#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_৩৫
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
মুনমুন এরপর দু’দিন কলেজ গেল না। সবাই বললেও শুনলো না। সাবেরী খাতুন কিংবা শাহরিয়ার কেউই সঠিক ভাবে কথা বলছিল না মুনমুনের সাথে। শাহরিয়ার কলেজ যাওয়ার পূর্বে কিছু নোট’স পুষ্পির কাছে দিয়ে বলল, “বেয়াদপটাকে দিয়ে দিও। অল্প কিছু সময় আছে, মন দিয়ে পড়তে বলো। আজেবাজে ফ্রেন্ড না বানিয়ে, সময়টা ভালো কাজে ব্যয় করতে বলো। কলেজ না গেলে নাই। বাসায় যেন পড়ে লক্ষ্য রেখো।”
শাহরিয়ারের কথার বিপরীতে কিছু বলতে ইচ্ছে হলেও বলল না পুষ্পি। আবার না রেগে যায়, সেই ভয়ে। সে নোট’স নিয়ে শাহরিয়ারকে এটা সেটা এগিয়ে দেয় রোজকারকার মতো। ইদানীং কালে পুষ্পির একটা অদ্ভুত শখ জেগেছে। দিনের পুরোটা সময় তার শাহরিয়ার পেছনে ব্যায় করতে ইচ্ছে করে৷ আরো বেশি যত্ন করতে ইচ্ছে করে৷ এমন হয়েছে যে, মাঝেমাঝেই সদ্য প্রেমে পড়া ষোলো বছরের কিশোরীর মতো অস্থির অস্থির লাগে। সারাক্ষণ মানুষটাকে নিজের চোখের সামনে রাখতে ইচ্ছে জাগে! এ কেমন ইচ্ছে!
মনে এমন ইচ্ছে হলেও প্রকাশ করে ভিন্ন সুর।
শাহরিয়ার ঘড়ি পরছিল, পুষ্পি ডাকে, “শুনুন?”
শাহরিয়ার পুষ্পির দিকে চায়। সায় জানিয়ে জবাব দেয়, “হুম?”
সঙ্গে সঙ্গে পুষ্পি বোকা বনে যায়৷ অযথা কেন ডেকেছে জানা নেই তার। তড়িঘড়ি করে বলে, “না, কিছু না। দেরি হচ্ছে না আপনার? এখনও যাচ্ছেন না কেন?”
শাহরিয়ারের ভ্রু কুঁচকে আসে। জানতে চায়, “কি ব্যাপার বলো তো? বিদায় করে দিতে চাচ্ছো কেন?”
পুষ্পি এবারও কথার গোলকধাঁধায় আটকে যায়৷ শাহরিয়ারের মতো অতো ভেবেচিন্তে কখনোই কথা বলতে পারে না সে। যাই বলে, তা নিয়ে কোনো না কোনো ভাবে প্যাঁচিয়ে পরে। এত চালাক মানুষটা!
পুষ্পি বলে, “কোনো ব্যাপার নেই৷ এমনি বলেছি, ভালোর জন্য।”
শাহরিয়ার শার্ট ইন করতে করতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। দুঃখী দুঃখী হয়ে বলে, “হাহ্! মানুষের বউ বিদায় দিতে চায় না। কত রোমান্টিক রোমান্টিক এক্টিভিটিস করে আটকাতে চায়। কত দরদ নিয়ে বলে, আজ না গেলে হয় না? ইয়া খোদা! আর আমার বউ কিনা দূর-দূর করে খেদিয়ে দেয়! কী দুঃখ, কী দুঃখ! এ দুঃখ আমি কারে দেখাই?”
পুষ্পি চট করে এবার শাহরিয়ারকে কথার বাণে আটকে ফেলে। বলে, “অন্যের বউ কি করে, না করে তা আপনি জানলেন কেমন করে?”
শাহরিয়ার নিজেও মজা পায় পুষ্পির এমন প্রশ্নে। মৃদুমন্দ হাসে আর জবাব দেয়, “স্বপ্নে।”
পুষ্পি আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে উত্তর করে, “ছিঃ! আপনি স্বপ্নে অন্যের রোমান্টিজম দেখেন!”
শাহরিয়ার বিস্মিত হয় না। বরং ঘর কাঁপিয়ে হেসে ওঠে। বলে, “খুব চালাক হয়েছো তো পুষ্প!”
পুষ্পি বলে, “আপনার সংস্পর্শ।”
পুষ্পি বিছানায় বসে ছিল। শাহরিয়ার দাঁড়ানো থেকে ঝুকে এসে বলে, “আমার সংস্পর্শ?”
পুষ্পি দূরে সরে মিটিমিটি হেসে জবাব দেয়, “হু!”
শাহরিয়ার বলে, “আমার সংস্পর্শে আর কি কি শিখেছ শুনি?”
