এখানে সুখ ছোঁয়া যায় পর্ব-০১

0
174

এখানে সুখ ছোঁয়া যায়’ (পর্ব-১)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

বড় চাচা বিয়ে করে বাড়িতে বউ নিয়ে এসেছেন। এই ৬৩ বছর বয়সে কি মনে করে তিনি বিয়ে করেছেন এই নিয়ে আপাতত বাড়িতে বেশ শোরগোল হচ্ছে। রিনিঝিনি বুঝতে পারছেনা এটা নিয়ে এত হাহাকার করার কি আছে? মানুষটা বুড়ো হয়েছে, দুদিন পরে ম’র’তেও পারে বলা যায় না। এখন যদি ফরজ কাজ বিয়েটাই না করে তা কি হয়? তার তো বরং ভালোই লাগছে। এই যে শেষ বয়সে গিয়ে হলেও বিয়েটা চাচা করেছেন এটাই ঢের। দাদী, ফুফুরা এত কাঁদছেন কেন? রান্নাঘরের সামনে বাড়ির সব মহিলা কেমন গোল হয়ে বসে আলাপ করে চলেছে। মা আর ছোট চাচী কি করবেন বুঝতে পারছেন না। হল রুমে যে হালকা পাকা চুল আর ফর্সা মুখের একজন ভদ্র মহিলা বসে আছেন তিনি সম্পর্কে তার মা চাচীদের সবার বড় জা হোন আর রিনিঝিনির বড় মা। মানুষটা এসেছে থেকেই কেমন মুখ ছোট করে বসে আছেন। মা চাচীরা বড় জা কে আপ্যায়ন করার জন্য রান্না বসাতে ভ’য় পাচ্ছেন। কেননা দাদী আর ফুফুরা এখনও খোলাসা করে কিছু বলেননি। এই একরত্তি বুড়ো মহিলাটির কথায় এখনও গোটা চৌধুরী বাড়ির সবাই উঠবস করে। তার মুখের উপর কথা বলার সাহস রিনিঝিনি ছাড়া আর কারোরই নেই বোধহয়।

হল রুমে বসে থাকা সেই টুকটুকে লাল শাড়ি পরে থাকা বড় মাকে দেখে রিনিঝিনির মায়া হলো। রান্নাঘরে গিয়ে জোর গলায় বলল,

-‘আশ্চর্য! বাড়িতে এত চমৎকার একটা ঘটনা ঘটে গেল অথচ তোমরা সেই উপলক্ষ্যে রান্না বান্না করছ না? মা? তুমি কি বয়স বাড়ার সাথে সাথে সব ভুলে বসেছ! রান্না চাপাও। মোরগ পোলাও, গরু, খাসি, সবজি, চপ, ডিমের কোরমা সহ যত দারুন রকমের আইটেম আছে সব তৈরি করো। আজ জম্পেশ খাওয়া দাওয়া হবে।’

রান্নাঘর এক মুহূর্তেই কোলাহল মুক্ত হয়ে গেল। দাদী কান্না থামিয়ে ভ্যাবলার মতো রিনিঝিনির মুখের দিকে তাকালেই রিনিঝিনি চোখ ছোট ছোট করে বলল,

-‘কি? তোমার কিছু বলার আছে? এখনও এখানে বসে আছো কেন! যাও রুমে যাও। ভালো একটা কাপড় পরো। বড় চাচার বউয়ের জন্য যে গহনা গাটি রেখেছিলে বের করো। দায়িত্ব ভুলে গেলে চলে?’

ফুফু কিছু বলতে নিলেই রিনিঝিনি হাত দেখিয়ে থামতে বলে।

-‘ফুফু আম্মা! আমাদের বাড়ির একটা ঐতিহ্য আছে। আপনারা সবাই আপনাদের কাজে সেটা আজ ভাঙতে বসছেন। এটা কি ঠিক?’

ফুফু আমতা আমতা করে বললেন,

-‘ঝিনি ভাইজানের বিয়েটা…

-‘তাহলে তোমরা কি চাইছ? বড় চাচা ফরজ কাজ না করুক? দেরি হোক তাও তো কাজটা সম্পন্ন করেছেন। তোমাদের তো আনন্দিত হওয়ার কথা আরো। এমন করছ কেন?’

ফুফু সবটা খুলে বললেন রিনিঝিনিকে। যে মহিলাকে বড় চাচা বিয়ে করে এনেছেন তিনি বড় চাচার প্রাক্তন। পড়ালেখা শেষ করে চাচা যখন তার দাদা আমিন হাসান চৌধুরীকে বললেন এই মেয়েটিকে বিয়ে করবেন তখন বংশ নিচু বলে দাদা রিজেক্ট করেছিলেন। এবং এ কথা বলেছেন, ‘আমি বেঁ’চে থাকতে এই মেয়েকে এই ঘরে ছেলের বউ করে আনব না।’ অতঃপর মেয়েটির বাবাও তাকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে পিতার কর্তব্য পালন করেন। বড় চাচা চিরকুমার হবেন বলে ঠিক করেন। দাদার মন গলেই না। আর তখন গলেও লাভ কী! মেয়েটির তো বিয়ে হয়েই গেছে। আজ এত বছর কীভাবে এই ঘটনা ঘটল এটা নিয়ে সবাই যেমন অবাক তেমনই দাদীজানের কষ্ট তার স্বামীর কথা অমান্য করেছেন তার ছেলে। তার ভাষ্যমতে স্বামীর অমর্যাদা তো হলোই তারই সাথে ছেলেও বাপের কথা ফেলে দিয়ে বড় ধরনের গু’না’হ করে ফেলল।
সবটা শুনে রিনিঝিনি বোঝালো,

