একমুঠো রোদ্দুর পর্ব-১৯+২০

0
120

#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ১৯
#আদওয়া_ইবশার

হিডেন ক্যামেরার সম্পূর্ণ ফুটেজ চেক করেও ঐ রাতের কোনো ভিডিও পাওয়া যায়নি। দিকহারা নাবিকের ন্যায় উতলা হয়ে উঠেছে প্রতিটা মানুষ। এই একটাই উপায় ছিল তাদের হাতে,যা দিয়ে কেসের মোড় ঘুরানোর আশায় ছিল সবাই। অবশেষে সেটাও ব্যর্থ। গম্ভীর চিত্তে মিতালী সাহা বসে আছে চলন্ত গাড়িতে। দৃষ্টি তার জানালার কাচ গলিয়ে স্থির হয়ে আছে যানজটপূর্ণ রাস্তায়। অতিরিক্ত চিন্তায় চোখ-মুখ কঠোর হয়ে আছে। টিমের বাকী সদস্য গুলোর মুখেও কোনো রা-শব্দ নেই। গাড়িতে উপস্থিত প্রতিটা মানুষই যেন এই মুহূর্তে বোবা প্রাণী। তবে ওবায়েদ বহুক্ষণ যাবৎ হাঁসফাঁস করছে কিছু একটা বলার জন্য। কিন্তু থমথমে পরিবেশ আর সিনিয়রের ভাবগম্ভীরতায় বলার সাহস পাচ্ছেনা। মিতালী সাহা দৃষ্টি বাইরে স্থির রেখেই কাটকাট স্বরে হঠাৎ নিরব পরিবেশটাকে সরব করে বলে ওঠেন,

“কী বলতে চাও ভনিতা না করে সরাসরি বলে ফেলো ওবায়েদ।”

খানিক চমকে ড্রাইভিং সিটে বসা ওবায়েদ হঠাৎ ব্রেক কষে হ্যাবলার মতো ঠাই বসে থাকে। তার এহেন মগজহীন কান্ডে হতবিহ্বত বাকিরা। মিতালী সাহা মেজাজ হারিয়ে কঠিন স্বরে ধমকে ওঠেন,

“দিন দিন কী সত্যিই তোমার বুদ্ধি হাঁটুর নিচে নামছে ওবায়েদ? এভাবে কেউ ব্রেক কষে?”

নিজের এহেন হঠকারিতায় উবায়েদ নিজেই তব্দা খেয়ে বসে আছে।সে নিজেও বোধহয় ভাবেনি হঠাৎ এভাবে সিনিয়রের ঝাঝালো কথার তোপে পরে সরাসরি ব্রেক কষে ফেলবে। আমতা আমতা করে নিজের হয়ে সাফাই গাইতে কিছু একটা বলতে নেয় উবায়েদ।তার আগেই তাপসী রগড় করে বলে ওঠে,

” ওবায়েদ সাহেব বোধহয় ভেবে নিয়েছে কেস সলভ হবার আগেই যমের বাড়ি দেখিয়ে আনবে আমাদের ম্যাম।”

“তোমার সবকিছুতে এই ফাজলামি করার বদ অভ্যাসটা দ্রুত চেইঞ্জ করো তাপসী। না হয় আমাকে খুব শিগগিরই তোমাদের প্রত্যেককে ছাটাই করে নতুন কাউকে আনতে হবে। আমার উকালতি পেশার দীর্ঘ পনেরো বছর বয়সে তোমাদের মতো এমন ছাগলমার্কা টিম মেম্বার নিয়ে কাউকে কাজ করতে দেখিনি। কী দেখে যে আমি এখনো তোমাদের আমার টিমে রেখেছি ইশ্বর ভালো জানেন!”

সিনিয়র অ্যাডভোকেট তাপসী পালের দিকে সূক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে ধীর চোয়ালে কথা গুলো বলে মিতালী সাহা ফের দৃষ্টি ঘুরায় ওবায়েদ এর দিকে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে ওঠে,

“ওবায়েদ, তুমি কী পেট থেকে কথা বের করবে না আমি অন্য ব্যবস্থা নিব?”

এই মহিলার অন্য ব্যবস্থা নেওয়া মানেই যে কামানের মতো ধারালো মুখটা ওবায়েদ এর ল্যাংটা কালের মানসম্মান বিসর্জিত ঘটনা থেকে শুরু করে চৌদ্দ পুরুষের মানসম্মান প্লাস্টিক করে ফেলা একের পর এক ঘটনার বর্ণনা দেওয়া তা ওবায়েদ খুব ভালো করেই জানে। মিতালী সাহার সাথে সে কাজ করছে দুই বছর পূর্ণ হলো বোধহয়। এই দুই বছরে ভদ্র মহিলা যে কতবার জনসম্মুখে তার মানসম্মান দফারফা করেছে এর কোনো ইয়াত্ত নেই। অবশ্য ভদ্র মহিলাকে সুযোগটা করে দিয়েছে তার গর্ভধারিণী মা নিজে। ভীষণ সরলা মা ওবায়েদ এর। যখনই মিতালী সাহার সাথে কোনো কারণবসত দেখা হয়েছে, তখনই যত পেটের কথা আর পিঠের কথা আছে সব উগলে দিয়ে গেছে। কিচ্ছু বাদ রাখেনি। মায়ের এই অত্যাধিক সরল ভাবমূর্তির জন্য ওবায়েদ যেখানেই যায় সেখানেই বলির পাঠা হয়।

“ওবায়েদ!”

জোরালো একটা ধমকে ভাবনা জগতে বিচরণ করা ওবায়েদ হতচকিয়ে ওঠে। ত্রস্ত গড়গড় করে বলে ওঠে,

“ম্যাম আমি বলছিলাম কী, আমাদের বোধহয় একটু কাদের ভুঁইয়ার ছোট ভাইয়ের পাস্ট হিস্ট্রি খুঁটিয়ে দেখা উচিৎ।আমি একটা খবর পেয়েছি ঐ ছেলের ছোট বেলা থেকেই হার্টের প্রবলেম ছিল।”

“ঐ ছেলে অতীতে কী করেছে, কোন রোগে ভুগেছে, কখন খেয়েছে, কখন টয়লেট করেছে এসব জেনে আমাদের লাভটা কী ওবায়েদ ভাই?”

মারাত্মক অনিহা নিয়ে কথাটা বলে তাপসী। পরপর বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নজর দেয় বাইরের দিকে। অস্পষ্ট স্বরে বিরবির করে,

“কোন জন্মের পাপের খেসারত দিতে যে এই বা’লের কেসে ফেঁসেছি ভগবান জানেন।”

তাপসীর কথায় ওবায়েদ রাগেনা। বরং অত্যন্ত বিনয়ী স্বরে পূণরায় বলে,

“আহা!আপনি এতো রেগে যাচ্ছেন কেন? দেখুন, এমনতো হতেই পারে ওনার পাস্ট হিস্ট্রি খুঁজতে গিয়েই আমরা কোনো একটা ক্লু পেয়ে গেলাম, যার মাধ্যমে সত্য পযর্ন্ত পৌঁছাতে পারব।”

“আর তখন যদি সেই সত্যটা এটা প্রমাণ করে, রক্তিম শিকদারের হাতেই খুন হয়েছে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ কাদের ভুঁইয়ার ছোট ভাই শাহীন ভুঁইয়া! তখন কী করবেন?”

