‘এখানে সুখ ছোঁয়া যায়’ (পর্ব-১১)
(ক’পি করা সম্পূর্ণভাবে নি’ষে’ধ।)
রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়িটা অনেক নিরব হয়ে পড়েছে। মেহমানরা সব তাদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছেন আরো আগেই। বাড়ির সবাইও যে যার ঘরে। অনিরুদ্ধকে তাহমীদের ঘরে দিয়ে এসে জরিনাকে ডেকে রিনিঝিনি টেবিলে খাবার গরম করে রাখতে বলল। জরিনা সব ঠিক করে দিয়ে চলে যাওয়ার সময় রিনিঝিনি তাকে গরম পানির ফ্ল্যাক্সটা আশুরা খাতুনের ঘরে দিয়ে আসতে বলল। জরিনা পানি গরম করে নিয়ে চলে গেল। একটু পরেই ফ্রেশ হয়ে নিচে নামে অনিরুদ্ধ। তার পেছন পেছন তাহমীদ ও আসে। এসেই রিনিঝিনিকে বলে,
-‘একটা স্ট্রং কফি বানিয়ে দে তো রিনি।’
রিনিঝিনি অনিরুদ্ধর প্লেটে খাবার বেড়ে দিয়ে কফি করতে চলে গেল। তাহমীদকে ইশারায় অনিরুদ্ধর কি লাগে না লাগে সেটার খেয়াল রাখতে বলল। তাহমীদ মৃদু হেসে মাথা নাড়ল। রিনিঝিনির হাবভাবে সে স্পষ্ট বুঝতে পারে যে অনিরুদ্ধ তার বোনের কাছে কেবল বড় মায়ের ছেলেই নয় তার বাইরেও অন্য কিছু।
কফি নিয়ে এসে রিনিঝিনি দেখল তাহমীদ আর অনিরুদ্ধ খোশ মেজাজে গল্প করছে। ভাইয়ের দিকে কফি মগ এগিয়ে দিয়ে সে একটা চেয়ার টেনে বসতে যাবে তখনই কলিং বেলের আওয়াজ পেল। তাহমীদ উঠতে নিলে সে বারণ করল, নিজেই এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল। দরজা খুলতেই সে দেখল ছোট চাচা এসেছেন। আজ সকালেই জরুরী ভিত্তিতে সিলেট গিয়েছিলেন তিনি। রিনিঝিনি ভেবেছিল চাচা আজ আর আসবেন না। ছোট চাচা বেশ তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিল। রিনিঝিনিকে প্রশ্ন করল,
-‘আমার একজন গেস্ট এসেছিল রিনি। তোর সাথে আলাপ হয়েছে ছেলেটার। নাম ইখতিয়ার।’
-‘জ্বি চাচা। উনি দুপুরেই এসেছেন। তিন তলার লিভিং এর পাশের ঘরটায় আছেন।’
-‘আচ্ছা। ওর আপ্যায়ন করেছিস তো ঠিক মতো?’
রিনিঝিনি হেসে বলল,
-‘আমার দিক থেকে আমি যথেষ্ট চেষ্টা করেছি চাচা। বাকিটা তুমি দ্যাখো এবার।’
-‘বেশ বেশ। আমিই দেখছি। তোর চাচী ঘুমিয়ে পড়ল নাকি? এত বার বললাম রাত অনেক হলেও ফিরব তবুও মহিলাটা অপেক্ষা করেনি!’
-‘তুমি কি খেয়ে এসেছ? খাবার বেড়ে দিব?’
-‘না রে মা। খাবার বাড়তে হবে না। খেয়েই এসেছি। আমি যাই, দরজাটা লাগিয়ে নে।’
ছোট চাচা চলে গেলেন। রিনিঝিনি ডাইনিং এর দিকে এগিয়ে গেল। অতিথিকে খাবার টেবিলে বসিয়ে তার এদিক সেদিক ঘোরা ঠিক হচ্ছে না।
ইখতিয়ার বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় বেশ মন দিয়ে বই পড়ছিল। দরজায় টোকা পড়তেই তার মনোযোগ কা’টে। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই বদরুল চৌধুরীর দেখা পায়। সে হেসে সালাম দিলো। সালামের জবাব দিয়ে বদরুল চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন,
-‘এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো তোমার?’
