#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিলো
লেখকঃ শারমিন আক্তার সাথী
পর্বঃ২৫
রেনু কান্না করতে করতে বলল,
‘বলেন।’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শিহাব বলল,
‘এ ঘটনা প্রায় তেরো বছর আগের। তখন আমার বয়স মাত্র ২৩ কি ২৪ বছর মেবি। মুক্তির সাথে আমার পরিচয় আমাদের অফিসে। আমি তখন গ্রাজুয়েশন শেষ করে কেবল জব নিয়েছি। সাথে পোস্ট গ্রাজুয়েশনও করছি। ভাবলাম এ জবটা করতে করতে মাস্টার্স শেষ হয়ে যাবে, তারপর নিজের পছন্দমতো জব নিব। মুক্তিও আমার অফিসেই জয়েন করে। পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম, ও আমার ভার্সিটিতেই ম্যানেজমেন্ট এ মাস্টার্স করছে। দু’জন একই বয়সী, একই ভার্সিটিতে পড়ার দরুণ খুব দ্রুত বন্ধুত্ব হয় আমাদের। অতঃপর একে অপরকে ভালোবেসে ফেলি। বুঝতেই পারছো বয়সটা কেমন তখন! ঐ বয়সে ছেলেদের চাহিদা কেমন থাকে। তবুও আমি নিজেকে সবসময় নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতাম।
একদিন মুক্তি হুট করেই আমার খুব কাছে চলে আসতে চায়। আমি-ই বারণ করে বলি, বিয়ে করি তারপর। হুট করে কী হলো ওর কে জানে, বলল আজই বিয়ে করবে। আমি প্রথমে ভাবলাম হয়তো মজা করছে। কিন্তু ও সিরিয়াস ছিলো। আমি বললাম তাহলে আমার পরিবারকে বলি তারা বিয়ের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু ওর এককথা এখনই বিয়ে করবে এবং কাউকে জানানো যাবে না। যখন সময় হবে তখন ও নিজেই জানাবে। ওর জেদের কাছে হার মানলাম সেদিন।
সেদিন সন্ধ্যায় কোর্ট ম্যারেজ হয় আমাদের। আমার তরফ থেকে আমার পরিচিত কেউ ছিলো না, তবে সাক্ষী হিসাবে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড মাহিন, আর ওর বোন নওশীন ছিলো। সাধারণ কাপড়ে বিয়ে হয় আমাদের। আমি ভীষণ খুুশিও ছিলাম, সাথে পরিবারকে না জানাতে পেরে দুঃখিও ছিলাম। আমাদের বাসর হয় একটা মোটামুটি লেভেলের হোটেলে। বিষয়টা আমার মোটেও ভালো লাগেনি সেদিন। আমার পরিবারের অবস্থা বেশ ভালো। আমার বিয়ে হবে ধুমধাম করে, বাসর সব হবে স্বপ্নের মতো সাজানো ঘরে। কিন্তু বিয়ে হলো চোরের মতো, আর বাসর হলো সস্তার হোটেলে। কিন্তু মুক্তির জেদের কাছে আমি বরাবরই হেরে যেতাম।
আমাদের জীবন আগের মতোই সাধারণভাবে চলতে লাগল। সংসারহীন, দায়িত্বহীন, ভবিষৎ পরিকল্পনাহীন। মুক্তিকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতাম,
‘মুক্তি তোমার সংসার করতে ইচ্ছা করে না?’
ওর উত্তর হতো,
‘সংসার মানেই হাজারটা ঝামেলা। হাজারটা দায়িত্ব, কর্তব্য, কাজ। তার চেয়ে এখন-ই ভালো আছি। ঝামেলাহীন। যখন যেখানে খুশি যাও, যেমন খুশি চলো। আমি কারও অধীনে থাকতে পারব না।’
যেখানে মেয়েরা সংসার নিয়ে আগ্রহী হয়, সংসার সাজানোর স্বপ্ন দেখে, সেখানে মুক্তি ছিলো তার ঠিক বিপরীত। ওর আমাকে তেমন প্রয়োজন পড়ত না। নিজের কাজ ও নিজে-ই করত। আমার কাছ থেকে টাকা পয়সাও তেমন নিতো না। মাঝে মাঝে জোর করে দিতাম বা কোনো উপহার দিতাম। আমাকে ওর প্রয়োজন পড়ত শুধু জৈবিক চাহিদা মেটানোর সময়। আমি যখন-ই বিয়ের কথা পরিবারে জানাতে চাইতাম, ও কোনো না কোনো ভাবে আমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে আটকে দিত।’
এভাবেই আমার দিনগুলো চলতে লাগল। ধীরে ধীরে আমি কেমন যেনো ডিপ্রেশনে পড়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের সম্পর্ক নিয়ে খুব হতাশায় থাকতাম সববসময়। একজন স্বামী তার স্ত্রীর কাছ থেকে যেমন ভালোবাসা, এটেনশন, যত্ন চায় আমি তার কোনোটাই মুক্তির কাছ থেকে পাচ্ছিলাম না। স্বামী হিসাবে নিজেকে ব্যর্থ মনে হতে লাগল। আমি মুক্তির কাছ থেকে ঐ মুগ্ধময় ভালোবাসাটা পেতে চাইতাম যে ভালোবাসা প্রত্যেক স্বামী তার স্ত্রীর কাছ থেকে পেতে চায়।
একদিন মুক্তিকে আমার চিন্তাটা খুলে বললাম। বললাম,
‘মুক্তি আমার এমন সম্পর্ক ভালো লাগছে না।’
‘কেমন সম্পর্ক?’
