একমুঠো রোদ্দুর পর্ব-১২+১৩

0
17

#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ১২
#আদওয়া_ইবশার

টানা পাঁচদিন তীব্র খরতাপের পর প্রকৃতির বুকে বর্ষণ নেমেছে রিমঝিম ছন্দ তুলে। সকাল থেকে একটানা বৃষ্টি। দুপুরের দিকে একটু থেমে নতুন উদ্যমে আবারও শুরু হয়েছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপরূপ বৃষ্টি ভেজা প্রকৃতিটা কতক্ষণ উপভোগ করে রুমে ফিরে আসে অতসী। এই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই শিকদার মঞ্জিলে যেতে হবে তাকে। রোদ্রিককে পড়ানো ছেড়ে দিয়েছে প্রায় মাস হবে। হুট করে গতকাল রাতে আবার রক্তিম অতসীকে ফোন করে রিকোয়েস্ট করেছে আর কয়েকটা মাস যেন রোদ্রিককে পড়ানোর দায়িত্বটা অতসী নেয়। দৃষ্টি অন্তঃসত্ত্বা। এই অবস্থায় তার পক্ষে দুষ্ট রোদ্রিককে পুরো দিন একা সামলানো সম্ভব না। অতসী কেন জানি তখন রক্তিমের মুখের উপর না বলে দিতে পারেনি। হয়তো স্বয়ং এমপি সাহেবের রিকোয়েস্ট দেখেই তার মুখ থেকে না শব্দটা বের হয়নি। অনিচ্ছা সত্বেও রাজি হতে হয়েছে। এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তার আজকেও রোদ্রিককে পড়ানোর জন্য যেতে একদম মন টানছেনা। কিন্তু ঐ যে এমপি সাহেবের রিকোয়েস্ট! ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে অতসী ভাবনা রেখে তৈরী হয়ে হাতে ছাতা নিয়ে রুম ছেড়ে বের হয়।

“কি রে! এমন বৃষ্টির মাঝে কোথায় বের হচ্ছিস?”

“শিকদার মঞ্জিলে।”

মায়ের প্রশ্নে ধীর কদমে ড্রয়িং রুম পেরিয়ে সদর দরজার দিকে হেঁটে যেতে যেতেই উত্তর দেয় অতসী। হঠাৎ এতোদিন পর শিকদার মঞ্জিলে যাবার কথা শুনে ভারী বিস্ময়ে মেয়ের মুখের দিকে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থাকে শিউলি বেগম।

“তুই না রোদ্রিককে আর পড়াবিনা বলেছিস! তা এখন আবার কিজন্য যাচ্ছিস?”

“খিচুড়ি খেতে যাচ্ছি। তোমাদের এমপি সাহেব খিচুড়ির দাওয়াত দিয়েছে। বলেছে, অতসী এই ভারী বাদল দিনে আমার বাড়িতে তোমায় খিচুরি ভোজনার্থ আহ্বান জানাচ্ছি। সেই নিমন্ত্রণ রক্ষার্থেই ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে যাচ্ছি এখন।”

চোখে-মুখে বিরক্তি ভাব নিয়ে মেয়েকে এমন নাটকীয় ভঙ্গিতে মিথ্যাচার করতে দেখে গম্ভীর হয়ে যায় শিউলি বেগম। আড়চোখে অতসীকে আগাগোড়া পরখ করে বলেন,

“একটু ঝেড়ে কাশ তো মা। ঘটনা কি? ওরা আবার তোকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঐ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দিহান নামের ঐ ছেলেটার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে না তো? খিচুড়ির লোভে পরে এতো বড়ো ভুল করার আগে অন্তত একশোবার ভেবে বাড়ি থেকে পা বাড়া।”

“এটা হলে তো তোমাদেরই ভালো হবে। তোমরাই তো না কী ঐ ঘুষখোর পুলিশ অফিসার ছাড়া আমার জন্য আর কোনো যোগ্য পাত্র খোঁজে পাচ্ছোনা। কত আফসোস তোমাদের, আমি হিরেকে কয়লা ভেবে পায়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি। এখন যদি এই খিচুড়ির উছিলায় বিয়েটা হয়ে যায় তবে তো আর তোমাদের আফসোস করে ম’রতে হবেনা।”

ভীষণ মেজাজি ভঙ্গিতে কিছুটা উচ্চস্বরেই জবাব দেয় অতসী। বিপরীতে শিউলি বেগম সুন্দরভাবে মেয়ের ভুলটা শুধরে দেয়,

