একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু পর্ব-২০

0
14

#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_২০
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

শীতকালীন অতিথি পাখিদের কলরবে গ্রাম্য প্রভাত প্রফুল্ল চিত্তে হুহু করে ওঠে। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে থাকা শ্যামল মেঠোপথের ধারে জড়োসড়ো হয়ে থাকে ছোট্ট কুকুর ছানা। সবুজ ঘাসের বুকে চিকচিক করে মিষ্টি শিশির বিন্দু। জানালার ফাঁকে উঁকি মারে ভোরের মিষ্টি রোদ।

ভারী ল্যাপ গায়ে দেয়া শাহরিয়ার বেঘোরে ঘুমাচ্ছে তখনও। তার চোখে এসে লাগে সেই মিষ্টি রোদ। গৃহপালিত গবাদিপশুর ডাক বাড়তে থাকে ক্রমশ। রাতভোর চেষ্টাতেও পুষ্পির মান না ভাঙাতে পেরে ব্যার্থ পুরুষ কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে! মাথার ঘন চুলগুলো এলোমেলো হয়ে সারা কপাল ছড়িয়ে রয়েছে। শাহরিয়ার চোখ বন্ধ অবস্থাতেই নিজের উষ্কখুষ্ক দাড়িতে হাত বুলাল। আধো আধো কন্ঠে ডাকল, “পুষ্প!”
খানিক বিরতি দিয়ে যখন উত্তর পেলো না, তখন পুনরায় ডাকল, এবং সেই সাথে আবদার জুড়ে দিল, “পুষ্প? দেখো তো গালে কি বসেছে! ইরিটেশন হচ্ছে খুব।”
কোনো রেসপন্স না পেয়ে শাহরিয়ার চোখ মেলল। আবছা অন্ধকারে ছেঁয়ে আছে ঘর। সারা ঘরে কোথাও পুষ্পি নেই!
এত ভোরে কই গেলো মেয়েটা?
ভাবতে ভাবতে শরীরের উপর থেকে ল্যাপ সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল মানুষটা। খুব শীত পড়ছে দু’দিন যাবত। পড়নে তার কালো একটা টি-শার্ট আর টাউজার। লুঙ্গি পড়ার অভ্যাসটা তার এত কালেও গড়ে উঠল না। মাঝেসাঝে যদিও পড়ে, খুব বেতাল লাগে তখন।

গায়ে বাদামী চাদর জড়িয়ে আড়মোড়া দিতে দিতে সে পুষ্পির সন্ধানে বের হয়। মনে মনে ভাবে, এত ঘনঘন রাগ করছে মেয়েটা আজকাল!
অথচ নিজের দোষ এড়িয়ে যায় সূক্ষ্মভাবে।

বাড়ির পেছন দিকে একটা গোয়ালঘর। ছোট চাচী গরুর সকালের আহারের ব্যবস্থা করছিল। শাহরিয়ার ডেকে জিজ্ঞেস করল, “ও চাচী? পুষ্পকে দেখছো?”
চাচী সহাস্যে বলল, “হ, দেখছি তো। ওই পুকুর পাড়ে বইসা রইছে। এত বেইন্না উইঠা গেলা দেহি দুই জন!”
শাহরিয়ার কোনরূপ ভাবনা চিন্তা ব্যাতিতই বলল, “গেরামের ঝকঝকা সকাল দেখতে উঠছি চাচী। এরম করো ক্যা?” বলতে বলতেই সে পুকুর পাড়ের দিকে এগিয়ে যায়। যে যেমন, তার সাথে তেমন করে মিশে যাওয়ার অনন্য গুন রয়েছে ছেলেটার।