‘লুকোচুরির এ বিয়ে। আমি তোমাকে সম্পূর্ণভাবে নিজের করে পেতে চাই।’
‘তো এখন কি পাওনি? তুমি যখন চাও তখন-ই তো আমি তোমার কাছে আসি। কখনও তো না করি না।’
‘মুক্তি, বিয়ে মানে কি শুধু একে অপরের সাথে ইন্টিমেট হওয়া?’
‘তাহলে তোমার কাছে বিয়ে মানে কী?’
‘বিয়ে মানে এটা পবিত্র ভালোবাসা। শুধু একে অপরকে ভালোবাসা না, একে অপরের পরিবারকেও ভালোবাসা। একে অপরের যত্ন নেয়া, এবং একে অপরের পরিবারের খেয়াল রাখা। একটা ছোট্ট সংসার, পরিবার, ছোটো বাচ্চার হাসি। যেখানে খুনসুটি, দুষ্টুমি, মুগ্ধতা, যত্ন, ঝগড়া, বোঝা-পাড়া, কাছে আসা, অভিমান করা, অভিমান ভাঙানো সব থাকে। মুক্তি আমি সামাজিকভাবে তোমাকে স্বীকৃতি দিতে চাই। আমার পরিবারের কাছে তোমাকে নিয়ে যেতে চাই। তাদের সাথে পরিচয় করাতে চাই। তাদের আমাদের বিয়ের কথা জানাতে চাই। জানি প্রথমে তারা রাগ করবে কিন্তু পরে ঠিক মেনে নিবে।’
মুক্তি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিলো,
‘তোমার কথা ঠিক শিহাব। আমিও এসব পেতে চাই। কিন্তু আমি জীবনে আরও কিছু পেতে চাই। আমার কিছু এ্যামবিশন আছে। আর সেসব আমাকে পূরণ করতে হবে। সে কারণে আমি এখন সংসারে মন দিতে পারব না। আর বাচ্চার কথা তো আমি ভাবতেই পারি না। বাচ্চা আর সংসারে মন দিলেই মেয়েরা তাদের স্বপ্ন থেকে পিছিয়ে যায়।’
‘কেন পিছিয়ে যায়? আমি তোমায় হেল্প করব। আমার পরিবার তোমায় হেল্প করবে।’
‘ওমন কথা সবাই বলে, শিহাব কিন্তু সংসারে আসার পর সব বদলে যায়। তখন না চাইতেও সংসারের চাপে মেয়েরা নিজের সব স্বপ্ন মাটি চাপ দিয়ে মেরে ফেলে।’
‘এ কথা সত্যি না মুক্তি। এ দেশে অনেক মেয়ে পাবে যারা স্বামীর সহায়তায় উন্নতির স্বর্ণ শিখরে পৌঁছে গেছে।’
‘তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য।’
‘তুমি নাহয় তাদের মধ্যে হলে।’
‘সরি শিহাব আমি পারব না।’
‘তাহলে আমাকে বিয়ে কেন করেছিলে?’
‘কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর তুমি চাইতে আমাদের বিয়ে হোক। সো তোমার ইচ্ছাটার মূল্য দিয়েছি আমি। আমি যেমন তোমার ইচ্ছার মূল্য দিয়েছি এখন তোমার উচিত আমার ইচ্ছার মূল্য দেওয়া। আর আমি জানি তুমি সেটা দিবে।’
সেদিন মুক্তির উপর আমি আর কিছু বলতে পারিনি।
দেখতে দেখতে আমাদের পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষ হয়ে যায়। আমাদের বিয়ের বয়সও তখন এক বছর হয়ে গেল। এনিভার্সারির দিন আমি মুক্তির জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করছিলাম কিন্তু আমি জানতাম না, আমার জন্য তার চেয়েও বিস্ময়কর কিছু অপেক্ষা করছে! সেদিন রাতে মুক্তি এলো। আমি ওকে বিবাহবার্ষিকীর শুভকামনা জানালাম। জড়িয়ে ধরে কাছে টানার চেষ্টা করলাম। এই প্রথম মুক্তি আমার কাছে এলো না। বরং আমাকে দূরে সরিয়ে বলেছিলো,
‘শিহাব সরি টু সে বাট আমি এ বিয়েটা আর কন্টিনিউ করতে চাই না।’
আমি বেশ অবাক হয়ে বলেছিলাম,
‘মানে?’
‘মানে আমি তোমার থেকে ডিভোর্স চাচ্ছি।’
ডিভোর্স কথাটা শুনে আমার মাথায় নিঃশব্দে বাজ পড়ল। কারণ জানতে চাইলাম। মুক্তি বলল,
‘সরি টু সে শিহাব বাট তোমার প্রতি আমার আর আগের মতো ফিলিংস নেই। কেন জানি তোমার প্রতি এখন আর ভালোবাসা কাজ করে না।’
‘এটা কেমন কথা মুক্তি? নিজের স্বামীর প্রতি তোমার ভালোবাসা কাজ করে না? এ-ও সম্ভব?’
‘এটাই সত্যি শিহাব। তোমাকে আমি এখন আর ভালোবাসি না।’
‘কেন? আমার অপরাধ?’
