#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ১৫
#আদওয়া_ইবশার
অন্ধকারে ঢাকা একটি ছোট্ট কামরা। ফ্লুরোসেন্ট বাল্বের ক্ষীণ আলোতে মৃদু আলোকিত সেই ঘরের এক কোণে দেয়াল ঘেঁষে বসে আছে রক্তিম, পিছন ফিরে, নত মস্তকে। তার এই নিস্তব্ধতায় যেন সময় থমকে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তার পেছনের অবয়ব দেখেই দৃষ্টির বুঝতে বাকি থাকে না, এই মানুষটিই তার অতি আপন, তার জীবনের সর্বাধিক প্রিয়জন, তার অর্ধাঙ্গী।
দৃষ্টি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, একটিও শব্দ বের হয় না তার মুখ থেকে। নিঃশব্দে তাকিয়ে দেখে রক্তিমের থমকে থাকা অবয়বকে। চোখের কোনে জমে থাকা অশ্রু বাধা ভেঙে ফেলে আবারও। সেলের শিক ধরে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে একবার তাকায় কামরুল হাসানের দিকে। যেন চোখের ভাষায় বিনম্র অনুরোধ করে, তাদের একটু একান্তে সময় দেওয়ার জন্য।
“মাত্র দশ মিনিট। মনে থাকে যেন,” বিরস মুখে বলে চলে যায় কামরুল হাসান। তার যাওয়া দেখতে দেখতে দৃষ্টি আবার রক্তিমের দিকে ফিরে তাকায়। রক্তিম এখনও নীরবে বসে থাকে, যেন দৃষ্টির আগমনের কোনো আঁচই পায়নি। সময় তার নিজস্ব গতিতে চলে যাচ্ছে। দৃষ্টি বুক ফুলিয়ে এক গভীর নিঃশ্বাস নেয়, নিজেকে শান্ত করে, এবং সাহস করে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে, “শুনছেন!”
রক্তিম মাথা তুলে তাকায়, তার চোখে কোনো অনুভূতি নেই, ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। সর্বদা সাহসী, নির্ভীক রক্তিম আজ যেন জীবন যুদ্ধে পরাজিত এক সৈনিক। তার এই মলিন চেহারা দৃষ্টির হৃদয়ে গভীরভাবে আঘাত করে। বুকের গভীরে জমে থাকা যন্ত্রণার ঢেউগুলো ভাঙতে শুরু করে। দৃষ্টি লোহার শিকল আঁকড়ে ধরে, কান্না যেন আর সামলাতে পারে না। কিন্তু রক্তিমের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসে না, সে এখন যেন এক মৃতপ্রায় দেহ, জীবনের স্পন্দনহীন।
দৃষ্টি নিজেকে সামলে নিয়ে চোখের অশ্রু মুছে শান্ত কণ্ঠে বলে, “আমি জানি আপনি নির্দোষ। আপনি কোনো খুন করেননি। যে মানুষটির সাথে আমি আটটা বছর কাটিয়েছি, তার প্রতি আমার এতোটুকু বিশ্বাস আছে। আপনি প্লিজ এভাবে ভেঙে পড়বেন না। আমরা সবাই আপনার পাশে আছি। কিছুই হবে না আপনার।”
দৃষ্টির এই কথাগুলোও যেন রক্তিমের উপর কোনো প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়। তিনি ধীরে ধীরে চোখ নিচু করে ফেলেন। দৃষ্টি অসহায় কণ্ঠে আবার বলে ওঠে, “তাকাবেন না আমার দিকে? একটু এগিয়ে আসুন না, প্লিজ! শুধু একবার আপনাকে ছুঁতে চাই। জানেন, আমার মনে হচ্ছে যুগ যুগ ধরে আপনাকে ছুঁতে পারছি না! বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে অসহ্য যন্ত্রণায়। এই যন্ত্রণা থেকে একটু মুক্তি দিন আমাকে, একটু স্বস্তি দিন।”