পুষ্পি অসম্ভব সুন্দর হাসে। সুর করে বলে, “অনেএএএক কিছু! শোনানো যাবে না।”
শাহরিয়ার পুষ্পির মাথায় টোকা মেরে আদরের সহিত বলে, “সুন্দরীতমা আমার।”
সুন্দর খুনসুটি আর অভাবনীয় মূহুর্তের ভেতর দিয়ে কেটে যায় সকাল। শাহরিয়ার কলেজ চলে যাওয়ার পর পুষ্পি তার নিত্যদিনের কাজগুলো করে। শাহরিয়ারের জিনিস গুলো গুছিয়ে রাখে। রান্নাবান্না শুরুর আগে পুষ্পি মুনমুনের রুমে আসে। মুনমুনকে ঘুম থেকে উঠায়। নাস্তা খেতে দেয়। ওর রুম গুছিয়ে দেয়। এবং শেষে শাহরিয়ারের দেয়া নোট গুলো দেয়। মুনমুন নোট’স নেয় ঠিকই তবে খুব একটা গ্রাহ্য করেছে বলে মনে হয় না। দু’দিন যাবত শুয়ে-বসেই দিন কাটাচ্ছে। তার ভাব ভঙ্গি এমন যেন, সে না বরং তার সাথেই অন্যায় কিছু করা হয়েছে।
পুষ্পি প্রশ্ন করে, “মুড অফ?”
মুনমুন জবাব দেয়, “না।”
পুষ্পি পুনরায় প্রশ্ন করে, “তোমার ভাইয়ার উপর রাগ?”
মুনমুনের চোখ ছলছল করে ওঠে। সে পাল্টা প্রশ্ন করে, “ভাইয়া আমায় দেখতে পারে না, তাই না ভাবি?”
পুষ্পি অবাক হয়, সাথে অভিমানও টের পায়। মুনমুনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “বোকার মতো প্রশ্ন করলে। তুমি হচ্ছো তোমার ভাইয়ার জান। চোখের মনি। কি আজগুবি চিন্তা করছ, বোকা মেয়ে।”
মুনমুন মানতে নারাজ। সে কেঁদে কেঁদে বলে, “তুমি ভুল জানো ভাবি। ভাইয়া আমায় একটুও দেখতে পারে না। ছোটবেলার মতো আদরও করে না৷ সারাক্ষণ বকা, ধমকানো, শাসন করা ছাড়া কখনো ভালোভাবে কথা বলতে দেখেছ?”
“সব সময় সব কিছু দেখা যায় না। না দেখানোর মাঝেও অনেক কিছু দেখার থাকে। একটু মন দিয়ে পড়, একটা ভালো রেজাল্ট কর। দেখবে কত আদর করছে। এখন তোমার বয়সটাই একটু শাসনের। যেন তোমার দ্বারা কোনো ভুল, অন্যায় না হয়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে সব কিছুর একটা উপযুক্ত সময় আছে। যে সময়ে, যে বয়সে, যে কাজটা করা উচিৎ, তখন যদি সেটা করো, দেখবে কেউ নিষেধ করছে না, বকা দিচ্ছে না। বন্ধু বানাবে, হ্যাংআউট করবে, মজা করবে, ঘুরবে-ফিরবে, সব কিছু করবে, তবে একটা উপযুক্ত সময়ে। এখন তোমার বয়সটাই এমন যে, যে তোমার উত্তম চায়, মঙ্গল চায়, তাকেই ভিলেন বানিয়ে দিবে; তোমার মন ও মস্তিষ্ক। কিন্তু সত্য এটাই তাঁরা যা করছে, তোমার ভালোর জন্যই করছে। একটা কথা মনে রাখবা, মা, বাবা, ভাই, বোন, পরিবারের মানুষ, আপনজনেরা কখনো খারাপ কিছু চায় না। সর্বদা তাঁরা সর্বোত্তম মঙ্গলটাই চায়। এখন বুঝতে পারছো না, আদরটাকেই অনাদর হিসেবে দেখছো, ন্যায়টাকে তোমার দৃষ্টি অন্যায় বানিয়ে দিচ্ছে৷ একটু বড়ো হও তখন বুঝবে, এই শাসন-বারন তোমার জন্য কতটা ইম্পর্ট্যান্ট বহন করেছে।”
মুনমুন চোখ মুছে বলে, “তার মানে বলতে চাচ্ছো, আমি যদি ইফাজের সাথে এখন কম মেলামেশা করি, ভদ্র মেয়ে হয়ে চলি, ভালো রেজাল্ট করি, ভাইয়া আমায় আর বকাঝকা করবে না? অনেক আদর করবে?”
পুষ্পি মৃদু হেসে বলে, “হান্ড্রেড পারসেন্ট। এখন জাস্ট ধ্যান-জ্ঞান টা পড়াশোনায় দাও, ফলাফলটা তুমি নিজেই দেখতে পারবে।”
মুনমুন থিতু হয়, ভাবুক হয়, কি যেন ভাবে। মন কি তার ছুঁল তবে?