“যদি এমন কিছু হয় তবে এটাই হবে অ্যাডভোকেট মিতালী সাহার লড়া শেষ কেস।”

ভাবলেশহীন স্বরে জবাবটা দিয়ে মিতালী সাহা আড়মোড়া ভেঙ্গে নড়েচড়ে বসে।ছোট্ট একটা হাই তুলে অলস ভঙ্গিতে বলেন,

“ওবায়েদ! এখানেই নেমে পরো। যতদূর জানি এখান থেকে পায়ে হেঁটে মাত্র বারো মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করলেই কাদের ভুঁইয়ার বাসা পেয়ে যাবে। তোমার কাজ এই মুহূর্ত হতে এখান থেকেই শুরু। আর হ্যাঁ, মাথায় রেখো আমাদের হাতে বেশি সময় নেই।যা করার দ্রুত করতে হবে। আর তাপসী, তুমি এখন আমার সাথে থানায় যাবে।”

কেউ আর কোনো কথা বাড়ায়না। নেমে যায় ওবায়েদ সেখানেই।অ্যাডভোকেট মিতালী সাহার গাড়িটা ছুটে থানার উদ্দেশ্যে। ইতি-উতি তাকিয়ে ওবায়েদ একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। সময়টা মধ্য দুপুর। বায়োজেষ্ঠ্য দোকানি কাস্টমার না থাকায় নিজের গদিতে বসে নাক দিয়ে অদ্ভূত শব্দ করে ঘুমাচ্ছে। লোকটা যতবার নিঃশ্বাস ফেলছে ততবার নাক ডাকা শব্দের সাথে ঠোঁট উল্টে থুথু ছিটাচ্ছে। এক নজর ঐদিকে তাকিয়েই গা গুলিয়ে ওঠে ওবায়েদ এর। এতো বিচ্ছিরি ঘুমও বুঝি কারো হয়? এই লোকের চা কিভাবে খায় মানুষ? নাক ছিটকে দোকানের সামনে থেকে চলে আসে ওবায়েদ। আশেপাশে তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করে অন্য কোনো চায়ের স্টল বা টং দোকান খোলা আছে কী না। কিন্তু ভরদুপুর হওয়ায় পুরো এরিয়াটাই যেন গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। কোথাও একটা কাকপক্ষিও নেই। ব্যর্থ একটা নিঃশ্বাস ফেলে ওবায়েদ পূণরায় ফিরে যায় চায়ের দোকানের সামনে। কিছুক্ষণ চোখ-মুখ কুঁচকে লোকটার ঘুমানোর বেহাল দশা দেখে ইতস্তত ভঙ্গিতে উঁশখুঁশ করে ডেকে ওঠে আস্তেধীরে,

“মামা! ও মামা শুনছেন?”

দুই-তিনবারের ডাকেই লোকটা ধরফরিয়ে ওঠে বসে। উত্তেজিত ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে চেষ্টা করে ডাকের উৎস খোঁজার। লোকটার ব্যতিব্যস্ততা দেখে ওবায়েদ সরল হেসে আবারও বলে,

“মামা! এই যে এদিকে আমি। শুনেছি আপনার দোকানের চা না কী পুরো সাভারের বেস্ট চা! তাই লোভ সামলাতে না পেরে এই ভর দুপুরে চলে এলাম আপনার হাতের এক কাপ গরম গরম চা খেতে।”

বলে বোকার মতো আবার হাসে ওবায়েদ। লোকটা কেমন যেন সন্দিহান নজরে তাকিয়ে দেখে ওবায়েদ এর হাসি মুখ। কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে সন্দিগ্ধ স্বরেই চড়া গলায় বলে,

“ঐ মিয়া! বোকা পাইছো আমারে? এই ভরদুপুরে যেইখানে মানুষ ঠান্ডা খাইয়া কূল পায়না, সেইহানে তুমি আমার কাছে গরম গরম চা খাইতে আইছো? তোমার মাথায় গ্যাস্ট্রিক আছে না কী আমার মাথায় গ্যাস্ট্রিক? মতলব কী কইয়া ফেলাও। চুরিটুরির ধান্দায় আইছো না তো আবার?”

দোকানির কথায় আচমকা ওবায়েদ এর হেঁচকি ওঠে টালমাটাল অবস্থা। বলে কী এই লোক? তার মতো এমন সম্মানিত একজন ব্যক্তিকে সরাসরি চোর বানিয়ে দিল? এই উকালতি পেশা যে তাকে আর কী কী উপাধিতে ভূষিত করবে মাবুদ ভালো জানেন। লাখ লাখ টাকা খরচ করে পড়ালেখা করে লাস্ট পযর্ন্ত চোর-ডাকাত, বাপটার, চিটার যা আছে সব উপাধি পেতে হলো। আগে জানলে পড়াশোনার পিছনে লাখ টাকা খরচ না করে এমন একটা চায়ের দোকান বানিয়েই লোকটার মতো দিনরাত ঠুসে ঠুসে ঘুমাতো ওবায়েদ। এতে অন্তত মানসম্মান একটু হলেও অবশিষ্ট থাকতো। জোরপূর্বক হেসে ওবায়েদ ব্যতিব্যস্ত হয়ে নিজেকে ভালো মানুষ প্রমাণ করতে চায়,

“ধুর মামা! কী যে বলেন না! আমার চেহারা দেখে কী আপনার চোর মনে হয়?”

“তুমি যে চোর না হেইডা তোমার চেহারায় কোথাও লেখা আছে?”

প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন শুনে এবার ওবায়েদ এর ইচ্ছে হচ্ছে নিজের কপাল নিজে চাপড়াতে। এই লোকের ঘুমানোর বেহাল দশার পাশাপাশি যে মাথার তারও সব কয়টা ছেঁড়া এটা আগে জানলে ওবায়েদ ঘুনাক্ষরেও এই দোকানমুখো হতনা। ব্যর্থতার গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে শেষ পযর্ন্ত ওবায়েদ হার মেনে বলে ওঠে,

“থাক মামা! আপনার আর আমারে চা খাওয়াইতে হবেনা। চা খাওয়ার শখ আমার আজন্মের জন্য মিটে গেছে। কৃতজ্ঞতা আপনার প্রতি, আমার চায়ের পিছনে খরচ করা টাকা গুলো বাচিয়ে দেবার জন্য। আসি ভালো থাকবেন।”

বলেই চলে যেতে নেয় ওবায়েদ। দুই-তিন কদম ফেলতেই দোকানি পিছন থেকে ডেকে ওঠে,

“এতো কষ্ট কইরা যহন আমার স্বাদের ঘুমডা ভাঙ্গাইছেন, তখন এক কাপ চা খাইয়াই যান। এতো ভাব লওন লাগবনা। আহেন। দুধ চা দিমু না কী রং চা?”

“কড়া করে এক কাপ লিকার মামা।”

মুখ ভরে হেসে জবাব দিয়ে বেঞ্চে গিয়ে আরাম করে বসে ওবায়েদ। মনে মনে ভাবে, বলে তো দিল কড়া লিকারের কথা। কিন্তু এই চা আদও সে খেতে পারবে তো? এখনো চোখের তারাই লোকটার একটু আগের ঘুমন্ত অবস্থার চিত্র ভাসছে। কেমন করে মুখ দিয়ে থুথু বের হচ্ছিলো মনে পরতেই এখনো গা গুলিয়ে বমি আসতে চাইছে। দোকানি কেটলিতে চায়ের পানি ফুটাতে ফুটাতে জানতে চায়,

“তা এই এলাকায় নতুন না কী মামা? আগে দেহিনাই যে!”

উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সাই জানায় ওবায়েদ। মুখটা দুঃখী দুঃখী করে বলে,

“আমার দেশের বাড়ি মামা কুমিল্লা। এখানে আসছিলাম বন্ধুর কাছে। কিছুদিন আগে শুনেছিলাম বন্ধুটা অসুস্থ। এরপর নিজেও একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই আসা হয়ে ওঠেনি। ফোনটাও হঠাৎ চুরি হয়ে যাওয়ায় আর খবর নিতে পারিনি।এখন আজ এসে শুনি বন্ধুটা আমার আরও দশদিন আগেই মারা গেছে।”

ওবায়েদ এর কথা গুলো শুনে দোকানির মুখের ভাবমূর্তি কিছুটা পরিবর্তন হয়। আফসোস ঝেড়ে বলেন,

“আহারে! কন কী মামা, আপনার বন্ধু আমগো এই এলাকার না কী?”

“হ্যা মামা। আপনিও হয়তো চিনবেন তাকে। খুব বড়ো রাজনৈতিক পরিবারের ছেলে। কাদের ভুঁইয়া আছে না! এবার যে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে? ওনার ছোট ভাই শাহীন আমার বন্ধু। আমরা এক কলেজে পড়তাম মামা।”

দোকানি কিছুটা চমকে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে ওঠেন,

“আরে মিয়া! আপনি শাহীন ভুঁইয়ার বন্ধু এই কথা আগে কইবেন না? এই পরিচয় দিলে কী আর এতোক্ষন এতো গুলা কথা কওন লাগে?”

কেটলি থেকে ধোয়া উঠা গরম চা কাপে ঢালতে ঢালতে দোকানি পূণরায় কন্ঠে আফসোস নিয়ে বলে ওঠে,

“পোলাডা মেলা ভালা আছিল মামা। তই বড়ো ভাইটা ছোড থেইকাই জম্মের শয়তান। বাপটাও আছিল এক নাম্বারের খাডাইস। বড়ো ভাই আর বাপরে ছাড়াইয়া পোলাডা ভালো মানুষ হইয়াই উঠছিলো। তয় একটা কথা কী জানেন মামা! ভালা মানুষরেই আল্লাহ দুঃখ দেয় বেশি। আর দুনিয়া থেইকাও উঠাইয়া নেয় তাড়াতাড়ি। ছোডু থেইকাই হুনতাম এই অসুখ সেই অসুখ। যেদিন খুন হইলো এর দুইদিন আগেও আমি দোকানে বইসা দেখছি এম্বোল্যান্সে কইরা হাসপাতালে নিতাছে। শ্বাসকষ্ট উঠলে না কী গলা কাডা মুরগির মতো তড়পাইতো। এর দুইদিন পরেই হুনলাম রক্তিম শিকদারের হাতে খুন হইছে।বাপ-ভাইয়ের পাপের ফল বোধহয় ভালা পোলাডা পাইছে। আল্লাহর যে কী বিচার আল্লাহই ভালো জানে।”

জহুরী নজরে দোকানির মুখের দিকে তাকিয়ে সব গুলো কথা শুনে ওবায়েদ আস্তেধীরে প্রশ্ন করে,

“হাসপাতাল থেকে শাহীনকে কবে বাড়িতে আনা হয়েছিল এই বিষয়ে জানেন কিছু মামা?”

“হেইডা তো জানিনা মামা। যাওনের সময় দোকানে বইসা দেখছিলাম তাই কখন গেছিলো এইডা কইবার পারছি। কিন্তু কখন আসছিল এইডা দেহিওনাই কইবারও পারুমনা।”

বলতে বলতে চায়ের কাপটা এগিয়ে দেয় ওবায়েদ এর দিকে। এক দৃষ্টিতে গরম ধোয়া উঠা চায়ের কাপটার দিকে ওবায়েদ একক্ষণ স্থির তাকিয়ে থেকে এক সময় দোকানির আড়ালে বেঞ্চের নিচে আস্তে করে চা টুকু ফেলে দেয়। তিন-চার মিনিট অহেতুক প্যাঁচাল পেরে বিল মিটিয়ে ওঠে যায়। আপাতত এখানের কাজ শেষ তার। যেটুকু জেনেছে এর বেশি জানতে গেলে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। হাঁটতে হাঁটতে একটু দূরে গিয়ে কল লাগায় মিতালী সাহার নাম্বারে। দুবার রিং হতেই মিতালী সাহা কল রিসিভ করে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলেন,

“যত দ্রুত সম্ভব রয়েল হাসপাতালে চলে আসো। শাহীন ভুঁইয়াকে এই হাসপাতালেই আনা হয়েছিল খুন হবার দুদিন আগে।”

কথাটা শোনা মাত্রই ভীষণভাবে চমকে ওঠে ওবায়েদ। আপনাতেই চাপা ঠোঁট দুটোর মাঝে দূরত্ব চলে আসে। কন্ঠে অঘাত বিস্ময় নিয়ে জানতে চায়,

“আপনি কিভাবে এই খবর জানলেন ম্যাম?”

“তোমার মতো কী আমাকেও রাবণের ভাই কুম্বকর্ণ মনে করো ওবায়েদ? মা কালির মতো চার চোখ আমার। দুইটা দৃশ্যত বাকি দুইটা অদৃশ্য। আমি ঘুমালেও আমার চোখ-কান সর্বদা খোলা থাকে। বেশি কথা বাড়িওনা। দ্রুত আসো।”

চলবে….

#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ২০(প্রথম অংশ)
#আদওয়া_ইবশার

ঢাকার মতো ব্যস্ত নগরীর জ্যামের কারণে হাসপাতালে পৌঁছাতে বেশ অনেকটা দেরী হয়ে যায় ওবায়েদ এর। লিফটের আশায় না থেকে সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলায় উঠতেই দেখা হয় মিতালী সাহা এবং তাপসীর সাথে। দুজনই সিরিয়াস মুখে কিছু একটা নিয়ে নিচু স্বরে আলোচনা করছে। দ্রুত কদমে দুজনের কাছে গিয়ে ওবায়েদ উদ্বিগ্ন মুখে জানতে চায়,

“এনিথিং সিরয়াস ম্যাম?”

মিতালী সাহা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,

“রিসিপশনিস্ট থেকে শুরু করে ডাক্তার, ওয়ার্ড বয় যাকেই জিজ্ঞেস করছি শাহীন ভুঁইয়ার ব্যাপারে, সেই সরাসরি অস্বীকার যাচ্ছে। আমার মনে হয় এখানে বড়ো কোনো রাঘববোয়ালের হাত আছে ওবায়েদ। বারবার মন বলছে, শাহীন ভুঁইয়ার অসুস্থতার জন্য স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু কেউ এটাকে স্বার্থচরিতার্থের জন্য খুন হিসেবে দেখিয়েছে। ”

“এখন কী করব ম্যাম? সব কিছুই তো একে একে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।কেসটা যে এতো জটিল হয়ে দাঁড়াবে একদম কল্পনাতীত ছিল।”

“পরিস্থিতি যতই জটিল হোক। আমাদের পিছিয়ে পরলে চলবেনা ওবায়েদ। তুমি এক কাজ করো, দিহানকে একটা ফোন দাও। বলো যত দ্রুত সম্ভব এখানে চলে আসতে। সে যেহেতু এন্টি টেরোরিজম ইউনিটে আছে, আমার মনে হয় তার পাওয়ার এখানে প্রয়োজন আমাদের। হতে পারে ওর পরিচয় শুনে অন্তত একজন হলেও ভয়ে মুখ খুলবে।”

মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে ওবায়েদ কল লাগায় দিহানের নাম্বারে।সেই মুহূর্তে দিহান অ্যাডিশনাল আইজি মোবারক আহমেদ এর রুমে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং শেষে রক্তিমের কেসটা নিয়েই কথা বলার জন্য ফাঁক খুঁজছিল। কেসটা নিজের হাতে নেওয়ার জন্য প্রথম থেকেই চেষ্টার ক্রুটি রাখছেনা দিহান। কিন্তু সম্ভব হচ্ছেনা। মাঝে আবার সাভার থানার ওসি কামরুল হাসানের সাথে হওয়া ছোটখাট ঝামেলাটাও জানাজানি হওয়ায় বেশ খেসারত দিতে হয়েছে তাকে।নিরবে দাঁড়িয়ে হজম করতে হয়েছে অ্যাডিশনাল আইজির বিষবাণ। মোবারক আহমেদ শান্ত দৃষ্টিতে দিহানের নত মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অত্যন্ত দাম্ভিক স্বরে বলে ওঠেন,

“প্রফেশন আর ফ্যামিলি, এই দুটো জিনিস যদি একসাথে জড়িয়ে কিছু বলতে চাও তবে আমি বলব প্রয়োজন নেই।নিজের কাজে মন দাও।”

আগেভাগেই শতর্কবার্তা শুনেও গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে দিহান নম্র কন্ঠে অনুরোধের সুরে বলে,

“স্যার প্লিজ! অন্তত একটাবার আমার দিকটা একটু ভেবে দেখুন। আমি কারো আত্মীয় হয়ে না, বরং আমার পেশাগত দিক থেকেই কেসটা হাতে নিতে চাচ্ছি।”

“কেসটা সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি খুব জটিল কিছুনা। ইভেন এই পযর্ন্ত সকল তথ্যাদি এটাই প্রমাণ করে রক্তিম শিকদার খুনটা সত্যিই করেছে। আমাদের কাজ কী তা তুমি ভুলে যাচ্ছো দিহান? সাধারণ পুলিশ যদি ব্যর্থ হয় তবেই একটা কেস আমাদের হাতে আসে। এখানে আমার মনে হচ্ছেনা তারা ব্যর্থ। তোমাকে আমি শেষবারের মতো ওয়ার্ন করছি, লিমিটের ভিতর থাকো। বিশ্বাস করো, তোমার জায়গায় যদি অন্য কোনো অফিসারকে নিয়ে আমার কানে অভিযোগ আসতো আমি তৎক্ষণাৎ সাসপেন্ড করতাম তাকে। কিন্তু তোমার লাক ভালো পার্সোনালি আমি তোমাকে যথেষ্ট পছন্দ করি। এবং সেটাও তোমার প্রফেশনাল লাইফের পাস্ট হিস্ট্রিতে থাকা সাকসেস গুলোর জন্যই। তোমার মতো একজন সৎ এবং কর্মঠ অফিসারের এই ইউনিটের প্রয়োজন। তাই এটাও ভাবতে পারো নিজেদের প্রয়োজনেই তোমাকে শেষবারের মতো একটা সুযোগ দিলাম।”

“আমার মতো একজন সৎ, কর্মঠ অফিসারকে যেমন এই ইউনিটের প্রয়োজন, তেমন আমার একমাত্র বোনেরও তার বিপদের দিনে তার ভাইকে প্রয়োজন স্যার। আমার প্রথম পরিচয় আমি মানুষ, এরপর কারো ছেলে, কারো ভাই। এরও পর আমি এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের অ্যাডিশনাল এসপি। আমি যদি আমার পরিবারটাকেই সেইফ রাখতে না পারি, তবে কিভাবে পুরো দেশের মানুষকে সেইফ রাখব? গোটা দেশের মানুষের হয়ে যদি জীবন বাজি রেখে লড়তে পারি, তবে কেন পরিবারের জন্য পারবনা?”

স্থান-কাল ভুলে ভীষণ মেজাজি হয়ে কথা গুলো বলে ওঠে দিহান।পারিপার্শ্বিক একের পর এক ঝামেলায় অতিষ্ঠ হয়ে ভুলে যায় তার সামনে বসা মানুষটা সিনিয়র অফিসার। ভুলক্রমেও সে সিনিয়রের সাথে এরূপ আচরণ করতে পারেনা। মোবারক আহমেদ নিজেও দিহানের এরূপ আচরণে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে তার মুখপানে। পরপর কঠিন মুখাবয়বে শক্ত চোয়ালে ধমকে ওঠে দিহানকে,

“ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট দিহান। দায়িত্বের কথা বলে ব্যক্তিগত আবেগকে তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার প্রশ্রয় দিচ্ছো।এরকম কিছু অন্তত তোমার থেকে আমি কখনো আশা করিনি। সব মানুষই নিজের পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে চায়, কিন্তু সেটা আমাদের পেশাগত জীবনের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে কখনো সম্ভব নই। ভুলে যাচ্ছো নিজের শপথের কথা?যে ইউনিফর্মটা গায়ে জড়িয়েছো, তার যেন এক বিন্দু অবমূল্যয়ন না হয়, শেষবারের মতো সাবধান করছি তোমাকে। ইউ ক্যান গো নাউ।”

কথা গুলো শুনতে শুনতে দিহানের হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ওঠে। দাঁতে দাঁত পিষে তড়তড় করে মাথায় চড়ে বসা রাগ,ক্ষোভটাকে সামলে ব্যর্থতাকে সঙ্গী করে বেরিয়ে আসে আইজির রুম থেকে। নিজেকে এই মুহূর্তে তার স্রেফ একটা তুচ্ছ কীট মনে হচ্ছে।পুরোপুরি অপদার্থ একটা মানুষ সে। সেই সাথে ভীষণ অযোগ্য ভাই। বোনের এতো বড়ো একটা বিপদে না পারছে নিজের পেশাগত শক্তি কাজে লাগাতে আর না পারছে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে। দিনকে দিন এক অন্যরকম মানসিক যন্ত্রণায় ভিতর ভিতর ছটফটিয়ে মরছে শুধু। হুটহাট ইচ্ছে হচ্ছে ঠিক এই মুহূর্তেই চাকরি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে। যে চাকরি, যে পাওয়ার নিজের আপন মানুষের কষ্ট দূর করতে পারবেনা, কী লাভ সেই চাকরি করে? কিন্তু পর মুহূর্তেই চৌকস বুদ্ধিদীপ্ত দিহান বাস্তবতার দুয়ারে দাঁড়িয়ে হঠকারী সিদ্ধান্তটা একদম ঝেড়ে ফেলছে মস্তিষ্ক থেকে। এই মুহূর্তে রাগে-ক্ষোভে হোক বা অভিমানেই, যেকোনো কারণে চাকরি ছেড়ে দেওয়া মানেই পরিস্থিতি আরও জটিল করা। এমনিতেই দুই পরিবারের মানুষ গুলো দিন-রাত পার করছে অজস্র চিন্তা আর দুর্বিসহ যন্ত্রণাকে সঙ্গে নিয়ে।দিহান চায়না এই মানুষ গুলো আবার নতুন করে তাকে নিয়েও চিন্তায় পরুক। সময়টা হয়তো একটু বেশিই খারাপ যাচ্ছে। তাই বলে রাগের মাথায় চাকরি ছেড়ে দেওয়াটা নেহাৎ বোকামি ছাড়া কিছুই হবেনা।

