এরই মাঝে পর্ব-০৯

0
108

#এরই_মাঝে
#পর্ব-৯

শায়লার প্রথম সেমিস্টার শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও সে বাড়ি যায়নি। টিউশনির অজুহাতে এড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে হাতে গোনা দুই একবার তৈয়ব মাওলানার সাথে কথা বলেছে। দাদার সাথে কথা বলতে না চাইলেও মহুয়া আর বিনার সাথে নিয়ম করে কথা বলে শায়লা। বোনদের পড়ালেখার খোঁজ নেয়, কিভাবে পড়বে সেই সাজেশন দেয়। মহুয়ার ইন্টার পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসছে। এরপর এ্যাডমিশন কোচিং। মহুয়া মেডিকেলের জন্য ঢাকায় কোচিং করতে চায়। শুনে শায়লা নিশ্চুপ থেকেছে। মেডিকেলের কথা শুনে ওইসময় কেন যেন রিদওয়ান এর কথা মনে হয়েছিল একবার। মনটা অকারণে তেতো হয়েছিল। চিন্তা ঝেড়ে ফেলে শায়লা। শুধু শুধু অচেনা একজনের জন্য ভেবে সময় নষ্ট করা কেন? কিন্তু মানুষ তো ভাবনা চিন্তা ছাড়া থাকতে পারবেনা। কারণে অকারণে এলোমেলো ভাবনা মন আচ্ছন্ন করে রাখে। রুম ফাঁকা পেলে শায়লা মাঝে মাঝে বিয়ের আংটিটা বের করে চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ। ও বাড়ির সাথে আর যোগাযোগ হয়নি। হঠাৎ হঠাৎ তার শশুর ফোন দিয়ে খোঁজ নেয়, যোগাযোগ বলতে এটুকুই। কিছুই তো পাল্টে যায় নি তাহলে কি দরকার ছিলো এই আনুষ্ঠানিকতার? শায়লা আপনমনেই বিরবির করে অভিযোগ জানায়।

ফোনটা বেজে যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে, শায়লা আনমনা হয়েই ফেন কানে ঠেকায়। ওপাশ থেকে তৈয়ব মাওলানার গলা ভেসে এলো-“শায়লা বু জান, তুমি বাড়ি আসবা না?”
কঠোর হৃদয়ের শায়লা স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো-“না দাদাজান, আপাতত বাড়ি যাব না। আমি যে বাচ্চাগুলোকে পড়াই ওদের পরীক্ষা চলছে।”
ডাহা মিথ্যে অজুহাত দেয় শায়লা। তৈয়ব মাওলানা গুম হয়ে গেলেন। ভারী কন্ঠে বললেন-“দাদা জানের উপর এতো রাগ?”
সহসা উত্তর দিতে পারেনা শায়লা। ঠোঁট কামড়ে আবেগ দমন করে-“না দাদাজান, রাগ করে নেই। সত্যিই বাচ্চাদের পরীক্ষা। ওদের পরীক্ষা শেষ হলে আসবো।”
“সত্যি বলতেছ তো?”
“সত্যি দাদাজান। আসবো আপনি ভাববেন না।”
হুট করে দু’জনেই চুপ করে গেল। তৈয়ব মাওলানা কিছু বলতে চাইছেন কিন্তু বলতে পারছেন না। শায়লা বললো-“আর কিছু বলবেন দাদাজান?”
“ওই বাড়ি থেকে ডাকলে যাইয় বুজান। মানা কইরো না তাদের। নতুন কুটুম, মানা করা খারাপ দেখাবে।”
শায়লা ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে৷ মৃদুস্বরে বিদায় নিলো-“রাখলাম দাদাজান, বের হবো এখন।”
নিঃশব্দে ফোন নামিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে। দাদাজান কেন ও বাড়ি যাওয়ার কথা বললো? কেউ কি কিছু বলেছে? সকালে তার শাশুড়ী মা ফোন করেছিল। ভদ্রমহিলা বেশ আদরের সাথেই তাকে বাসায় যাওয়ার দাওয়াত দিয়েছে। শায়লা হা না কিছু বলেনি। আসলে সে ভীষণ দ্বিধায় আছে যাবে কি যাবে না। ও বাড়ি গেলেই যদি ওই লোকটার মুখোমুখি হতে হয়? তাছাড়া অপরিচিত মানুষগুলোর সাথে সহজ হতে পারে না সে। শায়লা যাবে না বলে মনস্থির করলো।