পুষ্পির কথা কতটা প্রভাবিত করতে পেরেছে তা অনুমান করা যায় মুনমুনের পরবর্তী কার্জক্রম দ্বারা।
এরপর দিন থেকেই কলেজ যেতে আরম্ভ করে। পুষ্পিকে দিয়ে শাহরিয়ারকে বলিয়ে, শাহরিয়ারের সাথেই একত্রে কলেজ যাওয়া আসার ব্যবস্থা করে। লাবণ্য আর মেয়ে বন্ধুগুলোর সাথে একটু মিশলেও বাকিদের সাথে মেশা একদমই বন্ধ করে দেয়। মুনমুন দু’দিন পর থেকে কলেজ যেতে শুরু করলেও ইফাজ তখন আসতো না।
মুনমুনের যদিও মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হতো খোঁজ নিতে। কিন্তু সে তার মনকে দাবিয়ে রাখে। এবং বেশিদিন তার এই প্রচেষ্টা চালাতে হয়নি। এর আরও দু’দিন পরেই ইফাজ কলেজ আসতে শুরু করে।
মুনমুনকে দেখতে পাওয়া মাত্রই ওর কাছে আসে। কথা বলতে চায়। ইফাজ বার কয়েক কথা বলতে আসলেও মুনমুন এড়িয়ে যায়৷ নিজের সাথে দৃঢ় সংবদ্ধ থাকে।
এতে অবশ্য ছেলেটা একটু ক্ষিপ্ত হলেও মুনমুন খুব একটা কেয়ার করে না। সব গুলো ক্লাস মন দিয়ে করে। নোট’স, এসাইনমেন্ট, ক্লাসটেস্ট সহ সব কিছুতে ভালো করতে থাকে।
ওদের ফ্রেন্ডশীপ গ্যাংটা ভেঙে যাওয়ার পর থেকে অন্যরাও চুপসে যায়। ইফাজ আর মুনের ঘটনাটা সকলের অবগত থাকায় কেউ আর প্রশ্নও করে না কিছু। কেবল লাবণ্য একবার জানতে চায়, “স্যার কি বেশি রাগ হয়েছেন? বকেছে খুব তোকে, না?”
মুনমুনের চোখে জল আসে। তাও চোখের জল আড়াল করে মাথা নাড়ায়। যার অর্থ দ্বারায়, না।
লাবণ্যও আর বেশি কিছু জানতে চায় না। মুনমুনকে ফুললি সাপোর্ট দিয়ে, মুনমুনের সাথেই মিশতে থাকে।
এবং অবাক করা বিষয় ইফাজ ব্যাতিত বাকিরাও পড়াশোনায় সিরিয়াস হতে থাকে। ভালো ফিডব্যাক পেতে থাকে। শাহরিয়ার একদিন মুনমুনের ক্লাস টেস্টের খাতা দিতে দিতে গম্ভীর কন্ঠে বলে, “গুড, ভালো করছো। কিপ ইট আপ।”
সেই দিন যে মুনমুন কত খুশি হয়েছিল! পড়ার প্রতি স্প্রিড আরও বেড়ে যায়।
পুষ্পির কথা আরো সত্য প্রমাণ হতে লাগে মুনমুনের টেস্টের রেজাল্ট ভালো হওয়ার পর। ক্লাসের মিডব্যাঞ্চার থেকে ব্যাকবেঞ্চারে নাম লেখিয়ে ফেলা একটা মেয়ে হুট করে ক্লাসে টপ করে ফেলা মিরাকেল তো বটেই, শাহরিয়ারও বিস্মিত হয়ে যায়। মুনমুনের বাধভাঙ্গা খুশি চোখে লাগার মতো।
পুষ্পি মুনমুনের গালে হাত রেখে আদর দিয়ে বলে, “ইউ আর সুপার্ব। ইফ ইউ ওয়ান্ট, ইউ ক্যান ডু এনিথিং, বলেছিলাম না? মিললো আমার কথা? মাই ট্যালেন্ট গার্ল।”
শাহরিয়ার আরো অবাক করে দিয়ে জানায়, ভালো রেজাল্টের পুরষ্কার হিসেবে মুনমুনের যাবতীয় পছন্দের খাবার সে রেস্টরন্টে নিয়ে খাওয়াবে। পুষ্পিও মহা খুশি শাহরিয়ারের এই প্রস্তাবে। তবে সেদিন সে তাদের দুই ভাই-বোনকে একাই যেতে বলে। তার মনে হয়ে তাদের দুজনের বন্ধনটা আরেকটু ফ্রি হওয়া উচিৎ।
পুষ্পির ট্রিকস কাজে লাগে। এরপর থেকে সত্যিই শাহরিয়ারের সাথে মুনমুন অনেকটা ফ্রি হতে শুরু করে। পড়া না বুঝলেই তার কাছে ছুঁটে যেত। ক্লাস বাঙ্ক দিত না। গভীর রাত অব্দি পড়তো। সাবেরী খাতুনও মেয়ের এমন পরিবর্তনে ব্যাপক খুশি। মেয়ে যখন রাত জেগে পড়ে, আর প্রায়শই তিনি পাশে বসে থাকেন। পুষ্পি চা করে দিত। যখন যা লাগতো, বলা মাত্র হাজির করে ফেলতো। এভাবেই যাচ্ছিল সময়। মুনমুনের এইচএসসির আর বেশি সময় নেই।
কিন্তু এর মাঝেই একদিন পুষ্পি দেখতে পেল মুনমুন ছাদের এককোনায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। পুষ্পি ভীষণ অবাক হয়। তার জানা মতে বর্তমানে মুনমুনের এমন কোন এক্টিভিটিস নেই, যার ফলে শাহরিয়ার বকা দিতে পারে।
পুষ্পি কাধে ভরসার হাত রেখে জানতে চায়, “কি হয়েছে মুন? আমায় বলো? কাঁদছো কেন?”