আইজির রুম থেকে বেরিয়ে নিজের কেবিনের দিকে যাবার পথেই ইমরান পথ আটকে দাঁড়ায় দিহানের। সে মিটিংয়ে যাবার আগে ফোনটা তাড়াহুড়োয় ইমরানের কাছে রেখে গিয়েছিল।

“স্যার, লিগ্যাল রিসার্চার ওবায়েদ হাসান কল করেছিল। আপনাকে ইমার্জেন্সি রয়েল হাসপাতালে যেতে বলেছে।”

“বারোজনের একটা টিম গঠন করে দ্রুত বের হতে হবে আমাদের। কাল্লু কাদিরের খোঁজ পাওয়া গেছে শ্রীপুড়। অন্যদের পাশাপাশি তুমি আর ফয়েজ মাস্ট থাকবে আমার সাথে। দশ মিনিটের ভিতর সব যেন রেডি হয়ে যায়, গো।”

ফোনটা হাতে নিতে নিতেই অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে জবাব দেয় দিহান।জবাবটুকু ইমরানের কাছে কেমন যেন যন্ত্রমানবের মতো মনে হয়। যেন কোনো এক রোবট মুনিবের ইশারায় নিজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।

পিচঢালা শুনসান রাস্তায় টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো গাড়িটা দূর্বার গতিতে ছুটে যাচ্ছে। গম্ভীর, গুমটবাঁধা পরিবেশ গাড়ির ভিতর। ড্রাইভিং সীটে বসা ইমরান স্ট্রিয়ারিং নিয়ন্ত্রণ রাখার পাশাপাশি আড়চোখে কতক্ষণ পরপর দিহানের থমথমে মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করছে। ঢাকা-টঙ্গী সড়কে উঠতেই হুট করে ব্রেক কষে ইমরান। দিহান গম্ভীর নজরটুকু বাইরের থেকে ফিরিয়ে ইমরানের দিকে তাকায়। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ইমরান ভীষণ নরম স্বরে বলে,

” শ্রীপুড় যাবার থেকেও এই মুহূর্তে আপনার রয়েল হাসপাতালে যাওয়া প্রয়োজন স্যার। আপনি যান, কথা দিচ্ছি এদিকটা আমরা সবাই মিলে সামলে নিব।”

বিরক্ত মুখে দিহান ধমকে কিছু বলতে নিলেই পিছন থেকে ওয়াসীম অনুনয় করে বলে ওঠে,

“স্যার প্লিজ!সবসময় তো আমরা আপনার কথা মেনে চলি। এবার না হয় আপনি একটু আমাদের অনুরোধটা মেনে নিলেন?”

নিজের সিদ্ধান্তে অনড় দিহানকে কেউ টলাতে পারেনা। শেষ পযর্ন্ত হতাশ হয়ে ইমরান পূণরায় গাড়ি ছুটায় শ্রীপুড়ের উদ্দেশ্যে।

চলবে…

#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ২০(শেষ অংশ)
#আদওয়া_ইবশার

কেসের দ্বিতীয় শুনানি আজ। আদালত প্রাঙ্গন প্রতিবারের মতোই পুলিশ, সাংবাদিক, উকিল সহ সাধারণ মানুষের আগমনে পরিপূর্ণ। অসুস্থ শাশুড়ির কাছে মা’কে রেখে দূর্বল শরীর নিয়েই আদালতে ছুটে এসেছে দৃষ্টি। কালচে, মলীন দুচোখে তার সে কী আকুতি! একটু আশার খোঁজে ভীষণ উদগ্রীব নয়নজোড়া। মনটা ডানা কাটা পাখির মতোই ছটফটিয়ে মরছে প্রতি মুহূর্ত অল্প স্বস্তির আশায়। বোনের পাশে আজ দিহান উপস্থিত। ভাগ্য সহায় ছিল বলেই বোধহয় আজকের দিনটা ছুটি নিয়ে বোনের পাশে থাকতে পারছে। নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় বোনের দূর্বল হাতটা ধরে রেখে আদালতের একপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় মিতালী সাহা এবং তার টিমের।রক্তিমকেও এখনো কোর্টে হাজির করা হয়নি। শোনা যাচ্ছে আর মিনিট পাঁচেকের মাঝেই চলে আসবে। আদালতের মূল রাস্তার পাশের বড়ো ফটকের দিকে দৃষ্টির শুকনো ফ্যাকাশে মুখটা নিবদ্ধ। প্রাণ পুরুষটাকে এক ঝলক দেখার আশায় অন্তরাত্মা ভীষণ ছটফটে হয়ে আছে। সময়টা যেন শেষই হচ্ছেনা। মানুষটার সাথে সেই যে প্রথম দিন থানায় দেখা হলো এরপর কতগুলো দিন কেটে গেল চোখের দেখাটুকুও দেখেনা। অবশ্য দেখার সুযোগটাও দৃষ্টির হয়ে উঠেনি। একের পর এক বিপদের সম্মুখীন হয়ে নিজের ভিতরের সুপ্ত অনুভূতিটাকে হারিয়ে ফেলেছে কোনো এক অজানায়। যে হৃদয়ে ভালোবাসার ফুল ফুটতো প্রতিনিয়ত সেই হৃদয়ে আজ শুধু প্রভাতের বেলীর মতো ঝরে ঝরে দুঃখ বর্ষিত হয়। বহুল আরাধ্য পুরুষটাকে এক নজর দেখতে পাবার তৃষ্ণায় মরিয়া হয়ে থাকা মনটা আজ চাপা পরে গেছে কষ্ট আর দায়িত্বের ভারে। সর্বদা শুধু স্বামী, সন্তান আর সংসারের চিন্তায় বিভোর থাকা দৃষ্টির কাঁধে হুট করে এতো বড়ো দায়িত্বটা ভীষণ বোঝা মনে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় একের পর এক মানসিক চাপে পাগল হবার পথে সে। জীবনের প্রতি যখনই অভিযোগ চলে আসে অবচেতন মনে, তখনই ইচ্ছে হয় সব ছেড়েছুড়ে কোথাও একটা পালিয়ে যেতে। কিন্তু পরোক্ষণেই রক্তিমের শক্ত চোয়ালের গুরুগম্ভীর মুখটা যখন দুচোখের পাতায় ভেসে ওঠে তখনই মনটা নিজের ভাবনার বিরুদ্ধেই বিদ্রুহ শুরু করে। নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিয়ে ভাবে, “ঐ মানুষটা যদি তাদের জন্য এতো কিছু সহ্য করতে পারে সারা বছর তবে সে কেন সামান্য কয়টা দিন একটু সহ্য করতে পারবেনা? জীবন মানেই তো উত্থান-পতন। এক জীবনে দুঃখ যেমন বারবার আসে, তেমন দুঃখ শেষে সুখটাও প্রতিবারই আসে। দাঁতে দাঁত পিষে ধৈর্য্য নিয়ে দুঃখটাকে বিদায় করতে পারলেই দেখা মিলবে সুখের সোনারোদের।স্রেফ এইটুকু যদি কারো পক্ষে সম্ভব না হয় তবে তার এই অদ্ভুত মানবজীবনে টিকে থাকাও সম্ভব হবেনা। অদ্ভুত পৃথিবীর অদ্ভুত নিয়ম মেনে শত চড়াই- উতড়াই ঢিঙ্গিয়ে ভবিষ্যতের পথে হাঁটতে পারাটাই মানব জাতির সবথেকে বড়ো সফলতা। এই জীবন যুদ্ধে দৃষ্টিও একদিন সফল হবে। হয়তো তার সেই সফলতার দিনটা খুব একটা নিকটে না। আবার হয়তো খুব দূরেও না।