” রাগের মাথায় মানুষ সবসময় শুধু ভুলভাল বকে। তার প্রমাণ আবারও দিয়ে দিলি তুই। দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে হলেও তোর এই কথাটা মাথায় রাখা উচিৎ ছিল, সাধারণ পুলিশ আর এন্টি টেরোরিজম ইউনিট এর পুলিশ সদস্যদের মাঝে বিস্তর তফাৎ। দিহান ছেলেটা কোনো ঘুষখোর পুলিশ অফিসার ছিলনা। সে ছিল এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের একজন অ্যাডিশনাল এসপি। মাঝে মাঝেই আমার মনে হয় জানিস, তোকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে নামিদামি স্কুল, কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে লাভের লাভ কিছুই হবেনা আমার। কারণ গাধা আজীবন গাধাই থাকে। তাকে যতই পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলে ফেলা হোক না কেন, সে কখনো ঘোড়া হবেনা। তোর বেলাতেও এই লজিকটাই খাটে। তোর বাপ একটা পেট মোটা বেক্কল লোক। সেই পেট মোটা বেক্কল লোকের মেয়ে হয়ে তুই কি আর আমার মতো চালাকচতুর চাইলেও হতে পারবি?”

“মা সাবধান করছি তোমাকে, বাবাকে নিয়ে আর একটাও উল্টাপাল্টা কথা বলবেনা। আমার বাবা একজন সৎ, ভালো মানুষ দেখেই তোমার মতো হাফ মেন্টাল মহিলাকে নিয়ে তেইশ বছর যাবৎ সংসারে করছে।সেই বাবাকে নিয়েই যখন তুমি এসব ভুলভাল কথা বলো, তখন ইচ্ছে করে আমি নিজেই দেখেশুনে বাবাকে আর একটা বিয়ে করিয়ে দেই।”

আঙুল উঁচিয়ে শাসিয়ে কথা গুলো বলে একটু থেমে পূণরায় অসহায় কন্ঠে অতসী বলে ওঠে,

“আচ্ছা মা, একটা কথা বলো তো! তুমি সবসময় আমার আর বাবার পিছনেই কেন লেগে থাকো? অনিক, অহনা ওদের পিছনে তো একবারও লাগতে দেখিনা তোমাকে। আমাদের দুই-বাপ মেয়েকে দেখতে পারোনা কেন তুমি?”

“কারণ আমি তোর আপন মা না। আমার আগে তোর বাপ আরও একটা বিয়ে করেছিল। তোর বাপের সেই বউয়ের সন্তান তুই। আর অনিক, অহনা আমার সন্তান। তাই তাদের পিছনে না লেগে সবসময় তোদের বাপ-মেয়ের পিছনে লাগি। সে যায় হোক, আর দেরী করিস না বেরিয়ে পর। আর হ্যাঁ, বিয়েটা যদি হয়েই যায় তাহলে আগেভাগে একটা কল দিয়ে আমাকে জানিয়ে দিস। জামাই বরণের প্রিপারেশন নিতে হবে তো আমাকে। সতিনের মেয়ে বিদায় হচ্ছে সেই খুশিতে পুরো এলাকায় মিষ্টিও বিতরণ করতে হবে।”

শিউলি বেগমের যাবার পানে তাকিয়ে প্রলম্বিত একটা নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে পরে অতসী। তাদের মা-মেয়ের এই কাহিনী আজ নতুন নই। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই মা-মেয়ের এই দুষ্টু-মিষ্টি খুনসুটি। অবুঝ বয়সে অতসী মায়ের মুখে এমন কথা শুনে ভাবতো শিউলি বেগম বোধহয় সত্যিই তার আপন মা না। এই ভেবে কতদিন মেঝেতে গড়াগড়ি করে কেঁদেছে! কিন্তু যখন একটু বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই বুঝেছে মা তার সাথে দুষ্টুমি করেই সবসময় এমন করে। যে মা অতসীকে এভাবে খ্যাপিয়ে কাঁদাতো, সেই মা’ই আবার তার গলা ছেড়ে কান্না দেখে মুখ টিপে হেসে হাত বাড়িয়ে বুকে আগলে নিতো। গাল টেনে কপালে চুমু দিয়ে শুধাতো,

“কোন ডাইনি বলে রে আমি তোর মা না?”

অতসী যখন মায়ের এমন কথা শুনে বোকার মতো মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলত, “তুমিই তো বলেছো।”
তখন শিউলি বেগম ভ্রু কুঁচকে বলতেন,

“তোকে পাক্কা দশ মাস দশ দিন পেটে ধরেছি। পেটে পরার শুরু থেকে আমাকে জ্বালানো শুরু করেছিস এখনো জ্বালিয়েই যাচ্ছিস। অনিক, অহনার থেকেও বড্ড বেশি জ্বালিয়েছিস তুই আমাকে। সবসময় পেটে এমন গুতাগুতি করতি, মনে হতো ফুটবল খেলছিস। আবার পৃথিবীতে আসার সময়’ও ডাক্তারদের আমার পেট কাটতে বাধ্য করলি। এখন আমার তোকে জ্বালিয়ে আমাকে জ্বালানোর সুধ তুলতে হবেনা?”

শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে করতে বৃষ্টির ছন্দে তাল মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শিকদার মঞ্জিলে পৌঁছে যায় অতসী।কলিং বেল টিপে ছাতাটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই দরজা খুলে দেয় দৃষ্টি। সব ভুলে অতসী তাকিয়ে থাকে দৃষ্টির হাস্যজ্জ্বল মুখের দিকে। পা-থেকে মাথা জহুরি নজরে পরখ করে বোঝার চেষ্টা করে দৃষ্টির মাঝে মাতৃত্বের পরিবর্তনটুকু এসেছে কি না। কিন্তু না, পেট এখনো আগের মতোই।পরিবর্তন শুধু স্বাস্ব্য আগের থেকে উন্নতি হয়েছে। গাল দুটো ফোলা ফোলা। দৃষ্টি অতসীকে নিজের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা শব্দ করেই হেসে ফেলে। ভ্রু নাচিয়ে জানতে চায়,

“কি ব্যাপার? এভাবে কী দেখো আমার দিকে? প্রেমেটেমে পরে গেলে না কী? একেবারে নজর সড়ছেই না যে আমার থেকে!”

কিছুটা লজ্জা মিশৃত হাসি ফুটে উঠে অতসীর ওষ্ঠকোণে। বিব্রত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে,

“কেমন আছেন আপু?”

“ভালো আর থাকি কিভাবে? কত শখ করে আমার ভাইয়ের বউ করতে চেয়েছিলাম তোমাকে, সেই তুমিই ছ্যাকা দিয়ে বসলে! ভাইয়ের বউ তো হলেই না, একদম আমার ছেলেটাকেও পড়ানো ছেড়ে দিয়েছো। আমরা কী এতোটাই খারাপ? তোমার সাথে কখনো এই বাড়ির কেউ খারাপ ব্যবহার করেছে?”

এমন এক বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখিন হবার ভয়েই রৌদ্রিককে পড়ানো ছেড়েছিল অতসী। আজ সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে বড্ড হাঁসফাঁস লাগছে। ইচ্ছে করছে এক ছোটে পালিয়ে যেতে। দৃষ্টি অতসীর বিবেত ভাব বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে নেয়,

“আচ্ছা বাদ দাও এসব। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে সবই আল্লাহর ইচ্ছেতেই হয়। আল্লাহ যার জুড়ি যেখানে মিলিয়ে রেখেছেন সেখানেই হবে। এরপরও কাউকে ভালো লাগলে বিয়েটা সেখানে না হলে একটু আফসোস থাকে আর কি। আমরা অদ্ভূত মানুষ জাতি বলে কথা! সবাই জানি সৃষ্টিকর্তা না চাইলে কিছুই হবেনা, তবুও কোনো কিছু না হলে আফসোসের অন্ত থাকেনা আমাদের। এই দেখো, তোমাকে বাইরে দাড় করিয়ে রেখেই কথা বলা শুরু করে দিতেছি! কেমন নির্বোধ আমি! আসো আসো, ভিতরে আসো।”

বলতে বলতে দৃষ্টি নিজেই হাত ধরে টেনে ভিতরে নিয়ে যায় অতসীকে। কিন্তু ড্রয়িং রুমে যেতেই থমকে দাঁড়ায় অতসী। ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে রক্তিমের সাথে দিহান খুশগল্পে মত্ত। তাকে এই মুহূর্তে শিকদার বাড়িতে দেখে এক মুহূর্তের জন্য অতসীর মায়ের কথাটা মনে পরে যায়। আচ্ছা, ওরা কি সত্যি সত্যি অতসীকে মিথ্যে বলে এখানে এনে জোর করে দিহানের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে না কী? এমনটা তো হলে হতেও পারে। এরা সকলেই ক্ষমতাশালী মানুষ। ওদের বিরুদ্ধে অতসীর কিছু বলা বা কারার সাহসটুকুও হয়তো নেই। অজানা এক শংকায় পা দুটো ঐখানেই স্থির হয়ে যায় অতসীর। বৃষ্টির দিনের ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়াতেও কপালে ঘাম জড়ো হয়। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে হয় কাঠ।

“কী হলো আবার? এখানে থমকে দাঁড়ালে কেন? রোদ্রিক ওর দাদির রুমে। চলো!”

