এখানে সুখ ছোঁয়া যায় পর্ব-০২

0
128

‘এখানে সুখ ছোঁয়া যায়’ (পর্ব-২)

-‘তুমি এসেছ মা?’

রুমঝুম আশরাফ চৌধূরীর স্টাডিরুমে বসেছিল। মূলত আশরাফ চৌধূরীর জন্য অপেক্ষা করছিল। তবে একটা সময় অপেক্ষা ছেড়ে সে ঘুরেঘুরে স্টাডিরুমের আসবাবপত্র সহ আনুসাঙ্গিক সব কিছুই পর্যবেক্ষণ করছিল। একপ্রকার ভুলেই বসেছিল ক্ষণিকের জন্য যে সে কারো অপেক্ষায় আছে। তাই হয়তো হঠাৎ আশরাফ চৌধূরীর গলা পেয়ে একটু হকচকিয়ে ওঠে। ভী’ত হয়ে পড়ে।

তবে খোলা মনের মানুষ আশরাফ চৌধূরী সেটা একদমই আমলে নিলেন না। হেসে এবং একই সাথে একটা আফসোসের সুরে বললেন,

-‘আহা! দেখেছ কখন থেকে বসিয়ে রেখেছি তোমায়। আসলে কি হয়েছে কি আমাদের বাড়িতে একটা সুন্দর ঘটনা ঘটেছে। সেই আনন্দেই এত বেশি মগ্ন ছিলাম যে তোমার কথা মাথাতেই ছিল না। রা’গ করো নি তো?’

রুমঝুম সাথে সাথেই মাথা নেড়ে বলে উঠল,

-‘ওমা ছিঃ ছিঃ! রা’গ করব কেন? প্লিজ আঙ্কেল এভাবে বলে ল’জ্জায় ফেলবেন না।’

-‘বেশ বেশ! এবার বলো, আসতে অসুবিধা হয়নি তো কোনো?’

-‘না আঙ্কেল। কোনো অসুবিধা হয়নি।’

-‘আচ্ছা, তুমি তাহলে আগে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও। এরপর একসাথে লাঞ্চ করব আমরা। কেমন?’

রুমঝুম বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ে। আশরাফ চৌধূরী হাঁক ছেড়ে ডাকলেন,

-‘জরিনা!’

জরিনা দ্রুতই এলো। দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,

-‘জ্বে সাহেব!’

-‘জরিনা, গেস্টরুমটা ক্লিন করে রাখতে বলেছিলাম যে ক্লিন করেছিস?’

-‘জ্বে।’

-‘আচ্ছা। যা, রুমঝুমকে নিয়ে যা। ও কিন্তু আমাদের স্কুলের নতুন শিক্ষিকা। দেখিস, কোনো রকম অযত্ন যেন না হয় ওর।’

-‘আইচ্ছা। আসেন আপামণি, আমার সাথে আসেন।’

আশরাফ চৌধূরী রুমঝুমকে বললেন,

-‘যাও মা। ওর সাথে যাও। ও তোমাকে রুম দেখিয়ে দিবে। আর কিছু লাগলে আমাকে বলবে কিন্তু।’

রুমঝুম কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো আশরাফ চৌধূরীর দিকে। মানুষটা বেশ উপকার করেছে তার। এছাড়া ব্যবহার টা এত মধুর! একদম বাবার মতোন। রুমঝুম মনে মনে এই বাবার মতো ভালো মানুষটার জন্য দোয়া করে দিলো। এই ভালো মনের মানুষটা সবসময় ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক।

গেস্টরুমটা বেশ সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো গোছানো। এক দেখাতেই বেশ মনে ধরে গেল রুমটা রুমঝুমের। জরিনা চলে যেতেই দরজা লাগিয়ে দিয়ে সে বিছানায় একটু হামাগড়ি দিয়ে নিলো। সারাটা দিন এত ধকল গেছে! কিন্তু অলসতা করলেও চলবে না। গোসলটা সেড়ে নেওয়া দরকার। সে উঠল। ব্যাগ খুলে ভালো দেখে একটা শাড়ি বের করল। এই পরিবেশে রোজকার মলিন শাড়ি পরলে তো আর চলবে না। একটু মানিয়ে নিতে হবে। অবশ্য সেটাও সাধ্যের মধ্যে রেখে।

