#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিলো
লেখক: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ৩৯
রায়হান রহমান ওখানে না দাঁড়িয়ে সোজা ডাক্তারের কাছে গেলেন বিস্তারিত জানতে। তার সাথে সাথে সাজ্জাত এবং নূর ইসলামও গেলেন। ডাক্তার সাহেব, রায়হান রহমানকেও সে কথাই বললেন, যে কথাগুলো শশীদের বলেছিলেন।
শশী, হাসি বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘মা ওর কিছু হবে না তো?’
হাসি বেগম কান্না ভেজা কণ্ঠে বললেন,
‘কিছু হবে না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। কিছু হবে না রাযীনের! দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবে ও। তুই শুধু ওর জন্য দোয়া কর।
রাতের শেষ ভাগটা কী যে দুর্বিষহ কাটল সবার, তা কেবল তারাই জানে! রাসেল আর সুমি চলে আসল। ওদের সাথে রোমিসাকে নিয়ে গেল। বাকি কেউ যেতে রাজি হলো না। শশী তো বারবার আইসিইউ এর দরজার কাছে গিয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে, তারপর ঐ দরজার কাছেই ফ্লোরে বসে থাকে। হাসি বেগম এসে বারবার ওকে তুলে নিয়ে বেঞ্চে বসায়।
শশীর বারবার এমন অনুভূতি হচ্ছে যেন দমটা বন্ধ হয়ে মরে যাবে। শশী মনে মনে বলল,
‘সজলকে তো আমি বহু বছর যাবত চিনতাম, জানতাম, কই ও যখন ছেড়ে গেল, তখন তো এতটা কষ্ট হয়নি। আজ রাযীনের জন্য যতটা কষ্ট অনুভব হচ্ছে ততটা কখনও হয়নি। মনে হচ্ছে প্রাণটা যে কোনো সময় শরীর থেকে বের হয়ে যাবে। এই তো মাত্র কয়েকঘন্টা আগ পর্যন্তই আমার সারা শরীরে শুধু রাযীনকে অনুভব করেছি। প্রতিটা লোমকূপে ওর বিচরন অনুভব করেছি। এখনও তার রেশ রয়ে গেছে। কিন্তু এখন আমার শরীরে রাযীনের রেশ আর মনে ওকে হারানোর তীব্র ভয়। আমি নিজেকে কেন স্বাভাবিক রাখতে পারছি না! ও রাযীন এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না। তুমি তোমার কথা রাখলে না। কথা তো ছিলো আমার নিজ হাতে তুমি শাড়ি পরিয়ে দিবে, ভালোবাসার এক রঙিন দুনিয়ায় নিয়ে যাবে। যেখানে তুমি আমি ছাড়া কেউ থাকবে না। তুমি তোমার কথা রাখলে না রাযীন! তুমি না বলেছিলে, আমি তোমার প্রাণ। আমি কষ্ট পেলে তোমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়। তবে তুমি কেন আমাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছো? রাযীন জলদি উঠো। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রাযীন। খুব।’
৪৬!!
সকাল দশটা।
ডাক্তার রাযীনকে চেক করে দেখল, ওর কন্ডিশন ইমপ্রুভ হচ্ছে খুব দ্রুত। ডাক্তার মনে মনে বলল,
‘বাহ যত দ্রুত ওর কন্ডিশন ঠিক হচ্ছে, মনে হচ্ছে দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবে। এখন প্যারালাইজড হয়ে যাবার ভয় না থাকলে আরও বেটার হতো। ডাক্তার মারুফকে কল করলেন। কারণ মারুফ বলেছিলো, রাযীনের অবস্থার কথা সর্বপ্রথম ওকে জানাতে। ডাক্তার মারুফকে সবটা জানানোর পর মারুফ বলল,
‘ডাক্তার সাহেব এখন কাউকে রাযীনের ব্যাপারটা জানাবেন না। আমরা খুনি কে তা জানতে পেরেছি। আমরা ঘন্টা দুই পর হাসপাতালে আসছি। আপনি ততক্ষণ তাদের কিছু একটা বলে দিন।’
‘আচ্ছা।’
দুপুর বারোটা,
পুলিশ এসে সবার কাছে টুকটাক কথা জিজ্ঞেস করলেন? যেমন রাযীন কেমন মানুষ ছিলো? ওকে কেউ মারার মতো ষড়যন্ত্র করতে পারে কিনা? ওর কোনো শত্রু আছে কি-না? ইত্যাদি? ইত্যাদি?
সবার উত্তর-ই প্রায় একই। রাযীন এত ভালো মানুষ ছিলো যে, ওর কোনো শত্রু থাকতে পারে না! ওকে কেউ মারার কথা ভাবতেও পারে না। মারুফ সবার শেষে আসল শশীর কাছে। শশীকে জিজ্ঞেস করল,
‘কালকে আপনারা বাসায় কে কে ছিলেন?’
‘আমি আর রাযীন।’
‘আর কেউ এসেছিলো?’
‘না।’
‘কালকে রান্না কী কী করেছিলে?’
শশী বেশ বিরক্ত হয়ে বলল,
‘এগুলো কোন ধরনের প্রশ্ন?’
‘যা জিজ্ঞেস করছি তার সরাসরি উত্তর দিন। কি কি রান্না করেছিলেন?’
‘চিংড়ি মাছ, পালং শাক, আলু ভাজি, ডাল।’
‘রাযীন সাহেব কি কি খেয়েছিলেন?’
‘সবগুলো থেকেই অল্প অল্প পরিমাণ খেয়েছিলো।’
‘আপনি খেয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনি কি কি খেয়েছিলেন?’
‘চিংড়ি মাছ বাদে বাকি সবগুলো থেকেই একটু একটু খেয়েছিলাম।’
‘চিংড়ি মাছ কেন খাননি?’
মারুফের প্রশ্নের উত্তর দিতে শশীর খুব রাগ হচ্ছে। তবুও রাযীনের কথা ভেবে দিচ্ছে।
‘আমার চিংড়ি মাছে খুব বাজে রকম এলার্জি হয় চোখে।’
‘ডিনার কখন করেছিলেন?’
‘রাত সাড়ে আটটার দিকে।’
‘ওহ। কাল সত্যি আপনার বাসায় আপনি আর রাযীন বাদে কেউ আসেনি?’
‘সুমি আপা এসেছিলেন মাগরিবের সময়। তবে তিনি দুই মিনিটও দাঁড়াননি, ভিতরেও প্রবেশ করেননি। আমার একটা বই তার কাছে ছিলো। সেটা ফেরত দিতে এসেছিলের। দরজা থেকেই ফেরত দিয়ে চলে যান।’
‘সত্যি মিসেস সুমি ভিতরে ঢোকেনি?’
‘নাহ।’
‘আপনার আর আপনার স্বামীর সম্পর্ক কেমন ছিলো?’
‘স্বপ্নের মতো সুন্দর।’
‘তাহলে সজলের সাথে কী ছিলো আপনার?’
সজলের নাম শুনতেই শশীর মুখটা চুপসে গেল। মারুফ সবার সামনে দাঁড়িয়ে শশীর হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে বলল,
‘মিসেস শশী, মিঃ রাইয়্যান রহমান রাযীনকে হত্যা করার চেষ্টার জন্য আপনাকে গ্রেফতার করা হলো।’
সবাই হতভম্ব হয়ে মারুফের কথা শুনছে। সবার বিস্ময় এতটা যে, কেউ কিছু বলতে পর্যন্ত পারছে না। বিস্ময়ে শশী যেনো বোবা হয়ে গেল। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ওর হাতে পরানো হ্যান্ডকাপের দিকে তাকিয়ে রইল। রায়হান রহমান বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
‘এগুলো কোন ধরণের মজা?’
মারুফ হেসে বলল,
‘আপনার সত্যি মনে হচ্ছে আমি মজা করছি?’
রায়হান রহমান বেশ রাগ করেই বললেন,
‘নয়তো কী? শশী তার স্বামীকে কেন মারার চেষ্টা করবে?’
‘জি তিনি-ই হয়তো রাযীন সাহেবকে মারার চেষ্টা করেছেন। গতকাল রাতে রাযীন সাহেবর এক্সিডেন্ট এমনি এমনি হয়নি। বরং তাকে প্রথমে বিষযুক্ত খাবার খাওয়ানো হয়েছিলো। বিষেরl প্রভাবেই তিনি গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রং সাইডে চলে যান। ফলাফল ভয়াবহ দূর্ঘটনা। দূর্ঘটনা না হলেও হয়তো তিনি মারা যেতেন। বরং দূর্ঘটনা ঘটার কারণে বেঁচে আছেন। কারণ দূর্ঘটনা হওয়ার কারণেই তাকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয় এবং ডাক্তাররা তাকে যথাযথ চিকিৎসা দিতে পারেন। রাযীন সাহেবকে কিন্তু কোনো সাধারণ বিষ নয় বরং সাপের বিষ দেওয়া হয়েছিলো। তার ভাগ্য ভালো ছিলো যে, এখনও তিনি বেঁচে আছেন।
রায়হান রহমান রাগ করে বলল
‘কী বেহুদা কথা বলছেন? শশী কেন রাযীনকে বিষ দিয়ে মারবে?’
‘আপনার গুনধর বউ মা গতকাল আপনার ছেলের জন্য চিংড়িভূনা করেছিলো। বিষ সেই তরকারিতেই ছিলো। যেহেতু শশী ম্যাডামের চিংড়ি মাছে সমস্যা সে কারণে তিনি খাননি। রাযীন সাহেবও হয়তো তাকে খেতে জোরও করেননি। বাইরে থেকেও কোনো লোক আসেনি তাদের ঘরে। তাহলে খাবারে কে বিষ মেশালো?
আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম রাযীন সাহেব বাইরের কোনো খাবার খেয়েছেন বিষটা তাতে ছিলো। আমরা তার বিষয়ে তার অফিসে খোঁজ নিয়েছি, তিনি অফিসে দুপুর একটায় লাঞ্চ করেছিলেন। তার সাথে আরও আঠারোজন লাঞ্চ করেছেন। তারা দিব্যি সুস্থ আছেন। আর বিষটা যদি তাকে দুপুরে দেওয়া হতো তাহলে তিনি দুপুরের পর পরই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। কিন্তু তিনি রাত নয়টার পর অসুস্থ হয়। মানে তাকে তার কিছু পূর্বে বিষটা খাওয়ানো হয়েছে। আপনার বউ মায়ের ভাস্যমতে তারা সাড়ে আটটায় ডিনার করেছিলেন। আমরা তাদের টেবিলে পাওয়া খাবার ল্যাবে পাঠিয়ে টেষ্ট করিয়েছিলাম। চিংড়ি মাছের তরকারিতেই বিষটা ছিলো এবং বেশ ভালো মাত্রায়ই ছিলো।’
সবাই চূড়ান্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে মারুফের কথাগুলো শুনছে। সাজ্জাত বেশ রাগ করে বলল,
‘কতক্ষণ যাবত উল্টা পাল্টা বকে যাচ্ছেন। এত কিছু যখন বলছেন, তখন এটাও বলেন রাযীনকে মারার পিছনে শশীর মোটিভ কী?’
মারুফ মৃদু হাসল। তারপর বলল,
‘সাজ্জাদ সাহেব আপনার বোন কখনও রাযীন সাহেবকে ভালোবেসেছে বলে মনে হয় না? কারণ বিয়ের পূর্বে তার সজল নামের একটি ছেলের সাথে বহু বছরের সম্পর্ক ছিলো। কী কারণে তারা বিয়ে করেননি সেটা আপাতত জানি না! তবে শীঘ্রই জেনে যাবো। ছেলেটির সাথে তার বিয়ের পরও যোগাযোগ আছে। সজল নামের ছেলেটি চট্টগ্রামও এসেছিলো। এমনকি আপনার পুত্রবধূর সাথে দেখাও করে গেছে। বিশ্বাস না হলে তাকেই জিজ্ঞেস করুন।’
শশী এতটাই বিস্ময়ে আছে যে, নিজের পক্ষে পর্যন্ত কোনো কথা বলতে পারছে না! রাযীনের চিন্তা মাথায় এমনভাবে গেড়ে গেছে যে বাকি নিজের খেয়ালও করতে পারছে না। তার উপর মারুফের কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মারুফ বলল,
‘কি মিসেস শশী কেন মারতে চেয়েছিলেন আপনার স্বামীকে।’
শশীর এত রাগ হলো যে, ঠাস করে মারুফের গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো। পাশে থাকা মহিলা পুলিশ শশীকে কিছু বলতে আসলে মারুফ তাকে বাঁধা দেয়। শশী বলল,
‘আমি রাযীনকে ভালোবাসি। ওকে মারার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। আমি ওকে কেন মারব?’
‘তাহলে চট্টগ্রাম সজল কেন এসেছিলো?’
শশী বেশ শক্ত কণ্ঠে বলল,
‘আপনি এটা জানেন সজল চট্টগ্রাম এসেছিলো কিন্তু এটা জানেন না, যে যেদিন আমি সজলের সাথে দেখা করেছিলাম সেদিন রাযীন আমার সাথেই ছিলো।’
মারুফ খানিকটা অবাক হয়ে বলল,
‘কী?’
‘হ্যাঁ। রাযীন আমার আর সজলের অতীতের ঘটনার বিষয়ে সব জানত। সেদিন সজল এসেছিলো ওর পূর্বের করা কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে। রাযীন তখন সামনে ছিলো। পরে রাযীন নিজে বলেছে আমি যেনো সজলকে ক্ষমা করে দেই। হ্যাঁ বিয়ের আগে সজলের সাথে আমার একটা সম্পর্ক ছিলো, কিন্তু সেটা বিয়ের আগ পর্যন্ত। যেদিন থেকে আমার বিয়ে হয়েছে, আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে রাযীনের করে দিয়েছি। আমি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে সম্মান করি। সবচেয়ে বড় কথা আমি রাযীনকে ভালোবাসি। নিজের চেয়েও হাজারগুন বেশি ভালোবাসি।’
মারুফ তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
‘নিজে বাঁচার জন্য ভালোবাসার বাহানা অনেকে দেয়। আপনাদের বিয়ে হলো দেড় মাসের কিছু বেশি, এখনও দুই মাস হয়নি, এর মধ্যে আপনি রাযীন সাহেবকে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবেসে ফেললেন? ব্যাপারটা হাস্যকর না? যেখানে স্বামী-স্ত্রী বছরের পর বছর একসাথে থেকে একে অপরকে ভালোবাসতে পারে না, সেখানে আপনি মাত্র দেড়-দুই মাসে নিজের থেকে বেশি ভালোবেসে ফেললেন? তা-ও যেখানে আপনার পূর্বে একটা রিলেশন ছিলো। এটা বড়ই হাস্যকর লাগল।’
শশী কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। চোখ থেকে যেনো পানির ফোয়ারা বহিত হচ্ছে। মারুফ লেডি অফিসারকে বলল,
‘উনাকে নিয়ে চলুন।’
হাসি বেগম, নূর ইসলামকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
‘তুমি চুপ করে আছো কেন? আমার মেয়েটাকে তো পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে। ঐ সাজ্জাদ কিছু কর?’
মারুফ বলল,
‘সরি ম্যাডাম, বলেও কোনো কাজ হবে না! সব প্রমাণ আপনার মেয়ের বিরুদ্ধে। তাছাড়া আমাদের কাছে গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে।’
রায়হান রহমান বললেন,
‘আমরা তো কোনো কেস কিরিনি।’
‘আপনারা করেননি বাট মিস্টার রাসেল করেছেন। তাছাড়া আপনারা কেস করার পূর্বেই পুলিশ এ কেসে যুক্ত হয়েছে। তো আপনারা রাজি হোন বা না হোন মিসেস শশীকে আমরা গ্রেফতার করব।’
রায়হান রহমান রাসেলের দিকে ঘুরে বলল,
‘রাসেল, তুমি আমার কাছে জিজ্ঞেস না করে কেস কেন করেছো?’
রাসেল খুব বিনয়ের সাথে বলল,
‘ছোট্ট আব্বু, ক্ষমা করবেন আমাকে। যখন শুনলাম রাযীনের খাবারে বিষ ছিলো, তখন আমার এতো রাগ হলো যে, খুনিকে ধরার জন্য কেস করে দিলাম। তাছাড়া আমি কীভাবে জানব শশী, রাযীনকে মারতে চেয়েছে? আমি তো ভেবেছি আপনাদের অফিসের কেও।’
রায়হান রহমান, রাসেলকে আর কিছু বলতে পারল না। মারুফকে বললেন,
‘আমার বিশ্বাস শশী এমন কিছু করেনি। আপনি শশীকে ছেড়ে দিন। বাকিটা আমি থানায় গিয়ে এবং আপনাদের সিনিয়রের সাথে কথা বলে সামলে নিব।’
‘সরি স্যার আমরা একজন খুনীকে এভাবে ছাড়তে পারি না। আপনার ছেলের বিপদ হতে পারে।’
‘সেটা আমি দেখব। আমি শশীকে ছেড়ে দিন।’
পিছন থেকে মিতু বলে উঠলেন,
‘না ওকে একদম ছাড়বেন না। আমার ছেলেটা ওকে এতটা ভালোবাসলো, আর ও তাকেই মারতে চাইল? এই শশী তুই তো জানতি রাযীন তুই বলতে পাগল! তাহলে কী করে পারলি আমার ছেলেটাকে বিষ দিতে? যে ছেলেটা সারাদিন শশী শশী করে পাগল করে রাখত, তাকে কী করে পারলি বিষ খাওয়াতে? কী কমতি ছিলো আমার ছেলের মাঝে, তার ভালোবাসার মাঝে? কী ত্রুটি ছিলো আমার পরিবারের মাঝে? অফিসার ওকে নিয়ে যান, আমি আমার ছেলের উপর ওর ছায়াটাও পড়তে দিব না।
শশী কান্না করতে করতে বলল,
‘মা, বিশ্বাস করুন আমি সত্যি রাযীনের সাথে কোনো অন্যায় করিনি। রাযীনের ভালোবাসায় কোনো কমতি ছিলো না, আর না আপনাদের ভালোবাসায়। বরং রাযীনের মতো জীবন সঙ্গী পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার!’
মিতু বেশ রাগ করে বলল,
‘তাহলে সহজলের সাথে তোর কী সম্পর্ক? সে কে হয় তোর?’
‘মা, বললাম তো সজল আমার অতীত মাত্র। কার জীবনে অতীত থাকে না বলেন মা? বুঝার চেষ্টা করুন মা!’