মুনমুন যেহেতু প্রায় সব কিছুই পুষ্পির সাথে শেয়ার করে, তাই খুব একটা অপ্রস্তুত হয় না। বরং হালকা হওয়ার সঙ্গী পেয়ে নিজেকে হালকা করতে পুষ্পিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে৷
পুষ্পি পুনরায় জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে, বলো? কেউ কিছু বলেছে?”
মুনমুন ‘না’ সূচক মাথা নাড়ায়।
পুষ্পি প্রশ্ন করে, “তাহলে?”
মুনমুন কান্নার জন্য তখন কিছুই বলতে পারেনি। তবে পরে বলেছে। তার কষ্টের কারণ ছিল ইফাজের পরিবর্তন। ওর সাথে মেলামেশা বন্ধ হওয়ার ফলস্বরূপ, ইফাজের অন্য একটা মেয়ের সাথে বেশ ভালোই সখ্যতা গড়ে উঠেছে, যেটা মুনমুনকে পীড়া দিচ্ছে।
পুষ্পি বলে, “এই অল্প সময়ে যে পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে, তাহলে ভেবে দেখ, সে তোমার জন্য উত্তম ছিল কিনা? তার পরিবর্তনটা তোমার জন্য পজেটিভ হিসেবে নাও। তোমার প্রতি তার আকর্ষণ পার্মানেন্ট হলে কখনোই তা এত দ্রুত পরিবর্তন হতো না। আল্লাহর কাছে সন্তুষ্টি প্রকাশ করো। সত্যি বলতে এই বয়সটাই এমন। ফ্যাসিনেশন, ইনফ্যাচুয়েশন এর সময়। যা দেখে তাই ভালো লাগে, এবং ভালো লাগাটাও সাময়িক। কষ্ট পাবে না, বোকা মেয়ে। আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে, মনে রাখবে। যে ভালোবাসা অন্যের জন্য জমাতে চাও সেটা তোমার রবের প্রতি আনো, দেখবে জীবনে কত প্রশান্তি।”
এরপর বেশ কয়দিন পুষ্পি মুনমুনকে বুঝায়, খেয়াল রাখে, যত্ন করে। মুনমুনও কেমন করে যেন স্ট্রং হয়ে ওঠে। ব্যাপারটাকে নিজের জন্য উত্তম হিসেবে ধরে নেয়। এবং ইফাজের ভূত মাথা থেকে নামিয়ে পুনরায় পড়াশোনায় ফোকাস দেয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, তাহাজ্জুদ পড়ে, অবসরে কোরআন মাজিদ পড়ে।
এবং ফলস্বরূপ এইচএসসিতে জিপিএ-৫।
রেজাল্ট পেয়ে মুনমুন কেঁদেই ফেলে। বলে, “আমার কষ্ট সার্থক হয়েছে। আজকে নিশ্চয়ই ভাইয়া আমার উপর অনেক খুশি হবে তাই না ভাবি?”
পুষ্পিও ভীষণ খুশি হয়। জবাব দেয়, “নিশ্চয়ই। আমি জানতাম তুমি পারবে।”
মুনমুন অকপটে স্বীকার করে, “তোমার জন্য সম্ভব করতে পেরেছি ভাবি। আল্লাহ সহায় না হলে আর তোমার সাপোর্ট না পেলে কখনোই সম্ভব ছিল না। থ্যাংক ইউ ভাবী। আই লাভ ইউ। ইউ আর দ্যা বেস্ট। তোমার মতো করে আমায় কখনো কেউ বুঝতে পারেনি।”
পুষ্পি জড়িয়ে ধরে প্রতিত্তোর করে, “বোকা মেয়ে। তোমার অর্জন, তোমার কৃতিত্ব।”
মুনমুন বলে, “উঁহু। তোমার।”
রেজাল্ট জানার পর সেদিন সত্যি শাহরিয়ারের চোখেমুখে প্রশান্তি ফুটে ওঠে। বোনের এটুকু সফলতাই তাকে প্রাউড ফিল করায়৷ যেখানে মুনমুনের সামান্য ভালো রেজাল্ট নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল, সেখানে এত ভালো রেজাল্ট! লাস্ট কিছু মাসে তার পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। অবশেষে সার্থকতা।
মুনমুনের জন্য বেশ কিছু গিফট কিনে ফিরে সেদিন বাসায়। মুনমুনের পছন্দের সকল খাবার আনে, মিষ্টি-রসমালাই আনে। পুরো বাড়িতে একটা উৎসব লেগে যায় যেন।
এর নেপথ্যে পুষ্পির অবস্থান সকলে বিনাবাক্যে স্বীকার করে।
রাতে যখন পুষ্পি ঘুমাতে আসে শাহরিয়ার তখন শোয়া অবস্থায়, চোখ বন্ধ। পুষ্পি ভাবে, ঘুমিয়ে গেছে হয়তো। লাইট অফ করে পুষ্পি ঘুমাতে যাবে যখন, শাহরিয়ার ডাকে, “পুষ্প?”
পুষ্পি প্রথমে কিঞ্চিৎ চমকে ওঠে। পাশ ফিরে জিজ্ঞেস করে, “আপনি ঘুমাননি এখনও?”
“উঁহু।” শাহরিয়ারের শান্ত জবাব।
একটু থেমে বলে, “থ্যাংক ইউ।”
পুষ্পি জানতে চায়, “কেন?”
