একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু পর্ব-০৬

0
12

#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#ষষ্ঠ_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

পুষ্পির জ্বর নামল সন্ধ্যার পর। এই পুরোটা সময় শাহরিয়ার আর সাবেরী খাতুন যত্নের কোনো কমতি রাখেনি৷ মুনমুনও অবশ্য কলেজ থেকে এসে ভাবীর এমন কাহিল দশা দেখে বিচলিত হয়েছিল।
পুষ্পি যখন চোখ মেলল, দেখল শাহরিয়ার তখনও তার মাথার কাছে বসে আছে। পুষ্পির মাথায় হাত, চোখ বুজে আছে। পুষ্পির শরীর আর খাওয়া-দাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে নিজেরই খাওয়া হয়নি। বেশ কয়েকবার বমি করেছিল মেয়েটা। একবার তো শাহরিয়ারের শরীরেই করে দিল। মানুষটা সাবেরী খাতুনকেও ডাকল না একবার এসবের জন্য। নিজেই সব পরিষ্কার করল। পুষ্পির শরীর মুছে দিল। বমি করলেও পুনরায় একটু একটু করে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করলো। তবুও যেন হাঁপিয়ে উঠল না কিছুতেই।

মানুষটাই এমন। কেবল পুষ্পির বেলাতে না, নিজের মা, বোন কিংবা কাছের কোনো মানুষের মন-শরীর সকল কিছু নিয়েই যেন তার সকল চিন্তা! এমনিতে খুব শক্ত মনের মানুষ। অনেক কঠিন পরিস্থিতিতেও মনোবল শক্ত রাখার ক্ষমতা তার আছে। তবে প্রিয় কারো একটু কিছু হলেই মূহুর্তের মাঝে বিচলিত হয়ে যায়। নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখতে চায় সবাইকে। আদর্শ স্বামী, আদর্শ সন্তান, আদর্শ ভাই একেই কি বলে?

পুষ্পি উঠে বসতে চায়। ওর নড়াচড়ায় শাহরিয়ারের ঘুমঘুম ভাবটা কেটে যায়। উদ্বিগ্নতার সহিত বলে, “উঠছ কেন? খারাপ লাগছে? বমি পাচ্ছে? দেখি একটু….”
পুষ্পি মুখে মলিন হাসি একে বলে, “বমি পাচ্ছে না। ভালো লাগছে একটু। উঠে বসতে চাচ্ছি।”

শাহরিয়ার বলে, “আচ্ছা। আমায় ধরে উঠো।”

পুষ্পি উঠে বসে। শাহরিয়ারের দিকে চেয়ে বলে, “আমার খুদা লেগেছে।”
শাহরিয়ারের মুখে যেন তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে, “যথা আজ্ঞা মহারানী। আমি ধন্য হয়ে গেলুম!”

পুষ্পি মিষ্টি হাসে৷ শাহরিয়ার নিচে গিয়ে খাবার নিয়ে আসে। পুষ্পি নিজে খেতে চাইলে শাহরিয়ার বাধা প্রদান করে। সে খাইয়ে দিতে চায়। পুষ্পি মিনমিন করে বলে, “আপনার হাতে খেতে অস্বস্তি হয়।”
শাহরিয়ার খিটখিট করে হাসে। ইশশ! আবার সেই বিদঘুটে হাসি। হাসি থামিয়ে সে বলে, “কিন্তু এতে মহব্বত বৃদ্ধি পায়। দেখি কাছে আসো তো। বেশি কথা বলা বউ আমার।”
পুষ্পি হতবাক, বিস্মিত! সে বেশি কথা বলে?

শেষের কথাটা বলে শাহরিয়ার নিজেও মিটিমিটি হাসল। কারণ কথাটা সত্য না। বউ তার সল্পভাষী।

পুষ্পির খাওয়া হলে শাহরিয়ার গোসলে গেল।সারাদিনের ক্লান্তি দূরীকরণের প্রয়াশ মাত্র।

শাহরিয়ার গোসলে যাওয়ার পর পুষ্পি আধশোয়া হয়ে তার পাশে থাকা ইংরেজী নোভেলটা হাতে নিল। জেসমিন গিলোরির “দ্যা ওয়েডিং ডেইট!”