‘আমি কিছু বুঝতে চাই না। তুই আমার একমাত্র ছেলেকে মারতে চেয়েছিলি তোকে আমি ক্ষমা করব না।’
রায়হান রহমান বললেন,
‘মিতু মাথা ঠান্ডা করো। তুমি মা, তোমার আবেগটা বুঝতে পারছি কিন্তু এখন তুমি শশীকে পুলিশের হাতে তুলে দিলে, তারপর রাযীনের যখন হুস ফিরবে, সে যদি বলে, শশী এমন কিছু করেনি, তাহলে আমরা কেন শশীকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি? তাহলে তুমি কী বলবে রাযীনকে?’
‘তখনকার জবাব আমি দিব। এখন ওকে আমি আমার ছেলের আসে পাশেও দেখতে চাই না।’
মারুফ বলল,
‘দেখুন আপনাদের ঘরোয়া কথা আপনারা বলুন। আমি আসামিকে এখন নিয়ে যাবো। আপনাদের তাকে ছাড়াতে হলে কোর্টের অনুমতি নিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবেন। আপনারা মানেন বা না মানেন প্রমাণ সব মিসেস শশীর বিরুদ্ধে। উনাকে আমাদের গ্রেফতার করতেই হবে।’
শশী কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তারপর বলল,
‘অফিসার আমাকে একবার রাযীনকে দেখতে দিন প্লিজ। শুধু একবার ওকে কাছ থেকে দেখব। প্লিজ।’
ঐ কৃষ্ণকালো চোখের মুক্তোর মতো অশ্রু দেখে বোধ হয় মারুফের মনে দয়া হলো। মারুফ লেডি অফিসারকে নিয়ে যেতে বলল। ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে শুধু লেডি অফিসার শশীকে নিয়ে ভিতরে গেলেন। রাযীনের মুখে অক্সিজেন মাস্ক পরানো। লাইফ সাপের্টে আছে রাযীন। শশী একটু নিচু হয়ে রাযীনের হাত ধরে বলল,
‘আমি জানি, তুমি জলদি সুস্থ হয়ে আমাকে মুক্ত করবে। আমি জানি, আর কেউ আমাকে বিশ্বাস না করুক তুমি করবে। জলদি ওঠো রাযীন। আই নিড ইউ।’
শশী নিচু হয়ে রাযীনের কপালে চুমো আঁকল।
শশীকে নিয়ে গেল। সাজ্জাদ, নূর ইসলাম, রায়হান রহমান থামানোর অনেক চেষ্টা করল কিন্তু কাজ হলো না। সাজ্জাদও একটা সিএনজি নিয়ে, শশীদের গাড়ির পিছু পিছু যেতে লাগল। সাজ্জাদ গাড়িতে বসে কল করে শিহাবকে সব জানাল। বলল,
‘শিহাব, তুই জলদি আয়। আমাদের আদরের বাচ্চাটার আজ বড় বিপদ।’
‘ভাইয়া তুমি কোথায়?’
‘আমি ওদের পিছু পিছু থানায় যাচ্ছি। ওকে আমরা কখনও একা ছেড়েছি যে, আজ ছাড়ব। প্রয়োজন হলে থানার বাইরে ভিক্ষুকের মতো বসে থাকব তা-ও ওর কাছে কাছে থাকব। আমি জানি, আমাদের শশী কখনও কোনোদিন এমন করতে পারে না। শোন তুই আসার সময় আমার কাবাট থেকে চেকবই নিয়ে আসিস। ডেবিট কার্ড দিয়ে আর কয়টাকা তোলা যাবে! তুই নিজেও বেশি করে টাকা-পয়সা নিয়ে আসিস। এখানে ওকে ছাড়াতে কত কি লাগে বলতে পারছি না! শোন তোর পরিচিত ভালো কোনো উকিল থাকলে তাকে সাথে নিয়ে আসবি। তুই এক কাজ কর জামাল ফুপার সাথে কথা বল। তিনিও তো একজন উকিল। তিনি তো এখন ওকালতি করছেন না। তবে তার চেনা জানা ভালো অনেক উকিল আছেন। তুই এক কাজ কর, তাকেসহ নিয়ে আয়। তিনি আমাদের অনেক হেল্প করতে পারবে।’
‘হ্যাঁ ভাই আমি আসছি। তুমি প্লিজ নিজের এবং বাবা মায়ের খেয়াল রেখো।’
সাজ্জাদের কল কেটে শিহাব, রেনুকে কল করে বলল,
‘রেনু, জলদি ব্যাগপত্র গোছাও, ভাবিকেও গোছাতে বলো। আমরা সবাই কক্সবাজার যাচ্ছি আজ।’
‘শিহাব, সব ঠিক আছে তো?’
‘কিছু ঠিক নেই রেনু। রাযীনকে নাকি বিষ দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। আর তার দায় পড়ছে আমাদের শশীর উপর।’
রেনু বিস্ময় লুকাতে না পেরে বলল,
‘কী?’
’হ্যাঁ। পুলিশ শশীকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছেন। তোমরা যত তাড়াতাড়ি পারো সব গুছিয়ে নাও। আমি বড় ফুপার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।’
‘আচ্ছা।’
হাসি বেগম, মিতুর দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলল,
‘বেয়ান আপনার সত্যি মনে হয় আমার মেয়ে রাযীনকে মারার চেষ্টা করতে পারে? রাযীনকে বিষ দিতে পারে?’
মিতু কান্না করতে করতে বলল,
‘আমি কিছু জানি না বেয়ান! আমার ছেলেটা বাঁচবে কিনা আমি তা জানি না! আমি এখন ভুল সঠিক দেখার মতো অবস্থায় নেই, আমি শুধু আমার ছেলেকে ফেরত চাই।’
হাসি বলল,
‘শশীকে মিথ্যা অপবাদে জেলে দিলে কী রাযীন সুস্থ হবে? আচ্ছা বেয়ান রাযীন সুস্থ হয়ে যদি, আপনাকে জিজ্ঞেস করে সবকিছু সঠিকভাবে না জেনে শশীকে কেন জেলে দিলেন? তখন কী উত্তর দিবেন?’
মিতু চিৎকার করে বলল,
‘বললাম তো আমি কিছু জানি না। আমি এখন আমার রাযীন ছাড়া কারও কথা ভাবতে পারছি না।’
হাসি বেগম বললেন,
‘বেয়ান আপনি যেমন মা, আমিও তেমন মা। আপনি যেমন নিজ সন্তানের কথা ছাড়া কারও কথা ভাবতে পারছেন না, তেমন আমারও ভাবা উচিত ছিলো কিন্তু আমার যতটা কষ্ট শশীকে নিয়ে হচ্ছে, ততটা রাযীনকে নিয়েও হচ্ছে। রাযীনের কিছু হলে আমার মেয়েটাও তো বিধবা হয়ে যাবে। তার জীবনটাও কষ্টে ভরে যাবে। কিন্তু বিনা দোষে তাকে জেলে ঠেলে দিয়ে তো আপনার ছেলে সু্স্থ হবে না।’
হাসি বেগম আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু নূর ইসলাম তাকে থামিয়ে নিয়ে গেলেন। রোমিসা চুপচাপ মিতুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। ও কারও সাথে কোনো কথা বলছে না। এতসব ঘটনায় ভয়ে যেনো চুপসে গেছে। রোমিসা মিতুর কাঁধে মাথা দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘মা আমার মনে হচ্ছে ভাবি নির্দোষ। মা ভাইয়া, ভাবির অতীত সম্পর্কে সব জানতো, তারপরও ভাবিকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। ভাবিও তাকে খুব ভালোবাসতো। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ভাবি কখনও ভাইয়াকে বিষ দিতে পারে না! ওদের সম্পর্ক সত্যি খুব সুন্দর ছিলো। তুমিও তা বহুবার দেখেছো। মা আর একবার ভেবে দেখো।’
মিতু আস্তে করে বলল,
‘তাহলে সব প্রমাণ শশীর বিরুদ্ধে কেন? যদি ও দোষী না হতো, তাহলে ওর বিরুদ্ধে এত প্রমাণ কী করে এলো?’
রোমিসা এবার চুপ করে রইল।
৪৭!!
বিকাল সাড়ে চারটার দিকে জ্ঞান ফিরল রাযীনের।
রাযীন চোখ মেলে তাকালো। নার্স ডাক্তারকে ঢেকে আনলেন। ডাক্তার রাযীনকে চেক করে বলল,
‘রাযীন সাহেব কেমন আছেন?’