আদালতের মূল ফটক পেরিয়ে পরপর পুলিশের দুটো গাড়ি এসে উপস্থিত হতেই মিডিয়ার লোকজন ঘিরে ফেলেছে জায়াগাটা। এতো মানুষের ভীড়ে দূর থেকে দৃষ্টির পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা রক্তিমকে এক ঝলক দেখা। ছটফটে মনে অস্থির হয়ে দিহানের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ভাই! একটু যায় ওখানে? শুধু এক নজর দেখেই চলে আসব।”

বোনের নেতিয়ে পরা অসহায় মুখের দিকে তাকালেই দিহানের পুরুষালী কঠোর সত্তাটা বারবার দুমড়েমুচড়ে যায়। অসহনীয় এক যন্ত্রণা ভীষণ পীড়া দেয় সর্বাঙ্গে। মনে হয় তার মতো এমন কুলাঙ্গার অসহায় ভাই বোধহয় এই পৃথিবীতে আর কোনো বোনের নেই। লজ্জা লাগে নিজেকে ভাই হিসেবে পরিচয় দিতেও। বারবার ধিক্কার আসে নিজের প্রতি। বুক ফুলিয়ে ব্যর্থ একটা নিঃশ্বাস ফেলে দিহান বোনের হাতটা আর একটু শক্তভাবে নিজের হাতের মুঠোয় পুড়ে নরম সুরে বলে,

“অনেক ভীড় ওখানে আপু। একটু অপেক্ষা করো, এখান থেকেই দেখতে পাবে।”

অল্পক্ষণের মাঝেই দিহানের কথাটাই ঠিক হয়। পুলিশ ভীড় ঠেলে আসামির বেশে থাকা রক্তিমকে নিয়ে দ্রুত কদমে এগিয়ে যাচ্ছে আদালত ভবনে। দৃষ্টির মনে এক আশ্চর্য মায়া জাগানো শক্ত চোয়াল, টিকালো নাক, আর শাণিত দুটো চোখের অধিকারী রক্তিমকে আজ বড্ড অচেনা ঠেকছে দৃষ্টির কাছে। কী নিদারুণ মলীন চেহারা মানুষটার! একটু কাছে আসতেই রক্তিমের ডান কপালের পাশে লম্বালম্বি কাটা দাগ স্পষ্ট হয় দৃষ্টির চোখে। সাথে মুখের বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য কালচে দাগ দেখে তৎক্ষণাৎ কেঁপে ওঠে হৃদয়টা। পাগলপারা হয়ে দিহানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ছুটে সেদিকে। হতবম্ভ দিহান নিজেও ছুটে দৃষ্টির পিছন পিছন। হুট করে অনুভূতিহীন দুচোখ উঁচিয়ে সামনে তাক করে দৃষ্টিকে ছুটতে দেখেই থমকায় রক্তিমের চলন্ত পা জোড়া। জনমানবে পরিপূর্ণ আশপাশের পরিস্থিতি ভুলে চেঁচিয়ে ওঠে অতর্কিতে,

“এই মেয়ে! থামো ঐখানে। এভাবে পাগলের মতো দৌড়াচ্ছো কেন বোকা? দৃষ্টি পরে যাবে, থামতে বললাম আমি!”

দৃষ্টির কান পযর্ন্ত কী আর যাবে রক্তিমের এই নিষেধ বারণ? সে তো প্রাণ পুরুষের আদুরে মুখে আঘাতের চিহ্ন দেখে দিশাহারা। কোনো কিছুর পরোয়া না করেই বাতাসের গতিতে ছুটে এসে পুলিশ ঢিঙ্গিয়ে রক্তিমের মুখটা দুহাতে আকরে ধরে দৃষ্টি। পুরুষ হয়ে ভরা আদালতে অচেনা নারীর গায়ে হাত দেওয়াটা ভীষণ দৃষ্টিকটু দেখায় বলেই হয়তো পুলিশ গুলোও তেমনভাবে তাকে বাঁধা দিচ্ছেনা। তবে তাদের থেকে একটু দূরে থাকা মহিলা কনস্টেবল কয়জন দ্রুত এগিয়ে আসছে এদিকেই। দৃষ্টি কাঁদছে। রক্তিমের ফ্যাকাশে মুখটা দুহাতের অঞ্জলিতে আগলে নিয়ে আকুল হয়ে কাঁদছে। কান্নার দমকে তার নিজের কাছেই সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে। দূর্বল শরীরটা কাঁপছে বাজেভাবে। মুখ ফুটে কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু পারছেনা। প্রেয়সীর এই করুণ দশা সহ্য হলনা বোধহয় রক্তিমের। পাষাণ হৃদয়টা কেমন নিজের সাথে বেঈমানি করে হুট করে কোমল হয়ে উঠে। শক্ত দুটো চোখের কোল ঘেঁষে সন্তর্পণে গড়িয়ে পরে দুফোটা অশ্রুকণা। একরোখা, বেপরোয়া, ভীষন বদমেজাজি আর পাথুরে হৃদয়ের অধিকারী রক্তিম শিকদারের ইস্পাত কঠিন চোখ দুটো আজ জলে সিক্ত। এই দৃশ্যপট জীবদ্দশায় দৃষ্টি কখনো দেখবে ভাবেনি। কল্পনাতেও আসেনি এমন ভাবনা, বর্বর, পাষাণতুল্য জেনে আসা রক্তিম শিকদারকে সে কখনো কাঁদতে দেখবে। এই পুরুষের বেপরোয়া আচরণ, পাষাণ হৃদয় দৃষ্টিকে এতোকাল যতটা না কষ্ট দিয়েছে, তার থেকেও দ্বিগুণ কষ্ট আজ দিয়ে দিয়েছে এক লহমায় সামান্য অশ্রুজলে। অশান্ত হৃদয়ে পাগলের মতো মাথা নেড়ে দুহাতে রক্তিমের চোখ দুটো মুছে দিয়ে পুরো মুখে হাত বুলিয়ে দৃষ্টি এলোমেলো সুরে বারবার বলে,

“এই আপনি কাঁদবেন না। একদম কাঁদবেন না। আপনি কাঁদলে আমি কী করব? মরে যাব, একদম মরে যাব আমি। আচ্ছা, ওরা কী মেরেছে আপনাকে? কষ্ট হচ্ছে আপনার? কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলুন আমায়! এই দাগ, এগুলো কিভাবে হয়েছে? ব্যথা হচ্ছে এখানে?”

ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রক্তিম দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চেয়েও থেমে যায়। গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে দিহানের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বলে,

“পাখলটাকে সামলাও দিহান। আমি বুঝিনা তোমরা কেন ওকে এখানে নিয়ে আসো?”