পুষ্পি বইটা নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতেই শাহরিয়ার বেরিয়ে এলো।
মাথা মুছতে মুছতে বলল, ” ভাবছি আমি ইচ্ছাকৃত অসুস্থ হবো। এতে আমার দুটো লাভ হবে।”

পুষ্পি ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল।

শাহরিয়ার বলল, “প্রথম লাভ, উপলব্ধি করতে পারবে, অসুস্থ হওয়ার পর অন্য মানুষটা কি বিধ্বস্ত পরিস্থিতির শিকার হয়। তাহলে কাল রাতের মতো অমন অন্যায় আবদার আর করবে না। দ্বিতীয় লাভ, স্বামীর প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। পুরোটাই লাভ প্রজেক্ট।” বলেই উচ্চস্বরে হাসি।
পুষ্পি বিড়বিড় করে বলে, “পাগল মানুষ একটা।”
.
এরপর কেটে গেল আরো সপ্তাহ খানিক সময়। সব কিছুই স্বাভাবিক গতিতে চলছিল। কেবল মাঝেমধ্যে পুষ্পি বিষন্ন হয়ে যেত৷ এসব কিছু চোখ এড়াত না শাহরিয়ারে। পুষ্পির একাকিত্ব দূর করতেই শাহরিয়ার পরামর্শ দিল, ক্লাস শুরু করতে। পুষ্পি নিজেও এবার সেটাই চাচ্ছিল। তাছাড়া পুষ্পির কলেজটাও কাছেই ছিল। শাহরিয়ার ওকে পৌঁছে দিয়ে নিজেও তার কর্মস্থলে যেতে পারবে ইজিলি।

পুষ্পি আগে থেকেই পর্দার সহিত, শালিনতার সহিত চলাফেরা করত। বিয়ের পর যেন তা আরো বেড়ে গেল। শাহরিয়ার তৈরি হয়ে নিচে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। পুষ্পি নামল তার মিনিট পাঁচেক পরই। মুনমুন অবশ্য আরো আগে চলে যায় কলেজ। তার কোচিং আছে তাই।

পুষ্পি নিচে নামার পর তার শালিনতায় সন্তুষ্ট হলো সাবেরী খাতুন। বললেন, “মাশাআল্লাহ, মা। সাবধানে যেও।”
শাহরিয়ার মুখে কিছু বলল না ঠিক তবে মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠল, সন্তুষ্টি। শাহরিয়ার যখন পুষ্পিকে বাইকে উঠত বলল, ও তখন কিঞ্চিৎ ইতস্ততবোধ করল। শাহরিয়ার জানতে চাইল কোনো অসুবিধে কিনা। পুষ্পি জবাবে বলল, “আমার ভয় করে।”
শাহরিয়ার বলল, “ফি আমানিল্লাহ। কোনো ভয় নেই। আমাকে ধরে বস।”

পুষ্পি বাধ্য রমনীর মতো শাহরিয়ারের কথা শুনল।
সর্বচ্চ পনেরো মিনিট লাগল কলেজ পৌঁছাতে। পুষ্পি এই পুরো সময়টা শাহরিয়ারকে শক্ত করে ধরে ছিল। যদিও এতে শাহরিয়ারের একটু অসুবিধা হচ্ছিল বাইক চালাতে, তবুও এ ভেবে ভালো লাগছিল যে, মেয়েটা অন্তত তাকে ভরসা করে ভয়কে জয় করতে চেয়েছে।

যাওয়ার আগে বলল, “যাওয়ার সময় রিকশা নিয়ে যাবা। যদি না পাও, আমায় কল দিবা। আমি এসে নিয়ে যাব।”
পুষ্পি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। বলল, “দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি ক্লাস শেষ করেই চলে যাব। আপনি এখন যান। ক্লাসে দেরি হয়ে যাবে আপনার।”
শাহরিয়ার সহাস্যমুখে বলল, “ঠিক আছে। আসি তবে।”
পুষ্পি মুখভাব দেখা যায় না৷ সে বলে, “বারাকাল্লাহ ফি হায়াতি।”
এরপর শাহরিয়ার চলে যায় তার গন্তব্যে। পুষ্পির কলেজ থেকে তার কলেজের দূরত্ব মিনিট বিশেক এর।
.
এই ক’টা মাস যেভাবে চলছিল তার খানিক পরিবর্তন ঘটতে শুরু হলো আজ হতে৷ মনুষ্য জীবন এমনই। একক গতিতে কখনো চলতে পারে না৷ গতির পরিবর্তন ঘটে পারিপার্শ্বিক সাপেক্ষে।