*****

সকাল সকাল বন্ধুকে দেখে অবাক হলো আব্দুল রব-“দোস্ত, সব খবর ভালো? এতো সকালে আসলা যে? কোন সমস্যা?”
“তোমার সাথে কয়দিন দেখা নাই তাই দেখা করতে আসলাম। শরীর কেমন তোমার?”
“আছি কোনরকম। হাঁটুতে ব্যাথা বলে তোমার ওখানে যাওয়া হচ্ছে না কয়দিন। আমার বেয়াইন কেমন আছে?”
“আছে ভালো আছে।”
জবাব দিতে দিতে তৈয়ব মাওলানা বন্ধুর পাশের চেয়ারে বসলো। কাজের মহিলাকে ডেকে দুই কাপ চায়ের কথা বললো আব্দুল রব। তৈয়বকে চিন্তিত দেখাচ্ছে।
“কি হইছে কও দেখি?”
“মুকুল ফোন দিছিল। কে যেন খবর দিছে আমি শায়লা বুরে বিয়া দিছি তাই শুনে ফোন দিছে। সে বলে সে শায়লার বাপ তাকে না জানায় বিয়ে দিছি এইটা অন্যায় হইছে। বাপ ছাড়া বিয়া হয় না বলে। বাড়িতে আসতে চাইছে।”
গড়গড়িয়ে বলে গেলেন তৈয়ব মাওলানা। আব্দুল রবকে চিন্তিত দেখায়-“ওর এতদিন পরে মেয়েদের কথা মনে পড়ছে? কি আজব! আচ্ছা শোন, আসুক দেখি। কি বলে শুনি।”
“কিন্তু আমি চাই না ও আসুক। বউমার কষ্ট হয় ওকে দেখলে।”
আব্দুল রব চিন্তিত হয়ে বললো-“এতো বছর বউ বাচ্চা ফেলে আছে এখন হুট করে তাদের কথা মনে পড়ছে মানে কিছু একটা কারণ আছে। মুকুল যেমন মানুষ, ওর পক্ষে ভং ধরা সম্ঙব না।”
“চিন্তা তো ওই কারনেই। এইসব মানুষ হুট করে আসে জীবন এলোমেলো করে দিয়ে চলে যায়। আমি চাই না বাচ্চারা তাদের বাবার জন্য বিন্দুমাত্র কষ্ট পাক। ওদের কষ্ট দেখলে বউমা কষ্ট পাবে। তাছাড়া ওকে আমি ত্যাজ্য করছি। ও কেন আসবে?”
“ধর্মে তো ত্যাজ্য করার বিধান নাই বন্ধু। তুমি ওর সাথে সম্পর্ক রাখো না সেটা অন্য কথা। ও যদি তোমাকে বা বাচ্চাদের দেখতে আসতে চায় তাহলে তো ওকে বাঁধা দেওয়া যায় না।”
“আমার ভয় লাগে ও বাচ্চাদের হাত করার চেষ্টা না করে। রুবির কষ্ট দেখার কথা ভাবতেই নিজেকে অপরাধী লাগে। এখন শায়লাকে নিয়েও চিন্তা হয়। বিয়ে দিয়ে কি ঠিক কাজ করলাম?”
“ভরসা রাখো বন্ধু। এতো তাড়াতাড়ি উতলা হইয় না। আমার নাতি বলে বলতেছি না রিদওয়ান আসলেই ভালো ছেলে। শায়লা বু তার সাথে সুখে থাকবে।”
আব্দুল রব বেশ আত্মবিশ্বাসী সুরে বললো। তৈয়ব মাওলানা বন্ধুর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময়।
“তার জন্য তো দুইজনের দেখা সাক্ষাৎ হওয়া লাগবে। বিয়ের ছয়মাস গেলো ওদের দেখা হয় নাই একবারও। দেখা সাক্ষাৎ নাই, আলাপ নাই বিয়ে টেকা দূর দু’জনে ভাব হওয়ার চিন্তা হইতেছে আমার।”
“না হোক দেখা তাতে কি? আমরা তো ওদের সময় দিছি। দুইজনই ছাত্র, ওদেরও একটু সময় দাও। রিদওয়ান এর ফাইনাল ইয়ার শুরু হইছে আর শায়লার কেবল পড়ালেখা শুরু। এ যুগের ছেলেপেলে জোর করলে বিগড়ে যাইতে পারে। আমরা বরং ধীরে ধীরে ওদের ভাব করাবো।”
তৈয়ব মাওলানা কিছু বলতে যাবেন ফোন বাজলো। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে নাজনীন এর উত্তেজিত গলা পাওয়া গেলো-“আপনে কই? শিগগিরই বাড়িতে আসেন। মুকুল আইসা বউমার সাথে হাউকাউ করতেছে।”
“কি কও এইসব?”
তৈয়ব মাওলানা কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ায়।
“আমি আসতেছি।” বলে ফোন কাটলো।
আব্দুল রব বললো-“কি হইছে? কে ফোন দিছিলো?”
“মুকুল নাকি বাড়িতে বউমার সাথে চিল্লাচিল্লি করতেছে। আমি যাই।”
“কি কও? আচ্ছা চলো আমিও যাই।”
দুই বন্ধু লাঠি হাতে দ্রুত বেগে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।