দৃষ্টির আওয়ামী শুনে রক্তিম, দিহান নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাটা মাঝপথে থামিয়ে রেখে মাথা তুলে তাকায়। সাথে সাথেই তাদের নজরে আসে অতসীকে। অল্পক্ষণের জন্য বোধহয় অতসী, দিহান দুজনের চোখে চোখ পরে। তবে স্থায়ীত্ব পায়না দু-জোড়া দৃষ্টির মিলন। তড়িঘড়ি অতসী করে চোখ সরিয়ে সালাম জানায় রক্তিমকে,

“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। এমন বৃষ্টির মাঝে আসতে গেলে কেন? আজ না হয় নাই আসতে। রাস্তায় কোনো অসুবিধা হয় নি তো?”

“না ভাইয়া। কোনো অসুবিধা হয়নি।”

অতসীর কথা গুলো বলতে গিয়েও বারবার গলা জড়িয়ে যাচ্ছে। তার এই বেহাল দশা দেখে দৃষ্টি, দিহান দুই ভাইবোন ঠোঁট টিপে হাসছে। দৃষ্টির হাসিটা অতসীর দৃষ্টিগোচর না হলেও আড়চোখে সে ঠিকই দিহানকে ঠোঁট কামড়ে হাসতে দেখে দাঁত কিড়মিড়িয়ে মনে মনে অসভ্য, অভদ্র উপাধি দিয়ে দেয়।

****
দেখতে দেখতে কিভাবে যেন চোখের পলকেই দিন গুলো পাড় হয়ে যাচ্ছে। নশ্বর পৃথিবীর বুক থেকে সূর্যের আলো ফুরিয়ে যাবার সাথে সাথেই অতীত গর্ভে বিলীন হয়ে যায় এক একটা সোনালী দিন।ইলেকশন অতী সন্নিকটে। প্রার্থীগণ গতকাল নমিনিশন পত্র জমা দিয়ে এসেছে। সেই প্রার্থীদের মধ্যে রক্তিমও একজন। সংসদীয় সকল কাজকর্ম স্থগিদ। নির্বাচনী প্রচারণা, প্ল্যান- প্রোগ্রাম ছাড়া আপাতত আর অন্য কোনো কাজ নেই। তবে এই এক নির্বাচনী কাজেই পার্টির এক একজনের কালঘাম ছুটে যাচ্ছে। আজ এখানে মিটিং তো কাল ঐখানে সমাবেশে, এসব করে করে কখন দিন ফুরিয়ে রাত গভীর হয় রক্তিম টেরই পায়না। এদিকে ঘরে তার অন্তঃসত্ত্বা অভিমানী স্ত্রী। বাচ্চাটা গর্ভে আসার পর থেকেই দিন দিন যেন তার অভিমানের মাত্রা আকাশ ছুঁতে চাইছে। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে মাঝ রাতে বাড়ি ফিরে রক্তিমকে শুনতে হয় তার অভিমানীর হাজারটা অভিযোগ। এতেও খান্ত হয়না দৃষ্টি। যতক্ষণ না পযর্ন্ত রক্তিম নরম সুরে তাকে মানানোর চেষ্টা না করবে, ততক্ষণ পযর্ন্ত বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। অভিমানী প্রিয়তমা স্ত্রীর অভিমান ভাঙাতেই গতরাতে রক্তিম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল, আজ রাতের শহরে তারা দুজন নিশাচর পাখি হবে। ঘুরবে-ফিরবে, খোলা আকাশের নিচে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিবে। মিটিমিটি জ্বলতে থাকা নিয়ন আলোয় প্রিয় শহরটাকে দেখবে দুচোখ ভরে। সেই কথা রাখতেই রক্তিম আজ কোনো দলীয় সমাবেশ রাখেনি। অফিসে যা কাজ ছিল সেটাও দ্রুত শেষ খরার জন্য সন্ধ্যা থেকে পার্টির ছেলেদের তাড়া দিচ্ছে। এই নিয়ে মেহেদী ইতিমধ্যে দুই-তিনবার রক্তিমকে ঠ্যাস মেরে কথাও শুনিয়ে দিয়েছে।

“দুই বাচ্চার বাপ হতে গিয়ে বন্ধু অবশেষে বউয়ের আঁচলে ধরা দিল! তবুও ভালো, অন্তত মেয়েটাকে আজীবন একটা রশকসহীন রোবট মানবের সাথে সংসার করতে হবেনা। এই তোরা দ্রুত কাজ শেষ কর, আমাদের নেতা সাহেব আজ বউকে নিয়ে ডেটে যাবে।”