রক্তিমের পাথুরে হৃদয়টা বুঝি এবার একটু গলে! ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকায় রক্তিম, তার চোখে অসীম ক্লান্তি, কষ্ট, এবং অপরাধবোধের ছাপ। কিছু বলতে চায়, কিন্তু কণ্ঠ আটকে যায়। কিসের যেন একটা অদৃশ্য বাঁধা এসে সব কথা থামিয়ে দেয়। রক্তিম হালকা শ্বাস ফেলে ভীষণ অস্থির ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে দৃষ্টির কাছে। দৃষ্টি তৎক্ষণাৎ তার হাত দুটি টেনে ধরে, বুকের সাথে মিশিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। রক্তিমের দৃষ্টিজোড়া আবার চঞ্চল হয়ে ওঠে। এলোমেলো ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে, দৃষ্টির হাত থেকে নিজের হাত দুটো আলগা করে নিয়ে ধীরে ধীরে দৃষ্টির গালে হাত রাখে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কান্নারত মায়াময় সেই মুখটায়। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই রক্তিমের কঠোর চোখ থেকেও দুই ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। দৃষ্টির কপাল বরাবর লোহার শিকলের মাঝ দিয়ে মাথা ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“এতটা কষ্ট আমি তোমাকে কখনো দিতে চাইনি। আমার কঠোর হৃদয়ে যতটুকু ভালোবাসা লুকানো ছিল, সবটুকু উজাড় করে দিয়ে তোমাকে সুখে রাখতে চেয়েছি। কিন্তু আমি ব্যর্থ। বারবার নিজের অজান্তেই কষ্টের বৃষ্টিতে ভিজিয়েছি তোমাকে। কেন এসেছিলে আমার এই ছন্নছাড়া জীবনে? না এলে তো আর এত কষ্ট সইতে হতো না, আর না আমার মাঝে আজ এতো অনুশোচনার জন্ম হতো।”
দৃষ্টি রক্তিমের কথার বিরোধিতা করে পাগলের মতো এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ে। তড়িতান্বিত হয়ে বলে,
“একদম না। আমি আপনাকে ভালোবেসেছি, সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে। নিজেই বলেছিলাম, বিনিময়ে কিছুই চাই না। ভালোবেসে আমৃত্যু শুধু আপনার পাশে থাকতে চাই। আমাদের সম্পর্কের জন্য আমার একার ভালোবাসাই যথেষ্ট ছিল। তবুও, আমি সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারিনি। আমি জানি, আপনি কতটা চাপা স্বভাবের। তবুও, বারবার আপনার ভালোবাসার প্রকাশ ঘটানোর জন্য আমি পাগলামি করেছি। এভাবে বলতে গেলে, আমার অনুশোচনা হবার কথা। কিন্তু আপনি কেন অনুশোচনায় ভুগবেন?”
বুক ফুলিয়ে গভীর একটা নিঃশ্বাস নিয়ে রক্তিম দৃষ্টির কান্নাভেজা মুখের দিকে তাকায়। এই মেয়েটা, আট বছর আগে তার পথপ্রদর্শক হয়ে আঁধারে আলো দেখিয়েছিল। নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে এতগুলো বছর সংসার করে গেছে, তার লাগামছাড়া রুক্ষ মেজাজের স্বীকার হয়েও। শুধু একটু ভালোবাসার জন্য অল্প অভিমানে গাল ফুলানো ছাড়া কখনো কিছু নিয়ে অভিযোগ তুলেনি। কখনো দামি শাড়ি বা গয়নার আবদার করেনি। কত সুন্দরভাবে তার ভেঙ্গে যাওয়া সংসারটাকে জোড়া লাগিয়েছে নিজের হাতের জাদুর ছোঁয়ায়। দেখতে দেখতে দুই বাচ্চার মা হয়ে যাচ্ছে। এতগুলো বছরেও দৃষ্টির ভালোবাসার কমতি রক্তিম ঘুণাক্ষরেও উপলব্ধি করেনি। বরং সময়ের সাথে সাথে তার ভালোবাসার গভীরতা দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে। অথচ রক্তিম, সে তো প্রকৃতপক্ষে দৃষ্টিকে সর্বদা ভালো রাখতে পারেনি। বছরে ছয় মাস যদি মেয়েটা হেসেছে, তবে বাকী ছয় মাস কাঁদতে হয়েছে একমাত্র রক্তিমের চিন্তায়, তাকে হারানোর ভয়ে। আর আজ? আজ তো মেয়েটাকে একেবারে অকূল সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে। যে ফাদে রক্তিম পা ফেলেছে, সেই ফাদ থেকে সে আদৌ বের হতে পারবে কিনা জানা নেই। যদি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ না করতে পারে, তবে আজীবন মেয়েটাকে তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হবে। এই সমাজে স্বামীহীন একটি মেয়ের টিকে থাকা যে কতটা দুর্বিসহ, তা তো কারো অজানা নয়। তারপরও কি রক্তিমের অনুশোচনা হবে না? চোখ দুটি বন্ধ করে দৃষ্টির হাতের উল্টো পিঠে আলতো করে চুমু খায় রক্তিম। একহাত দৃষ্টির মাথায় রেখে অভয় দিয়ে বলে,
“একটুও কাঁদবে না। কিছু হবে না আমার। আমি জানি আমি নির্দোষ। আজ হোক বা কাল, সত্যিটা সবার সামনে আসবেই। সেই পর্যন্ত নিজেকে একটু শক্ত রাখো। আমি এই পৃথিবীর বুকে নিঃশ্বাস নিতে পারলেও, এই মুহূর্তে তোমাদের আগলে রাখার ক্ষমতা আমার নেই। কথা দাও, আমার অনুপস্থিতিতে আমার পুরো দায়িত্বটা তুমি পালন করবে! মা’কে দেখে রাখবে, রোদ্রিককে আমার অভাব বুঝতে দিবে না। তার সামনে একদমই কাঁদবে না। আর তোমার মাঝে যে প্রাণ বেড়ে উঠছে, ওকেও কিন্তু নিরাপদ রাখবে। নিজের যত্ন নিবে। আমি ছাড়া পাবার পর যদি শুনি, আমার একটা কথাও তুমি রাখোনি, তবে কিন্তু খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি। আর হ্যাঁ, এভাবে থানায় আর আসবে না। মূল কথা, আমি ছাড়া পাবার আগ পর্যন্ত একা একদম বাড়ির বাইরে বের হবে না। রোদ্রিকেরও এই কিছুদিন স্কুলে যেতে হবেনা। যদি খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে বাইরে বের হবার, তবে মেহেদী, রাকিব, শান্ত বা জাবিরকে সাথে নিয়ে বের হবে। মনে রেখো?”
দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকে মাথা ঝাকিয়ে সাই জানায় দৃষ্টি। একজন কনস্টেবল বারবার তাড়া দিচ্ছে বের হবার জন্য। সময় পেরিয়ে গেছে, কিন্তু দৃষ্টির যেন আজ তার প্রাণপুরুষটাকে দেখার স্বাদ মিটছে না। যত দেখছে ততই তৃষ্ণা বাড়ছে। সর্বনাশি মনটা বারবার ভাবাচ্ছে, এই দেখাই বুঝি শেষ দেখা।
“আরে আপা, কথা কানে যায় না? আপনি তো বহুত ত্যাড়া পাবলিক! বের হোন, ভালোই ভালোই। এটা থানার জায়গা, কোনো পার্ক নয়। এত পিরিতি আসে কই থেকে?”
অশ্রুসজল চোখে একপলক কনস্টেবলের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি আবারও রক্তিমের হাত দুটো আকড়ে ধরে। কাঁপা কণ্ঠে বলে,
“আমি আবার আসব। আমরা সবাই আপনার মুক্তির জন্য লড়াই করব। একদম চিন্তা করবেন না। তারা আপনাকে বেশিদিন এভাবে আটকে রাখতে পারবে না।”
রক্তিমের চোয়াল শক্ত হয় এবার। কঠোরভাবে বলে,
“কী বলেছি আমি? নিষেধ করিনি এখানে আর কখনো আসবে না? এরপরও আবার আসবে বলো কিভাবে?”