রাযীনের চোখের কোণ বেঁয়ে পানি পড়ছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। আর না ডান দিকের হাত-পা নাড়াতে পারছে। বাম হাতেও অনেক আঘাত লাগার ফলে ব্যান্ডেজ করা। যদিও ভাঙেনি তবুও অনেক আঘাত লেগেছে, ঠিক হতে অনেক সময় লাগবে। নিজের শরীর নাড়াতে না পেরে, কিছু বলতে না পেরে, রাযীন ছটফট করতে লাগল। বাম পা নাড়াতে লাগল। গো গোঁ শব্দ করে কিছু বলতে চাইল।
ডাক্তার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘রিলাক্স রাযীন। তুমি একদম ঠিক আছো। শুধু তোমার মস্তিষ্কের বাঁ দিকে অনেক ইনজুরি হওয়ার ফলে তোমার শরীরের ডান সাইডটা প্যারালিসিস হয়ে গেছে। বাট ডোন্ট ওরি ইয়াং ম্যান। সঠিক ট্রিটমেন্ট এর ফলে তুমি জলদি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে। তোমার উপর আল্লাহর অনেক রহমত আছে বলতে হয়, নয়তো ওমন এক্সিডেন্ট আর বিষের প্রভাব থেকে মানুষ সচারাচার ফিরে আসে না।’
বিষের কথা শুনে রাযীন অবাক হলেও বলতে পারল না। ডাক্তারের কথা শুনে গেলো নির্বিকার। ডাক্তার বলছিলেন,
‘তোমার মেরুদন্ডেও আঘাত লেগেছিলো বাট সেটা নিয়ে এখন তেমন ভয় নেই। এখন প্যারালিসিস শুনে ভয় পেও না। তোমার কন্ডিশন একদম নরমাল। খুব দ্রুতই তুমি বলতে পারবে। এখন বলার জন্য এত ছটফট করো না। নিজের মস্তিষ্কে বেশি প্রেসার দিও না।
তবে তোমরা আজকালকার জেনারেশন খুব লাকি। এ যুগের চিকিৎসাবিজ্ঞান খুব উন্নত। সাধারণ কিছু ট্রিটমেন্টে তুমি জলদি সুস্থ হয়ে যাবে।’
রাযীন চোখ বন্ধ করে ফেলল। মাথা প্রচন্ড যন্ত্রনা করছে ওর। এত তীব্র যন্ত্রনা যে, শরীরের কোনো অনুভূতি হচ্ছে না। সব অনুভূতি ভোতা মনে হচ্ছে। মনে মনে বলল,
‘হে আল্লাহ আমাকে তুমি এ যন্ত্রনা সহ্য করার মতো শক্তি দাও। শক্তি দাও। মা তুমি কোথায়? তুমি এসে আমার মাথায় হাত বুলাও। আমার ভালো লাগবে।’
মানুষ যখন খুব কষ্টে থাকে, তখন সৃষ্টিকর্তা আর মা ব্যতিত কারও কথা মাথায় থাকে না। ডাক্তার বাইরে গিয়ে রাযীনের জ্ঞান ফেরার কথাটা সবাইকে বলল। সাথেও এ-ও বলল,
‘ওনাকে দয়া করে এমন কিছু বলবেন না যাতে তার মস্তিষ্কে প্রেসার পড়ে। তাহলে বড় ধরণের ক্ষতি হতে পারে। উনি আপাতত অনেকদিন হয়তো কথা বলতে এবং হাঁটাচলা করতে পারবে না। রাযীন সাহেবের ডান দিক প্যারালিসিস হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে উনি সুস্থ হবেন। তাতে সময় লাগবে। ট্রিটমেন্ট থেরাপি বহুদিন চলবে। তবে আশা করা যায় দ্রুত সুস্থ হবেন।’
সবাই ভিতরে ঢুকলো। রাযীন সবার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল। ওর মুখটা হালকা একটু বেঁকে গেছে। প্রথম দেখায় বোঝা যাবে না। তবে খুব খেয়াল করে দেখলে বোঝা যাবে। রাযীন সবাইকে দেখছে। রাযীন মনে মনে বলল,
‘গাড়ি এক্সিডেন্ট হওয়ার সময় ভাবিনি আবার সবাইকে দেখতে পাবো? সৃষ্টিকর্তাকে অশেষ ধন্যবাদ যে, আমাকে আমার প্রিয়জনদের আবার দেখার মতো সুযোগ দিয়েছেন। রাযীন, চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবাইকে দেখছে। সবার চোখে আনন্দঅশ্রু। রাযীন প্রথমে ওর মা-বাবা আর রোমিসাকে দেখল। তারপর দেখল শ্বশুর-শাশুড়ি। রাযীন সবার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে আবার পুরো রুমটায় চোখ বুলাল। ওর চোখ শশীকে খুঁজছে। বারবার খুঁজছে। মনে মনে বলল,
‘শশী তুমি কোথায়? সবাই এখানে তুমি কেন নেই? আমার এ অবস্থা দেখে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা। সে কারণেই বোধ হয় ভিতরে আসার সাহস পাচ্ছে না। শশী একবার সামনে এসো। তোমাকে দেখি। তুমি কি বুঝতে পারছো না আমার কেমন লাগছে?’
রাযীনের মা, রাযীনের পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলালো। রাযীন চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল,
‘আহ শান্তি। মা তোমার পরশের মতো শান্তি কোথাও নেই! কোথাও না!’
মিতু, রাযীনের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমো খেয়ে বলল,
‘কেমন আছিস জানপাখি?’
রাযীন মলিন হাসার চেষ্টা করল। রাযীন আবার সারাঘরময় চোখ বুলালো। মনে মনে বলল,
‘শশী কোথায় তুমি? প্লিজ আমার কাছে এসো। আমার বুকে একটু মাথা রাখো। আমাকে জড়িয়ে ধরো একটু। কোথায় শশী তুমি?’
রাযীনের চোখের ভাষা যেনো মিতু পড়ে ফেললো। মিতু আজকের মতো ব্যবহার কখনও করেনি। হয়তো নিজ সন্তানের প্রতি অধিক ভালোবাসা থেকেই এমনটা করেছে। মিতুর বলতে মন চাইল,
‘ঐ মেয়েকে খুঁজিস না। ও তোকে মারতে চায়। আমি ওর ছাঁয়াও তোর উপর পড়তে দিব না। কিন্তু মুখে বলল, রাযীন তোর অবস্থা দেখে শশী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ও পরে তোর সাথে দেখা করতে আসবে।’
মিতুর কথায়, রায়হান রহমান এবং নূর ইসলামও সায় দিলেন।
রাযীন সন্দেহের চোখে সবার দিকে তাকাল। ওর মনে মনে বলল,
‘নিশ্চিত কোনো কিছু হয়েছে? নয়তো আমার এ অবস্থায় শশী যত অসুস্থ হোক না কেন, ও না এসে পারবে না। শশী তুমি ঠিক আছো তো?’
বাকি সবাইও রাযীনের কুশল জানতে চাচ্ছে। রাযীন সবার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসছে। কিন্তু রাযীনের চোখে তীব্র সন্দেহ। হাসি বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে সন্দেহ আরও তীব্র হলো। হাসির মুখ দেখে যে কেউ-ই বলে দিবে উনি ভিতরে ভিতরে খুব কষ্টে আছেন। এতটা কষ্টে যে, রাযীনের সুস্থতাও তাকে খুশি করতে পারছে না।’
রাযীন অসহায় চোখে কেবিনের দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। ওর শশীকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করছে।
চলবে…
#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিলো
লেখিকা: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব:৪০
৪৮!!
সাজ্জাদ সেই দুপুর থেকে থানার বাইরে বসে আছে। দুপুরের খাবার কিনে ভিতরে গিয়ে মারুফকে বলল,
‘স্যার শশী কাল রাতের পর আর কিছু খায়নি। সকালেও কিছু খায়নি। ওকে এই খাবারটা দিন।’
মারুফ বলল,
‘উনাকে এখান থেকেই দুপুরে খাবার দেওয়া হয়েছিলো কিন্তু তিনি খাননি। আবার রাতে দেওয়া হবে। বাইরের খাবার দেওয়া যাবে না।’
‘প্লিজ স্যার। এখানের খাবার ও খেতে পারবে না।’
মারুফ বেশ গম্ভীর ভাবে বলল,
‘সেটা আপনার বোনের ক্রাইম করার আগে ভাবা উচিত ছিলো যে, ক্রাইম করলে জেলের ভাত খেতে হবে।’
সাজ্জাদ বেশ রাগ করে বলল,
‘স্যার শশী-ই যে অন্যায়টা করছে তা কিন্তু পুরোপুরি প্রমাণিত হয়নি। আপনারা শুধু কিছু সন্দেহের ভিত্তিতে ওকে ধরে এনেছেন। এত তাড়াতাড়ি কারও উপর অপরাধী তকমা লাগিয়ে দিবেন না। আপনি প্লিজ শশীকে খাবারটা দিন। নয়তো আমাকে দেখা করতে দিন।’
‘দুঃখিত। সেটা সম্ভব না।’
‘আলবৎ সম্ভব। তার ব্যবস্থা আমি করছি।’
সাজ্জাদ বাইরে গিয়ে কাউকে কল করল। মিনিট বিশেক পর, মারুফ হাবিলদার পাঠিয়ে সাজ্জাদকে ডেকে ভিতরে নিয়ে গেল। তারপর বলল,
‘আপনারা টাকাওয়ালা লোকজনরা কথায় কথায় বড় বড় লোকের কাছে পৌঁছে যান কেন? টাকার জোর কিন্তু সবসময় থাকে না।’
সাজ্জাদ স্মিত হেসে বলল,
‘বর্তমান বিশ্বে টাকাটাই সবচেয়ে বড় জোর।’
‘যান আপনার বোনের সাথে দেখা করে আসুন এবং খাবার দিয়ে আসুন।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’
সাজ্জাদ, শশীর কাছে যেতেই শশী বলল,
‘ভাই, রাযীন কেমন আছে?’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাজ্জাদ বলল,
‘তুই নিজের কথা ভাব।’
‘রাযীন তো আমার থেকে আলাদা কেউ নয় ভাই!’