আর এক বর্ণ কিছু বলার সময় দেয়না পুলিশ। দুজন মহিলা কনস্টেবল এসে রক্তিমের থেকে দৃষ্টিকে টেনে ছাড়িয়ে নেয়। বোনকে কনস্টেবল দুজনের হাত থেকে ছাড়িয়ে এনে বুকের সাথে আগলে নেয় দিহান। ভাইয়ের শার্টের কলার খামচে ধরে উন্মাদের মতো কেঁদে যায় দৃষ্টি। গলা কাটা মুরগির মতো তড়পে মরে ব্যথিত হৃদয়ের অসহনীয় যন্ত্রণায়।

নির্দিষ্ট সময়ের মাঝেই কোর্টের সকল কার্যক্রম শুরু হয়। বাদী- বিবাদী দুই পক্ষের উকিলের একের পর এক সাক্ষপ্রমাণের ভিত্তিতে আদালতের ভিতরের পরিবেশ রমরমা। উপস্থিত সকলের মাঝেই এক টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। তবে দুঃখের বিষয় মিতালী সাহা এখন পযর্ন্ত যতগুলো পয়েন্ট, তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরেছে সেগুলোর একটাও রক্তিমকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট নই। দম বন্ধ করে বাবা আর ভাইয়ের মাঝে জড়বুদ্ধির ন্যায় বসে আছে দৃষ্টি। কে কী বলছে না বলছে সেদিকে তার লক্ষ্য নেই। নজর স্থির হয়ে আছে কাঠগড়ায় বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে থাকা রক্তিমের দিকে। তাদের পিছনের সারিতেই বসে আছে মেহেদী, রাকিব, জাবির সহ পার্টির আরও কিছু ছেলে। উপস্থিত প্রতিটা মানুষ খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে মিতালী সাহা অযথা একের পর এক কথার ছলে কোর্টের সময় বাড়াচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এখন পযর্ন্ত তিনি কোনো শক্ত প্রমাণ পেশ করতে পারেনি। একটু আশার আলোর জন্য মুখিয়ে থাকা মানুষ গুলো আজ ব্যর্থ মিতালী সাহার প্রতি। ইতিমধ্যে মনে মনে নিজেদের প্রস্তুত করতে শুরু করে দিয়েছে যেকোনো রায় মেনে নেওয়ার। মন গহীনে জ্বলতে থাকা আশার প্রদীপটা এই বুঝি পুরোপুরি নিভলো বলে। দিহান এক পলক বোনের প্রাণহীন মুখের দিকে তাকিয়ে হাতে অল্প বল প্রয়োগ করে হুট করে আশ্বাসের বাণী ছুড়ে,

“একদম উল্টাপাল্টা ভাববেনা আপু। এখন যা হচ্ছে মেনে নাও। শুধু এটুকু জেনে রাখো, শেষটা ভালো হবে। জয়ের হাসি আমাদের ঠোঁটে থাকবে।”

ভাইয়ের এই ছেলেমানুষি আশ্বাসটুকু এই মুহূর্তে বড্ড হাস্যকর মনে হয় দৃষ্টির নিকট। মলীন ঠোঁটের এক কোণে অল্প তাচ্ছিল্যের হাসি অস্পষ্টভাবে প্রকাশিতও হয়। কেমন যেন নিস্পৃহ স্বরে ফিসফিসিয়ে দিহানকে প্রত্যুত্তর করে,

“আমি রোদ্রিক নয় দিহান, রোদ্রিকের মা।এই কথাটা মাথায় রেখে আমাকে শান্তনা দিস।আবার অন্ধও না বধিরও না আমি। সব দেখছি, শুনছি।”

দৃষ্টির এই শীতল আচরণে থমকায় দিহান। ভেবে পায়না কি জবাব দিবে। শুধু ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকে ঐ অনুভূতিহীন মুখটার দিকে। যে মুখ জুড়ে আজ নেই কোনো সরলতা, নেই কোনো লাবণ্যতা। ভীষণ আদুরে প্রতিমার ন্যায় মুখটা আজ সর্বত্রই দুঃখ দিয়ে ঠাসা। যে দুঃখ এক প্রেমি হৃদয়কে বানিয়ে দিয়েছে নির্জীব অনুভূতিহীন জড়বস্তু।

উপস্থিত প্রতিটা মানুষ আশাহীন, অপেক্ষায় শুধু বিচারপতির মুখে রক্তিমের শাস্তির কথা শোনার। ঠিক সেই মুহূর্তে মিতালী সাহা প্রধান বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে ওঠেন,

“মহামান্য আদালতের কাছে আমি শেষবারের মতো পাঁচ মিনিট সময় প্রার্থনা করছি। এবং সেই সাথে অনুমতি চাচ্ছি আমার আজকের শেষ এবং প্রধান সাক্ষিকে কোর্টে হাজির করার।”

প্রসিকিউটর মিতালী সাহার কথায় শ্লেষাত্মক হেসে বলে ওঠেন,

“কেন যে শুধু শুধু আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করছেন আমি একটুও বুঝতে পারছিনা। আপনার সম্পর্কে আমার বেশ উন্নত ধারণা ছিল এতোদিন। বাট এই কেসের উছিলায় আপনার প্রতি আমার সেই ভাবনাটা মিছে হয়ে গেছে। কোথায় শুনতাম অ্যাডভোকেট মিতালী হাসা এক চুটকিতে জটিল জটিল কেস সলভ করে ফেলে, আর আজ দেখছি উল্টো অহেতুক কথার ছলে আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করে।”

প্রসিকিউটরের কথার তোয়াক্কা না করে মিতালী সাহা জজের দিকে উৎসুক নজরে চেয়ে। অপেক্ষায় কখন অনুমতি দিবেন তাকে। প্রধান বিচারক নিজের পাশে বসা বাকী দুজন বিচারকের সাথে কতক্ষণ আলোচনা করে আদালতের সময় আরও পনেরো মিনিট বাড়িয়েছে বলে ঘোষণা করে। সাথে সাথে মিতালী সাহা সহ পুরো টিমের মুখে এক অন্যরকম দ্যুতি খেলে যায়। চোখাচোখি হয় দিহানের সাথে মিতালী সাহার। ইশারায় কিছু একটা বুঝিয়ে দিহান পিছন ঘুরে তাকায় সদর দরজার দিকে। আস্তে করে বোনকে বাবার সাথে মিশিয়ে রেখে ওঠে যায় জায়গা থেকে। সাদেক সাহেব জানতে চায়,

“কোথায় যাচ্ছিস।”

“আসছি একটু। তুমি আপুকে ধরে বসো।”

ছোট্ট করে জবাব দিয়ে দ্রুত হল ছেড়ে বেরিয়ে যায় দিহান।মিনিট না গড়াতেই আবারও ত্রস্ত ছুটে আসে। তার পিছন পিছন আসে ওবায়েদের সাথে সম্পূর্ণ অচেনা একজন মাঝ বয়সের ভদ্রলোক। সেদিকে এক পলক তাকিয়ে মিতালী সাহা জোর গলায় বলে,

“ইউর অনার, আমার আজকের প্রধান এবং সর্বশেন শাক্ষী কার্ডিয়োলজিস্ট ডাক্তার নজরুল ইসলাম। আমার মক্কেল রক্তিম শিকদারের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অনুযায়ী এটাই স্পষ্ট যে শাহীন ভুঁইয়াকে রক্তিম শিকদার নিজ হাতে তারই পার্টি অফিসে খুন করেছে। কিন্তু এর বাইরেও আমাদের অজানায় যে স্পষ্টত সত্যতা রয়েছে, এই মুহূর্তে সেটাই প্রমাণ করবেন ডাক্তার নজরুল ইসলাম।”