শাহরিয়ারের ধীরস্থীর জবাব, “ফর এভ্রিথিং।”
একটু থেমে পুনরায় বলে, “মুনের এই পরিবর্তনের পুরো ক্রেডিট তোমার। ইউ আর জিনিয়াস, ইউ আর আ ম্যাজেশিয়ান। আগে বলেছি, আজ আবার বলতে ইচ্ছে করছে, তুমি আমার জীবনের ব্লেসিং। থ্যাংক ইউ, থ্যাংস ফর মেকিং মাই লাইফ বিউটিফুল। থ্যাংক ইউ ফর বিং ইন মাই লাইফ।”
পুষ্পি বিপরীতে কেবল বলে, “থ্যাংক’স টু ইউ।” কিন্তু মনে তার আরও অনেক না বলা কথা। অনেক অব্যক্ত ভালোবাসা। অনেকখানি সন্তুষ্টি।
জীবন সুন্দর। বিবাহিত জীবনের দুই বছর দুইমাস পুষ্পি এই সৌন্দর্য প্রাণভরে উপভোগ করে। মানুষটার ক্রমশ একান্ত নিজের হয়ে ওঠার গল্পটাও ভারী মিষ্টি। তার খুনসুটি, রশিকতা আর ভালোবাসার কৌশল কেমন যেন মায়ার বাঁধনে আকৃষ্ট করে রেখেছে প্রতিটা মূহুর্ত। সেই বিয়ের রাত থেকে এতটা সময়…….একদম নিজের হয়ে থেকেছে, রাগে, অনুরাগে, আর স্নিগ্ধ মায়াময় প্রেমে!
জীবনের সকল অপূর্ণতা যখনই পূর্ণতায় টার্ন নিতে যাবে, ঠিক তখনই যেন সময়ের কাটা ঠকঠক করে বলে ওঠে, “সুখের সময় যে বড্ড সীমিত। একটু হিসেব করে খরচ না করলে হয়? এত সুখ কি সয়?
সইতে আছে? এ যে নিয়ম বহির্ভূত!”
পুষ্পির অসুখটা দেখা দেয়, তাদের সুখী বিবাহিত জীবনের ঠিক দুই বছর তিন মাসের মাথায়।
(চলবে)……..
#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_৩৬
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়। দাপুটে রোদের দাপুটে গরম। চোখ মেলে তাকানো দায়। এত রোদ।
পুষ্পির যেহেতু মাইগ্রেন আছে, বেশি গরম পড়লে ওর ভীষণ কষ্ট হয়। চাপা স্বভাবের মেয়েটা সেই কষ্টের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় না অন্যের কষ্টের কথা চিন্তা করে। সাবেরী খাতুনকেও রান্না ঘরে আসতে দেয় না। বয়স হয়েছে চিন্তা করে তাকেও কোনো হেল্প করতে দেয় না। আসতে চাইলেও শাসন করে রুমে পাঠিয়ে দেয়। এত ভাবে সবার কথা মেয়েটা। ভ্যাপসা গরমে রান্নাঘরে পড়ে থাকে। সবার জন্য রান্না করে। সবার খেয়াল রাখে। কার কখন কি লাগবে, সব দিকে নজর তার। সামনে এক্সাম, ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনা করে।
কিন্তু সমস্যা তার তখন থেকেই প্রকাশ পেতে শুরু করে। রান্নায় ভুল হতে থাকে। হয় লবন হয়না, নয় লবনের জায়গায় চিনি দিয়ে ফেলছে, মশলাপাতি ছাড়াই রান্না করে ফেলা সহ নানান অদ্ভুত কান্ড ঘটতে আরম্ভ করে। মাঝেমাঝে নয়, এই ঘটনা প্রায় রোজকার হতে আরম্ভ করে।
কেউ কিছু বলে না, আপসে খেয়ে নেয়, মেয়েটা কষ্ট করে রান্না করেছে তা ভেবে। কখনো খেতে পারে না, খাবার নষ্ট হয়। পুষ্পির হীনমন্যতা কাজ করতে আরম্ভ করে। এমন হচ্ছে কেন! এতটা মনভুলা তো ও ছিল না কখনো!
এবং এই হীনমন্যতা থেকেই ওর ভেতর চেঞ্জ আসতে আরম্ভ করে। শাহরিয়ারের সাথেও আচরণ পরিবর্তন হতে শুরু করে। সেই নতুন নতুন পুষ্পি যেমন ছিল; সংকোচে জড়সড় হয়ে থাকা নতুন বউ, দশ কথায় রা’ নেই ঠিক তেমনটা! শাহরিয়ার ক্লাস করিয়ে এসে প্রচুর কথা বলে, বলতে চায়, পুষ্পি কেবলই চুপচাপ শোনে। হ্যাঁ, না কোনো কথা নেই, কোনো প্রশ্ন নেই, একদমই নির্বিকার ভঙ্গি। প্রথম একদিন-দুদিন শাহরিয়ার ওর সহজাত স্বভাব ভেবে সহজভাবে নিলেও, শেষে একটু একটু খটকা লাগে। মেয়েটা কি আপসেট কোনো বিষয়ে? পুষ্পির এই আকস্মিক পরিবর্তন কিছুটা চোখে লাগে। তাও সহজ করে নেয়৷ এই শান্তশিষ্ট, চুপচাপ স্বভাবটাই তো প্রথমে আকৃষ্ট করেছিল তাকে।
রাতে খেয়েদেয়ে অন্য দিনের চাইতে একটু দ্রুতই ঘুমিয়ে যায় শাহরিয়ার। পুষ্পিও শোয়, তবে ঘুমায় না। ঘুমাতে পারছে না। কেমন অস্বস্তি লাগছে।
ঘুম না আসার কারণে বিছানা থেকে নামতে লাগলে শাহরিয়ারের ঘুম ভেঙে যায়। মানুষটার ঘুম ভীষণ পাতলা!