সাজ্জাদ কিছুক্ষণ শশীর দিকে তাকিয়ে রইল তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘আমাদের বাচ্চাটা সত্যি বড় হয়ে গেছে। আজ সে ভালোবাসতে জানে। ভালোবাসার দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে। কিন্তু বাচ্চা এত ভালোবেসে লাভ কী হলো? সেই তো তার মা তোকে চরম অবিশ্বাস করল।’
‘রাযীন তো করেনি ? তাছাড়া মা তার স্থানে হয়তো সঠিক। কারণ যার সন্তানের অবস্থা এমন তার হিতাহিত জ্ঞান ঠিক থাকে না।’
‘সে শুধু রযীনের দিকটা ভাবল, তোর দিকটা না। তুই-ই তো বলতি তোর শাশুড়ি তথাকথিত শাশুড়িদের মতো না। তোকে মেয়ের মতো ভালোবাসে। কিন্তু আজ ব্যবহারে অন্যদের থেকে আলাদা কিছু তার মাঝে পেলাম না। সে শুধু রাযীনের মা হয়েই রইল, তোর মা হতে পারেনি।’
শশী মাথা নিচু করে আবার বলল,
‘রাযীন কেমন আছে?’
‘জ্ঞান ফিরেছে। তবে ডান পাশ প্যারালাইজড। কথা বলতেও পারছে না।’
শশী বলল,
‘ইয়া আল্লাহ, রাযীনকে সুস্থ করে দাও।’
‘বাচ্চা, খাবারটা খেয়ে নে।’
‘না ভাই, খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না।’
‘কাল রাতের পর কিছুই খাসনি। এমন করলে তো তুই অসুস্থ হয়ে পড়বি।’
‘কিছু হবে না।’
‘একটা কথা বল, রাযীনের জ্ঞান ফিরেছে, এখন ওর প্রচুর সেবা যত্ন করা লাগবে। তুই যদি নিজেই সুস্থ না থাকিস তবে, রাযীনের দেখাশুনা কী করে করবি? আর সুস্থ থাকতে হলে তোকে তো ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করতে হবে।’
শশী আর কথা বলল না। হাত বাড়িয়ে খাবার প্যাকেট দুটো, আর পানির বোতলটা নিলো। প্যাকেট থেকে কিছু খাবার খেয়ে বলল,
‘ভাই, আমাকে এখান থেকে কবে নিয়ে যাবে?’
‘যত দ্রুত সম্ভব। শিহাব আসছে। ওকে সব ব্যবস্থা করে আসতে বলেছি। তুই টেনশন করিস না। আমি থানার বাইরেই বসে আছি। ভাবিস না তুই এখানে একা।’
‘ভাইয়া, এই জায়গাটা বড্ড ভয়াবহ। এমন জায়গায় মানুষ থাকতে পারে না।’
‘বুঝতে পেরেছি। একটু সহ্য কর। আমরা যতদ্রুত সম্ভব তোকে নিয়ে যাব।’
‘ভাই, পারলে আমাকে একটা চাদর দিয়ে যেও। খুব ঠান্ডা লাগছে। রাতে রাযীনের খবর শুনে কিছু হুঁশ ছিলো না, পরনে যা ছিলো তাই পরেই চলে এসেছি। বাসায় পাতলা সোয়টারটা পরে ছিলাম, সেটায় এখন শীত মানছে।’
‘হ্যাঁ। সত্যি আজ ঠান্ডা বেশি।’
সাজ্জাদ নিজের গায়ের ব্লেজারটা খুলে শশীর দিকে এগিয়ে বলল,
‘আপাতত এটা পর। আমি পরে ব্যবস্থা করছি।’
‘ভাই, তুমি কি পরবে?’
‘আমি বাইরে গিয়ে একটা ব্যবস্থা করে নিব।’
শশী হাত বাড়িয়ে ব্লোজারটা নিতে গেলে, মারুফ সেটা ছো মেরে নিয়ে বলল,
‘আগে চেক করি তারপর। ব্লেজারের পকেটে, মোবাইল বা অন্যকিছু আছে কিনা?’
সাজ্জাদের মন চাচ্ছে মারুফের নাক বরাবর একটা ঘুষি মারতে। কিন্তু এখন রাগ করে কাজ করার সময় নয়। ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। মারুফ ব্লেজারটা চেক করে শশীর হাতে দিলো। শশী সেটা গায়ে জড়িয়ে বলল,
‘অফিসার আমি জানি, আমি এখানে বেশিদিন থাকব না। কারণ আমি কোনো অন্যায় করিনি।’
মারুফ হেসে বলল,
‘আমিও চাই আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হোন। কোনো মানুষই চান না কেউ বিনা অপরাধে শাস্তি ভোগ করুক।’
শশী খানিক গম্ভীর হয়ে বলল,
‘তবুও এ দেশে বহু লোক বিনা অপরাধেই শাস্তি ভোগ করে।’
মারুফ হাসল কিন্তু কিছু বলল না। মনে মনে বলল,
‘শশী আপনি জানেন না আমি মনে প্রাণে কতটা চাই আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হোন। তার কারণটা জানলে আপনি চমকে যাবেন। এত অবাক করা কারণ আপনি জীবনে দেখেননি কখনও। যাই হোক আপনাকে আগে নির্দোষ প্রমাণ করি তারপর নিজে গিয়ে তার কারণটা দেখিয়ে আসব।’
সাজ্জাদ বলল,
‘বাচ্চা, তুই সজলের কথা আমাদের কেন বলিসনি? আমরা তো কখনও তোর মতামতের অমত করিনি। তাহলে কেন বলিসনি?’
শশী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ভাই কোন মুখে বলতাম, সজল আমাদের সম্পর্কে কখনও সিরিয়াস ছিলো না। ও আগে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইতো। আমাকে বিয়ে করার প্রতি ওর তেমন কোনো আগ্রহ ছিলো না। আমি ওর কাছে পিছুটান ছিলাম। যেখানে ও-ই আমাদের সম্পর্কে সিরিয়াস ছিলো না, সেখানে তোমাদের কী বলতাম?’
‘বুঝলাম। রাযীন তোদের কথা জানত?’
‘হ্যাঁ সব জানত। রাযীন তো সজলের সাথে কথাও বলেছে। তবে রাযীন এত ভালো মানুষ যে, কখনও আমার অতীত নিয়ে কথা বলেনি। আমাকে কখনও এমন কোনো প্রশ্ন করেনি, যাতে আমি বিব্রত বোধ করি।’
মারুফ খানিক হেসে বলল,
‘আপনি দেখছি রাযীন সাহেবকে খুব ভালোবাসেন সাথে রেসপেক্ট করেন খুব?’
শশী সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘রাযীন মানুষটাই ভালোবাসার মতো, সম্মান করার মতো।’
শশী মনে মনে বলল,
‘একদিন রাযীন আমায় বলেছিলো, শশী একদিন তুমি আমাকে এতটা ভালোবাসবে যে, পুরো পৃথিবী একদিকে থাকবে আর আমি একা একদিকে থাকব। রাযীন তুমি জানো, আমার মনে হচ্ছে সে দিনটা এসে গেছে। আমি জেলে আমার শাস্তি হতে পারে, আমার জীবন নষ্ট হতে পারে সব জেনেও আমার নিজের জন্য একটুও চিন্তা হচ্ছে না বরং বারবার মনে হচ্ছে, তুমি ঠিক আছে তো?’
শশী, সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ভাই ভালোবাসা কী এমন হয়? মনে হয় মানুষটা ছাড়া পুরো পৃথিবী অন্ধকার!”
সাজ্জাদ, শশীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ বাচ্চা এমনই হয়। যখন কাউকে ভালোবাসে তখন তাকেই পুরো পৃথিবী মনে হয়।’
মারুফ বলল,
‘বাহ্! যখন আপনার দৃঢ় বিশ্বাস আপনি নির্দোষ তবে আশাকরি আপনাকে বেশিদিন জেলে থাকতে হবে না। আমিও সেই চেষ্টাই করব।’
রেনু, লিপি ব্যাগ গোচাচ্ছে আর কথা বলছে। রেনু বলল,
‘ভাবি, কাল রাতে যখন শশীর সাথে কথা বললাম মেয়েটা কত খুশি ছিলো অথচ আজ মেয়েটা জেলে, রাযীন ভাই হসপিটালে। আমার এত খারাপ লাগছে যা বলে বোঝাতে পারব না।’
‘রেনু তুই আর ক’দিন আসলি এ সংসারে। আমি তো শশীকে নিজ হাতে লালন পালন করেছি। নিজ সন্তানের মতো সবসময় দেখেছি। ভাব আমার কেমন লাগছে?’
‘বুঝতে পারছি ভাবি।’
‘জলদি জলদি কর। শিহাব এসে পড়ল বলে।’
‘হ্যাঁ।
রাতে মারুফ বাসায় গিয়ে, ওর স্ত্রী উর্মিকে কল করল। উর্মি ওদের পাঁচ বছরের মেয়ে ঢেউকে নিয়ে বাবার বাড়ি বেড়াতে গেছে। মারুফ, উর্মিকে কল করে বলল,
‘কি ম্যাডাম বাবার বাড়ি গেলে, নীরিহ জামাইটার কথা মনে থাকে না?’
‘জি থাকে। কয়বার কল দিছি তা তুমি খেয়াল করছো? সারাদিন তো চোর গুন্ডা নিয়ে ব্যস্ত থাকো। আমাদের সময় দাও?’
‘সরি। একটা নতুন কেস হাতে নিয়েছি। সেটা নিয়ে ব্যস্ত। তোমরা বাড়ি আসছো কবে?’
‘কাল বিকালে।’
‘জলদি আসো। তোমার জন্য দারুণ বিস্ময়ের একটা কাহিনী আছে।’
‘বলো।’
‘না না ফোনে বললে ততটা মজা পাবে না। কাল বাড়ি এসো তখন বলবো।’
‘আচ্ছা। ডিনার করছো?’