পুকুর পাড়ে এসেই পুষ্পিকে দেখতে পায়। গায়ে মেরুন রঙের শাল জড়ানো। শালের নিচ দিয়ে বেড়িয়ে আছে একগুচ্ছ ঘনকালো চুল আর কচুপাতা রঙের শাড়ির আঁচল। ঠিক যেন উদাস পল্লী-বধূ! কুয়াশা ঠেলে প্রাণপণে বেড়িয়ে আসতে চাওয়া সূর্য রশ্মি সুযোগ পেলেই বুঝি ছুঁয়ে দিবে এই পল্লী বধূটিকে! আর মাথার উপরের ওই বিশাল আম গাছটা যেন আঁকড়ে রাখতে চাইছে এই মায়াবিনীকে। কী অপূর্ব দৃশ্য! শাহরিয়ার মুগ্ধ হয়ে রয়। নিশ্চুপ গতিতে পাশে গিয়ে বয়।

পুষ্পি আলাপ পেতেই হকচকিয়ে চায়। শাহরিয়ার স্নিগ্ধ হেসে সম্ভাষণ জানায়, “সুপ্রভাত, পুষ্পরানী!”

পুষ্পি এক পলক চেয়ে চোখ সরিয়ে ফেলে। রাগ কিংবা অভিমান, কোনটাই তার পরেনি এখনো। বরং সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে।

শাহরিয়ার বলল, “স্বামীকে রেখে একা একা সকাল বিলাস করছেন, তার উপর আবার তার কথার প্রতিত্তুরও করছেন না; এ তো ঘোর অন্যায়!”
শাহরিয়ারের ভালো ভালো কথাগুলোও এখন বিশের মতো ঠেকে পুষ্পির কাছে। কিন্তু মুশকিল একটাই, বরাবরের মতোই রাগ প্রকাশ করতে পারছে না সে। মাঝে মাঝে ভাবে, কেন আল্লাহ রাগ প্রকাশে এত আনাড়ি বানালো তাকে! না পেরে উঠে যেতে লাগে মেয়েটা।
শাহরিয়ার বুঝে যায়, মন এখনও খারাপ মেয়েটার। হাত ধরে আটকায়। নরম-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে, “রাগ হচ্ছে, রাগ প্রকাশ করো। বকা দাও, যা খুশি করো, তবু চুপ করে থেকো না। চুপ করে থাকলে তো এই রাগ জিন্দেগীতেও কমবে না। কি মুশকিল!”
পুষ্পি ভ্রু কুঁচকে চায়। আগের দিনের ল্যাপ্টানো কাজল চোখে। এই ল্যাপ্টানো কাজলের কারণে
চোখের মায়া দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়ে গিয়েছে, নাকি উদাস দুটি চোখ ল্যাপ্টানো কাজলকে মায়ায় রূপান্তর করেছে; তা বোঝা দুষ্কর।

শাহরিয়ার নত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“আমি নত হচ্ছি তো, স্যরি বলছি তো। প্লিজ…”

পুষ্পি বলে, “আলো ফুটে উঠছে। ফ্রেশ হয়ে নিন। শুধু চাদর পরে এসেছেন কেন? জ্যাকেটটা তো চেয়ারের উপরেই ছিল। এত খামখেয়াল আপনার! ব্রাশ এনেছেন? আনেননি, না? এনে দিব?”

শাহরিয়ার অবাক হয় অনেকখানি। অস্বাভাবিক আচরণ। মাঝেমধ্যে বুঝে উঠতে পারে না মেয়েটাকে। কেমন যেন….অচেনা লাগে, ভয় হয়—–এমন আপস করে নেয়া স্বভাবটাকে। সত্যিই কি শুধু আপস করে নেয়, নাকি……!