রক্তিমের হাত দুটো ছেড়ে দৃষ্টি ধীরে ধীরে পিছাতে পিছাতে জেদি স্বরে বলে,
“আমি তো আসবই। যতদিন আপনি এখানে থাকবেন, ঠিক ততদিন আসব। কোনো কথা শুনব না আমি আপনার।”
অনিমেষ চোখে দৃষ্টির যাবার পানে তাকিয়ে থাকে রক্তিম। বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস।
চলবে…..
#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ১৬
#আদওয়া_ইবশার
আদালত প্রাঙ্গণে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। তাদের কেউ কেউ রক্তিমের পক্ষ নিয়ে কথা বলছে। তাদের ভাষ্যমতে, এই মানুষটা বিগত পাঁচ বছর যাবৎ এলাকার উন্নয়নের লক্ষ্যে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সর্বদা গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে থেকেছে। হাজারো বেকারকে কর্মসংস্থান গড়ে দিয়েছে। তার কাছে কোনো ন্যায্য আবদার নিয়ে গেলে কেউ কখনো খালি হাতে ফিরে আসেনি। এই পাঁচ বছরে তার নামে কোনো খারাপ রেকর্ড কেউ পায়নি। এক কথায় বলা যায়, সাভারবাসীর কাছে রক্তিম শিকদার মানেই ভরসার জায়গা। সেই ভরসার জায়গাটাকেই আজ কীভাবে তারা প্রশ্নবিদ্ধ করবে? হাজারো জনগণের দুঃখ মোচন করা মানুষটাকে কোন মুখে তারা খুনি বলবে? এটা নিশ্চয়ই অপজিট পার্টির কোনো চক্রান্ত। যে চক্রান্তে বাজেভাবে ফেঁসে গেছে তাদের প্রিয় এমপি রক্তিম শিকদার। আবার আরেক দল বলাবলি করছে, যে মানুষ অতীতে নিজের ভাইয়ের উপর অস্ত্র চালাতে পিছুপা হয়নি, তার পক্ষে এমন একটা খুন করা অসম্ভব নয়। ক্ষমতার লোভে পড়ে মানুষ পশুর থেকেও নিকৃষ্ট হয়ে যায়। হয়তো এরই জলজ্যান্ত প্রমাণ রেখে যাচ্ছে রক্তিম শিকদার। সে হয়তো ভেবেছিল কাদের ভুঁইয়া মালদার পার্টি, জনগণকে টাকা খাইয়ে সব ভোট কিনে নেবে, এবং সে নির্বাচনে হেরে যাবে। এই কারণেই হয়তো কাদের ভুঁইয়ার ছোট ভাইকে হত্যা করে তাকে নির্বাচনী কাজকর্ম থেকে পিছিয়ে রাখতে চেয়েছে। এমন ভাবনা-চিন্তা করা মানুষগুলোর মাঝেও আবার দুটি দল হয়ে গেছে। এক দল রক্তিমকে দোষী ভাবার পাশাপাশি এটাও ভাবছে, সে যদি খুন করেই থাকে তবে সেটা কেন তার পার্টি অফিসেই করবে? আর করলেও পালিয়ে কেন যায়নি বা লাশটাকে গুম কেন করেনি? এত কাচা খেলোয়াড় রক্তিম শিকদার? সে কী হাঁটুর নিচে বুদ্ধি নিয়ে খুনটা করেছিল? মেঝেতে লাশ রেখে সে নিশ্চিন্তে না কী চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিল! ভাবা যায় এসব? কৌতূহলী মানুষদের কৌতূহল যেন কিছুতেই মিটছে না। তারা নিজ মনে তাদের প্রশ্নের উত্তর ভেবে নিয়ে পুনরায় আরেক প্রশ্ন তৈরি করে ফেলছে। উত্তেজনা এভাবেই ছড়িয়ে যাচ্ছে শহরের প্রতিটা আনাচে-কানাচে। টিভি চ্যানেল থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া পর্যন্ত সয়লাব হয়ে গেছে এই এক বিষয়ে। তুমুল আলোচনা-সমালোচনা সবখানেই।