আস্তে করে ডাকে, “পুষ্প?”
পুষ্পি একটু হকচকিয়ে যায় যেন।
সে প্রশ্ন করে, “ঘুমাওনি?”
পুষ্পি ছোট করে জবাব দেয়, “ঘুম আসছে না।”
শাহরিয়ার চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসে। রুমে ড্রিম লাইট জ্বলছে। পুষ্পিকে বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট। সে প্রশ্ন করে, “কয়টা বাজে এখন?”
প্রশ্ন করতে করতেই মাথার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে টাইম দেখে। পুষ্পি জবাব দেয়ার আগেই বিস্মিত কন্ঠে বলে, “দুইটা! দুইটা বাজে, আর এখনও ঘুমাওনি তুমি! ঘুম আসছে না? কেন? দেখি শরীর ঠিক আছে?”
বলতে বলতেই পুষ্পির শরীরে হাত রেখে টেম্পারেচার চেক করতে চায়।
কিন্তু তার আগেই পুষ্পি উঠে দাঁড়ায়। প্রতিত্তোর করে, “শরীর ভালো। এমনি ঘুম আসছে না। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। সকালে ক্লাস আছে না আপনার?”
কথাট বলে শাহরিয়ারকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়।
শাহরিয়ার বুঝতে পারে, কোনো একটা বিষয় নিয়ে আপসেট, কিন্তু সেও তার স্বভাবসুলভ জোর করে না। সময় দেয়, হয়তোবা এখন বলতে চাচ্ছে না, পরে বলবে; ভেবে ঘুমিয়ে পরে সে।
এভাবেই কাটে কিছু দিন। তার উপর পুষ্পির মাইগ্রেনের ব্যাথাটাও যেন নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে। আগে যেখানে সপ্তাহে সর্বোচ্চ একবার হতো, এখন যেন রোজই হওয়া বাধ্যতামূলক!
এর মাঝে পুষ্পির পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। এবং তার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে তখন থেকেই। পড়া রিভিশন দিতে গিয়ে লক্ষ্য করল, তার কিছুই মনে নেই। সব ভুলে গিয়েছে। এমন কি ঘন্টাখানেক আগে পড়া প্রশ্নটার উত্তরও মনে করতে পারছিল না। এমন কখনো হয়নি আগে।
সারারাত জেগে পড়তে চায়, শাহরিয়ারের কারণে পারে না। বেশি রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে যে!
পরদিন পরীক্ষার হলে শাহরিয়ার পৌছে দিয়ে আসে। এবং বসে দেয় সে এসে নিয়ে যাবে৷ ওর এক্সাম শেষ হতে হতে, তার ক্লাসও শেষ হয়ে যাবে। পুষ্পি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড ভয় কাজ করে পুষ্পির। এক্সাম ভালো হবে তো? সব এন্সার করতে পারবে তো মনে করে!
এবং প্রশ্ন হাতে পাওয়ার পর তার শংকা আরো গাঢ় হয়। প্রশ্ন কমন, কিন্তু উত্তর লিখতে পারছে না। সময় কেটে যায়, কিচ্ছু লিখতে পারে না। আধা ঘন্টা, চল্লিশ মিনিট, এক ঘন্টা, দের ঘন্টা করে সময় পেরিয়ে যায়, কিন্তু মেয়েটা একটা কোশ্চেনেট এন্সারও করতে পারে না। কষ্টে, ভয়ে, লজ্জায় গলা শুকিয়ে যায়৷ শেষে হাঁপিয়ে উঠে, আর না পেরে খাতা জমা দিয়ে হল থেকে বেড়িয়ে যায়। অশ্রুতে চোখ টলমল করে। ডিপার্টমেন্টের ভালো স্টুডেন্ট সে। তার চাইতেও বড়ো বিষয় শাহরিয়ারকে চেনে কলেজের সকল শিক্ষক। কিভাবে মুখ দেখাবে সে! কেন এমন হচ্ছে তার সাথে, কেন সব ভুলে যাচ্ছে!
বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয় না, কিছু খায় না, কারো সাথে কোনো কথা বলে না, রুমবন্ধ করে রাখে নিজেকে।
শাহরিয়ার পুষ্পিকে বলেছিল এক্সাম শেষ করে অপেক্ষা করতে, সে সাথে করে নিয়ে ফিরবে বাসায়। কিন্তু পুষ্পি অপেক্ষা তো দূরের বিষয়, জানায়নি অব্দি সে যে চলে এসেছে। শাহরিয়ার গিয়ে পুষ্পিকে না দেখতে পেয়ে কল করে। কিন্তু ফোন অফ। শাহরিয়ার বাড়ির ফোনে কল করে, রিসিভ করে মুনমুন। সে জানায় পুষ্পি চলে এসেছে, এবং অনেক আগেই চলে এসেছে। শাহরিয়ার কিঞ্চিৎ রেগে গিয়ে বলে, “চলে গিয়েছে মানে! আমি অপেক্ষা করতে বলেছিলাম না? ফোন অফ কেন ওর?”