নিজের বিস্ময় লুকিয়ে রেখে শাহরিয়ার বলে, “ব্রাশ আনতে হবে না। চলো আজ একটা মজার জিনিস দেখাই তোমাকে।” বলতে বলতে সে আম গাছ থেকে একটা আম পাতা ছিঁড়ে। সেটাকে দু-ভাগ করে একটা পুষ্পির হাতে দেয়, অন্যটা নিজের হাতে রাখে। তারপর সেটা মুঁচড়ে রোল সেইপ আনে। পুষ্পিকেও তেমন করতে বলে। তারপর হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে দাঁত মাজতে মাজতে বলে, “এবার ব্রাশ করো। দাঁত চকচক করবে একদম।”
পুষ্পি কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। আনমনে শাহরিয়ারের ইন্সট্রাশন মানে। কিন্তু তার কিচ্ছু ভাল্লাগছে না। ঢাকা ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। এখানে আর একটুও থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না। শাহরিয়ারকে এবং শাহরিয়ারের কোনো কর্মকান্ড মন স্পর্শ করছে না। কেবল করতে হবে বলে করছে, সইতে হবে বলে সইছে।

শাহরিয়ার দাঁত মাজার পর দুই ধাপ সিড়ি নেমে মুখ ধোঁয়। ধুতে ধুতেই পুষ্পিকে লক্ষ্য করে। এবারের ব্যাপারটা বেশ জটিল, এত সহজে গলবে না, বুঝতে অসুবিধা হয় না।
শাহরিয়ারের দুশ্চিন্তার মাঝেই ঘটে যায় অন্যরকম এক মজার ঘটনা। মাথার উপর দিয়ে যেতে এক মহামান্য পাখি তার গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদন করে যায়। শাহরিয়ার টের পেতেই ‘ছিঃ ছিঃ’ করে লাফিয়ে ওঠে। পুষ্পিও দেখতে পেয়ে এবার হেসে ফেলে। সে যেন ভীষণ আনন্দ পায়। আনন্দে চোখে অশ্রু এসে পরে। প্রকৃতির এই নিরব শাস্তিতে উৎফুল্ল হয়ে বলে, “একদম ঠিক হয়েছে। খুশি হয়েছি। ফাজিল পুরুষের জন্য যথার্থ শাস্তি।”

শাহরিয়ার দীর্ঘ সময় পর পুষ্পির হাসি মুখ দেখে তার এই শাস্তি আপসে মেনে নেয়। বলে, “খুশি হয়েছো? ওকে, তাহলে আমিও খুশি হয়েছি। আয় পাখি আয়, তোকে একটা ধন্যবাদ দেই।”

বলেই সে পুকুরে ঝাপ দেয়। কনকনে ঠান্ডায় এই পুকুরে কেউ এত ভোরে গোসল করতে পারে তা যেন কল্পনাও করে পারে না মেয়েটা। আঁৎকে উঠে বলে, “এই ঠান্ডা লেগে যাবে আপনার। দ্রুত উঠুন।”

“কিচ্ছু হবে না।” বলতে বলতে দুই তিনটা ডুব দিয়ে ফেলে মানুষটা। টি-শার্টটা খুলে পুষ্পির দিকে ছুঁড়ে মারে। পুষ্পি ধরে ফেলে তা। শাহরিয়ার বলে, “পুষ্পরানী, খুব ঠান্ডা পানি। তোমার মতো।”

পুষ্পির মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়। কী যে হলো তার। মানুষটার ভালো কথাগুলোই সহ্য করতে বেশি কষ্ট হচ্ছে তার। খালি মনে হয়, এসব শুধু বলার জন্যই বলে, মন থেকে বলে না।

টি-শার্ট ধুয়ে সে আর সেখানে দাঁড়ায় না। ওটা উঠানে মেলে দিয়ে রুমে চলে যায়। শাহরিয়ার ভেবে পায় না, কিভাবে এই মান ভাঙবে।