রক্তিমকে যথাসময়ে কোর্টে হাজির করা হয়েছে। পরনে কয়েদিদের পোশাক, হাতে-পায়ে শেকল সমেত এক দল পুলিশের সাথে রক্তিম জিপ থেকে নামতেই তার দৃষ্টি থমকে যায় এক জায়গায়। এডভোকেট মিতালী সাহা এবং তার টিমের সাথে দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টি। ভীষণ চিন্তিত ভঙ্গিতে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তাদের মাঝে। সেই চিন্তার আর আলোচনার মূল বিষয়টা যে রক্তিম নিজেই তা দূর থেকেই বুঝতে পারলেও তার চোখ-মুখ কঠোর হয়ে আছে। এই মেয়েটাকে সে এত করে বুঝিয়ে বলল বাড়ির বাইরে না বের হতে, তবুও সে ধৈ ধৈ করে নাচতে নাচতে কোর্টে চলে এসেছে। কেন এসেছে সে, উকিল নাকি? কেস লড়বে? প্রাণপ্রিয় স্বামীকে চিকন বুদ্ধি খাটিয়ে এক চুটকিতে কেস ডিসমিস করে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবে? এর কোনোটাই তো না। তবুও বেয়াদবটা কথা শুনল না রক্তিমের। সে কী আর সাধে এই মেয়ের সাথে খ্যাঁক খ্যাঁক করে সবসময়? এই মেয়ের তো সোজা কথা কানে ঢোকে না। অতিরিক্ত রাগে, দুশ্চিন্তায় রক্তিমের মেজাজ তুঙ্গে। ইচ্ছে করছে হাত-পায়ের এই সমস্ত বেড়ি ছিঁড়ে ফেলে দৌড়ে গিয়ে বেয়াদবটার গালে বরাবর কষে দুই-তিনটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতে। তার না হয় নিজের জন্য চিন্তা নেই। তাই বলে বাচ্চাগুলোর চিন্তাও করবে না? বুক ফুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দাঁতে দাঁত পিষে পুলিশের সাথে কোর্টের ভিতর এগিয়ে যায় রক্তিম। ইতিমধ্যে দৃষ্টির নজরও চলে এসেছে রক্তিমের দিকে। দ্রুত গতিতে আসতে চেয়েছিল এদিকে। কিন্তু সেই সুযোগটা আর হলো না। মিডিয়ার লোকজন চারপাশে গিজগিজ করছে। তাদের কোনোমতে ট্যাকেল দিয়ে পুলিশ ত্রস্ত রক্তিমকে নিয়ে কোর্টের ভিতর চলে যায়। ব্যর্থ একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে দৃষ্টির বুক চিরে। অবাধ্য অশ্রুজলে চোখ দুটো টলমল হয়। মিতালী সাহা এগিয়ে এসে দৃষ্টির কাঁধে হাত রেখে ভরসা দেয়,
“এত অধৈর্য হয়ো না। মনোবল দৃঢ় করো। তোমার ভাই কোথায়? তার তো আসার কথা ছিল।”
ভাইয়ের কথা স্মরণ হতেই দৃষ্টির মাঝে আবারও চিন্তার উদ্রেক দেখা দেয়। সত্যিই তো, দিহান কোথায়? তার তো আজকের দিনে এখানেই থাকার কথা। শত কাজ থাকলেও সে বোনের এমন একটা বিপদে পাশে না থাকার মতো ছেলে তো নয়। মিতালী সাহা দৃষ্টির চিন্তিত মুখ পর্যবেক্ষণ করে নিজেই আবার বলে ওঠেন,
“আচ্ছা বাদ দাও। হয়তো কোনো কাজে আটকে গেছে। কেসের শুনানি শুরু হয়ে যাবে আর কিছুক্ষণের মাঝে। এসো।”
