#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#দশম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
খোলা জানালা দিয়ে একছটাক আলোকরশ্মি এসে লাগে পুষ্পির কুঁচকে যাওয়া কপালে, চোখে এবং গালে। বুক ধুকপুক ধুকপুক করছে অনবরত। খুব বেশি গরম নেই অথচ কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম!
মেয়েটা টি-টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাসটা কাঁপা হাতে নিয়ে একবারে সবটুকু পানি খেল।
বইটা বন্ধ করে পাশে রাখল। চিঠিটা তখনও হাতে। হাত কাঁপছে অনবরত। আশ্চর্য এত অস্বস্তি বোধ করার কি আছে!
একবার ভাবে, অন্যকারো চিঠি, খুলবে না৷ রেখে দেয় পাশে। কিন্তু মনুষ্য মন বড়োই কৌতুহলী। নিজের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে তারা বেশিরভাগ সময়তেই অপারগ! পুষ্পির বেলাতেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। সে পড়বে না, পড়বে না করেও, না পড়ে পারছিল না। মানুষটার যাবতীয় বিষয়েই আজকাল মেয়েটা বড্ড বেশি আগ্রহী! তার অস্তিত্ব জড়িত কোনোকিছুই এড়িয়ে যেতে পারে না ইদানীং!
চিঠিটা খুলল সে….
“প্রিয় হেমন্ত,
আমি জানি, হয়তো এই প্রথমবার তুমি তোমার প্রিয় সম্বোধনে বিরক্ত হয়েছ। কী করবো বলো? শেষবারের মতো তোমাকে এই নামে সম্বোধন করা হতে নিজেকে বিরত রাখতে পারলাম না। কারণ একটা সময় তুমি বলতে, আমার করা এই সম্বোধন তোমার বড্ড পছন্দের! আজ যেখানে আমি ব্যাক্তিটা অপছন্দের, অপ্রিয় হয়ে উঠেছি, সেখানে প্রিয় সম্বোধন বলে তো কিছু নেই, থাকতেই পারে না।
আমাদের প্রেমের প্রথম সময়গুলো কত বর্নিল ছিল! আজ তা ধূসর! আমাকে বলা তোমার সুন্দর কথাগুলো আমি আমৃত্যু মনে রাখবো। তুমি নিজেও জানো না, কত সুন্দর করে তুমি কথা বলতে জানো। হেমন্তের সেই ঝড়া পাতা বিকেলে তুমি যখন প্রথম বললে, ‘ রবীন্দ্রনাথের চারুলতা আমার ভীষণ পছন্দের। চারু? তোমায় আমি আজ থেকে চারুলতা ডাকবো। তুমি কিন্তু আপত্তি করতে পারবে না।’
আমি জানি না, কোনো মেয়ে আপত্তি করতে পারতো কিনা, তবে আমি পারিনি। কিন্তু আজ মনে হয়, তখন আমার আপত্তি করার প্রয়োজন ছিল। শুরুটা অমন রঙিন করার সুযোগ না দিয়ে বে-রঙিন করে রাখা উচিৎ ছিল। তাহলে হয়তো আমার মতো একটা স্বার্থপর মেয়ের কাছে, তোমার মতো স্বচ্ছ প্রেমিক হেরে যেত না।
বাবার শরীটা ভীষণ খারাপ করছে আজকাল। আমার জীবনের দুটো প্রিয় মানুষের একজন আমার বাবা। জ্ঞানত আমি কখনোই তাকে কষ্ট দেইনি, আর না ভবিষ্যতে পারব দিতে! বাবা আমায় প্রথমবারের মতো আবদার করে কিছু চেয়েছে, আমি ফিরিয়ে দিতে পারিনি। সে কারণেই বোধহয় জীবনের দ্বিতীয় প্রিয় মানুষটাকে কষ্ট দিতেও দুবার ভাবলাম না। পরশু আমায় দেখতে আসবে। বলা বাহুল্য বিয়েটাও সেদিনই হয়ে যাবে!