বিপরীতে রক্তিম নিরবে মেহেদীর দিকে এমনভাবে দৃষ্টিপাত করছে যেন,চোখ দিয়েই সে গিলে খাবে তাকে।হাসি-ঠাট্টা,গল্পগুজবের মধ্যে দিয়েই কাজ এগিয়ে নিতে নিতে বেজে যায় রাত দশটা। ইতিমধ্যে গুণে গুণে পনেরোটা কল চলে এসেছে দৃষ্টির নাম্বার থেকে। দুই-একবার রক্তিম ফোন রিসিভ করে শুধু আসছি বলেই কল কাটে। তবে যাবার মতো পরিস্থিতি এখনো করে উঠতে পারেনি। হাতে এখনো প্রচুর কাজ অবশিষ্ট। এগুলো শেষ না করে চলে যাওয়াও অসম্ভব। অন্যদিকে মনটাও অস্থির হয়ে আছে। বহুদিন পর আজ কেন জানি রক্তিমের মনটাও ভীষণ চাইছে দৃষ্টির হাতে হাত রেখে রাতের শহরে ঘুরে বেড়াতে। ম্রিয়মান চাঁদের আলোয় আলোকিত দূর আকাশটার দিকে তাকিয়ে মনে জমে থাকা সব গুলো কথা একটা একটা করে জানাতে প্রিয়তমা স্ত্রীকে। বহুদিন পর আবারও অল্প করে হলেও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হৃদয়টা বড্ড উতলা।

একটু একটু করে সময় গড়াতে গড়াতে রাত গভীর হয়। দেয়ালে টানানো ঘড়ির কাটা টিকটিক করে জানান দিচ্ছে রাত তিনটে বাজার কথা। গভীর আঁধারে নিমজ্জিত রাত। চারিদিকে পিনপতন নিরবতা। হুটহাট রাস্তা থেকে দুই-একটা কুকুরের উচ্চস্তরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ আর কোনো এক গাছের ডালে বসে ভয়ার্ত সুরে ডাকতে থাকা প্যাঁচার আওয়াজ গায়ে হিম ধরিয়ে দিচ্ছে। কান্নার দমকে দৃষ্টির শরীরটা কেঁপে উঠার সাথে সাথে কুকুর, প্যাঁচার করুন রোদনে হৃৎপিন্ডটাও কেঁপে কেঁপে উঠছে। শেষ রাতের হার কাঁপানো বাতাসে শরীরটা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে। তবুও সে অনঢ় বসে বারান্দায়। চোখের অশ্রুজলে যত্ন করে মুখে লাগানো প্রসাধনীর প্রলেপ গলে বিচ্চিরি অবস্থা। এলোমেলো মাথার চুল। দূর থেকে হঠাৎ এই মধ্য রাতে তার এমন বিধ্বস্ত রূপ দেখলে নিশ্চিত যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে। অথচ সে নির্বিকার চিত্তে বসে নিরবে চোখের অশ্রু ঝরাচ্ছে আর বিরবির করছে,

“কোনোদিন কথা রাখেনি। এক আকাশসম ভালোবাসার বিনিময়ে সবসময় শুধু বুকভরা কষ্টই দিয়ে গেছে।”

চলবে…..

#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ১৩
#আদওয়া_ইবশার

নিকশ কালো আঁধার কেটে চারিদিকে আলো ফুটতে শুরু করেছে। পবনের লিলুয়া বাতাসের তালে তালে নৃত্য করছে গাছের কচি কচি পাতা গুলো। পাখিরা কিচিরমিচির গুঞ্জন তুলে নীড় ছেড়ে দল বেধে ছুটছে খাবারের খোঁজে। প্রকৃতির সাথে সাথে আড়মোড়া দিয়ে একটু একটু করে জেগে উঠছে ঘুমন্ত শহরটা। বারান্দায় দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থাকতে থাকতে কখন যে দৃষ্টির চোখ দুটো লেগে এসেছিল খেয়ালেই ছিলনা। হঠাৎ দরজায় কড়াঘাতের শব্দে কাচা ঘুমটা ছুটে যায়। ধরফরিয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায়। বাইরে থেকে রোদ্রিকের কন্ঠ ভেসে আসছে।

“মাম্মা! সকাল হয়েছে তো। ওঠো তাড়াতাড়ি। মাম্মা!”