-‘না আঙ্কেল। আমার বেশ ভালোই লাগছে।’
হাতে থাকা ফাইল থেকে কিছু কাগজপত্র বের করতে করতে বদরুল চৌধুরী বললেন,
-‘কিছু দরকার পড়লে জানাবে কিন্তু।’
কথাটা বলেই কাগজ গুলো তিনি ইখতিয়ারের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ইখতিয়ার হাতে নিতেই তিনি বললেন,
-‘পড়ে দ্যাখো। আমি জানি এটা পড়ার পর তোমার মনে অনেক প্রশ্ন জাগবে। সেগুলোর উত্তর আমাকেই দিতে হবে। আর কেউ তো উত্তর দেওয়ার জন্য বেঁ’চে নেই।’
ইখতিয়ার দেখল তার হাতে থাকা কাগজ গুলো সাধারণ কাগজ নয়। কোনো দলিলপত্র। সে অবাক হলো। খুব মন দিয়ে সে সবটা পড়ল। তারপরই ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। তার মাথা কাজ করছে না। বেশ কিছুক্ষণ পরে সে মুখ খুলল।
-‘বাবা কোম্পানির পাওয়ার অব এটর্নি আমাকে দিয়ে গেছেন?’
বদরুল চৌধুরী সোফায় বসে বললেন,
-‘ইয়েস। শুধু এটাই নয়, তোমার বাবার যা কিছু আছে সবই তোমাকেই দিয়ে গেছেন।’
শেষে একটা চিঠি ছিল, সেটা পড়ার পরই ইখতিয়ারের চোখ ভিজে আসছিল। বাবার সাথে তার সম্পর্ক এক যুগ আগেই ন’ষ্ট হয়েছিল। মায়ের আকস্মিক মৃ’ত্যুর জন্য সে তার বাবাকেই দায়ী করে। সারাজীবন নিজের বিজনেসের পেছনে ছুটতে ছুটতে কখনো পরিবারকে সময় দিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। স্ত্রীর জটিল রো’গ ধরা পড়ার পরও সেটা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। একটা অসুস্থ মানুষের যত্ন নিতে হবে এই ছোট্ট কথাটি তাঁর মাথায় আসেনি। ইখতিয়ারের মা মিনা বেগম যেদিন মা’রা যান সেদিন দুবাই যাচ্ছিলেন সারোয়ার খান। মিনা বেগম সেদিন বারবার বারণ করেছিলেন নিজ স্বামীকে দূরে না যাওয়ার জন্য। ঘনিয়ে আসা মৃ’ত্যুর টের পেয়েছিলেন বোধহয়। তাই তো স্বামী, সন্তান দুই জনকেই কাছে চাইছিলেন খুব করে। মায়ের কল পেয়ে ইখতিয়ার সেদিনই রওনা হয় দেশের উদ্দেশ্যে। তবে সারোয়ার খান স্ত্রীর অনুরোধ ফেলে চলে যান। সেই রাতেই মিনা বেগম মা’রা যান। মায়ের শেষ সময়ে ইখতিয়ার পাশে থাকলেও তার বাবা সারোয়ার খান ছিলেন না। সেই থেকে বাবার প্রতি তার মনে ঘৃ’ণা, ক্ষো’ভের জন্ম হয়। এরপর সেই যে দেশ ছাড়ল আর ফিরল না। এত বছর পর তার দেশে ফেরার কারণ বদরুল চৌধুরীর জরুরী কল। সে চায়নি আসতে এক প্রকার জোর করেই আনা হয়েছে তাকে।
-‘ মা’রা যাওয়ার আগে সারোয়ার ভাই শেষ বারের মতো তোমাকে দেখতে চেয়েছিলেন। তুমি আসো নি। তোমার মান অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা কম করেননি তিনি। তুমিই সুযোগ দাও নি কখনো। সারোয়ার ভাই যেদিন মা’রা গেলেন সেদিন খুব চেষ্টা করেও কেউ রিচ করতে পারেনি তোমায়। শেষে আমি ই-মেইল করেছিলাম। এক সপ্তাহ পর তুমি রেসপন্স করেছিলে। আমি ভেবেছিলাম তখন অন্তত তুমি আসবে, কিন্তু! যাই হোক, আমার দায়িত্ব ছিল এসব তোমাকে বুঝিয়ে দেওয়ার। এজন্যই এমন জরুরী তলব করেছি। সব কয়টা দলিল এখানে আছে। তুমি বুঝে নাও।’