জীবনের এক সুন্দর হেমন্তে আসা ‘প্রিয় হেমন্ত’ ভালো থেকো তুমি। আমি এও জানি, তোমার ভালোবাসা যেমন সুন্দর, তেমনি তোমার রাগ আর অভিমান ভয়ংকর। বিশ্বাস করো, ক্ষমা চাইতে আমার দ্বিধা হচ্ছে। কিন্তু এই ক্ষমার অযোগ্য মেয়েটাকে পারলে ক্ষমা করে দিও।
চিঠির উত্তরের আশা আমি করছি না। জানি, এই চিঠির প্রতিত্তুর কখনো আসবে না। আমি চাইও না প্রতিত্তুর। শুধু চাই ভালো থেকো। জীবনে এমন কেউ আসুক, যেখানে ভালো থাকাটা অনিবার্য হয়ে দাঁড়াবে।
ইতি,
চারুলতা ”
চিঠিটা শেষ হওয়ার পরও কিছুক্ষণ সেটা খুলেই বসে রইলো পুষ্পি। তার কাছে সব কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে। বারবার শুধু মস্তিষ্কে একটা চিন্তাই আঘাত হানছিল, এই মানুষটার জীবনে পূর্বে কেউ ছিল! যাকে সে মন দিয়ে ভালোবেসেছিল! নিজেকে খুব নগন্য লাগলো তখন। মনে হতে লাগল, কেন বেসেছিল অন্যকাউকে ভালো! সব ভালোবাসা কেবল কেন তার জন্যই বরাদ্দ ছিল না!
পুষ্পি চিঠিটা বইয়ে রাখল। বইটা রেখে দিল পূর্বের স্থানে। তারপর রুম গোছাল। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছিল মেয়েটার। রুমের দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ল।
সাবেরী খাতুন একবার ডাকতে এসেছিল। ঘুমাচ্ছিলো দেখে আর ডাকেনি, চলে যায়।
শাহরিয়ার বাসায় প্রতিদিনের সময়েই ফিরল। রুমে এসে দেখল পুষ্পি ঘুমাচ্ছে। এই অসময়ে মেয়েটা কখনোই ঘুমায় না। শাহরিয়ার একটু অবাকই হলো। হাতের ঘড়িটা খুলেই দ্রুত কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা পরীক্ষা করল। নাহ, তাপমাত্রা স্বাভাবিক। পরে ভাবলো, হয়তো আজ ভীষণ চাপ পড়েছে, তাই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে।
নিজের ক্লান্তি ভুলে অর্ধাঙ্গিনীর ক্লান্তিতে বিচলিত হলো মানুষটা! মাথায় হাত বুলাল, গালে হাত ঠেকাল। মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। খুব মায়া লাগে আজকাল মেয়েটার জন্য।
ঠিক তখনই পুষ্পির ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে শাহরিয়ার দেখেই হুট করে উঠে বসল।
শাহরিয়ারও খানিক চমকে গেল এতে। মুখে মৃদু হাসি রেখে চোখ ছোট করে বলে, “কি হলো! এমন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলে যে! আমাকে কি বেশি পঁচা দেখাচ্ছে?”
পুষ্পি একটু লজ্জাই পেল। শাহরিয়ারের থেকে চোখ সরিয়ে বলে, “ধ্যাত! তেমন কিছু না।”
শাহরিয়ার কাছে ঝুঁকে বলে, “কেমন কিছু?”
পুষ্পি দুহাতে ঠেলে শাহরিয়ারকে সরিয়ে দিয়ে বলে, “ঘোড়ার ডিম! সরুন তো।”
শাহরিয়ার অট্টহাসিতে মাতিয়ে ফেলে ঘর। পুষ্পি বরাবরের মতোই বিড়বিড় করে বলে, “বিদঘুটে হাসি!”