‘তোমার কোনো অপরাধ নেই। দোষটা আমার। তোমাকে ভালো লাগত, সেই ভালো লাগাকে আমি ভালোবাসার নাম দিয়ে, ঝোঁকের মাথায় তোমাকে বিয়ে করি ফেলি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটা ঠিক হয়নি আমার। আর সত্যি বলতে আমি অন্য একজনকে ভালোবেসে ফেলেছি।’
মুক্তির কথাগুলো শুনে আমার ভিতরটা ভেঙে চুরে যাচ্ছিল। তবুও নিজেকে সামলে বললাম,
‘কাকে?’
‘দেখো তুমি অন্য কিছু ভেবো না। বাট আমি রুমেল সাহেবকে ভালোবেসে ফেলেছি।’
আমি চূড়ান্ত অবাক হয়ে বললাম,
‘রুমেল সাহেব? আমাদের অফিসের বস?’
মুক্তি মাথা নিচু করে বলল,
‘হ্যাঁ।’
ভীষণ রাগ হলো। রাগের মাথায় যা তা বলতে লাগলাম,
‘ওহ তবে বসের সাথে তোর ওসব অফিসিয়্যাল টুর ফুর কিছু না মূলত তোরা নষ্টামি করতে যেতি? নিজের বড় বড় স্বপ্ন পূরন করতে এখন তুই বে*শ্যাগিরি শুরু করছোস?’
মুক্তি বেশ রাগ করে বলেছিলো,
‘মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ শিহাব।’
‘রাখ তোর ল্যাংগুয়েজ। এতদিন অন্ধের মতো বিশ্বাস করার এই প্রতিদান দিলি তুই?’
‘আমি এত কথার জবাব দিতে পারব না। তুমি এই ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দাও। তারপর তুমি আর আমার ছায়াটাও দেখবে না।’
‘করব না সাইন। দেখি তুই কী করে ঐ ওমেনাইজারটার সাথে নষ্টামি করিস।’
মুক্তি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিলো,
‘আমি জানতাম তুমি এমন-ই রিয়াক্ট করবে। সে কারণে অনেক দিন আগেই আমি কৌশলে তোমার সাইন ডিভোর্স পেপারে নিয়ে রেখেছিলাম। তুমি চাও বা না চাও আমাদের তালাক আগেই হয়ে গেছে।’
কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছিল, কেউ কলিজাটা ছিড়ে নিয়ে তার পায়ের তলায় পিষে ফেলছে। মুক্তিকে নিজের কাছে রাখার শেষ চেষ্টা করলাম। সেদিন প্রচন্ড আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও, মেরুদন্ডহীন, বেহায়ার মতো ওর পা দুটো জড়িয়ে ধরে, কান্না করতে করতে বলেছিলাম,
‘মুক্তি তোমায় এতটা ভালোবেসে ফেলেছি যে, তোমাকে ছেড়ে থাকার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। তোমায় নিয়ে আমি কত কত স্বপ্ন সাজিয়েছি। ছোট্ট সংসার, পরিবার, বাচ্চা। তুমি চলে গেলে আমি মরে যাব মুক্তি। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না।’
কিন্তু মুক্তি আমার কোনো কথা শোনেনি সেদিন। আমাকে ছেড়ে চলে গেছিল সেদিন।
তারপর আর আমি ঐ শহরে মানে ঢাকা থাকতে পারিনি। চাকরি ছেড়ে নিজ শহরে চলে এলাম। ভাবলাম এখানেই প্রতিষ্ঠিত হবো। মুক্তির সাথে আমার আবার দেখা হয় বছর খানিক পর এক বিকালে। তারপর…।
রেনুর কান্নায় কথা থামালো শিহাব। ও হিচকি দিয়ে কাঁদছে। শিহাব বলল,
‘প্লিজ রেনু, এভাবে কেঁদো না।’
‘আপনি মুক্তিকে এত ভালোবাসতেন যে, তার পা পর্যন্ত ধরেছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’
রেনুর কান্নার বেগ আরও বাড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘আপনি তাকে যতটা ভালোবাসেন ততটা ভালো কি আমাকে বাসেন?’
‘আমি তোমাকে তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি রেনু। মুক্তির জন্য আমার মনে কোনো ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই। ওর জন্য আমার মনে এখন ঘৃণা ছাড়া কিছুই নেই। এমনকি ও মারা যাবার পরও সে ঘৃণা কমেনি। তবে হ্যাঁ ওর মৃত্যুর জন্য কোথাও না কোথাও আমি-ই দায়ী।’
‘চুপ করুন! চুপ করুন! আমি আজ আর কিছু শুনতে চাই না। আমার মন মস্তিষ্ক উলোট পালোট হয়ে গেছে। আমাকে নিজেকে সামলে নিতে দিন প্লিজ।’
৩৫!!
শশী, রাযীনের পাশে গিয়ে বসে বলল,
‘রাযীন সাহেব?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনি কি এখন ব্যস্ত?’
‘কেন?’
‘কোথাও বের হবেন?’
‘না? কেন তোমার কোনো কাজ আছে?’
‘আজকাল তো আপনার ব্যস্ততার শেষ নেই। নিজের বউ এর কথা মনেই থাকে না।’
‘ওহহো। ম্যাডাম দেখছি এত অল্পতেই অভিযোগ করা শুরু করে দিয়েছেন।’
‘তো কী করব? কদিন যাবত তোমার কাজ আর কাজ। আমাকে একটুও সময় দাও না। সারাদিন একা ঘরে বসে থাকি আমি। আমার ভালো লাগে না। এমন করলে আমি কিন্তু মাকে ফোন করে বলে দিব। তিনি আমাকে নিয়ে যাবেন। তখন তুমি করো তোমার কাজ।’
শশী মুখ বাঁকিয়ে আরেক দিকে ঘুরে রইল। রাযীন, শশীকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘জান পাখি রাগ করছে?’