দৃষ্টি তড়িৎ নিজেকে সামলে ওয়াশরুমের দিকে ছুটতে ছুটতে ছেলেকে বলে,

“আসছি আব্বু।দিদুনকে গিয়ে বলো তোমাকে ব্রাশ করিয়ে দিতে।”

বারংবার মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে আয়নায় প্রতিবিম্বের দিকে তাকায়। দেখতে পায় এক বিধ্বস্ত,বিষাদ কন্যার মুখের আদল।প্রিয় মানুষটার থেকে পাওয়া অবহেলাটুকু কষ্ট রূপে যে আদলে এখনো স্পষ্ট ফুটে আছে।চোখ দুটো ফুলে ব্যাথা হয়ে আছে।মাথাটা কেমন ভার ভার লাগছে।নিজেকে নিজের কাছেই একদম অপরিচিত মনে হচ্ছে।পাষাণ পুরুষটার কথা মনে পরতেই বুক ভেঙ্গে কান্না আসে আবারও। তড়িৎ নিজেকে কঠোরভাবে সামলে নেয় দৃষ্টি। ঐ বর্বর, হৃদয়হীন পাষাণ্ডটার জন্য আর এক বিন্দু চোখের জল ফেলবেনা দৃষ্টি। নিজেকে কষ্ট দেবার পাশাপাশি নিজের মাঝে বেড়ে উঠা ছোট্ট প্রাণটাকেও আর কষ্ট দিবেনা। ফ্রেশ হয়ে রুমে ফিরে মুখে ক্রিম মেখে, চুল আচড়ে একদম পরিপাটি হয়ে নিচে নামে দৃষ্টি। রেহানা বেগমের মুখোমুখি হতেই জিজ্ঞেস করেন,

“বউমা!রক্তিম বাড়ি ফিরেনি রাতে?”

“না।” চোয়াল শক্ত করে জবাব দিয়ে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে ছুটে দৃষ্টি। রেহানা বেগমের চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। যত কাজই থাকুক, রক্তিম কখনো বাইরে থাকেনা। ফজরের আগ মুহূর্তে হলেও বাড়ি ফিরে আসে। তবে আজ কী হলো? রেহানা বেগমের মন মানছেনা। কেমন যেন অস্থির লাগছে। কিছু অযাচিত চিন্তা এসে ঘিরে ধরেছে। চিন্তিত মুখেই রান্নাঘরের দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে নরম সুরে দৃষ্টিকে বলেন,

“ফোন করে একটা খোঁজ নিয়ে দেখো না ছেলেটা কোথায় আছে। ও তো কখনো এমন করেনা। যত রাতই হোক বাড়ি ফিরে আসে।সামনে ইলেকশন, দেশের অবস্থা এমনিতেই ভালো না। আল্লাহ না করুক, যদি কোনো বিপদ হয় ছেলেটার!”

নির্লজ্জ মনটা যদিও এতোটা অবহেলা পাবার পরও ঐ পাষাণ্ডটার চিন্তায় ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে আছে, তবুও বাঃহিক দিক থেকে দৃষ্টি নিজেকে নির্লিপ্ত রাখার আপ্রাণ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। প্রলম্বিত একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে কাজে মনযোগী হয়ে শাশুড়ির প্রশ্নের জবাব দেয়,

“কিচ্ছু হবেনা মা। অযথা টেনশন করে প্রেশার বাড়াবেন না।মেহেদী ভাই, রাকিব ভাই,শান্ত ভাই, জাবির ভাই সবাই তো আছে ওনার সাথে।”

এসব কী আর মায়ের মন মানতে চায়? রেহানা বেগম দৃষ্টির নির্লিপ্ততায় একটু হলেও বুঝতে পারছে দুজনের মাঝে আবার হয়তো কিছু নিয়ে মান-অভিমান চলছে।যে অভিমানের পারদ ভেঙে দৃষ্টি রক্তিমের জন্য হওয়া চিন্তাটা প্রকাশ করছেনা।রেহানা বেগম দৃষ্টিকে বোঝানোর ভঙ্গিতে কিছু বলতে চায়, এর মাঝেই কলিং বেল বেজে ওঠে। কান খাড়া করে দৃষ্টি সেই শব্দ শুনে কন্ঠে অভিমানের আভাস নিয়ে শাশুড়িকে বলে,

“চলে এসেছে আপনার জনদরদী পুত্রধন। বলেছিলাম না কিছুই হয়নি! সাহেব ভীষণ ব্যস্ত কী না! তাই রাতে বাড়ি ফেরার কথা ভুলে গিয়েছিল হয়তো।”