*****

“বুবু, আব্বা আসছিল। মার সাথে অনেক রাগারাগি করছে।”
বিনা পাক্কা গোয়েন্দার মতো চুপিচুপি শায়লাকে ফোন দিয়েছে। শায়লা হাটছে টিউশনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। সে হাটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। বিনার কথায় ভরসা হয় না বলে শায়লা সন্দিহান হয়ে জানতে চাইলো-“কবে?”
“পরশুদিন। কে যেন আব্বাকে তোমার বিয়ের খবর দিছে। আব্বা আসছিল মার সাথে মেজাজ দেখাইতে। দাদাজানের সাথে খুব ঝগড়া হইছে।”
শায়লা মেজাজ হয়ে গেলো ফোরটি নাইন। সে দাঁতে দাঁত চেপে মেজাজ সংবরণ করলো-“কি বলছে মাকে?”
“দাদাজান আর মাকে বলছে তারা তোমাকে বিয়ে দেওয়ার কে? সে নাকি তোমার শশুরবাড়ি যাবে খোঁজ নিতে। আম্মা অনেক কান্না করছে। পরে দাদাজান আব্বাকে ঘর থেকে বাইর করে দিছে।”
শায়লা দাঁত কিড়মিড় করলো-“ওই লোকটাকে বারবার আব্বা আব্বা করতেছিস কেন বিনা? তোর ওই লোকটাকে বাপ ডাকার খুব ইচ্ছা? তাহলে ওনার কাছে চলে যা। আর কোনদিন যেন তোর মুখে আব্বা ডাক না শুনি।”
শায়লা ফোন কেটে দিলো। তার শরীরটা অসম্ভব জ্বালা করছে। মন চাইছে তার মাকে কথা শুনিয়ে যাওয়া লোকটাকে পাঞ্চিং ব্যাগের মতো ঘুসি মারতে। কতোবড় সাহস তার মাকে কথা শুনায়। যে লোক বউ বাচ্চা ফেলে আরেক মহিলাকে বিয়ে করে সে কিনা অধিকার দাবি করতে এসেছে। লোকটাকে একটা উচিত শিক্ষা দিতে হবে। শায়লার অনেক দিনের ইচ্ছে তাদের জীবনে লোকটাকে নিজের জায়গা দেখিয়ে দেওয়া। ভাবতে ভাবতে এলোমেলো পা ফেলে হাটে শায়লা। রাস্তা পার হতে গিয়ে আচমকা কেউ হাত ধরে টানলো-“মাথা নষ্ট নাকি আপনার? দেখে হাঁটেন না কেন? এখনি গাড়ির নিচে পড়তেন।”
নিজেকে সামলে নিয়ে সামলে তাকিয়ে রিদওয়ানকে দেখেই আবারও মেজাজ হারায় শায়লা-“আপনি! কাজ নেই আপনার? আমি যেখানে যাই সেখানেই আপনাকে পাই কেন? আমাকে দেখে রাখার জন্য বেতন দিচ্ছি নাকি আপনাকে? আমি মরলে মরবো তাতে আপনার কি? কেন আমাকে বাঁচালেন? বুঝতে পারছেন না আমি আপনাকে পছন্দ করছি না?”
রিদওয়ান চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। হতবাক কন্ঠে বললো-“আপনাকে দূর্ঘটনা থেকে বাঁচাতে আমাকে পছন্দ করতে হবে কেন? আর শুনুন, আপনার পিছু নেওয়ার ইচ্ছে বা সময় কোনটাই নেই আমার। নেহাত মানবতার খাতিরে আপনাকে বাঁচিয়েছি। আর সমস্যা কি আপনার? সেদিনের আগ পর্যন্ত তো ভালোই কথা বলছিলেন। ডাক্তার শোনার পর থেকে এতো ক্ষেপে গেলেন কেন? কোন ডাক্তারের কাছ থেকে ছ্যাকা খেয়েছেন নাকি?”
শায়লা তেড়ে এলো রিদওয়ানের সমুখে, আঙুল উচিয়ে বললো-“খবরদার বাজে কথা বলবেন না। আপনাদের মতো ছেলেদের সাথে প্রেম করবো এতো বাজে সময় আমার নেই। নিজেকে খুব আহামরি ভাবেন নাকি?”
“অবশ্যই আহামরি ছেলে আমি। আপনি জানেন আমার বোনের ননদ আমার পেছনে ঘুরঘুর করে কবে থেকে। আমিই পাত্তা দেই না ওকে।”
“পাত্তা দেন বা না দেন আমাকে এসব শোনাচ্ছেন কেন? এসব ফালতু প্যাচাল শোনার মতো সময় নেই আমার। ছেলে ডাক্তার মানেই এক একটা বড় লুচু। চোদ্দটা প্রেম চোদ্দটা বিয়ে না করলে হয় না এদের। আই জাস্ট হেইট ডাক্তার। বুঝেছেন? আর কখনো আমার সাথে কথা বলবেন না। আমার থেকে দূরে থাকবেন। আমি মরে গেলেও কখনো আমার কাছে আসবেন না।”
শায়লা ননস্টপ বকবক করে থামলো। রিদওয়ান এবার আসলেই হতবাক। মেয়েটার এতো রেগে যাওয়ার কারণ কিছুতেই বোধগম্য হলো না। প্রতিউত্তর দেবে সে সুযোগ দিলো না শায়লা। নিজের ক্ষোভ ঝেড়ে হনহনিয়ে হেঁটে চলে গেলো। রিদওয়ান হতবুদ্ধি হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।

চলবে।