‘হুহ। তাতে কার কী?’
‘আমার-ই সবকিছু। তবে রাগ করে মাকে ফোন দিও না। এমনি মা কথায় কথায় আমাকে ঝাড়ির উপর রাখে। সবসময় কড়া করে বলেন, তোমার খেয়াল রাখতে।তারপর যদি শোনে কাজের বাহানায় তোমাকে সময় দিচ্ছি না বা তুমি মাকে অভিযোগ করছো। তাহলে মা রাতের মধ্যে এখানে চলে আসবে। তারপর আমাকে আচ্ছামত ধোলাই দিবে।’
‘সেটাই ঠিক হবে। আমি মাকে এখন-ই কল করব।’
রাযীন, শশীকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘আমার কাছ থেকে ছুটে গিয়ে দেখাও তো আগে।’
শশী মন খারাপ করে রইল। তা দেখে রাযীন শশীর কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে বলল,
‘আচ্ছা সরি। মন খারাপ করো না। তুমি কী চাও বলো?’
‘আজকে বিকাল থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত তুমি আমার।’
রাযীন দুষ্টু হেসে বলল,
‘আমি তো শুধুই তোমার।’
‘কট্রোল জনাব। আমি বলেতে চেয়েছি আপনার সময় আমার।’
‘ওকে।’
‘এখন বলেন তো?’
‘কী বলব?’
‘আপনার প্রেমে পড়ার গল্প। আপনি কীভাবে শশীর প্রেমে পড়লেন তার গল্প। আমি লিসেনার হয়ে আপনার প্রেমে পড়ার গল্প শুনব। ‘
‘লিসেনার হয়ে শুনবে নাকি বউ হয়ে?’
‘কোনভাবে শুনলে কেমন হবে?’
রাযীন, শশীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘বউ হয়ে শুনলে এভাবে আদর করে, ভালোবেসে পরম যত্নে শোনাব। আর লিসেনার হয়ে শুনলে ঐ যে, দূরের চেয়ারটা সেখানে গিয়ে বসো, আমি বলছি তুমি শোনো।’
শশী, রাযীনের গা ঘেষে বসে বলল,
‘বউ ইজ বেটার দ্যান লিসেনার।’
রাযীন হাসল। তারপর শশীকে কাছে টেনে বলল,
‘তোমাকে প্রথম দেখি আমাদের ভার্সিটিতে।’
‘আমাদের ভার্সিটিতে?’
‘জ্বি ম্যাডাম। আপনি আর আমি একই ভার্সিটির স্টুডেন্টস।’
‘রিয়েলি?’
‘হ্যাঁ। আমার গ্রাজুয়েশনের সার্টিফিকেট ওঠানো হয়েছিলো না। গ্রাজুয়েশন করেই তো বাবার ব্যবসায় মন দিলাম। তাই সার্টিফিকেট সংগ্রহ করার তেমন প্রয়োজন পড়েনি বলে, সংগ্রহ করে রাখিনি। হঠাৎ একটা কাজে আমার সার্টিফিকেট প্রয়োজন পড়লো। তো ভার্সিটিতে গেলাম তোলার জন্য। সেদিন ক’জন বন্ধুও একসাথে মিট করলাম। সার্টিফিকেট তুলে সবাই ভাবলাম, কতদিন পর ভার্সিটিতে আসলাম, ক্যাম্পাসটা একটু ঘুরে দেখি। প্রশাসনিক ভবন থেকে ভার্সিটির মাঠের মধ্যে যেতেই দেখলাম মেয়েদের সাইকেল প্রতিযোগিতা হচ্ছে। ভাবলাম রেসটা দেখেই যাই। প্রতিযোগিদের দিকে তাকাতেই একজনার দিকে চোখ আটকে গেল। বলতো সে কে?’
শশী লজ্জা পেলো। রাযীন শশীর গালে চুমো খেয়ে বলল,
‘এই লজ্জাবতীর উপর। তুমি সেদিন ধবধবে সাদা রঙের একটা জামা পরে ছিলে। সাথে হালকা গোলাপি রঙের ওড়না। সেলোয়ার কী রঙের পরেছিলে তা খেয়াল করিনি। সরি।’
শশী রাযীনের পেটে চিমটি কেটে বলল,
‘এত খেয়াল করা কেন লাগবে? তারপর বলো?’