পুষ্পি রুমে এসে দেখে শাহরিয়ারের ফোন বাজছে৷ আননোন নাম্বার। শাহরিয়ারের পোশাক বের করে ওয়াশরুমে রেখে আসে।
এরপর রুমে এসে বিছানা গোছাতে গোছাতেই, শাহরিয়ার মাথা মূছতে মুছতে রুমে প্রবেশ করে। কপাল, গলা, কান বেয়ে বেয়ে তখনও পানি ঝড়ছে। পুষ্পি নির্বিকার ভঙ্গিতে তার কাজ সম্পূর্ণ করে যাচ্ছে।
শাহরিয়ার তোয়ালেটা চেয়ারে রেখে পুষ্পির কাছে যায়। অনুনয়ের স্বরে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে? এমন চুপ করে থাকলে তো ভালো লাগছে না আমার৷”
পুষ্পি বলে, “আপনার কল এসেছিল৷ বেশ কয়েকবার রিং হয়েছিল৷ জরুরী কল হবে নিশ্চয়ই।”
শাহরিয়ার জিজ্ঞেস করে, “কার?”
“জানি না।”
শাহরিয়ার ফোন নিয়ে নাম্বার দেখে একটু অস্বস্তি বোধ করে। চারুর নাম্বার। পুষ্পি আড়চোখে পর্যবেক্ষণ করে। এর মাঝেই পুনরায় কল বেজে ওঠে। শাহরিয়ার খানিক বিরতি দিয়ে কল রিসিভ করে। পুষ্পি চলে যেতে লাগলে শাহরিয়ার আটকায়। হাত ধরে রেখেই কথা শুরু করে, “হ্যালো!”
“হ্যাঁ! হ্যালো। আমি…আসলে একটু বিরক্ত করছি তোমায়।”
“অসুবিধা নেই, বল৷”
“মায়ের প্রেশক্রিপশনটা কি তোমার কাছে রয়ে গিয়েছে? একটু দেখবা? আমার কাছে তো নেই, পাচ্ছি না। আর ওটা ছাড়া…..!”
চারুর কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই শাহরিয়ার জবাব দেয়, “ঠিক আছে, চেক করে দেখছি। থেকে থাকলে পাঠিয়ে দিব, চিন্তা করিস না। খালা কেমন আছে?”
“আল্লাহর রহমতে আগের চাইতে অনকটা ভালো।”
“আচ্ছা। রাখ তবে।” বলে নিজে রেখে দিল কল।
পুষ্পির হাত আরো শক্ত করে ধরে বলে, “কি সমস্যা?”
পুষ্পি চুপ করেই থাকে।
শাহরিয়ার রাগ হতে থাকে। মৃদু ধমকের স্বরে বলে, “কথা বলছো না কেন? চলে যাচ্ছিলে কেন? স্পেস চেয়েছি আমি তোমার কাছে? সমস্যাটা কোথায়? এমন দূরদূর করছো কেন? জাস্ট চারুকে একটু সাপোর্ট দিয়েছি বলে? চারুর জায়গায় অন্যকেউ হলেও একই কাজ করতাম, এতটুকু আস্থাও নেই কি আমার উপর তোমার? এটা একটা মানবিক কাজ নয় কি? মানছি ওভাবে তোমাদের রেখে যাওয়াটা ভুল ছিল। তাই বলে এমন কিছু করে ফেলিনি যে, নির্বিকার হয়ে যেতে হবে একেবারে৷ পুষ্প, চুপ করে থাকবে না, কথা বলো।”
পুষ্পি জবাবে বলে, “হাত ছাড়ুন।”
শাহরিয়ার জবাব দেয়, “যদি না ছাড়ি?”

পুষ্পি এবার কড়া জবাব দেয়, “আপনি ছাড়তে বাধ্য। সব কিছু আপনার ইচ্ছানুযায়ী হবে না। আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছে আছে। হাত ছাড়ুন। এই মূহুর্তে আপনার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে নেই আমার। যখন ইচ্ছে হবে তখনই বলবো।”

শাহরিয়ার হাত ছেড়ে দেয়। পুষ্পির এই ভয়ংকর নিরব রাগের ব্যাপারে এই প্রথমই অবগত হলো সে। এত জেদী….এত! এত কিছু বলার পরও এমন প্রতিক্রিয়া! এমন চুপ করে না থেকে ঝগড়া করলেও বোধহয় ভালো লাগতো।