মেয়েটার বিকেলের বিষন্নতা, অসময়ের ঘুমের প্রকৃত কারণ কিছুই টের পেল না শাহরিয়ার।
পুষ্পির আচরণ একদমই স্বাভাবিক। সে খাচ্ছে, পড়ছে, রুম গোছাচ্ছে, সকলের সাথে গল্প করছে। এমনকি দুপুরে ঘটে যাওয়া শ্বশুর এবং শাশুড়ীর তুমুল ঝগড়াঝাটিরও বিবরণ দিল শাহরিয়ারকে।
শাহরিয়ার তা শুনে তো হেসে খু*ন। নিজের বাবার মতামতের সাথে একমত হয়ে বলে, “আব্বা একদম ঠিক বলছে। পুরুষ মানুষ যে কি পরিমাণ নির্যাতিত হয়! আমাকে দিয়েই চিন্তা কর, আমার এই শান্তশিষ্ট বউটাও তো কম নির্যাতন করে না। কম সময় তো আমার কথার অবাধ্য হয় না। কম বার তো আমায় প্রত্যাখ্যান করোনি! কথা সত্য, পুরুষ হচ্ছে সব চাইতে অসহায়। আহারে! আহারে, দুঃখী পুরুষ মানুষ! সো স্যাড ফর পুরুষ মানুষ!”
পুষ্পি মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলে, “ইশশ!”
শাহরিয়ার হাত টেনে পুষ্পিকে কাছে নিয়ে বাহুতে আবিষ্ট করে বলে, “ইশ, না? সত্য কথাই তো বলেছি। অমন সুন্দর করে ‘ইশ’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছ কেন, হুম?”
রাতে সকলে একত্রে খেতে বসেও সাবেরী খাতুন আর হাসনাত সাহেব একে অপরের নামে অভিযোগ-নামা খুলে বসে পুত্রের কাছে। পুষ্পি শাহরিয়ারের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসে। ইঙ্গিতে বোঝাতে চায়, এবার ঠেলা সামলান।
যে কোনো পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার মতো অসাধারণ ক্ষমতা শাহরিয়ারের বরাবরই বেশি। সে খাওয়া থামিয়ে বলে, “আব্বা? মা? তোমরা দিনরাত ঝগড়াঝাটি করো, কোনো অসুবিধা নাই। বড়োদের থেকেই তো ছোটোরা শিখে, না? আমি আর পুষ্পও শিখছি। ভাবছি, দু-একদিন পর থেকেই কন্টিনিউ করবো। কি বলো পুষ্প?”
শেষের কথাটা পুষ্পির দিকে চেয়ে বলে। পুষ্পি ট্রিকস ধরে ফেলে। বহু কষ্টে হাসি সামলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।
মুনমুন বলে, “দূর্দান্ত হবে ভাইয়া। উফফ, একদিকে মা আর আব্বা অন্যদিকে ভাইয়া আর ভাবী, পুরাই ঝাকানাকা অবস্থা!” বলেই খিলখিল করে হাসে।
সাবেরী খাতুন আর হাসনাত সাহেবের মুখটা দেখার মতোই হলো। দুজনেই চুপ, কারো মুখে কোনো কথা নাই। তারা দুজন ঝটপট খেয়ে চলে যেতেই বাকি তিনজন হু হু করে হেসে ফেলল।
সারাদিনে বিষন্নতার ছিটেও লাগে না পুষ্পির গায়ে, যতক্ষণ সে পরিবারে সকল মানুষ গুলোর সাথে একত্রে থাকে! এত দরদের মানুষগুলা! এত নির্মল তাদের ব্যবহারের ধরণ!
পুষ্পি মনটাতে বিষন্নতাটা ভর করলো মাঝরাতে। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর বহু কসরত করেও আর ঘুমাতে পারছিল না। শাহরিয়ার তখন গভীর ঘুমে।
পুষ্পি মনটা কেমন যেন খচখচ করছিল। বারংবার করে উল্টো নিজেকে দোষারোপ করতে লাগল। বইটা যদি হাতে না নি, কৌতুহলী হয়ে চিঠিটা না পড়ত, কি এমন ক্ষতি হতো! শাহরিয়ারকে নিয়ে মনে যেই দ্বিধার উৎপত্তি হয়েছে সেটা কিছুতে গ্রহণ করতে পারছে না মেয়েটা। আশ্চর্যজনক ভাবে শাহরিয়ারের সুন্দর ব্যবহারগুলোও কেমন ঠুনকো হয়ে যাচ্ছিল, ফেকাসে হয়ে যাচ্ছিল। যা কিছুতেই চাচ্ছিল না পুষ্পি।
শাহরিয়ারের ঘুমন্ত মুখের দিকে একবার চাইল। তারপরই যেন আচমকা বিষন্নতা দ্বিগুণ হয়ে গেল। বিছানা থেকে নেমে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল।
জানালাটা খুলে পর্দাটা সরিয়ে দিল। মাঝরাতের ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগে। নাম না জানা হরেক রকম পোকার ডাক ভেসে আসে। পুষ্পি জানালার সাথে হেলান দিয়ে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ কতশত অজথা ভাবনা এসে মনে-মস্তিষ্কে হানা দেয়।
হঠাৎ-ই তার কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পায়। পুষ্পি হতচকিত হয়ে পাশে ফিরে চায়। শাহরিয়ার!