_______________________

তাহমীদ রুমে এসে প্রথমেই এক গ্লাস পানি পান করল। যা মা’ন’সি’ক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল! ছোট চাচার উপরে রা’গ হচ্ছে। এত সাধারণ একটা ব্যাপারকে এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলার কি দরকার ছিল? বড় চাচা বিয়ে করেছেন। ভালো কথা। এটা নিয়ে এত হাইপার হওয়ার কি আছে? শুধু শুধু একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং মাঝপথে ফেলে আসতে হলো। এখন আপডেট টা না নিলেই নয়! সে কল করল ম্যানেজারকে। কথা বলা শেষ হলো যখন তখন দেখল দরজায় রিনিঝিনি দাঁড়িয়ে আছে। তাহমীদ বলল,

-‘কিছু বলবি?’

-‘হুম।’

-‘ভেতরে আয়।’

রিনিঝিনি ভেতরে ঢুকল। তারপর বলল,

-‘বড় মাকে দেখেছিস ভাইয়া?’

-‘বড় মা?’

তাহমীদ অবাক হলো পরক্ষণেই মাথায় ব্যাপারটা খেলে গেল। মাথা নেড়ে বলল,

-‘না রে দেখা হয়নি।’

-‘ওহ। জানিস ভাইয়া? বড় মা বড় চাচার এক্স ছিলেন।’

তাহমীদ ভ্রু কুঁচকে বলল,

-‘তুই এত খবর কোথায় পেলি?’

-‘ফুফু আম্মারা বলেছেন।’

-‘ওহ।’

রিনিঝিনি কিছুক্ষণ রুম জুড়ে পায়চারি করে বলল,

-‘এবার তুই একটা বিয়ে করে ফেল না রে!’

হাত ঘড়ি খুলতে খুলতে তাহমীদ বলল,

-‘কেন?’

-‘তোর রুমটা আমার কাছে কেমন ম’রা ম’রা লাগে। এই ম’রা রুমকে তাজা করতে হলেও একটা বউয়ের খুব দরকার।’

তাহমীদ হাসল। রিনিঝিনি ভাইয়ের সেই সুন্দর হাসির দিকে তাকিয়ে রইল। ভাইয়ার একটা বউ আসবে কবে সেটা নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই। ভাইয়ের বিয়ে দেওয়ার তার শখটা আরো বেড়েছে বড় চাচার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে। হুট করে এমন কেন লাগছে সে জানে না।

জরিনাকে গুনগুন করতে করতে রুমের সামনে দিয়ে যেতে দেখে রিনিঝিনি ডাক দিলো। জরিনা কাছে আসতেই বলল,

-‘কে এসেছে রে?’

-‘ইস্কুলের নতুন মেডাম।’

-‘ওহ। এখানে থাকবে?’

-‘হ, মনে তো হইল এহানেই থাকব।’

-‘বাচ্চা কাচ্চা আছে সাথে?’

-‘না, জোয়ান মাইয়া লাগে। বিয়া শাদি হইসে কিনা বলা যায় না। তবে বাইচ্চা নাই।’

-‘ওহ। আচ্ছা তুই খেয়াল রাখিস ওনার কিছু লাগে কিনা।’

জরিনা চলে যেতেই রিনিঝিনি দেখল তাহমীদ নেই। ওয়াশরুমের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে সে হতাশ হলো। আজও ভাইয়ের সাথে এই ব্যাপারে পাকাপোক্ত আলাপ হলো না।’

______________________________

জরিনা আপেল কা’ট’ছে। পাশেই রিনিঝিনির দাদী আশুরা খাতুন বসে আছেন। তার হাতে গয়নার বাক্স। একটু পরেই তিনি সব তার বড় ছেলের বউয়ের হাতে তুলে দিবেন। তার চোখেমুখে দ্বিধা স্পষ্ট। মাথায় স্বামীর কথা আসছে বারবার। তার এই চেহারা দেখে জরিনা আপেল মুখে দিয়ে বলল,

-‘তয় দাদী! এত্তডি হার আপনে না দিলেও পারেন। হুনছি আগের ঘর আছিল, বড়লোক বাড়ির বউ ছিল। গয়না গাটি কি কম জমায়ছে? আপনে আবার দিবেন, হুদায় সব লস যাইব। নিজের পুলার বউরে দিয়া দিব। আপনের বংশে তো থাকব না।’

আশুরা খাতুন আরো বেশি চিন্তায় পড়ে গেলেন। আসলেই তো! এই সব গয়না গাটি যদি বড় বউ সব তার আগের পক্ষের সন্তানকে দেয় তবে কি হবে? এগুলো তো চৌধূরী বাড়ির ঐতিহ্য। বহু বছর পুরোনো। এই এতদিনের যত্নে রাখা সব স্মৃতি যদি এভাবে বিলিয়ে দেয় বড় বউ!