কথা গুলো বলতে বলতে ওবায়েদ এর বাড়িয়ে দেওয়া রিপোর্ট গুলো নিয়ে মিতালী সাহা বিচারকের সামনে পেশ করেন। পূণরায় বলতে শুরু করেন,

“এই হলো শাহীন ভুঁইয়ার মেডিক্যাল রিপোর্ট। রিপোর্ট অনুযায়ী শাহীন ভুঁইয়া ছোট বেলা থেকেই হৃদরোগে আক্রান্ত। যার কারণে জীবনের বেশ অনেকটা সময় শাহীন ভুঁইয়াকে হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে।শাহীন ভুঁইয়ার অসুস্থতার প্রথম থেকেই তার চিকিৎসার দায়িত্বে ছিল ডাক্তার নজরুল ইসলাম। সবথেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য যেটা তা হলো আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অনুযায়ী শাহীন ভুঁইয়া যেদিন খুন হয় তার ঠিক দুদিন আগেও তাকে রয়েল হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতাল এরিয়ায় অসুস্থ শাহীন ভুঁইয়াকে গাড়ি থেকে নামিয়ে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়ার স্পষ্ট একটা ফুটেজ মেডিক্যাল রিপোর্ট গুলোর সাথে পেশ করা হয়েছে।”

এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে একটু বিরতী নেয় মিতালী সাহা। পরপর প্রসিকিউটরের দিকে তাকিয়ে চমৎকার হেসে পূণরায় বলে ওঠেন,

” চাঞ্চল্যকর তথ্য শুধু এটুকুই না মহামান্য আদালত। অবিশ্বাস্য ঠেকলেও সবথেকে বড়ো সত্য এটাই, আমার মক্কেল রক্তিম শিকদার শাহীন ভুঁইয়াকে খুন করেনি। বরং অভিযোগে শাহীন ভুঁইয়াকে যে সময় খুন করার কথা বর্ণিত করা হয়েছে তার থেকেও আট ঘন্টা আগে হৃদরোগের কারণে শাহীন ভুঁইয়ার মৃত্যু হয়েছে রয়েল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।এই মুহূর্তে যার জলজ্যান্ত প্রমাণ ডাক্তার নজরুল ইসলাম নিজে এবং হাসপাতাল থেকে পাওয়া শাহীন ভুঁইয়ার ডেথ সার্টিফিকেট সহ সকল প্রকার রিপোর্ট।”

মুহূর্ত ব্যবধানে রুম জুড়ে হৈ হৈ পরে গেছে। উত্তেজনা ছড়িয়ে গেছে প্রতিটা মানুষের মনে। নিভু নিভু জ্বলতে থাকা আশার আলোটা যেন নতুন উদ্যমে প্রজ্বলিত হয়েছে। দৃষ্টির বুকের ভিতরটা ভীষণ বাজেভাবে ঢিপঢিপ শব্দ তুলছে। দুরুদুরু কাঁপতে থাকা বুকের সাথে দুই চোখের পাতা, শুষ্ক ঠোঁট দুটোও তিরতির কম্পল তুলে। অতিরিক্ত উত্তেজনায় সাদেক সাহেবের একটা হাত আকরে ধরে প্রচন্ড শক্ত করে। বিচারকের আদেশে একটা সময় দর্শক সারিতে থাকা সকলেই চুপ হয়। বলতে শুরু করন ডাক্তার নজরুল ইসলাম,

“শাহীন ভুঁইয়া আমার রেগুলার পেশেন্ট ছিল। আজ থেকে দেড় বছর আগে আমি নিজেই ওনার ওপেন হার্ট সার্জারি করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত সার্জারির পরও ওনার সমস্যাটা পুরোপুরি নিরাময় হয়নি। কিছুদিন পরপরই অতিরিক্ত শ্বাসকষ্টে ভুগতো। গত পনেরো তারিখ আনুমানিক বিকেল চারটার দিকে শাহীন ভুঁইয়াকে আমার কাছে নিয়ে আসা হয় অচেতন অবস্থায়। কন্ডিশন একদম ভালো ছিলনা। আমরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কয়েকজন অভিজ্ঞ ডাক্তার নিয়ে বোর্ড মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আরও একবার অস্ত্রপচারের। কিন্তু তার আগেই সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ হৃদরোগের জন্যই মৃত্যু হয় শাহীন ভুঁইয়ার। ঐসময় আমি হাসপাতালে উপস্থিত থাকলেও লাশ নিয়ে যাবার সময় উপস্থিত ছিলাম না। কিন্তু সেই রাতেই আমাকে অচেনা একটা নাম্বার থেকে কল দিয়ে মোটা অংকের টাকার লোভ দেখানো সহ আমার পরিবারের ক্ষতি করার কথা বলে বিভিন্ন হুমকি দিয়ে আমাকে বাধ্য করে শাহীন ভুঁইয়ার সমস্ত ফাইল পেশেন্ট ডাটা থেকে সরিয়ে ফেলতে। আমিও নিজের পরিবারের চিন্তায় বাধ্য হয়ে সেটাই করি। এরপর কে বা কারা লাশ নিয়ে কি করেছে না করেছে এটা আমার জানা নেই। যতটুকু সত্য আমার জানা ছিল আমি সেটুকুই বলেছি। আশা করি আদালত আমার দিকটা বিবেচনা করে আমার এই অপরাধ মার্জনা করবেন। শুধুমাত্র পরিবারের সেফটির কথা ভেবেই আমি এমন একটা অন্যায় করতে বাধ্য হয়েছি।”

নজরুল ইসলামের বক্তব্য শুনে সাথে সাথে প্রসিকিউটর প্রতিবাক্য করে ওঠেন,

“সসম্তটাই আষাঢ়ে গল্পের মতো বানোয়াট কাহিনী ইউর অনার। ডাক্তার নজরুল ইসলামের কথায় যদি সত্যি হয়, তবে কী আমাদের এখন ধরে নিতে হবে শাহীন ভুঁইয়ার পোস্ট মার্টেম রিপোর্ট মিথ্যে? আর তার গায়ে থাকা ছুরিকাঘাত! সেটাও কী মিথ্যে?”

“কথায় আছে, টাকা থাকলে না কী কাঠের পুতুলও বাপ ডাকে। আর এখানে তো সামান্য পোস্ট মার্টেম রিপোর্ট! হতেই পারে টাকার জোড়ে মিথ্যের আড়ালে ডাকা পরে গেছে সত্যটা। আজকাল এমন ঘটনা তো অহরহ হচ্ছে। আর বাকী রইল লাশের গায়ে থাকা ছুরিকাঘাতের কথা! ইউর অনার এখন পযর্ন্ত এই কেইস যতটুকু এগিয়েছে এতে এই মুহূর্তে কী এই ভাবনাটা আমাদের মাথায় আসতে পারেনা যে পুরো ঘটনাটা কেউ অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সাজিয়েছে রক্তিম শিকদারকে ফাঁসানোর জন্য? আমি মহামান্য আদালতের কাছে জোর গলায় দাবি জানাচ্ছি, শাহীন ভুঁইয়ার লাশ কবর থেকে পূণরুদ্ধার করে নতুন করে ময়নাতদন্ত করা হোক। আর এর সম্পূর্ণ দায়িত্ব একজন আদর্শ, নিষ্ঠাবান অফিসারের হাতে হস্তক্ষেপ করা হোক।”

চলবে….