পুষ্পি দুটো ক্লাস করল। তারপর লাইব্রেরীতে এসে বসল। এরপর শাহরিয়ারকে একটা মেসেজ দিল। ও সিন করেনি অবশ্য। ক্লাস করাচ্ছে হয়তো।
পুষ্পি লাইব্রেরীতে কিছুক্ষণ থেকে বেরিয়ে গেল পরবর্তী ক্লাসের জন্য।

শাহরিয়ারের ক্লাস ছিল না তখন। তবে ফোন সাইলেন্ট। অফিস রুমে বসে কিছু কাজ করছিল তখন। হঠাৎ বাহির থেকে আওয়াজ এলো,
“ম্যে আই কাম ইন স্যার?”
শাহরিয়ার না তাকিয়ে বলল, “কাম।”
মেয়েটা খানিক জড়োসড়ো হয়ে বলল, “আমায় আপনি আসতে বলেছিলেন, স্যার।”
শাহরিয়ার এবার তাকাল মেয়েটার মুখপানে। সুশ্রী মুখশ্রীর অধিকারী এক কিশোরী। চিবুক সামান্য ডাবানো। চুলগুলো দুই বেনী করা।
শাহরিয়ার শান্ত, স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “লাবণ্য! বসো।”
লাবণ্য এরপর কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে বসল। মাথা নিচু করে বসে রইল। হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে।এক হাত দিয়ে অন্য হাতের নখ খুঁটছে।

শাহরিয়ার বলল, “পড়াশোনা কেমন চলছে।”
লাবণ্য বলল, “ভালো।”
শাহরিয়ার যেন খানিক বিস্ময় প্রকাশ করেই পাল্টা বলল, “ভালো?”
লাবণ্য চুপ করে রইল। শাহরিয়ার নিজের লেখা থামিয়ে লাবণ্যের দিকে চাইল। দৃঢ় কন্ঠে বলল, “তোমার লাস্ট ক্লাস টেস্ট গুলোর মার্কস দেখেছ?”
লাবন্য হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
শাহরিয়ার দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, “অন্যদেরটা তো জানি না৷ কিন্তু আমার গুলোতে তো জঘন্য অবস্থা তোমার। তুমি কি পড়াশোনা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছ?”

লাবণ্য চুপ করে থাকে। শাহরিয়ারের সহসায় রাগ করে না। তবে একবার রেগে গেলে সেটা প্রকট আকার ধারণ করে।
সে কঠোর কন্ঠে বলে, “বাস্তবতা ভুলে অবাস্তবে বসবাস করে কারা, জানো? মূর্খরা। নিছক ছেলে মানুষী এক বার, দু’বার, সর্বচ্চ তিনবার প্রশ্রয় দেয়া যায়। এরপর সেটার লাগাম টেনে ধরতে হয়। অন্যথায় সেটা বিচ্ছিরি রূপ নেয়৷ তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো, লাবন্য?”

লাবণ্যর চোখ ছলছল করে ওঠে। এই মানুষটা অনেকবার পড়াশোনা নিয়ে অনেককে বকাঝকা করেছে। কিন্তু কাউকে বোধহয় না এমন কঠিন শাসন করেছে। পড়ায় মন না বসলে সেটা কি ওর দোষ? ও তো আর ইচ্ছে করে অমনোযোগী হয় না। লাবণ্য দু’বার উপর-নীচ মাথা নাড়ায়। অর্থ দাঁড়ায় সে বুঝেছে।
শাহরিয়ারের কাছে মোট ছয়-সাতটা চিরকুট রয়েছে। সে সবগুলো বের করল। লাবণ্যর সামনে সেসব রেখে বলে, “ইমোশন খুব মুল্যবান একটা জিনিস। যেখানে-সেখানে প্রয়োগ করার জন্য না। যেখানে ইমোশনটা যথাযোগ্য সম্মান পাবে, ইমোশনটাকে কেবল সেখানেই প্রয়োগ করবা। ইভেন সেটাই বুদ্ধিমতির মতো কাজ।”

লাবণ্য এবার সাহস সঞ্চয় করে একটা বড়ো মানুষের মতো প্রশ্ন করে, “ইমোশন কি এত বাছবিচার করে তৈরি হয়? এর পুরোটা কি মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে, স্যার?”

