এখানে সুখ ছোঁয়া যায় পর্ব-১২

0
169

‘এখানে সুখ ছোঁয়া যায়’ পর্ব-১২
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

মৌনতা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে চিৎপটাং হয়ে জরিনা ফ্লোরে শুয়ে আছে। বোঝা-ই যাচ্ছে অজ্ঞান হয়ে গেছে। কিন্তু তার অজ্ঞান হওয়ার ব্যাপারটা মৌনতা বুঝল না। এতক্ষণ সিঁড়ির কোণে দাঁড়িয়ে সে কাঁদছিল। রিতির সামনে কাঁদতে পারছিল না, তাই এখানে এসেছিল। শুধু রিতি নয় কারো সামনেই সে কাঁদতে পারবে না। আসলে এই জে’দি, ব’দ’রা’গী মেয়েটা কারো কাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে চায় না। চার বছরের লালিত স্বপ্ন আজ হঠাৎ ভেঙে যাওয়াতে সে নিজেই ভীষণ ভেঙে পড়েছে। তার এত ক’ষ্ট হচ্ছে অথচ সে একটু মুখ ফুটে বলতে পারছে না। এত করে চাওয়ার পরও না পাওয়ার বেদনা সইতে পারছে না সে। তাই সবটা উজাড় করে কাঁদছিল। দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ঝুঁকে কাঁদছিল সে। এতে তার খোলা চুল সামনে এসে পড়ে। জরিনা তো তাতেই ভূত ভেবে ভ’য়ে জ্ঞান হারালো। সিঁড়িতে শোরগোল শোনা যাচ্ছে, মৌনতার মনে হলো এমন চেহারায় এখন কেউ তাকে দেখলে নিশ্চয়ই হাসবে। তাই সে দ্রুত পা চালিয়ে তিন তলার লিভিং রুমে গিয়ে বসে রইল।

রিনিঝিনিরা উপরে এসে জরিনাকে পড়ে থাকতে দেখে চমকে উঠল। ঊষান ওয়াশ রুমে ছিল। বের হতেই বাইরে কথা বলার আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলল। তাকে দেখেই রিনিঝিনি বলল,

-‘পানি আন তো! এটাকে এত ডাকছি উঠছে না! পানি দিতে হবে চোখে মুখে। কি যে করে মেয়েটা!’

ঊষান পানি আনতে আবার রুমে গেল‌। ততক্ষণে রিতি, ঈশান, তাইফ ও চলে এলো। তাইফ আর ঈশান ঘুমিয়ে পড়েছিল। দুজনেই ঘুমঘুম চোখে দাঁড়িয়ে আছে। পানি এনে ছিটানোর পর জরিনা চোখ খুলল। সবাইকে দেখেই বলতে লাগল,

-‘সিঁড়িতে ভূ’ত আছিল বড় আফা। না না, ভূ’ত হইবো না, পেত্নী কওন যায়। লম্বা লম্বা চুল! ওরে বাবা!’

রিতি ভ’য় পেয়ে গেল। তাহমীদের টিশার্ট চেপে ধরল। রিনিঝিনি ধ’ম’কে উঠল,

-‘চুপ! আজগুবি কথা বলবি না। বারবার বারণ করেছি তাইফের সাথে বসে ওইসব হরর মুভি দেখবি না। তাও তুই দেখিস। দিনে টিভিতে দেখিস রাতে সামনে দেখছিস। এই হলো তোর অবস্থা! তাইফ? আজকের পর ড্রয়িং রুমের টিভিতে এইসব মুভি খবরদার আর দেখবি না। বেশি দরকার পড়লে নিজের ফোন নয়তো ল্যাপটপে দেখবি। তবুও টিভিতে আর না! বুঝেছিস?’

তাইফ মিনমিন করে বলল,

-‘ওকে আপু।’

সবাই যে যার রুমে চলে যেতে নিলেই একটা চিৎকার শুনতে পেল। রিনিঝিনির রুমের দরজা খুলে দৌঁড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে রুমঝুম। সবাইকে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে থমকে জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। তাহমীদ উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল,

-‘কি হয়েছে?’

রুমঝুম আমতা আমতা করে বলল,

-‘ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ মনে হচ্ছিল আমার উপর কিছু একটা আছে। চোখ মেলতেই একটা বিড়াল দেখতে পেলাম। আমি বিড়াল, কুকুর এসবে ভ’য় পাই।’

ঈশান বিরক্ত চোখে রিতির দিকে তাকালো। বলল,

-‘রিতি তোর ওই হাম্বুলকে সামলে রাখতে পারিস না!’

-‘ও তো ওর ক্যাট হাউজেই ছিল।’

জরিনা বলল,

-‘হাম্বুল ওই ঘরে ঢুকবো কেমন কইরা? দরজা তো বন্ধ আছিল। হেইডা কি আমি বুজছি।’

রিতি ভ’য়ে ভ’য়ে জানতে চাইল,

-‘সেটা কি জরিনা আপা?’

-‘আফামণি সেইটা কি তা মুখে কওন যাইবো না। তেনাগোর নাম মুখে লওয়া যায় না!’