‘না। ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে কেবল ওভেনে দিলাম। জলদি বাড়ি আসো তো, তিন দিন যাবত ফ্রিজের খাবার খেয়ে খেয়ে বিরক্তি ধরে গেছে।’
উর্মি খানিক রাগ দেখিয়ে বলল,
‘ও তো ফ্রেশ খাবারের জন্য আমাকে প্রয়োজন?’
মারুফ হেসে বলল,
‘তোমাকে আর ঢেউকে খুব মিস করছি।’
‘আচ্ছা কাল দুপুরের পর গাড়ি পাঠিয়ে দিও।’
কল কেটে মারুফ প্লেটে ভাত নিতে নিতে বলল,
‘উর্মি, মিসেস শশীকে দেখে আমি যেমন ধাক্কা খেয়েছি, তেমন বড়সর ধাক্কা তুমিও খাবে। সত্যি পৃথিবীটা বড্ড অদ্ভুত!’
৪৯!!
“আজকের ব্রেকিং নিউজ।”
ফরিদপুরের বিশিষ্ট্য ব্যবসায়ী রায়হান রহমানের ছেলে, রাইয়্যান রহমান রাযীনকে বিষ দিয়ে হত্যার চেষ্টা। আর এ হত্যার চেষ্টার দায়ে আটক তার-ই স্ত্রী সানজিয়া আরেফিন শশী।”
খবরটা পড়ে সজল বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। আর ওঠার কারণে ওর হাতে লেগে পাশে থাকা চা’য়ের কাপটা নিচে পড়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ভাঙার শব্দে সজলের মা, শাহানা বেগম দৌড়ে এসে বললেন,
‘কিরে কী ভাঙলি?’
‘মা, চায়ের কাপটা হাতে লেগে পড়ে গেছে।’
‘আচ্ছা। সর আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি।’
সজল তাড়াহুড়ো করে বলল,
‘মা, আমি একটু বের হচ্ছি, জরুরি কাজ আছে।’
‘এত সকালে কী জরুরি কাজ? নাস্তাও তো করলি না। মাত্র ঘুম থেকে উঠলি।’
‘আছে মা খুব জরুরি কাজ।’
‘বাইরে যাবি?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে শর্ট প্যান্ট পরে কোথায় যাচ্ছিস? কাপড় পাল্টে যা।’
‘ও হ্যাঁ।’
সজল কোনো মতে কাপড় পাল্টে ফোনটা হাতে নিয়ে বাইরে দৌড়ালো। বাইরে এসে জাহিদকে কল করে বলল,
‘জাহিদ শশীর খবর কিছু জানিস?’
‘সকালের খবরে পড়লাম ব্যাপারটা।’
‘এটা কি সত্যি নাকি ভূয়া খবর?’
‘খবরটা দেখেই আমি সুমনাকে কল করেছিলাম। সুমনা, লিপি ভাবিকে কল করে সবটা জানতে পারে। ঘটনা সত্যি। শশীকে মিথ্যা মামলায় জেলে দেওয়া হয়েছে। ওদের বাড়ির সবাইও এখন কক্সবাজার।’
সজল বলল,
‘তুই রেডি হ। আমরাও যাবো।’
‘কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব?’
‘কেন সম্ভব না? শশীর বিপদে আমরা বন্ধুরা ওর পাশে থাকব না?’
‘থাকব না, সেটা বলিনি সজল। কিন্তু এই মুহূর্তে অতদূর যেতে হলে তো অনেকগুলো টাকা লাগবে। সেগুলো আমি কোথায় পাব? বাবার কাছে চাইতে গেলে আমার অবস্থা বারোটা বাজাবে।’
‘টাকার চিন্তা তুই করিস না। সেটা আমি দেখছি। তুই তৈরি হয়ে আয়। আমি দেখছি আজকে কক্সবাজারের ফ্ল্যাইট কখন?’
‘ফ্ল্যাইটে যাবি?’
‘নয়তো কি গাড়িতে যাব? তিন দিন বসে। তুই চলে আয়।’
সজল ট্রাভেল এজেন্সিতে কল করে কক্সবাজারের দুটো টিকিট কনর্ফম করল। বাড়ি গিয়ে ওর বাবা সিদ্দিক সাহেবকে বলল,
‘বাবা আমার কিছু টাকা লাগবে।’
সজলের বাবা পেপার পড়তে পড়তে বললেন,
‘কত?’
‘ত্রিশ হাজার।’
‘এত টাকা দিয়ে কী করবে?’
‘কক্সবাজার যাচ্ছি বন্ধুদের সঙ্গে।’
‘গত মাসেও তো গেলে।’
‘এখন একটু কাজে যাচ্ছি।’
সিদ্দিক সাহেব কিছুক্ষণ সজলের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,
‘তোমার মায়ের কাছ থেকে নিয়ে নাও। টাকা পয়সা একটু হিসাব করে উড়াও। টাকা ইনকাম করতে কতটা কষ্ট তা তুমি এখনও জানো না।’
সজল খুব ধীরে বিড়বিড় করে বলল,
‘সব তো সুদেরই টাকা।’
সিদ্দিক সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললেন,
‘কিছু বললে?’
‘না না বাবা কিছু না। আমি মায়ের কাছে যাচ্ছি।’
সজলরা বিকালে কক্সবাজার পৌঁছে প্রথমে লিপির সাথে দেখা করে ঘটনার বিস্তারিত জানলো। তারপর সোজা থানায় গেল শশীর সাথে দেখা করতে। মারুফ তখন থানায়ই ছিলো। সজল, জাহিদ ওর কাছে গিয়ে বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম।’
মারুফ ওদের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো,
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে আপনারা?’
সজল বলল,
‘আমরা শশীর বন্ধু। ওর সাথে দেখা করতে এসেছি।’
‘আপনাদের পরিচয়?’
‘আমি সজল, ও জাহিদ।’
সজল নামটা শুনে মারুফ তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে বলল,
‘আপনি মিসেস শশীর এক্স বয়ফ্রেন্ড?’
সজল খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ল। তারপরও বলল,
‘জি।’
‘আমরা আপনার খোঁজ করার জন্য অলরেডি ফরিদপুর থানায় যোগাযোগ করেছি। আপনি দেখছি নিজেই কক্সবাজার এসে পড়েছেন। একটা কথা অাছে না, ছাগল নিজেই হালাল হতে কষাইয়ের কাছে আশ্রয় চাইতে যায়। আপনার অবস্থাও তেমন হবে।’
সজল ভয়ে ঢোক গিলল। জাহিদ বিড়বিড় করে বলল,
‘সজল, শশীর হেল্প করতে এসে দেখছি আমরা বিপদে পড়ে যাবো।’
সজল ধীরে ধীরে বলল,
‘ভয় পাসনে। দেখি আগে কী বলে?’
মারুফ বলল,
‘বসেন আপনারা? এখন বলুন এখানে কী করে?’
‘শশীর সাথে দেখা করতে এসেছি।’
‘কেন?’
জাহিদ বলল,
‘আমাদের বন্ধুর বিপদে আমরা দেখা করতে আসব না?’
‘অবশ্যই আসবেন। সজল সাহেব এখন বলেন রাযীন সাহেবকে বিষ দেয়ার পিছনে আপনি কতটা জড়িত?’
সজল বেশ ভয় পেয়ে বলল,
‘এগুলো কোন ধরনের প্রশ্ন?’
‘মিস শশীর সাথে আপনার রিলেশন ছিলো।’
‘হ্যাঁ তো?’
‘কিন্তু বিয়ে হয় রাযীন সাহেবের সাথে।’
‘হ্যাঁ তো? বাংলাদেশে লাখ লাখ ছেলে মেয়ের রিলেশন থাকে, তাকে বিচ্ছেদ হয় আরেকজনের সাথে বিয়ে হয়। তারমানে কি তারা সবাই একজন আরেকজনের স্বামী বা স্ত্রীকে গিয়ে খুন করে?’
মারুফ হাসল। তারপর বলল,
‘না তেমন কিছুই সচারাচার হয় না! তবে আপনাদের ক্ষেত্রে হয়েছে। মিস শশী তার স্বামীকে বিষ দিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে।’
‘সেটা কি প্রমাণ হয়েছে?’
‘এখনও পুরোপুরি হয়নি, তবে হতে কতক্ষণ।’
‘সে যখন প্রমাণ হবে তখন শশীকে কিংবা আমাকে দায়ী করবেন। এর আগে না।’
‘আপনার কি ধারনা মিসেস শশী এমন কাজ করতে পারে?’
সজল বলল,
‘কখনও না। দুনিয়া উল্টে গেলেও আমি বিশ্বাস করি না যে, শশী এমন কোনো কাজ করছে। কেউ গলায় ছুড়ি ধরে বললেও বিশ্বাস করব না। কিরে জাহিদ ঠিক বলছি কিনা বল?’
জাহিদ বলল,
‘হ্যাঁ স্যার ও ঠিক বলছে। শশীকে আমরা বহু বছর যাবত চিনি। ও এমন কাজ কখনও করতে পারে না। যে মেয়ে হাত কাঁটলে কেঁদে কেটে দুনিয়া ভাসায় সে মানুষ হত্যা করবে, সেটা অবিশ্বাস্য। তাছাড়া শশী অনেক নরম মনের মেয়ে। ওকে সবসময় মানুষকে সাহায্য করতেই দেখেছি, কারও ক্ষতি করতে কখনও দেখিনি।’
‘হুম বুঝলাম। আচ্ছা মিঃ সজল আপনাদের অনেক বছরের সম্পর্ক থাকার পরও বিয়ে কেন করলেন না? নাকি মিসেস শশী আপনাকে চিট করেছে?’