সে বিস্মিত স্বরে বলে, “পুষ্প? ঘুমাওনি তুমি?”
পুষ্পি মুখে মলিন হাসি এঁকে বলে, “ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম ভেঙে গিয়েছে।”
শাহরিয়ারের মনে এবার একটু খটকা লাগে। সন্ধ্যায় অসময়ের ঘুম, মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া, আর এই মাঝরাতে ঘুম না আসা…..সব কেমন রহস্য ঠেকে তার কাছে। মাথায় হাত বুলিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “কিছু হয়েছে? আমায় বলো।”
এতক্ষণ নিজেকে যতটা স্বাভাবিক রাখতে পেরেছে, এবার যেন তাও পারছিল না। কন্ঠ রোধ হয়ে এলো। শাহরিয়ারের হাত মাথা থেকে সরিয়ে দিয়ে বলে, “কিছু হয়নি। আপনি ঘুমান। আমায় নিয়ে অযথা ভাববেন না। আমি বাচ্চা নই।”
শাহরিয়ারের এবার আর বুঝতে বাকি থাকে না, নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। এবং কোনো ভাবে এই ‘হওয়ার’ পেছনে তার ভূমিকা রয়েছে। সে সরিয়ে ফেলা হাত পুনরায় মাথায় রেখে বলে, “আমি কিছু করেছি? কী করেছি আমি, বলো আমায়?”
শান্তশিষ্ট মেয়েটার এবার খুব রাগ লাগে। জানালার কাছ থেকে সরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরে।
শাহরিয়ার ভেবেই পাচ্ছে না, সে কি করেছে! পুষ্পির মুডসুইং এর কারণ ধরতে পারছে না সে।
নিজেও গিয়ে পুষ্পির পাশে শোয়।
পুষ্পির চোখ ছলছল করে। এক ফোটা অশ্রু চোখের কার্নিশ বেয়ে বালিশে পরে। সত্যিই মেয়েরা ভীষণ হিংসুটে। নিজের প্রিয় কিছুতেই অন্যকারো বিন্দুমাত্র অংশীদারিত্ব সহ্য করে পারে না। আর সে যদি হয় ইহজনম এবং পরজনমের সঙ্গী তবে তো কক্ষনোই না।
পুষ্পি উঠে বসে। শাহরিয়ারও উঠে বসে। শাহরিয়ার এবারও দরদ মিশ্রিত কন্ঠে ডাকে, “পুষ্প!”
পুষ্পি বলে, “এই নামে ডাকবেন না আমায়। বিরক্ত লাগছে।”
শাহরিয়ার জিজ্ঞেস করে, “কী নামে ডাকবো তবে প্রিয়তমা বউ আমার! ওগো সুন্দরীতমা! অনুগ্রহ করে বলো আমায়, কী করেছি আমি? কী আমার অপরাধ? ওহে…মায়াবীনি, হৃদয়হরণী, দয়া করো!”
পুষ্পির মনে শীতল বাতাস বয়ে গেল যেন। চোখ হয়ে উঠল ভাসা জলছবি! সেই ভাসা ভাসা চোখেই শাহরিয়ারের দিকে চাইল। মনে এত মায়া অথচ উপরে দেখাল শক্ত পাথর। খুব রুক্ষ ভাবে বলল, “কিছু হয়নি, কিছু করেননি আপনি। আমার এখন ঘুম পাচ্ছে। এখন ঘুমাব।”
(চলবে)……