কথাটা শোনার সাথে সাথেই রিতি রিনিঝিনিকে জড়িয়ে ধরল। রুমঝুম ও এগিয়ে এলো রিনিঝিনির কাছে। তারও ভ’য় করছে।

পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেল যে সবাই সব ভুলে এখন জরিনার কথা ধরে বসে আছে। রিনিঝিনির ও একটু একটু ভ’য় হচ্ছে। ঊষান সবাইকে এমন ভ’য় পেতে দেখে বলল,

-‘আরে এত ভ’য় পাওয়ার কি আছে? ভালোই তো হলো! সারা রাত জেগে আজ জরিনার ভূ’ত বন্ধুকে খুঁজব সবাই।’

জরিনা ঊষানকে ভেংচি কেটে বলল,

-‘অহন বুজবার পারবেন না। ওই পে’ত্নী ঘাড় ধইরা যখন মটকায় দিবে তখন বুজবেন এই জরিনা মিছা কয় নাই।’

তাইফ সায় জানালো। সে এসব নিয়ে রিসার্চ করেছে নিজের মতো করে। জরিনার কথা ফেলে দেওয়া যায় না। ঈশান বলল,

-‘চল আজ আর না ঘুমাই। সবাই এখন একটু গল্প করি।’

রিনিঝিনি না করল। কাল অনেক কাজ আছে। এখন ঘুমানোর প্রয়োজন। তাছাড়া অনিরুদ্ধ আছে, রুমঝুম আছে। ওরা ওদের গেস্ট। তাদের এভাবে রাত জাগিয়ে রাখা অনুচিত। ঈশান অনিরুদ্ধকে জিজ্ঞেস করল তাঁর কোনো সমস্যা আছে কিনা। অনিরুদ্ধ জানালো তার কোনো সমস্যা নেই সে রাজি আছে। রিনিঝিনি তা শুনে বলল,

-‘আপনি তো টায়ার্ড!’

-‘কোনো ব্যাপার না। রোজ তো এমন সুযোগ আসবে না। আর একদিন না ঘুমালে বিশেষ কোনো ক্ষ’তি হবে না।’

সবার জোরাজুরিতে রিনিঝিনিকে রাজি হতে হলো। রুমঝুমকে গিয়ে শুয়ে পড়তে বলা হলেও সে গেল না। তার পক্ষে এখন আর একা শোয়া সম্ভব না। যে ভ’য় পেয়েছে!

নিচে গিয়ে সবাই গোল হয়ে বসল। রিনিঝিনি আর জরিনা মাঝে গিয়ে কফি করে আনলো। তাহমীদ রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে দেখল বারবার হাই তুলছে মেয়েটা। নিশ্চয়ই ঘুম আসছে। সবাই গল্পে মেতে উঠল। রিনিঝিনির একটু আগেও এই আড্ডায় আসার ইচ্ছে ছিল না। অথচ এখন অনিরুদ্ধকে খোশ মেজাজে কথা বলতে দেখে তার খুব ভালো লাগছে। এক মনে তাকিয়ে শুধু তাকেই দেখছে। সে অবাক হয়ে ভাবছে আর কত ভাবে এই একটা মানুষের প্রেমে পড়বে সে!

তাহমীদ রুমঝুমের সামনে বসা। কফিতে চুমুক দেওয়ার সময় রুমঝুম খেয়াল করল তাহমীদ তাকিয়ে আছে তার দিকে। রুমঝুম যে তাকে ধরে ফেলল তাতেও যেন তার ভ্রুক্ষেপ নেই। রুমঝুম সতর্ক দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকালো। সবাই তাইফের মুখ থেকে মুভির এক্সপ্লেনেশন শুনছে। কারো তাদের দুজনের দিকে খেয়াল নেই। বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেলেও যখন তাহমীদকে অন্যত্র ফিরতে দেখল না তখন সে ভ্রু কুঁচকে ইশারা করল। তাহমীদ যেন সেটা দেখলই না। এতে রুমঝুম বিরক্ত হয়ে বাকিদের মতো তাইফের কথা শোনায় মন দিলো। কিন্তু একটু পর আবারো সে তাহমীদের দিকে তাকালো। দেখল আগের মতোই তার দিকেই সে চেয়ে আছে। রুমঝুমের তখন ম’রি ম’রি অবস্থা। দুরু দুরু বুক কাঁ’প’ছে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে পড়ছে। সে অসহায় বোধ করছে। এমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কোনো ভাবেই সইতে পারছে না। শেষে বাধ্য হয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘অস’ভ্য!’ কথাটা বাকিরা কেউ না শুনলেও তাহমীদ যেন স্পষ্ট শুনতে পেল।

ইখতিয়ারের বই পড়া শেষ হয়েছে। সে বই রেখে আড়মোড়া ভেঙে বসা থেকে উঠল। উদ্দেশ্য একটু রুমের বাইরে পায়চারি করা। সে দরজা খুলে বের হতেই দেখল সোফায় বসে একটা মেয়ে কাঁদছে। প্রথমেই চিনতে না পারলেও পরে ঠিকই চিনতে পারল। সে এগিয়ে এলো।

-‘আপনি কাঁদছেন কেন?’

মৌনতা চমকে উঠল। এই মুহূর্তে সে কাউকে আশা করেনি। ইখতিয়ারকে তো মোটেও না।

-‘আপনি প্লিজ এভাবে কাঁদবেন না।’

-‘আশ্চর্য! আপনি বলার কে আমি কীভাবে কাঁদব?’

-‘আমি সেটা বোঝাইনি। আমি বলছি এত আপসেট হবেন না।’

-‘আপসেট! কে বলেছে আমি আপসেট? মন গড়া একটা কথা বললেই হলো!’

-‘না। আপনি আসলে আপসেট না। আপনি ভীষণ ভাবে আ’ঘা’ত পেয়েছেন।’

-‘আপনি বেশি বেশি ভাবছেন!’

-‘মোটেও না‌‌। আমি ঠিক ভাবছি। দেখুন মিস! কাউকে না পেলে কাঁদতে নেই। বিশেষ করে যারা আমাদের চায় না তাদের জন্য আমাদের মোটেও কান্না করা উচিত না।’

মৌনতা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইখতিয়ারের দিকে। তার মনের অবস্থা এই অচেনা মানুষটা বুঝল কীভাবে?

চলবে।