আদালতের পরিবেশ থমথমে। উপস্থিত সবার চোখে-মুখে উদ্বেগ। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে রক্তিম শিকদার, বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচিয়ে। তার এই কাণ্ডে উপস্থিত মানুষজন ফিসফিসিয়ে কানাঘুষো করছে, চুরি করে আবার বাহাদুরি করাটা বুঝি একেই বলে। কেমন নির্লজ্জের মতো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখো! এজলাসে বসা বিচারপতি এক পল সেদিকে তাকিয়ে গম্ভীর চিত্তে সবাইকে চুপ করে বিচারকার্য শুরু করার আদেশ দিতেই পুরো হল নীরবতায় ছেয়ে যায়। শুরুতেই প্রসিকিউটর লাশের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেশ করেন আদালতে। যা কথা বলছে রক্তিমের বিপক্ষে। প্রসিকিউটর বলতে শুরু করেন,
“মি লর্ড, লাশের শরীরে পাওয়া প্রতিটা ফিঙ্গারপ্রিন্টের মিল পাওয়া গেছে রক্তিম শিকদারের সাথে। খুনি ভিক্টিমকে সর্বপ্রথম গলা চেপে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরেছেন। এরপরও খ্যান্ত হননি। সেই মৃত লাশের গায়েই লাগাতার ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করেছেন। যার সমস্ত প্রমাণ এই রিপোর্টে উল্লেখিত। এ থেকেই বোঝা যায় রক্তিম শিকদার ঠিক কতটা অসুস্থ মানসিকতার একজন মানুষ। এমন একটা বদ্ধ উন্মাদ, খুনির এই দেশে স্বাধীনভাবে চলার কোনো অধিকার নেই। পুরো ঘটনা এখানে জলের মতো পরিষ্কার। তাই আমার মনে হয়, এই কেস অযথা টেনে দীর্ঘ করার কোনো মানেই হয় না। মহামান্য আদালতের কাছে আমি আসামী রক্তিম শিকদারের সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য বিনীত অনুরোধ করছি।”
ছটফটিয়ে ওঠে দৃষ্টি। গাল বেয়ে টুপটাপ গড়িয়ে পড়ে অবাধ্য অশ্রুকণা। এসব কী হচ্ছে? রক্তিম খুন করতে পারে না। এমন অবিশ্বাস্য একটা কথা কিছুতেই মেনে নেবে না দৃষ্টি। কিন্তু বিপক্ষের উকিল যে তথ্য এবং বয়ান পেশ করেছে, এর ভিত্তিতেই যদি আদালত রায় দিয়ে দেয়? ধরফর করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায় দৃষ্টি। মুহূর্তে সবার নজর এসে আটকে যায় তার দিকে। পাশ থেকে সাদেক সাহেব মেয়েকে আগলে নিয়ে আবারও বসিয়ে দিতে চান। কিন্তু দৃষ্টি বসে না। অস্থির চিত্তে সে বলে ওঠে,
“মিথ্যে, সব মিথ্যে। তিনি ওই খুন করেননি।”
দৃষ্টির এমন অভিব্যক্তির জন্য কেউ বোধহয় প্রস্তুত ছিল না। কাঠগড়ায় দাঁড়ানো রক্তিম শীতল চোখে তাকিয়ে দেখে দৃষ্টির পাগলামি। মিতালী সাহা তড়িৎ দৃষ্টির পাশে বসা প্রত্যেককে ইশারা করে তাকে সামলাতে। বিচারকের আসনে বসা জজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে নম্র স্বরে বলেন,
“মি লর্ড, তিনি আমার মক্কেল রক্তিম শিকদারের স্ত্রী। স্বামীভক্ত অল্পবয়সী একটি মেয়ে। স্বামীর বিরুদ্ধে এমন একটা অভিযোগ মানতে না পেরে অস্বাভাবিক আচরণ করে ফেলেছে। তার হয়ে আমি আদালতের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”