ইখতিয়ারের মনে পড়ল, বাবা শেষবার যখন কল করেছিলেন তখন একটা কথাই বলেছিলেন, হয় সে দেশে ফিরবে নয়তো তিনি তার সকল সম্পত্তি দান করে যাবেন। এক পয়সাও দিবেন না তাকে। ইখতিয়ার জোর গলায় লাগবে না বলেই কল কেটে দেয়। পরদিন সে বন্ধুদের সাথে নরওয়ে গেল ঘুরতে। বাবা যেন সেই ট্রিপে তাকে বিরক্ত করতে না পারে তাই সব রকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল সে। নিজেকে একদমই নেটওয়ার্কের বাইরে নিয়ে যায়। সে যদি সেদিন ঘুনাক্ষরেও টের পেতো যে তার এই একটা ভুলের মাশুল তাকে সারা জীবন দিতে হবে তবে সে কখনোই এমন করত না। কোনো দিনও না। এক সপ্তাহ পর ফিরে এসে যখন বাবার চলে যাওয়ার খবর পায় তখন চেয়েও আর ফেরেনি সে। বাবার জীবিত অবস্থায় যখন একবার এলো না বাবা মা’রা যাওয়ার পর এসে তখন সে আর কি করত? সেই ঘটনার দুই বছর হয়ে গেছে। আজও ঠিক মতো ঘুমাতে পারে না সে। চোখ বন্ধ করলেই বাবার মুখটা ভেসে ওঠে চোখের পাতায়। আর তখনই আফসোস, অনুশোচনায় সে তখন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
ইখতিয়ারের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বদরুল চৌধুরী তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর চলে গেলেন। হাতের মুঠোয় থাকা চিঠিটা তখন আরেকবার সে খুলে দেখল। বাবার হাতের লেখা চমৎকার ছিল। গুটি গুটি অক্ষরে লেখা শব্দ গুলোর দিকে তাকিয়ে রইল সে চুপচাপ। তার মনে হলো যেন চিঠিতে লিখে নয় বাবা নিজের মুখেই বলছেন,
“বাবু? বাবার উপরে রা’গ? তোমার যে এত রা’গ, অভিমান আমার জানা ছিল না। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে বুঝবে কিন্তু তুমি আমার কথা শুনতেই রাজি না। বাবা! আমি তোমার মাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। তাঁর খেয়াল রাখায় হয়তো আমার ত্রুটি ছিল কিন্তু তাঁকে ভালোবাসায় কোনো দিন কমতি রাখিনি। আমি কখনোই তার মৃ’ত্যু কামনা করিনি, ভাবিইনি তার মৃ’ত্যুর ব্যাপারে। তাই তো সেদিন তার অন্তিম সময় আন্দাজ করিনি। ভেবেছিলাম অন্য বারের মতোই বারণ করছে। মিনা প্রতিবারই বারণ করে আমি বাইরে কোথাও যাওয়ার সময়। মনে হয়েছিল সেদিনও তাই করছে। বিশ্বাস করো, আমি যদি জানতাম বা বুঝতে পারতাম সেটাই তার আমাকে করা শেষ বারণ তবে আমি কোনো ভাবেই তাকে একা ছেড়ে যেতাম না। মিনা চলে যাওয়ার পর তুমিও চলে গেলে। আমি ভীষণ একা হয়ে পড়লাম। রাতে আমি ঘুমাতে পারি না বাবা। আমার তোমার মাকে, তোমাকে ভীষণ মনে পড়ে। আমি কাঁদতে পারি না। অথচ বড় সাধ জাগে তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। আমার বলতে তো শুধু তুমিই আছো! এই পৃথিবীতে আমি খুব একা। আমি জানি তুমিও ভালো নেই। আমার শরীরের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না, তুমি একটু এসো। আমরা কত দিন একসাথে বসে ভাত খাই না! তুমি নেই, তোমার মা নেই, ভাতের স্বাদটাও নেই। কতদিন তৃপ্তি করে খাইনা! আজকাল কেমন যেন লাগে। কিছুতেই শান্তি পাই না। মনে হয় বেশি দিন বাঁ’চবো না। একটু এসো বাবা। তোমাকে অনেকদিন দেখি না।
ইতি তোমার পিতা
সারোয়ার খান। ”
চিঠির উপরে তারিখ লেখা আছে। বাবা যেদিন মা’রা গেলেন সেদিন বিকেলেই লেখা। রাতেই বাবা মা’রা যান। তাই চিঠি আর তার কাছে পৌঁছায়নি।
________________________________
জরিনা আশুরা খাতুনের ঘরে গরম পানি দিয়ে এসে সিঁড়ির কাছে আসতেই দেখল কেউ দাঁড়িয়ে আছে। হু হু করে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সে একটু ঘাবড়ে গেল। বেশ কয়েকবার কে কে বলে জানতে চাইলেও জবাব পায় না। তার ফোনের ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বালাতেই সে দেখল মুখের উপর চুল ছেড়ে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। সাথেই সাথেই সে ‘ভূত’ বলে চিৎকার করে উঠে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল।
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
#চলবে।