জাহিদ বলল,
‘না স্যার তেমন কিছু না। আসলে সত্যি বলতে আমি শশীকে চিট করেছি।’
‘কীভাবে?’
‘ও তো সবসময়ই বিয়ে করতে চাইতো। কিন্তু আমি প্রথমে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিলাম। যার কারণে বিয়েটাকে আমার কাছে পিছুটান বলে মনে হতো। আমিই এত দ্রুত বিয়ে করতে চাইনি। শশীকে আমি কয়েক বছর অপেক্ষা করতে বলেছিলাম। কিন্তু আমি ভুলে গেছিলাম আমরা সমবয়সী। আমি ছেলে চাইলেও কয়েক বছর পর বিয়ে করতে পারব কিন্তু শশী মেয়ে, ওর জন্য সেটা মুশকিল। তাছাড়া অনেকভাবে শশীকে হার্ট করেছিলাম। আমার উপর অনেক বেশি কষ্ট পেয়েই শশী পরিবারের পছন্দে বিয়ে করে ফেলে।’
মারুফ মনে মনে বলল,
‘তাহলে সজলের বিষয়ে মিসেস শশী ঠিক বলছিলেন।’
তারপর সজলকে বলল,
‘তো আপনি তার পিছু পিছ কক্সবাজার কেন এসেছিলেন?’
‘শশীকে হারিয়ে আমি বুঝেছিলাম আমি কী হারিয়েছি? কিন্তু তখন বড্ড দেরী হয়ে গেছিলো। তখন ওর কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিলো না। ভাবলাম ওকে তো পেলাম না, ওর ক্ষমা পেলেই হবে। তাই ক্ষমা চাইতে এসেছিলাম।’
‘ক্ষমা চেয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘ক্ষমা করেছে?’
‘করেছে, তবে অনেক অপমানও করেছে।’
‘কী অপমান?’
সজল লজ্জায় লাল হয়ে গেল। কীভাবে বলবে শশী ওর সামনে রাযীনের ঠোঁটে চুমো খেয়েছিলো। মারুফ খানিকটা ধমকে বলল,
‘কী হলো বলুন? না হলে ধরে নিব সে অপমানের প্রতিশোধ নিতে রাযীনকে মারতে চেয়েছিলেন।’
‘স্যার থামেন। এসব প্রতিশোধ টতিশোধ আমার দ্বারা সম্ভব না! আমি প্রচন্ড ভীতু ছেলে আমার দ্বারা একটা তেলাপোকা মারাও সম্ভব না, মানুষ তো বহু দূরের কথা! আমাদের এলাকায় দশটা ভিতু থাকলে প্রথম তিনজনের কাতারে আমি। শশীর সাথে প্রেম হওয়ার পর সবসময় ভয়ে থাকতাম, কখনও ওর ভাইরা আমাদের সম্পর্কের কথা জানলে আমাকে না ধরে ক্যালায়। এ কারণে ওর ভাইদের দেখলে আমি উল্টা পথে পালাতাম।’
মারুফ বলল,
‘তাহলে বলুন কী অপমান করেছিলো?’
‘শশী আমার সামনে রাযীন ভাইকে লিপ কিস করেছিলো।’
মারুফ চোখ বড় বড় করে বলল,
‘কী?’
‘হ্যাঁ স্যার। একবার ভাবুন আপনি একটা মেয়েকে চার বছর যাবত ভালোবাসতেন, সে মেয়েটা সম্পর্ক চলাকালীন আপনাকে চুমো তো দূরে, থাক হাত পর্যন্ত সহজে ধরতে দিত না, সেই মেয়ে আপনার সামনে বসে তার স্বামীকে চুমো খাচ্ছে, তা-ও ঠোঁটে বুঝতে পারছেন কত বড় অপমান!’
মারুফের কেন জানি সজলের কথা শুনে খুব হাসি পাচ্ছে। নিজের হাসি চেপে কেঁশে বলল,
‘আসলেই অনেক বড় অপমান। একটা কথা বলুন আপনি কক্সবাজার এসে শশীর সাথে দেখা করতে চাইলেন আর শশী এবং রাযীর সাহেব সহজে রাজি হয়ে গেলেন?’
‘আমি নিজ থেকে শশীর সাথে দেখা করতে চাইনি। আমাকে দেখা করতে বাধ্য করিয়েছেন রাযীন সাহেব নিজে। তিনিই শশীর নতুন নাম্বারও আমাকে দিয়েছিলেন?’
মারুফ অনেকটা অবাক হয়ে বলল,
‘কী? কিন্তু কেন?’
‘স্যার, রাযীন ভাই শশীর জন্য পাগল না শুধু সাইকো চিনেন সাইকো, সেই সাইকো।’
তারপর সজল রাযীন, ওর আর শশীর মধ্যে হওয়া সব কথা বলল। মারুফ শুনে বলল,
‘রাযীন সাহেব আপনাকে কী নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছিলেন।’
‘না স্যার সেটা বলা যাবে না।’
‘ভেবে দেখুন, না বললে আপনি কিন্তু ফেসে যাবেন।’
‘স্যার বলতে পারি তবে প্রমিজ করুক কখনও শশীকে এ কথা বলবেন না! জাহিদ তুইও প্রমিজ কর। আমি জানি শশী বর্তমানে আমাকে একদম পছন্দ করে না। আমি চাই না এ অপছন্দ ঘৃণায় রূপ নিক। নিজের ভালোবাসার মানুষের ঘৃণাটা আমি নিতে পারব না।’
মারুফ, জাহিদ দু’জনেই বলল,
‘আচ্ছা।’
সজল বলল,
‘চতুর্থ বর্ষের শেষ দিকে শশীর সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন আমি সেকেন্ড ইয়ারে পড়া একটা মেয়ের সাথে রিলেশনে জড়িয়ে পড়েছিলাম।’
জাহিদ বলল,
‘লুচ্চা শালা। কী বলছিস তুই?’
‘দেখ ভাই শশী যেনো না জানে। ওটা জাস্ট একটা ক্যাজুয়াল রিলেশন ছিলো। ওখানে সিরিয়াস কিছু ছিলো না। কয়েকদিন পর যখন বুঝতে পারলাম আমি আসলে শশীকেই ভালোবাসি, তখন ব্রেকাপ করে ফেলি। কিন্তু রাযীন ভাই কী করে যেনো জেনে ফেলেছিলেন! তিনি বিয়ের পর শশীকে পরীক্ষা করার জন্য আমাকে ব্ল্যাকমেইল করেছিলেন। আমার কিছু করার ছিলো না, রাজি হয়ে যাই। তবে রাযীন ভাই সত্যি অমায়িক মানুষ ছিলেন। এত ভালো মানুষকে যে কোনো মেয়েই ভালোবাসতে বাধ্য। আর শশীকে তিনি অসম্ভব ভালোবাসতো। শশীকে হারিয়ে আমি কষ্ট পেলেও, মনে মনে এটা ভেবে ভালো ছিলাম শশী এমন একজন মানুষকে পেয়েছে যে শশীর জন্য নিজের জানও দিতে পারে।’
মারুফ বলল,
‘জান তো দিতেই গেছিলো। একটুর জন্য বেঁচে গেছে।
আরও কিছু প্রশ্ন করার পর মারুফ সজলকে, শশীর সাথে দেখা করার অনুমতি দিলো। মারুফ চাইলেও সজলকে আটকাতে পারবে না, কারণ সজলের বিরুদ্ধে ওর কাছে কোনো প্রমাণ নেই।
সজল, শশীর সমানে দাঁড়িয়ে। সজলকে দেখে শশী প্রথমে বলল,
‘তুমি এখানে কেন?’
‘তোমাকে দেখতে আসতে পারি না?’
‘দেখতে আসছো নাকি মজা নিতে?’
‘শশী, তুমি আমার সাথে সোজা করে কথা বলতে পারো না?’
‘না পারি না।’
সজল, জাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘জাহিদ, এই পাগলের সাথে কথা তুই-ই বল।’
জাহিদ বলল,
‘কেমন আছিস, শশী?’
শশী রাগ করে বলল,
‘দেখছিস না হানিমুন করতে জেলখানা এসেছি। বিন্দ্যাস চিল মুডে আছি। জামাই হসপিটালের বেডে প্যারালাইজড! এখন বুঝকে পারছিস কেমন আছিস?’
‘আরে মা চেতছিস কেন?’
‘তোর সাথে ঐ হারামিটাকে কেন নিয়ে এসেছিস?’
‘আমি নিয়ে আসিনি। বরং ঐ হারামিটাই আমাকে কক্সবাজার পর্যন্ত টেনে আনছে তোর সাথে দেখা করার জন্য।’
‘ওকে বল চলে যেতে। নয়তো আমি ওকে খুন করে সত্যি সত্যি খুনী হবো। বিয়ের আগে কম জ্বালিয়েছে যে এখন আবার জ্বালাতে আসছে।’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সজল বলল,
‘কখনও ক্ষমা করবে না আমাকে?’
‘যেদিন রাযীন ক্ষমা করতে বলেছিলো, সেদিনই ক্ষমা করে দিয়েছি তবে রাগ কমেনি।’
‘রাযীন ভাইয়ার কথা খুব মানো?’