রিনিঝিনি এসে দাদীকে বসে থাকতে দেখে তাড়া দিলো। আশুরা খাতুন বললেন,

-‘তুই যা আমি আপেল খাইয়া আসি।’

রিনিঝিনি চমকে উঠে বলল,

-‘আপেল? কোথায় আপেল?’

-‘এই তো!’

আশুরা খাতুন পাশ ফিরে দেখলেন খালি প্লেট আর ছু’রি পড়ে আছে টেবিলে। জরিনাকে আপেল কে’টে দিতে বলেছিলেন আর জরিনা সেই আপেল কে’টে আশুরা খাতুনকে না দিয়ে নিজেই সবটা খেয়ে চলে গেছে।

গোসলের পর রুমঝুমের সতেজ লাগছিল। আগের তুলনায় ক্লান্তি কিছুটা হলেও কমে তার। তবে আগে ক্ষুধা না লাগলেও এখন বেশ ক্ষুধা লাগল। কিন্তু এভাবে কি সে বলতে পারে যে তার ক্ষুধা লেগেছে?

ভাগ্য প্রসন্ন ছিল। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেতেই সে দরজা খুলে দেখল জরিনা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে খাবার খাওয়ার জন্য ডাক দিয়ে জরিনা চলে গেল। একটু সংকোচ লাগলেও রুমঝুম বের হলো রুম থেকে। ডাইনিং টেবিলে তখন বাড়ির সবাই কম বেশ উপস্থিত ছিল। আশরাফ চৌধূরী তাকে ডেকে রিনিঝিনির পাশে বসালেন। রিনিঝিনি রুমঝুমকে দেখে খুশি হলো। নিজেদের নামের কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়ায় হাসল। এমন অল্প সময়ে এভাবে সবার সাথে মিশে যেতে পেরে রুমঝুমেরও খুব ভালো লাগল।

খাওয়ার মাঝামাঝি সময়ে রিনিঝিনির মা বললেন,

-‘কিরে রিনি! তোর ভাইয়া কোথায়? এত দেরি করছে যে!’

-‘ওই তো আসছে ভাইয়া।’

রিনিঝিনি সিঁড়ির দিকে ইশারা করল। রুমঝুম কি মনে করে সেদিকে তাকালো। সেই ছেলেটা! উফ! কিছুক্ষণের জন্য সে ভুলেই গিয়েছিল ছেলেটার কথা। রুমঝুম অনুভব করল তার হুট করেই অনেক বেশি অ’স্ব’স্তি লাগছে। ইশ! এখানে আর এক মুহূর্ত বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না তার। সে উঠতে নিলেই রিনিঝিনি তার হাত চেপে ধরে। অবাক সুরে বলে,

-‘এই! কোথায় যাচ্ছো? খাবার শেষ করো। কিছুই তো খেলে না।’

তাহমীদের নজর পড়ল রুমঝুমের উপর। এমনকি সে কয়েক সেকেন্ড রুমঝুমের দিকে তাকিয়েই ছিল। ল’জ্জা আর অ’স্ব’স্তিতে তখন রুমঝুমের যাই যাই অবস্থা। আশরাফ চৌধূরী বললেন,

-‘ওহ রুমঝুম! ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই, আমার ছেলে তাহমীদ। তাহমীদ! ও রুমঝুম। স্কুলের নতুন মিস।’

তাহমীদ চেয়ার টেনে বসল। সরু চোখে রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে হালকা করে মাথা নেড়ে বলল,

-‘হ্যালো মিস!’

রুমঝুম কি বলবে বুঝতে পারল না। তার মাথায় আপাতত একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। ছেলেটা তাকে চিনতে পারে নি তো?

#চলবে।

ইনশিয়াহ্ ইসলাম।