মুনমুন জানায়, তা সে জানি না। সাথে এও জানায় তার কাছে পুষ্পিকে ঠিক লাগছে না। এসেই রুমে চলে গিয়েছে৷ কোনো কথা বলেনি
শাহরিয়ার দ্রুত বাসার দিকে রওয়ানা দেয়। ইদানীং তো তার কাছেও ঠিক লাগছে না। আজ আবার কি হলো!
শাহরিয়ার বাসায় ফিরে তখন সন্ধ্যা। মাগরিবের আজান হচ্ছে। রুমে ঢুকে সে আরো বিস্মিত হয়। দরজা চাপানো ছিল। রুমের লাইট অফ। শাহরিয়ার লাইট জ্বালায়। পুষ্পি রুমের কোথাও নেই। শাহরিয়ারের ভ্রু কুঁচকে আসে। মৃদু স্বরে ডাকে, “পুষ্প! এই পুষ্প!”
পুষ্পির কোনো সাড়াশব্দ নেই। শাহরিয়ার কাঁধ থেকে ব্যাগটা রেখে বারান্দায় যায়। এবং পুষ্পিকে সেখানেই দেখতে পায়। হাঁটু ভাঁজ করে, দু’হাতে হাঁটু ঝাপটে রেখে বসে আছে। কোনো বিকার নাই। শাহরিয়ার কাঁধে হাত রাখতেই চমকে ওঠে। সাথে চমকায় শাহরিয়ারও! এমন অস্থির পুষ্পির সঙ্গে পরিচিত নয় সে। শাহরিয়ার প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে? এক্সাম ভালো হয়নি? আমাকে না বলে চলে এসেছো কেন?”
পুষ্পি কেবল বলে, “স্যরি, আমি ভুলে গিয়েছি। আমি সব ভুলে গিয়েছি! স্য…রি!”
শাহরিয়ার কাছে টেনে নেয়। নিজের প্রকোষ্ঠ বুকের সাথে পুষ্পির মাথা ঠেকিয়ে বলে, “ইট’স ওকে, ইট’স ওকে। কুল ডাউন।”
সারাদিন পর একটু যেন মাথাটা হালকা হয় পুষ্পির। এরপর ধীরস্থির ভাবে নামাজ পড়ে। কোরআন পড়ে। মনটা আরও একটু খানি হালকা হয়। শাহরিয়ারও নামাজ পড়ে এসে এই দৃশ্য দেখে খানিক স্বস্তি পায়। ভাবে, এক্সাম খারাপ হয়েছে তাই খানিক ট্রমার ভেতর দিয়ে গিয়েছে হয়তো।
খাটের উপর বসতে বসতে বলে, “তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি৷ ইওর ফেভরিট।”
পুষ্পি কোরআন মাজিদ তাকের উপর রাখছিল। রাখা শেষে একবার তাকাল কেবল। শাহরিয়ার বুঝতে পারে না, কিভাবে কমফোর্ট ফিল করানো যাবে মেয়েটাকে। সে বলে, “আসো, এদিকে আসো।”
পুষ্পি পাশে গিয়ে বসে। শাহরিয়ার ব্যাগ থেকে বেলীফুলের একটা মালা বের করে। পুষ্পির হাতে পরিয়ে দিয়ে বলে, “একটা বিষয় জানো পুষ্প? ফুল আর পুষ্প; দুজনকে পাশাপাশি দেখলে আমি কনফিউজড হয়ে যাই, কার প্রশংসা করবো, কে বেশি সুন্দর!”
একটু ভাবুক হয়ে পুনরায় বলল, “উমম…তবে মনেহয় ভোট করলে আমার বউ উইন হবে৷ শি ইজ মোস্ট বিউটিফুল।”
কথাটা বলেই এত সুন্দর হাসলো মানুষটা! সারাদিনে প্রথমবারের মতো পুষ্পির মুখেও হাসির রেখা দেখা দিল। ফুলটা নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ শুকলো। কী সুন্দর ঘ্রাণ! চোখ বন্ধ হয়ে এলো আবেশে।
পুরো দৃশ্যটা মুগ্ধ হয়ে দেখে শাহরিয়ার। ক্রমশ তার মুগ্ধতা বাড়ছেই! একদম ফুলের মতো তার বউ, মুগ্ধ না হয়ে উপায় আছে! কিন্তু মনের মাঝে উঁকিঝুঁকি মারে একটা প্রশ্ন, কী নিয়ে এত বিষন্ন পুষ্পি!
শাহরিয়ার জিজ্ঞেস করতেও সাহস পায় না, পরীক্ষা কেমন হয়েছে। যদি আবার কেঁদে ফেলে সেই ভয়ে। সন্ধ্যা কেটে যায় এভাবেই।
শাহরিয়ার বই পড়ছিল। পুষ্পি প্রথমবারের মতো স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করে, “চা খাবেন? চা করে এনে দিব?”