‘সেদিন তুমি রেসে জিততে পারোনি তবে আমাকে জিতে নিয়েছিলে কিছু মুহূর্তেই। আমার মনে সেদিন কিছু তো একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিলো, যে অনুভূতির কোনো নাম নেই, গন্ধ নেই, চিহ্ন নেই, আছে শুধু অনুভূতি। অনুভবে অনুভব করা যায় এমন ভালোবাসাময় অনুভূতি। সেদিন রেসে তুমি সেকেন্ড হয়েছিলে। তখন তোমার নামটাও জেনে ফেললাম ‘শশী’।
তারপর সেদিন সারা ভার্সিটি আমি আর আমার দুই বন্ধু মিলে তোমাকে ফলো করেছি। তোমার ফুচকা খাওয়া দেখেছি, ঝালঝাল সিঙ্গারা খেয়ে তোমার ঠোঁট লাল হতে আর চোখ থেকে পানি পড়তে দেখেছি। দেখেছি চুড়ি কিনতে, বান্ধবীর সাথে কথার ছলে, দুষ্টুমি করে চোখ মারতে, চোখ বড় করতে। ফুচকা খেয়ে লুকিয়ে বান্ধুবীর ওড়নায় হাত মুছতে, ঝাল মুড়ির ঝালে নাক দিয়ে পানি পড়তে, সে পানি ওড়নায় মুছতে দেখেছি।’
শশী, রাযীনের মুখ চেপে বলল,
‘আমি ওমন কিছু করিনি। আমার নাক দিয়ে মোটেও পানি পড়েনি।’
রাযীন হাত সরিয়ে বলল,
‘করেছেন ম্যাডাম। নাক দিয়ে পানিও পড়েছে বাচ্চাদের মতো। আপনি বহুত দুষ্টু মেয়ে। সেদিন সারাটা সময় আমি আপনাকে ফলো করেছি। ফলো করতে করতে আপনার বাসা পর্যন্ত গিয়েছি। সেদিন আপনার কারণে আমার হাতে থাকা সার্টিফিকেটও হারিয়ে গিয়েছিলো। পরে সেটা আবার কালেক্ট করতে কত ঝামেলা পোহাতে হয়েছে জানো?
তারপর থেকে আমার একজন না একজন লোক তোমাকে ফলো করতো। তোমার সবকিছু আমাকে জানাতো। তোমার প্রতিটা মুহূর্তের খবর পেয়ে যেতাম আমি। তোমাকে দেখার তিনদিন পরই আমি তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই। তখন জানতাম না, তোমার সাথে সজলের রিলেশন চলছে। তুমি কল করে বলার পর জেনেছিলাম। তারপর তোমার জীবন থেকে দূরে সরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেও, তোমাকে ফলো করা বন্ধ করতে পারিনি। তারপর সজলের সম্পর্কেও সবরকম খোঁজ খবর নেই। মাস দেড় কি দুই আগে এমন কিছু জানলাম যা থেকে মনে হলো সজল তোমার জন্য একদম ঠিক নয়। তো তোমাকে পাবার জন্য আরেকটা চান্স নিলাম। আর এবার সত্যি সৃষ্টিকর্তা আমাকে নিরাশ করেননি। তাই তো শশী আজ আমার ঘর আলোকিত করছে।’
শশী মৃদু হেসে বলল,
‘বাহ সাধারণের মধ্যে অসাধারণ তোমার প্রেমের গল্প। রাযীন আমি তোমাতে সত্যি মুগ্ধ।’
‘ভালোবাসো?’
শশী মাথা নিচু করে রইল। রাযীন ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ওটাও শীঘ্রই হয়ে যাবে জানি আমি।’
শশী, রাযীনের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বলল,
‘রাযীন?’
‘হ্যাঁ।’
‘সজলের সম্পর্কে কী এমন জেনেছিলে যার কারণে তোমার মনে হয়েছে, সজল আমার জন্য পারফেক্ট নয়?’
রাযীন, শশীকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে বলল,
‘সেটা তোমার না জানলেও চলবে।’
‘প্লিজ বলো?’
‘প্লিজ জানপাখি জানতে চেও না। আমি একজনের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’
‘কার কাছে?’
‘তোমাকে সেটাও বলা যাবে না।’
‘কেন?’
‘শশী আমাকে ভরসা করো?’
শশী বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
‘নিজের চেয়ে বেশি।’
রাযীন খানিকটা অবাক হয়ে বলল,
‘শশী সত্যি তুমি আমাকে নিজের চেয়ে বেশি ভরসা করো?’
শশী, রাযীনের দুই গালে, দুই হাত দিয়ে, ওর চোখে চোখ রেখে বলল,
‘হ্যাঁ।’
শশীর চোখে, রাযীন নিজের জন্য সত্যি ভরসা দেখতে পাচ্ছে। রাযীনের এত ভালো লাগল, নিজের অজানেই রাযীনের ঠোঁট শশীর চোখ ছুঁয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। তারপর বলল,
‘যদি ভরসা করো, তাহলে ভরসা রেখো। তুমি কষ্ট পাও এমন কিছু আমি কখনও করব না। আর আমি যখন চাই না ঐ কথাগুলো তুমি না জানো, তাহলে সেটা তোমার জন্য জানা সত্যি উচিত হবে না। প্লিজ ভরসা করো।’
শশী হেসে বলল,
‘ওকে।’
চলবে……
#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিলো
লেখকঃ শারমিন আক্তার সাথী
পর্বঃ২৬
৩৬!!