পুত্রবধূর অষ্টাদশী কন্যার মতো অভিমানী রূপ দেখে রেহানা বেগম মুচকি হেসে দরজা খুলে দেয়। তবে কাঙ্ক্ষিত মুখটা দেখতে পায়না। রক্তিম আসেনি।এসেছে মেহেদী। সাতসকালে জামাতাকে দুয়ারে দেখে কিছুটা খুশি হলেও ছেলের চিন্তায় সেই খুশিটা ভাটা পরে। মেহেদীর মুখটাএ কেমন থমথমে। কিসের যেন চিন্তায় এতোটা বিভোর হয়ে আছে যে, শাশুড়িকে সালাম জানাতেও ভুলে গেছে। চোখ-মুখ কঠিন করে পাথরের মতো ঠাই দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরেই। মেহেদীর এমন আচরণে রেহানা বেগম কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও জোরপূর্বক হেসে নিজেই বলে ওঠেন,

“বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে না কি? ভিতরে আসো। আর আসবে আমাকে আগে একটু জানিয়ে আসবেনা? ইতু কেমন আছে বাবা? আর আমার পাকা বুড়িটা কেমন আছে?”

শাশুড়ির কথায় যেন মেহেদীর ধ্যান ভঙ্গ হয়। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলে,

“মা!রক্তিম..

“হ্যাঁ বাবা! বলো তো ঐ হতচ্চারাটা কোথায় আছে?সারাদিন বাইরে থেকেও কী তার কাজ শেষ হয়না? রাতেও বাড়ির বাইরে কিসের কাজ তার? ঘরে যে বউ-বাচ্চা আছে এই কথাও ভুলে গেছে না কী জনগণকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে! এই ছেলের জ্বালায় আমার আর বুড়ো বয়সেও শান্তি হলনা। বিয়ের আগে আমাকে একা জ্বালিয়েছে, এখন বউটাকেও জ্বালিয়ে মারছে।”

মেহেদী কিছু বলতে চেয়েও বারবার থেমে যাচ্ছে। কেমন যেন হাশফাশ করছে। রেহানা বেগম মেহেদীর এমন অস্থিরতা বুঝতে পেরে ভয়জড়ানো কন্ঠে কিছু বলতে চায়। কিন্তু ওনাকে কিছু বলতে না দিয়েই মেহেদী অসহায় মুখে বলে ওঠে,

“রক্তিমকে একটু আগে পার্টি অফিস থেকে পুলিশ এটেম টু মার্ডার কেসে ধরে নিয়ে গেছে মা।”

অবিশ্বাস্য, অনাকাঙ্ক্ষিত এমন একটা খবর বিশ্বাস হচ্ছেনা রেহানা বেগমের। কেমন যেন বিস্ময় চোখে তাকিয়ে আছে মেহেদীর দিকে। অসহায়, হতবিহ্বত এক মায়ের মুখের দিকে মেহেদী পারেনা দৃষ্টি স্থির রাখতে। তার থেকেও বড়ো কথা তার যে কঠোর পুরুষালী চোখ দুটো নিজের সাথে বড্ড বেঈমানি করে অশ্রু ঝরাচ্ছে। পুরুষদের তো এমনিতেই অতি শোকেও কাঁদতে নেই। সেই কাঁদতে বারণ পুরুষ আবার শাশুড়ির সামনে কিভাবে কাঁদবে? বাহুতে মুখ ঘষে নিজেকে সামলিয়ে কান্না ধামানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে মেহেদী। রেহানা বেগম অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েই বলে ওঠেন,

“এসব কী বলছো তুমি? মাথা ঠিক আছে তোমার? রক্তিমকে কেন মার্ডার কেসে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে? আমার ছেলেকে কী মদন পেয়েছো তোমরা? আচ্ছা, তুমি কী আমার সাথে মজা করছো? দেখো মেহেদী, আমি তোমার শাশুড়ি হই কিন্তু। আমার সাথে তোমার এসব মজা করা মানায়না।”

বলতে বলতে অস্থির হয়ে ওঠেন রেহানা বেগম। কেমন যেন উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ শুরু করেন। দুইপাশে মাথা নাড়াতে নাড়াতে ছুটে যায় রান্নাঘরে। দৃষ্টি তখন সকালের নাস্তার জন্য রুটি বানাচ্ছে। চুলায় সবজি বসানো। রেহানা বেগম ছুটে গিয়ে দৃষ্টির বাহু ধরে তার দিকে ফিরিয়ে অসহায় কন্ঠে বলেন,

“এই বউমা! শুনোনা, দেখো তো মেহেদী এসব কী বলছে।আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা। আচ্ছা, তুমিই বলো ওর সাথে কী আমার মজা করার সম্পর্ক? কেমন ফালতু ছেলেদের মতো আমার সাথে মিথ্যে বলে মজা নিচ্ছে! তুমি ওকে গিয়ে একটু বুঝিয়ে আসো তো। মা সমতুল্য শাশুড়ির সাথে কোনো ভদ্র ছেলে এভাবে মজা করেনা।”

শাশুড়ির কথার মর্মার্থ কিছুই বোধগম্য হয়না দৃষ্টির। ফ্যালফ্যাল করে কতক্ষণ উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করা রেহানা বেগমের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,

“কিসব বলছেন এসব মা? মেহেদী ভাই এসেছে? আসলেও ওনি আপনার সাথে মজা করবে কেন? কি বলেছে আপনাকে?”