পুষ্পি রুম থেকে বেড়িয়ে পুব দিকে গেল। শাহরিয়ারের এই ব্যাখ্যা, এই কথা তার নিরব রাগ বাড়িয়ে দিয়েছে। অশান্ত মন শান্ত করতেই নিরিবিলির খোঁজে এলো। নিরিবিলি পরিবেশ পেলো না ঠিক, তবে অশান্ত মন কিছু সময়ের জন্য শান্ত হলো ঠিক। একদল দস্যি ছানাপোনা এই শীতের সকালে উঠে পড়েছে গাছ পাকা পড়ে থাকা খেঁজুর টোকাতে। এই খেঁজুর গুলো পুষ্পি অনেক পছন্দ করে। খুব মজা লাগে। বাচ্চাগুলো সম্ভাবত মক্তব থেকে এসেছে। মেয়ে বাচ্চাগুলোর পরনে ফ্রক, সালোয়ার-কামিজ আর সেই সাথে হিজাব কিংবা বিশাল ওড়না মুড়িয়ে রেখেছে মাথায়, আর ছেলেগুলো লুঙ্গি, ফতুয়া আর মাথায় টুপি পরিহিত। তারা খেজুর টোকায়ে টোকায়ে ওড়না, হিজাব কিংবা ফতুয়ার পকেটে রাখছে। মক্তবে যাওয়ার আগে কিংবা পরে এটা বুঝি তাদের নিত্য দিনের কাজ। কী যে সুন্দর এই দৃশ্য!)
কে কার থেকে বেশি টোকাতে পারে তার যেন একটা ছোটখাটো প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। এরমাঝে দুজনের মাঝে মাঝামাঝি ধরনের ঝগড়াও লেগে গিয়েছে। একজন বলছে, সে আগে ধরেছে, তো অন্যজন বলছে, তার হাতে যখন এসে পড়েছে তারমানে সে-ই আগে ধরেছে। মোটামুটি একটা হট্টগোল বাঁধবে বাঁধবে অবস্থাতে পুষ্পি গিয়ে দাঁড়ায় কাছে। কেউ কেউ পুষ্পি উপস্থিত হতেই পগারপার, ধরা পড়ে যাওয়াত ভয়ে। আর কেউ কেউ জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পুষ্পি খুব সুন্দর হেসে বলে, “তোমরা তো বেশ ভালো ঝগড়া পারো! আমাকে একটু শেখাবে? আমি না একদমই ঝগড়াঝাটি পারি না।”

বাচ্চাগুলো গভীর বিস্ময় নিয়ে তাকায়৷ ঝগড়া যে কেউ শিখতে চাইতে পার; এ যেন তাদের ছোট মস্তিষ্কের ধারণাতীত। তাদের মধ্যে এক মিষ্টি বালিকা বলে, “ঝগড়া না পারলে তো হে ভালা মানুষ। আপনে শিখতে চাইতাছেন ক্যা?”

পুষ্পি সহাস্যে মেয়েটার গাল ধরে বলে, “পঁচা মানুষদের শায়েস্তা করতে একটু একটু ঝগড়া পারা লাগে।”
আরেকজন বলে, “কিন্তু ঝগড়া কেমনে শিখায়, ওইডা তো জানি না! ঝগড়া তো এমনে এমনেই হইয়া যায়। এই ধরেন, আমি কুলসুমের থেইকা একটা খেজুর কাইরা নিমু, হে দিব এক চিক্কর, ব্যাস বাইজা যাইবো কাইজ্জা।”
মেয়েটার সহজ-সরল বলার ভঙ্গিমায় পুষ্পি এবার পল্লি বালিকার মতো খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। চিকচিক করা শীতের রোদ এই আনন্দময়ী অভিমানী বধূর চোখে এসে লাগে৷ কী যে অপরূপা দেখতে লাগে এই দৃশ্য!