সকাল থেকেই রেনু, শিহাবকে এড়িয়ে চলছে। শিহাবের কাছে যাচ্ছে কিন্তু কথা বলছে না। ঠিক ইগনোর করছে বললেও ভুল হবে, রেনু আসলে খুঁজে পাচ্ছে না শিহাবের সাথে কী কথা বলবে? রেনু ইচ্ছা করেই শিহাবের সামনে বেশি আসছে না। কিন্তু আজ শুক্রবার হওয়ার কারণে রেনু চেয়েও শিহাবকে বেশি এড়াতে পারছে না। না চাইতেও বারবার দেখা হচ্ছে। রেনুর এহেনো ব্যবহারে শিহাবের খুব খারাপ লাগলেও, সে চুপ করে আছে। ও রেনুকে নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়ার সময় দিচ্ছে।
রান্না করার সময় রেনু শিহাবের কথা ভাবতে ভাবতে গরম তেলের কড়াইতে মাছ দিচ্ছিল, যার ফলাফল রেনু হাত পুড়িয়ে ফেলল। লিপি, রেনুর হাতে বার্নজেল লাগাতে লাগাতে বলল,
‘রেনু, আজ তোর খেয়াল কোথায় রে? এত আনমনা কেন? দেখ হাতটা কতখানি পুড়ে গেছে?’
রেনুর চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়তে লাগল। রেনু চোখ মুছতে মুছতে বলল,
‘ভাবি, যেখানে হৃদয়টা জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হচ্ছে, সেখানে সামান্য হাতের জ্বলানি কী করবে?’
‘কী হয়েছে? বল আমাকে? শিহাব ভাই কিছু বলেছেন?’
রেনু কিছু বলতে যাবে তখন রান্নাঘরে হাসি বেগম আসলেন। রেনু চুপ হয়ে গেল। লিপি চুপি চুপি চোখ ইশারায় বলল,
‘পরে বলিস।’
লিপি, হাসি বেগমকে বলল,
‘মা কিছু লাগবে?’
‘না। দেখতে আসলাম তোমাদের রান্না কতদূর। আযান তো দিয়ে দিলো। ওরা সবাই এখন জুম্মার নামাজ পড়তে যাবে, এসেই তো টেবিলে বসে যাবে। সপ্তাহে এই একদিনই তো সবাই মিলে একসাথে খাওয়া হয়। জলদি রান্না শেষ করো।’
লিপি বলল,
‘সব-ই হয়ে গেছে মা, শুধু মাছ ভাজাটা বাকি। মাছ ভাজতে গিয়ে রেনুর হাতে গরম তেল ছিটেছে। অনেকটা পুড়ে গেছে। তাই ওর হাতে বার্নজেল লাগিয়ে দিচ্ছিলাম।’
হাসি বেগম বেশ বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘একটা কাজ যদি ঠিকমতো করতে পারে। নিজের খেয়ালটাও ঠিকমতো রাখতে পারে না। মাছ কোথায়? দাও আমি ভেজে ফেলছি। তোমরা যাও যে যার মতো গোসল সেরে নামাজ পড়ো। নামাজ শেষ করে টেবিলে খাবার দাও।’
লিপি আচ্ছা বলে রেনুকে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
‘এখন তো শুনতে পারব না। বিকালে বলিস তখন শুনব।’
রেনু মাথা কাত করে সম্মতি জানাল। রুমে গিয়ে রেনু বাথরুমে ঢুকে অনেক কাঁদল। গোসল সেরে নামাজ পড়ে, মোনাজাতে অনেক কাঁদল। নিজে নিজে বিড়বিড় করে বলল,
‘হে আল্লাহ কেন করছো তুমি আমার সাথে এমন? আমি কী তোমার এতটাই অপ্রিয়? যখনই একটু সুখের মুখ দেখি তখন-ই কোথা থেকে যেনো কষ্টরা এসে ঘিরে ধরে। কেন করছো আমার সাথে এমন? আমার কী একটু ভালো থাকার অধিকার নেই? আমি বুঝতে পারছি না আমি কী করব? শিহাবকে অপরাধী ভাববো নাকি ক্ষমা করে দিব? একবার মনে হচ্ছে,শিহাবের কোনো দোষ নেই। ওর সাথে অন্যায় হয়েছে। আবার মনে হয়, উনি আমার সাথে অন্যায় করেছেন। আমার কাছ থেকে সত্য গোপন করে উনি অনেক অন্যায় করেছেন। হে আল্লাহ তুমি আমাকে পথ দেখাও। আমাকে সাহায্য করো। আমি চাই আমার আর শিহাবের সম্পর্কটা খুব ভালো থাকুক। শিহাব খুব ভালো মানুষ। আমি এ-ও জানি তিনি আমাকে খুব ভালোবাসেন। কিন্তু আমার সবকিছু এখন এলোমেলো লাগছে। কোনটা ঠিক কোনটা ভুল তা ভেবে পাচ্ছি না! আমাকে সঠিক পথ দেখান আল্লাহ। আমি শিহাবের সাথে থাকতে চাই, ওর সাথে ভালো থাকতে চাই। তাকে আমি ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি।’
নামাজ শেষে রেনু উঠে দেখে শিহাব বিছানায় বসে রেনুর দিকে তাকিয়ে আছে। শিহাবের মুখ প্রচন্ড ভার হয়ে আছে। শিহাব, রেনুর কাছে জিজ্ঞেস করল,
‘রেনু কান্না করে আল্লাহর কাছে আমার নামে অভিযোগ করলে?’
রেনু দৌড়ে দিয়ে শিহাবকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘কী সব আজেবাজে কথা বলছেন? আমি কেন আল্লাহর কাছে, আপনার নামে অভিযোগ করব?’
‘তাহলে অত কাঁদছিলে কেন?’
‘আমার মন ভার হলে আমি আল্লাহর সাথে কাঁদি। তাকে নিজের মনের কষ্টের কথা বলি। যাতে তিনি আমার উপর রহমত করেন। আমার মনকে শান্ত করেন।’
‘তোমার মন কি শান্ত হয়েছে?’