-‘দাদা বলেছেন তিনি বেঁ’চে থাকতে উনাকে এই বাড়িতে ছেলের বউ করে আনবেন না। এমন তো বলেননি তিনি ম’রে গেলেও আনবেন না? তাহলে আর কথার অমান্য হলো কোথায়? সবই তো ঠিক আছে। দাদী তুমি আর এমন করো না। চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও মেনে নাও। বড় মাকে দেখলাম। বেশ সুন্দর এই বয়সে এসেও। তোমার ওই টাক মাথা আর পেট বড় ছেলেকে যে মহিলাটে বিয়ে করেছে এই ভেবেও তোমার শোকর আদায় করা দরকার আল্লাহর দরবারে। যাও ওঠো। এভাবে বসে থেকো না। ফুফু আম্মা আপনারাও স্বাভাবিক হোন।’

দাদী উঠলেন, তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে অনেক বড় বোঝা গেল তার ওপর থেকে। হালকা লাগছে ভীষণ। ফুফুরা ছুটলেন হল রুমে। ছোট ফুফু একবারে সামনে গিয়ে আবারও ফিরে এলেন। বললেন,

-‘এই রিনি! শুনেছি ওনার একটা বড় ছেলে আছে। এখন এই ছেলেকে নিয়ে কি করি বল তো?’

-‘কি করবে? জামাই বানিয়ে ফেলো। মেয়ে আছে তো তোমার।’

-‘যাহ কি যে বলিস! তবে ওর মা তো সুন্দর। ছেলেও বোধ হয় সুন্দরই হবে। শুনেছি ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ার। আচ্ছা, সামনে দেখে পছন্দ হলে তেমনটাই ভাবব। নাহ, ভালোই বলেছিস।’

ফুফু একপ্রকার নাঁচতে নাঁচতেই হল রুমের দিকে গেল। রিনিঝিনি কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে নিজের ঘরে গেল। ইশ! দাদাজান বেঁচে থাকলে আজ বোধহয় বড় চাচাকে নয় তাকেই ধরে ঠ্যা’ঙা’তে’ন।

__________________________

বাড়ি থেকে কল আসতেই মিটিং এ থেকেও কলটা রিসিভ করল তাহমীদ। ছোট চাচা কল করে জরুরী ভিত্তিতে বাড়িতে যেতে বলেছেন। কি কারণ সেটা বললেন না।

গতরাতে বাবার শরীরটা খা’রা’প করেছিল। বুকে ব্য’থা বলছিলেন। বিকেলেই সে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে বলেছিল। এর মধ্যে কিছু অ’ঘ’ট’ন ঘটে যায়নি তো? ম্যানেজারকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে ছুটল সে বাড়ির দিকে। ড্রাইভ করতে করতে সে অনুভব করল তার হাত চলছে না। আহা! কি এক অবস্থা!

দারোয়ান রিন্টু গেটের কাছে বসে আছে। জরিনা সেই কখন বলল চা আনছে। এখনও আনেনি। চা না খেলে রিন্টুর কাজে মন বসে না। ঘুমে ঢুলুঢুলু করে। এখনও ঢুলছিল ঘুমে। একটা মেয়ে কন্ঠের ‘এই যে ভাই!’ শুনে সে চোখ খুলল। সাদামাটা সুতি শাড়ি পরিহিতা এক মেয়েকে দেখে সে বি’র’ক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেলল। এই মুহূর্তে জরিনাকে চেয়েছিল সে এক কাপ চা হাতে।

-‘জ্বে বলেন!’

-‘ভাই এটা কি আশরাফ চৌধূরীর বাড়ি?’

-‘হ। আপনে কেডা?’

ব্যাগ থেকে একটা চিরকুটের মতোন বের করে মেয়েটি রিন্টুর হাতে দিয়ে বলল,

-‘আমি রুমঝুম। চৌধূরী সাহেবদের কিন্ডার গার্টেনে চাকরিতে ঢুকেছি। উনিই আসতে বলেছিলেন।’

-‘ওহ আচ্ছা চিনবার পারছি। স্যারে কইসিলো আসব একজন ইস্কুলের। আহেন ভেতরে আহেন।’

রুমঝুম ভেতরে ঢুকতেই রিন্টু গেট লাগাতে নেয় কিন্তু পেছনে বাড়ির বড় ছেলে তাহমীদের গাড়ি দেখে বরং গেট পুরোটা খুলে একপাশে দাঁড়ায়।

রুমঝুম মস্ত বড় কালো গাড়িটাকে সাইড দিয়ে একপাশে দাঁড়ায়। কি মনে করে সে আর হাঁটল না। দাঁড়িয়েই রইল এক কোণে। দূর থেকেই দেখল গাড়ি থেকে এক সদর্শন যুবক হন্তদন্ত হয়ে নেমে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। তাকে দেখে একমুহূর্তের জন্য রুমঝুম দাঁড়িয়ে পড়ল। আরে! এটা কলেজের তার সেই গম্ভীর ক্লাশমেটটা না? এটা কি তার বাড়ি?

#চলবে।