শাহরিয়ার বই থেকে মুখ তুলে তাকায়। ভাবুক হয়ে বলে, “উমমম….খাওয়া যায়। কখনো বলিনি বোধহয়, তোমার হাতের চা দূর্দান্ত, পান করা মাত্রই রিফ্রেশ লাগে।”
পুষ্পি এবারও মিষ্টি হাসে। আকাশে কি সুন্দর চাঁদ। টেবিল থেকে স্পষ্ট দেখা যায় চাঁদটা। ঠিক যেন এই মূহুর্তে ওদের এসে ছুঁয়ে দিল!
পুষ্পি চা করল তো ঠিকই তবে তা আর শাহরিয়ারের জন্য আনতে পারলো না। তার আগেই ঘটিয়ে ফেলল দূর্ঘটনা। গরম চায়ের কাপ হাত ফসকে পায়ের উপর পড়ল ছিটকে। পুষ্পি ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠল। চিৎকার শুনে সকলে রান্না ঘরে ছুটে এল। মুনমুন, সাবেরী খাতুনের চিৎকারে শাহরিয়ারও নিচে নেমে আসে। এবং এই অবস্থা দেখে উত্তেজিত হয়ে যায়।
একটু আওয়াজ করেই বলে, “পুষ্প! কী হয়েছে তোমার? এত অসচেতন হয়ে উঠছ কেন?”
ততক্ষণে মেয়েটাকে ড্রইংরুমে নিয়ে এনে বসান হয়। পায়ে বরফ ঘষে দেয় শাহরিয়ার। পা’টা পুরো লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। পুষ্পির চোখে জল টলমল। শারীরিক এবং মানসিক দহন দুটো মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে যেন।
উপরে উঠার পর খাওয়ার জন্য আর নিচে নামায় না পুষ্পিকে। শাহরিয়ার রুমে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দেয়। একটু বকেও।
“সবসময় এত কেয়ারলেস হলে হয় নিজের উপর? কী নিয়ে এত আপসেট তুমি, শুনি?”
পুষ্পি বরাবরের মতোই নির্বিকার, নিশ্চুপ।
খাওয়ানো শেষে পায়ে একটু মলম লাগিয়ে দেয়। শাহরিয়ার মুখে দুঃখ সূচক আওয়াজ করে জানতে চায়, “ইশশ! ব্যাথা লাগছে বেশি?”
কি যে হলো মেয়েটার। শাহরিয়ারের সকল কথাতেই কান্না পেয়ে যাচ্ছে। পানি পান করে একটু স্থির হতে চাইল। তবে খুব একটা পারল না বোধহয়। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলল, “আমি আর এক্সাম দিব না।”
শাহরিয়ার বিস্মিত হলো বৈকি! অবাক হয়ে জানতে চাইল, “কেন? প্রিপারেশন তো ভালো ছিল তোমার!”
পুষ্পি কেবল বলল, “প্লিজ! দিতে চাই না আমি আর।”
পুষ্পির চোখের পানি দেখলে শাহরিয়ার শক্ত হতে পারে না, গলে যায়, নরম হয়ে যায়। কোনো প্রশ্ন করতে পারে না৷ জোর করতে পারে না।
হাতের উল্টো পাশ দিয়ে পুষ্পির চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে, “ওকে, ফাইন। দিতে হবে না। তোমার যা ইচ্ছে তাই করবে, আমি কখনো বাঁধা দেইনি, দিব না। আই অলওয়েজ এপ্রেশিয়েট ইউ, সাপোর্ট ইউ৷ জাস্ট ডোন্ট ক্রাই। কাঁদবে না। এটা আমার অপছন্দ।”
কয়টা দিন যাবত রাতে একটুও ঘুম হয় না মেয়েটার। আজ একদমই হচ্ছে না। হাসফাঁস লাগছে, অস্বস্তি লাগছে, অস্থির লাগছে। উঠে বসে। হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাস নিতে গিয়ে গ্লাস ফেলে দেয়। কাঁচ ভাঙার শব্দে শাহরিয়ার হুড়মুড় করে উঠে বসে। পুষ্পি রীতিমতো কাঁপছে তখন। শাহরিয়ার শংকা নিয়ে জানতে চায়, “পুষ্প? ঠিক আছো তুমি?”
পুষ্পি হুহু করে কাঁদে। মাথায় নাড়িয়ে জানান দেয়, ঠিক নেই সে, একদম ঠিক নেই।
শাহরিয়ার বরাবরের মতোই কাছে টেনে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “কী হয়েছে আমায় বলো? আমার কাছে কিসের এত সংকোচ তোমার?”
পুষ্পি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে, “আপনি জানেন না, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমি সব ভুলে যাচ্ছি। কিচ্ছু মনে থাকছে না আমার। কোনো কিছু ঠিক ভাবে করতে পারছি না। আমি সত্যি পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
শাহরিয়ার শঙ্কিত হয় ঠিক, তবে প্রকাশ করে না। আশ্বাস দিয়ে বলে, “ঠিক আছে। কোনো অসুবিধা নেই। কিচ্ছু মনে রাখতে হবে না তোমার। সব ভুলে যাও। আমায় মনে আছে তো? তাতেই হবে আমার।”
(চলবে)………..