পুষ্পি যাওয়ার পর শাহরিয়ার শার্টের পকেটে চারুর মায়ের প্রেসক্রিপশনটা পায়। ছবি তুলে সেটা হোয়াটসঅ্যাপ করে দেয় চারুকে৷ তারপর একটা জ্যাকেট পরে বাসা থেকে বেড় হয়ে যায়। মেজাজ খুব দ্রুত খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সে চায় না, রাগের মাথায় পুষ্পিকে কোনো ওলট-পালট কথা শুনাক। রাগ কমাতে পারবে এমন মনবল নিয়ে বাসায় ফিরবে বলে ঠিক করে। যতক্ষণ সেই কনফিডেন্স আসবে না, ততক্ষণ ফিরবে না বলে ঠিক করে।

শাহরিয়ার বের হয় সকালে। সারাদিন আর বাসায় ফেরে না। এমন অচেনা পরিবেশে একা একা খুব খারাপ লাগে পুষ্পির। দাদা বাড়িতে মুনমুনের সমবয়সী বেশ কিছু কাজিন থাকায় সে তাদের নিয়ে বেশি মজে থাকে। সাবেরী খাতুন তার জা’দের সাথে সাংসারিক নানান গল্পে মশগুল হয়ে থাকে৷ পুরো বাড়ি মানুষে ভরপুর, হৈহল্লায় মেতে থাকলেও মুখচোরা পুষ্পির খুব নিঃস্ব লাগে। সবাই খানিক বাদে বাদে এসে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করলেও ওই দু-এক শব্দে জবাব দিয়েই শেষ। একা একা পুরো বাড়ি ঘোরে। ছাদে যায়, বাগানে যায়, পুকুর পাড়ে যায়, বাড়ির পেছনের ঝোপঝাড়ে গিয়ে আনমনা হয়। কীসব ভাবতে ভাবতে কান্না পেয়ে যায়৷ একটুকুও খেয়াল নেই মানুষটার তার কথা? এমন বেমালুম ভুলে গেলো সবাই তাকে? নানুর কথা মনে পড়ে যায়। নানু আর ও একা যখন ছিল, তখনও বোধহয় এত একা লাগেনি।

একে তো মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত তারউপর আবার নানাজনে শাহরিয়ারের কথা জানতে চাইছে তার কাছেই। সকালে নাস্তার টেবিলে তার খোঁজ পড়ে, দুপুরের খাবারে খোঁজ পড়ে, সে লাপাত্তা।
ও কেমন করে জানবে সে কই? সে তো তাঁর খেয়ালখুশি মতো চলে। ওর মতো বাধ্য জীবন তো তার না! নিষ্ঠুরতম পুরুষ মানুষ।

শাহরিয়ার বাসায় ফেরে মাগরিবের পর। পুষ্পি জায়নামাজে তখনও। নামাজ শেষে সূরা ওয়াকিয়া পড়ছে। ড্রয়িং রুম থেকে হট্টগোল ভেসে আসে, সেই সাথে শাহরিয়ারের প্রফুল্ল কন্ঠস্বর।

শাহরিয়ার রুমে প্রবেশ করে পুষ্পিকে এই অবস্থায় দেখেই নরম হয়ে যায়। হিম হয়ে আসে মন। এত পবিত্র লাগে এই মেয়েটাকে। সব কাজ এত নিখুঁত, এত সুন্দর ভাবে, এত মোলায়েম ভাবে উপস্থাপন করে যে, যে কেউ মুগ্ধ হয়ে যাবে। এই যে ঘরে এক কোনে জায়নামাজে বসে কোরআন মাজিদ পড়ছে, তাও দেখতে কী অনিন্দ্য সুন্দর লাগছে৷ তার মা তার জন্য একটা রত্ন তুলে এনেছে।
কিন্তু মান যে কি করে ভাঙাবে তা নিয়ে খুব ফ্যাসাদে আছে।
পুষ্পির দৃষ্টি আকর্ষণ এর জন্য শাহরিয়ার একটু গলা ঝেড়ে কাশে। পুষ্পি একবারও ফিরে চায় না। সূরা পড়া শেষ করে কোরআন মাজিদ সরিয়ে রাখে। জায়নামাজ ভাজ করে রাখে। হিজাবটা একটু টেনে ঠিক করে পড়ে থাকে। তারপর জিজ্ঞেস করে, “কিছু লাগবে? লাগলে বলুন, এনে দিচ্ছি।”
শাহরিয়ার বলে, “কিছু লাগবে না। এদিক এসে বসো। একটু কথা বলি৷”
পুষ্পি বলে, “কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ক্লান্ত লাগছে৷ মুনমুনের কাছে যাচ্ছি। কিছুর প্রয়োজন হলে ডাক দিয়েন, চলে আসবো।”

