্যালো…. নাব্য কথা বলছো না কেন?’
বর্ষার কথায় সম্বিত ফিরে পেল নাব্য। ডেস্কের অন্যপাশে থাকা সেলফোনটা অনবরত বেজে যাচ্ছে। নাব্য ভ্রু কুঞ্চিত করে ওপরের নামটা দেখল।
–‘ একটা জরুরি ফোন এসেছে। রাখছি এখন। ‘
বলে এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে লাইন কেটে দিল।
বাজতে থাকা অপর ফোনটা কানে তুলতেই রাফিয়া উত্তেজিত গলায় বললেন,
-‘ নবু নিতিন কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোনও বন্ধ।’ বলেই কান্না জুড়ে দিলেন তিনি।
-‘ কি! কখন থেকে খুঁজে পাচ্ছো না?’
-‘সন্ধ্যার পর ওকে আর দেখেনি বাড়ির কেউ।’
নাব্য দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। নয়টা পঞ্চান্ন মিনিটে ঘড়ির কাঁটা স্থির হয়ে আছে। এতো সময় ধরে নিতিন নিখোঁজ!
নাব্য চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরে বেরোতে বেরোতে বলল,
-‘ তুমি অপেক্ষা করো আম্মা। আমি এক্ষুনি আসছি।’
চলবে ইন শা আল্লাহ …….