পরাজিত এক সৈনিকের মতোই শরীর ছেড়ে বসে পড়ে দৃষ্টি। বাবার কাঁধে মাথা রেখে এক হাতে আঁকড়ে ধরে ঢুকরে কেঁদে ওঠে। প্রধান বিচারক আদালতে পেশ করা রিপোর্টগুলো নিয়ে সহকারীদের সাথে পরামর্শ করেন এবং মিতালী সাহাকে নিজের বক্তব্য পেশ করতে বলেন। মিতালী সাহা, চোখে-মুখে ক্লান্তি আর হতাশায় জর্জরিত, রক্তিমের মুখের দিকে তাকিয়ে গভীর একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। তিনি জানেন এই মুহূর্তে এত শক্ত প্রমাণ এক চুটকিতে মিথ্যা প্রমাণিত করে রক্তিমকে নির্দোষ প্রমাণ করা অসম্ভব। কিন্তু আশা ছাড়লে চলবে না। কেসটা হাতে নেওয়ার সময় মিতালী সাহা ভেবেছিলেন অন্যান্য কেসের মতোই হয়তো খুব সহজেই তথ্য, প্রমাণ জোগাড় হয়ে যাবে। কিন্তু গত চব্বিশ ঘণ্টায় তার সেই ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়ে, রক্তিমের পক্ষে একটি প্রমাণও জোগাড় করতে সক্ষম হননি।
“আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট প্রমাণিত সত্যটাও কিন্তু অনেক সময় মিথ্যা হয়ে থাকে, ইউর অনার। মিথ্যেকে সত্য আর সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখা কিন্তু খুব জটিল কিছু না। এমনও তো হতে পারে প্রসিকিউটর সাহেবের আদালতে পেশ করা সমস্ত রিপোর্ট একটা মিথ্যার আস্তরণে ঢাকা! সেই মিথ্যার আস্তরণটুকু সরিয়ে সত্যটা সামনে আনার জন্য আমার কিছু সময় প্রয়োজন। আমার মক্কেল রক্তিম শিকদার একজন সম্মানিত ব্যক্তি, এবং তার বিরুদ্ধে আনা এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। তিনি চক্রান্তের শিকার। যেহেতু প্রমাণগুলো সব তার বিরুদ্ধে মিলে যাচ্ছে, সেহেতু আমি কেসের পুনরায় তদন্তের জন্য সময় চাই। আমার বিশ্বাস, আরও তদন্তের মাধ্যমে সত্য বেরিয়ে আসবে এবং রক্তিম শিকদারকে এই মিথ্যা অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে। আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, কোর্ট যেন আমাদের আরও এক সপ্তাহ সময় দেয়, যাতে আমরা সঠিকভাবে সবকিছু যাচাই করে দেখতে পারি।”
“প্রশ্নই আসে না। ইউর অনার, সবকিছু যেখানে সুস্পষ্ট সেখানে অযথা তদন্তের নামে কোর্টের মূল্যবান সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।”
প্রসিকিউটরের দিকে শান্ত নজরে তাকিয়ে মুচকি হাসেন মিতালী সাহা। হাসিমুখেই বলেন,
“ওয়েল, মেনে নিলাম সবটা সুস্পষ্ট। আমার মক্কেল রক্তিম শিকদারই আসল খুনি। আমি এখন এখানে দুটি পয়েন্ট তুলে ধরব। এই দুটি পয়েন্টের সঠিক ব্যাখ্যা যদি প্রসিকিউটর আমাকে দিতে পারেন, আমি হার মেনে নেব। এবং আদালতের যেকোনো রায় আমি সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করব। পয়েন্ট নাম্বার ওয়ান, খুনটা যেখানে হয়েছিল, আই মিন রক্তিম শিকদারের পার্টি অফিস। দোতলা বিশিষ্ট সেই পার্টি অফিসের প্রতিটি কোণায় কোণায় সিসি টিভি লাগানো। এবং প্রতিটি সিসি টিভিই সক্রিয়। তবে কেন সেই রাতের কোনো ফুটেজ নেই? কীভাবে উধাও হলো সেই ফুটেজগুলো?”