শাহরিয়ার দ্রুত গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। বলে, “আমার সাথে কথা না বলে এখন কোথাও যেতে পারবে না। নেভার। বিছানায় বসো।”

পুষ্পির ভ্রু কুঁচকে আসে। রাগে কান্না কান্না পাচ্ছে।
শাহরিয়ার অধিকারের স্বরে বলে, “নিজে গিয়ে বসবা, নাকি কোলে করে নিয়ে বসাবো? যাও বসো বলছি।”
পুষ্পি মনে মনে খুব গালি দেয়, “বেয়াদপ, ফাজিল, খারাপ, জঘন্য, অসহ্য, অনেক বেশি খারাপ, অনেক বেশি জঘন্য।”
এসব বকা জোড়ে বললে অবশ্য শাহরিয়ার হেসে খুন হতো। হয়তোবা বলতো, “আহারে আমার অবলা বউ! গালিও জানে না!”

পুষ্পি বলে, “বসবো না। দাঁড়িয়ে থাকবো। যা বলা বলুন, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুনবো।”

শাহরিয়ার সুন্দর হেসে পুষ্পিকে কাছে টেনে নেয়। খুব আদুরে ভঙ্গিতে দুই বাহুতে আবদ্ধ করে। এক হাত মাথার পেছনে রেখে বলে, “পুষ্প? সুন্দরীতমা আমার! আমি কানে ধরছি, একশ ঘা বেতের বারি শাস্তি হিসেবে মঞ্জুর করে নিচ্ছি, সহস্রাধিক শাস্তির আকুল আবেদন জুড়ে দিচ্ছি, যা ইচ্ছে শাস্তি দাও। তোমার ইচ্ছে ব্যাতিত চারুর নামও কখনো মুখে নিব না বলে প্রতিজ্ঞা করছি। তুমি যা যা বলবে, আগামী একমাস ঠিক তাই তাই করবো বলে শপথ গ্রহণ করছি। আমার যাবতীয় ভুল, যাবতীয় খামখেয়ালি, যাবতীয় মূর্খতার জন্য আমি আমার পূণ্যময়ী বউয়ের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। মাফ করে দাও প্রিয়তমা। ইটস মাই রিকোয়েস্ট। প্লিজ এক্সেপ্ট মাই রিকোয়েস্ট। আর কখনো এমন অন্যায় আমি করবো না। সত্যি বলছি, বিশ্বাস করো। আমার সহ্য হচ্ছে না, তোমার এমন নিরব উপেক্ষা। কথা বলো, বকাঝকা করো, শাসন করো, চুপ করে থেকো না তাও। সদয় হও অনুগ্রহ করে।”

বাঁধভাঙা জলে ভেসে যায় শাহরিয়ারের সাদা শার্ট। কত গভীর এই অভিমান কেমন করে বোঝায় মেয়েটা। কত কষ্টে সে সকল অনুযোগ চেপে রাখে তাও কি করে বোঝায়? এই শ্যামলাটে নিজস্ব পুরুষকে কেমন করে বোঝায়, একটি ফুলের সৌন্দর্য নষ্টে একটি পাপড়ির মলিনতাই যথেষ্ট!

(চলবে)……