প্রশ্নটা করেও উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকেনা দৃষ্টি। ত্রস্ত ড্রয়িং রুমে ছুটে গিয়ে মেহেদীর মুখোমুখি হয়।দেয়ালে হেলান দিয়ে নির্জীবের মতো দাঁড়িয়ে মেহেদী দুহাতে মুখ ঢেকে আছে। হতভম্ব হয়েই দৃষ্টি জানতে চায়,

“ভাইয়া! কখন এসেছেন আপনি? আর মা’কে কী বলেছেন? পাগলের মতো কিসব বলছে মা আমার কাছে?”

দৃষ্টির সরল মুখটার দিকে কিছু পল অসহায় নজরে তাকিয়ে থাকে মেহেদী। তার উষ্কখুষ্ক চুল, রক্তবর্ণ ফোলা দুটো চোখ, উদ্ভ্রান্তের মতো চেহারা দেখে চমকে যায় দৃষ্টি। বুকের ভিতর কামড়ে ধরে অজানা এক ভয়। আসন্ন বিপদের আভাসে কিছু বলতে চেয়েও ঠোঁট দুটো তিরতির করে কেঁপে ওঠে। গলার কাছে দলা পাকিয়ে যায় সকল কথারা। মেহেদী নিজেই দু-পা এগিয়ে আসে দৃষ্টির দিকে। বুক ফুলিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত রেখে বলে,

“দৃষ্টি, আমি জানি তুমি অনেক ম্যাচিউরড একটা মেয়ে। আমার কথা গুলো একটু শান্তভাবে শুনো বোন প্লিজ! একদম রিয়েক্ট করবেনা। অন্তত রিয়েক্ট করার আগে এটা ভেবো, তোমার গর্ভে একটা প্রাণ আছে। তুমি হাইপার হলে ওর ক্ষতি হবে। মা হয়ে কী তুমি চাইবে সন্তানের ক্ষতি হোক?”

দৃষ্টি নির্বাক। পাথরের মতো ঠাই দাঁড়িয়ে। তবে মাথার ভিতরে হওয়া ভোতা যন্ত্রণাটা বেড়েছে দ্বিগুণ। বুকের ভিতরটা বারবার উত্তাল সমুদ্রের ফেনীল ঢেউয়ের মতোই ফুলেফেঁপে ভয়ংকর এক ঝড় হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তবে কী অবচেতন মন তার সর্বনাশের বার্তা দৈবীয় অর্থেই জেনে গেছে? মনের ভিতর চলা ঝড়টা বহুকষ্টে ধামাচাপা দিয়ে দৃষ্টি অস্ফুটে জানতে চায়,

“ওনি কোথায় ভাইয়া? কী হয়েছে?”

এই মেয়েটা। ভীষণ সারল্যে ভরপুর এই মেয়েটার মায়াময় মুখটার দিকে তাকিয়ে তার এতো বড়ো সর্বনাশের সংবাদটা জানাতে কুন্ঠাবোধ করছে মেহেদী। মনটা তীব্র বিদ্রোহ শুরু করছে, ভালোবাসার কাঙ্গাল এই মেয়েটাকে নতুন এক দুঃখের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতে মন একদম সায় দিচ্ছেনা।তবুও বলতে হবে। জানাতে হবে সবটা। এমন একটা সংবাদ কখনো চাপা রাখা যাবেনা। সবথেকে বড়ো কথা দৃষ্টি রক্তিমের স্ত্রী। সেই স্ত্রী যে কী না নিঃস্বার্থভাবে গত আটটা বছর রক্তিমকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছে। গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া রক্তিম আলোর পথ ফিরে পেয়েছে যে স্ত্রীর হাত ধরে। জিভের ডগায় শুকনো খড়খড়ে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে মেহেদী বলে ওঠে তিক্ত সত্যটা,

“রক্তিমকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে দৃষ্টি। পার্টি অফিসে কাদের ভুঁইয়ার ছোট ভাইয়ের লা’শ পাওয়া গেছে। রক্তিমকে পুলিশ লা’শের পাশ থেকেই এরেস্ট করে নিয়ে গেছে।”

চলবে…..