“খুনি নিশ্চয়ই খুন করে সেটার প্রমাণ বাঁচিয়ে রাখবে না!”
প্রসিকিউটর ফরিদ মির্জার উত্তরে মুচকি হেসে সায় জানিয়ে মিতালী সাহা বলেন,
“এক্সাক্টলি। খুনি যেমন খুন করে সেটার প্রমাণ বাঁচিয়ে রাখবে না, তেমন নিশ্চয়ই খুনি খুন করার পর লাশের পাশে আরাম করে ঘুমাবে না! ইউর অনার, আমার মক্কেল রক্তিম শিকদারকে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে সকালে ঘুমন্ত অবস্থায় গ্রেপ্তার করে। সেই ঘুমটাও কিন্তু স্বাভাবিক কোনো ঘুম ছিল না। গ্রেপ্তার করার দীর্ঘক্ষণ পরও যখন আমার মক্কেল রক্তিম শিকদার স্বাভাবিক চেতনায় ফিরে আসেনি, তখন ব্লাড টেস্টসহ ইমার্জেন্সি কিছু মেডিক্যাল চেকআপের মাধ্যমে জানা যায় রক্তিম শিকদারের শরীরে বেঞ্জোডায়াজেপাইন্স নামক এক ধরনের ড্রাগস চালান করা হয়েছে। এবং সেটা অত্যন্ত সুকৌশলে কফির সাথে মিশিয়ে আমার মক্কেলকে খাওয়ানো হয়েছে। এই ড্রাগসের প্রভাবে একজন মানুষ প্রায় ১২ ঘণ্টা বা তারও উপরে অচেতন থাকে। মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী, রক্তিম শিকদারের শরীরে ড্রাগস প্রবেশ করানো হয় রাত আনুমানিক ১০টার দিকে। অন্যদিকে, তথ্য প্রমাণ অনুযায়ী ভিক্টিমকে খুন করা হয় রাত ১২টার পর। তবে আমার মক্কেল কীভাবে এই হাই পাওয়ারের ড্রাগসের প্রভাব কাটিয়ে খুনটা করল? বিষয়টা কী একটু খতিয়ে দেখা উচিত না?”
আবারও এক উত্তেজিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেছে কোর্টরুমে। মিতালী সাহার পয়েন্ট দুটোই অল্প আশার আলো খুঁজে পেয়ে দৃষ্টির বুক চিরে অল্প স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। সাদেক সাহেব শক্ত করে মেয়ের হাতটা চেপে ধরে নীরবে আশ্বস্ত করেন, “সত্যের জয় হবেই।” আকাশসম বিষাদের ভিড়ে এক টুকরো স্বস্তির হাসি ফুটে ওঠে মেহেদী, রাকিব, জাবির, শান্ত সহ পার্টির সব ছেলেদের মুখে। তবে ভিতরে ভিতরে এখনো অস্থির প্রত্যেকে। আদালত কী সময় দেবে? না কি এই প্রমাণের ভিত্তিতেই রায় দিয়ে দেবে? দমবন্ধকর এক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে প্রায় অনেকটা সময় অতিবাহিত হবার পর অবশেষে বিচারক গম্ভীর স্বরে বললেন,
“কেসের গুরুত্ব এবং পরিস্থিতি বিবেচনা করে, কোর্ট আপনাদের আরও এক সপ্তাহ সময় দিচ্ছে। কিন্তু পরবর্তী শুনানিতে অবশ্যই সমস্ত প্রমাণ এবং তথ্যাদি উপস্থাপন করতে হবে। এবং সেই সাথে আদালতের কার্যক্রম আজকের মতো এখানেই সমাপ্তি ঘোষণা করা হলো।”
চলবে…