‘কেন মানব না? ও আমার সব।’
‘খুব ভালোবেসে ফেলেছো তাকে?’
শশীর চোখ দুটো ভরে এলো। বৃষ্টির ফোটার মতো চোখ গড়িয়ে অশ্রু পড়তে লাগল। কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল,
‘হ্যাঁ। সবার চেয়ে বেশি।’
সজল হাত বাড়িয়ে শশীর চোখের জল মুছে বলল,
‘পাগলীটা আমি মজা নিতে আসিনি, তোমাকে আর রাযীন ভাইকে একসাথে করতে এসেছি।’
‘কীভাবে করবে? সব প্রমাণ আমার বিরুদ্ধে।’
‘আমি লিপি ভাবির থেকে সব শুনেছি। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। তোমার ভাইরা আছেন, রাযীন ভাই আছেন, আমরা তোমার বন্ধুরা আছি, একটা না একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। ততদিন একটু কষ্ট করো। শশী এই রাসেলটা কে?’
‘আমার চাচাতো ননদের বর।’
‘যেখানে রাযীন ভাই এর পরিবার কেস করেনি সেখানে ঐ হারামজাদা কেন কেস করলো?’
‘আমি জানি না।’
‘ব্যাটাকে যদি ল্যাংটো না করেছি মনে রেখো। তুমি নিজের খেয়াল রেখো। আমরা এখন আসছি।’
সজল মারুফের কাছে গিয়ে বলল,
‘স্যার, রাযীন ভাইর খাবারে যে বিষ ছিলো তা তো শশীকে গ্রেফতার করার আগে কেউ জানত না। তাহলে মিঃ রাসেল কীভাবে আগেই কেস করলেন? আমি শশীর বড় ভাবির সাথে বিস্তারিত কথা বলে এ বিষয়টা জানতে পেরেছি।’
মারুফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
’মিঃ রাসেলকে সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই।’
‘কেন?’
‘কারণ মিঃ রাসেলকে আমিই বিষের ব্যাপারটা প্রথমে বলেছিলাম। যখন রাযীন সাহেবের ঘর সার্চ করতে যাই তখন তালা ভেঙে ঢুকতে তারাই সাহায্য করে। তখনই আমাকে প্রশ্ন করে তালা ভেঙে কেন ঢুকছি, তখন তাকে বিষের ব্যাপারটা বলেছি। তারপর তিনি আমাদের চোখে চোখেই ছিলেন।’
সজলের মনে যা-ও একটু আশার প্রদীপ উকি দিয়েছিলো, তা-ও নিভে গেল। তবে সজলের খুব রাগ হচ্ছে। ঐ শালাকে একটা লাত্থি হলেও সজল মারবে।
৫০!!
আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেল রাযীনের চোখ দুটো শশীকে দেখার জন্য ছটফট করছে। প্রতিদিন মিতু, রায়হান রহমান, এবং বাকি সবাই কোনো না কোনো বাহানা দিচ্ছে। রাযীন জানে ওগুলো সব মিথ্যা। ও বুঝতে পারছে শশীর কিছু হয়েছে, নিশ্চিত খারাপ কিছু হয়েছে। কিন্তু ও নিরুপায়! না বলতে পারছে, না চলতে। রাযীনের নিজেকে এতটা অসহায় লাগছে যে, মরে যেতে মন চাচ্ছে। বারবার আল্লাহকে ডাকছে আর বলছে,
‘হে আল্লাহ আমাকে সুস্থ করে দাও।’
রোমিসা, রাযীনের কাছে বসা। কেবিনে শুধু রাযীনের সাথে এখন রোমিসা আছে। মিতু সকালে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বাসায় গেছে। তাই রোমিসা, ওর কাছে থেকে যায়। রাযীন বাম হাত দিয়ে রোমিসাকে ইশারায় ডাকতে লাগল। রাযীনের বাম হাত এখন অনেকটা ঠিক হয়েছে। যদিও খুব যন্ত্রণা হয়, তবে টুকটাক ছোটোখাটো জিনিস হাত দিয়ে তুলতে পারে। মুখ দিয়ে গো গো শব্দ করতে লাগল। রোমিসা বলল,
‘ভাই কিছু লাগবে তোর?’
রাযীন বাম হাতের ইসারায় কলম দেখাল।রোমিসা প্রথম কয়েবার বু্ঝতে পারল না। ও পানি, ফল এসব এনে দিচ্ছিল। রাযীনের এত রাগ হচ্ছিল। তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে আবার টেবিলে রাখা কলমটা দেখালো। রোমিসা কলমটা দেখে বলল,
‘ভাইয়া তুই লিখে কিছু বলতে চাস?’
রাযীন চোখের পলক ফেলল। রোমিসা পাশে রাখা হসপিটালের একটা কাগজ পেয়ে সেটা আর কলম রাযীনের বাম হাতে দিলো।
রাযীন কিছু একটা লেখার চেষ্টা করছে। ও বাম হাতে লিখতে পারে না। তারউপর বিছানায় শুয়ে, শরীরের এক অংশ প্যারালাইজড। তবুও অনেক চেষ্টা করে ভাঙা ভাঙা ভাবে লিখল শ শ। এতটুকো লেখায়ই রাযীন প্রচন্ড হাঁপিয়ে গেছে। হাতটাও যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে। রোমিসা লেখাটা দেখে বলল,
‘ভাবির কথা বলছিস?’
রাযীন চোখের পলক ফেলল। রোমিসা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘সবাই আমাকে বলতে নিষেধ করেছে। কিন্তু এখন তোর অবস্থা দেখে না বলে পারছি না। তবে তুই প্লিজ প্রেশার নিস না। নিজের ক্ষতি করিস না। কারণ তোর ক্ষতি হলে ভাবিবে বাঁচানো সম্ভব হবে না।’
রাযীন চোখ বড় বড় করে তাকাল। রোমিসা বলল,
‘ভাবি বর্তমানে জেলে আছে ভাইয়া।’
রযীনের চোখ বড় হয়ে গেল। রোমিসা বলল,
‘ভাবিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তোকে হত্যা করার চেষ্টার দায়ে। তিনি এখন জেলে। পুলিশের মতে তোকে বিষ দিয়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছে। আর বিষটা ভাবির রান্না করা চিংড়ি মাছে ছিলো। সে কারণেই তোর এক্সিডেন্ট হয়।
রাযীন মনে মনে বলল,
‘অসম্ভব! শশী কোনো দিনও আমাকে মারার কথা চিন্তাও করতে পারে না। ও আমাকে ভালোবাসে। সত্যি অনেক ভালোবাসে। যে মেয়েটা আমার জন্য তার চার বছরের সম্পর্কের তোয়াক্কা করল না, আমার সাথে সবসময় সুখী থাকার চেষ্টা করেছে, আমাকে এত ভালো রেখেছে, শেষ মেস ভালোবেসে তার সবটা আমার কাছে সমাপর্ণ করেছে। সে মেয়ে কোনো দিন আমাকে বিষ দিয়ে মারার চেষ্টা করবে না। অসম্ভব! ওর চোখে আমি সেই ভালোবাসাটা দেখেছি, যেটা আমি সবসময় ওর চোখে দেখতে চাইতাম।
তাছাড়া ওর যদি আমাকে মারার হতো, তবে অনেক আগেই মারতে পারত! এতদিন কেন অপেক্ষা করল? ওর যদি আমাকে মারার হতো, ও আমার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমার্পণ করতো না! এর মধ্যে মস্ত বড় কিন্তু আছে! তৃতীয় পক্ষ নামে একটা সাপ আছে, যে সাপটাকে আমাকে বিষ দিয়েছে, দায় শশীর উপর ফেলেছে? সাপটা কাজটা এমনভাবে করেছে যাতে কাজও হয় কিন্তু তার নাম না আসে। ঐ যে প্রবাদ আছে না, সাপ যাতে মরে, লাঠিও না ভাঙে! এমন সময় আমাকে বিছানায় পড়ে থাকতে হচ্ছে। আমার শশী কষ্ট পাচ্ছে খুব কষ্ট পাচ্ছে!
রোমিসার কথায় ধ্যান ভাঙল রাযীনের। রোমিসা বলল,
‘ভাবি জেলে খুব কষ্টে আছে ভাই। তুই জলদি সুস্থ হয়ে তাকে নিয়ে আয়। তার পরিবার তাকে ছাড়ানোর খুব চেষ্টা করছে কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। জানিস ভাই গত পরশু আমি মাকে না জানিয়ে চুপি চুপি ভাবিকে দেখতে গিয়েছিলাম, শিহাব ভাইয়ার সাথে। জানিস ভাবির দুই গাল থাপ্পরের কারণে নীল হয়ে রয়েছে। ফুলে গেছে তার দুই গাল। ভাবিকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় লেডি অফিসার তাকে অনেক মেরেছে।
রাগে, দুঃখে রাযীনের চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল। রাগে বাম পায়ের পাশে থাকা চেয়ারটাকে লাত্থি মেরে ফেলে দিলো। বাম হাতে বিছানায় ঘুষি মারতে লাগল। নিজেকে এত অসহায় লাগছে। রাযীন মনে মনে বলল,
‘যে মেয়েকে একটা টোকা দেওয়ার কথাও আমি ভাবি না, তাকে এভাবে মেরেছে। একবার সুস্থ হয়ে নেই, আমি কাউকে ছাড়ব না। যে হাত দিয়ে আমার শশীর গায়ে হাত দিয়েছে সে হাত আমি ভেঙে ফেলব।
চলবে….