‘একটু।’
‘রেনু খেয়াল করে শোনো, আজ জুম্মার দিন আমি আল্লাহর কসম কেটে বলছি, তোমাকে আমি অসম্ভব ভালোবাসি, নিজের চেয়েও অনেক বেশি। হ্যাঁ, তোমাকে আমার অতীতটা না জানিয়ে আমি অন্যায় করেছি, কিন্তু আমি তোমাকে হারানোর ভয়ে জানাতে পারিনি। একবার তোমায় হারিয়ে পাগল পাগল হয়ে গেছিলাম। তারপর বহু কষ্টে তোমাকে পেয়েছি। সৃষ্টিকর্তার দরবারে অনেক চাইবার পর তোমাকে পেয়েছি। সেই তোমাকে নিজের ভুলে হারিয়ে ফেলি কী করে বলো? তোমাকে হারানোর ভয়েই আমি এতদিন ঐসব কথা বলতে পারিনি।’
রেনু কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘হ্যাঁ আমি বুঝতে পেরেছি। তবে আপনার সত্যিটা বলা উচিত ছিলো।’
‘আমার ভুল হয়ে গেছে। সরি রেনু। মাফ করে দাও।’
‘হুম বুঝতে পেরেছি।’
‘ও রেনু আমি সত্যি তোমায় অনেক ভালোবাসি।’
‘আমিও। আমিও।’
শিহাব, রেনুর কপালে, চোখে গভীর আবেশে চুমো খেয়ে বলল,
‘তুমি আমাকে একটু সময় দাও, আমি তোমার সব কষ্ট দূর করে দিব। তোমার জীবন সুখে ভরিয়ে দিব।’
রেনু কিছু বলল না। শুধু শিহাবের বুকে মুখ লুকালো।
লিপি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওদের কান্ড দেখে মুখ টিপে হেসে, গলা খাকরি দিলো। রেনু, শিহাব দুজনেই চমকে তাকাল। লিপি হেসে বলল,
‘আজ শুক্রবার, জুম্মার নামাজের পর কত সুন্দর চমৎকার একটা পবিত্র মুহূর্তের সাক্ষী হলাম। বাহ্ ভালো লাগছে। তা রেনু হৃদয়ের জ্বলন কমেছে তোর?’
রেনু লজ্জায় মাথা নিচু করে রইল। লিপি, শিহাবকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘শিহাব ভাই রেনুর মন খুব খারাপ। বুঝতে পারছি আপনাদের মধ্যে কোনো সমস্যা হয়েছে। আপনাদের সমস্যা আপনারাই সমাধান করবেন, আমি নাক গলাব না। রেনু বহুদিন অসুস্থ ছিলো। বেটার হয় আজ বিকালে ওকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসুন। ওর মনটা ভালো হবে। শুনেছি নতুন পার্ক হয়েছে আমাদের পাশের এলাকায়। সেখান থেকে ঘুরে আসুন, দরকার হলে রাতের খাবার খেয়ে আসেন। এখন দুপুরের খাবার খেতে আসেন।’
দুপুরের খাবারে পর শিহাব, রেনুকে নিয়ে সত্যি-ই ঘুরতে যাবার জন্য তৈরী হতে বলল। রেনুর খু্ব ভালো লাগল। বিয়ের পর ডাক্তারে কাছে যাওয়া ছাড়া শিহাবের সাথে রেনুর কোথাও বের হওয়া হয়নি। রেনু ভাবল,
‘ঘুরতে যাবার কারণে হয়তো দুজনারই হালকা হবে, ফলে দু’জন দু’জনাকে ভালোভাবে বুঝতে পারবে। দু’জনার মাঝের তৈরী হওয়া দূরত্বটাও হয়তো কমে যাবে।রেনু হালকা নীল রঙের স্লিক শাড়ি পরে, হিজাব বাঁধার জন্য চুল সেট করছিলো। শিহাব তখন পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘রেনু তোমাকে এত কেন সুন্দর লাগে? মনে হয় সবসময় সামনে বসিয়ে তাকিয়ে থাকি! নীল শাড়িতে তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, আজ ঘুরতে যাওয়া ক্যান্সেল করে শুধু তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি।’
রেনু লজ্জায় মাথা নিচু করে বলল,
‘না আমি ঘুরতে যাবো। বিয়ের পর আমাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে বের হয়েছেন? এখন আপনাকে বয়স নিয়ে খোঁটা দিলেই রাগ করবেন। অথচ বয়ষ্কদের মতোই আপনার চালচলন।’
শিহাব মৃদু হেসে বলল,
‘আচ্ছা সরি। এখন থেকে মাসে অন্তত তিনবার তোমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবো।’
‘তিন বার লাগবে না। মাসে একবার ঘুরতে নিয়ে গেলেই হবে। শিহাব সাহেব স্ত্রীকে খুশি করতে লাখ লাখ টাকা লাগে না; মাঝে মাঝে একটু ঘুরতে নিয়ে গিয়ে বিশ টাকার ফুচকা খাওয়ালেই সে অনেক খুশি হয়। অথবা কাজ থেকে ফেরার পথে, হাতে করে একমুঠো কাঁচের চুড়ি কিংবা একটা দুটো ফুল। কতইবা দাম তার? হয়তো বিশ বা ত্রিশ টাকা। অথবা মাঝে মাঝে ফেরার পথে তার জন্য চটপটি কিংবা চকলেট নিয়ে আসলেন। বাস এতেই মহাখুশি স্ত্রী জাতি। স্ত্রীকে খুশি করতে দামি, শাড়ি, গয়না লাগে না। তাকে একটু বেশি এটেনশন দিলেই হয়। সে যখন সাজে, তার একটু প্রশংসা করুন কারণ সাজে তো সে মূলত স্বামীর প্রশংসা পাবার জন্য-ই। অথবা শাড়ি কুঁচি ঠিক করে দেয়া, তার কাজের সময় রোমান্টিকভাবে তাকে বিরক্ত করা। কথায় কথায় তাকে ছুঁয়ে দেয়া। অসুস্থতায় একটু খেয়াল রাখা। এক সাথে বসে চা খাওয়া। অথবা অলস বিকালে একে অপরের কাছে বসে, হাতে হাত রেখে একটু রোমান্টিক গল্প করা। এর চেয়ে বেশি কিছু অধিকাংশ স্ত্রীরা কিছু চায় বলে আমার মনে হয় না। এসবের মূল্য কী খুব বেশি?’