শাহরিয়ারের ভ্রু কুঁচকে আসে৷ ছোটছোট ছেলে-মেয়েগুলো আজকাল এত পাকা হয়েছে!

সে বলে, “বাছবিচার করে হয় না, এটা যেমন ঠিক। ঠিক তেমনি যখন জানবে; যেখানে ইমোশনটা খরচ করছ সেটা একটা মরিচিকা বৈ কিছু নয়। সেটা জানার পরও সেই মরিচিকার পেছনে ছোটা’টা বড্ড বেশি বোকামি। ভালোমন্দ, উচিৎ-অনুচিত, সঠিক-বেঠিক এই সকল কিছু বিচার করার বোধবুদ্ধি সৃষ্টিকর্তা সবাইকে দিয়েছে। আমাকে যেমন দিয়েছে, তেমনি তোমাকেও দিয়েছে। দেয়নি বলো?”
লাবণ্য পুনরায় ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ায়। তার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে।
শাহরিয়ার লাবণ্যের মাথায় হাত রাখে। পরম স্নেহে বলে, “ইউ আর আ ব্রাইট স্টুডেন্ট। তোমার ফিউচার ব্রাইট। তুমি চাইলে অনেক দূর যেতে পারবা। তোমার সেই অ্যাবিলিটি আছে। আমি তা জানি। জীবনটাকে এত ক্ষুদ্র করে ফেলবে না। এক জায়গায় আটকে রাখবে না। অনেক দূর যাওয়ার আছে তোমার। অনেক কিছু দেখার আছে। পথচলা তো কেবল শুরু! আজকে বাড়ি গিয়ে একটা ফ্রেশ সাওয়ার নিয়ে যত ‘ফ্যাসিনেইশন’ ‘ইনফ্যাচুয়েশন’ আছে সব ধুয়ে ফেলবা। নেক্সট ক্লাস টেস্টে আমি তোমার থেকে হায়েস্ট মার্ক চাই। হোপফুলি তুমি এটা করে দেখাবে। ইউ ক্যান গো নাও।”

লাবণ্যর কপোল ছুঁয়ে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। খুব কষ্ট লাগে। শাহরিয়ার ইচ্ছে করেই সেসব এড়িয়ে যায়। মোটেও প্রশ্রয় দেয় না
লাবণ্য উঠে যেতে লাগলে বলে, “আরেকটা কাজ করে যাও। এই চিরকুটগুলো ছিঁড়ে ফেলো এক্ষুনি।”

লাবণ্য এবার ছলছল চোখে শাহরিয়ারের দিকে চায়। শাহরিয়ার আশ্বাস দেয়ার মতন করে হাসে। বলে, “ছিঁড়ো। ফ্যাস্ট।”
লাবণ্য বলে, “আই ক্যান্ট।”
শাহরিয়ার বলে, “ইউ ক্যান।”
শেষে রাগ হয়ে লাবণ্য ছিড়ে ফেলে চিরকুটগুলো। তারপর কেঁদে ফেলে।
শাহরিয়ার বলে, “ওয়েল ডান। ঠিক এভাবেই জীবনের সে সকল ফ্যাসিনেইশন ছিঁড়ে ফেলবা, নষ্ট করে ফেলবা; যেগুলো প্রপার ভ্যালু পাবে না। থ্যাংক ইউ। এবার যাও।”
লাবণ্য সঙ্গে সঙ্গে বাহিরে চলে আসে। কান্নায় ভেঙে পড়ে।

বাহিরে আসতেই মুনমুন সহ বাকি বন্ধুরা ঘিরে ধরে। মুনমুন জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে? ভাইয়া বকা দিয়েছে তোকে?”
অন্যজন জিজ্ঞেস করে, “স্যার কেন ডেকেছে? কী হয়েছে, বল না?
লাবণ্য শুধু বলে, “কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু না! তোরা এখান থেকে যা প্লিজ।”

(চলবে)…..