শিহাব অবাক হয়ে বলল,
‘এসব তো ছোটো কাজ? এসব করলে স্ত্রীরা খুশি হয়?’
‘এসব ছোটো ছোটো ভালোবাসায় একটা মেয়ে যে কতটা মুগ্ধ হয় তা কেবল মেয়েরাই জানে। মেয়েরা অল্পতে কষ্ট পায়, কাঁদে আবার অল্পতেই মহাখুশি হয়। কোনো স্বামী যদি তার স্ত্রীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলোর দিকে নজর দেয়, সেসব কাজ করে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভালোবাসা প্রদান করে, তবে সে ব্যক্তির স্ত্রীকে খুশি করতে দামি কিছু লাগে না। স্ত্রীকে খুশি করার জন্য কিছু ট্রিক্স খাটান লাগে। তার ছোটো ছোটো ইচ্ছে পূরণ করলেই হয়। ক্ষুদ্র চাহিদা পূরণ হলে, তার বৃহৎ চাহিদা আর হয়ে ওঠে না। কারণ স্বামীর দেয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভালোবাসাকেই সে সাগর সমান বানিয়ে ফেলে, সে তার স্বামীতে তৃপ্ত থাকে, তাকে তার চেয়ে লক্ষগুন বেশি ভালোবাসা দেয়।
শিহাব হেসে বলল,
‘ওহ জেনে খুশি হলাম। আমিও ট্রাই করব।’
রেনু মৃদু হাসল। শিহাব বলল,
‘এখন চলো।’
লিপি সাজ্জাদের কাছে গিয়ে বলল,
‘সাজ্জাদ চলো কোথাও ঘুরে আসি।’
সাজ্জাদ বেশ অবাক হয়ে বলল,
‘তুমি ঘুরতে যাবে আমার সাথে?’
‘হ্যাঁ। কেন? যেতে পারি না?’
‘না না কেন পারো না? বিগত কিছু বছরে আমি এত বলেও তোমাকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যেতে পারিনি। সবসময় আমি আর সাহির গিয়েছি।’
‘আজ থেকে আমিও যাবো।’
তারপর কিছুক্ষণ নীরব রইল দু’জনেই। সাজ্জাদ বলল,
‘কখনো কী মন থেকে মাফ করতে পারবে আমায়?’
লিপি মলিন হেসে বলল,
‘আমার মনে হয় আমাদের সম্পর্ককে আরেকটা সুযোগ দেওয়া দরকার। আর কিছু না হোক সাহিরের কথা ভেবে। যাতে সাহির বড় হয়ে বুঝতে না পারে আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা আর পাঁচটা দম্পত্তির মতো না। আমাদের এখন থেকেই চেষ্টা করা উচিত স্বাভাবিক সুস্থ একটা সম্পর্ক তৈরী করার।’
সাজ্জাদ বসা থেকে উঠে লিপির গালে হাত দিয়ে বলল,
‘আমি তোমায় ভালোবাসি লিপি।’
লিপির চোখ ভরে এলো। চোখ বন্ধ করে বলল,
‘কতদিন পর বললে এ কথাটা।’
সাজ্জাদ, লিপির গালে হাত রেখে-ই বলল,
‘আজ থেকে প্রতিদিন বলব।’
এখানে একটু থামুন একটা কথা শুনুন। যাকে ভালোবাসবেন তাকে সবসময় নিজের ভালোবাসার কথা প্রকাশ করবেন। কারণ আপনার কাছের মানুষটিও চায় তাকে আপনি কতটা ভালোবাসেন তার প্রকাশ করুন। কথায় না হোক কাজে প্রকাশ করুন। তবুও নিজের ভালোবাসার ক্ষেত্রে মুখচোরা না হয়ে প্রকাশ করুন। দেখবেন সম্পর্ক সুন্দর থেকেও সুন্দরতম হবে।
আর শুনুন গল্প পড়ে কমেন্ট করেন না কেন? বড় বড় কমেন্ট করবেন। আপনাদের কমেন্ট পড়ে আমার সময়টা সুন্দর থেকে সুন্দরতম কাটে। হ্যাঁ হয়তো মাঝে মাঝে অতি ব্যস্ততায় কমেন্ট রিপলাই করতে পারি না। তবে প্রতিটা কমেন্ট আমি খুব গুরুত্বসহকারে পড়ি।
চলবে….